ওগো মায়া, ওগো বাতায়ন সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়; সংকলক : সুশোভন প্রামাণিক, প্রথম প্রকাশ: আগস্ট ২০১৬; খোয়াবনামা - কলকাতা- ১০৩; পৃষ্ঠাঃ ২৪৭; ISBN: 978-81-932067-8-2
“Yet we have on living
Living and partly living”- T.S. Eliot
প্রখ্যাত নগর সমাজতাত্ত্বিক লুইস মামফোর্ড শহরের বিবর্তনের (অবশ্যই পশ্চিমীদেশের) কথা বলতে গিয়ে আমাদের শুনিয়েছিলেন — ‘মেট্রোপলিস থেকে নেক্রোপালিসের (City of the Dead) দিকে ছুটে চলার কথা। অন্যদিকে, নগর-দার্শনিক ফ্রাঙ্ক লয়েড রাইট (আমেরিকার বড় শহর সম্পর্কে বলেছিলেন, যা আমাদের শহর কলকাতা সম্পর্কেও প্রাসঙ্গিক) মন্তব্য করেছিলেন — “The carcass of the city is far too old, too far gone …. hopelessly, helplessly, inorganic it lies there” অর্থাৎ পুরোনো শহরকে আর কোনভাবেই নতুন রূপ দেওয়া সম্ভব নয়, কারণ তার মৃতদেহ অনেককালের বাসি এবং তার বিকৃতিও ব্যাপক’। মনে রাখতে হবে, সমাজবিজ্ঞানীদের এইসব মন্তব্য উঠে আসছে এমন একটা সময়ে — যখন আধুনিকতা, নগরায়ণ ও শিল্পায়ন তার চূড়ান্ত পর্যায়ে — তখনও বিশ্বায়নের সর্বব্যাপী স্রোত গ্রাস করে নি শহরগুলোকে। মামফোর্ড প্রয়াত হলেন ১৯৯০-তে। বিগত শতকের নয়ের দশক নিয়ে এলো নানামুখী বদল। সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর পতন, বিশ্বায়ন, উদারীকরণ, বেসরকারীকরণ … কাঠামোগত সংস্কার কর্মসূচী, মুক্তবাণিজ্য … ইত্যাদি কতো না অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক প্রক্রিয়া। আপাত গালভারী এইসব শব্দের পেছনে ‘নিহিত পাতালছায়া’ কি বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে আমাদের শহরের মানচিত্রে, আমাদের নাগরিক জীবনে, এমনকি ব্যক্তিজীবনেও … তা আমাদের বোধগম্য হয় নি, যা বুঝতে লেগেছে আরও এক দশক, যখন ‘প্রতিটি প্রাণ অন্ধকারে নিজের আত্মবোধের দ্বীপের মতো’। সমাজবিজ্ঞানী মামফোর্ড জীবৎকালে ভুবনায়নের করাল ছায়া প্রত্যক্ষ করেন নি — কিন্তু ১৯৪৬-এ লেখা ‘City Development’ বা ‘The City in History’ (১৯৬১) গ্রন্থে শহরের বিবর্তনের যে ছবি এঁকেছেন — তা এই ২০১৭ সালেও সমান প্রাসঙ্গিক। পূর্ব আলোচনার সূত্র ধরেই বলি, বিশ্বায়ন আমাদের নাগরিক জীবনে নিয়ে এলো ঝাঁ-চকচকে শপিং মল, মাল্টিপ্লেক্স, আর সুখাদ্যের সম্ভার-সাজানো কতশত খাদ্য-বিপণি (সমাজবিজ্ঞানী রিট্জার এই প্রক্রিয়াকে বলেছেন ম্যাকডোনালাইজেশান)। তাই শহরের এই বদলে-যাওয়া চরিত্র ছুঁয়ে দিল আমাদের রুচি, খাদ্যাভাস — আরও ব্যাপক অর্থে আমাদের মূল্যবোধ, সম্পর্কের ক্ষেত্র, আমাদের মানসিকতা ও আরও অনেক অনেক কিছু। ওয়ার্থ (Wirth)-কথিত শহুরে নৈর্ব্যক্তিক সম্পর্ক আমাদের আরও বেশি আত্মমুখী করে তুলল, আমরা আমাদের চারপাশে বানিয়ে তুললাম এক কাঁচের আবরণ, যাকে মনস্বী সমাজতাত্ত্বিক জর্জ সিমেল বলেছেন metropolitan type of individuality বা blase attitude (নির্বিকারত্ব)। ফলে ভীড়ের মধ্যে একা হয়ে যাওয়া মানুষ পরিপার্শ্ব সম্পর্কে উদাসীন — এক অবক্ষয়ী শহুরে সমাজে নির্জন দ্বীপের মতোই (জীবনানন্দ দাশের কবিতায় নানাভাবে এসেছে এই ছবি)। প্রতিবেশিত্ব নেই, বন্ধুতা নেই — আছে শুধু স্বার্থ-সাধন। যতক্ষণ প্রয়োজন, ততক্ষণ-ই তুমি বন্ধু — তারপর আর কোনও উষ্ণতা নেই সম্পর্কের। আবার দরকার হলে ভাঙ্গা গীটারের ছেঁড়া তার জোড়া লাগানোর অপচেষ্টা, যখন হয়তো আর কোনও সুরই ঠিকমতো খেলে না।
একটি বইয়ের পাঠ-প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে কেন এমন সব প্রসঙ্গ উত্থাপিত হল? — এ প্রশ্ন উঠতে পারে। আসলে আলোচ্য বইটির বিভিন্ন লেখা পড়তে পড়তে আমার শহরের (কলকাতা) এই বিবর্তনের ও আমাদের নাগরিক মানসিকতার (ব্যক্তি-মানসিকতারও) বদলে যাওয়া মুখচ্ছবি কেমন যেন স্পষ্ট হয়ে উঠলো। ঘষা কাঁচের ওপার থেকে দেখা দৃশ্যের সারি। তবে ‘কেবলই দৃশ্যের জন্ম নয়’ — আপাত-তুচ্ছ দৃশ্যের ভেতরের থেকে ক্রিস্টালের মতো স্পষ্ট হয়ে ওঠে নানা দর্শন, নানা তত্ত্বের আভাস, নানা তর্কের ইঙ্গিত। সমাজবিজ্ঞান-চর্চার সঙ্গে দীর্ঘজীবন যুক্ত থাকার সুবাদে এই গ্রন্থভুক্ত লেখাগুলো আমাকে বিশেষভাবে আকর্ষণ করেছে। সাহিত্যের সমাজতত্ত্ব (Sociology through Literature) গ্রন্থে লুইস কোসার (Lewis Coser) জোরের সঙ্গে বলতে পারেন ‘শুধু ঔপন্যাসিক নয়, সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় যারা সৃজনশীল — তাঁরা তাঁদের লেখার মধ্যে জীবন ও সমাজের বিভিন্ন রঙ, বিভিন্ন প্রেক্ষিতকে ধরতে চেষ্টা করেন’। আমার মনে হয়েছে — শুধু সামাজিক প্রেক্ষিত বা জীবনের রঙ নয়, সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় তাঁর লেখার স্তরে স্তরে কি নিপুণভাবে ছড়িয়ে দিয়েছেন - নানা দার্শনিক উপলব্ধি, সামাজিক তত্ত্বের নানা মাত্রিক বিন্যাস — যা হয়তো সমাদৃত হয়ে উঠতে পারে ভবিষ্যতের সাহিত্য ও সমাজতত্ত্বের গবেষকের কাছে!
মাস কয়েক আগে কলকাতার এক উঠতি প্রকাশক আয়োজিত সাহিত্যের আড্ডার মাসিক সমাবেশে যাবার সুযোগ হয়েছিল (নিমন্ত্রণ পেয়েছিলাম) এই কলমচির। সেই মাসের আড্ডার বিষয় ছিল — ‘প্রবন্ধ’ এবং এই বিষয়ে বলার জন্যে সেই আসরে আমন্ত্রিত ছিলেন নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক থেকে শুরু করে, অতীতের খ্যাতনামা সাহিত্যকদের পুত্র ... এমন কি বহুল প্রচারিত বাংলা দৈনিকের তথাকথিত প্রবন্ধ লিখিয়ে-ও। তো, এইসব বক্তারা ‘প্রবন্ধ কেমন হওয়া উচিত’ — এই নিয়ে ভারী ভারী সব কথাবার্তা বলেছিলেন — ‘প্রবন্ধের প্রকরণ, প্রবন্ধের ভাষা, প্রবন্ধের আকার, রস ... আরও কত কী! শরতের এক মনোরম সন্ধ্যায় এইসব কথাবার্তা আমাকে দিনের শেষে এমন ক্লান্তির দেশে নির্বাসন দিতে উদ্যত হয় যে আড্ডা অসমাপ্ত রেখে ক্ষমা চেয়ে পালিয়ে আসি। নেওয়া সম্ভব ছিল না আর, তখন আমার মন ও মগজ বাঁধা পড়ে আছে “ওগো মায়া, ওগো বাতায়নে”। সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়ের লেখার সঙ্গে আমার অন্তরঙ্গ পরিচিতি ঘটে ১৯৯১ সালে ‘অন্তবর্তী প্রতিবেদন’-র সূত্রে (এই বই, যদিও, প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৮৯ সালে)। সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় এই বইটির প্রতি তাঁর মুগ্ধতা প্রকাশ করতে গিয়ে সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়কে চিহ্নিত করতেন “অর্ন্তবেদী প্রতিবেদনের” লেখক হিসাবে, আর ষাটের দশকের এক কবি তো দেখেছি তার বুকসেল্ফে-র সামনে সাজিয়ে রাখতেন বইটাকে আর আড্ডা দিতে আসা তরুণ কবিদের উৎসাহ দিতেন বইটার পাঠের বিষয়ে। বই ছাড়াও বিভিন্ন পত্রিকায়, সংবাদপত্রে, এদিক-ওদিক দীর্ঘদিন ধরেই সঞ্জয়ের লেখা পড়ে আসছি — যা আকারে কখনও দীর্ঘ, কখনও নাতিদীর্ঘ। ছকবাঁধা প্রবন্ধের প্রকরণ, আকার, কাঠামো, রস ইত্যাদির তোয়াক্কা না করে তিনি কোনও নির্দিষ্ট বিষয়ে (চলচ্চিত্র, সঙ্গীত, কবিতা বা মানুষের দিনযাপন) নিজের ভাবনা-চিন্তা প্রকাশ করেছেন এবং ধারাবাহিকভাবে করে চলেছেন। ফলে তিনি আয়াসহীন ভাবে হয়ে উঠেছেন আমাদের সমকালীন জীবনের, সংস্কৃতির এক ধারাবাহিক ভাষ্যকার। তাই তাঁর সম্পর্কে ‘প্রাবন্ধিক’ এই বিশেষণে বিশেষিত করতে আমার দ্বিধা হয়। আর প্রবন্ধ সম্পর্কে তাঁর মন ও মননেও যে কোন ভালোলাগা নেই, তা স্পষ্ট হয়ে উঠল জনৈক তরুণকে দেওয়া তাঁর এক ভিডিও-সাক্ষাৎকারে, যেখানে তিনি বলছেন — ‘প্রবন্ধ হচ্ছে একটি বাতিল ধারণা। ... চিন্তাটাই সবচেয়ে বড় সম্পদ। ... নিজস্ব ভাবনাকে যে-কেউ যে-কোনও ভাবে বলতে পারে। আসল কথা হল চিন্তনপ্রক্রিয়াকে নথিভুক্ত করা।’ তাঁর এই মূল্যবান কথার সমর্থন মেলে তাঁর দেড়-দু’পাতার লেখায়, ব্লগে বা অন্যত্র স্বল্প আয়তনিক লেখায় - যে লেখায় মিশে রয়েছে আমাদের মতো প্রজন্মের মানুষের স্মৃতি-বিস্মৃতি, ধূসর-বিবর্ণ ছেলেবেলা, আমাদের স্বপ্ন-প্রেম-প্রেমহীনতা, আনন্দ-বিষাদের-যৌনতার অজস্র ছবি, টুকরো টুকরো ছবি বা অন্যভাবে বলা যায়, এই সব ছবির কোলাজেই তৈরি হয়ে উঠেছে লেখাগুলো ... যা পড়তে পড়তে মনে হতে পারে অধুনা মুখদর্শনীতে (ফেসবুক) পোষ্ট করা কোনও তাৎক্ষণিক ভাবনা বা প্রতিক্রিয়া। ফলে এই লেখাগুলোর মধ্যে দিয়ে অন্তত আমার কাছে ছকবাঁধা (stereotyped) প্রবন্ধের গতানুগতিক মুখচ্ছবি ধরা পড়ে নি। (তাই এগুলোকে ‘না-প্রবন্ধ’ বা ‘প্রবন্ধের মতো’ বলা যেতে পারে)। আর যদিও গতানুগতিক চিন্তায় সঞ্জয়কে প্রাবন্ধিক বলেই চিহ্নিত করি, তাহলে বলতে হয় — ‘বাংলা প্রবন্ধ-সাহিত্যকে তিনি শুধু রক্তাল্পতা থেকেই মুক্ত করেন নি’, তিনি এর অবয়ব বা কাঠামো ও প্রকরণ-ও পাল্টে দিয়ে সঞ্চার করেছেন নতুন প্রাণ। সালতামামি ছেড়ে এবার আসি মূল বইটির প্রসঙ্গে।
২৪৭ পৃষ্ঠাসম্বলিত এই বই বিন্যস্ত চারটি অধ্যায়ে — ১. রেখেছো বাঙালি করে ২. জন্মান্তরের স্মৃতি ৩. রক্তের ডালপালা ৪. ওগো মায়া ওগো বাতায়ন। প্রতি অধ্যায়ে প্রতিটি লেখাই সুপাঠ্য শুধু নয়, আমাদের জীবনে ও যাপনে মিশে থাকা নানা অসংগতি যেগুলো সম্পর্কে আমরা আপাত উদাসীন — সেগুলোকে প্রশ্নচিহ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়। সত্যিই তো, অমর্ত্য সেন, রবিশঙ্কর, সত্যজিৎ রায় ছাড়া আর কোনও বাঙালির নাম কেন দেশের সীমানা ছাড়ায় না? কেন হারিয়ে গেল বাঙালির নিজস্বতা, আভিজাত্য? কেন বাঙালি তরুণ-তরুণীরা কষ্ট করে ৩/৪ লাইন বাংলা বললেও তার মধ্যে ১০টা ‘বাট’, ‘বিকজ’ আর ‘ইনফ্যাক্ট’? ‘কিন্তু’ ‘কারণ’ বা ‘সত্যি বলতে’ — এমন সব শব্দবন্ধ কি তাহলে হারিয়ে গেল বাংলা ডিকশ্নারি থেকে? বাঙালি আর স্বপ্ন দেখে না, সর্ষে সিয়ে মানকচু বাটা খায় না, মাছের ঝোল তার কাছে বিস্মৃতি। এখন তো ‘ম্যাকডোনালাইজেশন’ এর যুগ। বাঙালি ‘যেমন খুশি সাজো’ পোষাক পরে ঘুরে বেড়ায় কে.এফ.সি-তে, বার-কি-কিউ নেশানে(!)। অনেক বাঙালিবাড়িতে নাকি আজকাল ‘রান্নাঘর’ থাকলেও সেখানে রান্না হয় না — খাদ্য আসে ‘হোম ডেলিভারি/ সার্ভিস’ থেকে।
বিভিন্ন লেখায় সঞ্জয় এই আত্মবিস্মৃত বাঙালির দিকে আড়চোখে বা চশমার ফাঁক দিয়ে তাকিয়েছেন আর তির্যকভাবে কোথাও শ্লেষ, আবার কোথাও বিষাদ মিশিয়ে পরিবেশন করেছেন তার সমকালীন ভাবনাগুলোকে (যার মধ্যে রয়েছে উৎকন্ঠা-ও)। তাঁর ভাষায় — ‘স্বপ্নের ফেরিওয়ালা হওয়ার যোগ্যতাও বাঙালি মধ্যবিত্তের আর রইল না’ বা ‘এথনিক বাঙালি দেখতে হলে বছরে একবার সায়েন্স সিটির পাশে মিলনমেলায়, সেখানে কাতারে কাতারে বাঙালি পুলিপিঠে খাবে বলে বইমেলায় ডানা মুড়ে বসে।’ এই অধ্যায়ে একটি উল্লেখযোগ্য লেখা — ‘বিদ্যার মোচ্ছব: সেমিনারোলজি’। বর্তমান কলমচি-ও যেহেতু প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যাচর্চার সঙ্গে যুক্ত দীর্ঘদিন ধরেই, তাই ‘বিদ্যার মোচ্ছব’ যে কতটা অন্ত:সারশূন্য আর ঝাঁ-চকচকে দেখনাই-তে ভরা, তা অতিমাত্রায় বোধগম্য হয়েছে অজস্রবার। (যদিও অনেকবার তাকেও নিমরাজী হয়ে এই মোচ্ছবের অংশীদার হতে হয়েছে।) আর পশ্চিমবঙ্গের এক নামী বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাকেন্দ্রে দীর্ঘ ১৪ বছর ‘গবেষণা সহযোগী’ হিসাবে যুক্ত থাকার সুবাদে ‘সেমিনারোলজি’ কি বস্তু - তা হাড়ে হাড়ে বুঝেছি। ঐ ‘দিবে আর নিবে - মিলাবে মিলিবে’-র বস্তুবাদী হিসেব-নিকেশ! দিনভর বকম্-বকম্, বিরিয়ানী-চাঁপ বা ফ্রায়েড রাইশ-চিলিচিকেনের মাধ্যাকর্ষণ টানে, ২৫ থেকে ৮৫ সব সেমিনারমুখী। ‘সমস্ত দিনের শেষে’ তাবড় তাবড় পণ্ডিতদের অ্যাকাডেমিক কোঁত যে কী অশ্ব-ডিম্ব প্রসব করে, তারও অজস্র উদাহরণ ছড়ানো আছে, সেমিনারে-সেমিনারে। ফলে হাতে থাকে বলপেন বা পেন্সিল আর ‘কাগজের স্তূপ জমতে থাকে জমতেই থাকে’। আর মাথার ভেতরেও গজগজ করে ঐসব পণ্ডিত অধ্যাপকদের বক্তৃতা (যারা শ্রেণীকক্ষে জেরক্স বিলোন কল্পতরু হয়ে আর সেমিনারকক্ষে কী সরব ও সক্রিয়)!। আজ এই ধূসর প্রৌঢ়ত্বে পৌঁছে মনে পড়ে চাণক্য শ্লোক — “মূর্খের দেশে বিদ্যা একটি বোঝা, গাধারাই তা বহন করে”!
ব্যক্তিগত ভালোলাগার কথা বলতে গেলে বলব যে, আমার মন ছুঁয়ে গেছে ‘জন্মান্তরের স্মৃতি’, ‘রক্তের ডালপালা’ এবং ‘ওগো মায়া ওগো বাতায়ন’ পর্যায়ের লেখাগুলো। বিচ্ছেদ, শ্যাওলা-রঙা মনখারাপ, কখনও ‘স্মৃতির সুরভি’, কখনও ‘ছায়ারোদ্দুর’ কেমন যেন এক আশ্চর্য ভালোলাগার নক্সীকাঁথা বুনে দেয় লেখাগুলোর গায়ে — বিষয়ের মধ্যে ফারাক সত্ত্বেও কিংবা বিভিন্ন সময়ে জাত লেখাগুলো কেমন করে যেন অনায়াসেই হয়ে ওঠে সুতোবিহীন মালিকা! আমরা যারা সাধারণ পাঠক, যারা সঞ্জয়ের প্রজন্মের প্রায়-কাছাকাছি, তাদের মানসিকতা ও সমাজ-সময়কে দেখার দৃষ্টির মধ্যে তো কোথাও সামান্য হলেও মিল ছিল। তখন মাল্টিপ্লেক্স ছিল না, সালোঁ ছিল না, পার্লারে ভরে যায় নি শহর — শপিং মলের সমারোহ মুখ ঢেকে দিত না। তাই আমরা চারদিক থেকে কুড়োতে চাইতাম জীবনের খোলাম-কুচি, বসন্তে যেমন করে কুড়োতাম পলাশ বা কৃষ্ণচূড়া আর শরতে শিউলি ফুল। আমাদের শৈশব, কৈশোর বিপন্নতার চোরাবালিতে পা রাখে নি, আমাদের তারুণ্য-যৌবন ছিল ‘মন-কেমন করা’ আনন্দে ভরা। ‘মুক্ত-সম্পর্কে’ তখন অনায়াস ছিল না যৌনতার হাতছানি। তখন প্রেমে ছিল হাতচিঠির গোপন-চলাচল, এস.এম.এস, হোয়াটস-অ্যাপ, মুঠোফোনের ‘ইনবক্সে’ বার্তার আধিপত্যহীন। ‘বকুল গন্ধে সন্ধ্যা’ নামার আগে আমাদের নিশ্চিত ডেস্টিনেশান ছিল বারান্দার ব্যালকনি বা আলসে্হীন খোলা ছাদ — যেখানে কারুর চোখের চাওয়া মন দুলিয়ে দিত। কিংবা সরস্বতী পুজোর সকালে হলুদ শাড়ি-পরিহিতা নন্দিনীদের জন্যে যুবকদের ভীড় জমত গার্লস-স্কুলের সামনে! তবে তারা কেউ লেখকের মতো ‘নন্দিনীর মুখে গীতবিতানের কারুকার্য’ খুঁজতে চেয়েছে কিনা জানা নেই। যৌবনের সেই উন্মাদনার দিনে সঞ্জয় সুন্দরকে চিনতে শিখেছেন আর কী সাবলীলভাবেই ব্যক্ত করেছেন তার উপলব্ধি — “টোড়ির রেখাব থেকে গান্ধারে উঠে আকাশের মেঘ নন্দিনীর নাকে ছায়া ফেলেছে, সরস্বতী প্রণাম করে আমার মনে হল, এ জীবন সুন্দরের।” এইরকম সব আশ্চর্য হীরকদ্যুতি এই বইয়ের পাতায় পাতায় উদ্ভাসিত! আলোচনার সীমিত পরিসরে এতসব চমৎকার লেখা নিয়ে কথা বলার তাগিদ বা ইচ্ছে ষোলো আনা থাকলেও, বাস্তবিক সম্ভব নয়। তবে হ্যাঁ অবশ্যই উল্লেখ করবো বন্ধু নবারুণ ভট্টাচার্যের সঙ্গে চিরকালীন বিচ্ছেদের পরে লেখা বিষাদগাথা ‘বমির দাগ’ (‘এই সময়’-এ প্রকাশিত ও পঠিত)। ‘ইতরের দেশে’ জাত এই লেখক ও কবির (নবারুণ ভট্টাচার্য) কলম ছিল খোলা তলোয়ার, তাই তো তিনি সদর্পে, না কি অবজ্ঞায় ছুঁড়ে দেন এমন পঙ্ক্তি — “বেশি বড়লোকের সঙ্গে মাখামাখি করার দরকার নেই। তাতে কখনও শিল্প হয় না, দালালি হয়।” নবারুণ ভট্টাচার্যের মতো বন্ধুর চলে যাবার পথের দিকে তাকিয়ে, চুল্লীর আগুনের বিভায় চোখ রেখে সঞ্জয় লিখে ফেলেন বিদায়-ইস্তেহার — “আমাদের চেনা উপাখ্যানে নবারুণ, আমাদের সহজীবী ও মহাযোদ্ধা, অন্যরকম ওয়াচ-টাওয়ার ..,” নবারুণের লেখা আসলে বমন-রহস্য। অবাধ্যতার অনার্য মস্করা। অথচ নবারুণ দেখেছিল বাতাসে বিপদের গন্ধ।
শ্রাবণমেঘের আধেক দুয়ার যাঁর কন্ঠের যাদুতে অনায়াসেই খুলে যায়, যাঁর কন্ঠ আমাদের মনে করিয়ে দেয় ‘পুরোনো সেই দিনের কথা’ — তিনি হলেন “রবীন্দ্রসঙ্গীতের বিশ্বে সর্বাধিকভাবে সেরিব্রাল” — আমাদের আত্মার আত্মীয়, দেবব্রত বিশ্বাস। ‘চিরসখা হে — দেবব্রত বিশ্বাস’ লেখায় সঞ্জয় আমাদের মনে প্রদীপের নিভে-আসা সল্তের মতো উস্কে দেন এই মহান শিল্পীর একা-হয়ে যাবার বেদনাহত এপিসোড। ‘বিশ্বভারতীর নায়েব-গোমস্তাদের’ নির্দেশিত ছক-বাঁধা পথে হেঁটে জর্জ বিশ্বাস কোনও ‘অচলায়তনের বাসিন্দা’ হতে চান নি। চাইবেন কেন? তিনি তো স্বীয় প্রতিভায়, স্ব-পরিচয়ে, যাদুকন্ঠের মাদকতায় অনন্য এবং অমৃত্যু উচ্চশির। মাস কয়েক আগে দেবব্রত বিশ্বাসের জন্মদিনে মুখদর্শনীতে (ফেসবুকে) সকাল থেকে দুপুর, দুপুর থেকে রাত্রি পর্যন্ত দেবব্রতর অনুরাগীরা সঞ্জয় মুখপাধ্যায়ের এই লেখাটিকে উদ্ধৃত করেছেন — ‘জর্জ বিশ্বাসের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য’ এই শিরোনামে।
মন ছুঁয়ে যায় আরও একটি স্মৃতিমেদুর আন্তরিক লেখা — “মা আমার”। আমাদের সকলের মনেই এক গভীর গোপন অনুভূতি হচ্ছেন মা — যিনি জীবনের পরতে-পরতে জড়িয়ে আছেন আনন্দ-বিষাদ-যন্ত্রণায় — যিনি আমাদের ঝড়ের রাতে, বর্ষার দুপুরে কিংবা শীতের ভোরবেলায় চরম ও পরম আশ্রয়। ধরিত্রীর মতোই সর্বংসহা জননী — যার জঠর-নিষ্ক্রান্ত হয়ে আমাদের প্রথম পৃথিবীর আলো দেখা! দুর্গোৎসবের স্মৃতিগাথার মধ্যে কখন যেন প্রয়াত মা’য়ের স্মৃতিও মিশে যায় লেখকের মনের অলিন্দে। কী আন্তরিকতায় সঞ্জয় লেখেন — ‘আমার শ্যামবর্ণা মা ভাদ্রমাসের শেষদিকে মাথায় রিঠা ঘসে সাবান দিয়ে স্নান করার পর তাকে খুব উজ্জ্বল লাগতো! মনে হত আশ্বিন এসে গেছে, রোদ্দুরের রঙ্ হলুদ হল।’ মনে পড়ে যায় স্মৃতিধার্য সেই পঙ্ক্তি — “মাগো আমার মা, তুমি আমার দৃষ্টি ছেড়ে, কোথাও যেও না”। কিন্তু মা’রা তো চলেই যান — দৃষ্টিপথ ছেড়ে - দূরবর্তী কোন নীহারিকার দেশে! আমাদের চোখের জলে জোয়ার নামে! — এই বইয়ের নানা লেখায় সঞ্জয় আমাদের উপহার দেন বোধ ও বিষাদে উৎকীর্ণ অসংখ্য ছবি। আমরা দেখতে পাই — “ভান গঘের কাকেরা গমক্ষেতের ওপর দিয়ে উড়তে থাকে; ড্রয়িং-এর মৌনসংহতি ছিঁড়ে ফেলে তারা আমাদের সঙ্গে কথা বলে; আমাদের রক্তে মিশিয়ে দেয় কান্নার উৎক্ষিপ্ত ও একাকী চিত্রমায়া”। বিপন্ন বিস্ময়ে আমরা দেখি এই চলমান দৃশ্যাবলী কোথাও যেন আমাদের অনুভূতিপ্রদেশেও আলো ফেলছে! রোলাঁ বার্তের মতো (সঞ্জয়ের অত্যন্ত প্রিয় দার্শনিক, এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছেন বার্তের ‘মিথোলজি’র প্রতি তার মুগ্ধতার কথা) সঞ্জয়ও আমাদের চেনা পরিবেশে, সমসময়ের প্রেক্ষিতে হয়ে ওঠেন একজন প্রকৃত ‘দৃশ্যকথক’। চলচ্চিত্র-বিদ্যার শিক্ষক ও চলচ্চিত্র বিশেষজ্ঞ হওয়ার কারণে তার লেখায় ‘ভিসুয়ালিটি’ এত বেশি! তাই কী অনায়াস দক্ষতায় তুলে আনেন ‘অলীক জনপদ’ কালীঘাটের গলি-উপগলি, সামাজিক জীবন — চেনা-অচেনা মানুষ ও তাদের নিত্যদিনের সম্পর্ক, কলকাতার বদলে-যাওয়া স্কাইলাইন, পুরোনো ভাঙাচোরা বাড়ির পাশে জন্ম-নেওয়া বহুতল, আর আকাশের কাছাকাছি এই সুরম্য বহুতলের পাশে পড়ে থাকা ঘিঞ্জি বস্তি, যেখানে জমা হয় মাছের কাঁটা, আবর্জনার স্তূপ, কলের জলের জন্যে ঝগড়া। এইসব দৃশ্য আমাকে মনে করিয়ে দেয় বিশিষ্ট সমাজ-ভাষ্যকার ম্যাকাইভারের মন্তব্য — “The city is the place of opposites” সত্যিই কী বিষম বৈপরীত্যে ভরা এ শহর!
‘স্মৃতির বালুচরে’ ভিড় করে আসা অজস্র ঘটনার মধ্যে সঞ্জয় তুলে ধরেছেন আগুন-ঝরা সেই সত্তর দশকের উত্তাল রাজনীতির আবহ! ‘রক্তের ডালপালা’ পর্যায়ের এরকম দু’টি লেখা ‘ওগো বারুদ হাওয়া’, ‘অনধিকার চর্চা’। মনে পড়ে কলকাতা থেকে বেশ দূরে ‘দিগন্তের কোল-ঘেঁষা শ্যাম মফস্বলে' নিজের কিশোরীবেলা, যখন স্কুলের দেওয়ালে দেওয়ালে লেখা থাকত 'দিনবদলের পালা এল / ঝোড়ো যুগের মাঝে’। বান্ধবীর বাড়িতে শুনতে পেতাম বৈঠকখানা ঘরে তরুণ দাদার উত্তেজিত কন্ঠ — ‘প্রিয়, ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য’। সবকিছু কেমন ধোঁয়াশা লাগত, কারণ সে বয়সে রাজনীতির জটিল আবর্তে ডুব-সাঁতার কাটার বয়স হয় নি। সঞ্জয় নিজেও যেহেতু ছাত্রজীবনে তুমুলভাবে বামপন্থী রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছিলেন, তাই তার নিজস্ব অভিজ্ঞতার বিশ্বস্ত দলিল হয়ে উঠেছে এই দুটি লেখা। কিভাবে ক্লাসরুমের বাইরের ক্লাস ছাত্রদের দিয়ে একটা বিকল্প বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করতে সাহায্য করেছিল; তৎকালীন মার্কসবাদী নেতারা কোন ঘটনার প্রেক্ষিতে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রদের নিয়ে বৈঠক করতেন — স্থান পেয়েছে এইসব ঘটনার বিবরণ-ও। আছে বর্ষশেষের শীত-সন্ধ্যায় উপাচার্য গোপাল সেনের মর্মান্তিক মৃত্যুর বেদনাহত ছবি। মনীষীদের মূর্তিভাঙা, অগ্নিসংযোগ — সারা পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা। এসব তো চেনা ছবি। বিপ্লবের মন্ত্র নিয়ে যেসব মেধাবী তরুণেরা সেই সময় যে নকশালপন্থী রাজনীতিতে জড়ালেন — তাদের পথ ঠিক ছিল কিনা — তা নিয়ে তর্কে-বিতর্কে গঙ্গা দিয়ে অনেক জল গড়িয়েছে! একসময় স্বপ্নের ফানুস নেমে এসেছে মাটিতে। সে অন্য প্রসঙ্গ। তবে ইতিহাস সাক্ষী থেকেছে সে’-সব দিনের — যখন 'বরানগরের ১৩ই আগস্টের সেই ভয়াবহ দিন ও রাতের পর শিলাঘাটে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে অসংখ্য তরুণদের ধড়হীন মাথা! ‘মুণ্ডমালায় হেঁটে গেছে’ কত-শত দেনা! সন্তানহারা বাবা-মায়ের আর্তনাদে বরানগরের গলি-উপগলির চোখ ঝাপসা হয়ছে।' সে সব এখন গল্প-কথা। সঞ্জয় যথার্থই বলছেন — ‘অনেকেই আজকাল, নকশালপন্থীদের নিয়ে রূপকথার গল্প লেখেন। শুধু আমরা ছিন্ন লাশ: পুরোপুরি ম্যাজিক রিয়াল।‘
বহতা সময়ের রোদ ডানায় মেখে যেসব দৃশ্য/ দৃশ্যাবলী ধরা দিয়েছে ‘ওগো মায়া ওগো বাতায়নে’-র বিভিন্ন শীর্ষকের লেখায় — তা যেন পাঠকের কাছে একটা মায়াবী জার্নির মতো! তাই ‘রান্নাঘর ওগো’র পাশ কাটিয়ে চলতে চলতে আমরা কখন যেন পৌঁছে যাই এই বইয়ের শেষ লেখায় — “সমুদ্রের কান্না, চাঁদের গোধূলিতে”। কী অপার এক বিষন্নতা লুকিয়ে আছে এ’লেখায় — যার থেকে হয়তো আনন্দের দূরত্ব খুব বেশি নয়। মৃত্যু জীবনের অনিবার্য পরিণতি, আমাদের জানা — তবু সে যখন আসে, শূন্যতার বাষ্পে ভরিয়ে দেয় আমাদের হৃদয়। রবীন্দ্রনাথ কখন যেন বলে ওঠেন এই চূড়ান্ত বিষাদের মাঝে — ‘তোমার পরশ আসে কখন কে জানে’। কবি অনন্য রায়, কবি তুষার চোধুরী ছিলেন সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়ের পরম বন্ধু, দুজনেই প্রয়াত। জীবনের অনেক, অনেক প্রহর ভরা ছিল একদিন বন্ধুত্বের উষ্ণতায়, ভালোবাসায়। হঠাৎ মৃত্যু, যার আসার ‘কোন সময় জ্ঞান নেই’, সকল ‘বাঁধন ছিন্ন’ করে দিল। চোখের জলের জোয়ারে — ঝাপসা পরিপার্শ্বের মাঝখানে দাঁড়িয়ে জীবিত বন্ধু শুনতে পান সেই বহুশ্রুত প্রিয় গান — তোমার পরশ আসে কখন কে জানে। সঞ্জয় বলেছেন — “এই গান না থাকলে তোমার জন্ম বৃথা হয়ে যেত সঞ্জয়!" সত্যিই তো — এরকম গান — আরও কতো গান — কতোভাবে ছুঁয়ে থাকে আমাদের জীবন, আমাদের যাপন। সে গান না থাকলে হয়তো মানেহীন হয়ে যেতে পারতো আমাদেরও বেঁচে থাকা। মনস্বী দার্শনিক নীৎশে তো সেই কবেই বলে গেছেন — “Without music, life would be a mistake”.
সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়ের লেখা পাঠের প্রাথমিক পর্ব থেকেই আমাকে আকৃষ্ট করেছে তার ভাষা-রীতি। সত্যিই, এ এক আশ্চর্য মেধাজগৎ! বিদ্যুৎ-চমকের মতো বুদ্ধির দীপ্তি ফুটে ওঠে সঞ্জয়ের গদ্যভাষায়, তার কথা বলার অনন্য ভঙ্গিতে — যার মধ্যে মিশে রয়েছে শ্লেষ, মজা, তির্যক দৃষ্টি, আক্রমণাত্মক ইঙ্গিত। সঞ্জয়ের মুগ্ধ পাঠকের কাছে এই বই মুগ্ধতার আরও একটি অতিরিক্ত সংযোজন, নি:সন্দেহে। পাঠকদের জন্যেই বিভিন্ন লেখার কয়েকটি পঙ্ক্তি উদ্ধৃত করার লোভ সংবরণ করা গেল না —
• ‘আসলে ছোট ছিলাম কিনা — তাই স্বপ্ন ছিল। স্বপ্নদোষও ছিল’ — (পানু বিনে গীত নাই)।ভাষা নিয়ে এযাবৎকাল আলোচনা, পর্যালোচনা বা গবেষণা কিছু কম হয় নি! কতকাল আগেই বঙ্কিমচন্দ্র এ-বিষয়ে দিক নির্দেশ করেছেন — ‘ভাষা হেলে না, টলে না, বাঁকে না — সরল সোজা পথে চলিয়া গিয়া পাঠকের প্রাণের ভিতর প্রবেশ করে’। ভাষার প্রয়োগ বিষয়ে বঙ্কিমের এই সোজা-সাপটা মন্তব্যে যুক্তি আছে নি:সন্দেহে, কিন্তু তা কি সাহিত্যের শরীরে একইভাবে শ্রাবস্তীর কারুকাজ ফুটিয়ে তুলতে পারে? এসব তর্কে অনুপ্রবেশ না করে বলা যায় — ভাষা প্রাণ পায় লেখকের হাতের যাদুস্পর্শে। আর তখন কথা বলে ভাষা, স্রষ্টা বা লেখক যেন আড়ালে চলে যান। সোস্যুর বলেছিলেন — “Language speaks, not man” (ব্যক্তি নয়, কথা বলে ভাষা)। প্রায় একই কথা বলেছেন মনস্বী রোলাঁ বার্ত- ‘writing writes, not author' (লেখন লেখে লেখক নয়)। এসব প্রসঙ্গ মনে হল সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়ের ভাষা-রীতি সূত্রেই। এই ‘পরবাস’ পত্রিকায় তাঁর প্রকাশিত প্রথম বই “স্থানাঙ্ক নির্ণয়” (১৯৭৭)-এর আলোচনায় মাননীয় অধ্যাপক নিরুপম চক্রবর্তীর পর্যবেক্ষণ— “সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়ের রচনাগুলিতে তাঁর ভাষা প্রায় এক অলৌকিক অবলম্বন। তাঁর রচনায় এক নিদারুণ গুরু-চণ্ডালির কাকোফেনিতে চেম্বার-সংগীতের বিশুদ্ধি ছড়িয়ে যায় গদ্য-পদ্য-প্রবন্ধের সীমারেখা লুপ্ত করে।” অত্যুক্তি নয়। সত্যিই সঞ্জয়ের লেখার গায়ে অভ্রকুচির মতো ছড়ানো যে ভাষা — তা প্রায় এক ‘অলৌকিক অবলম্বন’ — যার ইঙ্গিত নিহিত ছিল মাত্র বছর পঁচিশের এক যুবকের প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থে। জীবন-চক্রের দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে এখন তিনি প্রবীণতার গোধূলিতে। কত বিচিত্র বিষয় আশ্রয় করেছে তার রচনা - চলচ্চিত্র, চিত্রকলা, কবিতা, উপন্যাস, রাজনীতি, সংগীত, এলিট সংস্কৃতি থেকে সাধারণ দোকানী ও আরও কতো কী যে! বিষয়ের ভিন্নতা সত্ত্বেও তার প্রকাশ ঘটেছে যে মায়াবী যাদুলন্ঠনের মতো আশ্চর্য ভাষায় — তা পাঠককে নিশ্চিতভাবে একই সঙ্গে বিস্মিত ও মোহিত করে! এক সাক্ষাৎকারে সঞ্জয় বলেছেন — ‘ভাষার শরীরে থাকবে ‘Rhetoric of Walking’ অর্থাৎ চলার ছন্দ। তাই বাংলা ভাষা যেদিন এই চলার ছন্দ আয়ত্ত করবে — তত বেশি ‘কুমারীত্ব’ ফিরে পাবে, সেকেলেপনা ঘুচে যাবে’। প্রকৃত প্রস্তাবে, এই চলার ছন্দই সঞ্জয়ের ভাষা-রীতিতে যোগ করেছে সৌন্দর্য, মৌলিকতা ও ঋজুতা। আমি মনে করি, এই ভাষাশৈলী অননুকরণীয়!• 'আড্ডার বাঙালি ‘পথের পাঁচালী’ বানাতে পারত। কাজের বাঙালি সেই ‘আড্ডা’ নিয়ে পিএইচডি করে’ — (আড্ডা)।
• 'স্বপ্নের ফেরিওয়ালা হওয়ার যোগ্যতাও বাঙালি মধ্যবিত্তের আর রইল না' — (বাঙালি মধ্যবিত্ত)।
• 'আমি আদার ব্যাপারী — হিন্দু কলেজের সমাবর্তনে সার্টিফিকেট মুড়ে দেওয়া হল — পেচ্ছাপ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় জাহাজের খোঁজ রাখতে গিয়ে দেখি, কলকাতায় ‘অ্যাংকর’ আছে, জল নেই' — (বাঙালির ঈশ্বরদর্শন)।
• 'ম্যাটিনি শো শেষ হলে শরৎসন্ধার মেঘমালা।' — (গরমকালের হাতপাখা)।
• 'অবাধ্যতার অধিকার ছিল আমাদের মৌলিক অধিকার।' — (ওগো বারুদ হাওয়া)।
• 'বইমেলা তো পরাবাস্তবতার, শুধু নির্জ্ঞানরহিত।' — (বইমেলার বিবর্তন)।
• 'কবির কাজই হল ভাষার অস্থিতি ঘোষণা — মহাকরণে যে-ই থাকুক না কেন!' — (পাত্রী স্বাস্থ্যবতী ও সুন্দরী : বাংলা কবিতা)।
• 'টিভিতে যে সব রান্না করার গল্প শোনে — সে সব মশলা এমনই যে ভূতেরাও অলৌকিক ভেবে কুলকুচি করে ফেলে।' — (রান্নাঘর ওগো)।
• 'তখনও কলকাতার গণতন্ত্র এত সুপ্রতিষ্ঠিত হয় নি যে সারা শহরটাই বস্তি বস্তি লাগবে বেঢপ কিছু উঁচু বাড়ির জন্যে।'
• 'বড়লোকের স্মৃতিতে এত সৌরভ থাকে না,' — (বড়লোক)।
• 'ভাগ্যিস ইতিহাস মুখ্যমন্ত্রী বা নোটবই লেখকদের কথায় চলে না। তাই সত্তর দশক তৈরি হয়েছিল' — (ওগো বারুদ হাওয়া)। •
দীর্ঘক্ষণ এই আলোচনায় সিংহভাগ নিয়ে নিয়েছে প্রশস্তি। তাই বলে কি, কালো দিক কিছু নেই? আছে। এত চমৎকার লেখার ফাঁক-ফোঁকরে মুদ্রণপ্রমাদ যেন খুঁতহীন সুন্দরী নারীর মুখে ছড়িয়ে থাকা ‘ফ্রেকলস্’ এর মতো — যা শুধু চোখ নয়, মনকেও পীড়া দেয়। “আশ্বিন বুঝি, আশ্বিনে কাঁপে ঘর” — রচনাটি অনেক আগেই “অর্ন্তবর্তী প্রতিবেদনে” (১৯৮৯) গ্রন্থভূক্ত হয়েছে। মান্না দে- বিষয়ক লেখা (তিনি বললেন, রবীন্দ্রসঙ্গীতটা চেষ্টা করেছিলাম, পারি নি) — আমার মনে হয়েছে, এই বইয়ের মেজাজের সঙ্গে খাপ খায় না। সংকলক সুশোভন প্রামাণিককে আরও একটু সতর্ক ও যত্নশীল হবার অনুরোধ রাখলাম। তবে সংকলকের লেখা প্রারম্ভিক — “ধ্বংসের মধ্যে দিয়ে যাত্রা” — একটি অনবদ্য গদ্য, যেখানে আল্তো করে কান পাতলে, বইটি সম্পর্কে পাঠকের অভিনিবেশ তৈরি হতে বাধ্য (যারা সঞ্জয়ের লেখার প্রথম পাঠক, তাদের উদ্দেশে)। বিগত কয়েক দশক ধরে এদিকে-ওদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা নানা লেখাকে একত্রিত করে বন্ধুর সুপরামর্শে যে বিনি সুতোর মালা গাঁথলেন সুশোভন — তার ফলশ্রুতিই সম্ভব করে তুললো এমন একটি চমৎকার বইয়ের জেনেসিস।
এই বই সম্পর্কে আলোচনা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে, যদি এর অলংকরণের সৌন্দর্যের কথা অনুল্লেখিত থেকে যায়! বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী সনাতন দিন্দার চিত্রভাষা এক অপরূপ মাত্রা যোগ করেছে মুদ্রিত শব্দমালার সঙ্গে। ছবি আর লেখা মিলে তা যেন হয়ে উঠেছে ‘যথার্থ ছবি-লেখা’। ফলে সঞ্জয়ের লেখার ভাষা আর সনাতন দিন্দার চিত্রভাষা যেন একে অন্যের পরিপূরক। আবেগের আতিশয্যেই, মুগ্ধ এই কলমচির মনে হল — এ যেন আল্লারাখা আর রবিশঙ্করের যুগলবন্দী! তাই এই যতটা পাঠের, ততটাই দৃষ্টিনন্দন। তবে এই কর্মযজ্ঞের নেপথ্যে বসে যিনি আসল কলকাঠি নেড়েছেন — তিনি রাজা পোদ্দার — এক তরুণ উদ্যোগী প্রকাশক। তাকে আমি কুর্নিস জানাই। তার প্রকাশনার নামটিও মন-ছোঁয়া - ‘খোয়াবনামা’। এই বই অলংকরণ ও বিন্যাসে হয়তো তিনি এমন ছাপ রাখলেন - যা পাঠক অনেকদিন মনে রাখবে। বইটির ডিজাইনিং চমৎকার। লেখা থেকে কখনও ২/৩-টি, আবার কখনও ৩/৪-টি পঙ্ক্তি বেরিয়ে চলে গেছে পাতার এদিকে-ওদিকে। কখনও পাতার রং স্বতন্ত্র - কালো পাতার বুকে মুদ্রিত অক্ষরের সারি। মুদ্রিত অক্ষরের ফন্ট সাইজও আলাদা। সব মিলিয়ে অভিনব পরিকল্পনা! সারা বইটির গায়ে লেগে রয়েছে রাজার পরিশ্রম আর যত্নের স্পর্শ। আমার সীমিত জ্ঞানে মনে হয়েছে — বাংলা মুদ্রণজগতে এই বই এক নতুন পথের দিশারী।
পরিশেষে বলি লেখক সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় পাঠকের কাছে যথেষ্ট গ্রহণযোগ্য এবং জনপ্রিয়-ও। চলচ্চিত্র-বিদ্যার শিক্ষক - এই পরিচিতির বাইরে তার নিজস্ব লেখালেখি মনোযোগী পাঠককে বরাবরই আকর্ষণ করেছে। বিবিধ বিষয় নিয়ে তার কলম ধারাবাহিকভাবে কথা বলে চলেছে। কিন্তু আমার মনে হয়, সব শ্রেণীর পাঠক তার লেখায় মনের রসদ খুঁজে পায় না। এতো বিবিধ বিষয় নিয়ে তার লেখার উপজীব্য তাই নিয়ে অনেকে প্রশ্ন তোলেন! কেউ তার গদ্যকে বলেন দুর্বোধ্য! তার লেখায় এতো রেফারেন্স, এতো উদ্ধৃতি-পুনরাবৃত্তি সব নিয়েও ওঠে প্রশ্ন। অবশ্য এসবে কিছু যায় আসে না, কারণ ভিন্নরুচির অধিকার তো পাঠকের আছেই। আমি একজন সধারণ ও সঞ্জয়ের মুগ্ধ পাঠক হিসাবে এই গ্রন্থের পাঠ-প্রতিক্রিয়া জানালাম। সমাজবিজ্ঞানের একজন মনোযোগী চর্চাকারী হিসাবে নানাদিক দিয়ে আলোচ্য বই আমাকে আকর্ষণ করেছে (সাহিত্য-মূল্য ছাড়াও)।
সাম্প্রতিকে যে সমাজ সেজে উঠেছে ‘token of technical progress’ (হারবার্ট মারক্যুজ)-এর বিবিধ উপকরণে — যেখানে শুধুই “evacuation of world of fancy” (T. S Eliot) — সেই সমাজের অস্বাস্থ্যকর, স্যাঁতস্যাঁতে আবহাওয়ায় — আমার মনে হয়, বেঁচে থাকা অর্থময় হয়ে উঠতে পারে, সদর্থক হয়ে উঠতে পারে ভালো লেখা/ বইয়ের নিবিড় সাহচর্যে। হাতে গোনা ভালো বইয়ের মধ্যে “ওগো মায়া ওগো বাতায়ন” — এমনই একটি বই - যা ইতিমধ্যেই যথেষ্টভাবে (২০১৬-এ প্রকাশিত) সমাদৃত। তবে না, এসব বইয়ের নাম ‘বেস্টসেলারের তালিকাভুক্ত হয় না — এসব বই প্রাতিষ্ঠানিক (সরকারী/বেসরকারী) পুরস্কারের কোমল স্পর্শ বঞ্চিত থাকে। কবি হেল্ডারলীন লিখেছিলেন — “হায় যা হাটের পণ্য। তাই আজ জনতার প্রিয়!' সে অর্থে জনতার প্রিয় (আগেই বলেছি) হয়ে উঠতে গেলে লেখাকে যেখানে নামতে হয় — সেই অবনমনের ভার এই বইতে অনুপস্থিত। এই বই ‘জনতোষের’ নয় — জনগণেশের অ্যাভারেজ রুচিকে তৃপ্ত করা এই বইয়ের কাজ নয়। তবে অসংখ্য বাজারী লেখার পাশ কাটিয়ে “ওগো মায়া ওগো বাতায়ন” মেধাবী পাঠকের হাতে আদরের চিহ্ন এঁকে দেবার ক্ষমতা রাখে, কারণ “কোথাও তো মায়া রহিয়া গেল”।