ট্রেনে জানলার ধারে সীটটায় বসে পেছন দিকে মাথাটা এলিয়ে দিলাম। পা দুটো ছড়িয়ে দিলাম সামনের সীটের তলায়। বুকের ভেতর থেকে একটি ক্লান্তি ও শান্তির হৃদয়-মথিত আআঃ বেরিয়ে এলো। জানলায় তখন বিকেল নামছে।
দশদিনের ফোটোগ্রাফির অ্যাসাইনমেন্ট সেরে বাড়ি যাচ্ছি। শহর থেকে দূরে বীরভূমের সাঁওতালদের মধ্যে থেকে আবার সভ্যতায় ফেরা।
অ্যাসাইনমেন্ট বলতে অবশ্য তেমন বড়ো-সড়ো কিছু নয়। হবেই বা কেন, আমি তো এক নবাগত ফ্রি-ল্যান্সার ফটোগ্রাফার মাত্র। কোনো পত্রিকার বা কাগজের সঙ্গে কোনো পাকাপোক্ত ব্যবস্থা নেই, যদিও সকলের সঙ্গেই এক আধটা কাজ করেছি। ক্যান্ডিড শটে আমার হাত বেশ ভালো, অনেকেই বলে। ফোটো-জার্নালিস্ট হবার একটা সহজাত ইন্সটিংক্টও আমার রয়েছে। তাই তো এই পত্রিকাটা থেকে একটা ফটো-ফিচার করবার সুযোগ দিয়েছে। টাকা-পয়সা কিছু দেবে না - পাঁচ রোল ফিল্ম দিয়েছে; ডেভেলাপ করার দায়িত্ব ও খরচা ওদের। তার সঙ্গে গাড়িভাড়া আর সামান্য অ্যালাউএন্স - যাতে অতি কষ্টে খাবার খরচ ওঠে।
তবুও একটা সুযোগ তো বটে। পরিচিতি পাবার সম্ভাবনা। এই লাইনে পায়ের নিচে একটু জমি পাওয়ার সম্ভাবনা।
এদিকে আকাশে রঙের হোলি শুরু হয়েছে। দিগন্তে গাছগুলোর সিলুয়েট। ক্যামেরা চোখে লাগালাম অভ্যাসবশত। ফোটোগ্রাফি করার এই এক জ্বালা – ভিউ-ফাইন্ডার দিয়ে না দেখলে কিছুই যেন ঠিক মতন দেখতে পাই না। যদিও এই দৃশ্যটি নিতান্ত ক্যালেন্ডার-ঘরানার, আলাদা করে দেখার মতো কিছু নয়। তবে শেষ ফিল্ম-রোলে একটা বা দুটো শট বাকি আছে, শেষ করে দেওয়াই ভালো।
ক্যামেরা প্যান করে দেখবার চেষ্টা করছি কিছু ছবি বেরোয় কিনা – হঠাৎ দেখি জঙ্গলের একপাশের সরু রাস্তা দিয়ে একটা মেয়ে কোনাকুনি ভাবে দৌড়ে আসছে ট্রেনটার দিকে। কালো সাঁওতাল মেয়ে, পরনে টকটকে লাল শাড়ি। আধো অন্ধকারেও বেশ দেখা যাচ্ছে।
মেয়েটাকে ফ্রেম করে ছবি তুলতে গিয়ে দেখতে পেলাম ওর পেছনে ধাওয়া করে আসছে অন্তত সাত-আটজন লোক। সাদা গেঞ্জী বা ফতুয়া আর সাদা খাটো ধুতি বা লুঙ্গি পরা। সকলের হাতেই দা বা কাটারি গোছের কিছু। অনেকটা দূর হওয়া সত্ত্বেও জুম করলে দেখা যাচ্ছে সকলের মুখের আদিম নৃশংসতা।
মেয়েটা পাগলের মতন দৌড়চ্ছে। প্রাণের ভয় মানুষকে কতটা বাড়তি শক্তি দিয়ে দেয়, ওকে দেখে বোঝা যাচ্ছে। কোনাকুনি ভাবে দৌড়তে দৌড়তে মেয়েটা প্রায় ট্রেনের কাছে পৌঁছে গেলো এক সময়। ব্যাপারটা ভালো করে দেখবো বলে ট্রেনের দরজার কাছে চলে গেলাম চট করে। দরজা খুলে ঝুঁকে পড়ে দেখবার চেষ্টা করতে লাগলাম মেয়েটাকে।
আর ঠিক তক্ষুনি একটা দা উড়ে এসে সশব্দে ট্রেনের দরজার কাছে আছড়ে পড়লো। মেয়েটার মাথার অল্প ওপর দিয়ে। খান খান শব্দ করে। আর সেই মুহূর্তেই নিচু হয়ে আমি মেয়েটার হাতটা ধরে ফেললাম। এক ঝটকায় তুলে নিলাম ওকে ট্রেনে আর সেই সঙ্গেই ট্রেনের দরজাটাও বন্ধ করে দিলাম।
মেয়েটা হাঁপাচ্ছে। কথা বলতে পারছে না, শুধু তাকিয়ে আছে আমার দিকে। মেয়েটার চোখদুটি ভারী সুন্দর – গভীর আর টানা-টানা। আমি ওর দিকে তাকিয়ে বললাম...
***
স্বপ্ন ভেঙে গেলো। ঠিক এই জায়গায় এসেই স্বপ্নটা ভেঙে যায়। প্রত্যেকবার।
উঠে বসে একটু জল খেলাম। বাথরুমে গিয়ে মুখে চোখে ঘাড়ে একটু জল দিলাম। বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। প্রত্যেকবারের মতোই।
আসলে তো মেয়েটার চোখটা আমি দেখি নি। মুখই ভালো করে দেখি নি – চলন্ত ট্রেন থেকে দেখা যায় নাকি? ওকে এক ঝটকায় ট্রেনে তুলেও নিই নি – বড্ডো ভয় করছিলো ওই ধেয়ে আসা উন্মুক্ত অস্ত্রধারীদের দেখে। শুধু জানলা দিয়ে তাকিয়েছিলাম - যতক্ষণ না মেয়েটা ট্রেনের সঙ্গে পাল্লা দিতে না পেরে পিছিয়ে পড়ে। যতক্ষণ না মেয়েটার আর্ত চিৎকার ভেসে আসে।
ক্যামেরার রোলের শেষ ছবিটা অবশ্য তুলতে পেরেছিলাম জানলা দিয়ে। অন্ধকার অরণ্যের সিলুয়েট ভেদ করে আসা সাদা পোশাকের জন্তুরা আর তার সামনে রক্তিম মরীচিকার মতো একটি কালো মেয়ের দৌড়। দিগন্তের আকাশে তখন রক্তের ছাপ।
ছবিটা ভালো হয়েছিলো। শুধু ভালো নয়, খুব ভালো। সে বছর দেশে এবং বিদেশে অনেক পুরস্কার পেয়েছিলো। সঙ্গে প্রচুর প্রাইজমানি। গত দশ বছরে প্রকাশিত বেশিরভাগ ভারতীয় ফোটোগ্রাফির বইতে এই ছবিটা একেবারে অপরিহার্য। পাশে আমার নামটা থাকে, অনেক সময় আমার মুখের ছবিও। এক ধাক্কায় এই একটা ছবি আমাকে পরিচিতি – খ্যাতি – প্রতিষ্ঠা সব এনে দিয়েছে।
শুধু মাঝে মাঝে মধ্যরাতে এই স্বপ্নটা আসে। আর ওই মেয়েটার হরিণের মতো চোখ। তারপর সমস্ত রাত আর কিছুতেই দু চোখের পাতা এক করতে পারি না।
(এই সংখ্যায় অতনু দে-র আরো দু'টি গল্পঃ 'করাল কুম্ভীর' ও 'বিশ্বাসবাবুর গান')