• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৭০ | মার্চ ২০১৮ | গল্প
    Share
  • ছুমন্তর : সুরজিৎ মণ্ডল


    --খেলাচ্ছল জোও ও ও র তালি!!

    সব বাচ্চা একসাথে এএএ !! এই যেএএএএএ ....

    --শশশশশশশশশ!! আআআস্তেএএএএ .....

    চ্চুচুচুচুচু ...

    জমাট ময়লা তেলচিটে বোতাম-খোলা পুরনো ডেনিমরঙা জ্যাকেটটা গা থেকে খুলে ফেলতে ফেলতে লোকটি মুখে অদ্ভুত অদ্ভুত ভঙ্গি করে সামনে দাঁড়ানো খুদে দর্শকবৃন্দের উদ্দেশে চেঁচিয়ে যাচ্ছিল আর বিস্ময়, উচ্ছাস মাখা কচিমুখগুলো সম্মোহিতের মত মাথা নাড়ছিল। হেমন্তের বিকেলের বিষণ্ণতা গ্রাস করতে পারেনি ছোট্ট খয়রামারি বাজারকে। হাটবারে ব্যস্ততা, ভিড় সাধারণত অন্যান্য দিনের চেয়ে বেশিই থাকে। পশ্চিম ঘেঁষে মাছ-বাজারের চালাগুলো, তার পাশে একটু ফাঁকা মতন জায়গা, সেখানেই চলছিল হাটবারের খেলা। লোকজন আর পাত্তা দেয়না কারণ ও একেবারে পাতি খেলা, প্রতি হাটবারেই ব্যাটা আসে, এসেই ওই জায়গাটা দখল করে চিল চিৎকার জুড়ে দেয়; প্রথম প্রথম সবাই খুব উৎসাহে দেখতো কাঠির ওপর কালো কুচকুচে বলের ইচ্ছে মত ওঠানামা, চোখ-বাঁধা খেলা, টাকা-হারানো খেলা। কিন্তু এখন অভ্যস্ত চোখে উৎসাহের ভাঁটা পড়েছে; শুধু ছুটে ছুটে খেলে বেড়ানো ক্ষুদে ভূমিপুত্ররা ফি হপ্তা জুটে যায় সদলবলে ...

    আর একবার কাঠি ছুঁইয়ে দেওয়া, ব্যাস! রূদ্ধশ্বাস উত্তেজনা—

    চাদর ঢাকা শরীরটা শূন্যে উঠে যাবে মন্ত্রবলে!

    সব্বার চোখ সেদিকেই ...

    এক ............দুই .............তিন্!

    —ওকি!! আরেব্বাস!! দ্যাখ দ্যাখ বোঁচা, কি রে ভাই!

    গনু কাঁধ খামচে ধরে বোঁচার, ককিয়ে ওঠে বোঁচা, ফিসফিস করে বলে,

    —আহ্! দ্যাখ্ না আগে ... ঐ ঐ!

    মাটি থেকে দু'হাত ওপরে চাদর ঢাকা ছোট্ট শরীরটা ঝুলে আছে, একদম পূর্ণ শবাসনে, কোথাও কোন ভাঁজ নেই। গনু জানে ওটার ভেতরে এখন আর চন্দা নেই। চন্দাকে ডেকে কানে কানে কিসব বললো লোকটা, আর তারপরেই ওকে ধরে শুইয়ে দিল ছ'ফুট তক্তার ওপরে। এ খেলা দশ বছরি গনু আগে কখনো দেখেনি।


    -- টগর ফুল --


    ইস্কুলবাড়ির পিছন দিকে যে লোহার গেটটা আছে, তার পর থেকেই বড়পুকুর অবধি চলে গেছে দু'হাত চওড়া পায়ে-হাঁটা পথ। দূরে গিয়ে মিশেছে শাল আর শিশু গাছের ভিড়ে, ওদিকটা কেউ যায়না, একেবারে ধূ ধূ ফাঁকা মাঠ তারপরেই। ছুটির দিনে স্কুলের কোন সাড়াশব্দ যখন পাওয়া যায়না, জায়গাটা বড্ড নিঝুম। বড়পুকুরের ধারে গনু খালি গায়ে গামছাটা কৌপীনের মত করে পরে নিয়ে কসরৎ চালিয়ে যাচ্ছে। পাশেই রাখা আছে সর্ষের তেলের ছোট্ট শিশিটা; একটু আগেই গায়ে চুপচুপে তেল মেখে নিয়েছে গনু, এবারে একটু কয়েক পা পেছনে সরে গিয়ে সামনে দৌড়ে যেতে হবে ...

