• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৭০ | মার্চ ২০১৮ | গল্প
    Share
  • জামাই থেকে ঘরজামাই : সুব্রত ঘোষ


    রুপাই ভোক্তা, দীপেন মল্লিক ও জামাই — এরা তিনজনই লোধা বা শবর সম্প্রদায়। এই তিনজনই আমার পরিচিত। সকাল সকাল আমাদের আমবাগানে গিয়ে গাছের তলায় খাটিয়া নিয়ে আধশোয়া অবস্থায় অবস্থান করছিলাম। এদের তিনজনের আগমনে বাগানের নিস্তব্ধতা কাটিয়ে জামাইকে জিজ্ঞাসা করলাম— “কিরে ‘নুধা’ তোরা যাবি কোথায়?” জামাই উত্তর করলো— “দেখ দাদা তোর সাথে যখনই দেখা হয় তুই লোধা জাততে ‘নুধা’ বলে কথা বলিস্‌, অন্য কেউ বললে কিন্তু দেখাই দিতাম। যাক্‌ তুই বলে তোকে ছেড়ে দিলাম। আমি বললাম — “দেখ জামাই ‘নুধা’ কিন্তু তোকেই শুধু বলি।”

    জামাই এবার হেসে বলল তা তো জানি। তবে তোকে বলতে দ্বিধা নাই দাদা, তুই মজা করে যে বলিস্‌ তা বুঝি। আর তোর মুখে কিন্তু ‘নুধা’ শুনতে ভালই লাগে। ঘটনাপ্রবাহে এদের উপর আমার কিঞ্চিৎ অধিকার ফলাবার জায়গা আছে সেটা এরা ভালই জানে এবং মান্যতা দেয়।

    যাই হোক জামাই জানালো ইঁদুর ধরতে। বললাম ব্যাগে খোন্তা নিয়ে (খোন্তা মানে বনের আলু তোলার হাতিয়ার) কোথায় যাবি ইঁদুর ধরতে? জামাই জানালো যাবো আর কোথায়, তুই যে বাগানে মাটির গাদা করে রেখেছিস, ঐখানে, অনেকদিন থেকে ইঁদুর বাসা করে আছে। তোর বাগানের আমের মুকুল আর কাশির মূল খায়। (কাশির মূল হল কাশ ফুলের শেকড়) এদের মাংস খুব মিঠা হবে। এদের পুরা ফেমেলি আছে ওই গর্তে।

    বললাম — কটাই বা ইঁদুর পাবি যে, তিনজনের ভাগে পোষাবে? তার থেকে আমার বাগানে কাজ কর, দুই কেজি বয়লার মাংস দেবো, তোদের পুষিয়ে যাবে। তাচ্ছিল্যের সুরে বললো — হুঁ — বয়লার মাংস। মেঠো ইঁদুরের মাংস খেলে ভুলবি না। এদের মাংস কত মিঠা জানি্‌স...। আমি খাটিয়া থেকে উঠে দাঁড়ালাম বললাম চ-দেখি, কোথায় দেখা ইঁদুরের বাসা, বলে ওদের সাথে এগিয়ে চললাম। কিছুটা যাবার পর উচু ঢিপির কাছে যেতেই জামাই নিচুস্বরে বললো দাদা কাছে আয়, ওই দেখ ইঁদুরের গর্ত। ভালোভাবে তা-কা, গর্তের মুখটা বালি দিয়ে অর্ধেক ঢেকে ইঁদুর পরিবারের একজন পাহারা দিচ্ছে। ঠিক যেমন যৌথ বাহিনী বালির বস্তা চারিদিকে দিয়ে বন্দুক হাতে পাহারা দেয়। দেখ দাদা ইঁদুরের চোখ দুটা কেমন আমাদের দিকে চেয়ে আছে। এদের গর্তের মুখ একটাই থাকে।

