১
রাস্তার একদিকে নয়ানজুলি, পার হয়ে খানিকটা খোলা ঘাস-জমি। রাধাচূড়ার হলুদ পাপড়ি ছড়িয়ে আছে ঘাসের ওপর। ফুরিয়ে যাবার সময় পার হয়ে গেছে অনেকদিন, যাই যাই করেও চলে যেতে পারছে না। রাস্তার অন্যদিকে ক্রেপ মার্টল গাছের সারি, বর্ষার শুরুতে সাদা আর ভায়োলেট রঙের ফুল ধরেছে। সোজা সরল রাস্তাটা পাহাড়ে গিয়ে মিশেছে। মেঘ লেপ্টে আছে পাহাড়ের গায়ে। যে-কোনো মুহূর্তে ঝরে পড়বে সমতলে। এই শহরে বৃষ্টি আসে অঝোরে। দূর থেকে দেখা যায় হাওয়ায় সওয়ার হয়ে বৃষ্টি আসছে। জানলার শার্শিতে ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দ ওঠে। আমার অবশ্য রিমঝিম বৃষ্টি পছন্দ। যে বৃষ্টি পুরোন বন্ধুর মত। রাস্তা দিয়ে সাইকেলে যেতে যেতে নাম ধরে ডাক দিয়ে চলে যায়, বাপি... বাপি...। যার মধ্যে দিয়ে অনায়াসে হেঁটে যাওয়া যায়। জামা যেটুকু ভেজে গায়ে গায়ে শুকিয়ে যায় বেমালুম।
আমার পছন্দ অপছন্দর খেয়াল আর কে রাখে? এখানে একবার বৃষ্টি শুরু হলে আর থামার নামটি নেয় না। যুদ্ধবাজ মানুষের শহর। সবাই দিনরাত লড়ে খাচ্ছে। এমনকি গণপতি উৎসবেও ড্রামে যুদ্ধের বাজনা বাজে, দ্রিমি... দ্রিমি...। বর্ষা শেষ হতে না হতেই গণপতি ঠাকুর এসে পড়বেন। পুজোর প্যান্ডেল বাঁধা হবে। ততদিন আকাশে পাঁশুটে মেঘ আর নিচে বৃষ্টির কুচকাওয়াজ। বর্ষার দু-তিন মাস, বেশিরভাগ দিন আমার মন খারাপ হয়ে থাকে। বন্যাকে ফোনে বললে সে হাসে। তার বর্ষা নিয়ে আমার মত আদিখ্যেতা নেই। সে থাকে উইমেনস হোস্টেলে, শহরের দক্ষিণ প্রান্তে, আমি উত্তরে। দু-জায়গায় কখনও একসঙ্গে বৃষ্টি হয় না। বন্যা বলে, ‘বর্ষাকে এত ভয় পাও কেন? বর্ষা না হলে শহর জল পাবে কোথা থেকে? জল ছাড়া কি মানুষ বাঁচে?’
আমি বলি, ‘জল কি শুধু বাঁচায়, জল মারেও তো! যেমন তুমি আমায়।’
ফোনের ওপার থেকে আমি বন্যার দু-কূল ছাপানো হাসির শব্দ শুনতে পাই, ‘মরা মানুষ কি কথা বলে? বেশ তো ফুট ফুট করে কথা বলছ।’
আমি বলি, ‘পুরোপুরি মরিনি, আধমরা হয়ে বেঁচে আছি। তবে বেশি দিন নয়। তাড়াতাড়ি চলে এস। দেরি করলে আর আমায় খুঁজে পাবে না।’
‘কেন তুমি কি হারিয়ে যাবে?’