    কুউওবাং ... ছপ্ ছপ্পাস!!

    সাত-আট হাত ওপর থেকে স্প্রিং-এর মতো জলে লাফিয়ে পড়লো ছোট্ট গনু--এলোমেলো সাঁতার, মাথা ঝাঁকিয়ে নেওয়া। স্নানের মত মজা আর কিছুতেই নেই ...গনু চিৎ সাঁতার দিতে থাকে একমনে; ওপর থেকে দেখলে অবিকল মরা মানুষের মত ভেসে থাকা শুধু মনে হয়।

    ফুলে ফুলে সাদা হয়ে থাকা টগর ফুলের গাছটা পলকা, উঠতে ভরসা নেই গনুর, তাছাড়া হাতের নাগালে যা আছে তাও নেহাত কম নয়। ভেজা গায়ে গনু ফুল পাড়তে থাকে। মা বলে পুজোতে লাগেনা, কিন্তু কি সুন্দর দেখতে টগর ফুল। ছেঁড়া ছাতা সারাই করে যে ষষ্ঠীদা, ও বলে কি,

    --সাদা ফুল ছুঁই/ সাদা তুই জুঁই/ দ্যা-খ সব —

    সাদারঙের যে-কোনো ফুল হাতে এই লাইনটা আউড়ে গেলেই চোখ বুজে নাকি সব দেখতে পাওয়া যায়; তবে সবাই পারবে না, যাদের আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষে বিষ্যুাৎবারে জন্ম, তারা পারলেও পারতে পারে, আবার না-ও পারে; হাজারে একজন পারে, আর সবাই একথা জানেও না। গুল মারে খুব ষষ্ঠীদা। গনু জানে শ্রাবণের ভরা বর্ষায় তার জন্ম, মা জন্মদিন পালন করে পায়েস রেঁধে, বার জানেনা সে ঠিকঠাক। চুপিচুপি কয়েকবার টগরফুল হাতে নিয়ে চোখ বুজে বিড়বিড় করে আউড়ে দেখেছে গনু, আরো অনেককেই ও বলেছিল কথাটা ... ধুস, সব ঝাপসা অন্ধকার! কোথাও কিছু নেই; চোখ ব্যথা-ব্যথা লাগায় খুলে ফেলেছিল সে।

    আজ একবার দেখলে কেমন হয়?

    বেলা বারোটা মানে দুপুরবেলা, সে জানে। চাদ্দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নেয় গণপতি; নাহ্ ... লেজকাটা লালচে কুকুরটা শুধু স্কুলের লোহার গেটের সামনে গুটিসুটি পাকিয়ে শুয়ে আছে, আর কিছু কোথাও নেই। দু'হাত ভরে রাখা টগর ফুলগুলোর দিকে চেয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলে গনু; ফিসফিসিয়ে বলতে থাকে,

    --সাদা ফুল ছুঁই/ সাদা তুই ...

    --মনের ভুল--

    কানে ঝিঁ ঝিঁ পোকা ডেকেই যাচ্ছে অবিরাম; মায়ের হাতটা কপালে বুঝতে পারছিলো গনু। সারা গায়ে ব্যথা, মাথাটা ভারী, মুখের ভিতরে জিভটাও বড় বিস্বাদ। পুঁইডাঁটা আর মিষ্টি কুমড়োর কষা কষা গন্ধটা নাকে লাগছে, গনু টের পায় মা রান্না বসিয়েছে।

    --মা ...

    --শরীর খারাপ লাগছে নাকিরে আবার?

    --না।

    --পুকুরে চান করলে রোজ করিস, হঠাৎ হঠাৎ করিসনা এরকম সোনা আমার; শরীরে সইবেনা। দাঁড়া, ঝট করে রান্নাটা নামিয়ে আসি, তুই চুপ করে শো।

    মা চলে যেতেই অন্ধকারটা ঠাহর করতে পারলো গনু। মাথার দিকের জানলা দিয়ে বাইরে তাকালেই হাঁড়ির তলার কালির মত কালো ... জ্বর গায়ে চুপ করে শুয়ে থাকে সে। কালকে ইস্কুলে যেতে পারবে সে? ইস্কুলের চৌহদ্দিটা মনে করার চেষ্টা করে সে ...আপিস ঘর ... বসার ঘর ... হলদেটে রং ক্লাসঘর, পলেস্তারা খসা জায়গায় জায়গায়। ভেতরের মাঠটায় চোরকাঁটার উৎপাত; খুব চেষ্টা করছিল গনু ইস্কুল চলাকালীন সময়ের দৃশ্যাটা কল্পনা করতে, বারবারই অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে স্কুলের ভেতরটা, পরপর ঘরের দরজাগুলো বোঝা যাচ্ছে ... বারান্দার যে অংশটা মাটিতে মিশেছে, সেটা যেন স্পষ্ট ... গনুর মাথা ব্যথা করছে আবার।

    --ওঠ সোনা, খেয়ে নে, চল্ চল্ বাবা।

    মা হুটোপাটি করে ঘরে ঢুকেই গনুর মাথার পাশটায় ধপ্ করে বসে পড়েন, আঁচল দিয়ে মুখটা মুছতে মুছতে বলেন, --জ্বর নেই এখন। চল খেয়ে তারপর আবার শুবি।

    গনু উঠে বসতে গিয়ে বুঝতে পারে স্বাভাবিক শক্তির ছিটেফোঁটাও গায়ে অনুভব করতে পারছে না সে; মাকে ধরে উঠে বসে গনু আস্তে আস্তে। টগর ফুলগুলো তেপায়ার ওপরে যেমন রেখেছিল, তেমনি আছে। মা ঘর থেকে বেরোতেই গনু ফুলগুলো হাতে নেয় আবার সযত্নে ... গায়ে কাঁটা দিচ্ছে, ঠান্ডা লাগছে গনুর, চোখ বুজে বিড়বিড় করে চলেছে সে—

    ইস্কুলের ভেতরে সে এখন। কেউ নেই, ফাঁকা পুরো ইস্কুলের ভেতরটা ... চাদ্দিকে ঘাস আর চোরকাঁটার মাঝখান দিয়ে যে সরু রাস্তাটা চলে গেছে ইস্কুল মাঠটাকে দ্বিখণ্ডিত করে, সে এখন সেই রাস্তার মাঝখানটায় দাঁড়িয়ে আছে; একা।

    --ফের ইস্কুল--

    --আরে ঝালমুড়ি পরে খাবি, শোন না আগে!

    --কি রে? তাত্তাড়ি বল।

    --কাল কি হয়েছে শোন মজার কথা, তোকে কানে কানে বলব ...

    দুই ক্ষুদে মাথা একজায়গায় হয়ে গভীর গোপন আলোচনায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে হঠাৎই। একজনের মুখে উত্তেজনা, আরেকজনের চোখেমুখে অবিশ্বাসের ছাপ ফুটে উঠতে থাকে। দ্বিতীয় ছেলেটির নাকটা থ্যাবড়া মতন, কপালগুণে নামও পেয়ে গেছে "বোঁচা"।

    --শোন, আর কাউকে বলিসনা যেন, মনে থাকবে তো?

    --হ্যাঁ। কিন্তু বললেই বা কি? এটা কি সত্যি নাকি?

    ঠোঁট উল্টে দ্বিতীয় জন বলে; মন থেকে সে এখনো বিশ্বাস করতে পারেনি ব্যাপারটা কিছুতেই, আদৌ খুব বিশ্বাসযোগ্যও নয় ঘটনাটি। প্রথম জন এবারে তার মুখে তাকিয়ে ভুরু নাচিয়ে বলে, --তোকে ব্যাপারটা বিশ্বাস করাই কি করে বলতো? দেখতে আমি পেয়েছি ... তোকে বলেছি বটে, কিন্তু তুই তো আর দেখতে পাচ্ছিস না! আচ্ছা, পরে ভেবে দেখা যাবে কি করা যায়, নাকি?

    --চল এখন।

    --মন্ত্র মূল--

    জাদু মানেই তার গুমোর থাকা চাই। দাঁতে দাঁত চেপে এই জাদুকে আঁকড়ে ধরেই সারাজীবন কসরৎ দেখিয়ে আসছে সে; কত সময়ে, কত জায়গায় কত লোকের প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে-- নাহ্। সে দমে যায়নি। প্রদর্শনের কৌশল পাল্টে ফেলেছে, প্রায় একমাস অন্তর করে নতুন খেলা আয়ত্ত করেছে, করতে হয়েছে। লোকে এক খেলা বারবার দেখে বিরক্ত হয়ে যায়; বলে--ও মাস্টার, নতুন কি আছে? দেখাও টপ্ কইরি, ঝুলি উপুড় করো এবেরে!

    সব বাক্সগুলো পরপর সাজাতে থাকে ডেনিমরঙা জ্যাকেটের জাদুকর ... একটা পলিথিন বিছিয়ে নিয়েছিল সে আগেই, তার ওপর দাঁড়িয়ে বাজারের চার পাশটায় দ্রুত চোখ বুলিয়ে নেয় একবার; সোজা কথায় ভিড় মেপে নেওয়া। বাচ্চাগুলো একটু একটু করে এগিয়ে আসছে তাকে লক্ষ্য করেই। এরাই নিত্য হাটবারের নিয়মিত দর্শক। সাজানো বাক্সের পাশে রাখা কাপড়ের ব্যাগ থেকে চোঙাটা বার করে সে, একটা ফাটা, কর্কশ আওয়াজ করে ওঠে জিনিসটা। মাছ-হাটা থেকে লোকজন ঘাড় ঘুরিয়ে একবার দেখে আবার কইমাছ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে; ছড়িয়ে থাকা বাচ্চাদের জটলাটা কেন্দ্রীভূত হতে থাকে একটা নির্দিষ্ট জায়গাকে ঘিরে।

    --অ্যাই যে কালো কাপড়টা বাবুরা, দেখে নাও ... দেখে নাও এটা; এসো এসো, তুমি দেখো কোথাও ফুটোফাটা আছে কিনা!

    ডেনিমরঙা জ্যাকেটের অভ্যস্ত পেশাদারি গলাটা বেশ চড়া, সবার কানেই ঢুকেছে কথাটা। সত্যিই মোটা কালো সরু গামছার মতো কাপড়টা দুর্ভেদ্য বটে; পরখ করে দেখে নিল কয়েকজন ক্ষুদে দর্শক। এইবারে খেলা শুরু হচ্ছে; ভিড়ের মধ্যে থেকে একজনকে হঠাৎ ধরে কালো কাপড়টা চোখে পেঁচিয়ে বেঁধে দিচ্ছিল ডেনিমজ্যাকেট বেশ করে। অধীর আগ্রহে অপেক্ষমান ছোটদের দল ...

    --তালিয়াঁআআ জোওওওর একবার ফির্ সে!

    ক্ষুদে হাতগুলোর চটপট শব্দের হাততালির শব্দ মিলিয়ে না যেতেই ঝট করে জিজ্ঞেস করে ডেনিম জ্যাকেট, --ঐ যো রাস্তায় যাচ্চে মোটরসাইকেল দাদা, গায়ে কি জামা রে বাবুউউ??

    সবাই একঝটকায় পিচরাস্তার দিকে তাকাতেই দেখতে পেলো অলস গতিতে যাওয়া বাইকারোহীর কমলা রঙের শার্ট। বিদ্যুৎগতিতে সবার চোখের দৃষ্টি ফেরৎ চলে এসেছে ততক্ষণে আবার চোখ বাঁধা ছেলেটির দিকে;

    --কমলা।

    নিশ্চুপ মূর্তির মত দাঁড়িয়ে থাকা দেহের মুখনিঃসৃত শব্দটি সমস্ত গুনগুন থামিয়ে দিল; সবার চোখ বড় বড় হয়ে উঠেছে ...

    ডেনিমরঙা জ্যাকেট আবার কিছু একটা জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল, হঠাৎ একটা মৃদু কিন্তু শ্রবণযোগ্য বাক্য কানে আসল ছোট্ট ভিড়ের ডানদিক থেকে,

    --এরম তো তুইও পারিস ... এটা খেলা না কোন...

    থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল ডেনিমজ্যাকেট, কে বললো কথাটা? ঐ তো ঐ তো, থ্যাবড়া নাকের বাচ্চাটা, শালা বলে কি রে!

    --কি হয়েছে বাবু? কে পারবে এটা? এসো এসো ...

    তীব্র একটা রাগে কানের দুপাশে শিরাগুলো দপ্ দপ্ করতে লাগলো তার। গণপতি অবশ্য এরকম কিছুর জন্য একেবারেই তৈরি ছিলনা, তবে পালাবার উপায়ও আর নেই, ডেনিমজ্যাকেট প্রায় ছুটে তার মুখের সামনে এসে পড়েছে, হাতটা ধরেই বলে উঠলো,

    --তুমি পারবে? বাহ্। এসো এসো।

    একরকম হাত ধরে জোর করেই ভিড়ের মাঝখানে পলিথিন পাতা ফাঁকা জায়গাটায় গনুকে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করিয়ে দিল ডেনিমরঙা জ্যকেট; সবার দিকে ঘুরে ব্যঙ্গের সুরে বললো সে,

    --আমি এখন এর চোখ বেঁধে দিচ্ছি, কেমন? এ কি করে তোমরা দেখো সবাই। সাবাশ বেটা ... চলোওও এক-দো-তিন--

    ডেনিমরঙা জ্যাকেটের মুখে ক্রূর হাসিটা ফুটেছে এবারে। গণপতির চোখে কালো কাপড়ের বাঁধন এঁটে বসতে থাকলো, ছোট্ট বুকে দ্রিম দ্রিম মাদল বাজছে গনুর ... সকলের অলক্ষ্যে খুউব সাবধানে পরনের হাফপ্যাোন্টের ডান পকেটে হাত চলে গেল গণপতির ...

    কি আশ্চর্য!! নরম নরম কি যেন কতগুলো ...ভেজা ভেজা ভাব ...পরশুদিনের টগরফুল! খেয়ালই নেই কখন রেখেছে সে!

    --এই যো বাবুউ, যে সাইকেল দাদা মুদিখানায় ঢুকছেন, পরনে কি?

    শেষটুকু বলার সময় জোর ছিল কথায় তার। কেঁপে উঠেছিল গনু, বুকে একসাথে দশটা হাতুড়ি পিটছে কেউ; পকেটে হাতটা ঢোকানোই ছিল, সে অস্ফুটে বিড়বিড় করতে লাগলো--

    সাদা ফুল ছুঁই/সাদা তুই জুঁই/দ্যাখ সব--

    আরে! এতো ইস্কুলের যে ঘন্টা বাজায়, সেই ভালোকাকু! নীল ফতুয়াটা পরে আছেন ...

    --নীল রঙের ফতুয়া পরে ভালোকাকু ওটা।

    কাঁপা কাঁপা গলায় গনু বলে ওঠে ... খুউব সজোরে একসাথে চটপটে হাততালিতে কান পাতা দায় হয়ে যায় ...

    ডেনিমজ্যাকেট ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে চোখবাঁধা গণপতির মুখের দিকে; বেলা পড়ে আসছে, আরেকবার তবু, নাহলে এখানে সে আর কখনো খেলা দেখাবে না আর ...

    --বাবু, বলো দেখি ঐ পাকুড়গাছের নিচে বসে আছে যে বুড়োটা, তার হাতে কি?

    সে নিজেও জানে কোয়েশ্চেন সিলেবাসের বাইরে চলে যাচ্ছে ... কিন্তু কিছু করার নেই, এই অদ্ভুত ক্ষমতাকে স্বীকার করলে তার বিদ্যে মিথ্যা হয়ে যাচ্ছে ...কিছু করার নেই ...

    গনু চোখ-বাঁধা অবস্থায় মুখটা একটু নাড়ায় শুধু ...

    --ছোটো একটা ঝুড়ি।

    প্রচণ্ড জোরালো চটাস-পটাস হাততালির মাঝেই মুখ নিচু করে আনে ডেনিমজ্যাকেট গনুর কানের পাশে, চাপা হিসহিসে গলায় সে বলে ওঠে,

    --কোথায় শিখেছ এসব? বলো বলছি ... আমার চোখকে ফাঁকি দিতে পারবে না বুঝেছো? এ বিদ্যেও আমাদের শাস্তরে আছে ... তুই এতটুকু পুঁচকে শিখলি কোথায় রে!

    এতক্ষণে গনু দৌড়টা দিতে পারে ... কালো কাপড়টা খুলে চোখ থেকে খুলে এসে গলায় ঝুলে আছে, ওটা খুলবার সময় নেই ... তীব্র গতিতে তাকে প্রায় ধরে ফেলছে বোঁচা; পিচরাস্তাটা যেখানে শেষ, তারপরেই ডানদিকে মাঠের রাস্তা, আর সোজা গেছে যেটা, সেটা লালমাটির মোরাম ঢালা পথ। প্রায়ান্ধকার হয়ে এসেছে ...মা কি করছে এখন?

    কয়েক সেকেন্ড থমকে দাঁড়ায় গনু, আর কয়েক মুহূর্ত পর বোঁচা এসে পড়বে তার নাগালের মধ্যে, সে নিজেও হাঁফিয়ে গেছে ... হাঁফাতে হাঁফাতেই চোখ বুজে শ্বাস নিতে নিতে গনু বিড়বিড় করতে থাকে--

    সাদা ফুল ছুঁই/সাদা তুই ...

    হ্যাঁ, সন্ধ্যা নেমেই গেছে। মা সন্ধ্যাপ্রদীপ দিচ্ছেন, তুলসীভিটের সামনে প্রদীপের মৃদু আলোয় মাকে খুউব সুন্দর দেখাচ্ছে।



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণ: রাহুল মজুমদার
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)