    গর্তের মুখে দিনের বেলায় খুব দায়িত্ব নিয়ে পাহারা দিতে হয়, সর্বক্ষণের জন্য। ইঁদুরের অনেক শত্রু। গর্তের কাছাকাছি সাপের আনাগোনা, বা মানুষের যাতায়াত, আকাশে বাজপাখি বা টিকরা পাখির একাগ্র লক্ষ্য ওই গর্তের প্রতি। জামাইকে জিজ্ঞাসা করলাম — হ্যাঁ রে জামাই টিকরা পাখি কোন পাখি? জামাই জানালো টিকরা পাখি সবসময় দেখতে পাবে নাই দাদা। গাছের ডালে এসে চুপটি করে বসে থাকে, ওদের গায়ে সাদা ছিটছিটে দাগ থাকে। এদের খাবার বাচ্চা মুরগীর ছানা, ইঁদুর, আর বাঘ- মৌমাছির চাকে ডানার ঝাপটা মেরে মৌমাছি সরিয়ে, চাক থেকে মৌমাছির বাচ্চা আর মধু খেয়ে উধাও হয়ে যায় নিমেষে। মৌমাছির ঝাঁক পিছনে তাড়া করে এদের হদিশ পায় না। ফিরে এসে গাছের তলায় গরু, ছাগল, মানুষ যাকে পায় তার দফারফা করে ছাড়ে।

    পাহারাদার ইঁদুর বিপদ বুঝে সকলকে সতর্ক করে। আমাদের আরো গর্তের কাছে যেতেই চিঁচিঁ শব্দে গর্তের মধ্যে ইঁদুরটির অন্তর্ধান হলো। বুঝলাম এই শব্দ দিয়ে ভেতরের পরিবারের সকলকে সতর্ক করলো। জামাই সত্বর গর্তটাকে মাটি দিয়ে ঢেকে পায়ের গোড়ালি দিয়ে আরো শক্তপোক্ত করলো। রূপাই ও দিপেন মাটির গাদার চারিপাশে ঘুরে ঘুরে পর্যবেক্ষণ করে নিয়ে বলল — না, আর কোন গর্তের মুখ নাই।

    দু’জন গর্তের কাছে বসে শালপাতায় মুড়ে দোক্তা দিয়ে চুটা বানিয়ে, চুটা ধরালো। অন্যজন কি জানি কিসের সন্ধানে চলে গেল। আমি গর্তের কাছে দাঁড়িয়ে লক্ষ্য করলাম, সত্যি-তো এখানে ওখানে অনেক কাশফুলের ঝাড়। কিছুক্ষণের মধ্যে তৃতীয়জন ফিরে এলো। সঙ্গে কিছু শুকনো ঘাস, পাতা ও একটা পুরানো মাটির ঘট। দুইজন মিলে আরো শুকনো ঘাস, পাতা-লতা জোগাড় করে নিয়ে এলো। এবার খোন্তা যন্ত্রটা দিয়ে ঘটের পেছনটা ফুটো করে গর্তের মুখে মাটি সরিয়ে ঘটের পিছনের সঙ্গে গর্তের মুখে বসিয়ে চারদিক দিয়ে মাটি দিয়ে বসিয়ে দিলো। ঘটের মুখ ঘাস-পাতা-লতা চেপে চেপে ভর্তি করলো, এমনভাবে ভর্তি করলো যাতে শুধু ধোঁয়া হয়, আগুন শিখা যাতে না হয়।

    বুঝলাম এদের উদ্দেশ্য যাতে ধোঁয়া গর্তের দিকে যায়। এই ধোঁয়ায় গর্তের মধ্যে যে-কটা ইঁদুর আছে সব কয়টি অক্সিজেনের অভাবে যেন মারা যায়। বলতে বলতে ঘাসের আগুন জ্বালিয়ে দিলো। ধীরে ধীরে পট্‌-পট্‌ করে ঘাস জ্বলতে লাগলো। আগুনের শিখা আর বেরোতে দিল না। ঘাসের গাদা দিয়ে চেপে মুখ দিয়ে ফু-ফু করতে লাগলো। ক্রমে ক্রমে ধোঁয়া বাইরে থেকে গর্তের ভেতর দিকে বেশি করে যেতে লাগলো।

