রত্না
কদিন ধরেই মনে হচ্ছিল — আজ সব্জি কাটতে বসে হাত কেটে গেল রত্নার। ধারালো বঁটিটা গাজরটাকে দুফাল করে ফেলার পরেও ডান হাতের বুড়ো আঙুলটা রয়ে গেছিল সেখানে। যেন কোন অদৃষ্ট মুহুর্তের অপেক্ষা!
দেবেশের ট্যুর থেকে ফিরতে এখনো দিন চারেক বাকি! তিন সপ্তাহ পরে। পনেরো বছরের যৌথ জীবনে একটানা চার সপ্তাহ একসঙ্গে থাকা হয় কি না কে জানে। তবু দেবেশ ফিরবে বলে অ্যাড্রিনালিন ক্ষরণ হতে থাকে। সম্পর্কটায় তো আর ধুলো পড়তে দেওয়া যায় না।
ব্যাপারটা গত দেড় দু সপ্তাহ ধরে হচ্ছে। প্রথমে আমল দেয় নি, কিন্তু তেতাল্লিশেই যদি রিফ্লেক্স কমে যায় তাহলে তো ভাবনার কথা। আসলে হাত পা যেন নিজের কথা শুনছে না আর মনে হচ্ছে। রত্না ঠিক করল আজকেই সন্ধ্যায় ডঃ বক্সীর সঙ্গে গিয়ে দেখা করবে।
— সমস্যাটা ক দিনের? আগে বলনি তো?
— বুঝতে পারি নি। তা ছাড়া ডঃ বক্সী বলেছিলেন টেস্টগুলো হয়ে যাক।
— কাল যাবে নাকি? আমার কিন্তু চিন্তা হচ্ছে মনা।
— দেব কিচ্ছু হবে না। হর্মোনাল ইমব্যালেন্স ট্যালেন্স বা মেনোপজাল সিনড্রোম হবে হয়তো।
রত্না মাথাটা দেবেশের বুকের কাছে ঘন করে নিয়ে আসে। কতদিন পর যেন দেবেশ তাকে নিজের বুকের মধ্যে মিশিয়ে নিতে চায়। কিছুটা আরামে কিছুটা আশঙ্কায় রত্নার চোখ বুঝে আসে।
— এটাকে এক্ষুনি খুব জটিল কিছু বলা যাবে না। তবে নার্ভগুলোতে বেশ ভাল রকম সমস্যা হচ্ছে বোঝা যাচ্ছে। এক কাজ কর তুমি ডঃ চক্রবর্তীর সঙ্গে গিয়ে দেখা কর! ম্যাক্সে বসেন! নিউরোলজিটা ভাল বোঝেন। সব থেকে বড় কথা হাসপাতাল এখনো ওনাকে বাগ মানাতে পারেন নি।
— কিন্তু ডক্টর বক্সী আমি একা যেতে সাহস পাচ্ছি না। দেবেশকে বললেও ও চিন্তা করবে হয়তো এ সপ্তাহেই আসবে। তবুও...
— ঠিক আছে তুমি ওনার চেম্বারে দেখা কর রবিবার সকালে, হরিশ মুখার্জীতে। আমি বলে দেব।
এরপরের ঘটনাগুলো যেভাবে ঘটার সেভাবেই ঘটতে লাগল। সময় নিয়েও কিন্তু অবশ্যম্ভাবীভাবেই রত্না গতিহীনতার দিকে এগিয়ে যেতে লাগল। প্রথম প্রথম দেবেশ অনেক ছোটাছুটি করছিল। এমন কি দেশের সেরা নিউরোলজিস্ট ডঃ অগ্নিহোত্রীর কাছে মুম্বইয়ের অফিসের সাহায্যে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে ছুটে গেল।
রত্নার দাদা শুভঙ্কর এসে একদিন বলল,
— মা চাইছিল রতু আমাদের কাছে কিছুদিন গিয়ে থাকুক। যদি কিছু ইম্প্রুভমেন্ট হয়...
— দেখো! কিন্তু ডাক্তাররা বলেছে এটা অ্যামায়োট্রফিক ল্যাটেরাল স্ক্লেরোসিস বা এএলএস মানে নার্ভ রিলেটেড একটা সমস্যা। রত্নাকে জিজ্ঞেস করে দেখ... আর ওর যদি মনে হয় তাহলে গিয়ে না হয় মায়ের কাছে থেকেই আসুক। তবে তোমাদের সংসারে হ্যাঙ্গাম হবে না তো? রত্নার দিকে নজর রাখার জন্য সারাক্ষণ কাউকে চাই। ওর তো এখন উঠে একা একা বাথরুমে যেতেও অসুবিধা হচ্ছে।
— না না সে কি কথা? মালতী আছে, কাজের মেয়েটি আছে আর সবার উপরে মা আছে! পঁচাত্তর বছরেও তিনি যথেষ্ট কর্মঠ। আমি বরং রতুকে কাল নিয়ে যাব।
— না সেরকম হলে তো আমিই পৌঁছে দিতে পারি। কাল সকালে একটু দেরীতে যাব না হয় অফিস।
রাতে বিছানায় শুয়ে দেবেশের হাতটা নিজের কাঁপা কাঁপা হাতের মধ্যে নিয়ে অভিমান ভরা গলায় রত্না বলল,
— আমায় সরিয়ে দিচ্ছ দূরে? বোঝা হয়ে যাব, না? দেব?
পরম মমতায় দেবেশ রত্নার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল।
— ঘুমিয়ে পড়! কাল সকালে আবার তাড়া থাকবে!
দীর্ঘশ্বাসটা বুকের ভিতরে নিজের ওজন বাড়িয়ে যেতে লাগল খালি।
নিজের বাড়ি নিজের বাড়ি থাকে। বিয়ের পনেরো বছর পরে অনুভূতিগুলো কেমন আলাদা হয়ে যায়। দাদা বৌদি আর সর্বোপরি মায়ের আন্তরিকতাও কিছুদিন পরেই অনুগ্রহের মতো ঠেকতে শুরু করল রত্নার। তারা কখনই বলে না, কিন্তু ফ্ল্যাটবাড়িতে চারজন প্রাপ্ত বয়স্ক এবং একজন টিনএজার এমনিতেই অনেকটা। তারপর যদি একজন অতিরিক্তের আগমন ঘটে।
বলব না বলব না করে দিন কুড়ি পরে একদিন বলেই ফেলল রত্নাঃ
— মা অনেকদিন তো হল, এবার ফিরে যাই?
— কেন রে মা মন টিকছে না?
— না মা দেব ফিরছে তিন দিন পর। একা বাড়িটা দেখতে কি ওর ভাল লাগবে?
— কিন্তু মা তুইই বা একা কি করে সামলাবি? ট্রিটমেন্টও যা চলছে সে এতই ধীরে যে এরপর কি করবি বুঝতে পারছি না। আমি চোখ বুজলে তারপরে তোর কি হবে সেই ভেবে ভেবে অস্থির হয়ে পড়ি মাঝে মাঝে। ঘুম আসে না চোখে।
— মা, ইচ্ছাশক্তি দিয়ে সব বাধাই জয় করা যায়। আচ্ছা দেব আগে ফিরুক। একটা হুইল চেয়ারের ব্যবস্থা করব না হয়। আর একজন দিনরাতের লোক।
জয়ন্তী
— চলে এলি যে?
— আর থাকা গেল না মা! সব কিছু ছেড়ে দেওয়া যায়! কিন্তু মূল্যবোধ ছাড়া যায় না মা।
— কি করবি এবার? একা একা?
— একা কোথায়? তুমি আছ তো!
— আমি আর কদ্দিন?
— আরে যদ্দিন আছো তদ্দিন তো থাক। আর বেশি ভাবতে পারছি না! ইচ্ছেই করছে না। খালি এই হবে সেই হবে করে তো এই হল শেষ পর্যন্ত।
— সব কিছু চুকিয়ে বুকিয়ে এসছিস? নাকি...
— ও সব কিছু ভেব না মা। খোঁজ খবর নিয়ে নেব। একটা চাকরি আগে ধরতে হবে। পেয়ে যাব ঠিক। এই পৃথিবীর মনোবিদ দরকার প্রচুর পরিমাণে। সব্বাইকে ভাল রাখতে হবে মা।
— এই সংসার একা মেয়েদের কিন্তু খুব একটা ভাল চোখে দেখে না জয়ী।
— ভাল মন্দ নিয়ে কি করব মা? সংসারই রইল না তো ভাল মন্দ। যাক গে বল আজ কি খাবে? চিকেন খাবে? পাঁচশোটা টাকা দাও তো। চাকরি পেয়েই ফেরত দিয়ে দেব। একটু বাজার দোকান করে আনি। আর ঘরের অবস্থা কি করেছ?
— একা থাকি আমার আবার দরকার কি?
জয়ন্তীর দ্বিতীয় ইনিংস, না না তৃতীয় ইনিংস শুরু হল। প্রতিটা খেলার শেষেও কিছুটা খেলা থেকে যায়। নিজেদের যারা ঠিক মতো অ্যাডপ্ট করতে পারে তারাই টিকে যায়। জয়ন্তী বিজ্ঞাপন দেখে আবেদন পাঠানো শুরু করল।
— এখানে আসতে কতটা সময় লেগেছে আপনার?
— দেড় ঘন্টা!
— আপনি রোজ দেড় দেড় তিন ঘন্টা ট্র্যাভেল করে খুশি মনে কাজটা করতে পারবেন?
— স্যার, আমার বয়স এখন পঁয়ত্রিশ। আপনাকে লুকোই নি যে আমার সেপারেশন প্রসিজিওর চলছে। তাও কি গত পাঁচ মিনিটে একবারও আপনার মনে হয়েছে যে আমি অখুশি আছি?
— না, মানে এসব ক্ষেত্রে বোঝা যায় না তো! আর আমাকে আমার ইনস্টিটিউটের স্বার্থও দেখতে হবে।
— স্যার আমি কাজটা ভালবাসতাম বা বাসি। চাকরিটা বিয়ের জন্য ছেড়েছিলাম। এখন সেটাই যখন থাকছে না তখন বাধা নেই কোন। শান্তিতে কাজ করতে পারব।
— দেখুন আপনার স্মার্টনেস আর রেজিউমে আমাকে অন্য রকম ভাবতে বাধ্য করছে। তবুও বাচ্চাদের নিয়ে কাজ তো! আপনি কাছাকাছি কোথাও ফ্ল্যাট বা বাড়ি নিলে ভাল করবেন।
— দেখছি স্যার। আসলে মা একা থাকেন। অবশ্য আরেকটা কথা বলতে পারি, আমাকে নিলে আপনি ঠকবেন না! গুড ডে স্যার।
— গুড ডে।
দিন, ক্ষণ, মুহুর্ত দেখে ঘটনা ঘটে না। আর সাধারণ জীবনে তো আরই নয়। তাই কোন শুভক্ষণ না দেখেই বৈকুন্ঠপুরের আদর্শ অ্যাপার্টমেণ্টের টাওয়ার টু—এর গ্রাউণ্ড ফ্লোরের ফ্ল্যাটে জয়ন্তী বাসা বাধল। ইনস্টিটিউট থেকে সত্যিই আসতে যেতে অসুবিধা হচ্ছিল। মাকে বলতে দেখল মাও খুব একটা ‘কিন্তু কিন্তু’ করল না। বিবাহিত কন্যা ঘাড়ের বোঝা না হলেও ঘাড়ের কাছাকাছি থাকলে কানাকানি চলতে থাকে। তার থেকে এটাই বেশ ভাল হল। জয়ন্তীরও সমস্যা হল না। কাজের আর বাড়ির ঠিক মাঝামাঝি জায়গায় একটা ছোট্ট দু কামরার ফ্ল্যাট।
রত্না
দোতলার রত্নাদের ফ্ল্যাট থেকে রাজিয়ার পক্ষে একা হুইল চেয়ারটাকে নিয়ে নামানো অসুবিধা হয়ে যায়। লিফটেও বিশেষ জায়গা থাকে না আর নীচে নেমেও একটা দু পয়সার সিঁড়ি। কত আর গার্ডকে ডেকে আনা যায়। ওদের বিরক্তিটা বুঝতে পারে বেশ, রত্না তাই রাজিয়াকে বারণই করে দিয়েছে। দেবেশ রত্নাকে একটা পোর্টেবল রিডিং টেবিল কিনে দিয়েছে। ল্যাপটপ আর হাবিজাবি বই আর একটা কিণ্ডল। চোখ ক্লান্ত হয়ে যায়। ব্যালকনিটা বড় না হলেও আজকাল বিকেলের অনেকটা সময় রত্নার সেখানেই কাটে। দেবেশের চাকরিটাও আজকাল ক্লান্তি উৎপাদন করছে বটে। সম্পর্কের ক্লান্তি।
— বৌদি, কাগজের লোক এয়েছে।
— টাকাটা আছে দ্যাখ বসার ঘরের শোকেসের দেরাজে ডাইরিটার মধ্যে। নিয়ে আয়।
— ও আমি ঘাঁটতে পারবু নি কো! তোমাকে নিয়ে আসছি, তুমি দেখে দিয়ে দাও।
— রাজিয়া আমি এখন এখান থেকে নড়ব না। তুই এক কাজ কর, ছেলেটাকে বলে দে কাল সকালে আসতে। টাকাটা তোর হাতে দিয়ে রাখব।
সামনের মাঠটায় ছেলেগুলো দুম দাম বল পেটাচ্ছে। দোলনাটা ফাঁকা থাকে না এই সময়। ব্যালকনিটায় একটা দোলনা লাগানো যায় না? দেবেশকে বলতে হবে। হাতের জোরটা থাকলে ওয়াকিং স্টিক নিয়েই নীচে নেমে যেত সে। দোলনায় বসে থাকত। দুলতো না হয়তো— কিন্তু বসে থাকত।
— রাজিয়া! তোর রান্না হয়ে গেছে?
— হ্যাঁ! কেন? কিছু বানাবো না কি?
— একটু পোস্ত দিয়ে আলুভাজা করবি? শুকনো লঙ্কা ফোড়ন দিয়ে? মুখ মেরে আসছে। পোনা মাছটাও রাতে খাব না আর। এক মাছ আর ভাল লাগে না।
— তা আমি কি করব বল? ছোলেমানের কাচে গিয়ে আমি বাপু অন্য মাছ ভরসা কত্তে পারি নে কো। আমাদের বাড়িতে এই সময় ছোট মাছ ছেয়ে গেচে গো। দিদি! দাদা এলে একবার তোমায় নে যাব।
— আরে তোকে কেউ কিছু বলেছে? আমার ভাল লাগে না সেটাই বলছি।
পৃথিবীটা বেলা শেষের সঙ্গে সঙ্গে ছোট হয়ে আসছে। এই অঞ্চলে বিস্তির্ণ আকাশ বলতে তো শুধু খোলা মাঠটুকুর ছাদ, আর তারপরেই আবার কুঠুরির ঠোকাঠুকি। কিছু কিছু আলো, অন্ধকারের ব্যবধানে আলাদা হয়ে দুলতে থাকে। ঘরে ফিরে যাবার সময় প্রায় হয়ে এল। পশ্চিম আকাশে হয় তো তখনও কিছুটা আবীর রয়ে গেছে, পূবের ব্যালকনিতে খালি তার চলে যাবার রেশ।
— দিদি একটু আসবে! নীচের নতুন দিদিমণি এসেচেন। বলছেন আলাপ করবে।
— কে?
— আরে নিচের ফ্ল্যাটে সে দিন এল না? একাই থাকে গো! বরটর কিচ্ছু নাই!
— আহ তুই বড় বাজে কথা বলিস। আচ্ছা চল আসছি!
জয়ন্তী
সন্ধের দিকে ফেরার সময় জয়ন্তী আজকাল বাড়ির কাছের মার্কেটটা থেকে সবজি—টবজি কিনে আনে। একটা ঠিকে লোক রেখেছে। ভোরবেলা এসে দুটো সবজি করে দিয়ে যায়। রুটিটাও। সন্ধ্যার পরে ওরা লোকাল ধরে ফিরে যায়, তাই আসে না। সবে দেড় মাস হয়েছে আলাপও বিশেষ হয় নি কারুর সঙ্গেই। ইন্সটিটিউটেই থিতু হতে সময় লাগছে। অবশ্য বাচ্চাদের খুব পছন্দ জয়ন্তীর। বাচ্চাদেরও জয়ন্তীকে। এই সব ইনস্টিটিউটে দাঁত ফোটাতে অবশ্যই একটু বেশী সময় লাগে। বহুদিন ধরে ফ্যাকাল্টিরা কাজ করে আসছে মোটিভেট করতে করতে নিজেরাই মোটিভেশন হারিয়ে ফেলে। তবে জয়ন্তী সব কিছুর মধ্যেই হাসি মুখটাকে বজায় রেখেছে। পাঁচিলটা ভাঙব ভাঙব করছে বটে। ততদিন পর্যন্ত বাচ্চাদের নিয়েই থাকতে হবে হয়তো।
ডায়রেক্টর ভদ্রলোক ওকে পছন্দই করেছিলেন মনে হয়। তিনিও বেশ সাহায্য করছেন। বেশ অমায়িক ব্যবহার কাজ নিয়ে কোন সমস্যা না থাকলে কোন ব্যাপারই না। তবে ভদ্রলোকের বোধহয় প্রাইভেট প্র্যাকটিসের রোগ আছে। সেটাকে আজকের পরিপ্রেক্ষিতে দোষও দেওয়া যায় না।
আসলে দোষগুণের বেড়াটা ধুলো মাটিতে ধোঁয়া ধোঁয়া হয়ে যাচ্ছে আজকাল। অম্লানের দোষ ছিল, কিন্তু কতটা? মা বা জয়ন্তীর মাপকাঠিটা আলাদা আলাদা। মা হয়তো মনে মনে ক্ষুণ্ণ কিন্তু মুখে বলেন না কিছুই। ছ মাস তো দেখতে দেখতেই কেটে যাবে। আর তারপর হয়তো আরও ছটা মাস। সর্ষের তেল ইটালিয়ান রান্নায় চলে না বিশেষ।
গেট দিয়ে ঢোকার সময় দেখল মালতী চলে যাচ্ছে।
— কি রে এত দেরী করলি?
— দিদিমণি! চিনি এনেচ?
— না! সে ছাড় না তুই দেরী করলি?
— ও কিচু না গো! কাল বলব! কিন্তু চিনি না আনলে খাবে কি? চিনি ছাড়া চা তো তোমার মুখে রুচবে না গো।
— কেন? একেবারেই নেই?
— হিহিহি তাইলে কি বললাম?
— ও থাক গে! মোতির দোকান থেকে আনিয়ে নিলেই চলবে! নাহলে কারুর বাড়ি থেকে এক কাপ নিয়ে নেব না হয়। দেবে না?
— এখানকার নোকগুলো যেন কেমন কেমন গো দিদি। তবে উপরের বৌদি শুনেচি ভাল। আগে কি ভাল বাজনা বাজাতো গো?
জয়তী মহিলাকে আবছা দেখেছে। বারন্দায় মাঝে মাঝে বসে থাকেন। কিন্তু নিচে নামতে দেখে নি কখনো। আবছা শুনেছে বটে কিন্তু ওসব কথায় জয়ন্তী খুব একটা কান পাতে না। স্বভাবে নেই। না হলে এই সমাজে কান পাতাই দায় হতো। বৃত্তের বাইরের মহিলাদের এখনো সমাজ একটু কিন্তু কিন্তুর চোখ নিয়ে দেখে।
— ওপরের বৌদি চিনি দেবে বলছিস?
— হিহিহি! তোমার মাতায় দুষ্টু বুদ্দি হয়েচে বুইচি। মোতিকে তুমি ফোন কচ্ছ না বুইচি।
— যা পালা! তোর ট্রেন পালিয়ে যাবে এবার। কাল তাড়াতাড়ি বেরবো। শনিবার আয়েশ করে শুনব তোর গল্প। দেখিস বাপু ঘোঁট পাকাস নি কোন।
মালতী কান লাল করে পালাল। গার্ড ছেলেটাকেও দেখতে পেল না। গল্প বোনা হচ্ছে, গল্প বোনা হচ্ছে কোথাও। এভাবেই সুতোয় সুতো জুড়ে গল্প বোনা হয়। সরু সুতো মোটা সুতো পাশাপাশি চলতে চলতেই জট পাকায় আবার খোলে আবার পাকায় আর কখনো কখনো কখনই খোলে না।
ভাল করে ঠাণ্ডা জলে স্নান করে একটা ওভারসাইজড টি শার্ট আর র্যা পঅন পরে উপরের সিঁড়ি ধরল জয়ন্তী। আজকে অন্যবাড়ির চা খেতেই হবে। কাঁহাতক আর কার্ণিশে বসা যায়। ঘরের ভিতরেও তো ঘর রয়েছে একটা!
রত্না আর জয়ন্তী
মেয়েটিকে ভাল লাগল রত্নার। খোলা মেলা ভারহীন, কিন্তু ধারহীন নয়। তবে প্রথম দিন বলে নিজের ব্যাপারে কিছু বলল না হয়তো। তবে এক কাপ চায়ের আমেজে এতো কথা হয় না। আর মেয়েটি ভাল এই হল ব্যাপার।
— শোন রত্না দি, আমি কিন্তু তোমাকে তুমি বলছি। কচ্চি মেয়ে একটা! শখ কত আপনি বলে ডাকব হ্যাহ!
— হাহাহা! না না তুমিটাই বড় আপন আপন লাগে। আর আপন বলার মতো তো বিশেষ কাউকে পাই না। কমিয়ে দিয়েছে আসা।
— যদি কিছু মনে না কর! মানে...
— না না মনে করার কি আছে। এটা তো হয়েছে বছর খানেকের উপর... দেবেশ অনেক চেষ্টা করেছে। কিন্তু তাকেও তো আর ঘরে বসে থাকলে চলবে না। আফটার অল খরচপাতি তো আছেই। সব মিলিয়ে বেশ অনেকটা। আর আমার ওষুধ পত্র তো রয়েইছে। উন্নতি বা অবনতি আর আজকাল অতটা খেয়াল করে দেখি না।
— আচ্ছা তুমি শুনছিলাম ভাল বাজনা বাজাতে? কি বাজনা?
— ওহ এর মধ্যে সে খবর নেওয়া হয়ে গেছে? তা কে বলল?
— আরে আমার কাজের মেয়েটি! সে ছাড়। কি বাজাতে? সেতার না পিয়ানো?
— হুঁ সে আর কি করবে জেনে! একটা সময়...
— এই রত্না দি! প্লিজ তুই করে বলো না!
— আচ্ছা ঠিক আছে। আসলে চট করে তো! যাই হোক আমি সিন্থ বাজাতাম। পড়ে আছে শোবার ঘরের কোণে। হাত নড়ে না তো!
— সময় কাটে কি করে?
— সময়? কে জানে? ভাল কিছু হলে একটু পড়ি। তবে ভাল কিছু কি আর হয়! দেব যখন ফিরে আসে তখন হয়তো একটু ভাল কিছু রান্না টান্না...
— আচ্ছা দাদা কবে আসবেন?
— পরের রোববার তো আসার কথা। এ সপ্তাহে ফোনে কথা হয় নি। ব্যস্ত আছে বোধহয়!
— তাহলে পরশু শনিবার তোমাকে রান্না করে খাওয়াই?
— আমায়? কিন্তু আমি নিচে যাব কি করে? আমার তো...
— আরে দি! পর্বত আর মহম্মদের গল্প শুনেছ তো? আমিই চলে আসব! আর হ্যাঁ! আমার এখানে কিন্তু এসে বেশ লাগল। কয়েকটা কাজ আছে নাহলে আজকেই একসঙ্গে নাচা গানা হত। কাল সকালে বেরনোও থাকে তো! এলাম তাহলে! আসছি জোহরা!
জয়ন্তীরও ভাল লেগছে রত্নাকে। আসলে কেউ যে জয়ন্তীকে দেখে ছুটে পালিয়ে যাচ্ছে না এই ঢের। তবে জয়ন্তী নিতেও পারে। অম্লানকেও তো নিয়েছিল আপন করে। পরিবার সহ। কিন্তু কি হল? কি হল কে জানে? ভাবনাটাকে বেশি এগোতে দিল না আর আজ কয়েকটা বাচ্চার রিপোর্ট এসেছে। একটু পড়ে নিতে হবে।
জয়ন্তী আর রত্না আর দেবেশ
— আরে বাহ তুই তো দারুণ রান্না করিস!
— হুঁ হুঁ বাওয়া কি ভেবেছিলে? সেদিনের মেয়ে এসব আমি পারব টারব না? আরে মোচাটা আরও একটু নাও?
— না রে এর বেশী পারব না! আসলে ফিজিক্যাল কোন নড়াচড়া নেই তো! বেশী খেলে হাঁসফাঁস করি! আর দিস না রাজিয়া।
— ওকে ওকে খাওয়ার ব্যাপারে আমি বিশেষ জোরাজুরি করতে পারি না বাপু। রাজিয়া তুমি নিও কিন্তু। আর কাল দাদা এলে মোচা চিংড়িটা একটু দিও। দাদা খায় তো বাসি?
— আরে ট্রাভেলিং জব। ওসব না খেলে চলবে?
— হ্যাঁ দিও। কাল একটু মায়ের কাছে যাব! না হলে দাদার সঙ্গে দেখা করে নিতাম। তা থাকবেন তো দাদা কদিন?
এই একটা প্রশ্নের উত্তর যার কাছে থাকে, সে পরের দিন এসে হাজির হল। প্রায় তিন সপ্তাহ পরে। তাও নাকি এক—দু দিনের জন্য।
— ট্রান্সফার করে দিল? আর তুমি কিছু জানালে না? বলতেও তো পারতে? ছোট জায়গা আমার ওষুধ পত্তর মেডিকেল অ্যাটেনশন? এসব কি হবে?
— প্রাথমিকভাবে তোমাকে নিয়ে যাচ্ছি না রতু!
অন্য কেউ এসে গেল? নাকি এভাবেই সুতোগুলো ঘষা খেতে খেতে ছিঁড়ে যায়। বেশ কিছু দিন ধরেই মনে হচ্ছিল। রত্না চুপ করে রইল।
পরের দিন দেবেশ একটা আপগ্রেডেড হুইলচেয়ার নিয়ে এল।
— অনেক দাম তো! এর কি হবে?
— কি হবে আর! এই আর কি! মানে রাজিয়া না থাকলেও তুমি এদিক ওদিক করতে পারবে!
— তার আর কোন দরকার আছে?
দেবেশ খরচ টরচ অনেক কিছু বোঝাতে এসেছিল। রত্না বলে নি কিছুই। সম্পর্কটাই আনোনা হয়ে যাচ্ছে।
— নিচের ফ্ল্যাটে জয়ন্তী বলে একটা মেয়ে এসেছে। সেপারেটেড বোধহয়। তোমাকে বেশী চিন্তা করতে হবে না। আমি নিজেই ডঃ চক্রবর্তীর কাছে চেকআপে ওর সঙ্গে চলে যাব। আর ও হ্যাঁ থ্যাংকস ফর দ্য হুইলচেয়ার।
— খরচ টরচ নিয়ে তুমি কিছু ভেব না। আর আমি তো আসবই মাঝে মাঝে!
— সহানুভূতি জানাতে? সে তোমার বাড়ি তুমি আসতেই পার। তবে আমি ম্যানেজ করতে পারব মনে হয়।
দেবেশ চলে গেল। জয়ন্তীর সঙ্গে হালকা হাই হ্যালো। ব্যাস দেবেশ চলে গেল। এক বুক অভিমান, দলা মাখা কষ্ট রেখে চলে গেল। জয়ন্তী কি বুঝলো কে জানে কিন্তু আসা যাওয়ার পরিধি বাড়িয়ে দিল।
এক মাস, দেড় মাস, দু মাস কেটে গেল। দেবেশ ফোনও খুব কম করে। নাকি ভীষণ কাজ এখন। জয়ন্তীকে একদিন রত্না আশঙ্কার কথা জানালো।
— অন্য কেউ এসে গেল নাকি রে? নড়তে পারি না চড়তে পারি না। ফিজিক্যাল নিড বলেও তো কিছু আছে। তাই হয় তো!
— দেখ দি, এসব নিয়ে ভেবে কি করবি? আমি অন্য রাস্তায় যাচ্ছি যেমন তুমি যাবে কি? ক্যান ইউ অ্যাফোর্ড দ্যাট? প্র্যাক্টিকালি ভাবো।
— কি বলতে চাইছিস? আমার আত্মমর্যাদা বলে কিছু নেই?
— না না আই ডিড নট মিন দ্যাট। আমি বলছি তুমি এখন এদিকটায় নজর না দিয়ে সুস্থ হবার কথা ভাব।
— তুই নিজে পারিস? অম্লানের কথা ভুলে গিয়ে নিজের লাইফ নিয়ে বেঁচে থাকতে তুই পারিস?
— না না তা না। আমি পারি না। কিন্তু তারপরেও বেঁচে আছি। মূল কথা হল ওটাকে নিয়ে বেশী ভাবি না। ব্যাক অব দ্য মাইন্ড রয়েছে চিন্তাটা, কিন্তু ঐ পর্যন্তই। মোরওভার আমি তো খোরপোষ দাবি করছি না। নিজে চাকরি করি।
— সেটাই তো আমার সমস্যা রে আমার নিজের কিছু নেই রে। কিচ্ছুটি নেই!!!
কান্না ভেজা মাথাটা আশ্রয় নেয় জয়ন্তীর বুকে। রাজিয়া তাকিয়ে থাকে। কি যেন আশঙ্কায়! রাত্রি নামে। বিচ্ছিন্ন তিন নারী এক ছাতের তলায় অন্ধকার নিয়ে বেঁচে থাকতে তৈরী হয়।
রাজিয়া
রাজিয়া শেখকে তার বর সুলতানা বলে ডাকত। কিন্তু তাই বা কদ্দিন? তিন বছর—সাড়ে তিন? তারপর সন্তানহীন দম্পতির মাঝের দেওয়ালটা বাড়তে বাড়তে বাঁচার জায়গা ছোট করে ফেলে। রাজিয়া কাজ করতে বেরিয়ে পড়ে। পেট চালাতে হবে তো!
সেদিন সকালে রাজিয়া জানলা দিয়ে দেখল, মালতী কেমন হেসে হেসে রাতের বেলার গার্ড রতনের সঙ্গে কথা বলছে। এত দূর থেকেও চোখের ঝিলিক দেখতে পেল তার। নিজের গালে কপালে চিবুকে হাত বুলোতে বুলোতে জানলার কার্ণিশের দিকে চেয়ে রইল সে। কোকিলের বাচ্চা পাড়ার সময় হয়ে গেছে। কাকেরও বোধহয়। কাজ গুছোতে ভিতরে চলে যেতে গিয়ে দেখল দিদি কেমন কুঁকড়ে শুয়ে রয়েছে। আজকাল গলার কাছে কিছু একটা আটকে আটকে যায় দিদির। কথা বলতে গেলে হাঁফিয়ে পড়ে। কাশি দম আটকানো সবই সঙ্গী হয়েছে।
একটা চোঙার মতো কি একটা জয়ন্তী দি কিনে এনেছে। পাড়ার মোড়ের দোকান থেকে মাঝে মাঝেই তার ওষুধ নিয়ে আসে রাজিয়া। আজ সকালে বাজারে বেরিয়ে দেখে সে দাঁড়িয়ে আছে গেটের কাছে:
— কি ব্যাপার, এইখানে কি করছ?
— তোর কাচে এইচি।
— আমার কাচে? আমার কাচে কেন? আমার কাচে তো কিচু নেই! ওই মেয়েমানুষটা কি তাইড়ে দিয়েচে?
— কাজ নেই আর! মদ খেয়ে মাথাটা ঝনঝন করচিল। কাজে গে একটু চিল্লামিল্লি করে ফেলিচি। সুপারভাইজার বাবু ডেকে বলে দিল আর আসতে হবে নি কো! কোতায় যাব। রাতদিন বসে বসে ভাবি। তোর কতা বড় মনে পড়ে রে সুলতানা।
— নেশা কর?
— কোতায় পাব বল? পয়সা নেই খেতে পজ্জন্ত পাই না। ময়না ছেড়ে গেল। কিচু খেতে দিবি?
— যা চেহারা বানিয়েচ... নেশা কর না বলি তো মনে হয় নে কো। তা একেনে কোন মতলবে এয়েচ আমি কিন্তু বুইয়ে গিচি। মানে মানে কেটে পড় বলচি। নইলে…
— অমন করে বলিসনে সুলতানা। তুই বিশ্বেস কর তোকে ছেড়ে আমি ভাল থাকি নারে। থাকতে পারবুওনি।
— ছাড়ো ছাড়ো! মাল গিলবে বলে পয়সার জন্য এয়ে একন মিষ্টিমিষ্টি কতা শোনানো হচ্ছে। শোনো আমি তোমার কেনা বাঁদি নই এই বললে ফেলে দিবে আর এই বললে ঘরে তুলে নিবে। আর কোনদিন যেন না দেকি এদিকপানে। একানে আমার একটা ইজ্জত আচে কিন্তুক।
পিছনে লোকটার কাকুতি মিনতিকে পাত্তা না দিয়ে রাজিয়া দোকান থেকে ঘুরে এল। গেটের সামনে দেখল মালতী আর রতন। ওকে দেখে একটু কেমন অপ্রস্তুত হয়ে গেল। বাঁকা হাসি ফেলে দিয়েই আবার তুলে নিয়ে বীরদর্পে গটগটিয়ে তাদের সামনে দিয়ে হেঁটে গেল ফ্ল্যাটের দিকে।
রত্না
আজকাল একটা দমবন্ধ করা কষ্ট হয় কথা বলতে গেলে। জয়ন্তী খুব করছে। নিজের বোনও বোধহয় করে না এমন। রাজিয়ার কথা তো ছেড়েই দেওয়া যায়। রত্না ভাবছিল, মেয়েটার নিজের সমস্যা আছে। ওর পাজী বরটা বোধহয় ফেরত এসেছে। মালতীর কাছ থেকে শুনে জয়ন্তী বলেছিল, জিজ্ঞাসা করায় রাজিয়া অম্লান বদনে ‘হ্যাঁ, তো?” বলে দিয়েছিল। আর কখনো কিছু জিজ্ঞাসা করার প্রয়োজন হয় নি।
যাই হোক এরা আছে, তবুও আজকাল যেন সবকিছুতেই এতটা অপরের উপর নির্ভর করতে হয় যে বিশ্রী লাগে।
শুভঙ্কর এসেছিল সেদিন
— তোকে বললাম রতু, আমাদের সঙ্গে থাক। কিন্তু তুই জেদ করে চলে এলি। এখন দেবেশও নেই এখানে। কবে ফিরবে কিছু বলেছে?
— কি খাবে দাদা কফি না কোল্ড ড্রিংক্স?
— ঠাণ্ডা কিছু আছে?
— রাজিয়া! সরবত করে দিই?
— হ্যাঁ ঠিক আছে! কিরে? উত্তর দিচ্ছিস না যে?
— কী?
— বলছি দেবেশ কবে ফিরছে?
— তুমি জিজ্ঞাসা করে নাও না?
— সে তো করতেই পারি, ফোন তোলে না কেন কে জানে?
— থাক করতে হবে না। আমি জানলে নিজেই জানিয়ে দেব।
কথা এগোয় না আর। জয়ন্তী আসে বিকালে।
— তা দু চার দিন ওদের সঙ্গে তো থেকে এলে পার।
— ভাল লাগে না রে আর! আমার আর কিচ্ছু ভাল লাগে না!
— না না শোনো শোনো। গরমের ছুটি আসছে! আমি এদিকটা একটু গুছিয়ে নিই। তারপর আমরা বেড়াতে যাব। তুমি কদিন ঘুরে এস। বলো তো আমি ফোনে কথা বলে ব্যবস্থা করছি। পৌঁছেও দিয়ে আসব।
সেই মতো কথা হয় শুভঙ্করের সঙ্গে। সবাই খুশী খুব। রত্না সেই মতো দিন দশেকের জন্য দাদার বাড়ি যায়। সঙ্গে রাজিয়া।
মা রত্নাকে দেখে অভিমান করেন। আদর করেন। বৌদি, ভাইঝি অপরাজিতা ছুটে আসে। ছোট মাসিও চলে আসে রবিবার। শনিবার দুপুর থেকে নিয়ে গল্প আড্ডা। রত্নার ভালই লাগছিল। কিন্তু গলার কাছের পাথরটা চেপে চেপে বসছিল। নিঃশ্বাস নিতে অসুবিধা। মাঝে মাঝেই উঠে যেতে হচ্ছে। রাজিয়ার চিন্তা হচ্ছিল। গলার আওয়াজটাই কেমন যেন ভেঙে ভেঙে যাচ্ছে। সকলে বুঝতে পারে না। রাজিয়ার অভ্যাস হয়ে গেছে বটে। বাকিরা অভ্যস্ত নয়। সাতটা দিনে বাড়িটাকে হাসপাতালের ওয়ার্ডের মতো বানিয়ে দিয়ে নার্সিংহোমে ভর্তি হল রত্না। জয়ন্তীখবর পেয়ে এল। কিন্তু চুপচাপ। নার্সিংহোম থেকে ফিরে আসতে আসতে রত্নার দিন দশেক লেগে গেল। ছুটিতে যাওয়া যাবে বলেছে ডাক্তার কিন্তু গলার আওয়াজটাকে বাজেয়াপ্ত করে নিয়েছেন তিনি। বেশী কথা বলা যাবে না নাকি!
জয়ন্তী
রত্না দাদার বাড়ি যাবার পর জয়ন্তীর একটু ফাঁকা ফাঁকা লাগছিল। একদিন অম্লান এল, একা, আইনি সংযোগ ছাড়া।
— জয়!
— অম্লান, প্লিজ! আমাকে ওই নামে ডেকে যদি মনে কর দুর্বল করে দেবে তাহলে ভুল ভেবেছ।
— আমি ভুল করেছিলাম। আমি সব কিছু ভুল করেছিলাম মেনে নিচ্ছি।
— মেনে নিয়ে আমার কি উপকার হবে? ভুল তো একা তোমার নয়! আমারও ছিল। কিন্তু সেটা মেনে নিয়ে কি হবে? যাই হোক, আজ বাদে কাল ডেট পড়েছে। এখন এসব বলে বা ভেবেও বিশেষ লাভ নেই।
— জয়... আচ্ছা আচ্ছা জয়ন্তী আমরা কি বন্ধু থাকতে পারি না?
— বন্ধু থাকার জন্য তো আমরা একসঙ্গে যাই নি অম্লান! এখন এ প্রশ্নের কোন মানে হয় না! তোমার আর আমার মধ্যে একটা কিছু ছিল আর এখন সেটা নেই। এই সহজ সত্যটা মেনে নিয়ে নিজের পথে চল। আমিও চলি! এসো বরং!
অম্লান চলে গেলে অন্ধকার নিয়ে একা বসে ছিল জয়ন্তী। মাকে ফোন করলঃ
— মা!
— বল জয়ী! কি হয়েছে?
— মা! কাল ব্যাপারটা হয়ে যাবে।
— কি বলব বল? তোরা এখন বড় হয়েছিস!
— মা! বড় তো তোমাদের হাত ধরে তোমার হাত ধরেই হয়েছি! আমি খালি তোমাকে জানালাম। মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকাটা তো তোমরাই, তুমিই শিখিয়েছ!
— পারলে একবার ঘুরে যাস! হ্যাঁ মা ছুটিটা পড়লে দিন পাঁচেক যাব! তার আগে রত্নাদিকে একটু দেখে আসি!
— আয়!
রত্না ও জয়ন্তী
কথা কমে গেছে রত্নার— জয়ন্তীরও। রত্না জয়ন্তীকে ধরে আছে, জয়ন্তী রত্নাকে। রাজিয়া অত শত কথা বলতে পারে না তবুও অদৃশ্য এক বন্ধনে সেও ধরে আছে দুজনকে। বেড়াতে গেল তারা, সঙ্গে রাজিয়া। সেই কোন শরৎবাবুর কালে পশ্চিম বলতে বাঙালী যেত দেওঘরে। একটা ছোট মতো গেস্ট হাউসের ব্যবস্থা করে নিয়ে জয়ন্তী রত্না আর রাজিয়াকে নিয়ে গেল সেখানে। দিন চারেক। একে অপরের মন খুলে পড়েছে দুজনেই। কে যে কার থেকে বেশী দুঃখী তা বলা যায় না!
রত্নার সমস্যাটা শারীরিক, আবার মানসিকও। দেবেশ মাঝে মাঝে ই—মেল করে। ফোন করলে রাজিয়া ধরে। গুরুগম্ভীর অকাজের কেজো কথা। বেশিদূর এগোয় না। কিন্তু ব্যক্ত করতে না পারার বেদনাটা রত্নার মধ্যে কুরেকুরে মরে।
জয়ন্তীর কোন সমস্যা নেই। সমস্যা কাটিয়ে উঠেছে বলেই মনে করছে সে। অন্ততঃ সেপারেশনটা ওকে অনেকটা হালকা করে দিয়েছে। তবুও কলকল করে বইতে গেলে অনেকটা গভীর খাদ চোখের সামনে ভেসে ওঠে।
— ও দিদি কি হল!
জয়ন্তী রেগে গেছিল, কিন্তু সামলে নিল!
— কাছে থাকবে তো!
— হাত ধুতে গেছিলাম দিদি!
রত্না যেন দুর্বল হাতটা তুলে ডাকার চেষ্টা করছে কাউকে! আওয়াজ পরিষ্কার নয়, উদ্দেশ্যও নয়। জয়ন্তী একবার নামটা করল,
— দেবেশ দা?
বাকি থাকা শক্তি দিয়ে শরীরের বিতৃষ্ণাকে ছুঁড়ে দিল রত্না! তারপর নিস্তেজ হয়ে পড়ল।
দেবেশ আর জয়ন্তী
ব্যালকনিটার কাছে দেবেশ মুখ নিচু করে বসে আছে। কয়েকজন পরিচিতের সহায়তায় ফিরে এসেছে রত্নাকে নিয়ে জয়ন্তী। হাসপাতালে কয়েকদিন খুব টানাটানি। দেবেশকে রত্নার আপত্তি সত্ত্বেও ডেকে এনেছে জয়ন্তী! এখন ভিতরের চেয়ারটায় বসে! তাকিয়ে আছে কিন্তু কিছুই যেন দেখতে পাচ্ছে না। মুখ খুলল দেবেশ,
— আমি পারি নি জয়ন্তী! জানো তো! বড্ড ভালোবাসি, ভালবাসতাম রত্নাকে। কিন্তু আমিও তো মানুষ! আমারও একটা মন আছে!
— দেবেশ দা! দরকার আছে কি কোন? একটা মানুষের অবয়বের বাইরেও একটা মানুষ থাকে! ভিতরের মানুষটা! শরীর কিছুই নয় দেবেশ দা! মানুষটা সব! সেটাই তুমি... নাহ তোমায় দোষ দেওয়া যায়ও না! তুমি মানুষই! ভগবান তো নয়!
— রত্না আমাকে ক্ষমা করতে পারে নি! পারার কথাও না! সারা জীবনটাই হয়তো বয়ে বেড়াতে হবে এই গ্লানি!
— একটা অনুরোধ রাখবে আমার? কটা দিন থেকে যাও! আর তো কটা দিনই!
শুনেছিল— দেবেশ থেকে গেল দিন দশেক!
জয়ন্তী আর দেবেশ
রত্না চলে গেলো। একটা মানুষের শেষ কটা দিন যতটা আলোআঁধারির মধ্যে কাটানো সম্ভব সেটুকুতেই বেঁচে নিয়ে রত্না চলে গেল। জয়ন্তীর বুকের বাঁদিকে কি যেন একটা নেই নেই। হালকা হয়ে গেছে। টনটনে ব্যথা। বাড়িটা ছেড়ে দেবে ভাবছিল। কিন্তু রাজিয়া বলল যখন জয়ন্তীর সঙ্গেই থাকবে, তখন জয়ন্তীও ঠিক করে নিল যে পালাবে না আর। কোথায় পালাবে আর কতদূর।
মানুষ কোথাও না কোথাও বড়ই একা, আবার কোথাও কোথাও চাইলেও একা থাকতে পারে না। রাজিয়াকে নিয়ে তার সংসার শুরু হল কিছুদিনের মধ্যেই। উপরে থাকলেও এই সংসারে রত্নাও কোথাও না কোথাও বেশ ফিট করে গেল। দীর্ঘশ্বাসে নয়, গল্পে আনন্দে খুনসুটিতে রত্না ঢুকে পড়ে দখিনা বাতাসের মতো।
এদিকে দেবেশ বেশ কয়েকদিন ভাবল। একা একা ভাবল। দোনামনা করছিল। কিন্তু সিদ্ধান্ত তো একটা নিতেই হত। স্মৃতির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা চলে না। চলেই এলো সে। ভাংচুর হল না যে তা নয়। তবুও ওই যে— সিদ্ধান্ত তো একটা নিতেই হত। আজকাল সকাল বিকেল দেখা হয় জয়ন্তীর সঙ্গে। হয় তো এক টুকরো হাসি, ‘কেমন আছো?’ ‘ভালো আছি’ টুকু। ব্যাস! তবে দেখা হয় জয়ন্তীর সঙ্গে দেবেশের। রত্নার সঙ্গেও.........