• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৭০ | মার্চ ২০১৮ | গল্প
    Share
  • স্বখাত সলিল : রূপা মণ্ডল



    (১)

    সকাল থেকে সানাই চালানো হয়েছিল। আজ বৌভাত, বাড়ি ভর্তি আত্মীয়-কুটুম। নতুন বৌ বিছানায় উঠে বসে বললো, "উঃ, আওয়াজে মাথা ধরে গেল একেবারে!" ওমা, একি কথা! কয়েকজন আত্মীয়া, যারা নতুন বৌমার ঘরে জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখছিলো চমকে গিয়ে থমকে গেল এক্কেবারে। একজন বলার চেষ্টা করলো, "আজ যে তোমার বৌভাত!"

    --তাতে কি হয়েছে? ঘুম থেকে উঠিনি, এখনই এতো জোরে সানাই বাজাতে হবে?

    কি মুখরা মেয়ে গো। সবাই কাজের অজুহাতে সরে পড়তে লাগলো। শুধু একজন বলে গেল, "ওই বাথরুমে তোমার জন্য মাজন আর ব্রাশ রেখে দিয়েছ। মুখ ধুয়ে নিও।"

    বাইরে তখন গুঞ্জন শুরু হয়ে গেছ। "এই মেয়েকে নিয়ে ঘর করবে কি করে?", "কে সম্বন্ধ করেছিল?" ইত্যাদি ইত্যাদি।

    --ওমা, মা গো!

    --কি হলো? কি হলো?

    বন্ধ দরজায় অনেকের করাঘাত। দরজা খুলে নববধূ দৌড়ে বেরিয়ে এলো, "কি বড় আরশোলা! বাড়িতে পেস্টকন্ট্রোল করা হয় না, না কি?"

    শাশুড়িমায়ের মুখখানা গম্ভীর হয়ে গেল। লোকজনের সামনে কেউ এমনভাবে বেইজ্জত করে?

    মুখে বললেন, "তাড়াতাড়ি মুখ ধুয়ে এসো, খেতে দিচ্ছি।"


    (২)

    --একি? এতো তেলেভাজা লুচি-টুচি আমি খাই না; আর এ কি আলুচচ্চড়ি? এতো শুধু জলে আলু ভাসছে।

    --তবে তুমি কি খাও?

    --এখন আমাকে গরমজলে লেবু-মধু, গ্রিন টি আর একটু পরে একবাটি দুধ-কর্নফ্লেক্স, দুটো কলা আর একটা ডিম্ সেদ্ধ দেবেন।

    --আজকে ডিম্? একটা শুভদিনে!

    --তাতে কি। শুভদিনে যদি মুরগির মাংস রান্না হতে পারে, তাহলে ডিমে দোষ কি?

    বাবাঃ, বাড়িতে ঢুকেই এ মেয়ে কাকচিল বসতে দেবে না দেখছি। এতো মুখ। শাশুড়ি বেশ ঘাবড়েই গেলেন।

    প্রসূনের বাবা বলেছিলো, "ওদের অবস্থা খুব ভালো। ওরা দেবে-থোবেও ভালো। খোকার আমার চিন্তা থাকবে না।" তাই একদিন একটু দেখে এসেই কর্তা-গিন্নি বিয়ের কথা ফাইনাল করে দিয়েছিলেন। খুব বেশি খোঁজখবর নেন নি। সম্বন্ধটা এনেছিল প্রসূনের বড়পিসি কাদম্বিনী। বলেছিলো, "বৌদি, বড়বাজারে ওদের বহুপুরোনো শাড়ির ব্যবসা আছে। ওর বাবার নিজস্ব দোকান আছে ওখানে। তাছাড়া পাঁচভাইয়ের আলাদা আলাদা ব্যবসা; অঢেল পয়সা, একটি মাত্র বোন, দেবে-থোবে ভালোই। প্রসূনকে অমত করতে বারণ কোরো।"

    --লক্ষীছাড়া ছেলে আমার, কোথাকার কোন ছাত্রীকে কবে পড়াতে গিয়ে তাকে বিয়ে করবে বলে কথা দিয়ে বসে আছে।

    --ওসব ভুত মাথা থেকে একদম তাড়াতে বলো বৌদি। নাহলে এমন পয়সাওলা ঘরের মেয়ে পিছলে যাবে।


    (৩)

    --বৌমা, ওখানে কি করছো? দেখছো না, আমাদের ওদিকের ছাদে রেলিং নেই?

    --ওদের বাগানটা দেখছিলাম, বেশ সুন্দর ফুল ফুটেছে। আপনাদের বাগানটা একটু ফুলের গাছ দিয়ে সাজান নি কেন? আমাদের বাড়িতে ছাদে কি সুন্দর ফুলের টব ছিল। এই শীতে গোলাপ, ডালিয়া, চন্দ্রমল্লিকা, ইনকা গাঁদা, আরো কত রকমের মরসুমি ফুলে সারা ছাদটা ভরে থাকে। আপনাদের দেখছি ফুলের শখটা একটু কম।

    --আমাদের তো আর মালি নেই। নিজেদেরই সব করতে হয়।

    --রাখতেই পারেন। একজন মালি আর কত টাকা নেবে? বড়োজোর হাজারখানেক, হাজার দেড়েক টাকা।

    --কি বলছো, মাসে হাজারখানেক, হাজার দেড়েক টাকা দিয়ে মালি রাখবো?

    --তাতে কি হয়েছে। মানুষের কিছু শখ-সাধও তো থাকে না কি? তাছাড়া, আপনার ছেলে তো সরকারি চাকরি করে।

    প্রসূনের মা গম্ভীর মুখে তাড়াতাড়ি জামাকাপড়গুলো মেলতে লাগলেন।


    (৪)

    --একবার এদিকে আসুন তো।

    বৌমার গলা শুনেই তটস্থ শাশুড়ি রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলেন।

    --কি হয়েছে?

    --দেখুন তো টি.ভি.র রিমোটটা কেন কাজ করছে না।

    --বোধহয় ব্যাটারি শেষ হয়ে গেছে।

    --এরই মধ্যে ব্যাটারি শেষ হয়ে গেল? নতুন টি.ভি.-র নতুন রিমোট। কে জানে কোথাকার সস্তার মাল কিনে এনেছেন। আমার বাবা তো টি.ভি. কেনার জন্যে পঁচিশ হাজার টাকা দিয়েছিলো।

    --ঠিক আছে, প্রসূন আসুক। আমি ওকে বলবক্ষন রিমোট না টি.ভি.র প্রব্লেম, চেক করে দেবে।

    --সে কি পারবে না কি। কোনো টি.ভি.র মেকানিককে খবর দিন বরং, নাহলে যে দোকান থেকে কিনেছিলো, সেখানে কমপ্লেইন করতে বলুন।


    (৫)

    --তুমি মাকে কি বলেছ? আমরা সস্তার জিনিস কিনে আনি?

    --তাছাড়া কি। এই তো এই খাটটা। পাশ ফিরলেই কেমন ক্যাঁচ-ক্যাঁচ আওয়াজ করে। আর ওই ড্রেসিং টেবিলটা। ছিঃ। ওরকম নকশা এখন আর চলে না কি? আমার বৌদিরা তো দেখে হেসেই খুন।

    --তবে আরো বড়োলোকের বাড়িতে তোমার বাবা বিয়ে দিলেন না কেন? যাদের টাটা-বিড়লার মতো সম্পত্তি আছে।

    --কেন? আমার বাবা কি তোমাদের কিছু কম দিয়েছে না কি? পাঁচ লাখ টাকা নগদ নিয়েছো। আমাদেরই ভুল হয়েছিল তোমাদের ক্যাশ টাকা দেওয়া। জিনিসগুলো কিনে পাঠালে এমন ঠকতে হতো না।

    প্রসূন সারাদিন মুখ গোমড়া করে ঘুরছে। বৌয়ের অমন ট্যাঁকটেকে বাক্যি হজম হয় না কি। খাবার সময়ে ভালো করে খেলোও না। প্রসূনের মাও সব বুঝতে পারছেন; কিন্তু কিছু করার নেই। মাঝে মাঝে দীর্ঘশ্বাস ফেলছেন আর ভাবছেন, বোধহয়, এই মেয়েকে বৌ করে না এনে প্রসূনের ওই ছাত্রীকেই একবার দেখে এলে ভালো হতো।


    (৬)

    --এই অবেলায় এতো সেজেগুজে কোথায় চললে বৌমা?

    --আমার বন্ধুর বাড়ি। ফিরতে রাত হতে পারে। হয়তো ওখান থেকে আমি বাপের বাড়িতেও চলে যেতে পারি। ফোনে জানিয়ে দেব।

    --কোথায় তোমার বন্ধুর বাড়ি?

    --গড়িয়াহাট। ও এখানে থাকে না, কানাডা থেকে তিন বছর বাদে এখানে আসছে।

    --তা প্রসূনের সঙ্গে গেলেই তো পারতে।

    --ওর কি সময় আছে না কি। তাছাড়া, আমি আমার বন্ধুর বাড়ি বেড়াতে যাবো, সেখানে আবার লেজুড়ের মতো ওকে টেনে নিয়ে যাবো কেন? ওরা তো ওকে নেমন্তন্ন করেনি।

    বাড়ির সামনে থেকে ক্যাবে চড়ে বৌমা চলে গেল। প্রসূনের মা শুধু বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলেন।


    (৭)

    বসার ঘরে ল্যান্ডফোনটা ঝনঝনিয়ে বাজছে। প্রসূনের মা ঘরে ঢুকে রিসিভার কানে ঠেকিয়ে বললেন, "হ্যালো--"

    --বৌদি, সহেলী কোথায়? প্রসূন আর সহেলীকে নিয়ে সামনের রবিবারে আমাদের বাড়িতে এসো। একদিন ওদের নেমন্তন্ন করে খাওয়াবো ভেবেছিলাম, তাই রবিবারেই ছুটির দিনে ভালো হবে, কি বলো?

    --আর বৌমা। সে এখন তার কোন বন্ধুর বাড়ি গেছে। কাউকে তো কিছু বলার প্রয়োজন মনে করে না।

    --সে কি গো। তোমাদের কথা শোনে না?

    প্রসূনের মেজো পিসি শকুন্তলা যেন রহস্যের গন্ধ পেলো। ননদ-বৌদি বৌমার নিন্দায় মেতে গেল।


    (৮)

    সহেলীর সাথে অঞ্জনের প্রেম আজ থেকে নয়। সেই ইলেভেনে পড়ার সময় থেকেই। সহেলীর প্রাণের বন্ধু ছিল রাকা। রাকার মাধ্যমেই অঞ্জনের কাছে প্রেম নিবেদন। আজও সেই দিনটার কথা মনে পড়লে সহেলীর হাসি পায়। অঞ্জন কি বোকাটাই না ছিল। তখন ও একেবারেই স্মার্ট ছিল না। হালকা গোঁফের আড়ালে ওর মুখখানা ঠিক আলুভাতের মতো লাগতো।

    উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে অঞ্জন গেল সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে। রাকা ইংরেজি নিয়ে এম.এ. কমপ্লিট করে একটা কলেজে প্রফেসরি পেল আর সহেলী ইতিহাস নিয়ে এম.এ. কমপ্লিট করতেই বাবা পাত্র দেখা শুরু করে দিলেন।

    একে তেমন সুন্দরী নয়, স্থূলকায়া, গায়ের রং ঈষৎ চাপা--এমন মেয়ের বেশি বয়স হয়ে গেলে মুশকিল; তাই সমীরণবাবু সহেলীর বিয়ের জন্যে একেবারে উঠে পড়ে লেগেছিলেন।

    এদিকে অঞ্জন তখন কানাডাতে একটা প্রজেক্ট করছে। সহেলীর সাথে যোগাযোগ অনেক কম। ইমেইল করলে সাতদিন বাদে উত্তর দেয়। এস.এম.এস. পাঠালে দেখে না। ফোন তো ধরেই না, বলে, "খুব ব্যস্ত ছিলাম গো। এতবড়ো প্রজেক্টের দায়িত্ব কম না কি?"

    এদিকে সমীরণবাবু একটি ভালো পাত্রের সন্ধান পেলেন--প্রসূন সরকারি চাকরি করে, অতএব হাতছাড়া করা চলবে না। সেজন্যে বেশি পণ চাইলেও অরাজি হন নি।

    সহেলী বার বার বলেছিলো, "বাবা, তুমি একবার অঞ্জনের সাথে কথা বলো। ও ফিরে আসলেই..."