    আমি বললাম, “কি রে জামাই কতক্ষণ এইরকম ধোঁয়া দিবি?” “আধ ঘন্টা তো লাগবেই দাদা। জানি্‌স দাদা ইঁদুরগুলোর অবস্থা কেমন হবে?” কোলকাতা শহরে একটা হসপিটালে ৮০-৮২ জন রুগী ধোঁয়ার জন্য দম বন্ধ হয়ে মারা গেছিল অক্সিজেনের অভাবে। বুঝলাম জামাই ‘আমরি কাণ্ডের’ কথা বলছে। এদের অবস্থা ঠিক ওদের মতো হবে। আমরি হসপিটালের কথা মনে পড়ে মনটা বিষণ্ণ হয়ে পড়লো। জামাই আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললো, “দাদা তোর মনটা কি খারাপ লাগছে গর্তের মধ্যে ইঁদুরগুলো মারা যাবে বলে?” “না না,” মনে মনে ভাবলাম এ আর কি? এতো খাদ্য ও খাদকের সম্পর্ক।

    ধোঁয়া দেবার কাজে দুইজন ব্যস্ত। জামাই একটানা আমার সাথে কথা বলে যাচ্ছে। আমি কৌতূহলবশত কথা শুনতে শুনতে এদের কর্মকাণ্ড লক্ষ্য করছিলাম। জামাই বলছিল — জানিস দাদা এই পৃথিবীতে আমরা যত খাবার খাই তা তো অধিকাংশই গাছ থেকে পাওয়া। আমাদের পূর্বপুরুষ বনবাসীরা তো লক্ষ লক্ষ গাছের মধ্যে মানুষের খাদ্য খুঁজে তার ফল, ফুল লতা পাতা আমাদের খাদ্যের জন্য তুলে দিয়েছে। যেমন ধরো খেজুর গাছ, পাতায় কাঁটা গাছের কাণ্ড এবড়োখেবড়ো, বাইরে থেকে দেখলে মনে হবে এই গাছের কোন রসকষ নাই। কিন্তু ভেতরে এত সুগন্ধি রস আছে তার সন্ধান তো আমাদের পূর্বপুরুষ বনবাসীরা দিয়েছে। সেই রস জাল দিয়ে তোমরা গুড়, পায়েস, পিঠে-পুলি কত কিছু করে খাও। কখনও তোমাদের মনে হয়েছে, এটা কে বা কারা আবিষ্কার করেছে? জামাই বলতেই লাগলো — এই ধর, তোমাকে যদি প্রশ্ন করি যে উড়োজাহাজ কে বানিয়েছে? তুমি তার নাম এখনই বলে দেবে। কিন্তু এই প্রকৃতির মধ্যে এত গাছগাছালির মধ্যে ঠিক মানুষের খাবারটি তোমাদের খাবারের পাতে তুলে দিয়েছে আমাদের পূর্বপুরুষ বনবাসীরা। তাদের কারোর একটি নামও তোমরা জানো? জানো না। আমি না হয় অল্প পড়াশুনা জানা লোক। কিন্তু তোমরা তো অনেক পড়াশুনা করেছ, তোমাদের মধ্যে একজন কেউ বলতে পারবে? কেউ পারবে না।

    শুধু কি খাবার, আমাদের বনবাসীরা শিমূল গাছ খুঁজে তোষক, বালিশ, তুলা তুলে দিয়েছে তোমাদের আরামের জন্য। জামাইকে জিজ্ঞাসা করলাম — হ্যাঁ রে, তুই কতদূর পড়েছিস? বললো — ক্লাস এইট। তারপর বাপ্‌-মা দুই লোক-ই মরি যেতে আর লেখাপড়া হয় নি। জামাই আবার শুরু করলো... শুধু কি খাদ্য ঔষধের গাছগাছালি, আমরাই খুঁজে বার করছি, একদিনে তো হয়নি, ওর জন্য শত শত বছর ব্যয় হয়েছে। এই তো দাদা তোর আমবাগানের মধ্যে দিয়ে আসার সময় একটা ঔষধি গাছ দেখলাম। যত বিষধর সাপই হোক, সাপ কাটলে ঐ গাছের পাতা বেটে খেলে মানুষটা বেঁচে যাবে। আমি তোকে চিনিয়ে দেবো।

