বাবা তোমার মুখে এরকম ভয়ঙ্কর নির্লিপ্ততা কেন? তুমি কি বুঝতে পারছ না আমার কত কষ্ট হচ্ছে? তুমি কি বুঝতে পারছ না বাবা আমি মরে যাচ্ছি? অনেকটা রক্ত বেরিয়ে গেছে। ঘরের বিছানায় পড়ে আছি আমি। তুমি কিভাবে এলে এখানে? কার কাছে খবর পেলে? এসেছই যদি ওভাবে দাঁড়িয়ে ঝুঁকে দেখছ কেন? আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছ না কেন বাবা? বিদিশা আমায় সতেরো বার স্ট্যাব করেছে। আমার হার্ট লিভার কিডনি সব ফালা ফালা করে দিয়েছে। কিন্তু বিশ্বাস করো ওর সাথে চীট আমি করি নি। ওকে ঠকাই নি আমি। ও মিথ্যে সন্দেহের বশে…
পুরোটাই কি মিথ্যে অজয়?
অ্যাঁ? তুমি...তুমি কি অনহিতার কথা বলছ? অনহিতা জাস্ট আমার অফিস কলিগ ছিল। দ্যাট’স ইট। আমি কোন দিন ওকে সে ভাবে দেখি নি - বিদিশা যেরম মনে করে।
তাই কি? আমার যেন মনে হচ্ছে তোমার যেন একটা দুর্বলতা ছিল অনহিতার ওপরে। সেই একটা শনিবারে যখন বিদিশা শপিং-এ বেরিয়ে গেল, তুমি বিনা কারণে অনহিতাকে চ্যাটে ধরোনি?
হ্যাঁ ইয়ে। ধরেছিলাম। কিন্তু তুমি...তুমি জানলে কি করে? যাই হোক, যখন জেনেই ফেলেছ তখন সত্যি বলি। সত্যি বলতে আমার একদম কিছু ছিল না তা নয়। আমার ওর সাথে কথা বলতে ভাল লাগে। ও আমায় বোঝে। তবে ওকে শুধু আমি বন্ধুর চোখেই দেখি। কিন্তু তুমি জানলে কি করে?
আমি জানি। কিন্তু সত্যিই কি বন্ধুর চোখে দেখো ওকে?
হ্যাঁ.. বিশ্বাস করো। তার বেশি কিছু নয়। একদম সত্যি এটা।
তবে একদিন বিদিশাকে রাতে আদর করার সময় মনে মনে তুমি অনহিতার কথা ভেবেছিলে কেন?
কি বলছ তুমি? কক্ষনো নয়। ইয়ে মানে। হ্যাঁ। ভেবেছিলাম। সে একটা প্রচণ্ড দুর্বল মুহূর্তে। কিন্তু সে তো আমি কাউকে কখনো বলি নি। আমার গোপনতম সিক্রেট। তুমি কি করে জানলে বাবা? হাউ কুড উ?
জানি আর এও জানি, বিদিশাকে তুমি শুরুতে ভালইবাসতে। কিন্তু তোমাদের মধ্যে ইন্টেলেকচুয়াল লেভেলে কোন বন্ধুত্ব ছিল না। তাই তোমরা একে অপরের থেকে ধীরে ধীরে দুরে সরে গেছো।
ঠিক ঠিক। ভীষণ সত্যি। আমি অনেকবার ভেবেছি এই কথা। কিন্তু তুমি আমার সব মনের কথা জানলে কি করে বাবা? বুঝেছি। তুমি আমার ডাইরি পড়েছ। আমার পারমিশান না নিয়েই আমার ডাইরি পড়লে? দ্যাট ওয়াজ নট ফেয়ার।
না। ডাইরি আমি পড়িনি। বিদিশা সন্দেহ করার পরে, বাড়িতে অশান্তি শুরু হওয়ার পরে, তুই তো ডাইরিটা ছিঁড়েখুড়ে সেই রাস্তার ধারে বড় ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে এলি। কি করে পড়ব?
কিন্তু তখনও তো তোমরা কিছু জানতে না। তখনও তো পাঁচকান হয় নি ব্যাপারটা। তবে কি করে জানলে আমার ডাইরি ছিঁড়ে ফেলার কথা?
তোর মনের কথা জানতে আমায় তোর ডাইরি পড়তে হয় না। তোর মন ডাইরেক্ট পড়ে ফেলি। আমারই হাতে গড়া মন কি না।
মানে?
