সে এক দিন ছিল আমাদের যখন পাড়ায়-পাড়ায় মাতব্বরেরা সব বিপ্লবভাবাপন্ন ছিলেন। মানে ওপরে-ওপরে আর কি! ভেতরে রক্ষণশীলতার চিনা প্রাচীর। লাল পতাকা স্রেফ কথার কথা, এখন তো দেখছি এমনকী গেরুয়াতেও অরুচি নেই কারুর। কুঁদুলে বাঙালির নিজস্ব মাপে কমিউনিস্ট পার্টির খাঁচা তৈরি হয়ে গিয়েছিল চেতনা জুড়ে। প্রতিটি মহল্লার নিজস্ব দেবতারা নিদান দিতেন কী আচরণীয় এবং অনাচরণীয়ই বা কোনটা। মহল্লা, কেননা তা একটা বিশেষ স্থানিকতার হিসেব দেয়, যেখানে আদৌ চুঁইয়ে আসে না আদর্শের অবশেষ কিংবা পলিটব্যুরোর তত্ত্বনির্ঘোষ। বাস্তবটা যে আরেকটু রুখু তা মানতেই হয়। কিন্তু একাদিক্রমে সাড়ে তিনটি দশকের নিরবচ্ছিন্ন সরকার পরিচালনা যেন বাঁদিকের বুক পকেট সামলে-সামলেই জীবন কাটিয়ে দেওয়া লোকটার মতো, যে মরার আগে পর্যন্ত জানলই না আর একটুখানি নিচেই তার হৃদয়খানা ছিল, আলাদিনের আশ্চর্যপ্রদীপ। নতুন দুনিয়া গড়তে চাওয়া ছেলেমেয়েরা, সাপের মাথায় পা দিয়ে নেচে আসা প্রজন্ম রক্ত দিয়ে স্বপ্ন দিয়ে গড়েছিল যে কমিউনিস্ট পার্টি, তা নেহাতই কানাগলিতে মুখ থুবড়ে পড়ল।
এরকমই এক সময়ে, সেটা ২০০৩-এর বর্ষা, এক বিকেলে রাস্তায় জানলাম আর নেই ‘পদাতিক’। যে কাজের জন্য রাস্তায় বেরোনো, ক্ষুণ্ণিবৃত্তির একমাত্র সাধন ছাত্র-পড়ানো, সেদিনের মতো দায়িত্বজ্ঞানহীন হতেই হল। বাড়ি এসে ঘরের কোণে বসেছিলাম সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা নিয়ে। আবার কয়েকমাসের মধ্যেই সুযোগ এসে গেল কোণ ছেড়ে সুভাষকে নিয়ে ফের বড়ো রাস্তার মোড়ে দাঁড়াবার। দক্ষিণ কলকাতার যে এলাকায় আমাদের আস্তানা সেবারই প্রথম সেখানে বইমেলার আয়োজন হবে। এক বন্ধুর বদান্যতায় দলহীন আমি কীভাবে যেন সেই মেলা প্রস্তুতি কমিটির সদস্য। একমাত্র যে মিটিংয়ে আমি ছিলাম তা অনুষ্ঠিত হয়েছিল তখনকার শাসক দলের এক পার্টি অফিসের দোতলায়। জনগণের চেতনায় শান দেওয়ার বই উৎসবের পরিকল্পনার দায়িত্ব তখন আমাকে নিয়ে মোট চারজনের। সদ্য সুভাষের মৃত্যুতে কাতর আমি মূর্খের মতো প্রস্তাব করলাম মেলার মাঠের চারটি (দু-একটা কম বেশিও হতে পারে) গেটের একটি যদি সুভাষের নামে করা যায়। মুহূর্তেই আপত্তি করলেন যিনি, তিনি স্থানীয় অটো ইউনিয়নের মাতব্বর। নামটা অনেকটা সেই হাতকাটা বিশে, হুব্বা অনিল, চাক্কু সুনীল গোত্রের। তাঁর সাফ কথা সুভাষ পার্টি বিরোধী। তখন সদ্যই খবরের কাগজগুলো লিখে হাত ধুয়েছে সুভাষের শেষযাত্রার নাটক নিয়ে। এমনকী শঙ্খ ঘোষেরাও সঙ্গী হতে পারেননি সুভাষের শেষযাত্রায়। কবি জয়দেব বসু ‘এবার আমরা রাত জাগি!’ নিবন্ধে লিখছেন:
যাঁদের শ্রদ্ধা করি, সম্মান করি, সবাই ফুটপাথে দাঁড়িয়ে। ভিতরের ঘরে টেবিল ঘিরে মমতা-সুব্রত-মদন-শোভনদেব… বাজপেয়ীকে ফোন করা হচ্ছে, কে জানে হয়তো-বা বুশকেও। বেলা বাড়তে থাকল। শ্রীমতী কোনোক্রমেই পশ্চাৎপসরণ করবেন না বুঝে নিয়ে ভদ্রমহিলা-ভদ্রলোকরাই গুটিগুটি হাঁটা দেওয়া শুরু করলেন। স্যরকে [শঙ্খ ঘোষ] প্রশ্ন করলাম, ‘শ্মশানে যাবেন না?’ থম্ মারা মুখে বললেন, ‘এতক্ষণ ভাবছিলাম… কিন্তু এখন ইচ্ছে করছে না।’ এরকম একটা সময় চটি ফট্ফট্ করতে-করতে সপারিষদ শ্রীমতী বেরিয়ে এসে হাঁকডাক শুরু করলেন। পিছন থেকে কে যেন চেঁচালো, ‘অ্যাই বডি তোল… বডি তোল।’ (পরিচয়, সুভাষ মুখোপাধ্যায় বিশেষ সংখ্যা)তখনকার বিরোধী নেত্রী তাঁর ভ্রাতা বাহিনী নিয়ে কীভাবে সুভাষের ‘বডি’ নিয়ে চলে গেছেন সেসব খবর পড়ে সেই মাতব্বর বেশ অনড় রেনিগেড সুভাষের ইতিহাস মুছে ফেলে সর্বহারার মহান কর্তব্য পালনে। দু-একবার মৃদু স্বরে আপত্তি করার সুযোগ দিয়ে শেষমেশ তিনি আমার মতকে বালখিল্য প্রমাণ করে ছাড়লেন। সুভাষের দক্ষিণায়ন সম্পূর্ণ হল।
মৃত্যুর পরের ঘটনা তো প্রায় নাটকীয়, কিন্তু কমিউনিস্ট সুভাষের জীবননাট্যে অন্তত লেখালেখির বিষয়ে বিশেষ উত্থান-পতন ছিল না। সেন্সরড হওয়ার জ্বালায় নীল হতে হতে বয়স বাড়িয়েছেন তিনি। ১৯৫৪-য় ‘ভূতের বেগার’ (মার্কসের ‘ওয়েজ লেবার অ্যান্ড ক্যাপিটাল’-এর অনুবাদ) দিয়ে শুরু। ‘স্বাধীনতা’ পত্রিকার ২ জানুয়ারি ১৯৫৫ সংখ্যায় লেখা হয় লেখক না কি বিজ্ঞানের শুদ্ধতা নষ্ট করেছেন। ওই বছরের সেপ্টেম্বরে পার্টির পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির পক্ষে জ্যোতি বসু জানিয়ে দেন সুভাষ যে ভঙ্গিতে মার্কসীয় অর্থনীতির প্রচার চাইছেন তা বর্জনীয়। ‘চিঠির দর্পণে’ সুভাষ লিখছেন : ‘এদিকে প্রকাশকের মাথায় হাত। পার্টির নিষেধাজ্ঞা থাকায় পার্টির দোকান বইটি রাখেনি। ভয়ে পার্টির কেউ সেই বই কেনেনি। অপছন্দের বই বলে পার্টি আঁতুড়ঘরে নুন দিয়ে মারল। ক্ষমতায় না থেকেই এই।’ এ তো গেল অবিভক্ত পার্টির সেন্সরশিপ। আর পার্টি ভাগ হওয়ার পর পুরোনো পার্টিতেই থেকে যাওয়া সুভাষ সেন্সরড হননি এমন নয়।
১৯৭৯ সালে কলকাতার আনন্দ পাবলিশার্স প্রকাশ করে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতার বই ‘একটু পা চালিয়ে ভাই’। শুধু আনন্দবাজার গোষ্ঠীর প্রকাশনা বলেই নয়, এতে ছিল আলেকজান্ডার সলঝেনিৎসিনের কিছু লেখার অনুবাদ। সলঝেনিৎসিন আর পস্তেরনাক কিন্তু কমিউনিস্টদের চোখে একই দোষে দুষ্ট ছিলেন না। অন্তত পস্তেরনাক কিছুটা কম ঘৃণিত কেননা তিনি নোবেল পুরস্কারটা গ্রহণ করেননি বা করতে পারেননি। সলঝেনিৎসিন দেশে ফেরার রাস্তা বন্ধ হবে জেনেও নোবেল পুরস্কার গ্রহণ করেছিলেন। এহেন ‘সাম্রাজ্যবাদের দালালে’র (!) কবিতা অনুবাদ করার কথা সিপিআই-য়ের রাজ্য কমিটির সভায় উঠলে রাজ্য নেতারা সুভাষকে পরবর্তী সংস্করণে ওই কবিতাগুলি বর্জন করার পরামর্শ দেন। ওই পরামর্শে কান দেওয়া দূরের কথা সুভাষ ৩০ অগাস্ট ১৯৮০-র দৈনিক আনন্দবাজারে লিখলেন ‘আমি ছেড়ে যাইনি, এক পাশে সরে শুধু উত্তরের অপেক্ষায় আছি।’ যে নিবন্ধটি শেষ হল কবিতায়—
‘রক্তে পা ডুবিয়ে হাঁটছেএরপর পার্টি সদস্যপদ পুনর্নবীকরণ ইত্যাকার ব্যাপারের আর কোনো অর্থই থাকে না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যে তরুণ প্রেমের কবিতা না লিখে সাহিত্যে নবযুগের অনুসন্ধান করেছিলেন, সাচ্চা কমিউনিস্টের মতো ইয়োরোপ-ফেরত স্ত্রীকে নিয়ে বজবজের ব্যঞ্জনহেড়িয়া গ্রামে থেকে, মজা পুকুরের জল খেয়ে রাজনীতি করার সাহস দেখিয়েছেন, রাজ্যে প্রথম যুক্তফ্রন্ট ভেঙে দেওয়ার প্রতিবাদে যিনি আওয়াজ তুলেছিলেন ‘রাস্তাই একমাত্র রাস্তা’— সেই সুভাষ পড়ে রইলেন পার্টির বাইরে।
নিষ্ঠুর সময়
সারা পৃথিবীকে টানছে রসাতলে
এখনও আকাশচুম্বী ভয়।
অথচ সামনেই হাত আরেকটু বাড়ালেই—
রয়েছে বন্ধুর হাত,
সুখশান্তি
বাঞ্ছিত জগৎ—
যদি একবার বোঝো তুমি
থুথু দিয়ে জোড়া যায় না,
জুড়তে হয় ভগ্নমনোরথ—
এ আগুনে
এ রাংঝালে।’
অথচ এমন আড়োছাড়ো সম্পর্ক রেখে পার্টি করতেন না সুভাষ। বাড়িতে যখন রিটায়ার্ড বাবা, তিন মাসের ব্যবধানে মা আর দাদা মারা গেলেন, তখন স্ত্রীকে নিয়ে চলে গেলেন বজবজের ব্যঞ্জনহেড়িয়া। পার্টির রণদিভে পর্বশেষে চারদিকে তখন দল ছেড়ে দেবার হিড়িক। বাতাসে হতাশা। সুভাষ লিখছেন : ‘পার্টির ওপর তাদের অভিমান লাইন ভুলের জন্যে নয়। যেন কোনো ছেলেধরা ফুল শুঁকিয়ে তাদের ফুস্লে নিয়ে গিয়েছিল। এখন তারা হাত কামড়াচ্ছে।’ ওপর-ওপর ভেসে না থেকে আরও ঘনিষ্ঠ ভাবে জগৎ-জীবনকে জানতে পৌঁছলেন ব্যঞ্জনহেড়িয়া। চটকল আর তেলকলের শ্রমিক মহল্লা। আঠারো টাকা ভাড়ায় মাটির ঘরে বাস। সামনে এঁদো পুকুর। দুজনেই ওয়েজ বিহীন কমিউনিস্ট পার্টির হোলটাইমার। লেখালিখি থেকে সাকুল্যে মাসিক আয় পঞ্চাশ। তাও কিস্তিতে। নতুন ঠিকানা ৭৩, ফকির মহম্মদ খান রোড, বজবজ, চব্বিশ পরগনা। সুভাষ জানিয়েছেন: ‘ভোরে গেট মিটিং। সকালে দুটো নাকে মুখে গুঁজেই চলে যেতে হয় বাসে সটান আলিপুরের ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে।… সন্ধেবেলা ফিরে হয় পার্টি অফিস, ইউনিয়ন অফিস, নয় বস্তিতে। গীতার সঙ্গে ওখানেই কোথাও দেখা হয়ে যায়।’ সকাল থেকে রাত রাজনীতিময় জীবন। কিন্তু তাও পার্টির বন্ধুদের চক্ষুশূল ছিল। ১৪.৫.৫২-তে সুভাষের গদ্য লেখার গুরু সোমনাথ লাহিড়ী চিঠিতে লিখলেন : ‘সুভাষ, পরিচয়ে এসে তোমার দেখা পেলাম না। শুনলাম তুমি নিরিবিলিতে সাহিত্যসাধনা করার জন্যে বনবাস নিয়েছ, আবার পি সি অফিসে শুনলাম যে তুমি ম্যাস কন্ট্যাক্ট করে উপন্যাস লেখার জন্যে বজবজ গেছ।’ লাহিড়ী হাওয়ায় ওড়া গুজবের কিছু নমুনা নিশ্চয় সুভাষকে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের দু-বছর জোড়া বজবজের দিনগুলি জীবন নিয়ে নিরীক্ষায় যেমন তেমনি কবিতায় নেহাত অপচিত হয়নি। ‘সালেমনের মা’-এর মতো কবিতা বাংলা ভাষায় খুব কমই লেখা হয়েছে :
‘পাগল বাবরালির চোখের মতো আকাশ।আসলে নিজের জীবনের সঙ্গে বীজের জীবনের কোনো তফাৎ চাইতেন না তিনি। তাই এমন জীবন সংলগ্ন কাব্য। ১৯৮০-র আনন্দবাজার পত্রিকার যে লেখার কথা আগে একবার উল্লিখিত হয়েছে তার আরও একটু প্রাসঙ্গিক অংশ উদ্ধৃত করলে সুভাষের জীবনবোধ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায় : ‘পদাতিক বেরিয়ে যাওয়ার পর লেবার পার্টি ছেড়ে আমি কমিউনিস্ট পার্টিতে আসি। ডক শ্রমিকদের মধ্যে কাজ দিয়ে আমার রাজনীতিক জীবনের হাতেখড়ি। কমিউনিস্ট পার্টিকে আমি যেটুকু দিয়েছি, আমি পেয়েছি তার বহুগুণ বেশি! পার্টির কর্মসূচি, প্রস্তাব, রণকৌশল, রণনীতি— আমার পাওয়ার উৎস এসবেরও বাইরে। আমি পেয়েছি দেওয়ালে পোস্টার মেরে, অফিসঘর ঝাঁট দিয়ে, মিছিলে গলা মিলিয়ে, কাগজে ডাকটিকিট সেঁটে, খেতখামারে কলকারখানায় কাজ করা হাতের ছন্দে, বস্তিতে আর কুঁড়েঘরে, মাদুরে আর ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে।
তার নীচে পাঁচ ইস্টিশান পেরনো মিছিলে
বারবার পিছিয়ে প’ড়ে
বাবরালির মেয়ে সালেমন
খুঁজছে তার মাকে।
এ কলকাতা শহরে
অলিগলির গোলকধাঁধায়
কোথায় লুকিয়ে তুমি,
সালেমনের মা?
বাবরালির চোখের মতো এলোমেলো
এ আকাশের নীচে কোথায়
বেঁধেছো ঘর তুমি, কোথায়
সালেমনের মা?
মিছিলের গলায় গলা মিলিয়ে
পিচুটি –পড়া চোখের দুকোণ জলে ভিজিয়ে
তোমাকে ডাকছে শোনো,
সালেমনের মা—
এক আকালের মেয়ে তোমার
আরেক আকালের মুখে দাঁড়িয়ে
তোমাকেই সে খুঁজছে।।’
কমিউনিস্ট পার্টি আমাকে তন্ন তন্ন করে দেখার চোখ দিয়েছে, অন্ধকারে ঝাঁপ দেবার সাহস জুগিয়েছে, লাগসই শব্দ দিয়ে আমার মুখে সচিত্র বোল ফুটিয়েছে।
এক জীবনে আমার কাছে এই ঢের।’
তাই তামাম দুনিয়ার কমিউনিস্ট শিল্পী সাহিত্যিকদের বড়ো অংশের মতো স্তালিনের আমলে সোভিয়েতের তথাকথিত ‘মধ্যাহ্নের অন্ধকার’ নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হননি। সুভাষ মুখোপাধ্যায় কিন্তু স্তালিনের মৃত্যুর পর লিখছেন ‘কমরেড স্তালিন’—
‘কমরেড স্তালিন, তুমিআবার সোভিয়েতের বিংশতিতম কংগ্রেসে ক্রুশ্চেভ পেপারস প্রকাশিত হবার পর যখন লাল দুনিয়াজোড়া ভূমিকম্পের পরিস্থিতি, ‘সাইলাস টিম্বারম্যানে’র মতো উপন্যাসের লেখক হাওয়ার্ড ফাস্টও লিখে ফেলেন ‘দ্য নেকেড গড’। সুভাষ কিন্তু রাজনীতির মৌল প্রয়োজনীয়তার, মানব কল্যাণের, শোষণের অবসানের স্বপ্নের হাত ছেড়ে অতি সংবেদনশীল হতে চাননি। বরং ‘মুখুজ্যের সঙ্গে আলাপ’ কবিতায় লিখেছেন—
সুখে নিদ্রা যাও।
রাত শেষ হয়ে এলো;
দাও
এবার আমরা রাত জাগি।
... ... ... ...
আমাদের চোখ থেকে
মুছে নিলে ভয়,
যেদিকে তাকাই
দেখি
স্পন্দমান তোমার হৃদয়।
এ পৃথিবী তোমার হৃদয়।
... ... ... ...
স্তালিন জীবন হোক। আজ থেকে
মৃত্যুহীন জীবনের
নাম হোক
কমরেড স্তালিন।’
‘ধ্বংসের চেয়ে সৃষ্টির,মধ্যিখানে ১৯৬৪-র পার্টিভাগ আর সিপিআইএম-সিপিআই তিক্ততা সুভাষকে পীড়িত করেছে খুব। যা নিয়ে পরে লিখবেন ‘কমরেড, কথা কও’-এর মতো উপন্যাস। নকশালবাড়ির অভ্যুত্থান সমর্থন করেননি। কিন্তু নকশালবাড়ির জন্ম তো কমিউনিস্ট রাজনীতিরই গর্ভে। তাই তাকে অস্বীকার করতেও পারেননি। ১৯৪০-এর দশক যে বিপ্লবের সম্ভাবনায় সতত চঞ্চল ছিল, ভুল হোক বা ঠিক নকশালবাড়ির বিদ্রোহ সেই আকাঙ্ক্ষিত মোমেন্টাম নিয়ে আছড়ে পড়েছিল এদেশের বুকে। ‘ছেলে গেছে বনে’ কবিতায় তাই তিনি লিখলেন—
অন্ধকারের চেয়ে আলোর দিকেই
পাল্লা ভারী হচ্ছে।
... ... ... ...
পুরনো মানচিত্রে আর চলবে না হে,
ভূগোল নতুন ক’রে শিখতে হবে।
আর চেয়ে দেখো,
এক অমোঘ নিয়মের লাগাম-পরা
ঘটনার গতি
পাঁজির পাতায় রাজজ্যোতিষীদের
দৈনিক বেইজ্জত করছে।
ধনতন্ত্রের বাঁচবার একটাই পথ
আত্মহত্যা।
দড়ি আর কলসি মজুত
এখন শুধু জলে ঝাঁপ দিলেই হয়।
পৃথিবীকে নতুন করে সাজাতে সাজাতে
ভবিষ্যৎ কথা বলছে, শোনো,
ক্রুশ্চভের গলায়।’
‘... এখনও মিছিল গেলে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়াই রাস্তায়আবার সিপিআইএম দলটির শাসনকালে পশ্চিমবঙ্গের সদর মফস্সলে দলতান্ত্রিকতার চূড়ান্ত চেহারা দেখে তিতিবিরক্ত হলেও সীমিত ভূমিসংস্কারেই বাংলার গ্রাম যে জেগে উঠছিল তাও চোখ এড়ায়নি তাঁর। পুরোনো কমরেড জ্যোতি বসুর উদ্দেশে তাই লিখছিলেন, যে প্রতিমা গড়ছেন তাতে অনুগ্রহ করে যেন তিনি চক্ষুদানও করেন। কিন্তু কা কস্য পরিবেদনা! সুভাষ মুখোপাধ্যায় ক্রমে ‘ওদের’ হয়ে গেলেন। ভারতের কমিউনিস্টদের যদি কোনো সাংস্কৃতিক মানচিত্র নির্মাণ করা হয় তাতে সুভাষকে বাদ দিলে অন্যতম প্রধান একটি প্রদেশ বাদ যায় বলেই মনে হয়। যদিও সুভাষের রাজনৈতিক ভাবনা শেষ পর্যন্ত একই রকম অভ্রান্ত ও ঋজু ছিল এমন কথা বলা যায় না। সিপিআই ১৯৭৫-এ ইন্দিরা গান্ধির জাতীয় জরুরি অবস্থা ঘোষণাকে সমর্থন করলেও, ভাটিন্ডা কংগ্রেসে সেই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার পর সেটি একটি বিচ্যুতি হিসেবে স্বীকৃত হয়। সুভাষ তা মানতে পারেননি। তিনি মনে করতেন ‘জরুরি অবস্থা ঘোষণার যথেষ্ট যৌক্তিকতা ছিল। কারণ দক্ষিণপন্থী দলগুলি তখন বিপজ্জনক ভাবে’ শক্তি সঞ্চয় করছিল। ইতিহাস প্রমাণ করেছে সুভাষের এই বিচার ঠিক ছিল না। কিন্তু তাতে তাঁর চার দশকের রাজনীতি মিথ্যে হয় না। মিথ্যে হয় না ‘শ্রেণীহীন সমাজের চিরবাসনায়’ আমাদের পদাতিক কবির অবদান। সুভাষ মুখোপাধ্যায় বাঙালির সংগ্রামী চেতনার পূর্বপুরুষ। অভ্রান্ত ছন্দে, ভরপুর স্বপ্নে যিনি বিদ্রোহের চিত্রকল্পের নির্মাতা। ‘কমরেড, আজ নবযুগ আনবে না?’— এই নীল গ্রহের যে কোনো প্রান্তে সংগ্রামের ম্যানিফেস্টোর প্রথম চরণ হতে পারে অনায়াসেই।
যে কোনো সভায় গিয়ে শুনি
কে কী বলে।
কেউ কিছু ভালো করলে দিই তাতে সায়।
সংসারে ডুবেছি, তাই জ্বালাই না ধুনি।
ফেলে রেখে আমাকে বন্ধনে
ছেলে গেছে বনে।
অথচ তারই হাতে দেখছি মুক্তপাখা
যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত
আমারই পতাকা।।’