    সমীরণবাবু সে কথার কোনো গুরুত্বই দেন নি। পাগলী মেয়ে, ভাবছে বুঝি ওই বিদেশে থাকা ছেলেটাই ভালো হবে। আরে, ওদেশে সে কার সাথে ঘুরে বেড়াচ্ছে, কি করছে, তার কি কোনো ঠিক আছে? হাতের সামনে এমন একটা ভদ্র-সভ্য সরকারি চাকুরে ছেলে পেয়ে কেউ হাতছাড়া করে? তাছাড়া, প্রসূনের খবর নিয়ে দেখেছেন ছেলেটার বিরুদ্ধে কেউ কোনো খারাপ কিছু বলে নি। এমন ছেলের সাথে বিয়ে হলে মেয়ে সুখীই হবে। তাই আর তিনি দেরি করতে চান নি। একটা শুভদিন দেখে চারহাত এক করে দিয়েছেন।


    (৯)

    প্রতিদিন সহেলী অঞ্জনের ফ্ল্যাটে ঢুকেই সোজা বেডরুমে চলে যেত। আজ দেখলো অ্যাটাচ বাথরুম থেকে জলের আওয়াজ আসছে, অঞ্জন ঘরে নেই। সে খাটে বসতে গিয়েই নজর পড়লো পাশে রাখা বেডসাইড টেবিলটার দিকে। ওর উপরে অঞ্জনের একটা পার্সোনাল ডাইরী রাখা ছিল, যেটা সহেলীই তাকে গিফট দিয়েছিলো। এমনিতে কারো ডাইরিতে সহেলী হাত দেয় না, কিন্তু অঞ্জনের কথা আলাদা। আর কিছুদিন বাদেই তারা হাসব্যান্ড-ওয়াইফ হতে যাচ্ছে। প্রচণ্ড কৌতূহলবশে সে অঞ্জনের ডাইরিটা খুলে ফেলল--সহেলীকে নিয়েও অল্প কিছু কথা লেখা আছে, তবে সেগুলো ইম্পরট্যান্ট কিছু নয়। পাতা উল্টাতে উল্টাতে সে একটা মাঝারি সাইজের মোটাসোটা খাম পেলো। সেটা খুলতেই বেরিয়ে পড়লো রাকার আল্ট্রা মডার্ন পোশাক পরা কিছু ছবি এবং দু-একটা পুরোনো চিঠি।

    চিঠিগুলো যখন অঞ্জন কানাডায় ছিল তখন লেখা। তবে ছবিগুলো কবেকার তা বুঝতে পারলো না সহেলী। দরজায় একটা খুট করে আওয়াজ হতেই সহেলী খামটা চট করে ডাইরির মধ্যে রেখে দিয়ে সেটা আবার যথাস্থানে রেখে দিলো। একটু পরেই তোয়ালে জড়িয়ে ঘরে ঢুকলো অঞ্জন।

    --তুমি? কতক্ষন এসেছো? আমাকে ডাক নি কেন? কি নেবে বলো? চা না কফি?

    সহেলী কোনো উত্তর দিচ্ছে না দেখে অঞ্জন চোখ বড় বড় করে বললো, "মহারানীর কি হলো? আমার উপরে রাগ হয়েছে?"

    সহেলী সরাসরি চোখ রাখলো অঞ্জনের দিকে, "রাকা তোমার ফ্ল্যাটে আসে?"

    --ক্কই, না।

    অঞ্জনের একটু চমকে ওঠার ব্যাপারটা সহেলীর নজর এড়ালো না। অঞ্জন ওয়ার্ডরোব থেকে প্যান্ট-শার্ট বের করলো। আজকে ও পরল নামি ব্র্যান্ডের স্কাই ব্লু টি-শার্ট আর ব্ল্যাক জিন্স। দারুন হ্যান্ডসাম দেখাচ্ছে অঞ্জনকে। সহেলীকে জড়িয়ে ধরে অঞ্জন বললো, "চলো, আজ তোমার পছন্দমতো কোথাও থেকে লাঞ্চ করে আসি।"

    অঞ্জনের এই ভালোবাসার উত্তাপ সহেলীকে সব কিছু ভুলিয়ে দেয়। সে অঞ্জনকে বিশ্বাস করে ভরসা পেতে চায়। ভেসে যেতে চায় তার ভালোবাসার জোয়ারে।


    (১০)

    অঞ্জনের বার্থডে সেলিব্রেট করতে আজ ওরা "সপ্তপদী"-তে লাঞ্চ করতে গিয়েছিলো। অঞ্জন নিজেই ড্রাইভ করে গিয়েছিলো ওর নতুন কেনা সুইফট কার নিয়ে। সহেলী আজ মেরুন রঙের বাটিক সিল্ক শাড়িটা পরেছে। কন্ডিশনার লাগানো স্টেপকাট চুলগুলোতে একটা চন্দ্রমল্লিকা গুঁজে নিয়েছে। অঞ্জনের ফ্ল্যাটে টবে ফুটেছিলো। অঞ্জন নিজেই তুলে লাগিয়ে দিয়েছে।

    লাঞ্চের মেনুগুলো সব সহেলীর পছন্দ অনুযায়ী--পোলাও, ছানার ডালনা, দই-কই, ইলিশ পাতুরি, চাটনি, দই, সন্দেশ।

    খেতে খেতে সহেলী অঞ্জনকে জিজ্ঞাসা করলো, "তোমাদের প্রজেক্ট কবে থেকে শুরু হচ্ছে?"

    --আর বেশিদিন নেই। মনে হচ্ছে সামনের সপ্তাহেই কাজ শুরু হয়ে যাবে। আমি নেক্সট মানডে থেকে অফিসে যাওয়াটা কন্টিনিউ করবো।

    --তাহলে তোমার সাথে কিভাবে দেখা করবো?

    --রোজ হয় তো হবে না, তবে শনি-রবিবারে তো ফ্রি। তাছাড়া হোয়াটস-আপে চ্যাটিং তো হবেই।

    --কালকে দুপুরে যাবো তোমার ফ্ল্যাটে।

    --উঁহু, কালকে বিকেলে এস। দুপুরে আমি নাও থাকতে পারি। আমাকে একবার হয়তো অফিসে যেতে হবে এম.ডি-র সাথে দেখা করতে।

    এরপর ওরা আইনক্সে মুভি দেখে, একটা শপিং মলে কেনাকাটা করে ফিরে এলো অঞ্জনের ফ্ল্যাটে। সহেলী অঞ্জনকে একটা দামি শার্ট গিফট করলো। রিটার্ন গিফট হিসাবে অঞ্জন দিয়েছে একটা গোল্ড পেন্ডেন্ট।


    (১১)

    অঞ্জনের গাড়ি যখন সহেলীকে প্রসূনদের বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে গেল তখন রাত্রি দশটা। সহেলী কলিংবেল বাজানোর আগেই দরজা খুলে গেল--সামনে প্রসূন দাঁড়িয়ে আছে।

    --এতো রাত হলো?

    --আমি বন্ধুর বাড়ি গিয়েছিলাম।

    --ওই ভাগ্যবানটি কে যিনি গাড়ি থেকে নামিয়ে দিয়ে গেলেন?

    --আমার বন্ধু।

    --বয়ফ্রেন্ড?

    --হ্যাঁ, তাই। যা তুমি ভাববে।

    --আমাদের মধ্যবিত্ত বাড়িতে এসব চলে না। বয়ফ্রেন্ড নিয়ে থাকতে হলে অন্য কোথাও যেও।

    --ঠিক আছে। তোমাদের আর বেশিদিন কষ্ট করতে হবে না।

    সহেলী সোজা ঘরে ঢুকে সশব্দে দরজা বন্ধ করে দিলো।


    (১২)

    সহেলী আজ রাতে কিছু খায় নি। বোধহয় খেয়েই এসেছে। প্রসূনের মা কয়েকবার দরজায় ধাক্কা দিয়ে ফিরে গেছেন।

    উঃ কি সাংঘাতিক মেয়েকে বাড়ির বৌ করে নিয়ে এসেছিলেন। হাড় একেবারে ভাজা ভাজা করে দিলো গো। কতবার ভেবেছেন, বাড়ির ছাদ থেকে ওকে ফেলে দেবেন; নাহলে বিষ খাইয়ে দেবেন। কিন্তু সেটা করলে বাড়িশুদ্ধ সবার হাতে হাতকড়া পড়বে যে। প্রসূনকে অনেকবার বলেছেন, "খোকা, ওকে শাসন কর।"

    ছেলে শুধু চুপ করে থাকে। নাহলে বলে, "তোমরাই তো পণ নিয়ে ওকে আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছো।"

    প্রসূনের মা চুপসে যান। নিজের সম্মান রাখতে প্রসূনের বাবা যেন কানে তালা এঁটে থাকেন। বৌয়ের বাপ-মায়ের কাছে অভিযোগ করেও লাভ হয় নি; তারা বলেছে, "একটু মানিয়ে নিন ওকে। আগে তো এরকম ছিল না।"

    প্রসূনের মা মাঝে মাঝে অমন বৌয়ের মরণকামনাও করেন। মনে মনে ভাবেন, ছাদের ওই রেলিং না থাকা জায়গাটা থেকে যদি বৌটা গড়িয়ে পড়ে যেত, তবে ল্যাঠা চুকে যেত। বাঁচা যেত তাহলে। নিজেই পড়ে মরেছে। কেউ কিছু বলতেও পারতো না।


    (১৩)

    কি যেন এক অদ্ভুত আকর্ষণ সহেলীকে প্রতিদিন অঞ্জনের কাছে টেনে নিয়ে যায়। চুম্বকের মতো টানতে থাকে। দুপুর হলেই ছুটে যেতে ইচ্ছে করে। প্রতিদিন সকাল থেকে সে সাজগোজ করতে থাকে, চুলে শ্যাম্পু করে, আলমারি থেকে অঞ্জনের পছন্দমতো শাড়ি বের করে, সেটা পরে আয়নার সামনে নিজেকে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখে। অঞ্জন কোন শ্যাম্পুর সুবাস, কোন পারফিউম পছন্দ করে সহেলীর সব মুখস্ত হয়ে গেছে।

    আজ সহেলী সবুজ রঙের পিওর সিল্কের শাড়ি পরেছে। কানে মুক্তোর টপ, গলায় সোনার সরু চেনের সাথে গোল্ড-পেন্ডেন্ট, হাতে সুন্দর রিস্টলেট আর ঘড়ি। হাতের নখগুলো মিলেনিয়াল পিঙ্ক রঙে সুসজ্জিত।

    যাবার আগে দামি পারফিউম স্প্রে করে নিলো সারা শরীরে। লেদার পার্সটা তুলে নিয়ে বেরোতে গিয়েই শাশুড়ির সাথে মুখোমুখি দেখা।

    --কোথাও যাচ্ছ?

    --হ্যাঁ।

    --রোজই তো দেখি বেরিয়ে যাও এই সময়ে। কখন ফিরবে?

    শাশুড়ির কণ্ঠে বিরক্তি। সহেলী কোনো উত্তর দিচ্ছে না দেখে তিনি আবার বললেন, "আজ একটু তাড়াতাড়ি ফিরে এসো।"


    (১৪)

    মনোজিৎ অফিসে ঢুকে দেখলো প্রসূন নিজের টেবিলে খুব চিন্তিতভাবে বসে আছে। সরকারি অফিস, প্রায় এগারোটা বাজে--এখনো অনেকেই আসেন নি। কিন্তু এই অফিসে একমাত্র প্রসূনই সময়মতো আসে বলে বড়োবাবু মাঝে মাঝে ওর প্রশংসাও করেন, যেটা আবার অনেকের সহ্য হয় না।

    মনোজিৎ আর প্রসূনের পাশাপাশি টেবিল। মাঝেমধ্যে কাজের ফাঁকে সুখদুঃখের কথা ভাগাভাগি হয়। আর এই অফিসে মনোজিতেরই একমাত্র এর কথা ওকে, আর ওর কথা তাকে বলার বদ অভ্যেসটুকু নেই। বয়সে সামান্য বড় হওয়ায় মনোজিৎ প্রসূনকে ভাইয়ের মতোই স্নেহ করে। অফিসে সবার সাথেই প্রসূনের সম্পর্ক ভালো; কিন্তু মনোজিতের সাথে তার বন্ধুত্বটা একটু বেশি। আজ একটু বাড়তি স্নেহ-মমতার ছোঁয়া পেয়ে প্রসূন তার দুঃখের কথা সব হুড়-হুড় করে বলে ফেললো।

    মনোজিৎ বললো, "এসব কথা তুই আগে বলিস নি কেন? বৌভাতের পরদিনই যখন হানিমুনে না গিয়ে অফিসে চলে এলি সেদিনই আমার একটু সন্দেহ হয়েছিল; কিন্তু কারো ব্যক্তিগত ব্যাপারে নাক গলান আমার স্বভাব নয়, তাই..."

