।। ১ ।।
গরুমারার বুক চিরে গাড়ি ছুটছে হু হু করে। বাসের জানলার ধারে একা বসে জঙ্গলে চোখ রেখেছে সৌত্রিক। জঙ্গল জঙ্গল, কতরকম সবুজ, কত গাছ, কত জায়গায় গাছের পাতা ঝরে পড়েছে মাটির ওপর। দেখে যেন মনে হয় বড় নরম লাগবে ওই পাতার বিছানায় শুলে। এই তো মালবাজারে কী খটখটে রোদ ছিল, গাড়িতে ঢোকার পর মনে হচ্ছিল গরমে যেন সেদ্ধ হয়ে যাবে, কিন্তু বনের হাওয়ায় যেন নেশা লাগে, ঠাণ্ডা বাতাসে মনে হয় যেন ক্লান্তির প্রতিটা বিন্দু নিদ্রার চাদর বিছিয়ে জীবনকে জড়িয়ে ধরতে চায়। আবার বৃষ্টিও নামে বনের মাঝামাঝিতে। সে বৃষ্টির আমেজ ভিন্ন, সে বৃষ্টি হয় শুধু বনে, শুধু অরণ্যে, শুধু প্রকৃতির কোলে। প্রকৃতি যেন হেসে উঠে বলে, দেখলি তো আমি খুশি থাকলে তোর জন্য এক পৃথিবী বৃষ্টি নামাতে পারি, তোকে বাতাস দিতে পারি। অরণ্যের না-দেখা প্রান্তর থেকে কোনো সুন্দরী যেন আকুল হয়ে ডাকে তার বুকে। সেই ডাকে বুক ফাটে কিন্তু সাড়া দেবার ভাষায় মুখ ফোটে না। কিছুক্ষণ চলার পর ফিকে হয় জঙ্গল, শুরু হয় চা বাগান। চাবাগানের সবুজ চাদরের ওপাশে দেখা যায় ছোট ছোট বাড়ি। ওগুলো বোধহয় চাবাগানের শ্রমিকদের কিংবা হয়তো নয়, ওখানেও কি পৃথিবী এতটাই জটিল, নাকি কৃত্রিম গতানুগতিকতার নাগপাশ ছাড়িয়ে ওরা জীবনকে সহজ করে নিয়েছে তরতর করে বয়ে যাওয়া ঝকঝকে জলের পাহাড়ি নদীর মত? দুঃখ বেদনা কি ওদেরও পীড়া দেয় সেই শহুরে ইমারতি সংস্কৃতির মত?--না, দেয় না হয়ত। ওদের পৃথিবী ছোট্ট, একরত্তি বাচ্চার মত সরল। ওরা কষ্ট পেলে চিৎকার করে কাঁদে, আনন্দ পেলে হাসে, উৎসবে খায় আকন্ঠ হাঁড়িয়া, দিনের শেষে হয়ত আদর করে জড়িয়ে ধরে ওর আদিবাসী প্রেমিকাকে, তারপর নিশ্চিন্ত নিদ্রা। যে নিদ্রায় কোনো দুঃস্বপ্ন নেই, নেই মোবাইল ফোন বেজে ওঠার আতঙ্ক, নেই ভবিষ্যৎ নিয়ে অযথা চিন্তার বোঝা, নেই কিছু তৈরি করা সামাজিক প্রথা মেনে চলার ক্লান্তি। এসব ভাবতে ভাবতে মনটা কেমন যেন করে ওঠে। সেটা ঠিক ভয়-কষ্ট-লজ্জা-ঘেন্নার মত ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। যেন অনেকটা আফশোষের সাথে কিছুটা দুঃখ, কিছুটা ক্লান্তি, কিছুটা অবসাদের এক মিশ্রণ। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে শরীরের গোপনতম কোণ থেকে।
পকেটের মোবাইলটা আবার বাজতে শুরু করেছে। ভাবনার ওপর ভাবনা জুড়ে ঘনিয়ে ওঠা মনমেঘ কেটে গিয়ে বাস্তবের রৌদ্রে মনটা চিড়বিড় করে ওঠে। বিরক্ত লাগে এই মোবাইল যন্ত্রটাকে, জীবনের প্রতিটা মুহূর্তকে এই যন্ত্র দুর্বিসহ করে তুলছে। কখনও কখনও নীরবতা বড় প্রিয় হয়ে ওঠে, কিছু ব্যক্তিগত মুহূর্তে মন ভাবনার অতলে ডুব দিয়ে যেন সদ্যস্নাত পাখির মত গা ঝাড়া দিয়ে উঠতে চায়। সেই মুহূর্তগুলোতে এইসব যন্ত্রের কলকলানি বোধহয় মানুষের আয়ু কমিয়ে দিতে পারে, অন্তত সৌত্রিকের তাই মনে হয়। একটা আলস্য মেশানো বিরক্তি নিয়ে ফোনটা পকেট থেকে বের করে ও। রঞ্জনা ফোন করছে। কিছুটা অবাক লাগে সৌত্রিকের। একমাস তো কেটে গেছে বিচ্ছেদের পর। পরিষ্কার বিচ্ছেদ, তার মধ্যে ছিল না কোনো কাদা ছোঁড়াছুড়ি, ছিল না 'আমি ওকে ছাড়লাম না ও আমাকে ছাড়ল' গোছের প্রতিযোগিতা, ছিল না মুখদর্শন না করার প্রতিজ্ঞা। বড় সম্মানজনকভাবে বিচ্ছেদ করেছিল ওরা দুজনে। সেদিনের পর আর কথা হয়নি ওর সাথে। কেন হয়নি এ উত্তর নেই সৌত্রিকের কাছে। অথচ ওরা দুজনেই তো ভেবেছিল প্রেমের সম্পর্কটা না থাকলেও বন্ধুত্বটা থাকবে কিন্তু সেটা আর হয়নি। মালবাজার থেকে জলপাইগুড়িগামী সাড়ে তিনটের বাসটা ধরতে গেলেই মনে হত সমস্ত পৃথিবী যেন সর্বশক্তি দিয়ে টেনে রেখেছে সৌত্রিকের পা দুটো। ক্রমাগত মনে হত কি দরকার আবার দেখা হবার। দেখা হলেই তো মনে পড়বে পুরোনো সব কথা, গান-কবিতা-স্কুল-হাসপাতাল মেশানো অতিসাধারণ কিছু ঝ্যাওলঝ্যা লে আলোচনা, সে আলোচনায় জীবনের কিছু আসত যেত না কিন্তু জলপাইগুড়ির দূরত্ব যেন কমে যেত মাইলখানেক। প্রেম তো কোনো সরল সমীকরণ নয় যে সেটা ইচ্ছে হলে মিলিয়ে দেব বা ইচ্ছে হলে মেলাব না! দীর্ঘদিন একজনের সাথে থাকার ফলে শুধু সম্পর্ক তৈরি হয়না, তৈরি হয় এক দৈনন্দিন অভ্যেস। কিছু অপ্রয়োজনীয় কথা বলে ফেলার অভ্যেস, কিছু গোপনকথা ভাগ করে নেবার অভ্যেস, কিছুক্ষণ একসাথে হাত ধরে হাঁটার অভ্যেস, শারীরিক সংসর্গ করার অভ্যেস। এই অভ্যেসগুলো মানুষের ব্যক্তিত্ব, আত্মা, নিজস্বতা সবকিছুর সাথে মিশে একটা সম্পৃক্ত দ্রবণ তৈরি করে। সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসা অনেক সহজ কিন্তু সেই দ্রবীভূত অভ্যেসগুলো আলাদা করা বড় কঠিন। তাই সম্পর্ক ভাঙলে নিজের কিছু নিজস্বতা, নিজের অক্ষত আত্মার কিছু অতি কোমল অংশ চিরদিনের মত হারিয়ে যায়। একটা ক্ষত তৈরি হয়। গান-কথা-মদ-ছ্যাবলামি-উপদেশে একটা তাৎক্ষণিক আরাম হয় বটে কিন্তু ভেতরের ক্ষতটা একই রকম দগদগে থাকে। এ সত্য যতটাই ধ্রুব ততটাই যন্ত্রণার।
ফোনটা ধরল সৌত্রিক--হ্যালো। গলাটা স্বাভাবিক রাখার চেষ্টায় সেটা একটু বেশিই অস্বাভাবিক শোনালো যেন।
ওপাশের উত্তর আসল সেকেন্ড তিনেক পর--শোনো সৌত্রিক তোমার দেওয়া কার্ড, চিঠি, উপহারগুলো আমি তোমাকে ফেরত দিতে চাই। তুমি একদিন সময় দিয়ে ওগুলো নিয়ে যেও, ওগুলো রাখার দায় আর নেই আমার।
কথাটা শুনে সৌত্রিক আর উত্তর দিল না, ফোনটা কান থেকে নামিয়ে কেটে দিল ভাবলেশহীন ভাবে। আবার ফোন বাজল মিনিট দুই পর, রঞ্জনার। সৌত্রিক কেটে দিয়ে ফোনটা অফ করে দিল। অফ করার কারণটা ঠিক দুঃখ নয়। আসল কারণটা ভয়। ওর করা প্রেমের শেষপর্যন্ত একটা অতি সাধারণ, বস্তাপচা, অসফল পরিণতি হবে সেই ভয়। এসব উপহার ফেরত, ঘ্যানঘ্যানানি, ফেসবুকে ব্লক, ফোন এলে কেটে দেওয়া এগুলো খুব সাধারণ, খুব মধ্যবিত্ত, ফিল্মি, ক্লিশেড। সৌত্রিক তো নিজেকে এত সাধারণ ভাবেনি কোনোদিন। পড়াশোনা থেকে সঙ্গীত, সাহিত্য থেকে চলচ্চিত্র, দেশ থেকে রাজনীতি সব জায়গায় তো ওর সাবলীল বিচরণ ছিল চিরটাকাল। মননজগৎ জুড়ে জাল বুনত সুনীল-শক্তি কিংবা ঋত্বিক-মৃণাল-সত্যজিৎ। মধ্যবিত্ত মানসিকতার বিরুদ্ধে ওর জেহাদ ছিল চিরকালের। তাহলে কি এই সম্পর্কের ভাঙ্গন ওকে নামিয়ে আনল বাস্তবে? প্রমাণ করল মধ্যবিত্ত বাঙালিয়ানা একটা সামাজিক স্থিতি? কিছু মধ্যবিত্ত লোকের সাথে উঠে বসে খেয়ে প্রেম করে বিছানায় শুয়ে মধ্যবিত্ত, ট্র্যাডিশনাল, ভেতো বাঙালি ছাড়া আর কিছু হওয়া যায় না, খুব চেষ্টা করলেও যায় না। বড় ক্লান্তিকর এই চিন্তা। মাথাটা যেন চিন্তার ভারে বড় ভারী হয়ে গেছে, দুপাশ দিয়ে খানিকটা ব্যথাও করছে। চিন্তাটা থামানোর চেষ্টা করল সৌত্রিক। কিন্তু আজকাল চিন্তাগুলো যেন বড্ড লাগামছাড়া হয়ে গেছে, একটা ভাবনা যেতে না যেতেই যেন আরেকটা এসে জোটে অজান্তেই। না ঘুমানো অব্দি এই ভাবনানদীর বিরাম নেই। আঃ একটু শান্তি চাই, প্রশ্নহীন, চাহিদাহীন, চেতনাহীন শান্তি। বাড়ি ফিরে বেশ লম্বা ঘুম দেবার প্রতিজ্ঞা করল সৌত্রিকের মস্তিষ্ক।
।। ২ ।।
নটা থেকে আউটডোর শুরু হয়েছে হাসপাতালে। এখন বেলা গড়িয়ে প্রায় একটা। কিন্তু রোগীর বিরাম নেই। আউটডোর ঘরের দরজা থেকে শুরু করে সাপের মত ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে সে লাইন বোধহয় পৌঁছেছে কোনো অস্তিত্বহীন আদিম যুগে। সে লাইনের শেষ গরিব লোকটি ভুগছে চরম সংশয়ে। সে কী চিকিৎসা পাবে!পেলেও বা কতটুকু? তার গায়ে কি হাত দেবে ডাক্তার? নাকি আবার পাঠাবে এ ঘর থেকে ওঘরে, এলাইন থেকে ওলাইনে? গোটা দেশবাসীর যেন দম আটকে গেল লাইনে দাঁড়াতে দাঁড়াতে। স্কুল, অফিস, ট্রেন, বাস, কলেজ, ব্যাংক, হাসপাতাল, রেশন, নোটবন্দী, শুধু লাইন আর লাইন। যেন সীমাহীন কালসর্প জীবনকে জড়িয়ে ধরে শুষে নিচ্ছে প্রতি মানুষের ধৈর্যের শেষ বিন্দুটুকু। আউটডোর ঘরের ভেতরে সৌত্রিকও আস্তে আস্তে ডুবতে শুরু করেছে ক্লান্তিতে। রোগ-উপসর্গ-চিকিৎসা-ফলাফল এই চক্রাকারে চলা চিন্তার এক ক্লান্তি আছে। সে ক্লান্তির সিংহভাগ মানসিক। একটা সময়ের পর মস্তিষ্কের প্রতিটি কোষ বিদ্রোহ ঘোষণা করে, কিন্তু রোগী শেষ না করে ওঠার উপায় নেই। আউটডোরের শেষদিকে চিকিৎসা করার থেকে অনেক বেশি গুরুত্ব পায় আউটডোর শেষ করার দায়। ঠিক করে হয়তো চিকিৎসা দেওয়া যায় না সমস্ত মানুষকে। কেন যায় না এ প্রশ্নের উত্তর হবে বিভিন্ন। মানুষ দোষারোপ করবে ডাক্তারকে, ডাক্তার সরকারকে, সরকার ফের ডাক্তারকে। চক্রাকার এই ঘূর্ণিপথের ভুলভুলাইয়া চলছে, হয়ত চলবেও, কিন্তু তাতে লাইনের শেষ মানুষটির ভাগ্যের বা মানসিক স্থিতির কোনো পরিবর্তন হবে বলে মনে হয় না। আজকের মত কাজ গুছিয়ে এনেছে সৌত্রিক। পেটে খাবার পড়েনি অনেকক্ষণ, একটু বেশি ঘামছে যেন, একটা অবশ করা ঝিমঝিমে অনুভূতি চলছে। যেন মনে হচ্ছে সৌত্রিকের দেহটা শুধু ওখানে বসে আছে, যে রোগীদের জিজ্ঞেস করে চলেছে কিছু গতে বাঁধা প্রশ্ন, আর কলম দিয়ে লিখে চলেছে ওষুধ। আর আসল সৌত্রিক তার দেহ থেকে বেরিয়ে সহ্য করছে সমস্ত কষ্ট, ক্লান্তি, জীবনের ছোট ছোট হারের দুঃখ আর ব্যর্থ প্রেমের যন্ত্রণা।
--কি ওষুধ লিখছেন আপনি প্রতিদিন ডাক্তারবাবু?আচমকা মধ্যবয়সী একজন পুরুষের প্রশ্ন যেন ঘোর থেকে টেনে বের করে সৌত্রিককে।
--কেন কি হয়েছে?সংশয়াপন্ন গলায় জিজ্ঞাসা করে সৌত্রিক।
--কি হয়েছে মানে? আমি আজ সাতদিন ধরে লাইনে দাঁড়াচ্ছি অসুস্থ শরীরে, কালকে পাঠালেন ফিজিশিয়ানের কাছে, তার কাছে লাইন আরও লম্বা সে তো বলল আপনার ওষুধই চলবে, গায়ে হাত দিয়েও দেখেনি।
--দেখছি আমি দাঁড়ান, আপনার কটা রক্ত পরীক্ষা করা জরুরি।
--কিসের পরীক্ষা?লোকটির গলায় স্পষ্ট উত্তেজনা ও ক্ষোভের সুর।
সৌত্রিক দেখল, যে চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী এতক্ষণ তার পাশে বসে রক্তচাপ মাপছিল সে নেই। --আসুন আপনি বসুন, আমি দেখছি।
--কি দেখবেন আর আপনিই যদি দেখবেন তাহলে কেন কালকে আমাকে ওদিকে পাঠালেন? আর সাতদিন ধরে দেখাচ্ছি এতদিনে আপনার মনে হল রক্ত পরীক্ষার কথা? কেন আগে করাননি?
এ প্রশ্নের জবাব সেই লোকটিকে বোঝানো বড় কঠিন বলে মনে হল সৌত্রিকের। তারসাথে মাথাটাও একটু গরম হল বৈকি। --দেখানোর হলে দেখান, এত জবাব আমি আপনাকে দেব না।
--কেন দিবি না শুয়োরের বাচ্চা? শালা পাবলিকের টাকায় পড়ে সরকারি চাকরি করিস। লজ্জা করে না, কাজ না করে মাস গেলে হাত পেতে গাদাগাদা টাকা নিস। জবাব কেন দিবি না।
হিংস্র স্বরে একনাগাড়ে এই গালাগালি শুনে কিরকম অসহায় লাগে সৌত্রিকের, একটা ভয় আর নিরাপত্তাহীনতা চেপে বসে, মারবে নাকি? সৌত্রিক কোনমতে বলে--আপনি গালাগালি করছেন কেন?লাইনের পেছনের লোকেরাও মৃদুস্বরে প্রতিবাদ জানায়।
--আজ আমার সাতদিন জ্বর, কাজে যেতে পারছি না, বাগানের অবস্থা খারাপ, কাজে না গেলে পরিবারের লোক খাবে কি? আপনি খাওয়াবেন? আমার প্রাইভেটে দেখানোর সামর্থ নেই। হাসপাতালে ছাড়া কোথায় দেখাব?বলতে বলতে লোকটা একটু হাঁপিয়ে পড়ে যেন। চোখ ছলছল করে ওঠে।--একদিন হাসপাতালে এসে লাইনে দাঁড়িয়ে ডাক্তার দেখিয়ে, তারপর ওষুধ নিয়ে বাড়ি যেতে কতক্ষণ লাগে জানেন? ছ'ঘন্টা লাগে।ধরা গলায় কথাগুলো বলে লোকটা বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। পেছনের রোগীদের কেউ কেউ বলে ওঠে, 'দাদা রাগ করতেসেন ক্যান? দেখায়ে যান আরসেন যখন।’কিন্তু লোকটি এক মুহূর্ত না দাঁড়িয়ে বেরিয়ে যায়। একটা ভয়-লজ্জা-ক্ষোভ-অপমানে সৌত্রিকের মনটা তেতো হয়ে যায় এক নিমেষে। অনেক চেষ্টা করেও সৌত্রিক বুঝতে পারে না ওর এই গালাগালি খাবার সত্যিই কোন কারণ আছে কিনা। বাকি রোগীদের শেষ করে ধীরপায়ে ঘরে আসে সৌত্রিক। মাঝে মাঝে ওর বড় কাঁদতে ইচ্ছে করে। কিংবা খুব জোরে চিৎকার করতে। বিশেষ করে যখন মনে হয় জীবনের দুঃখ বা সমস্যাগুলো বুকের ওপর চেপে বসেছে, যেন বুকের আয়তন কমে গেছে অনেকটা, সেই দমবন্ধ সময়ে কাঁদলে বড় উপকার হয়, অন্তত তাই মনে হয় সৌত্রিকের। কিন্তু আজ অব্দি কাঁদতে পারেনি ও। এইসময় রঞ্জনার কথা ঘুরেফিরে মনে আসে বারবার। এই সময় ও থাকলে বেশ কিছু কথা বলে মনটা ফুরফুরে হয়ে যেত। একবার ফোন করবে নাকি ওকে, বলবে নাকি আজ ও যাবে সাড়ে তিনটের বাসে, জায়গা রাখবে জানলার ধারে, যেখানে বাতাবাড়ি থেকে উঠবে রঞ্জনা। না থাক। দরকার কি, ভেঙে যাওয়া সম্পর্ক নিয়ে হ্যাংলামি সৌত্রিক চৌধুরী করে না। সৌত্রিকের মস্তিষ্ক ওর হৃদয়কে যেন খুব কড়া হাতে শাসন করে দেয়। চিন্তার রেশ কাটিয়ে সৌত্রিক টের পায় বড্ড খিদে পাচ্ছে যেন। রঞ্জনা চলে যাবার পর থেকে সৌত্রিকের মাথা খিদে, ঘুম, ক্লান্তি, শরীর খারাপ লাগা এসব আলাদা করে বুঝতে পারে না যেন। সব মিলেমিশে একটা অস্বস্তিকর অনুভুতি হয়, সেটাকেই নিজের মত করে বুঝে নেয় ও। চেয়ার থেকে উঠে ক্যান্টিনে গিয়ে বসে। আজ আর বাড়ি যেতে ইচ্ছে করছে না, মনে হচ্ছে প্রকৃতির কোলেই কাটিয়ে দেবে জন্ম জন্মান্তর।
।। ৩ ।।
আজ বাসে বাড়ি ফেরার পথে মাঝ রাস্তায় নেমে পড়ে সৌত্রিক। আকাশ মেঘলা হয়ে উঠেছে, বৃষ্টি নামবে বোধহয়। ছাতা আনা হয়নি, ভালোই হয়েছে, একটু ভিজে নেবে বৃষ্টিতে। শেষ কবে বৃষ্টিতে ভিজেছে মনে পড়ে না সৌত্রিকের। এত নিয়মকানুন, রোগভোগ, সম্পর্ক, আশা-হতাশায় ঘেরা এই পৃথিবীতে সহজলভ্য জিনিসগুলোও দুর্লভ হয়ে গেছে রাতারাতি। মূর্তি নদীর দিকে যাবার রাস্তায় গাড়িঘোড়া কম থাকে। একটা সাইকেল ভ্যানে একাই উঠে বসে ও। ভ্যান এগিয়ে চলে ধীরে সুস্থে। বয়স্ক ভ্যানওয়ালা আপনমনে বকবক করে যায়। যেন কথা না বলতে পারার দমবন্ধ ভাবটা কিছুটা কাটিয়ে উঠতে চায়। তার কথা কেউ শুনছে কিনা তাতে তার বিশেষ কিছু এসে যায় না। পুজো এগিয়ে এসেছে, রাস্তার দুধারে মাঠের মধ্যে কাশফুল ফুটেছে ঝাঁকে ঝাঁকে। সাদা হয়ে যাওয়া মাঠটাকে মনে হচ্ছে যেন অবাস্তব, খানিকটা স্বর্গীয়। বেশ কয়েক বছর আগে এরাস্তায় যে নির্জনতা ছিল এখন তা আর নেই। কিছুদূর অন্তর রিসর্ট গজিয়েছে ট্যুরিস্টদের জন্য। মূর্তি নদীর কাছে নাকি একটা থ্রি-স্টার হোটেলও হয়েছে, খবর পেয়েছে সৌত্রিক। চলতে চলতে হঠাৎ থেমে যায় ভ্যানটা। একটি ছেলে দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার ধারে, একা। পরনে একটা জিন্স, টিশার্ট, চোখে রেব্যানের সানগ্লাস, দেখেই মনে হয় বেশ দামি, গলায় ডিএসএলআর ক্যামেরা, মাথায় টুপি। ভ্যান থামতেই লাফিয়ে উঠে বসে সৌত্রিকের পাশে। ভ্যানওয়ালাকে চেঁচিয়ে বলে, 'চলো কাকা।’কিছুটা বিরক্তই লাগে সৌত্রিকের। এসব লাফাঙ্গা মার্কা পোশাক আর কথাবার্তা বিশেষ পছন্দ করে না সৌত্রিক। আড় চোখে একবার ছেলেটার মুখ দেখার চেষ্টা করে তারপর চুপচাপ প্রকৃতির দিকে মনোযোগ দেয়। 'দাদা কি বেড়াতে এসেছেন নাকি?' লাফাঙ্গাও এবার কথা বলতে শুরু করেছে। বিরক্তিকর। ভদ্রতার খাতিরে সৌত্রিক বলে, 'না আমি এদিককারই, এই একটু সময় কাটাতে যাচ্ছি।''এদিকে মানে? বাড়ি কোথায় আপনার?' 'আমার বাড়ি জলপাইগুড়িতে', সৌত্রিক বলে। 'বাঃ সেতো খুবই ভালো জায়গা শুনেছি, তা এদিকে কি সূত্রে?' এই সময় সৌত্রিক খেয়াল করে শুরুতে যতটা বিরক্ত লাগছিল এখন আর কথা বলতে ততটা খারাপ লাগছে না। বরং এই উদ্দেশ্যহীন বাক্যালাপ ভালোই লাগছে। 'আমি এখান থেকে একটু দূরে মালবাজারে চাকরি করি।' 'বলেন কি দাদা। জলপাইগুড়িতে বাড়ি, মালে চাকরি করেন, ডুয়ার্সে থাকেন, আপনি তো সুখী মানুষ।' লাফাঙ্গার এই কথায় মৃদু হাসে সৌত্রিক, বলে, 'আর আপনি? বেড়াতে নাকি?' 'একদম, আমি বিশুদ্ধ বেকার।বাবার পয়সায় খাইদাই ঘুরিফিরি, দেখুন আমার কী ছিরি, দিনে করি নেশাগিরি, রাতে আয়েশে ঘুমাই।'বলে নিজে নিজেই হা হা করে হাসে লাফাঙ্গা। সৌত্রিকও একথায় না হেসে পারেনা। লাফাঙ্গা বেকার হলেও বড় সরেস ছেলে। নাহলে সত্যজিতের গানকে গড়েপিটে এরকম নিজের মত করে নেবার ভাগ্য আর কজনের হয়? 'তা আপনি কি সত্যজিৎ রের ফ্যান নাকি?'হাসতে হাসতেই জিজ্ঞাসা করে সৌত্রিক। 'আপনি তো বড় ঘোড়েল লোক দেখছি, রায়কে স্টাইল করে 'রে' বলেন'--লাফাঙ্গার স্বরে কৌতুক। সৌত্রিক হেসে বলে 'আমিও রায়ই বলতাম, কিন্তু 'ঘরে বাইরে' দেখার পর 'রে' বলি।’লাফাঙ্গা খানিকটা সময় নেয় ব্যাপারটা বুঝতে, তারপর বলে 'ও বুঝেছি ঘরে by Ray বলতে চাইছেন।’ 'নিঃসন্দেহে,' বলে সৌত্রিক। কথাবার্তা বড় জমে উঠেছে। ভ্যান পৌঁছেছে মূর্তি নদীর ধারে। 'চলুন নদীর ধারে গিয়ে একটু বসি'--লাফাঙ্গার কথায় রাজি হয়ে গেল সৌত্রিক। 'দাঁড়ান দুটো বিয়ার নিয়ে আসি, আপনার চলে তো?' বিগলিত মুখে সম্মতি জানিয়ে মানিব্যাগ বের করে সৌত্রিক। 'আরে আপনি আবার পয়সা কি বের করছেন, আপনাকে বললাম না আমার সব বাবার পয়সা, তাই খরচ করতে দুঃখ নেই, রাখুন রাখুন।' সৌত্রিক কি বলবে ঠিক বুঝে পায় না। খানিক দূরে দোকান থেকে দুটো বিয়ারের বোতল নিয়ে নদীর ধারে বসে সৌত্রিক আর লাফাঙ্গা। 'তা কি বলছিলেন যেন, আমি সত্যজিতের ফ্যান কিনা?' টক করে বিয়ারের বোতলের ছিপি খুলতে খুলতে লাফাঙ্গা জিজ্ঞাসা করে। 'হুঁ' বিয়ারে চুমুক দিতে দিতে আওয়াজ করে সৌত্রিক। 'ঠিক সত্যজিৎ না, আমি এই সিনেমা জিনিসটারই বিরাট ফ্যান। মানে বিদেশী সিনেমা নয়, আমি আমাদের দেশী মানে খাঁটি ভারতীয় সিনেমার বিরাট ফ্যান।' খানিক অবাক হয় সৌত্রিক। 'সেকি! তার মানে আপনি নোলান, স্পিলবার্গ, টারান্টিনো, স্কোরসেসে এসব দেখেন না?' 'না দেখি না।' নির্দ্বিধায় জবাব দেয় লাফাঙ্গা। 'কেন?' সৌত্রিকের প্রশ্নে বিয়ারে লম্বা চুমুক দিয়ে লাফাঙ্গা বলে,'কারণ আমি তারসাথে আমার জীবনের কোনো মিল পাইনা। নোলান বা স্পিলবার্গের কল্পবিজ্ঞান দেখার জন্য আমেরিকা বা বিদেশ দেখাটা বাধ্যতামূলক হয়ে যায়। আমার মনে হয় আমার কল্পবিজ্ঞান আমার বাড়ির পাশের ছাপোষা, ভেতো, ট্রাডিশনাল, মধ্যবিত্ত বাঙালিকে ঘিরেই হবে। অনেকটা 'বঙ্কুবাবুর বন্ধু'র মত।' এতটা শুনে সৌত্রিক বলল 'কিন্তু সেরকম সিনেমা বা গল্প হচ্ছে কোথায়? সেই শঙ্কুতেই তো সব আটকে গেছে।' 'কে বলেছে হচ্ছে না? যেকোনো ছোটদের শারদীয়া পত্রিকা খুলে দেখুন দিব্যি কল্পবিজ্ঞান লেখা হচ্ছে, শীর্ষেন্দুবাবু লিখছেন, 'পাতালঘর' সিনেমা হয়েছে। আসল কথাটা তা নয়, আসলে আপনি নিজে শঙ্কুতে আটকে গেছেন। নতুন লেখকদের বা পরিচালকদের চান্সই দিচ্ছেন না।' লাফাঙ্গার কথায় ক্ষুণ্ন হলেও বড় কোনো ভুল দেখতে পেল না সৌত্রিক। 'কল্পবিজ্ঞান নাহয় গেল কিন্তু ড্রামা, অ্যাডভেঞ্চার, থ্রিলার, হরর, ফ্যান্টাসি সবেতেই তো বিদেশ এগিয়ে।' একথা শুনে মুচকি হাসে লাফাঙ্গা। 'এখানেই তো সমস্যা দাদা, ভারতীয় সিনেমাতে এই আলাদা আলাদা ভাগ যোগের সমীকরণ ছিলই না কোনোদিন। আমাদের সিনেমা তো সব মেশানো। একটা সিনেমাতেই রোমান্স, অ্যাকশন, গান, থ্রিল, ড্রামা, নেকুপুশু মার্কা ডায়লগ, ওভার-এক্টিং, বাজে এক্টিং, সব মেশানো একটা খিচুড়ি। সেখানেই তো চরম এন্টারটেনমেন্ট। ভাবুন তো ডিডিএলজের শেষ দৃশ্য নিয়ে আপামর ভারতবাসীর কী পরিমাণ উন্মাদনা ছিল, কিংবা রাজ কপূরের 'আওয়ারা', যার গান 'আওয়ারা হুঁ'-তে মেতেছিল আসমুদ্রহিমাচল। কিংবা সত্যজিতের গুপি বাঘা সিরিজের সেইসব মিউজিক্যাল ম্যাজিক, 'মহারাজা তোমারে সেলাম। সেলাম, সেলাম, সেলাম। আহাহাহা।'লাফাঙ্গার কথার ভঙ্গিমায় আর গানের সুরে কেমন ভুস ভুস করে হাসি বেরিয়ে আসে সৌত্রিকের। লাফাঙ্গার গানের গলাটা বড় ভালো। খানিক হেসে বিয়ারে চুমুক দিয়ে সৌত্রিক বলে, 'হোয়াট এবাউট রে'স আদার ফিল্মস, লাইক 'নায়ক' অর 'কাঞ্চনজঙ্ঘা'? অর ঋত্বিক ঘটক'স ফিল্মস লাইক 'অযান্ত্রিক'? খানিক উত্তেজিত হয়ে প্রশ্ন করে সৌত্রিক। টিপ টিপ করে বৃষ্টিটা শুরু হয়ে এখন বেশ জোরে পড়ছে। সেদিকে খেয়াল নেই সৌত্রিকের। ভিজে যাচ্ছে ওর শরীর, দামি জামা প্যান্ট। মূর্তি নদীর জলে বৃষ্টির আওয়াজ কেমন স্বর্গীয় রিমিঝিমি শব্দবিন্যাস সৃষ্টি করছে। যেন কোনো নামজাদা উস্তাদজীর বাজানো সেতারের ঝালা। একটু সময় নিয়ে লাফাঙ্গা বলে 'ওগুলো ভারতে বানানো সিনেমা, কিন্তু ইন্ডিয়ান সিনেমা নয়।''হোয়াট?' একটা অদ্ভুত অবিশ্বাস গলায় ফুটিয়ে খানিকটা চিৎকারই করে ওঠে সৌত্রিক। লাফাঙ্গা ঢকঢক করে বেশ খানিকটা বিয়ার গলায় ঢেলে বলে,'ইয়েস স্যার, ইউ হার্ড মি কারেক্ট। সিনেমা বাংলায় বানানো, পশ্চিমবঙ্গে বানানো, পশ্চিমবঙ্গ ভারতের অঙ্গরাজ্য এই প্রত্যেকটা কথাই সত্য, কিন্তু সিনেমাটি ভারতীয় সিনেমা নয়, দ্যাটস হোয়াই দে কল দেম 'প্যারালাল সিনেমা, আসল কথাটা বুঝুন, ভারতীয় সিনেমা একটা সেপারেট জঁর।'লাফাঙ্গার কথায় হাসবে না কাঁদবে বোঝেনা সৌত্রিক। 'তারমানে আপনি বলছেন, এই বস্তাপচা বালের গান, আর বালের মেলোড্রামা না হলে ভারতীয় সিনেমা হবে না। সবাই এগিয়ে যাবে আর আমরা এখনো সেই শিল্পহীন কিছু জঞ্জাল বানিয়ে যাব।'সৌত্রিকের ঝাঁঝালো প্রশ্নে লাফাঙ্গার গলায় সতর্কতা, 'নাও বি কেয়ারফুল স্যার। ভারতীয় সিনেমা যদি শিল্পহীন জঞ্জাল হয় তাহলে, 'মাদার ইন্ডিয়া', 'শোলে', 'লগান', 'থ্রি ইডিয়টস', 'রঙ দে বাসন্তী', 'তারে জমিন পর', মায় 'দঙ্গল' পর্যন্ত জঞ্জালের দলে পড়বে। এগুলো কোনটাই জঞ্জাল নয়, আবার নাক মুখ কুঁচকে দেখার মত সমান্তরাল চলচ্চিত্রও নয়। এগুলো হল খাঁটি শিল্প যেখানে গোটা সিনেমাতে ভারতীয় সিনেমার সমস্ত বৈশিষ্ট আগাপাশতলা প্রকাশ পেয়েছে। গান আছে, নাচ আছে, মস্তি আছে, দুঃখ আছে,'এতটা বলে তৃপ্তির হাসি হাসে লাফাঙ্গা, ‘আসলে কি জানেন তো ইন্ডিয়ান সিনেমার ফরম্যাটের ওপর কিছু নির্ভর করছে না, নির্ভর করছে আপনি কি বানাতে চাইছেন, জঞ্জাল না শিল্প।'লাফাঙ্গার যুক্তিটা অনিচ্ছা সত্ত্বেও মেনে নিতে হয় সৌত্রিককে। তারসাথে ছেলেটার প্রতি বেশ একটা ভালোলাগা জেগে ওঠে মনে, খানিকটা হিংসেও হয়। ছেলেটা বেকার, নিজেই স্বীকার করেছে যে এখনো বাবার পয়সায় খায় অথচ মাথার ভেতর যুক্তিগুলো কী অসম্ভব পরিষ্কার, গানের গলাটি অপূর্ব, আবার বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞানও রয়েছে। নিজের সাথে ছেলেটার খানিক তুলনা করে সৌত্রিক। ও নিজে ডাক্তার, এখন চাকরি করে, মাইনেও ভালো ফলত বাবার পয়সায় খাবার কোনো প্রশ্নই নেই। অর্থাৎ বাঙালির বস্তাপচা মানসিকতায় সৌত্রিক চৌধুরী একজন সফল মানুষ। কিন্তু এই সাফল্যের সিঁড়ি চড়তে চড়তে মাথার যে পেছন মারা গেছে তার বেলা! মনের সমস্ত কোমলতা, শিল্প, ইচ্ছে অনিচ্ছে সবকিছুর সাথে ক্রমাগত আপোষ করে এই বেঁচে থাকা বড় যন্ত্রণাদায়ক, বড় কঠিন। বাবা মা, প্রেমিকা, পরশ্রীকাতর সমাজ এদের জন্য সৌত্রিক এইসব করে চলেছে, জোর করেই করে চলেছে, কিন্তু নিজের জন্য কি করছে? সৌত্রিকের মনে পড়ে 'জিন্দেগি না মিলেগি দোবারা' সিনেমার একটা দৃশ্যের কথা, যেখানে দীর্ঘদিন পর ইমরানের সাথে দেখা হয়েছে তার বাবা সালমান হাবিবের, তিনি পেশায় নামজাদা শিল্পী। ইমরানের কাছে তিনি জানতে চেয়েছেন যে সে কি করে? ইমরান জবাবে বলেছে, সে লেখে। কি লেখে প্রশ্নের জবাবে ইমরান বলে, সে একটি বিজ্ঞাপন সংস্থার জন্য লেখে। এরপরই সালমানের মুখে ছিল সেই তাৎপর্যপূর্ণ প্রশ্ন 'আপনে লিয়ে ভি কুছ লিখতে হো?' সালমানের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন নাসিরউদ্দিন শাহ। মিনিট পাঁচেকের উপস্থিতি, খানকয়েক ডায়লগেই বুঝিয়েছিলেন নিজের অভিনয়ের অনবদ্যতা। লাফাঙ্গা ঠিকই বলেছে সব ভারতীয় সিনেমা খারাপ নয়। আপনি তো একেবারে চুপ মেরে গেলেন দাদা। কি এত ভাবছেন? লাফাঙ্গার প্রশ্নে মৃদু হাসে সৌত্রিক। কথায় কথায় সময় পেরিয়ে গেছে অনেকটা। সন্ধে ঘনিয়ে আসছে পাহাড়ের কোল বেয়ে। ডুয়ার্সে সন্ধে নামে ঝুপ করে, অন্ধকারের চাদর মুড়ি দিয়ে ক্লান্ত প্রকৃতি, যেন অবসর নিতে চায় আরেকটা বয়ে যাওয়া দিন থেকে। বৃষ্টির তোড় বেড়েই চলেছে, ভিজছে সৌত্রিক, ভিজছে ওর অন্তঃকরণ, আর ওর পাশে বসে ভিজছে লাফাঙ্গা-মার্কা একটা ছেলে যে বাবার পয়সায় খায়। সন্ধে নামতেই বেড়ে গেছে নদীর জলের শব্দ, কলকল শব্দে প্রতিটি জলবিন্দু যেন নিজেদের মধ্যে অজানা ভাষায় মেতেছে কোনো আলোচনায়। কী বলছে তারা? আরেকটা বিয়ার চলবে নাকি? লাফাঙ্গা জিজ্ঞেস করে। সৌত্রিক বলে খেতে পারি, কিন্তু এবার আমি দাম দেব। আপত্তি নেই তাতে। সৌত্রিকের কাছ থেকে টাকা নিয়ে আরো দুবোতল বিয়ার নিয়ে আসে লাফাঙ্গা। ফেনাওঠা বিয়ারে চুমুক দিয়ে সৌত্রিক বলে, 'তা আপনি বৃষ্টিতে ভিজছেন ঠিক আছে, কিন্ত আপনার দামি ক্যামেরাটা যে ভিজছে, ক্ষতি হবে না?'সৌত্রিকের প্রশ্নে লাফাঙ্গা হেসে বলে, 'হলে হবে, আরেকটা কিনব।'সৌত্রিক খানিক অবাকই হয় এই গাছাড়া হাবভাবে। 'তা ওটাকি শুধু ঝুলিয়েই রাখা হয়, না কাজেও লাগানো হয়?'সৌত্রিকের প্রশ্নে লাফাঙ্গা বলে, 'কাজে লাগানোর জন্যেই তো আনা, আমি আসলে ডুয়ার্স নিয়ে একটা ডকুমেন্টারি করার তালে আছি। এইদিককার মানুষজন, আদিবাসী, লোকসঙ্গীত, লোকনৃত্য, ইতিহাস এসব নিয়ে খুব বেশি কাজ হয়নি। তারসাথে ইচ্ছে আছে বৈকুণ্ঠপুর রাজবাড়ির অতীতটা ঘেঁটে দেখার। কুচবিহারের রাজবাড়ি, রাজা, গায়ত্রীদেবী নিয়ে অনেকে অনেককিছু জানেন। কিন্তু জলপাইগুড়ির রাজবাড়ি সেই তুলনায় অনেকটাই মলিন।’'তা আপনি কি একাই বানিয়ে ফেলবেন নাকি? আপনার সাথে লোকজন কোথায়? ডকুমেন্টারি বানানো তো বেশ কঠিন কাজ, রিসার্চ করতে হবে রীতিমত।’সৌত্রিকের কথায় মাথা ঝাঁকিয়ে সন্মতি জানায় লাফাঙ্গা। 'আমি ঠিক কাজ শুরু করার জন্য আসিনি, কোথায় কিভাবে কাজ করব, কয়েকটা ভালো স্পট আগে থেকে ঠিক করে রাখা, এদিকে কেউ এসব নিয়ে কাজ করছে কিনা বা আগে কতটা কি কাজ হয়েছে এসব নিয়েই জানার জন্য ঘুরে বেড়াচ্ছি।' 'তা কি বুঝলেন দেখেশুনে?' সৌত্রিকের প্রশ্নে বিয়ারের বোতলে চুমুক দিয়ে হাসে লাফাঙ্গা। 'কাজ যে একদম হয়নি তা নয়। উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশকিছু বইপত্র পেলাম, জলপাইগুড়ি জেলা গ্রন্থাগারেও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ নথি এবং ছবি রয়েছে। কিন্তু সবটাই বড় এলোমেলো। বিষয়গুলো আরও গুছিয়ে নেওয়া দরকার।’সন্ধে ঘনিয়ে রাত নেমেছে পায়ে পায়ে। ঘড়ির কাঁটায় ছটা দশ। আলো জ্বলে উঠেছে হোটেল আর রিসর্টগুলোতে। সৌত্রিকের সচেতন মস্তিষ্ক ওকে স্মরণ করিয়ে দেয় এবার ফিরে না গেলে শেষ বাসটা মিস করবে, বাড়ি ফেরা হবে না আজ রাতের মত। জামাকাপড় বৃষ্টিতে ভিজে চুপচুপ করছে। 'দাদা কি ওঠার প্ল্যান করছেন নাকি?' লাফাঙ্গা প্রশ্ন করে। 'হ্যাঁ বস এবার উঠব ভাবছি।এখন না গেলে শেষ বাসটা আর পাব না।‘'তা বেশ তো বিয়ারটা তো শেষ করবেন নাকি?' সৌত্রিক হেসে ঢকঢক করে শেষ করে বিয়ারটা। লাফাঙ্গা যেন খানিক বিষণ্ণ হয়ে পড়ে সৌত্রিকের এই তাড়া দেখে। ‘আপনি কোনোদিন ভবঘুরে জীবন কাটাননি, তাই না দাদা?' লাফাঙ্গার প্রশ্নে সৌত্রিক হেসে বলে 'প্রয়োজন পড়েনি কখনও।' 'ভগবানের আশীর্বাদে আপনার প্রয়োজন পড়বেও না কখনও।’হেসে ওঠে সৌত্রিক, এবার বিদায় নেবার সময় এসেছে। লাফাঙ্গার সাথে কথা বলে আজ অনেকটা ভালো লাগছে সৌত্রিকের। মাঝে মাঝে আড্ডা না দিলে জীবনের সমস্যাগুলো চেপে বসে মাথার ওপর। সৌত্রিক বসেজুতোটা খুলে জল ঝেড়ে নেয়। মাথার ভেজা চুলগুলো ঠিক করে নেয়। কিন্তু উঠতে গিয়ে বোঝে নেশাটা আজ যেন বড় বেশিই লেগেছে। খালিপেটে থাকার জন্য নাকি? লাফাঙ্গা বুঝতে পেরে এগিয়ে এসে ধরে উঠিয়ে দেয় সৌত্রিককে। সৌত্রিক হেসে বলে,'থ্যাঙ্কস।’বিদায়ের মুহূর্তে সৌত্রিক করমর্দন করে লাফাঙ্গার সাথে। বলে, 'আপনার সাথে কথা বলে আজ বড় ভালো লাগল দাদা, আপনার চিন্তা ভাবনার আমি সত্যিই প্রশংসা করি--' শেষদিকে কথা কিছুটা জড়িয়ে গেল সৌত্রিকের। 'তা আপনার নামটা, আপনার সাথে তো পরিচয়ই হয়নি।’সৌত্রিকের কথায় লাফাঙ্গা মুচকি হাসে, মাথা থেকে ভেজা টুপিটা খুলে নেয়, রাতেরবেলা অকারণে পরে থাকা সানগ্লাসটাও খোলে এবার, রেব্যানের সানগ্লাস। হাত বাড়িয়ে সৌত্রিকের দিকে এগিয়ে আসে বলে, 'দাদা আপনি আমাকে লাফাঙ্গা নামেই ডাকতে পারেন, যদিও আমার নামটা আপনি জানেন, আমি সৌত্রিক চৌধুরী, বাবার পয়সায় খাইদাই ঘুরিফিরি, দেখুন আমার কী ছিরি, আমি দিনে করি নেশাগিরি, রাতে আয়েশে ঘুমাই।’
তড়িতাহতের মত পিছিয়ে আসে সৌত্রিক, এই লোকটার নামও সৌত্রিক চৌধুরী। নেশার ঘোরে কি ভুল শুনছে নাকি? এমনসময় আকাশে বিদ্যুৎ চমকে ওঠে,পরপর,দুবার। আলোর ঝলকানিতে সৌত্রিক দেখে ওরই মত সেই এক নাক, এক মুখ, একই রকম চুল ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছে আরেকজন সৌত্রিক চৌধুরী, যে বাবার পয়সায় খায়। মিথ্যে নয়, নেশা নয়, ভ্রম নয়, সত্যি; একেবারে জলজ্যান্ত সত্যি, দিনের আলোর মত সত্যি। কাঁপা কাঁপা গলায় সৌত্রিক বলে, আর কি আমাদের দেখা হবে? একথা শুনে হাসে লাফাঙ্গা। ‘নিশ্চয়ই হবে, কেন হবে না? আপনি চাইলেই হবে। আজ বিগত একমাস ধরে তো হচ্ছে দেখা। মূর্তি নদীর দিকটায় চলে আসবেন সময় করে। আমি রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকব। কাঁধে থাকবে ব্যাগ, চোখে রেব্যানের সানগ্লাস, মাথায় টুপি, গলায় ডিএসএলআর। আজ সিনেমা নিয়ে আলোচনা হল, এর পরদিন প্রেম নিয়ে কেটে যাবে আমাদের সন্ধ্যা।’ কেমন ভালোলাগা পেয়ে বসল সৌত্রিককে। এই অসম্ভব জটিল পৃথিবীতে একজন অন্তত লোক ওর সাথে সময় কাটাতে ইচ্ছুক ভেবে কেমন শিশুসুলভ পুলকে জেগে উঠল মনের সমস্ত অণু পরমাণু। লাফাঙ্গা ওর সামনে দাঁড়িয়ে মুচকি হাসল। ‘আজ তাহলে এগিয়ে যান, ছটা কুড়ির শেষ বাস মাল থেকে রওনা হয়ে গেছে, আর কিছুক্ষণের মধ্যেই বেরিয়ে যাবে। হ্যাঁ ফিরতে হবে, আবার ফিরতে হবে বাস্তবে, ফিরতে হবে ক্লান্তির দুনিয়ায়। দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে সৌত্রিকের গভীরতম অন্তঃস্থল থেকে। সৌত্রিক লাফাঙ্গাকে বলে, ‘আজ তাহলে আমি আসি।’ লাফাঙ্গা ফিল্মি কায়দায় হাত নেড়ে বলে ‘আদিওস আমিগো’, বিদায় বন্ধু। আর দাঁড়ায় না লাফাঙ্গা, মিলিয়ে যায় মূর্তি নদীর ওপর ঘনিয়ে ওঠা অন্ধকারে। সৌত্রিক হাঁটা লাগায় বেশ জোরে। বাসটা কি পাবে ও? কেন পাবে না, নিশ্চয়ই পাবে, জোরে হাঁটা লাগালেই পাবে। নেশার ঘোরটা খানিক কমে আসে সৌত্রিকের।
।। ৪ ।।
‘আস্তে আস্তে, সৌত্রিক, প্লিজ। আমি খুলে দিচ্ছি তো, ছিঁড়ছ কেন? আমি ফিরব কি করে? তুমি এখনও ব্রার হুক খুলতে শিখলে না, বাবু প্লিজ এরকম কোরো না। আমায় একটু সময় দাও।’ মিলনের আগে রঞ্জনার এইসব কাকুতিমিনতি পাগল করে দিত সৌত্রিককে। যত ও এসব বলত সৌত্রিক তত পাশবিক হয়ে উঠত। বিগত দুবছরে ওর যে কত চুড়িদার আর ব্লাউজ সৌত্রিক ছিঁড়েছে বিছানায় তার গোনাগুনতি নেই। রঞ্জনা মুখে যাই বলুক না কেন, মনে মনে পছন্দ করত সৌত্রিকের এই আগ্রাসন। নিজের আর ওর সমস্ত পোশাক খুলে সৌত্রিক আদর করত রঞ্জনাকে। ওর কপাল, চোখ, গাল, ঠোঁট, স্তন, নাভি, উরু, যোনিতে অবাধে বিচরণ করত সৌত্রিকের জিভ। সলজ্জ রঞ্জনা সৌত্রিকের হাতে নিজেকে সঁপে দিয়ে প্রাণপণে চেষ্টা করত মুখে কোন আওয়াজ না করবার, কিন্তু সৌত্রিকের বেপরোয়া আদরে ওর মুখ থেকেও বেরিয়ে আসত শীৎকার ধ্বনি। রঞ্জানার গোটা শরীরের প্রতি রোমকূপে তীব্র আশ্লেষে আদর ঢেলে দিতে চাইত সৌত্রিক। সবথেকে বেশি আদর করত ওর বুকে। ইচ্ছে হত রঞ্জনার দুটো সুগঠিত স্তন আর বিভাজিকাকে ক্ষতবিক্ষত করার। কতবার সৌত্রিক ওর বুকে দাগ করে দিয়েছে। আদর পেয়ে বিছানায় সাবলীল হয়ে উঠত রঞ্জনাও। তীব্র আকর্ষণে জড়িয়ে ধরত সৌত্রিককে, চুমু খেতে খেতে হাত দিত সৌত্রিকের সুকঠিন লিঙ্গে, আদর করত চোখ বন্ধ করে। তারপর হত মিলন। ওর সাথেই তো প্রথম শারীরিক সংসর্গ করেছে সৌত্রিক। প্রথমদিন ওকে ছোঁয়ার পরই বীর্যস্খলন হয়েছিল সৌত্রিকের, লজ্জা পেয়েছিল সৌত্রিক, খানিক অপমানিত। কিন্তু রঞ্জনা বুঝতে দেয়নি কিছুই। সেইসব বেপরোয়া মিলনের স্মৃতি বড় মধুর সন্দেহ নেই, কিন্তু রঞ্জনাহীন জীবনে ততটাই যন্ত্রণার। এখন সেসবদিনের কথা মনে পড়লে বড় পাগল পাগল লাগে সৌত্রিকের। ওর কথা ভেবে হস্তমৈথুন করার চেষ্টা করেছে সৌত্রিক, কিন্তু ঘেন্না ছাড়া আর কোন অনুভূতি আসেনি ওর। কামগন্ধহীন ভালোবাসায় কোনোদিনই বিশ্বাস করেনি সৌত্রিক, রঞ্জনাও করেনি। ও তো জানত সৌত্রিক বড় শরীরপাগল, তাই কোনোদিন ফেরায়নি ওকে। এখন পরিশ্রান্ত দিনের শেষে মাঝে মাঝে সৌত্রিক রঞ্জনার সাথে মৃত্যুর তুলনা করে ফেলে অজান্তেই। মৃত্যুও হয়ত রঞ্জনারই মত। নারী,সুন্দরী, কুহকিনী, মিলনে তারও অনিচ্ছা নেই বিন্দুমাত্র। প্রতি মুহূর্তে জীবনকে জড়িয়ে ধরে সেও সৌত্রিককে প্রলুব্ধ করে চলেছে বারংবার। সেও জানে সবকিছু, সব গোপন কথা, মনের কোণে জমা হয়ে ওঠা দুঃখ, যন্ত্রণা, ক্লেদ। সেজন্যেই সৃষ্টির আদিকাল থেকে অনুভূতিপ্রবণ সমস্ত মানুষ অত্যুৎসাহীহয়ে পড়েছেন মৃত্যু নিয়ে। তাদের কেউ সাদরে বরণ করেছেন মৃত্যুকে, কেউ বা নিজগুণে বর্ণনা করেছেন তাঁকে, কিংবা বলা ভালো বর্ণনা করার চেষ্টা চালিয়েছেন। সৌত্রিকের মনে পড়ে ছাত্রজীবনে ওর পড়া ‘মৃত্যুঞ্জয়’ কবিতার কথা যার শেষ পঙ্ক্তিতে রবীন্দ্রনাথ যেন খানিক বিদ্রোহী হয়ে উঠে বলেছেন, ‘আমি মৃত্যু চেয়ে বড় এই শেষ কথা বলে যাব আমি চলে।’ এই লাইনের যথার্থতা নিয়ে সৌত্রিকের প্রশ্ন জেগেছে বারংবার। প্রথাগত শিক্ষায় যতই বোঝানোর চেষ্টা হোক না কেন যে রবীন্দ্রনাথ তার অসামান্য সৃষ্টির মধ্য দিয়ে আমাদের মধ্যে অমর হয়ে আছেন, সেই যুক্তি মাথায় রেখেই তবে বলা যেতে পারে নোবেলজয়ী, অসামান্য সাহিত্যপ্রতিভাসম্পন্ন এক কবিরও মৃত্যু নিয়ে কিছু সময় ব্যয় করবার প্রয়োজন হয়, কবিতা লিখে এই বক্তব্য পেশ করতে হয়, ‘যে তিনি মৃত্যু চেয়ে বড়’, এমনকি এটা জানবার পরেও যে তাঁকে চলে যেতে হবে। বস্তুত কবি এখানে প্রকারান্তরে স্বীকার করেছেন যে মৃত্যুর শক্তির কাছে তিনি বারংবার পরাজিত, তিনি অমর নন, ফলত তাঁর মৃত্যু চেয়ে বড় হয়ে ওঠার আকাঙ্খা বিশেষ ধোপে টেঁকে না। অনেকটা ইঙ্গমার বারগম্যানের ‘দ্য সেভেন্থ সিল’ সিনেমার মত। যেখানে পরিচালক স্পষ্টতই বুঝিয়েছেন মৃত্যুকে অতিক্রম করা অসম্ভব, সে দাবাখেলায় যে যতই ভালো হোক না কেন। তাই সৌত্রিকের মনে হয় যদি কোন দেবতার বা দেবীর পুজো করতেই হয় তবে মৃত্যুই হবে সেই আদর্শ দেবী, কারণ মৃত্যু ইনেভিটেবল, তার ছলছাতুরি নেই, জীবনসায়াহ্নে সে দোষ, গুণ, ধর্ম, ভাবনা, কর্ম নির্বিশেষে সকলকে নিজ কোলে স্থান দেয়, তার মাতৃত্ব, স্নেহ, প্রেম, ভালোবাসা আছে বৈকি। বস্তুত বাস্তবজীবনের ধর্মকর্ম, দেবদেবী, পাপপুণ্য, ধুমধাম করে হওয়া দুর্গা বা কালীপূজোর প্রতি সৌত্রিকের এখন একটা বিতৃষ্ণা জন্মেছে, বিতৃষ্ণা জন্মেছে তথাকথিত সামাজিক রীতিনীতির ওপর। জীবনের বাস্তবতায় এসব জিনিসগুলোর প্রাসঙ্গিকতা সৌত্রিকের মনে এখন আর নেই বিশেষ। এখনও সৌত্রিকের মনে জ্বলজ্বলে বিচ্ছেদবেলায় সেই শেষবার রঞ্জনাকে জড়িয়ে ধরার স্মৃতি। রঞ্জনা কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল, ‘সৌত্রিক কি হবে আমার? কোথায় যাব আমি?’ এক বিবাহযোগ্যা ভারতীয় নারীর বড় সঙ্গত প্রশ্ন ছিল তা। প্রেম সম্পর্ক মানেই তো কলঙ্ক, বদনাম, বৈবাহিক সম্পর্কের আগে অসংখ্য জেরার মুখে পড়া, তারসাথেই অবচেতনে সতীচ্ছদা(??)অক্ষুণ্ণ রাখতে না পারার নিরাপত্তাহীনতা। বিশেষ কিছুই বলতে পারেনি সৌত্রিক, চোখে বোধহয় সামান্য জল এসেছিল। কিন্তু তারইসাথে ছিল এই সমাজ, দেশ, কাল, বস্তাপচা নিয়ম আর ধর্মের প্রতি একটা সুতীব্র বিরক্তি, একটা ক্ষোভ আর ঘেন্না, যে ঘেন্নায় বিনা কারণে গা গুলিয়ে ওঠে, বমি পায় অজান্তেই। দেহের প্রতিটি কোষ প্রতিবাদী হয়ে উঠলেও সৌত্রিকের মত সাধারণ মানুষের করার থাকে না খুব বেশি। কিন্তু প্রতিবাদ লেখা জরুরি, প্রয়োজনে লেখা জরুরি মৃত্যু দিয়েই, সমাজ বা আইন তাকে আত্মহত্যাই বলুক আর ধর্ম তাকে মহাপাপই বলুক, সৌত্রিকের তাতে বিশেষ এসে যায় না কিছু। --দেখো কিন্তু ছুঁয়ো না, ছোঁও কিন্তু স্বাদগ্রহণ কোর না, স্বাদগ্রহণ কর কিন্তু গিলে ফেল না এই যদি হয় ভগবানের নিয়ম তবে তার পুজো অন্তত সৌত্রিক চৌধুরী করবে না। সৌত্রিকের মনে পড়ে বিখ্যাত হলিউড ছবির ডায়লগ, ‘দ্য গ্রেটেস্ট ট্রিক ডেভিল এভার প্লেড ইস দ্যাট হি কনভিন্সড পিউপিল হি নেভার এক্সিস্টেড।’ কিন্তু সে আছে। আমাদের জীবন, চেতনা, বিদ্যা, স্পেস টাইম, অহংকার, বিবর্তন, শরীর, যৌনতা, হিংসা, আত্ম অভিমান, লালসা সব জুড়ে সেই ডেভিলের এক পৃথিবীময় সাম্রাজ্য। সেই সাম্রাজ্যের স্বাদ মানুষকে প্রশ্ন করতে শেখায়, জীবনকে বুঝতে শেখায়, অসংখ্য অ্যাঞ্জেল-হুর-পরীর মুখ নিঃসৃত অমৃততুল্য বাণীর আকাশকুসুম থেকে বের করে যেন অনেক খানিক ঠেলে দেয় লুসিফারের দিকে, যেখানে আমিত্ব ও জ্ঞানই হয়ে ওঠে শেষ কথা। একবিংশ শতকে যদি গোল পৃথিবী, মানব বিবর্তন, টেস্ট টিউব বেবি, নিউক্লিয়ার ফিউশন কিংবা ক্লোনিং বৈজ্ঞানিক সত্য হয়ে দেখা দেয় তাহলে সে পৃথিবীতে ভগবান নিঃস্ব, সে খানিক ক্লান্তও বটে অথবা তার ধামাধারিরা সকলে হিপক্রিট তা নিয়ে সন্দেহ নেই সৌত্রিকের। তাই সত্য ছিল রঞ্জনা, সত্য ছিল ভালোবাসা, সত্য ছিল মিলন, সত্য ছিল জ্ঞান ও প্রচেষ্টা কিন্তু ততধিক সত্য ছিল অহংবোধ। আজ সৌত্রিকের সব হারিয়ে যেতে পারে কিন্তু সেই অহংকার হারাতে পারে না, কিছুতেই না। যদি হারিয়ে যাবার আশঙ্কামাত্র তৈরি হয় তবে বেদনাই হবে সঙ্গিনী, অভিমানই হবে অলংকার, মৃত্যুই হবে সমাধান, আত্মহননই হবে উত্তর। না মানসিক দ্বন্দ্ব নেই আর, আর নেই চিন্তা ভাবনা বা মনের পাগলামো বয়ে বেড়াবার ক্লান্তি, চূড়ান্ত সমাধানে পৌঁছেছে সৌত্রিকের মনন, সৌত্রিক এখন তা থেকে মাত্র দু’পা দূরে।
।। ৫ ।।
ইনসুলিনের ভায়াল থেকে দশ ইউনিট ইনসুলিন টানতে টানতে হুড়মুড় করে স্মৃতির পাহাড় জমে ওঠে সৌত্রিকের মনে। অভ্যস্ত হাতে কতবার ইনসুলিন টেনেছে সৌত্রিক, কতবার দিয়েছে কত মধুমেহ রোগীকে, যাদের কেউ কেউ সুস্থ হয়ে উঠেছে, কিংবা কেউ কেউ মারা গিয়েছে শত চেষ্টার পরেও। ডামডিম চা বাগানের শ্রমিক বিজন খালকো, বা রাঙামাটির সুমন টোপ্প যাদের প্রায় নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়ে এনেছিল সৌত্রিক, নেপথ্যে ছিল স্যালাইন, ইনসুলিন আর পটাসিয়াম কারেকশনের জটিল সমীকরণ। ধন্যবাদ দিয়েছিল তারা, কিংবা কেউ দেয়নি। সেই ইনসুলিনকেই সৌত্রিক বেছেছে আজ যন্ত্রণাহীন মৃত্যুর জন্য। বড় নিশ্চিন্ত ও একইসাথে নিশ্চিত এ মৃত্যু। কোন স্বাভাবিক মানুষ ইনসুলিন নিলে রক্তে বিপজ্জনকভাবে শর্করার মাত্রা কমে যায়, মস্তিস্কে পৌঁছায় না শর্করা। খাদ্যের অভাবে খুব অল্প সময়ে বস্তুত খুবই অল্প সময়ে মৃত্যু হয় মস্তিষ্কের। প্রথমে কোমা, তারপর নিয়মিত ছন্দে প্রাণপাখি উড়ে যায় জীবনসীমানার অপর প্রান্তে। পড়ে থাকে একটি ঘর্মাক্ত প্রাণহীন শরীর। আর এসব ভেবে কাজ নেই। হাতের বাহুতে একটি রবারের ফাঁস বেঁধে একটি শিরাকে ফুলিয়ে তোলে সৌত্রিক তারপর ইনসুলিন সিরিঞ্জের ছুঁচ ফুটিয়ে ঠেলে দেয় ইনসুলিনের শেষ বিন্দুটুকু। তারপর বের করে নেয় ছুঁচ। সমবেদনা জানায় ক্ষতস্থান থেকে বেরিয়ে আসা এক ফোঁটা রক্তবিন্দু। বড় হালকা লাগে সৌত্রিকের। একবার মনে পড়ে বাবা মায়ের মুখ। দুঃখ হয়তো পাবেন তারা, কিন্তু সামলেও উঠবেন হয়ত। সময় বড় অদ্ভুত জিনিস, সময়ের সাথে সাথে প্রলেপ লাগে সব ক্ষততেই, কয়েকটা ছাড়া। পরপর চলা স্লাইড শোর মত সৌত্রিকের মনে পড়ে ওর স্কুল, কলেজ, বন্ধুদের কথা; মনে পড়ে গ্রামের বাড়িতে শীতকালে খুব ভোরে উঠে শিউলি ফুল কুড়িয়ে আনার আনন্দ, কিংবা ছোট্টবেলায় বাসে জলঢাকা নদী পেরোতে পেরোতে মাকে করা সেই প্রশ্ন, ‘মা জলঢাকা নদীর জল তো ঢাকা নয়।’ ঝিমঝিম করে ওঠে মাথা, অবশ হয়ে আসে শরীর, ঘোলাটে দৃষ্টিতে সৌত্রিক শেষবার দেখে নেয় ওর সুইসাইড নোট যার নাম ও রেখেছে ‘কৈফিয়ত।’ তারপর ঘুমিয়ে পড়ে চির ঘুমের সাম্রাজ্যে, শান্তির খোঁজে। পড়ে থাকে লেখার ডায়রি, সবুজ কালিতে ‘স্লিদারিন’ লেখা একটি বড় পোস্টার, একটি ধুলো পড়া ল্যাপটপ, একটি স্টেথো, আরও কিছু নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী।
কৈফিয়তঃ
রঞ্জনাকে ভালবেসেছিলাম আমি। এটা জানবার পরেও যে সম্পর্কে সে আমার বোন। নিজের নয়, মাসতুতো। শরীরী ভালোবাসার প্রথম দিন থেকে বুঝতে পারতাম সমাজ মেনে নেবে না এ ভালোবাসা, কিংবা সমাজের চোখে আমরা হয়ে উঠব খানিক ঘৃণিত, অপাংক্তেয়।সেই ঘৃণার পুঞ্জীভূত পাহাড়ে চাপা পড়ে থাকবে আমার আর রঞ্জনার ব্রাত্য হয়ে ওঠার গল্প। আমি চাই না সমাজ পড়ুক এ কৈফিয়ত, কিন্তু চাই রঞ্জনা যেন পড়ে, আমাকে ও যেন ভুল না বোঝে। আমি ছাড়তে চাইনি ওকে, এড়িয়ে যেতে চাইনি কোন দায়িত্ব। প্রথমদিনেও নয় কিংবা যেদিন হঠাৎ জানতে পেরেছিলাম ও অন্তঃসত্ত্বা সেদিনেও নয়। আমি সসম্মানে বিয়ে করতে চেয়েছিলাম ওকে, পিছিয়ে এসেছিল ও নিজেই, বলেছিল এটা জানাজানি হলে সমাজ নাকি বাঁচতে দেবে না আমায়, কিংবা আমাকে মেরে ফেলবে ওর বড়দা সমর। আজ ওকে বলতে বড় ইচ্ছে করে ওকে ছাড়াও আমার বেঁচে থাকা হল না আর। অদ্ভুত গোঁয়ার্তুমি ছিল খুকুর। ‘খুকু’ রঞ্জনার ডাকনাম। ও আমাকে বিয়ে করতে চায়নি কিন্তু কথা দিয়েছিল বাচ্চাটাকে ও নষ্ট করবে না, আর বলেছিল সমস্ত অবহেলা, অত্যাচার আর সামাজিক কলঙ্কের মাঝেও ও গোপন রাখবে আমার পরিচয়। রঞ্জনার এ সিদ্ধান্ত যতটাই সাহসী ছিল, ততটাই কঠিন ছিল আমার পক্ষে তা মেনে নেওয়া। নিজের সন্তানের পরিচয় দিতে না পারার যে কাপুরুষতা তার জ্বালা নিয়ে বেঁচে থাকা আমার পক্ষে অসম্ভব ছিল। আমি রঞ্জনাকে বলেছিলাম সে কথা, কিন্তু ও বোঝেনি আমাকে। ও সম্পর্কটাই রাখতে চায়নি আর। রঞ্জনার চলে যাওয়ায় আমি ভেতরে ভেতরে ক্ষতবিক্ষত হয়ে গিয়েছিলাম। কোনোদিন কোথাও কাউকে বলতে পারিনি আমার সেই মানসিক যন্ত্রণার বৃত্তান্ত। এই আত্মসম্মানহীন জীবনে বেঁচে থাকতে ভালো লাগত না আর, আস্তে আস্তে নিজের পেশাকেও অপছন্দ করতে শুরু করেছিলাম, ডাক্তারি করতে ক্লান্ত লাগত বড়, ক্লান্ত লাগত মানব শরীরের জটিল হিসেবনিকেশের অঙ্ক কষতে।রঞ্জনা আমার মৃত্যুর জন্য দায়ী নয়, ওকে যেন কোনোরকমভাবেও আইনি লাঞ্ছনা বা গঞ্জনা সহ্য করতে না হয়। তবে ওর শরীরে বেড়ে ওঠা সন্তানটিকে দেখে যাবার এক অপত্য বাসনা ছিল বটে, কিন্তু না দেখে আত্মহননের সিদ্ধান্তে অতৃপ্তিও নেই বিন্দুমাত্র। আমার সীমিত জীবনে সরকারি পয়সার বিনিময়ে করা মানবসেবার পুণ্যফলে যদি স্বর্গ না মেলে তবে আত্মহত্যার মহাপাপে নরকেই ঠাঁই পাব, কিন্তু সেখানেও এই ভেবে শান্তিতে থাকব যে জীবনসায়াহ্নে রঞ্জনাও সেখানেই আসবে, পাপ করেছে বলে নয়; আমাকে ভালবেসেছে বলে।