‘যেতেই পারি। ইউ এন মিশনের একটা জবের জন্য অ্যাপ্লাই করেছি। কাজটা পেলে টিবেটে পোস্টিং হবে।’
বন্যার বোধহয় অভিমান হল। ফোন রেখে দিল। সমস্যাটা বন্যাকে বোঝাতে পারি না। কাউকেই না। বৃষ্টিজল নিয়ে আর কারো তো এমন মাথাব্যথা নেই। জল যে খেলা করার বস্তু নয় সেই ধারণাটাই নেই কারো। আমার অন্য বন্ধু-বান্ধবদেরও এই ধরনের ঝামেলা নেই। তারা দিব্য আছে। প্রতি শুক্রবার সন্ধেবেলা মেঝের ওপর সতরঞ্চি পেতে গোল হয়ে বসে। মাঝখানে ধুনিতে আগুন জ্বলে। সবাই যজ্ঞের আগুনে হাত সেঁকে নেয়। এক কোল থেকে অন্য কোলে অশ্বমেধের ঘোড়া লাফায়। দীপ্ত আর নীরজ উঁচু গলায় ধর্ম ও রাজনীতি নিয়ে তর্ক করে। দুজনের যুক্তিতেই প্রগাঢ় আত্মবিশ্বাস। শুনে মনে হয় এই মুহূর্তে বর্তমান সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার খোলনলচে বদলে দেওয়াটা ভয়ানক জরুরী। না হলেই সাংঘাতিক একটা কাণ্ড ঘটে যাবে। তাদের আলোচনার মধ্যে আমি হাঁদার মত বসে থাকি। আমার নিজেকে অপরাধী বলে মনে হয়। আমি এই রাষ্ট্র ও জনগণের পরিবর্তিত পরিস্থিতি সম্বন্ধে কিছুই প্রায় জানি না। প্রাজ্ঞ বন্ধুদের তুলনায় আমি নিতান্তই একটি দ্যায়লা করা শিশু।
আচমকা সেসব গুরুগম্ভীর আলোচনা তুচ্ছ করে দেবু স্খলিত কন্ঠে গান গেয়ে ওঠে। পুরনো কোনো হিন্দী সিনেমার গান। বোঝা যায় সে আজকাল মন দিয়ে এফ এম রেডিও শুনছে। তার গলায় ব্যর্থ প্রেমের কান্না ঝরে পড়ে। কত কাল আগে একটি তরুণী তার তরুণ হৃদয় মাড়িয়ে বধূ বেশে চলে গেছে। আজ তার মুখ মনে পড়ে না। কেবল মনে পড়ে তার রাজহংসীর মত গ্রীবা, নত হয়ে যৌবনসরসীর নীরে মুখ দেখত। মাছেরা ঘাই দিলে ঢেউ উঠত, ছলাত-ছল। সেই ঢেউয়ের কথা মনে করে তার চোখ জলে ভেসে যায়। বন্ধুরা বোঝে আজ তার বেশি চড়ে গেছে। তাকে সান্ত্বনা দেবার জন্য একজন ল্যাপটপ খুলে নীল ছবির ক্লিপ দেখায়। নরনারীর অস্বাভাবিক অন্তরঙ্গতা দেখতে দেখতে সে তার অন্তর্লীন দুঃখের কথা ভুলে উৎফুল্ল হয়ে ওঠে।
এক টুকরো কাবাব মুখে তুলে চিবোই। বিস্বাদ লাগে, ছিবড়ে হয়ে যায়। পানীয়র পেয়ালায় ঠোঁট ঠেকাতে ইচ্ছে করে না। মুখের ভিতরটা তিতকুটে হয়ে আছে। আমি ধর্ম বা ধর্মঘট কোনোটাই বুঝি না। অপরিচিত নারী-শরীর আমায় টানে না। কখনও কখনও নিজের ওরিয়েন্টেশান নিয়ে সন্দেহ হয়। বন্ধুদের মাঝখান থেকে উঠে যাই। জানলার ধারে দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরাই। খোলা পাল্লার অনেক নিচে মাটি, রাস্তা। আজ সারাদিন মুষলধারে বৃষ্টি হয়েছে। আপাতত স্থগিত। সমুদ্রে রাতের জোয়ার আসার সময় হল। আবার যদি বৃষ্টি আসে রাস্তায় জল জমে যাবে। হ্যালোজেন মাড়িয়ে একটি মেয়ে হেঁটে যাচ্ছে। মেয়েটাকে আমি চিনি, বাড়িওলার মেয়ে। আমরা কয়েকজন সদ্য চাকরিজীবী ছোকরা এই অ্যাপার্টমেন্টটা ভাড়ায় নিয়েছি। অ্যাপার্টমেন্ট মালিকও এই বিল্ডিঙেই থাকেন। অন্য একটা ইউনিটে। এই রাতবিরেতে একা একা কোথায় যাচ্ছে মেয়েটি? একটু দূরেই হাইওয়ে পার হয়ে খাড়ির সমুদ্র, মাইলের পর মাইল ম্যানগ্রোভ। ম্যানগ্রোভের মধ্যে দিয়ে জলের সুঁড়িপথ গেছে এঁকেবেঁকে। জোয়ারের সময় জেলেদের নৌকো ওই সুঁড়িপথ দিয়ে শক্ত ডাঙায় এসে লাগে। মেয়েটা ওইদিকে হেঁটে যাচ্ছে। কোথা থেকে একটা জোয়ান লোক মাটি ফুঁড়ে উঠে এল। এই বিল্ডিঙের কেউ নয়, আগে কখনও দেখিনি। মেয়েটি কিছুক্ষণ তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে কথা বলল। তারপর পরস্পরের হাত ধরে উল্টো দিকে হাঁটা দিল।
২