    --শ্বশুরমশাই-শাশুড়িমাকে জানিয়েছিস ব্যাপারটা যে রোজ তাদের মেয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায় আর রাত্রি করে বাড়ি ফেরে অন্য ছেলের সাথে?

    --হ্যাঁ, মা বলেছিলো, কিন্তু তারা সে সব কথা বিশ্বাস করতেই চায় নি। শুধু বলেছে, আপনারা একটু মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করুন।

    --এভাবে চলতে পারে না... তাছাড়া তুই তো বলছিস তোদের মধ্যে কোনো বৈবাহিক সম্পর্কই গড়ে উঠছে না। তুই একজন এডভোকেটের কাছে লিগাল ওপিনিয়ন নে। বলিস তো, আমার একজন মাসতুতো দাদা আছে সে অ্যাডভোকেট, তার সাথে তোর কথা বলিয়ে দিতে পারি।

    --বলো না কথা। আমিও সেটা ভেবেছি।

    --তাহলে আজ বিকেলে চল ওর চেম্বারে। আমি এখনই দাদার সাথে কথা বলে নিচ্ছি।


    (১৫)

    সেদিন অঞ্জন বলছিলো, ওর গাড়িটা খুব ডিসটার্ব করছে, এটা বিক্রি করে আর একটা নতুন গাড়ি কিনবে। সেজন্য আড়াই লাখ টাকা ডাউন পেমেন্ট করতে হবে ; কিন্তু ওর কাছে অত টাকা নেই, পঞ্চাশ হাজারের মতো কম পড়ছে।

    সহেলীকে বলেছিলো, "একটু চেষ্টা করে দেখো না। যদি ম্যানেজ করা সম্ভব হয়। আমার নতুন প্রজেক্টটা চালু হলেই শোধ করে দেব।"

    ছেলেটা বড্ডো বেশি বেহিসাবি খরচ করে। হাতে টাকা এলেই সব টাকা শেষ করে ফেলে। এই প্রথম নয়, এর আগেও সহেলী দু-তিনবার অঞ্জনের প্রয়োজনে টাকা সাহায্য করেছে। সেই যেবারে মেজো বৌদির হাতের হীরের আংটিটা চুরি গেল আর তার দায়ে চাকরি গেল বাড়ির পুরোনো চাকরের, সেই সেবারেও।

    সহেলী জানে টাকাটা ওর পক্ষে জোগাড় করা কতটা কঠিন। বাবার কাছে চাইলে হাজার কৈফিয়ত চাইবে, তাছাড়া দেবেও না। তার চেয়ে বরং কোনো একটা গয়না বাঁধা দিয়ে যদি--

    আজ অঞ্জনের ফ্ল্যাটে যাওয়ার আগে তাই ও একটা নামী জুয়েলারি শপে ঢুকতেই একজন সেলস গার্ল এগিয়ে এলো, "কি দেখাবো ম্যাডাম?"

    --কিছু দেখাতে হবে না। এই বালাজোড়া আমি বাঁধা দিতে চাই।

    --এখানে বাঁধা নেওয়া হয় না। বিক্রি করলে নেওয়া হবে।

    --দেখুন তো কত দাম হবে।

    শাশুড়ির দেওয়া বালাজোড়া এগিয়ে দিলো সহেলী। একজন সেলসম্যান ওজন করে বললো, "হলমার্ক নেই, ওই সব মিলিয়ে সত্তর হাজার মতো পাবেন ম্যাডাম।"

    --ঠিক আছে। দিয়ে দিন।

    টাকাটা সাবধানে ব্যাগের ভিতরে রেখে সহেলী বাইরে বেরিয়ে এসে একটা ট্যাক্সি নিল।


    (১৬)

    আজ দুপুরে রাকাকে সঙ্গে নিয়ে অঞ্জনের শপিং-এ যাবার কথা ছিল সাউথ সিটি মলে। তাই রাকা পাক্কা বারোটার সময়ে চলে এসেছে। খুব সাজগোজ করেছে সে। রাকার ছোট ছোট করে ছাঁটা ঘাড় পর্যন্ত চুলগুলোকে ডার্ক ব্রাউন কালার করা। চোখে কৃত্রিম আইল্যাশ লাগানো, তার উপরে নিখুঁতভাবে আইশ্যাডো, আই-লাইনার লাগানো। মুখে নিখুঁত মেকআপের সাথে সাথে ঠোঁটে চেরি ব্রাউন লিপস্টিক। হাতের নখ সুন্দর করে শেপ করে নীল রঙের নেলপলিশ। পরনে ব্রুমস্টিক স্কার্ট, পায়ে ব্রাউন কালারের হাই হিল ব্যাক স্ট্র্যাপ স্যান্ডেল। রাকার গায়ের রং মোটের উপর ফর্সার দিকেই, তাই বেশ ভালোই লাগছে।

    রাকা ভিতরে ঢুকেই বললো, "উঃ, কি গরম। একটু কোল্ড্রিংকস দিতে বলো না।" বলেই ওর হ্যান্ডব্যাগটা ছুঁড়ে দিলো সোফার উপর।

    মেড সান্ত্বনা দু'গ্লাস কোল্ড্রিংকস নিয়ে এলো। রাকা প্রায় অর্ধেকটা শেষ করেই সোজা অঞ্জনের সাথে ওর বেডরুমে ঢুকে গেল। একটু বাদেই অঞ্জন মুখ বাড়িয়ে বললো, "দুটো গ্লাস দাও তো? আর দোকান থেকে চিকেন পকোড়া নিয়ে এসো, দেখো গরম থাকে যেন। এই নাও টাকা।"

    টাকা নিয়ে সান্ত্বনা মুখ টিপে হেসে চলে গেল। সে রাকাকে চেনে, বাবুর সাথে বিয়ে হবে তাও জানে। আবার ওদিকে সহেলী দিদিমনি এলেও বাবুর সাথে ঘরে ঢুকে যায়। কী চরিত্র!


    (১৭)

    সহেলী অঞ্জনের ফ্ল্যাটের নিচে পৌঁছে দেখলো ওর সুইফট কার-টা পার্কিং-এই রয়েছে, তার মানে ও আজ অফিসে যায় নি। কিন্তু দু'বার কলিংবেল বাজিয়েও দরজা খুলছে না দেখে সহেলী বেশ অবাক হলো।

    --ওমা, আপনি এখানে দাঁড়িয়ে আছেন? কিন্তু বাবু তো বাড়িতে নেই।

    সান্ত্বনা কখন পিছনে পিছনে এসেছে বুঝতে পারে নি সহেলী।

    --তোমার বাবু কোথায় গেছেন?

    --অফিস।

    --তাহলে নিচে গাড়ি রয়েছে কেন?

    --অন্য গাড়িতে গেছেন।

    --ঠিক আছে দরজা খোলো। আমি বসছি।

    সান্ত্বনা কেমন যেন ইতস্ততঃ করছে। হাতে ক্যারিব্যাগের মধ্যে ঠোঙাটা তেলে ভিজে উঠেছে।

    --ওতে কি আছে?

    --চিকেন পকোড়া। বাবু এনে রাখতে বলেছিলো।

    অঞ্জন ফ্ল্যাটে নেই অথচ চিকেন পকোড়া আনতে বলেছে। সহেলীর কেমন যেন খটকা লাগলো।

    --ঠিক আছে, তুমি দরজা খোলো।

    বৌটা চাবি খুঁজছে। কিন্তু খুঁজে পাচ্ছে না। সহেলী অধৈর্য।

    --কি হলো?

    --চাবিটা খুঁজে পাচ্ছি না। দেখি দোকানে ফেলে এলাম কিনা।


    (১৮)

    সহেলী আরো অধৈর্য হয়ে উঠলো। কি যে করে না এইসব কাজের বৌরা। এক্কেবারে কেয়ারলেস। ফ্ল্যাটের চাবি কেউ দোকানে ফেলে আসে? অঞ্জনকে বলে এটাকে তাড়াতে হবে।

    সান্ত্বনা কখন ফিরবে কে জানে? এখানে দাঁড়িয়ে থাকাটাও অস্বস্তির। লোকজনেরা যাতায়াত করতে করতে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখবে।

    সহেলী চলে যাবে ভাবছিল। হঠাৎ অঞ্জনের ফ্ল্যাটের দরজাটা খুলে গেল। সহেলীকে দেখে ভীষণ চমকে গেল অঞ্জন। কিছুক্ষন আগে কেউ দু'বার কলিং বেল বাজিয়েছিল, অঞ্জন ভেবেছিলো বোধহয় রমেশ এসেছে। কারণ ওর একটা গাড়ির টেস্ট ড্রাইভের ব্যাপারে আসবার কথা ছিল।

    --একি তুমি?

    সহেলীর তো এখন আসার কথা ছিল না, তাকে তো বিকেলে আসতে বলেছিল। সহেলীকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে সোজা দরজাটা বন্ধ করতে করতে বললো, "একটু দাঁড়াও, আমি আসছি।" সহেলীর মুখের উপরে দরজা বন্ধ করে ভিতরে ঢুকে গেল অঞ্জন। ওই সামান্য সময়েই সহেলী দেখতে পেল একটা হাইহিল লেডিস জুতো খোলা রয়েছে দরজার পাশে। কার জুতো ওটা? তবে কি রাকার? কাজের বৌটা বললো, অঞ্জন ফ্ল্যাটে নেই। অথচ সে নিজেই দরজা খুললো। তাহলে? বৌটা কি মিথ্যে বললো? চাবি হারানোটাও কি গল্প?


    (১৯)

    সহেলীর মাথার মধ্যে আগুন জ্বলছে। কে আছে ভিতরে তাকে দেখতেই হবে। পাগলের মতো কলিংবেল বাজিয়ে যাচ্ছে সে। তবুও অঞ্জন দরজা খুলছে না দেখে, সে দরজায় ধাক্কা দিতে শুরু করলো। অঞ্জন দরজাটা খুলতেই সে হুড়মুড়িয়ে ভেতরে ঢুকে পড়লো।

    --কে আছে ভেতরে? আমাকে ঢুকতে দিচ্ছিলে না কেন?

    --কই, কেউ তো নেই।

    --তবে জুতো কার?

    সহেলীও অবাক হয়ে গেল। জুতোটা তো নেই ওখানে। কিন্তু ও তো একটু আগেও দেখেছিলো। কি আশ্চর্য। কোথায় গেল জুতো জোড়া।

    সহেলী ছুটে ঢুকে পড়লো অঞ্জনের বেডরুমে। এখনো দুটো কাঁচের গ্লাসে অর্ধেকটা হুইস্কি পড়ে আছে। বিছানার চাদর এলোমেলো। সহেলী টেনে খুলে ফেললো ওয়ার্ডরোব--ভিতরে কেউ নেই। তাহলে? অঞ্জন চেপে ধরতে চাইলো সহেলীকে। জোর করে তার হাত ছাড়িয়ে সে হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়লো অ্যাটাচ বাথরুমে। আধো অন্ধকারে দেখতে পেল সে রাকাকে। সে চিৎকার করে উঠলো, "তুই এখানে, হতচ্ছাড়ি। দাঁড়া তোর কি করি দেখ।"

    সহেলী রাগে উন্মাদ হয়ে লম্বা ডাঁটিওলা মপটা হাতে নিয়ে তেড়ে যায় রাকার দিকে। কিন্তু কিছু করার আগেই কে যেন তার মাথায় ভারী কিছু দিয়ে সজোরে আঘাত করলো। সহেলীর চোখ দুটো অন্ধকার হয়ে গেল। "আঃ" বলেই জ্ঞান হারিয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়লো সে।

    --একি করলে।

    --চুপ করো। এখন বডিটা সরাতে হবে।

    নাহঃ, আর নিঃশ্বাস পড়ছে না। রক্তে ভিজে গেছে বাথরুমের মেঝে। এখুনি কেউ এসে পড়ার আগেই কোথাও একটা সরাতে হবে বডিটা।


    (২০)

    অঞ্জন একটা ট্রলিব্যাগ বের করলো। রাকা আর সে--দুজনে মিলে সহেলীর বডিটা ট্রলির মধ্যে ঠেসে ঠেসে ভরলো। তারপরে চেন টেনে রেখে দিলো একপাশে। রক্তে ব্যাগ ভিজে যাচ্ছে। এটা নিয়ে বেরোতে গেলে কেউ দেখে ফেলতে পারে। ওদিকে দরজায় কে যেন কলিংবেল বাজছে। বোধহয় সান্ত্বনা দোকান থেকে ফিরে এসেছে।

    দুজনে জল দিয়ে ভালোভাবে সব পরিষ্কার করে নিলো, পাল্টে নিলো রক্তমাখা জামাকাপড়। একটা অপেক্ষাকৃত ছোট ট্রলিব্যাগে অঞ্জন অতি দ্রুত তার নিজের জামাকাপড়, প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুছিয়ে নিলো। সহেলীর মোবাইল ফোন আর পার্সটাও তাতে ভরে নিলো। চারিপাশটা একবার ভালো করে তাকিয়ে দেখে নিয়ে রাকাকে বললো, "চলো। এখনই আমাদের পালাতে হবে।"

    অঞ্জন দরজা খুলতেই সান্ত্বনা চাপা স্বরে বললো, "সেই সহেলী দিদিমনি এসেছিলেন। আমি বলেছি, আপনি বাড়ি নেই। চাবি আনার ছল করে আমি ওনাকে তাড়িয়েছি।"

    --ঠিক আছে। এখন আমরা বেরোচ্ছি। ফিরতে কয়েকদিন সময় লাগবে। চিকেন পকোড়াগুলো নিয়ে তুমি এখন বাড়ি চলে যাও। আমি ফিরে এসে তোমাকে ফোন করবো।

    অঞ্জন আর রাকা লিফটে চড়ে দ্রুত নিচে নেমে গেল। পার্কিং থেকে গাড়িটা বের করে নিয়ে ওরা আবাসন ছেড়ে বেরিয়ে গেল। গাড়ি ছুটল বেহালায়, রাকার ফ্ল্যাটের দিকে।


    (২১)

    অঞ্জন অনেকদিন ধরেই প্ল্যান করেছিল রাকাকে নিয়ে সিঙ্গাপুর চলে যাবে। রেজিস্ট্রি ম্যারেজের পর ওখানে গিয়েই হানিমুন করবে তারা। তারপরে ইন্ডিয়াতে ফিরে দিন কয়েক থেকে বারাসাতে ওর পৈতৃক সম্পত্তিটা বিক্রি করে দিয়ে ফিরে যাবে কানাডায়। আর একটা নতুন প্রজেক্ট শুরু হবে ওখানে। ও এবারে ওই প্রজেক্টের ডেপুটি প্রজেক্ট ম্যানেজার।

    অঞ্জনের এখানে থাকার একমাত্র উদ্দেশ্যই ছিল বারাসাতে জমি সমেত বসতবাড়িটা চড়া দামে বিক্রি করে দেওয়া। তাছাড়া, সহেলীর মতো সাধারণ ও বিবাহিতা মেয়েকে বিয়ে করেই বা কি লাভ? যত্তসব ঝুটঝামেলা। তার থেকে বরং ওর সাথে একটু মজা করে নিয়ে ওর থেকে কিছু টাকাপয়সা হাতিয়ে নিতে পারলে লাভ আছে। সহেলীর বাবার যে অনেক টাকা, সেটা অঞ্জন ভালোই জানে।

    দিন পাঁচেক আগে সিঙ্গাপুর যাবার জন্যে ভিসার এপ্লিকেশন করেছিল অঞ্জন ও রাকা। সেটা হাতে এসে গেলেই ওরা দেশ ছেড়ে চলে যেতে পারতো। কিন্তু মাঝখানে এই বিপত্তি হয়ে যাবে তা কে জানতো? এখন পুলিশ কিছু টের পাবার আগেই গা ঢাকা দেওয়া দরকার।


    (২২)

    ছুটির পরে প্রসূন অফিস থেকে বেরিয়ে মনোজিতের সাথে ওর মাসতুতো দাদার চেম্বারে গেল কলকাতা হাই কোর্টের পাশেই কিরণ শঙ্কর রায় রোডে। হেস্টিংস চেম্বারের দোতলায় তাঁর অফিস। মিস্টার অনিমেষ ব্যানার্জী এখন শুধু হাই কোর্টেই প্রাকটিস করেন। ম্যাট্রিমোনিয়াল স্যুট ছাড়াও তিনি অন্যান্য সিভিল কেস করে থাকেন এবং হাইকোর্ট বার এসোসিয়েশনে তাঁর যথেষ্ট পরিচিতি আছে। ক্লায়েন্টের সংখ্যাও নেহাত মন্দ নয়।

    প্রসূনরা যেহেতু আগে থেকে ফোনে জানিয়েছিল, তাই রিসেপশনে বেশিক্ষন বসতে হলো না। দু-চারজন ক্লায়েন্টের পরেই তিনি ওদের ডেকে নিলেন। মনোজিতের পিছনে একটু সসংকোচে দাঁড়িয়ে ছিল প্রসূন।

    ভদ্রলোক একদৃষ্টিতে জরিপ করে বললেন, "ভিতরে আসুন।"

    প্রসূন দেখলো ভদ্রলোকের চওড়া কপাল, কানের পাশে জুলপিগুলোতে পাক ধরেছে। চোখে মোটা চশমা। ঈষৎ স্থুল ভুঁড়িখানা সাদা জামার উপর স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ভদ্রলোক যে বড়োসড়ো চেয়ারে বসে আছেন তার পাশের হাফ রাউন্ড টেবিলের উপরে একটি মেয়ের চোখবাঁধা মূর্তির হাতে একটি দাঁড়িপাল্লা, তার পাশে কতগুলি ঠাকুর-দেবতার ছোট ছোট ছবি, আর একটা বড় ডাইরি। ভদ্রলোকের পিছন দিকে দেওয়াল জুড়ে শো-কেসে আইনের মোটা মোটা বই। অন্যদিকে দেওয়ালের একপাশে একটি স্টিল র‍্যাকে প্রচুর ব্রিফ সাজানো।

    অ্যাডভোকেট সাহেবের উল্টোদিকের চেয়ারে ওরা দুজনে বসলো। এবারে ভদ্রলোক মনোজিতের দিকে তাকিয়ে বললেন, "কি খাবি বল? চা না কফি?"

    --এখন শুধু চা-ই বলো।

    ভদলোক টেবিলের উপরে রাখা একটা বেল বাজিয়ে দিলেন। তারপরে প্রসূনের দিকে তাকিয়ে বললেন, "হ্যাঁ, বলুন, আপনার সমস্যাটা কি?"

    প্রসূন একটু চুপ করে আছে দেখে মনোজিৎই ওর সমস্যার কথাটা সংক্ষেপে বলতে যাচ্ছিলো। ভদ্রলোক হাত তুলে থামিয়ে দিলেন, "তুই চুপ কর। ওনার সমস্যাটা ওনাকেই বলতে দে।"

    প্রসূন মনে মনে নিজেকে একটু গুছিয়ে নিয়ে সব বললো একে একে। ভদ্রলোক সব শুনে বললেন, "তার মানে এই বিয়েতে আপনারও ঠিক মত ছিল না...তাই তো? হয়তো মেয়েটির দিক থেকেও কোনো আপত্তি থেকে থাকতে পারে। এখন আপনারা ঠিক কি চাইছেন? মানিয়ে নিতে? না কি মিউচুয়াল ডিভোর্স?"

    --আমি ডিভোর্সই চাই। এভাবে আমিও থাকতে পারছি না। স্ত্রী যদি স্বামীর সঙ্গে কোনো সম্পর্ক না রেখে অন্য পুরুষ নিয়ে ঘুরে বেড়ায়।

    প্রসূনের গলায় ক্ষোভ ঝরে পড়লো। সে মাথাটা নিচু করে বসে রইলো।


    (২৩)

    রাকার ফ্ল্যাট থেকে জিনিসপত্র বলতে সামান্য কিছু জামাকাপড়, টাকাপয়সা আর দরকারি কাগজপত্র নিয়ে ওরা আবার গাড়িতে গিয়ে উঠলো।

    গাড়ি চালাতে চালাতেই মোমিনপুরের একটি জানাশোনা ছেলেকে ফোন করে অঞ্জন দুটো সিমকার্ড জোগাড় করে নিলো। একেবারে নতুন, ছেলেটা কোথাও থেকে ম্যানেজ করে দিলো।

    হাওড়ার একটি মোবাইল শপ থেকে সে-দুটো কালেক্ট করে ওদের গাড়ি সোজা চললো বোলপুরের উদ্দেশ্যে।

    রাকার এক পিসিমা বোলপুরে থাকেন। আপাততঃ ওনার বাড়িতেই উঠবে ওরা। পিসেমশাই উকিল ছিলেন, বছর পাঁচেক আগে তিনি গত হয়েছেন। এখন পিসিমা একলাই থাকেন। একমাত্র ছেলে সুরজিৎ বিদেশে, কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার। রাকা ফোন করে জানিয়েছে যে, সে বিয়ের নেমন্তন্ন করতেই বোলপুরে আসছে। সেই শুনে পিসিমা ভীষণ খুশি হয়েছেন।

    পিসিমাকে গিয়ে কি বলবে, আগে থেকে মনে মনে গুছিয়ে নিচ্ছিলো রাকা। বিশেষ করে দিন কয়েক থাকতে হলে একটা জোরদার কারণ দরকার।

    যাওয়ার সময়ে ওরা বর্ধমানে নেমে একবার খাওয়া-দাওয়া করে নিলো।


    (২৪)

    রাত্রি সাড়ে আট'টা নাগাদ ওরা বোলপুরে পৌঁছলো। শান্তিনিকেতন এখন তো প্রায় শহর, কিন্তু কিছু কিছু জায়গা এখনো বেশ নিরালা, নির্জন আছে। বড় বড় বাগানের মধ্যে ছবির মতো সুদৃশ্য নিজস্ব বাড়িগুলি একটা আলাদা আভিজাত্যের দাবি রাখে। বেশিরভাগ বাড়িগুলির বাসিন্দারাই কেয়ারটেকার রেখে নিজেরা অন্যত্র বিশেষ করে কলকাতা শহরে বসবাস করেন। পৌষমেলা কিংবা বসন্ত উৎসবে ফিরে আসেন সবাই মিলে।

    পিসিমা ওদের ফোন পেয়ে দরজা খুলে দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। গাড়িটা গেটের কাছে পৌঁছতেই একজন কালোমতো লোক ছুটে এসে দরজা খুলে দিলো। গাড়ি বাগানের মাঝখানের রাস্তা দিয়ে সোজা গিয়ে পৌছালো পোর্টিকোর নিচে।

    একজন মেড এসে ওদের ভিতরে নিয়ে গেল। লোকটি অঞ্জনের হাত থেকে ট্রলি ব্যাগ দুটি নিয়ে ওদের পিছু পিছু ভিতরে চললো। সেগুন কাঠের তৈরী মস্তবড় দরজা দিয়ে বাড়ির ভিতরে ঢুকেই ধুলোময়লাহীন মার্বেলের মেঝেতে পা রাখতে গিয়ে দেখলো যেন তাতে মুখ দেখা যাবে। একজন মহিলা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে একটু উঁকি দিয়েই আবার ভিতরে চলে গেলেন। কাজের মেয়েটির পিছু পিছু ওরা সিঁড়ি দিয়ে উঠে দোতলার হলঘরে পিসিমার দেখা পেলো। এতো সুন্দরভাবে সাজানো বাড়ি আধুনিক ফ্ল্যাটবাড়ির বিলাসিতাকে ম্লান করে দেয়।

    রাকা পিসিমার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করছে দেখে অঞ্জন একটু নিচু হয়ে পিসিমার হাঁটু ছোঁয়ার চেষ্টা করলো। পিসিমা বললেন, "থাক থাক বাবা, তোমাকে তো ঠিক চিনলাম না।"

    রাকা তড়িঘড়ি বলে উঠলো, "কি করে চিনবে বলো? ও তো এখানে থেকেই না। এই সামনের ১৮ তারিখে বিয়ের পরেই আমি ওর সাথে কানাডায় চলে যাবো।"

    পিসিমা একটু যেন জরিপ করে নিচ্ছিলেন অঞ্জনকে। রাকা আবার বলে উঠলো, "আসলে আমি এতদূরে একা একা আসতে পারবো কিনা সেই নিয়ে ওর চিন্তা হচ্ছিলো, তাই চলেই এলো আমার সাথে।"

    পিসিমা শুধু বললেন, "ভালো করেছো।"

    রাকা পিসিমার গলা জড়িয়ে ধরে বললো, "তুমি ছাড়া আমার আর কে আছে বলো? সেই তো কোন ছোটবেলায় বাবা-মাকে হারিয়েছি। আর তো কোনো আত্মীয়স্বজনের সাথে যোগাযোগ নেই। ওর অবস্থাও আমারই মতো।"

    পিসিমা বললেন, "তোমরা খুব ভালো সময়েই এসেছো। এখন এখানে বসন্ত উৎসব শুরু হয়ে গেছে। আগামীকাল গিয়ে দেখে এসো। আমি এখন একটু উঠছি। তোমাদের চা দিতে বলে দিচ্ছি।"

    প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই রান্নার দিদি সুদৃশ্য কাপে করে ধূমায়িত চা আর স্যান্ডুইচ নিয়ে ঘরে ঢুকলো। চায়ের সুবাসে ঘরটা যেন ভরে গেল।


    (২৫)

    আজকেও রাত্রি নয়টা বেজে গেল এখনো বৌমার দেখা নেই। সহেলীর শাশুড়ি অধৈর্য হয়ে উঠলো--"কি মেয়েরে বাবা। কোনো একটা চক্ষুলজ্জা নেই। এতো করে বলে দিলাম তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরার জন্য, তবু এতো দেরি করছে।" গজগজ করতে করতে ল্যান্ডফোনের রিসিভারটা তুলে নিলেন। সহেলীর মোবাইল সুইচ অফ। রাগ সামলাতে না পেরে সহেলীর বাপের বাড়িতেই ফোন করলেন।

    ওদিকে একজন মহিলা কণ্ঠে কেউ বললো, "হ্যাল্লো--"

    --সহেলীর মাকে একটু ফোনটা দেবেন?

    --একটু ধরুন, দিচ্ছি।

    বোধহয় ছেলের বৌ হবে, "মা, মা, এদিকে একটু আসুন তো। আপনার ফোন আছে--"

    সহেলীর মা ফোন ধরতেই ওর শাশুড়ি বললো, "দিদি, আপনাকে একটা কথা বলি, আপনার মেয়েকে একটু বলবেন যেন তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরে? আজকেও এখন রাত্রি নয়টা বেজে গেছে, তিনি বাড়ি ফেরেন নি।"

    সহেলীর শাশুড়ির কণ্ঠে উষ্মা ঝরে পড়লো।

    সহেলীর মা একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, "আমি নিশ্চই বলবো দিদি। কিন্তু মেয়ে বড় হয়ে গেছে, বিয়ে হয়ে পরের ঘরে চলে গেছে, এখন কি আর সে আমাদের কথা শুনবে? আপনিই বরং প্রসূনকে বলুন যেন একটু বকাবকি করে।"

    --সে চেষ্টা কি সে করে নি ভেবেছেন? তাতে আমার ওনার মানহানি হয়ে যায়। রাগ করে না খেয়ে শুয়ে পড়েন। আমাদের হয়েছে যত্ত জ্বালা।

    --ঠিক আছে, আমি আজকেই সহেলীর বাবার সাথে কথা বলে দেখছি কি করা যায়। আমিও আর পারছি না দিদি।

    সহেলীর মায়ের গলাটা খুব হতাশ লাগে।


    (২৬)

    পিসিমার বাড়িতে আজ রাতে খাওয়া-দাওয়াটা বেশ ভালোই হলো। বামুনদির রান্নার হাতখানি খুব ভালো। খেতে খেতে রাকা একটু নাক সিঁটকালেও, অঞ্জনের মনে পড়ে গেল বহুবছর আগের স্মৃতি। সেই যৌথপরিবার, মা-জেঠিমা একসাথে পরিবেশন করছে আর দাদু, জেঠু, বাবা, কাকাদের সাথে অঞ্জন তার জ্যাঠতুতো ভাইবোনেরা একসাথে দালানে খেতে বসেছে। তখন যেরকম খাবারের স্বাদ পেতো, ঠিক সেরকম।

    উপর-নিচ মিলিয়ে মোট বারোখানা ঘর। তার মধ্যে একটি হল, নিচে একটি রান্নাঘর। পিসিমা দোতলায় থাকেন, তাঁর ঘরের পাশের দুটি ঘরে রাকা আর অঞ্জনের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে।

    অঞ্জন ঘরে ঢুকে প্রথমেই একটা সিগারেট ধরলো। অনেক্ষন থেকে প্রাণটা আনচান করছিলো। তারপর ট্রলিটা খুলে পাজামা-পাঞ্জাবি বের করতে গিয়েই নজর পড়লো সহেলীর পার্সটার উপরে। ওতে কি কি আছে, দেখার জন্যে বের করতেই সে পার্স খুলে চমকে গেল। এতো টাকা। গুনে দেখলো, সত্তর হাজার।। এতো টাকা নিয়ে সহেলী কি করছিলো? তাহলে কি তাকেই দিতে এসেছিল? সহেলীর মোবাইল ফোনটা সুইচ অফ করে অঞ্জনই ট্রলির ভেতরে ঢুকিয়ে রেখেছিলো। এবারে সেটাকে বের করলো। কিন্তু এটা অন করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। তার চেয়ে বরং...

    অন্ধকারে বাড়ির চারিপাশটা খুব ভালোভাবে বোঝা না গেলেও উপর থেকে অঞ্জন লক্ষ করেছে বাড়ির পিছনের দিকে একটা পুকুর আছে। সহেলীর মোবাইলটা নিয়ে ও খুব সাবধানে পিছনের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। চারিদিকে তাকিয়ে দেখে নিলো ওকে কেউ লক্ষ্য করছে কি না। মনে হচ্ছে, বাড়ির সকলেই শুয়ে পড়েছে। শুধু রান্নাঘর থেকে বাসনের টুংটাং আওয়াজ আসছে। অঞ্জন টিপ্ করে সহেলীর ফোনটা ছুঁড়ে দিলো দূরে। পুকুরের জলে শুধু একটা "ঘপ" করে আওয়াজ হয়ে জলটাকে একটু আন্দোলিত করেই ফোনটা ডুবে গেল। কিন্তু এই ঘটনার সাক্ষী রইলো শুধু একজন, অঞ্জন সেটা জানতেও পারলো না। পুকুরের থেকে একটু দূরে একটা ছোট্ট আগুনের ফুলকি কয়েকবার জ্বললো, নিভলো।

    ঠান্ডা হওয়ার শিরশিরানিতে অঞ্জন অনুভব করলো, এদিকে এখনো বেশ ঠান্ডা আছে। গাছপালা বেশি থাকার কারণেই হয়তো। সে এবারে ঘরে ঢুকে বিছানায় টান টান হয়ে শুয়ে পড়লো। সারাদিন ধকল তো কম যায় নি।


    (২৭)

    রাত দশটা বেজে গেছে, সহেলী এখনো বাড়ি ফেরে নি। প্রসূন সহেলীর বাবাকে ফোন করেছিল। তিনি সম্ভাব্য সমস্ত জায়গায় ফোন করে খবর নিয়েছেন। কিন্তু সহেলী সেখানে কোথাও যায় নি। প্রসূন ভাবছিলো একবার মনোজিৎদাকে ফোন করা দরকার। কিন্তু এতো রাত্রে ফোন করাটা কি ঠিক হবে? সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে সে ফোনটা করেই ফেললো। মনোজিৎদা তখনও শোয় নি। প্রসূনের কথা শুনে সে বললো, "তাহলে তো হাসপাতালগুলোতে একবার খোঁজ করা দরকার। থানাতেও একটা খবর দে। অবশ্য থানায় এতো তাড়াতাড়ি যাস না। আগে সব জায়গায় আর একটু খোঁজ খবর কর।"

    হাসপাতালে প্রসূন আর ওর বন্ধুরা মিলে খুঁজে দেখলো, কোথাও নেই। বাড়িতে বসে সহেলীর শ্বশুরমশাই আর শাশুড়ি-মা ঘনঘন ছেলেকে ফোন করে জানতে চাইছেন, "বৌমার কোনো খোঁজ পেলি বাবা?"

    ওদিকে সহেলীর দাদারা বোনকে চারিদিকে খুঁজতে বেরোলো। সহেলীর মা কাঁদতে কাঁদতে বলেই চলেছেন, "আমার মেয়েটা কোথায় গেল গো। ওগো, ওকে একটু খুঁজে দেখো না গো।" সহেলীর বাবা রেগে গিয়ে ঝাঁঝিয়ে উঠলেন, "কোথায় খুঁজবো তোমার মেয়েকে? দিনে দিনে সে উচ্ছন্নে গেছে। তোমার আস্কারাতেই সে আজ এই রকম হয়েছে।"

    সারা রাত ধরে খোঁজাখুঁজির পরেও যখন সহেলীর খোঁজ মিললো না তখন প্রসূন নিকটবর্তী থানায় মিসিং ডাইরি করলো।


    (২৮)

    তখন রাত বারোটা হবে, কোথাও থেকে ঘড়ির ঢং ঢং আওয়াজ সেটা জানান দিলো। অঞ্জনের ঘুম ভেঙে গিয়েছিলো, পাশ ফিরে শুতে গিয়ে ওর মনে হলো কেউ যেন ওর পাশে শুয়ে আছে।

    ঘুমের ঘোরে, নাইট বাল্বের মৃদু আলোতে হঠাৎ মনে হলো যেন সহেলীর ঠান্ডা, নিষ্প্রাণ দেহটা ওর পাশেই রয়েছে। ভীষণভাবে চমকে উঠে বসে পড়লো অঞ্জন। হাতের কাছেই মোবাইলে টর্চ রয়েছে, সেটাই প্রাণপণে খুঁজে বের করলো সে। কই নাহ্‌। কোত্থাও কেউ নেই। পাশবালিশটাকেই সহেলীর দেহ ভেবে ভুল করেছে সে।

    সারারাত আর ঘুম এলো না অঞ্জনের। চোখ বুজলেই সহেলীর অলীক উপস্থিতি। রক্তমাখা মুখে বিস্ফারিত চোখে যেন তাকিয়ে আছে সে। পাশের ঘর থেকে রাকাকে ডেকে তুলতেও লজ্জা করলো। এরকম পরিস্থিতিতে বহুবছর আগে পড়েছিল সে। তখন অঞ্জনের বয়স দশ বছর। একদিন রাতে বাবা তার মাকে বালিশ দিয়ে শ্বাসরোধ করে খুন করেছিল। কারণ বাবার সাথে অন্য মেয়ের সম্পর্কের কথা তার মা জেনে গিয়েছিলো এবং সে কথা দাদু আর জেঠুকেও জানিয়েছিল। দাদু আর জেঠুর কাছে বকুনি খেয়ে বাবা রাগের চোটে মদ্যপ অবস্থায় ঘুমন্ত মায়ের মুখে বালিশ ঠেসে খুন করেছিল। ঘুমন্ত অঞ্জন মায়ের গোঙানির শব্দ শুনে জেগে যায়। ততক্ষনে মা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে। অঞ্জন সব কিছু দেখে ফেলেছে দেখে বাবা তাকেও গলা টিপে মারতে যায়। কিন্তু অঞ্জন ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয় বাবাকে। খাটে সজোরে মাথা ঠুকে যায় বাবার। পরে ইন্টারনাল হেমারেজে মৃত্যু হয় বাবার। কিন্তু একজন জাঁদরেল উকিলবাবু কেসটা অন্যভাবে সাজিয়ে অঞ্জনকে শাস্তির হাত থেকে রক্ষা করেন। এরপরে অঞ্জন মানসিক রোগের শিকার হয়ে পড়ে। অনেক চিকিৎসা করিয়ে কিছুটা সুস্থ হয় সে। ডাক্তার বলেন, "এই পরিবেশ থেকে ওকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যেতে হবে। নাহলে খুনের স্মৃতি ওকে তাড়া করে বেড়াবে।" তখন দাদু ওকে বোর্ডিং স্কুলে ভর্তির বন্দোবস্ত করেন।

    রাকাকেও এসব কথা কোনোদিন বলে নি অঞ্জন। এগুলি তার জীবনের একান্ত ব্যক্তিগত কালো অধ্যায়।

    অঞ্জন যে 'হিপনোফোবিয়া'-য় আক্রান্ত সেটাও রাকার অজ্ঞাত। রোজ রাত্রে অঞ্জন ওষুধ খায়, ঘুমের, নার্ভের ওষুধ। কিন্তু আজকে তাড়াহুড়োতে সে সেসব আনতে ভুলে গেছে।


    (২৯)

    রাকাও সারারাত ভালো করে ঘুমোতে পারে নি। ঘরের আলো নেভাতেও ভয় করছিলো তার। কেমন এক লহমায় ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো সে নিজের মনের মধ্যেই যেন সাঁতলাচ্ছিলো। সহেলীর সাথে স্কুলজীবন থেকেই বন্ধুত্ব ছিল তার, একসময়ে অঞ্জনের সাথে বাড়াবাড়ি রকমের বন্ধুত্ব নিয়ে রাকার মনে ঈর্ষা জাগলেও সহেলীর বিয়ে হয়ে যেতে সে অনেকটাই নিশ্চিন্ত হয়। মনে করে এবারে তার প্রেমের পথ পরিষ্কার হলো। তাছাড়া সহেলী কোনোদিনই রাকার মতো সুন্দরীও ছিল না। তাই অঞ্জনের আকর্ষণ নিশ্চই তার দিকেই ঘুরে যাবে --মনে করে রাকা। আসলে সে তার একান্ত ব্যক্তিগত জীবনে একেবারেই একা। খুব ছোট বয়সে একটা কার একসিডেন্টে বাবা-মাকে হারিয়ে দিদিমার কাছে বড় হয়েছিল সে। গত দু'বছর আগে তিনিও স্বর্গে গেছেন। তাই তার জীবনে একজন একান্ত নিজের মানুষের অভাবটা রয়েই গেছে।

    রাকা একটা কথা জানতো সহেলীর সাথে অঞ্জনের মেলামেশার কারণটা আসলে অর্থনৈতিক। সহেলী সচ্ছল পরিবারের মেয়ে--ছোট থেকেই দু'হাতে টাকা ওড়াতে অভ্যস্ত, তাই অঞ্জনের সাথে বন্ধুত্বের আর একটা কারণ ছিল সেটাই।

    কিন্তু অঞ্জন কোনোদিন সহেলীকে খুন করতে পারে তা কল্পনাও করতে পারে নি রাকা, হুইস্কির ভারী বোতলটা দিয়ে সহেলীর মাথায় সজোরে আঘাত করতেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ে সে। তারপর তার শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যায়। বোতলটা সামান্য ভেঙেও যায়।


    (৩০)

    সকালে ঘর থেকে বেরিয়েই রাকার সাথে দেখা হয়ে গেল। সেও রেডি হয়ে দোতলার ডাইনিং রুমে যাচ্ছিলো। সেখানে পিসিমা টেবিলে বসে ফল ছাড়াচ্ছিলেন। স্যান্ডুইচ, কফি আর কিছু ফল খেতে খেতে কথা হচ্ছিলো। পিসিমা জিজ্ঞাসা করলেন, "তোরা বিয়ের কেনাকাটা করেছিস?

    অন্যান্য আত্মীয়স্বজনদের নেমন্তন্ন করেছিস?"

    খেতে খেতে রাকা মুখ নিচু করে বললো, "আমার সাথে প্রায় কারোরই কোনো যোগাযোগ নেই, শুধুমাত্র তুমি ছাড়া। তাছাড়া কি কেনাকাটা করবো? রেজিস্ট্রি ম্যারেজ তো।"

    --তা বললে কি হয়? একটা ভালো শাড়িও তো কিনবি।

    --আমি শাড়িটাড়ি পরি না।

    --আরে বিয়ের দিনে শাড়ি পরবি না তো কি পরবি?

    পিসিমা বললেন, "চল, আমি বরং তোকে একটা ভালো শাড়ির দোকানে নিয়ে যাই।"

    --আমি শাড়ি পরি না, বলছি তো।

    --বেনারসি ছাড়া কি বিয়ে হয়? তুই আমার সাথে চল। হরি, ড্রাইভারকে গাড়ি বের করতে বলো।


    (৩১)

    > অনেক জোরাজুরির পর রাকা বেনারসির বদলে একটা কাঞ্জিভরম নিল। পিসিমা বললেন, "তোরা বসন্ত উৎসব দেখে আয়, আমি বরং বাড়ি ফিরে যাচ্ছি।"

    রাকা আর অঞ্জন বিশ্বভারতীর দিকে চললো। পিসিমার গাড়ি লাল ধুলো উড়িয়ে মিলিয়ে গেল পথের বাঁকে।

    শিমুল-পলাশের গাছে গাছে রঙিন ফুল। রাস্তার দু'ধারে বাঁশের ব্যারিকেট। মাঝখানে বিশ্বভারতীর ছাত্র-ছাত্রীরা নৃত্যের মাধ্যমে বসন্তকে বরণ করে নিচ্ছে, চারিদিকে আবির উড়ছে। লোকজনের ঠাসা ভিড়, সবাই বসন্ত উৎসবের দৃশ্য ক্যামেরাবন্দি করতে ব্যস্ত। রাকা আর অঞ্জনের ভিড়ে মিশে থাকা ছাড়া কিছু করার নেই। আনন্দটাকে তারা উপভোগ করতেও পারছে না।

    হঠাৎ একজন শ্যামলা মতো, চশমা পরা, কাঁচা-পাকা চুলওয়ালা ভদ্রলোক ওদের দিকে এগিয়ে এলেন--"আরে রাকা ম্যাডাম না? এখানে কি বসন্ত উৎসব দেখতে না কি?" রাকা মুখ তুলে দেখলো, তাদের কলেজের একজন হিস্ট্রির প্রফেসর। রাকা একটু হাসার চেষ্টা করলো, "হ্যাঁ, ওই আর কি। এখানে একজন আত্মীয়ের বাড়ি এসেছিলাম।"

    --কি আশ্চর্য। এখানে আপনার সাথে দেখা হয়ে যাবে ভাবি নি। যাক ভালোই হলো। তা ইনি কে? আপনার হ্যাসবান্ড বুঝি? নমস্কার নমস্কার। আমার নাম জয়ন্ত বসু, আমি রাকার সাথে এক কলেজে পড়াই। আপনাদের এখানে দেখে যে কি ভালো লাগছে। পরিচিত কাউকে দেখলে বড় ভালো লাগে। ওই যে আমার মিসেস। আর আমার মেয়ে, বুল্টি। ভালো নাম, সংহিতা।

    ভদ্রলোক সত্যিই রাকা আর অঞ্জনকে দেখে উচ্ছ্বসিত। গড়গড় করে কথা বলেই চললেন। অঞ্জন শুধু প্রতিনমস্কার করে চুপ করে আছে। রাকা বেগতিক দেখে বললো, "অনেক্ষন এসেছি। আমাদের এবারে ফিরতে হবে, বুঝলেন। পরে আবার দেখা হবে।" ভদ্রলোক ছাড়বার পাত্র নন। তিনি মোবাইল নম্বর নিয়ে ডায়াল করে, সেভ করে, নিজের হোটেলের অ্যাড্রেস দিয়ে তবে ছাড়লেন।


    (৩২)

    এখানে থাকাটাও নিরাপদ নয় বুঝে রাকা আর অঞ্জন ফেরার সিদ্ধান্ত নিলো। এদিকে একটাও ট্যাক্সি পাওয়া যাচ্ছে না। শেষে একটা টোটোওলা যাত্রী নামিয়ে ফিরে যাচ্ছিলো, তাকেই বেশি টাকা দিয়ে রিকোয়েস্ট করে ফিরে চললো ওরা।

    ওদিকে মোবাইলের সিম কার্ড চেঞ্জ করায় ভিসার ব্যাপারে অম্লান ওদের সাথে যোগাযোগ করে উঠতে পারে নি। অঞ্জন তাকে ফোন করতেই সে বললো, "দাদা, আমি আপনার সাথে অনেকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেছি; কিন্তু ফোন সুইচ অফ বলেছে।"

    --আমার ফোনটা জলে পড়ে গিয়েছিলো, তাই সার্ভিস সেন্টারে দিয়েছি।

    --রাকা ম্যাডামের ফোনও সুইচ অফ ছিল।

    --হ্যাঁ, ওরটা আবার চুরি হয়ে গেছে।

    --দেখুন তো কি কাণ্ড। আমি এদিকে আপনাকে জানাতেই পারছি না যে প্রসেসিং হতে আরো সময় লাগবে। ধরুন সব মিলিয়ে ওই পাঁচ-সাত দিন মতো, আর কি। আগের এপ্লিকেশন-টা রিজেক্ট হলো তো।

    --কি বলছো তুমি, আরো পাঁচ-সাতদিন হলে কি করে চলবে? আমাকে তো এক তারিখের মধ্যে ফিরে এসে আবার কানাডায় যেতেই হবে।

    --অনেক চেষ্টা করেছি দাদা, হচ্ছে না।

    --দেখো টাকাপয়সা দিয়ে কোনোভাবে ম্যানেজ হয় কি না।

    --সে চেষ্টাও করেছি। তবু আর একবার দেখছি।


    (৩৩)

    এদিকে ঈশানীদেবী বাড়ি ফিরতেই পরিচারক হরি এগিয়ে এলো।

    --মা, এই দেখুন। এই ব্যাগটা বাড়ির পিছনের দিকে ওই ঝোপের মধ্যে পড়েছিল।

    --কার ব্যাগ?

    --তা জানি না, তবে কোনো মেয়েছেলের হবে বোধহয়। এই দেখুন এতে একটা ছোট ছবি রয়েছে।

    --ব্যাগে কোনো ঠিকানা বা অন্য কিছু আছে?

    --না, শুধু একটা কার্ড রয়েছে।

    --কই দেখি। এতো ব্যাংকের ডেবিট কার্ড। সহেলী ব্যানার্জি--এই নামে তো কাউকে চিনি না। আর আমাদের বাড়ির পিছনের ঝোপের মধ্যে এটা ফেললেই বা কে? ঠিক আছে, তুই যা। আর এই ব্যাগটা আমার ঘরে রেখে দিয়ে আয়।


    (৩৪)

    --কুকুরটা কেন ওরকম করছে।

    সত্যিই অবাক হওয়ার মতো ব্যাপার। অঞ্জনের ফ্ল্যাটের উল্টো দিকে জয়ন্ত বাবুর ফ্লাট, বহুদিনের বাসিন্দা, সেই আবাসনের শুরু থেকেই। বাড়ির আলসেশিয়ানটাকে নিয়ে রোজই মর্নিং ওয়াক-এ যান, আজ কুকুরটা বাইরে বেরিয়েই অঞ্জনের দরজার সামনে গিয়ে দু'বার কি যেন শুঁকে গলা দিয়ে 'গর গর' করে আওয়াজ করতে লাগলো। চেন ধরে টানাটানি করতেও সে সরে আসতে চাইছে না। কেন এমন করছে। অন্যদিন তো করে না।

    আজ কয়েকদিন ধরে অঞ্জনদের ফ্ল্যাটের দরজা বন্ধ। অবশ্য ছেলেটা একাই থাকে। মাঝে মধ্যে দু-একটা মেয়েকেও আসতে দেখা যায়, বান্ধবী-টান্ধবী হবে বোধহয়। আজকাল কে কার খোঁজ রাখে? সামনাসামনি ফ্লাট হলেও যাতায়াত ছিল না। কখনো সখনো সামনাসামনি দেখা হলে "গুড মর্নিং", "গুড নাইট" জাতীয় বাক্যালাপ হয়েছে।

    কুকুরটাকে জোর করে সরিয়ে আনার চেষ্টা করতেই অঞ্জনের ফ্ল্যাটের দরজায় বেশ কয়েকবার আঁচড়ে দিলো। ইস, একটু পালিশ চোটে গেল বোধহয়। "হেই, টমি। হোয়াট নুইসেন্স আর উ ডুইং?" কুকুরটা এখনো 'ঘর ঘর' আওয়াজ করছে। অদ্ভুত তো।


    (৩৫)

    --মা কেমন আছো? দিন কয়েক হলো কাজের চাপে তোমাকে ফোন করে উঠতে পারি নি। সরি মা। হরিকাকা ঠিকমতো তোমার দেখাশোনা করছে তো?