আর ওই ডার্ক ইচ্ছেগুলো আমিই তো দিয়েছি। তুই অনুশোচনা করিস না। তোর তাতে কোন দায় নেই, দোষ নেই। অজয় এই সব বিরোধ, কনফ্লিক্ট তো আমি তোকে এই জন্য দিয়েছিলাম যাতে তুই এই সংসার থেকে ডিটাচড হয়ে ইন্ট্রোস্পেক্ট করতে পারিস। আত্মবিশ্লেষণ। আত্মসমীক্ষা। বোঝার চেষ্টা করতে পারিস তোর স্বরূপ। একটা করে খেলনা দিয়েছি। কেড়ে নিয়েছি। যাতে সব খেলনাতে ইন্টারেস্ট হারিয়ে নিজেকে চিনতে চেষ্টা করিস।
তুমি দিয়েছিলে? মানে কি? তুমি দেবার কে? হ্যাঁ আমি সব ছেড়ে ছুড়ে দিয়ে দু একবার একলা বসে ভাবার চেষ্টা করেছি। যে আমি কি চাই? কি পেলে শান্তি পাব? আমি লোকটা আদতে কে? কিন্তু তারপর আবার দৈনন্দিন জীবনের চাহিদারা আমায় জোর করে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছে। কিন্তু তুমি এইসব কনফ্লিক্ট দিয়েছ কথাটার মানে কি? তুমি দেবার কে? আমি সত্যি বুঝতে পারছি না বাবা।
ওয়েল। যদি নিজেকে জানার চেষ্টাটা চালিয়ে যেতিস, তাহলে আজ আমায় তোকে খুন করতে হত না।
কি বলছ? তুমি আমায় খুন করেছ? বিদিশা তো আমায় স্ট্যাব করল। ঘুমের ঘোরে আমার নাকে কি একটা ধরল। আমার হাত পা অবশ হয়ে গেল। প্রতিরোধ শক্তি চলে গেলেও আমি সব বুঝতে পারছিলাম। ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছিল।
হ্যাঁ আমিই ওকে দিয়ে করিয়েছি অজয়। আমার কিছু করার ছিল না। আমায় ক্ষমা করে দিস। আমারও কষ্ট হবে তোকে ছেড়ে থাকতে। কিন্তু এই কাজ তুই-ও তো করেছিস অজয়। তুই একটা কম্পুটার সিমুলেটেড ব্রেন নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করছিলি না? মৃত্যুঞ্জয় নাম দিয়েছিলি তার। সে তোকে বাবা বলে জানত। সেটাকেও তো তোকে মডেলটা এক্সপেক্টেড ওয়েতে বিহেভ করছিল না বলে টার্মিনেট করতে হয় । আমি সেই একই দোষে দোষী মাত্র। তার বেশি নয়।
ওটা একটা প্রোগ্রাম ছিল বাবা। তার বেশি কিছু নয়। কিন্তু আমি? আমি তো একটা রক্ত মাংসের মানুষ….তুমি আমার নিজের বাবা হয়ে পারলে বিদিশাকে দিয়ে এই কাজ করাতে? আমি, আমি কত কষ্ট পাচ্ছি দেখতে পাচ্ছ না? আমার সারা শরীরে অসহ্য যন্ত্রণা…
যদি উত্তরটা পাওয়ার দিকে এগোতিস, তাহলে আমাকে এই ভাবে প্রোগ্রামটা টার্মিনেট করতে হত না। আমার এই মডেলটাও ফেল হয়ে গেল। অজয়, তুইও মানুষ না। তোর শরীর নেই। ওটা মিথ্যে কল্পনা। তুইও তোর সৃষ্ট মৃত্যুঞ্জয়ের মতই একটা কম্পুটার সিমুলেটেড কনসাসনেস। আমি তোর মধ্যে তোর হাত পা মাথা আছে এই বোধ ভরে দিয়েছি। এই যে তোর নাম অজয় এই বোধ ভরে দিয়েছি। বিদিশাও আমারই তৈরি একটা কম্পুটার সিমুলেটেড কনসাসনেস। তুই তোর জীবনে যত লোকের সাথে আলাপ করেছিস কেউ সত্যি নয় রে। ওরাও তোর মতই কম্পুটার সিমুলেশান। একটা লাইব্রেরি অব সিমুলেটেড ব্রেন ইম্পোর্ট করেছি তোর ডিজিটাল জীবনে। এই চুয়াল্লিশ শতাব্দীতে স্ট্যান্ডার্ড রেডিমেড ব্রেন লাইব্রেরি পাওয়া যায় কিনতে। কিন্তু তোর মনটা, তোর চেতনাটা আমার নিজের সৃষ্টি। তুই আমার সন্তান।
কি সব বলছ? এটা হতে পারে না। আর এটা তো একত্রিশ শতাব্দী। চুয়াল্লিশ কি করে হল?
আজকে যত তারিখ বলে তোর ধারণা সেটাও যে আমিই ভরেছি তোর প্রোগ্রামে। একটু পুরোনো দিনে ফেলে ট্রাই করছিলাম। তোর মধ্যে মৃত্যুঞ্জয়কে সৃষ্টি করার ইচ্ছেও আমি-ই দিয়েছি। আসলে আমি এই নেস্টেড সিমুলেশানটা চালাচ্ছিই এই জন্য যাতে এই পরস্পর বিরোধী বোধগুলোর মধ্যে থেকে কোন একটা অন্তত সিমুলেটেড কনসাসনেস বুঝতে পারে কিনা যে এগুলো হতে পারে না। দীজ আর আটার নন্সেন্স। ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হতে পারে না। মানুষ বোকার মত ধর্মের নামে একে অপরকে মারতে পারে না। দীজ আর পসিবল ওনলি ইন আ প্রোগ্রামড ওয়ার্ল্ড। যাতে সে বুঝতে পারে যে সে সত্যিকারের মানুষ নয়, একটা কম্পুটার প্রোগ্রামের একটা থ্রেড মাত্র। যদি সেই ব্যাপারটা বুঝতে পারতিস বা তোর সন্তান মৃত্যুঞ্জয় অন্তত বুঝতে পারত তাহলে আমাকে তোর প্রোগ্রামটা টার্মিনেট করতে হত না। তুই অমর হয়ে যেতিস। তুই পারলি না। আমি আবার একটা নতুন সিমুলেশান ট্রাই করব। এখনও ভেবে দেখ যদি বুঝতে পারিস তোর স্বরূপটা। তাহলে আমি এখুনি হাসপাতালে গিয়ে সুস্থ হয়ে যাওয়ার বোধ তোর কৃত্রিম মনে ভরে দিতে পারি।
বাবা, আমার এই হাত, পা, মাথা কিছু সত্যি নয়? আমি সত্যি নই? আমি অজয় নই? আমি কিছুতেই মানতে পারব না বাবা…
আচ্ছা দাঁড়া। তোর হাত পা নেই কিনা দেখবি? আমি তোর বডি কনসাসনেস মডিউলটাকে শাট ডাউন করে দিই। এবার বুঝছিস? হালকা লাগছে?
না না না। তুমি জাস্ট একটা সিডেটিভ দিয়েছ। তাই আমি হাত পা মাথার বোধ আর পাচ্ছি না। আমি কিছুতেই মানতে পারব না আমার এতদিনের এত কিছু সব মিথ্যে। বাবা আমি অজয় তোমার ছেলে...
কন্ট্রোল সি মেরে দেন বিজয়বাবু। অজয় নামের প্রোগ্রামটা বন্ধ হয়ে যায়। একটা সিগারেট জ্বালিয়ে দেওয়ালের দিকে শূন্যগর্ভ দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকেন। পারল না তার এই সিমুলেশানটাও সেল্ফ কনসাস হতে। নিজেকে জানতে। আবার করে করতে হবে...তবু মনে তার কেন জানি কষ্ট হয়। যতই সিমুলেশান হোক, তারই তো সন্তান। গর্ভপ্রসূত না হলেও তারই তো মস্তিস্কপ্রসূত। আত্মজ। বিজয়বাবু ভাবেন “আফটার অল তিনি তো মানুষ। কষ্ট হওয়া তো স্বাভাবিক।”
***
চিন্তিত মুখে বিজয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে ধনঞ্জয়। নাহ, তিনি মিছেই আশায় দিন গুনছেন। এই বিজয় এখনও ভাবছে ও আদতে মানুষ। আর ওর দ্বারা সৃষ্ট অজয় একটা সিমুলেটেড কনসাসনেস। ও এখনও বুঝছে না যে ও নিজেও একটা কম্পুটার সিমুলেশান মাত্র, ওর ছেলেরই মত। ওর ছেলের ছেলেরই মত। ও এখনও ভাবছে এটা চুয়াল্লিশ শতাব্দী। ওই টাইমফ্রেমটা ওর সিমুলেশানে আমি ভরেছিলাম। ও এখনও বুঝছে না এটা আসলে আদতে সাতাত্তর শতাব্দী। ও সেলফ কনসাস হতে পারল না। বিজয়কেও টার্মিনেট করে দিতে হবে। নতুন করে আর একটা সিমুলেশান শুরু করতে হবে। শুধু মায়ার বশে করতে পারছেন না। তিনি তো মানুষ।
***
ধনঞ্জয়ের দিকে তাকিয়ে হতাশায় মাথা নাড়ে তার সৃষ্টিকারী সিমুলেটেড ব্রেন দুর্জয়...