বেলা করে ঘুম ভেঙ্গেছে। গত রাতের খোঁয়াড়ি এখনও কাটেনি। উঠে শুনি সকাল থেকে হুলুস্থুল চলছে বিল্ডিঙে। কী যেন নাম ছিল মেয়েটার? শালিনী... কাল রাত থেকে বেপাত্তা। নিচে নেমে দেখলাম বিল্ডিঙের সবাই ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে। বাড়িওলা পাংশু মুখে ওয়াচম্যানের প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে আছেন। ভদ্রলোকের শরীর ভাল নয়। একটা বাইপাস হয়ে গেছে বছর খানেক আগে। সবাই জানতে চাইছে বাড়িতে কোনো ঝগড়া-ঝাঁটি হয়েছিল কিনা। মেয়ের কোনো বিশেষ বন্ধু ছিল কি? অত রাতে মেয়ে বেরোল, বারণ করনি? ভদ্রলোক কাউকে কিছু জবাব দিচ্ছেন না। বেভভুল হয়ে বসে আছেন। আর উদ্বিগ্ন হয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছেন। কয়েকজন খাড়ির দিকে খুঁজতে গেছে। ওয়াচম্যান রাত্রে শালিনীকে নাকি ওদিকেই যেতে দেখেছিল। আমি জানি শালিনী জলের দিকে যায়নি, উল্টো দিকে গেছে। বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে মেয়েটা, নিজের ইচ্ছেয়।
আকাশের মুখ গোমড়া। বৃষ্টি নামবে যে-কোনো সময়। আমি আর দেবু ভিড়ের থেকে একটু দূরে গিয়ে সিগারেট ধরালাম। ধোঁয়ার গন্ধে গন্ধে কোথা থেকে নীরজ এসে হাজির হল, সামনের একটা বিল্ডিঙেই থাকে। শহরতলীর এই নোডটা নতুন ডেভেলাপ হচ্ছে বলে কম ভাড়ায় ঘর পাওয়া যায়। তাই সদ্য চাকরি পাওয়া ব্যাচেলারদের ভিড় বেশি। নীরজ লোক জমায়েত দেখে নেমে এসেছে। আমার প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট টেনে নিয়ে সুখটান দিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘ক্যা হুয়া? কোই মর গয়া ক্যা?’
যেন মরে যাওয়া একটা বিনোদন। সবাই তাই সমবেত হয়ে মজা নিচ্ছে। ওকে ঘটনাটা জানাতেই হাতের ইশারায় সমস্ত উদবেগ নস্যাৎ করে দিয়ে বলল, ‘আরেহ, ছোক্রি খাণ্ডালা গয়ি হোগি, বয়ফ্রেন্ডকে সাথ। মৌসম-হি অ্যায়সা হ্যায় ইয়ার, ক্যা করে?’
বলা নেই কওয়া নেই একটা মেয়ে হারিয়ে গেল। এ কেবলমাত্র মৌসমের চক্রান্ত! সার্চ পার্টি মুখ চুন করে ফিরে আসছে। খাড়ির ধারে কেউ নেই। এমনকি জেলেরাও। সমুদ্রে এখন ভাঁটার টান লেগেছে। জেলেরা মৌরলা মাছ ভাজা দিয়ে পান্তা ভাত খেয়ে ঘুমোচ্ছে। সবাই চিন্তিত মুখে বলল, এবার পুলিসে একটা খবর দিতে হয়। দেবুর পুলিসে খুব ভয়। ওর মায়ের সঙ্গে এক পুলিসের অ্যাফেয়ার ছিল। আজকের কথা নয়। দেবু তখন খুব ছোট... চার পাঁচ বছর বয়স। সেই পুলিস প্রেমিক যখনই বাড়িতে আসত দেবুর মা দেবুকে বাথরুমে আটকে রাখত। দেবুর মা মারা গেছে চার পাঁচ বছর হয়ে গেল। কিন্তু এখনও পুলিস দেখলেই দেবুর প্যান্ট ভিজে যায়। পুলিসের কথা শুনে দেবু শুকনো মুখে বলল, ‘পুলিস মানেই ঝামেলা। আজ আর কাল তো ছুটি। চল, আমরাও খাণ্ডালা ঘাট যাই। যদি মেয়েটাকে খুঁজে পেয়ে যাই...।’
আমাদের এই নোডটা থেকে স্টেট ট্রান্সপোর্টের বাসে খাণ্ডালা পৌঁছোতে ঘন্টা দেড়েক লাগে। রাস্তার দুদিকে সবুজের সমারোহ। অন্তত একান্ন রকমের সবুজের শেড। ঘাট সেকশানে বাসের খোলা জানলা দিয়ে মেঘ ঢুকে আসে। চুল ভিজিয়ে দেয়। বর্ষায় রাস্তা খারাপ বলে পৌঁছোতে একটু দেরি হল। আমি দেবু আর দীপ্ত এসেছি। নীরজও বলেছিল আসবে। শেষ মুহূর্তে আসা ক্যান্সেল করল। ওর কোনো দূর সম্পর্কের রিলেটিভ মেয়েকে নিয়ে আসছে কানপুর থেকে। মেয়েটার নিফটে ইন্টারভিউ আছে। তাদের এয়ারপোর্টে রিসিভ করতে যেতে হবে। নীরজের আগ্রহ দেখে মনে হল, মেয়েটা নিফটে চান্স পেয়ে গেলে নীরজেরও একটা হিল্লে হয়ে যেতে পারে। আমরা আর ওকে আসার জন্য চাপ দিলাম না।
বাস থেকে নেমে একটা সস্তার রিসর্টে রাত কাটানোর বন্দোবস্ত করে আমরা লাঞ্চ করতে ঢুকলাম। চিকেন কারী দিয়ে ভাত মেখে খেতে খেতে দীপ্ত বলল, ‘একটা মুশকিল হয়েছে। শালিনী মেয়েটাকে আমি ভাল করে চিনি না। একটা ফটো সঙ্গে করে নিয়ে এলে ভাল হত। মিলিয়ে দেখতাম।’
দেবু মাথা নিচু করে খাচ্ছিল। অস্ফূটে বলল, ‘আছে তো!’
আমরা দুজনে অবাক হয়ে তাকালাম। দেবু লাজুক লাজুক মুখ করে মোবাইলটা তুলে বাঁ হাতের বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে লক খুলে শালিনীর ছবি দেখাল। শালিনী বাসস্টপে দাঁড়িয়ে আছে... নিচু হয়ে জুতোর স্ট্র্যাপ বাঁধছে... ওষুধের দোকানের কাউন্টারে... হাতে খবরের কাগজ মোড়া প্যাকেট। দেবুর অঙ্গুলি হেলনে শালিনী হাসছে, হাত নাড়ছে। তবে অধিকাংশই প্রোফাইল বা টপ ভিউ। সামনা সামনি ছবি তোলার সাহস পায়নি। দীপ্ত কড়া গলায় বলল, ‘শালা, ছুপা রুস্তম! মেয়েটাকে স্টক করছিলি?’
দেবুর মুখটা কাঁদো কাঁদো হয়ে গেল। বলল, ‘না না, তা কেন? আসলে মেয়েটাকে একদম আমার মায়ের মত দেখতে, তাই...।’
আমরা খাওয়াদাওয়া সেরে রিসর্টে ফিরে একটু ঘুমিয়ে নিলাম। বিকেলে রাজমাচি পয়েন্ট যাব। সেখানে ট্যুরিস্টদের ভিড় হয়। হয়তো শালিনী ও তার প্রেমিকের সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে। ঘুমোনোর আগে বন্যাকে ফোন করলাম। ওকে বলা হয়নি আমরা হঠাৎ করে খাণ্ডালা চলে এসেছি। ওর ফোন আনঅ্যাভেলেবল দেখাল। মেসেজ করলাম, ডেলিভারি হল না। কোথায় আছে কে জানে? ঘরে দুটো সিঙ্গল কট ছিল। একটা এক্সট্রা ম্যাট্রেস পেতে দিয়ে গেছে। দেবু সেটায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করছিল। জিজ্ঞেস করলাম। ‘কী হল তোর?’
দেবু বলল, ‘জানিস বাপি, ওরাংওটাংদের মায়েরা নিজেদের বাচ্চাদের খুব ভালোবাসে।’
নিজের বাচ্চাকে কোন মা না ভালোবাসে? এইসব অসংলগ্ন কথার উত্তর হয় না। বললাম, ‘ফালতু না বকে, ঘুমোতে দে।’
বিকেলের দিকে রাজমাচি পয়েন্টে রীতিমত মেলা বসে যায়। ভ্যালি পার হয়ে উল্টো দিকের পাহাড়ের গায়ে রহিস লোকেদের বিনোদ-বাংলো। খাদের ওপর ঝুঁকলে মেঘ দেখা যায়। হাওয়ায় জলকণা উড়ে এসে চোখের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছিল। শীত শীত লাগছিল। জ্যাকেটের চেনটা বুকের ওপর টেনে তুলে দিলাম। রাস্তার ধারে একটা লোক কাঠকয়লার চুলায় খোসা ছাড়ানো ভুট্টা পোড়াচ্ছিল। দীপ্ত দরদাম করে কিনল। লেবু আর বীটনুন মাখানো ভুট্টা-পোড়া খেতে খেতে আমরা পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসা ঝর্ণা দেখতে থাকলাম। দেবু বলল, ‘কাল সকালে বুসি ড্যাম যাই, চল।’
দীপ্ত পিঠ দিয়ে হাওয়া আড়াল করে একটা সিগারেট ধরিয়ে বলল, ‘ধ্যুর! আমি গেছি, বেকার জায়গা! যত মাতাল-চাতাল লোকের ভিড়। হাফপ্যান্ট পরে, ভুঁড়ির ওপর গেঞ্জি তুলে, জলকেলি করতে করতে মাল খায় আর অশ্লীল চিৎকার করে।’
সন্ধে হয়ে আসছিল। পায়ের নিচে থেকে মেঘ উঠে আসছিল। একটা ছেলে বেশ কিছুক্ষণ ধরে আমাদের আশেপাশে ঘুরঘুর করছিল। ফিরে তাকাতে হাতের মোবাইলটা তুলে দেখাল। একটা নগ্ন মেয়ের ফটো। বলল, ‘চাংলি মুলগী ভাউ... ফক্ত আলী... পাইজে ক্যা।’
ঘুরে একটা গালি দিতে গিয়ে চমকে উঠলাম... মোবাইলে ছবিটা শালিনীর... আজ সকাল থেকে দ্বিতীয়বার মোবাইলের স্ক্রীনে শালিনীর ছবি দেখলাম।
৩
লোকটা তখনও মুখে মিচকে হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। দীপ্ত আমার হাত ধরে টানল। আমি বাধা পেয়ে খিঁচিয়ে উঠে বললাম, ‘কী?’
দীপ্ত আমায় আঙ্গুল তুলে দেখাল। রাস্তার ধারে একটা লাল রঙের ডুকাটি পার্ক করা। তার পাশে সাদা টপ আর ডেনিম জিনসে একটা মেয়ে। বাইকের সীটের ওপর হাতের ব্যাগটা নামিয়ে রেখে দুহাতে চুল উঁচু করে তুলে হেয়ার ব্যান্ড লাগাচ্ছে। বন্যা... বন্যা এখানে কী করছে? বলেনি তো আজ খাণ্ডালা ঘাটে আসবে! বন্যা ডুকাটির রিয়ারভিউ মিররে নিজের মুখ দেখে ঠোঁটে লিপ্সটিক লাগাচ্ছিল। ওকে ঠিক নীল পরীর মত দেখতে লাগছিল। মনে হচ্ছে ডানায় ভর দিয়ে এক্ষুণি উড়ে যাবে। উড়ে গেলে এই পাহাড়, উপত্যকা, গাছ-গাছালির মধ্যে ওকে কোথায় খুঁজব? আমি তাড়াতাড়ি হাত তুলে ওকে ডাকতে যাচ্ছিলাম। দীপ্ত আমার হাত চেপে ধরল। একজন স্মার্ট চেহারার যুবক বন্যার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। ফর্সা, চোখা চেহারা। রাউন্ডনেক টী-শার্টের বুক থেকে সানগ্লাস ঝুলছে। মেঘলা দিনে কেউ আবার সানগ্লাস চোখে দেয় নাকি? পাতি স্টাইল মারার জন্য বুকে ঝুলিয়ে রেখেছে। ছেলেটা মোটরবাইকের ওপর রাখা হেলমেটটা তুলে বাঁ বগলের নিচে রেখে ডান হাত দিয়ে বন্যার কাঁধ বেড় দিল। বন্যা আদুরে কবুতরের মত তার বুকের কাছে সরে এল। তারপর আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে দুজনে তার উলটো দিকে হেঁটে গেল।
পর পর দুটো চমকের ধাক্কায় আমার মাথা টলে গেল। আমি রাস্তার ধারের নিচু পাঁচিলের ওপর বসে পড়লাম। দীপ্ত ওর অর্ধেক খাওয়া সিগারেটটা আমার মুখে গুঁজে দিল। পাশে দাঁড়িয়ে আমার কাঁধটা জোরে চেপে ধরে রইল। আমার ঠিক পিছনেই খাদ। ব্যালান্স হারালে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। আমার মাথা বিলকুল কাজ করছিল না। বন্যা আমায় কখনও ঘুণাক্ষরেও আন্দাজ দেয়নি ওর অন্য কোনো ছেলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়েছে এবং সেই ছেলেটা মেঘলা দিনেও সানগ্লাস পরে ডুকাটি চালায়। আমার কি দৌড়ে গিয়ে একবার ওদের সামনে দাঁড়ানো উচিত ছিল না? সানগ্লাসের ব্যাপারটা ততটা সিরিয়াস নয়। যত নষ্টের গোড়া এই হারামী ডুকাটিটা। তেলের লাইন খুলে হাতে ধরা জ্বলন্ত সিগারেটটা দিয়ে এটার পেট্রল ট্যাঙ্কে আগুন লাগিয়ে দিলে কেমন হয়? মিনিমাম উঠে গিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখা ডুকাটিটার গায়ে একটা লাথি তো মারতে পারি। সেসব কিছুই না করে আমি পাথরের মত চোখে বন্যা আর ওর প্রেমিকের চলে যাওয়া দেখছিলাম। ঠিক তখনই খাদের নিচে থেকে মেঘ উঠে এসে ওদের আড়াল করে দিল। ভাগ্যিস দিল। না দিলে আমাদের খেয়ালই হত না যে দেবু আমাদের সঙ্গে নেই। যে লোকটা মোবাইলে শালিনীর নগ্ন ছবি দেখাচ্ছিল সেও হাওয়া।
দেবু কোথায় গেল? ব্যাটা এক নম্বরের ভীতু। নতুন জায়গায় এসে আমাদের ফেলে একা একা কোথাও যাবে না। দীপ্ত আর আমি ভিড় ঠেলে এদিক ওদিক খুঁজতে লাগলাম। অন্ধকার নামছে, রাস্তার আলোগুলোয় তেমন জোর নেই। দেবু চায়ের গুমটিতে নেই, সিগারেটের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে সিগারেট কিনছে না। নিজেকে মুক্ত করার জন্য কোনও গাছের গুঁড়ির আড়ালে দাঁড়িয়ে নেই। দেবুর মোবাইলে ফোন করলাম। রিং হয়ে হয়ে কেটে গেল। আমরা দুজনেই বার বার চেষ্টা করে থকে গেলাম। দেবু ধরল না। একটা পায়েচলা পথ ঢালু হয়ে নেমে গেছে। সেটা ধরে কিছু দূর গেলাম। পথটা আচমকা একটা ঘাস জমিতে শেষ হয়ে গেল। ঘাসের নিচে ছপ ছপ জল, পার হয়ে খাদ, কিনারে একটা শ্যাওলা ধরা পাথরের বেঞ্চ। কেউ কোথাও নেই। আমরা ফিরে এলাম। দীপ্ত বলল, ‘দেবু নিশ্চয়ই ওই লোকটার পিছন পিছন গেছে। শালিনীর খোঁজ করতে।’
যারা একটা মেয়েকে ফুসলে নিয়ে এসে শরীর ব্যবসায় নামাতে পারে তারা লোক সুবিধের নয়। আরও দল-বল আছে নির্ঘাত। একা একা লোকটার পিছু পিছু যাওয়ার মত বোকামি দেবুর করা উচিত হয়নি। মেয়েটার ওপর যতই টাল থাক ওর বোঝা উচিত ছিল যে বিপদ হতে পারে। এই অচেনা অজানা জায়গায় আমরা ওকে এখন কোথায় খুঁজব? ভীষণ রাগ হচ্ছিল দেবুর ওপর। এই ভাবে আমাদের ফেলে চলে যাবার জন্য। ফিরে এসে আমরা আবার রাস্তার ধারে পাথরের পাঁচিলের ওপর বসলাম। দেবুর মোবাইল আপাতত নেটওয়ার্ক ক্ষেত্রকে বাহার। ডুকাটি বাইকটাকে আর দেখতে পেলাম না। বন্যা চলে গেছে। ভেবেছিলাম আজ না হলেও বন্যা একদিন না একদিন আমার কাছে আসবে। ইদানীং দেখাসাক্ষাৎ কমে আসছিল। দুজনেই নিজেদেরকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। আমি আমার নতুন চাকরি নিয়ে, বন্যা ওর পিএইচডির পড়াশুনো। জল জমতে জমতে কখন বুকের ওপর উঠে এসেছে বুঝিনি। এমন নয় যে জল ছুঁয়ে ছেনে সম্পর্কের একটা অবয়ব তৈরির চেষ্টা করিনি। হয়তো গড়তে ভুল হয়েছিল। কখনও মনে হয়েছে একটা আদল দেখতে পাচ্ছি। আবার ভেঙ্গে গেছে। জল-গড়া সহজ কাজ নয়। টিপ টিপ করে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। আমরা দুজন ছাতা খুলে বসে রইলাম, যদি দেবু ফিরে আসে। আধ ঘন্টা পেরিয়ে গেল। লোকজন কমে আসছে। চায়ের গুমটিটা বন্ধ করার তোড়জোড় করছে। দীপ্ত বলল, ‘দেবু রিসর্টে ফিরে যায়নি তো?’
৪
আমরা জোর পায়ে হেঁটে রিসর্টে ফিরে দেখলাম - না, দেবু ফেরেনি। দীপ্ত আবার দেবুর ফোন ট্রাই করল, স্যুইচ অফ। আমার সাংঘাতিক টেনসান হচ্ছিল। বললাম, ‘থানায় জানালে হয় না?’
‘কী বলবি? দেবুকে কিডন্যাপ করেছে।’
‘না, তা নয়।’
‘দেবু কি একটা বাচ্চা ছেলে যে হারিয়ে গেছে বলে থানায় ডাইরি করবি? ওয়েট করা ছাড়া আমাদের কোনও উপায় নেই।’
‘কতক্ষণ অপেক্ষা করব? যদি কোনও ঝামেলায় ফেঁসে গিয়ে থাকে?’
দীপ্ত আঙ্গুল মটকাল, ‘আর একটু দেখি...।’
আমরা রিসর্টের লাউঞ্জে সোফার ওপর বসে বসেছিলাম। উল্টোদিকের দেওয়ালে আটকানো টিভিটা “মৌসম” খারাপ হবার কারণে সিগ্ন্যাল না পেয়ে আচমকা বন্ধ হয়ে গেল। ঝোড়ো হাওয়ার সঙ্গে তুমুল বৃষ্টি শুরু হল। এই বৃষ্টি বাদলার মধ্যে ডুকাটির সওয়ারিরা নিরাপদে শহরে ফিরে যেতে পেরেছে তো? নাকি আজ রাত্তিরটা ওরা খাণ্ডালার কোনও রিসর্টে কাটিয়ে যাবে। এক ঘরে, এক বেডশীটের নিচে। ঘাড় বেয়ে একটা যন্ত্রণাবোধ মাথায় উঠে চুলের মুঠি চেপে ধরছিল। ঠিক তখনই টং লিং টং লিং করে দীপ্তর মোবাইলটা বেজে উঠল। পাশ থেকে দেখলাম স্ক্রিনে দেবুর নাম ভাসছে।
‘দেবু, তুই কোথায়? ঠিক আছিস তো?’
আমি দীপ্তর কানে ধরা মোবাইলের ওপর ঝুঁকে পড়ে শুনলাম দেবু বলছে ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, চিন্তা করিস না, ফিরছি আধ ঘন্টার মধ্যে।’ আর কিছু বলার আগেই দেবু ফোনটা কেটে দিল। দীপ্ত ফোন রেখে দিয়ে বিরক্ত গলায় বলল, ‘আমরা ফালতুই টেনসান করছি। কথা শুনে তো মনে হল মহারাজ বহাল তবিয়তে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ইররেস্পন্সিবল ইডিয়েট!’
যাক, অন্তত নিশ্চিন্ত হওয়া গেল যে দেবুর কোনও ক্ষতি হয়নি।
দেবু ফিরল পাক্কা দেড় ঘন্টা পরে। ফিরেই কোনও কথা না বলে বাথরুমে ঢুকল। আমরা উৎকণ্ঠা নিয়ে বসে রইলাম। বাইরে থেকে জলের শব্দ শুনে মনে হল চান করছে। সস্তার রিসর্ট। বাথরুমে গীজার নেই। বলেছিল, লাগলে বালতিতে গরম জল দিয়ে যাবে। দেবু বর্ষার রাত্তিরে কনকনে ঠান্ডা জলে চান করছে! আমি আর দীপ্ত মুখ চাওয়া চাওয়ি করলাম। মিনিট পনেরো পরে খালি গায়ে মাথা মুছতে মুছতে বেরিয়ে এসে দেবু বলল, ‘কীরে খাবার অর্ডার করিসনি? খিদে পেয়েছে।’
দীপ্তর আর সহ্য হল না। রাগে ফেটে পড়ল, ‘তোর খিদের মুখে...। কোথায় ছিলি এতক্ষণ? একটা ফোন করতে পারিসনি? হাতে কি পক্ষাঘাত হয়েছিল?’
দেবু কোন উত্তর দিল না। ধপ করে খাটের ওপর বসে পড়ল। আমি দেখলাম ওর চোখ লাল। ভালো করে মাথা মোছেনি। ভিজে চুল কপালের ওপর লেপ্টে আছে। ঘাড়ের কাছে একটা লম্বা আঁচড়ের দাগ। রক্ত ফুটে আছে। আমি ওর কাঁধে হাত রাখলাম, ‘দেবু, কী হয়েছে?’
দেবু চোখের কোণায় জল। অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নিল। বলল, ‘কই, কিছু হয়নি তো!’
‘লুকোস না দেবু। ব্যাপারটা সিরিয়াস। আমার দিকে তাকা, তুই কি শালিনীর খোঁজ পেয়েছিস?’
দেবু সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়ল। আমি আর দীপ্ত উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কোথায় আটকে রেখেছে মেয়েটাকে? তুই আমাদের ডাকলি না কেন?’
দেবু বলল, ‘ওরা সাংঘাতিক লোক। ওদের কব্জা থেকে শালিনীকে ছাড়িয়ে আনা অসম্ভব।’
বললাম, ‘পুলিশে খবর দিই চল। জায়গাটা তো তুই চিনিস।’
দেবু আমার হাত চেপে ধরল, বলল, ‘না... ওদের সঙ্গে পুলিশেরও যোগসাজস আছে।’
দীপ্ত এতক্ষণ মন দিয়ে আমাদের কথাবার্তা শুনছিল। এবার চোখ ছোট করে বলল, ‘ন্যাকামি করিস না দেবু। তুই এখানে বসে বসে কাঁদলে মেয়েটাকে উদ্ধার করা যাবে না।’
দেবু চোখে হাত ঘষল, ‘কে বলল আমি কাঁদছি?’
দীপ্ত ভেংচি কেটে বলল, ‘না, তুই কাঁদছিস না, তোর চোখে জয় বাংলা হয়েছে। এখন ওঠ, পুলিশের কাছে চল।’
দেবু রুখে উঠল, ‘তোর ইচ্ছে হলে তুই পুলিশের কাছে যা, আমি যাব না।’
আমি দেবুকে বোঝাতে গেলাম, ‘দেবু, মেয়েটাকে দেখে তোর না নিজের মায়ের মুখ মনে পড়ে! তাকে এইভাবে বিক্রী হয়ে যেতে দিবি?’
দীপ্ত অসহিষ্ণু রাগে ফুঁসছিল। বলল, ‘মা না আরও কিছু! জিজ্ঞেস কর এতক্ষণ কোথায় ছিল, কী করছিল। মেয়েটার সঙ্গে মস্তি করে এসেছে। দেখছিস না গলায় নখের দাগ। চান করে পাপ ধুচ্ছিল। ছিঃ!’
দেবু আমার হাত ছাড়িয়ে ছিটকে উঠল। ওর চোখ জ্বলছে। দীপ্তর দিকে চেয়ে হাতের মুঠি পাকাল। চিৎকার করে বলল, ‘হ্যাঁ, করেছি। মেয়েটার সঙ্গে মস্তি করেছি। বেশ করেছি, হাজার বার করব। তোর কী?’
দীপ্ত বলল, ‘শালা, অন্ধকারের জীব। মাংস দেখলেই নোলা সক সক করে ওঠে।’
দেবুর নিঃশ্বাস পড়ছে জোরে জোরে। কথা জড়িয়ে যাচ্ছে, ‘অন্ধকারের তুই কী বুঝিস? বড় বড় কথা বলছিস? বাথরুমের ভিজে মেঝের ওপর অন্ধকারে কখনও বসে থেকেছিস? প্যাঁচ কাটা কলের থেকে মাথার ওপর টপ টপ করে জল পড়ত। নর্দমা দিয়ে থপ থপ করে ব্যাং ঢুকে আসত। জলের মধ্যে বসে থাকতে থাকতে পেচ্ছাপ হয়ে যেত। সাড় থাকত না। ভয় হত মা যদি ভুলে যায়! বাথরুমের বন্ধ দরজাটা কখনও না খোলে!’
দেবুর এই রূপ কোনোদিন দেখিনি। শান্তশিষ্ট ভীতু ছেলেটার মধ্যে যে এতখানি কষ্ট চাপা ছিল আগে বুঝিনি কখনও। মনে হল ওর মনের অন্ধকার বাথরুমের দরজাটা খুলে গেলে একটা নিদারুণ বিপত্তি হতে পারে। দীপ্তকে থামাতে যাচ্ছিলাম। তার আগেই দীপ্ত বলল, ‘সেসবের সঙ্গে মেয়েটার কী সম্বন্ধ? স্রিফ তোর মায়ের মত দেখতে বলে মেয়েটার ওপর তুই শোধ তুললি? মেয়েটাকে তুই... ।’
দীপ্ত যেন একটা খুব হাসির কথা বলেছে, দেবু দীপ্তর থুতনি ধরে নাড়া দিয়ে হা হা করে হেসে উঠল, ‘কী রে বাবু? মেয়েটাকে আমি কী? বল না... বল না... কথাটা শেষ করলি না কেন? আমি কী...?’
আমি আশ্চর্য গলায় বললাম, ‘দেবু, তুই পারলি?’
দেবু হাসতে হাসতেই বলল, ‘আরে এত আপসেট হচ্ছিস কেন? খুন করিনি তো! জাস্ট পয়সা দিয়ে ভোগ করেছি। এই ধরনের মেয়েগুলো তো পয়সার জন্যেই...।’
দীপ্ত আর নিজেকে সামলাতে পারলো না। দেবুর গালে ঠাস করে একটা চড় কষাল। চড় খেয়ে দেবুর হাসির দমক আরও বেড়ে গেল। যেন আমরা দুটো আহাম্মক, বাচ্চা ছেলে। ওকে মিছিমিছি দোষারোপ করছি, বোকার মত তিলকে তাল করছি। দেবু বলল, ‘তোরা ছেলেমানুষ, সত্যি ছেলেমানুষ...।’
হিস্টেরিয়ার রোগীর মত দেবু অফুরন্ত হাসছে। আমরা দুজন দেবুর পালিশ করা সাদা দাঁতের ওঠাপড়ার দিকে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রয়েছি। হাসতে হাসতে দেবুর চোখ ফেটে জল পড়ছে। দীপ্ত অস্থির হয়ে আমায় ঠেলা দিয়ে বলল, ‘বাপি, ওকে থামা...।’
আমরা দেবুকে থামাবার জন্য গায়ে ধাক্কা দিয়ে বারবার বলতে লাগলাম, ‘এই দেবু, পাগলামি করিস না। চুপ কর, চুপ কর... ।’
কে কার কথা শোনে? জল খেলার যাবতীয় নিয়মকে তাচ্ছিল্য করে দেবু হেসে যাচ্ছে। বাইরে বৃষ্টিপাতের শব্দ ছাপিয়ে ওর হাসির শব্দ খাণ্ডালা ঘাটের আনাচে কানাচে অনুরণিত হচ্ছে। পাহাড়ে ধাক্কা খাচ্ছে, ফিরে আসছে, ঢালু রাস্তা দিয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে। যেমন করে পিঠে যুগল প্রেমীকে নিয়ে দাঁত কেলিয়ে হাসতে হাসতে ডুকাটি গড়িয়ে যায়। খাণ্ডালা ঘাটের অন্ধকার বর্ষার রাত্তিরে সেই অপার্থিব হাসির শব্দ শুনতে শুনতে, একটা অচেনা ভয়ে আমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে এল।