    --হ্যাঁ রে। আমি একদম ঠিক আছি। তুই ভালো আছিস তো?

    --হ্যাঁ মা, আমি ঠিক আছি। এইসময়ে তো ওখানে বসন্ত উৎসব হচ্ছে, তাই না? তুমি গিয়েছিলে দেখতে? এখন এই শীতের শেষে একদম ঠান্ডা লাগবে না।

    --না রে। জানিস রাকা এসেছে, সঙ্গে ওর হবু বর অঞ্জনও। সামনের ১৮ তারিখে ওদের বিয়ে হবে। রেজিস্ট্রি ম্যারেজ। আমাকে ছাড়া আর কাউকে বলে নি। ওরা এখন এখানেই আছে।

    --তুমি যে কি করো না মা। চেনা নেই, শোনা নেই--একটা অপরিচিত ছেলেকে বাড়ির মধ্যে থাকতে দিচ্ছ? রাকাও তো বহুদিন হলো আমাদের সাথে যোগাযোগ রাখে না। হঠাৎ কোত্থেকে উদয় হলো?

    --ওভাবে বলিস না। হয়তো শুনতে পাবে।

    --শুনুক গে। তুমি ওদের বেশি পাত্তা দিও না মা।

    এরপর মামুলি দু-চারটে কথা বলে সুরজিৎ ফোন ছেড়ে দিলো।


    (৩৬)

    রাত্রে বাড়ি ফেরার সময়ে পাড়ার ক্লাবে একবার সবার সাথে দেখা করতো প্রসূন। আজকাল আর যায় না। সবাই আড়ালে বলাবলি করছে "মোটা পণ নিয়ে বিয়ে করেছিল, এখন বোধহয় বনিবনা হয় নি। বৌটার ওপরে বোধহয় অত্যাচার করতো, তাই বাড়ি থেকে পালিয়ে গেছে। নাহলে কেউ বাড়িছাড়া হয়?"

    ওদিকে সহেলীর মায়ের হার্ট এট্যাকের মতো হয়েছিল। তিনিও নার্সিং হোমে ভর্তি। প্রসূন একবার দেখতে গিয়েছিলো, সহেলীর দাদারা কেউ ওর সাথে কথা পর্যন্ত বলে নি।

    বাড়ি ফিরলেই প্রসূনের মা রোজ একই প্রশ্ন করে, "খোকা, বৌমার কোনো খোঁজ পেলি?"

    প্রসূনের বাবা চিরদিনই চুপচাপ ধরনের মানুষ। তিনি যেন আরও চুপচাপ হয়ে গেছেন। টিভিতে খবরটাও আর শোনেন না। সব সময়ে চুপ করে কি যেন ভাবেন। বোধহয় মনে মনে নিজেকেই দোষারোপ করেন। এভাবে চলতে থাকলে বাবারও একটা কিছু ঘটে যাওয়া অসম্ভব নয়। প্রসূন মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।


    (৩৭)

    লাঞ্চের সময়ে রাকার মনে হল পিসীমা যেন কোন একটা বিশেষ কিছু চিন্তা করছেন। অন্যদিন "কি খাবি?”, “মোচার ঘন্টটা ভালো হয়েছে?”, “রাতে আজ কি রান্না করতে বলবো?" ইত্যাদি নানা কথা জিজ্ঞাসা করেন; আজ সামনে বসে থাকলেও একদম চুপচাপ। হঠাৎ জিজ্ঞাসা করলেন, "তোদের বিয়ের আর কত দেরি?" রাকার মনে হলো, পিসিমা বোধহয় জানতে চাইছেন ওরা আর কতদিন এখানে থাকবে।

    অথচ এখানে আসার পরে পিসিমা নিজেই কত উৎসাহী হয়ে বলেছিলেন, "বিয়ের আগের দিন পর্যন্ত এখানেই থাক। আমিও তোদের সাথে রেজিস্টারের কাছে যাবো, উইটনেসের সই দেব। আর এখানে একটা ভালো দিন দেখে পুরোহিত ডেকে তোদের সিঁদুর দান করাবো।" তাই রাকার মনে হচ্ছে পিসিমা বোধহয় কিছু একটা আঁচ করেই কথাটা বললেন।

    রাকা কিছু বলার আগেই অঞ্জন বললো, "আমাদের আর কয়েক দিনের মধ্যেই ভিসা হয়ে যাবে, তখনি আমরা রেজিস্ট্রি করে নেবো।" রাকা বুঝতে পারছিলো, অঞ্জন মনে মনে চটে গেছে। না হলে এমনভাবে রাকাকে কিছু বলতে না দিয়ে সে আগেভাগে কিছু বলতো না। রাকা দেখলো অঞ্জন তাড়াতাড়ি যাহোক করে খেয়েই উঠে পড়লো। পিসিমা চুপ করে বসেই রইলেন। রাকা মুখ নিচু করে খেয়েই যাচ্ছিলো, পিসিমা যেন একটু স্বগতোক্তির মতো করে বললেন, "বিয়ের আগে এক বাড়িতে থাকাটা ভালো দেখায় না, তাই বলছিলাম আর কি।"

    রাকা কোনো কথার উত্তর না দিয়ে চুপচাপ খেয়ে উঠে পড়লো।

    হাত ধুতে যাওয়ার সময়ে দেখলো অঞ্জন বারান্দায় দাঁড়িয়ে কাউকে ফোনে জিজ্ঞাসা করছে ভিসা পেতে আর কত দেরি হবে।


    (৩৮)

    লিফ্‌ট থেকে নেমেই জয়ন্তবাবু নিজের ফ্ল্যাটের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কিসের যেন একটা ঘ্রাণ নেবার চেষ্টা করলেন। বিশ্রী পচা গন্ধ। কিন্তু গন্ধটা ঠিক কোথা থেকে আসছে তা তিনি বুঝে উঠতে পারলেন না। মিসেস দরজা খুলতেই তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, "তুমি কোনো গন্ধ পাচ্ছ?"

    --হ্যাঁ, একটা পচা গন্ধ আসছে কোথা থেকে। তবে আমাদের বাথরুমের কাছে গেলে আরো জোরে আসছে গন্ধটা।

    --আবাসনের অফিসে জানানো দরকার।

    এই বলে জয়ন্তবাবু আবার লিফটে করে নিচে নেমে গেলেন। নিচে গিয়ে সিকিউরিটিকে প্রথমে বললেন ব্যাপারটা। আবাসনের অফিসে গিয়ে গন্ধের কথাটা জানাতেই তারা বললো যে আজ বিকেলে প্লাম্বার এসেছিলো, সেও ব্যাপারটা নোটিশ করেছে। সে দেখেছে যে, একটা কাক অঞ্জনবাবুদের বাথরুমের জানলায় বসে তারস্বরে চিৎকার করছে, একবার উড়ে যাচ্ছে, একবার এসে বসছে। আর গন্ধটাও ওই জানালার দিক থেকেই আসছে। তবে আবাসনের অফিস থেকে যখন ফোন করা হয়, তখন অঞ্জনবাবুর সাথে কোনো যোগাযোগ করা যায় নি।

    আবাসন কর্তৃপক্ষ ব্যাপারটা যাতে পুলিশকে জানায় সেই পরামর্শ দিয়ে জয়ন্তবাবু ফিরে গেলেন।


    (৩৯)

    ঈশানীদেবী মনে মনে ভাবছিলেন যে, ওদের ভাবগতিক যেন কেমন কেমন। বিয়ে করতে যাচ্ছে আর কয়েকদিনের মধ্যে অথচ রাকার চেহারাতে নতুন বৌয়ের মতো কোনো জৌলুস নেই। দুজনকেই হাসতে দেখা যায় না। সর্বক্ষণ মোবাইল ফোন নিয়ে কি যেন খুটুর খুটুর করে চলেছে। আর হরি বলছিল, অঞ্জনকে সে একটা মোবাইল ফোন পুকুরের জলে ছুঁড়ে ফেলতে দেখেছে। ফোন কেউ জলে ফেলে দেয়? তাও আবার ইচ্ছা করে? ফোনটা কি খারাপ ছিল? তাহলে তো সারিয়ে নিতেও পারতো। কে জানে কি ব্যাপার-স্যাপার। সুরজিতের সাবধানবাণীটাও মনে পড়লো --"চেনা নেই, শোনা নেই --একটা অপরিচিত ছেলেকে বাড়ির মধ্যে থাকতে দিচ্ছ? রাকাও তো বহুদিন হলো আমাদের সাথে যোগাযোগ রাখে না। হঠাৎ কোত্থেকে উদয় হলো?"

    নানান কথা ভাবতে ভাবতে আনমনে তিনি খবরের কাগজটা হাত বাড়িয়ে টেনে নিলেন। রাজনীতির নীতিহীনতা আর চারিদিকে খুনখারাপির খবর পড়তে তাঁর ভালো লাগে না। কিন্তু সম্পাদকীয়, প্রবন্ধ, রবিবাসরীয় গল্প, খেলার খবর পড়তে বেশ ভালো লাগে। এই সেদিন একটা গল্প পড়লেন .... কি যেন নামটা? "প্রতিশোধ" বেশ ভালো লেগেছিলো। কাগজের পাতাগুলো নাড়াচাড়া করতে করতে হঠাৎ চোখ আটকে গেল একটা ছোট ছবির দিকে। আরে। এই ছবিটা যেন চেনা চেনা লাগছে। 'সন্ধান চাই' বিভাগে ছবিটির নিচে নাম লেখা আছে সহেলী ব্যানার্জি, গত শনিবার থেকে সে নিখোঁজ। বাড়ি উত্তর কলকাতায়। বিজ্ঞাপন দিয়েছে প্রসূন ব্যানার্জি; নিচে একটা মোবাইল নম্বর রয়েছে।

    ঈশানীদেবী সঙ্গে সঙ্গে ফোন করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু ফোনটা দু'বার রিং হয়ে কেটে গেল, কেউ ধরলো না। ঈশানীদেবী একটা খামের মধ্যে লেডিস পার্সটা ভরে মুখটা আঠা দিয়ে ভালো করে বন্ধ করলেন। ইন্টারকমে হরিকে ডাকলেন, বললেন, "ড্রাইভারকে বলো গাড়ি বের করতে।"

    গাড়ির শব্দ পেয়ে রাকা গিয়ে বারান্দায় দাঁড়ালো। হরি গেট বন্ধ করছে দেখে তাকে জিজ্ঞাসা করলো, "গাড়ির শব্দ হলো যে, কার গাড়ি?"

    --গিন্নীমা কোথায় যেন গেলেন, বোধহয় পাঠবাড়ী। মাঝে মাঝে পাঠ শুনতে যান কি না।


    (৪০)

    গরদের শাড়ি পরিহিতা সম্ভ্রান্ত পরিবারের বৃদ্ধাকে দেখে থানার ও.সি. একটু অবাক হলেন। মুখে বললেন, "বসুন, আপনার কি সমস্যা?"

    বৃদ্ধা কিছু না বলে তাঁর ব্যাগ থেকে আজকের খবরের কাগজটা বের করে টেবিলের উপরে মেলে 'সন্ধান চাই' বিভাগে সহেলীর ছবিটা দেখালেন, তারপরে সেই মুখবন্ধ খামটি তুলে দিলেন ও.সি.র হাতে।

    --পার্সটা কোথায় পেয়েছেন?

    --আমার বাড়ির পিছনের ঝোপের ভিতরে। আমার পরিচারক হরি এসে দিয়েছে গতকাল সকালে। কিভাবে এটা এলো, সেটা আমি বুঝে উঠতে পারছি না। তবে আজকের কাগজে এই 'সন্ধান চাই' বিভাগে মেয়েটির ছবি দেখে আমি চমকে উঠি। তাই ছুটে এসেছি আপনার কাছে। যদি কোনো সন্ধান পাওয়া যায় এই ভেবে।

    --খুব ভালো করেছেন আপনি। আপনার বাড়ির চারিদিকে লোকবসতি কেমন?

    --খুব বেশি ঘনবসতি নয়। সব বাড়িগুলোই উঁচু পাঁচিল দিয়ে বা মজবুত বেড়া দিয়ে ঘেরা । সামনে বাগান ইত্যাদি আছে। বেশিরভাগ বাসিন্দারাই বাইরে থাকেন। পৌষমেলা বা বসন্ত উৎসবে আসে। আমার বাড়ির সামনের রাস্তা থেকে কিছু ছুঁড়লে বাড়ির পিছনের ঝোপে গিয়ে পড়ার কথা নয়।

    --বাড়িতে ইদানিংকালে কেউ এসেছিলো?

    --আমার বাড়িতে দুজন গেস্ট রয়েছে। তারা কলকাতা থেকে এসেছে।

    --কবে এসেছেন তাঁরা?

    --গত শনিবারে সন্ধেবেলায়।

    ও.সি. দেখলেন বিজ্ঞাপনে হারিয়ে যাওয়া মেয়েটিও গত শনিবার থেকেই নিখোঁজ। সঙ্গে সঙ্গে তিনি উঠে পড়লেন। বললেন, "চলুন, আপনার বাড়িটা একবার দেখে আসা যাক।"


    (৪১)

    পুলিশ এসে ফ্ল্যাটের দরজা ভেঙে ঢুকে চারিদিক খুঁজে শেষে বাথরুমের ভিতরে পেয়েছে একটা মেয়ের পচাগলা দেহ। কি সাংঘাতিকভাবে ট্রলিব্যাগের মধ্যে দুমড়ে-মুচড়ে বডিটাকে ঢোকানো হয়েছিল। ঘটনার ভয়াবহতা দেখে সবাই তাজ্জব। বিশেষ করে উল্টোদিকের ফ্ল্যাটে থাকা জয়ন্তবাবু, যিনি আবাসনের অফিসে প্রথম জানান যে, ওই ফ্ল্যাটের ভিতর থেকে দুর্গন্ধ আসছে।

    সান্ত্বনা বলে মেয়েটি কয়েকদিন জয়ন্তবাবুর ফ্ল্যাটেও কাজ করেছিল; তাই তাকে তিনি চেনেন। সে এখন অঞ্জনের ফ্ল্যাটে কাজ করে। পুলিশের কাছে তার নাম বলেছেন তিনি, ওকে ধরতে পারলেও রহস্যের সমাধান হতে পারে। কিন্তু মেয়েটি যাদবপুরের যে বস্তিতে থাকতো, সেখানে খোঁজ করে তার কোনো খবর পাওয়া যায় নি।

    সারা আবাসন জুড়ে বিভিন্ন স্থানে মানুষের জটলা আর একটাই আলোচনা, কি করে এমন একটা নৃশংস ঘটনা ঘটে গেল। এমন কু-কর্ম করে একজন এই আবাসন থেকে নির্বিঘ্নে পালিয়ে গেল কি করে।

    মিডিয়ার লোকেদের ভিড় জমেছে। আবাসন কর্তৃপক্ষ বুঝেশুনে উত্তর দিতে অনুরোধ করেছেন সবাইকে। কোনো কোনো টি.ভি. চ্যানেল আর কিছুক্ষনের মধ্যেই এক্সক্লুসিভ নিউজ টেলিকাস্ট করবে।


    (৪২)

    আজ শনিবার, দুপুর দুটোয় অফিস ছুটির পরে বিকেল পৌনে চারটে নাগাদ প্রসূন বাড়ি ফিরেছিল। মুখহাত ধুয়ে টি.ভি.-তে খবরের চ্যানেলটা খুলতেই দেখলো এক্সক্লুসিভ নিউজে দেখাচ্ছে যাদবপুরের একটা আবাসন থেকে একটি মেয়ের পচাগলা দেহ ট্রলির মধ্যে পাওয়া গেছে। এইসব খবর দেখলে শরীরের মধ্যে একটা কেমন যেন অস্বস্তি হতে থাকে। প্রসূন চ্যানেলটা পাল্টে খেলার চ্যানেল দেখতে লাগলো। আজ ইন্ডিয়া-অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট ম্যাচ আছে। বিজ্ঞাপনের বিরতির ফাঁকে আবার নিউজ চ্যানেলে ফিরে এলো। এখনো সেই খবরটাই দেখাচ্ছে। একজন মহিলা সাংবাদিক মাইক্রোফোন নিয়ে বলে যাচ্ছেন, "এই আপন নীড় আবাসনের যে বিল্ডিং-এর তিনতলার ফ্ল্যাটে মেয়েটির দেহ পাওয়া গেছে সেখানকার আবাসিকরা বলছেন, তিনি এখানে প্রায় দিন আসতেন... গত শনিবার দুপুরে তাঁকে এখানে শেষবারের মতো আসতে দেখা গিয়েছিলো..." মিডিয়া একটা কিছু পেলে হয়। চ্যানেলটা চেঞ্জ করতে যাচ্ছিলো প্রসূন, হঠাৎ একটা কথা শুনে তার হাতটা অবশ হয়ে রিমোটটা পড়ে গেল। "...মেয়েটির পরনে ছিল হালকা সবুজ শাড়ি, গলায় সোনার চেনে যে পেন্ডেন্টটি ছিল তাতে মনোগ্রাম করে লেখা আছে "সহেলী"...আর এর থেকে অনুমান করা হচ্ছে তাঁর নাম ছিল 'সহেলী'। এখন পুলিশ ঘটনার তদন্ত করে দেখছে এখানে তিনি কেন আসতেন এবং ওই ফ্ল্যাটের বাসিন্দার সাথে তাঁর কি সম্পর্ক ছিল, ... এই যে প্রতিবেশী ভদ্রলোক জয়ন্ত সেন কি বলছেন, শুনুন। বলুন জয়ন্তবাবু।" মহিলা সাংবাদিক মাইক্রোফোনটা একজন ভদ্রলোকের সামনে ধরলেন। ভদ্রলোকের পাশেই দাঁড়িয়ে একটা মস্তবড় আলসেশিয়ান।

    প্রসূন চেঁচিয়ে উঠলো, "মা, মা।"

    প্রসূনের মা সুতপাদেবী ছুটে এলেন, "কি হয়েছে? এমনভাবে চিৎকার করছিস কেন?"

    --মা, সহেলী মারা গেছে।

    --কি বললি। সহেলী মারা গেছে?

    সুতপাদেবী যেন আর্তনাদ করে উঠলেন। হাত থেকে পড়ে ভেঙে গেল চায়ের কাপটা।


    (৪৩)

    অম্লান ফোনে জানালো যে ভিসা হয়ে গেছে। আগামীকাল রবিবার। সোমবারে সে দিতে পারবে। অঞ্জন যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। ওকে অনেক ধন্যবাদ দিয়ে ফোনটা ছেড়ে ফেসবুকের আপডেট চেক করতে গিয়েই সে চমকে উঠলো। সব জানাজানি হয়ে গেল তাহলে।

    অম্লানের উপরে সব থেকে বেশি রাগ হচ্ছে। কেন যে ওকে ভিসার দায়িত্ব দিয়েছিলো। রাকার ঘরে উঁকি দিয়ে দেখলো সে কোনো একটা ম্যাগাজিনের পাতা ওল্টাচ্ছে। তার মানে সে এখনো খবরটা দেখে নি। পিসিমার ঘরের দরজা বন্ধ। বাড়ির কাজের লোকেদের কোনো সাড়াশব্দ নেই। বোধহয় সবাই বিশ্রাম নিচ্ছে। অর্থাৎ এখনো ব্যাপারটা কেউ জানে না। এই সুযোগেই পালাতে হবে।

    --রাকা।

    --কে?

    রাকা মুখ তুলে দেখল।

    --রাকা, আমি। চলো, আমাদের এক্ষুনি বেরিয়ে পড়তে হবে।

    --কেন?

    --পরে বলছি সব। তোমার ব্যাগ নিয়ে চটপট নেমে এস নিচে।


    (৪৪)

    ঈশানীদেবীর গাড়ির পিছনে পিছনে পুলিশের গাড়ি এসে দাঁড়ালো বাড়ির সামনে। হরি গেটের কাছেই ছিল। সে বললো, "গিন্নিমা, এই একটু আগেই অঞ্জনদা আর রাকা দিদিমনি চলে গেল গাড়ি চেপে। আমাকে বললো, একটু ঘুরে আসছি। কিন্তু ওদের ব্যাগ নিয়ে গেল।"

    ও.সি. জিজ্ঞাসা করলেন, "কি? পালিয়ে যাবে কোথা? আমরা ঠিক ওদের খুঁজে বের করবোই।"

    তারপরে ঈশানীদেবীর দিকে তাকিয়ে বললেন, "আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ। আমরা এইমাত্র খবর পেয়েছি যে সহেলী মেয়েটি শুধু হারিয়েই যায় নি, তাকে খুনও করা হয়েছে।"

    পুলিশের গাড়ি ধুলো উড়িয়ে চলে গেল। ঈশানীদেবী আর হরি দাঁড়িয়ে রইলো বাড়ির সামনে। দু-একজন কৌতূহলী, পথচলতি মানুষ দাঁড়িয়ে দেখছিলো ঘটনাটা।

    ঠিক সেই সময়েই ঈশানীদেবীর মোবাইল ফোনটা বেজে উঠলো, "হ্যালো" বলতেই ওপাশ থেকে একটি পুরুষ কণ্ঠে কেউ জিজ্ঞাসা করলো, "দুপুরবেলায় এই নম্বর থেকে দু'বার কল করা হয়েছিল। কে ফোন করেছিলেন বলুন তো?" ঈশানীদেবী বুঝলেন এই সেই প্রসূন ব্যানার্জী। তিনি বললেন, "ভুল করে কল হয়ে গিয়েছিলো বাবা।"


    (৪৫)

    ন্যাশনাল হাইওয়ে দিয়ে একশোর বেশি স্পীডে গাড়ি ছুটছে তারাপীঠের দিকে। গাড়ি চালাতে চালাতে অঞ্জন হঠাৎ পিছনে লক্ষ করলো একটা পুলিশের গাড়ি যেন সমানতালে ছুটে আসছে তাদের দিকে। তবে কি পুলিশ তাদের পিছু নিয়েছে? সে গাড়ির স্পিড আরো বাড়িয়ে দিলো। পুলিশের গাড়িও স্পিড বাড়িয়েছে। অঞ্জন যতটা সম্ভব দ্রুত চালাতে চেষ্টা করছে। কোথাও থামলে চলবে না। পাশ দিয়ে সাঁ সাঁ করে ছুটে যাচ্ছে বড় বড় ট্রাক, বাস। একবার একটা লরির খুব কাছাকাছি চলে গেল তাদের গাড়ি। আর একটু হলেই ! রাকা বলল, "সাবধানে চালাও।"

    অঞ্জন ভালোই জোরে চালাচ্ছে। আরো একটু স্পিড বাড়ালো। লুকিং গ্লাস দিয়ে দেখলো পিছনে পুলিশের গাড়িটা এখন অনেকটাই দূরে।

    আহমেদপুরের কাছে রেল গেটে এসে দেখলো ট্রেনের জন্য রেলগেট বন্ধ হচ্ছে। অঞ্জন বেশ বিপজ্জনকভাবেই রেলগেট পার হয়ে গেল। একটা বাইকে সামান্য একটু ধাক্কা লাগলো। তবু গাড়ি থামালো না। বাইকের আরোহী নিজেকে সামলে নিয়ে ওদের তাড়া করলো। যতটা সম্ভব দ্রুত ছুটছে ওদের গাড়ি। পিছনে তাড়া করে আসছে বাইকার ও পুলিশ। অঞ্জন দেখলো একটা ছাগল কোথা থেকে রাস্তার মাঝে এসে পড়লো। জোরে ব্রেক কোষতেই গাড়িটা টাল সামলাতে না পেরে একটু কাত হয়ে গিয়ে রাস্তার ধারে উল্টে গেল।

    তীব্র যন্ত্রণার অনুভূতি ও তার সাথে জ্ঞান হারানোর আগে অঞ্জন ঝাপসা চোখে দেখলো আশপাশের ঝুপড়ি দোকানগুলো থেকে হৈ হৈ করে ছুটে আসছে লোকজন। রাকার থেঁতলানো মাথা থেকে গড়িয়ে আসছে রক্তের ধারা। ঠিক যেমন...

    জানালার কাচে অনেক মানুষের মুখ। কেউ বলছে, "এই সর সর, পুলিশ আসছে।"

    কিন্তু একি, সহেলী কোথা থেকে এল! মুখে চাপা হাসি। সেই মেরুন শাড়িটা পরে। হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছে যেন। হাতে একটা গোড়ে মালা নিয়ে এগিয়ে আসছে ... এক পা, এক পা করে!



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ লেখক
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments