• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৭০ | মার্চ ২০১৮ | গল্প
    Share
  • উদ্‌যাপন : সৌমেন ভট্টাচার্য


    মিল্টুর বউয়ের পেটে বাচ্চা এল শেষমেশ, আর সেটা বিয়ের ন-বছরের মাথায়। তারা চেপে যেতে চাইলেও খবরটা জানাজানি হয়ে গেল কীভাবে যেন।

    পাশের বাড়ির মাসিমা মহা খুশি। অভিমান মাখানো ধমক দিলেন তিনি মিল্টুর বউকে - এই ভাল খবরটা কি চাপতে আছে?

    বাপ-মা মরা মেয়েটাকে নিজের মেয়ের মতো ভালোবাসেন তিনি, পাশে দাঁড়ান আপদে বিপদে। ভাল খবরটা তিনি হজম করতে পারলেন না চুপচাপ। ফলে সারা পাড়া হতে সময় নিল না মোটেই, একেবারে ব্লটিং পেপারে কালি শোষার মতো।

    যারা আড়ালে বাঁজা আর কী সব যেন বলত মিল্টুর বউকে, তাদের থোঁতা মুখ ভোঁতা। মাসিমার আনন্দ আর ধরে না। উত্তেজনার চোটে বলে ফেললেন - ***গুলোর মুখে ঠাকুর ঝামা ঘষে দিয়েছেন।

    মিল্টুর গন্ডগোল আছে বলে বেড়াত যারা, তাদেরও এক গাল মাছি।

    কিন্তু মিল্টুর বউয়ের মুখখানা বর্ষার মেঘের মতো থমথমে; আর কিছুটা আনমনা - কী যেন ভেবে চলেছে রাতদিন। চোখদুটো কালো ফাঁদলে একেবারে ডুবে গেছে গোলগাল মুখখানায়, যেন কত রাত ঘুমোয়নি।

    মাসিমা যত জানতে চান মুখ ভারের কারণটা কী, তত সে এড়িয়ে যায় এটাসেটা বলে। তিনি বোঝালেন অনেক করে, অত চিন্তার কিছু নেই। প্রথম প্রথম সবারই ভয় করে, কিন্তু কিস্যু নেই ভয়ের। তিনি ঠিক জানেন, ছেলে হবে। ঠাকুর যখন চেয়েছেন মুখ তুলে এতদিন বাদে, ঠিক ভাল হবে সব। টালির ঘরে রাজপুত্তুর আসছে।

    ফাঁকা চোখে সব শুনল মিল্টুর বউ।

    বড় কাঁসার বাটিতে তাকে পায়েস করে খাওয়ালেন তিনি, বললেন মিষ্টিমুখ হল। কিসমিস দিলেন পায়েসে, যেমনটা ভালবাসে সে। কাঁটার চচ্চড়ি করে খাওয়ালেন রোববার। আর চালতার টক।

    কিন্তু মিল্টুর বউয়ের মুখ থেকে হাসি গেছে যে গেছেই, নাম নেই ফেরার।

    ওদিকে মিল্টুরও কোনও অদলবদল নেই খবরটা শুনে – যতক্ষণ বাড়িতে তার চেয়ে ঢের বেশি বাইরে। বাইরে ঢুঁ মারা যেন বেড়ে গেল আরও আগের থেকে। মদটাও আগের মতোই।

    কেউকেউ বলল, এবার অন্তত একটু সময় দে বউটাকে। মাসিমারও সেই একই কথা।

    কিন্তু কে কার কথা শোনে?

    একজন তো এমনটাও বলল – এখনও বাড়িতে সময় না দিলে বাচ্চা তো বাপ না বলে কাকা বলে ডাকবে।

    হেসে উড়িয়ে দিল মিল্টু। বাইরে চষা জারি রইল পুরো দমে।

    ক্লাবের ছেলেরা একদিন চেপে ধরল তাকে খেলার মাঠের কাছে - এতো বড়ো খবরটা শুকনো মুখে শোনা যাবে না গুরু, মাল খাওয়াতে হবে ভরপেট।

    হেসে আর খিস্তিখামারি করে সে কেটে পড়ল সেখান থেকে। সবাই হাসতে লাগল পেছনে – শালার মাথা বিগড়ে গেছে আনন্দে।

    দিন সাতেক পর এক সোমবার কাজ থেকে রাতে বাড়ি ফিরল না মিল্টু। এমনিতে ফিরতে ফিরতে ন-টা সাড়ে ন-টা হত। বোতলের ঠেকে ভিড়ে গেলে আরও খানিকটা পর। সেদিন এগারোটা বেজে গেলেও ফিরল না সে। মোবাইলটাও সুইচড্‌ অফ্‌। যেখানে কাজ করত, ফোন করা হল সেখানে। বেজে বেজে কেটে গেল ফোন। অত রাতে কে থাকবে সেখানে ফোন ধরার জন্য?

    পাশের বাড়ির মাসিমা মিল্টুকে শাপ-শাপান্ত করতে লাগলেন - এখন কেউ এতক্ষণ একা রাখে বউকে? নির্ঘাত মদ খেয়ে পড়ে আছে কোথাও।

    তার বউকে নিয়ে গেলেন তিনি নিজের কাছে – একা রাত কাটানো ঠিক নয় এই অবস্থায়, অনেকরকম বিপদআপদ হতে পারে। জিজ্ঞেস করলেন ঝগড়াঝাঁটি হয়েছিল কি না বরের সঙ্গে।

    মিল্টুর বউয়ের মুখে তালা। কাপড়ের আঁচলে মুখ চেপে কাঁদতে লাগল সে। হাজার জিজ্ঞেস করেও তিনি কিচ্ছুটি বলাতে পারলেন না তাকে দিয়ে। অভিমান করে বললেন – মাসিমা পর হয়ে গেল তোমাদের, কী এমন ক্ষতিটা হত নিজেরা ঝামেলা না পাকিয়ে আমায় বললে।

    মিল্টুর বউ বোবা। জল গড়িয়েই চলেছে দু-গাল বেয়ে।

    শেষটায় মাসিমা আরও বেশি করে উদ্ধার করতে লাগলেন মিল্টুকে।

    তাঁর সামনেই অজ্ঞান হয়ে গেল মিল্টুর বউ আচমকা। চোখেমুখে জল দিতে জ্ঞান ফিরল খানিক পর। তিনি ডাক্তার ডাকতে চাইলেন, বাধা দিল সে।

    কাল সকালে পুলিশে খবর দেওয়া উচিৎ - বলল একজন।

    মাসিমা বললেন – কী হবে ওসব করে? দেখ গে যা কোন চুলোয় বসে ছাইপাঁশ গিলছে, নেশা ফুরোলে বাড়ির কথা মনে পড়বে।

    পুলিশে যাওয়ার দরকার পড়ল না আর। তার আগেই পুলিশ এল তাদের বাড়িতে পরদিন সকাল সকাল। সরু গলিখানায় পুলিশের গাড়ি দেখে ভিড় জমে গেল নিমেষে।

    যেখানে কাজ করত সেখানেই গলায় দড়ি দিয়েছিল মিল্টু একটা ফাঁকা ঘরে আগেরদিন রাতে। টেরই পায়নি কেউ।

    মিল্টুর বউ একেবারে পাথর হয়ে গেল শুনে। ফ্যালফ্যালে চাউনি, একফোঁটা জল নেই চোখে; যেন বোধশোধ খোয়া গেছে।

    তাকে আর পাড়া প্রতিবেশীদের জিজ্ঞাসাবাদ করল পুলিশ।

    আগের রাতের মতোই বোবা মেরে রইল সে, হাজার চেষ্টাতেও একটা শব্দও বের করা গেল না তার মুখ থেকে। পুলিশ খুঁজে দেখল সুইসাইড নোট পাওয়া যায় কিনা। খুঁজে দেখল না বলে ঘরখানা তছনছ করল বললেও হয়।

    অঝোরে কাঁদতে লাগলেন মাসিমা। মিল্টুর বউয়ের চোখের জল যেন তাঁর চোখ থেকে ঝরতে লাগল। কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলেন – মিল্টুরে কেন করলি এমনটা? বউটার কথা ভাবলি না একবার? বাচ্চাটার কথাও তো ভাবতে পারতিস অন্তত।

    কাঁদতে কাঁদতেই উদ্ধার করা চলতে লাগল মরা মানুষটাকে।

    মিল্টু যে কেন করল এমনটা বুঝতে পারল না কেউ। ছোটছোট জটলা এখানে ওখানে। সব্বার মুখে একটাই কথা – মিল্টু কেন যে এই পাগলামিটা করল, কে জানে। এখন তো আনন্দে ভাসার কথা ওর!


    (এই সংখ্যায় সৌম্যেন ভট্টাচার্য্যর আরো একটি গল্পঃ 'হিমশৈল')




    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ রাহুল মজুমদার
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)