    এইসব কথা বলতে বলতে ধোঁয়া দেওয়া শেষ হলো। জামাই গর্তের দিকে এগিয়ে গেলো। গর্তের মুখ থেকে ঘট সরিয়ে খোন্তা দিয়ে মাটি খুঁড়তে খুঁড়তে গর্তের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে ইঁদুর নাগালের মধ্যে পেলো না। হাত বার করে আবার খুঁড়তে লাগলো, জামাই বললো অনেক বড় বাসা এদিক-ওদিক অনেক পথ।

    মাটি খোঁড়া থামিয়ে জামাই আবার শুয়ে পড়ে হাত ঢুকিয়ে বললো — এবার পেয়েছি। বলে, একটা মস্ত বড় মরা ইঁদুর বের করে ছুঁড়ে দিয়ে বলল এটা এদের ঠাকুরদাদা। পরে আরেকটা বের করে বললো এটা মনে হচ্ছে ঠাকুমা। লেজ তুলে ভালো ভাবে দেখে নিলো।

    আবার একটি বার করে জামাই মজা করে বলল এটা বিধবা পিসিমা, এদের বাসায় ভায়ের আশ্রয়ে থাকতো। পরপর একটার পরে একটা বার করে — কোনটা কাকা, কাকী, ভাই, ভাইয়ের বৌ, নাতি পুতি। সবাই এরা যৌথ পরিবারের সদস্য। প্রায় ৪০-৪৫টি ইঁদুর বার করে বললো দেখবি আয় দাদা এরা কেউ দিনের বেলায় গর্ত থেকে বের হয় না। ঘরে যা থাকে তাই খায়। এদের খাবারের ভাণ্ডারটা দেখে যা। থরে থরে খাবার সাজানো আছে, বিভিন্ন গাছের বীজ, ধান, কাশফুলের শিকড়, আরো কত কি। মরা ইঁদুরগুলো ব্যাগে ভরতে ভরতে জামাই বলল প্রায় ৫-কেজি মাংস হবে। চ-দাদা তোর বাগানে গিয়ে বসি ওখানে ভাগ হবে।

    আমি ওদের পিছু নিলাম, ছায়া-স্নিগ্ধ আমগাছের তলায় খাটিয়ায় বসলাম। ওরা তিনজন মটিতে বসলো, ব্যাগ থেকে ইঁদুরগুলো মাটিতে ঢেলে দিলো। তিন ভাগ হবে। দুইজন চুটা ধরিয়ে চুটায় টান দিলো, লক্ষ্য করলাম কোন কিছু জয় করার পর মানুষের মুখে যে প্রসন্ন ভাব ফুটে উঠে, এদের মুখে সেই ছাপ।

    মরা ইঁদুর ভাগ হল। দুইজন দুইটি গামছায়, একজন ব্যাগের মধ্যে ভাগ নিলো। জামাই বললো — চ দাদা, তোকে সাপ কাটলে যে ওষধি গাছটার পাতা খায় সেটা দেখিয়ে আসি। গাছটা দেখলাম, ঐ গাছটি খুব একটা চোখে পড়ে না। বড় বড় পাতা, একটা পাতা ছিঁড়ে হাতে ডলে গন্ধ নাকে নিলাম, বেশ উগ্র গন্ধ। গাছটা খুব একটা বড় না। জামাই বলল দেখিস দাদা বাগান সাফা করতে যেন গাছটা না কেটে ফেলিস।

    জামাই বলল, আচ্ছা দাদা তুই কি পুতলি গাছ চিনিস? উত্তর করলাম কি আছে ওই গাছে? জানিস দাদা, যদি কারো জন্ডিস হয় পুতলি গাছের পাতা বেটে সাতদিন খেলে জন্ডিস সেরে উঠবে। আবার কোন বাচ্চার যদি কৃমি হয়, তাহলে ছোট খেজুর গাছের ভেতরে সাদা রংয়ের যে শাঁস আছে ঠিক শাঁখআলুর মত খেতে, বাচ্চাদের খাওয়ালে কৃমি উধাও। এরকম হাজার হাজার ঔষধি গাছ আছে যা আমি কিছু কিছু জানি।

    আমরা খটিয়ার কাছে ফিরে এলাম। জামাই মাটিতে বসলো। জামাই ওর সাথীদের বললো তোরা এগিয়ে চল। আমি একটু পরে যাবো। দুইজন ইঁদুরের ভাগ নিয়ে চলে গেলো। জামাই বললো এখন ঘরে গিয়ে কি করবো বল, বউটা এখন ঘরে নাই বন গেছে ছাতু (মাশরুম) কুড়াতে। ফেরার সময় হলে আমি চলে যাবো।

    ফুরফুর বাতাস বইছে। আমগাছের ছায়ায় বসে এই বাগানের অজস্র পাখির ডাক ছাড়া আর কোন আধুনিক জগতের ধ্বনি শোনা যায় না। প্রকৃতিকে এখানে অনেক কাছে পাওয়া যায়।

    জামাই একটা চুটা ধরিয়ে খুব আরাম করে টানতে লাগলো। আমার মনের মধ্যে একটা প্রশ্ন উদয় হলো। জামাইকে জিজ্ঞাসা করলাম — হ্যাঁরে জামাই তোকে সবাই জামাই বলে ডাকে কেন? জামাই উদাসভাবে উত্তর করলো দাদা আমি শুধু জামাই না, আমি ঘরজামাই। এর পিছনে অনেক ইতিহাস আছে। আমি বললাম কি কথা বল? জামাই কি করবে ভেবে না-পেয়ে মাথা চুলকাতে চুলকাতে বিহ্বল হয়ে পড়লো।

    আমি বললাম — কি-রে বল, কি করে জামাই থেকে ঘরজামাই হলি? জামাই কুয়ো থেকে জল তুলে ঢক-ঢক করে জল খেয়ে এসে বসলো। দেখে মনে হলো এ জীবনকে বয়ে নিয়ে যেতে যেন হাঁপিয়ে পড়েছে। — তবে শোন দাদা, আমার বয়স এখন অনেক। জিজ্ঞাসা করলাম — কত? ধরনা ঝাড়গ্রাম রাজা বাহাদুরের বাপকে দেখেছি। তা কত হিসাব কর। বুঝলাম এ-হিসাব আমার দ্বারা হবে না, কথা না বাড়িয়ে বললাম বুঝেছি অনেক বয়স।

    আমাদের ঘর ছিল কালীনগর গ্রামে। সেই গ্রামে ২৫-৩০টি লোধা ঘর ছিল, সবারই ছিটাবেড়া ঘর ছিল, চালে কোনরকমে খড়-লতাপাতা চাপানো।

    আমার বাপ মা দুই লোকই মারা গেছে। তখন আমি আট ক্লাসে পড়ি। ওখানে আমার পড়া শেষ। দিদিটাই আমাকে বড় করলো। দিদির বিয়ে হয়ে শ্বশুরঘর চলে গেলো। আমি ধীরে ধীরে জোয়ান হলাম, দিদি, গাঁয়ের লোক আর কুটুমরা আমাকে বিয়ে দিলো লালবাজার গ্রামে।

    আমার ঘর উঠানে গোবর লেপা হলো, উঠানে কাঁচা শালগাছ পোঁতা হলো। উঠানে আঁকিবুকি হলো। দুয়ারে চৌকাঠে আলপনা দেওয়া হলো। নূতন বউ ঘরে এলো। দুই দিন ঘরটা মাতাই গেলো কুটুম-বন্ধু সকলে এসে। ধীরে ধীরে সকলে ফিরে গেলো। ঘরটা একেবারে ফাঁকা হয়ে গেলো।

    বউটাকে বললাম — হে-রে বউ বিয়ে তো হলো, এরপর তো খেটে খেতে হবে। বন থেকে কাঠ না আনলে ভাত নাই — সারাদিন খাটলে তবে ভাত।

    বউটাকে বললাম — হে রে দুপুর তো হলো, হেঁটে যেতে হবে বনের মধ্যে দিয়ে অনেক দূর দিদির ঘর। দুই দিন ঘুরে আসি চ। বউটা ঘাড় নাড়িয়ে সম্মতি জানালো — বলল, যেখানে নিয়ে যাবি সেখানে-ই যাবো। বউটাকে বললাম যদি যাবি ঝটপট গরম ভাত খেয়ে বেরাতে হবে। নচেৎ বড় বন, মাঝ বনেই সন্ধ্যা নেমে যাবে। যদি তেমন হয় বনেই রাতটা কাটাবো। ভয় কি? বনের লোকের আবার বনে ভয়? তাড়াতাড়ি গরম ভাত খেয়ে গাঁয়ের লোককে বললাম দেখিস্‌ রে আমার ঘরটা, আমার দিদি ঘর যাবো, ওখানে হাট বসে, সংসারের বাসন কিনবো, সংসার যখন করেছি, আর কি?

    ঘরে তালা দিয়ে আমরা বনের রাস্তা ধরলাম। হেঁটেই চলেছি তো চলেছি, বন আর বন, ঘন থেকে আরো ঘন হচ্ছে। জোরে জোরে পা চালিয়েও সন্ধ্যার কাছে হেরে গেলাম, আজ রাতটা গাছের উপর মাচা করে থাকতে হবে। স্থির করলাম একটা বড় গাছের ডালে মাচা করবো। সঙ্গে কাতান (কাতান মানে কাটারি) ছিল। বৌটাও কাজে সাথ দিলো। মোটা মোটা ডাল কেটে দুধিলতা (শালজঙ্গলে এক ধরনের বনজ লতা যা ভেষজ গুণসম্পন্ন) দিয়ে আচ্ছা করে কষে বেঁধে দু’জনের শোবার জায়গা করলাম। কচি পাতার বিছানা করলাম। বৌ-টাকে বললাম চ — জল খেয়ে আসি। শ্রাবণের শেষে বনের নিচু জায়গায় জলের অভাব নাই। শ্রাবণের শেষে ঘন সবুজ গাছের মাচায় বসলাম।

    বন ঘন অন্ধকারে ছেয়ে গেলো। দিনের পশু-পাখির কোলাহল বন্ধ হয়ে রাতের পাখিদের কোলাহল শুরু হলো। আমাদের মাথার কাছে একটা কাল-পেঁচা ডাকতে শুরু করলো। আমরা শুয়ে পড়লাম। বৌ-টা আমার বুকের কাছে মুখ নিয়ে সংসার বাঁধার স্বপ্ন দেখতে শুরু করলো, শেষে আমাদের দেখে আকাশের তারারা লজ্জায় মেঘের আড়ালে মুখ লুকালো। আমরা সংসার গড়ার স্বপ্ন দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়লাম। ভোর হল। আমরা মাচা থেকে নেমে হাঁটতে লাগলাম। বেলা ১০টায় দিদির ঘর পৌঁছালাম। নূতন বৌকে দেখতে গাঁয়ের মেয়ে-বৌরা এলো, রাতে বনে কাটিয়েছি শুনে বৌ-রা মুখ টিপে হাসলো, ওদের থেকে বিদায় নিয়ে কাছেই হাটে গিয়ে কুলো, বাঁশের ঝুড়ি, হাঁড়ি, হাতা কিনলাম। গ্রামের হাট, দূর-দূরান্ত থেকে এই হাটে লোক আসে। এখানে বাবুই দড়ি সব থেকে বেশি আসে।

    দিদির ঘরে রাতে থেকে ভোর ভোর দিদির ঘর থেকে ফিরে আসার পথ ধরলাম। আসার সময় দিদি বউয়ের হাতে কাঁচের চুড়ি আর আঁচলে ১০০-টাকার একটা নোট বেঁধে দিয়ে বললো আবার আসি‌স। সকাল সকাল বেরিয়েছি, রাতের মধ্যে ঘরে পৌঁছে যাবো। বনের মাঝে দুই বার বিশ্রাম নিলাম। তারপর আবার হাঁটা। সন্ধ্যার কাছাকাছি বনের শেষপ্রান্তে এসে পৌঁচেছি। এমন সময় বনের মধ্যে কয়জনকে দেখতে পেলাম। আরে এরা তো সবই আমাদের গাঁয়ের লোক। আমরা দুজনে ওদের দিকে এগিয়ে যেতে ওরা বলল তোরা কোথায় যাবি? আমরা বললাম — কেন গ্রামে। ওরা বলল — আমরা সকলে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে এসেছি এই বনে। ওদের মাঝে গিয়ে বসলাম। ওরা বলতে শুরু করলো — গত রাতে টাউনের একটা বাড়িতে চুরি হয়। চোর সিঁধ কেটে গৃহস্থের টাকা-পয়সা, জামাকাপড় নিয়ে গেছে। ভোর হতেই ওই পাড়ার ছেলে-ছোকরারা দলবল নিয়ে আমাদের গ্রামের উপর হামলা করে সকলের ঘরে মাটির হাঁড়ি, থালা, বাসন ভাঙচুর করে আর মুখে অকথ্য গালাগাল। তোর ঘরে তালা দেওয়া দেখে যত রাগ তোর ঘরের উপর পড়লো। গালাগাল দিতে দিতে বলতে লাগলো — শালা, ঘরে তালা দিয়ে আগের থেকে সরে পড়া, সিঁধ কাটার ওস্তাদ। নে আগুন লাগা। আমরা পুরুষরা গ্রামে কেউ নাই, সারাদিন সব বনে আছি। বনের ধার থেকে তোর ঘরে আগুন লাগানো দেখেছি। গ্রামের মা-বেটিরা যে কে কি করছে কিছুই জানিনা।

    নূতন বৌ-টা মাথায় হাত দিয়ে চোখের জল ফেলতে লাগলো। দলের মধ্যে কে একজন বললো চোখের জল ফেলছিস কেন। নিজের ঘরে যেতে পারবি না, আবার থানায় যেতে পারবি না। সব জায়গায় আমাদের চোর বলবে। বনই আমাদের আপন। অন্ধকারে কেউ একজন বললো, কাঁদিস না বৌ, কাঁদতে আমাদের ঠাকুরের মানা আছে।

    জামাইকে দেখে মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে উঠলো। জামাই বলেই চলেছে জানিস দাদা, যে গ্রামে বড় হলাম, খাতা-বই বগলে নিয়ে স্কুলে যেতাম। গাঁয়ের ছেলেদের সাথে ডাংগুলি, বাঁদরলাঠি খেলতাম, গ্রামের ধারের খালের পাড় থেকে ঝাঁপ মেরে সাঁতার কাটতাম, ফিরে আসার সময় খালের থেকে গামছা দিয়ে মাছ ধরে ঘরে ফিরতাম, সেই গ্রামে কাছে এসেও গ্রামে ফিরিতে পারবো না। দাদা বুকটা এখনও জ্বালা করে। ঐ গ্রামে আজও আমি সিঁধকাটা চোর।

    বউটা চোখ মুছে আমাকে বলল, কাতান আছে তো, আমাকে লাঠি কেটে দে। একটা লাঠি এনে দিতেই সবাইকে বলল, যখন ঘরই নাই তো গ্রামে গিয়ে কি হবে? জিনিসপত্র মাথায় তুলে শক্ত হাতে লাঠি নিয়ে বললো — চ — আমার পিছু পিছু। দেখি কোন মরদ আছে, তোকে চোর বলে? বউটার পিছু পিছু গিয়ে আমরা উঠলাম শ্বশুরঘরে। অন্ধকার গ্রাম। ক্লান্ত হয়ে রাত্রিতে ঘুমিয়ে পড়লাম। সকাল হতেই সকলে বলাবলি করতে লাগলো, ওদের ঘরে কাল রাতে জামাই এসেছে। সেই গ্রামে থাকতে লাগলাম। ধীরে ধীরে আমি জামাই থেকে একদিন ঘর-জামাই হয়ে গেলাম। সেই থেকে আমার গ্রাম হলো “লালবাজার”।



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ রাহুল মজুমদার
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments