বিপ বিপ করে এসএমএস-টা আসার সাথে সাথে রাতুলা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। রাতুলা ভালো করে জানে এবার একটার পর একটা ফোন করে চলবে রজতাভ এবং কথাবার্তার গোপনীয়তা বজায় রাখার জন্য ও ঘর ছেড়ে ব্যালকনিতে এসে ফিসফিস করে কথা বলবে। রাতুলা অপমানিত বোধ করে রজতাভর এরকম ব্যবহারে। প্রথম প্রথম দু-এক বার ওর অপছন্দের কথা জানিয়েছে রজতাভকে। কিন্তু ওর ব্যবহারে কোন পরিবর্তন না হওয়ায় আজকাল রাতুলা নিজে থেকেই ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
রজতাভর এরকম আচরণ শুরু হয়েছে গত সাত আট মাস ধরে যখন থেকে তিমিরদার পাল্লায় পড়ে স্থানীয় পার্টি অফিসে যাতায়াত শুরু করেছে। যদিও তিমিরদার এলাকায় বেশ সুনাম, অনেক সমাজসেবা মূলক কাজও করেন তবুও রজতাভর হঠাৎ করে রাজনীতিতে যুক্ত হওয়া পছন্দ নয় বাড়ির কারও। পাড়ায় কারো কিছু হলে রজতাভ এমনিতেই এগিয়ে যায় তাদেরকে যথাসাধ্য সাহায্য করার জন্য। এর জন্য রাজনীতির রং কেন দরকার হল তা বুঝতে পারে না রাতুলা। প্রথম প্রথম রাতুলা বুঝিয়েছে, এখন ছেড়ে দিয়েছে। রজতাভর বাবাও ওকে অনেক বুঝিয়েছেন, পরিণতিতে ঝগড়া, কথা কাটাকাটি হয়েছে কিন্তু কোন লাভ হয়নি। রজতাভ বদ্ধপরিকর যে ঘরের খেয়ে বনের মোষ ও তাড়াবেই। ওর বাবা কিছুদিন হল কথা বলাই বন্ধ করে দিয়েছেন। এখন কাজের চাপ কম, অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরে তাই এত সময় পাচ্ছে নষ্ট করবার। প্রজেক্টের চাপ বাড়লেই এ-সব পাগলামি বন্ধ হয়ে যাবে বলেই রাতুলার বিশ্বাস।
রাতে কয়েক ঘণ্টার জন্য বেরোতে হবে বলে রজতাভ খাবার টেবিলে এসে বসল। রাতুলা একটু অবাক হলেও কোন প্রশ্ন করেনি। রাত এগারোটা নাগাদ পাবলো এসে একটা চিরকুট দিয়ে গেল রজতাভকে। রজতাভ বাইক নিয়ে বেরিয়ে যেতেই রাতুলা দরজায় তালা লাগিয়ে শুয়ে পড়ল।
সোনাবন, দখিনরেখাতে এসে বাইক দাঁড় করাল রজতাভ। রাত সাড়ে-বারোটা প্রায়, এত রাতে এদিকে কখনও আসেনি। হঠাৎ এমন নির্জন জায়গায় তিমিরদা কেন আসতে বলল বুঝতে পারছে না কিছুতেই। হাইওয়েতে দুএকটা মালবাহী ট্রাকের আওয়াজ ছাড়া আর কোন শব্দ নেই। নিঝুম চারিপাশ। রাস্তায় ট্রাকের হেডলাইট ছাড়া আর কোন আলোও দেখা যাচ্ছে না। কোন বড় বিপদ বা অসামাজিক কাজ অপেক্ষা করে নেই তো ওর জন্য? বাইকটা ঘুরিয়ে স্টার্ট দিতে যাবে ঠিক তখনই পাবলো এসে হাত রাখল কাঁধে। পাবলোকে দেখে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল রজতাভ। পাবলো জানাল দু কিলো মিটার ভিতরে যেতে বলেছে তিমিরদা। দাদা ওখানে কোন কাজে গেছে। দাদাকে ওখান থেকে তুলে রুপপুর খালপাড়ে পৌঁছে দিলেই কাজ শেষ। এত রাতে তিমিরদার ওখানে কি কাজ থাকতে পারে ভেবে পেল না রজতাভ। কথা না বাড়িয়ে বাইক চালু করল।
জঙ্গলের পায়ে চলা সরু পথ দিয়ে বাইক চালানো বেশ কঠিন। বারবার ঝোপঝাড় চাকার মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে বলে নামতে হচ্ছে। কিছুটা আসার পর পাবলো কাঁধে হাত রেখে থামতে বলল। গাড়ির হেডলাইটে দেখা যাচ্ছে একজন মানুষ উবু হয়ে পড়ে আছে মাটিতে। হঠাৎ এমন দৃশ্য কল্পনা করতে পারেনি রজতাভ। পাবলো এগিয়ে গেল। ভাবলেশহীন ভাবে বলল 'চলে এসো রজতদা। হাত লাগাও। বাইকে বসাতে হবে।' ঠিক করে পা ফেলতে পারছে না রজতাভ। মে মাসের গরমেও ভীষণ শীত করছে। রজতাভ জায়গা থেকে নড়ছে না দেখে পাবলো এসে হাত ধরে টানল। পাবলো লাশটা সোজা করতেই রজতাভ দু-পা পিছিয়ে গেল। চোখ দুটো ঠিকরে বেরোচ্ছে, গায়ের জামাটা সপসপে ভিজে, মুখে সদ্যমৃত্যুর তীব্র যন্ত্রণা। তিমিরদার নিথর দেহটা সামনে পড়ে আছে।
দু-হাত দিয়ে মুখ ঢেকে বসে পড়ল রজতাভ। পাবলো বলল, 'তাড়াতাড়ি করো। খালপাড়ে পৌঁছে দিতে হবে তিমিরদাকে। এখানে বেশি দেরি হলে ওখানে আমাদের লাশ পড়ে যাবে।' নিজের আর পাবলোর মাঝখানে তিমিরদাকে বসাল। তিমিরদার মাথাটা রজতাভর বাঁ-কাঁধে আর হাতদুটো গলার দুপাস দিয়ে ঝুলছে। তিমিরদার পুরো শরীরটা রজতাভর গায়ের সাথে লেপ্টে আছে। বাইক চলছে তো চলছেই পথ ফুরোচ্ছে না। এ যেন এক অনন্তযাত্রা। খুব শীত করছে রজতাভর। অল্প কাঁপছেও।
খালপাড়ে একটা গর্ত আগে থেকেই খুঁড়ে রাখা ছিল। তিমিরদাকে নামিয়ে দিল ওরা দুজন ধরাধরি করে। ওখানে একজন অপেক্ষা করছে। মুখটা কাপড় দিয়ে অর্ধেক ঢাকা। চোখ দুটো অন্ধকারে বাঘের মতন জ্বল জ্বল করছে। রজতাভ চিনতে পারল না। পাবলো বলল 'এ বার তুমি এস রজতদা। হাইওয়েতে সাবধানে যেও।'
ভোর সাড়ে তিনটে। রজতাভ বাড়ির বাইরের গেট খুলে ঢুকে নিজেই বিশ্বাস করতে পারছে না যে ও বেঁচে ফিরেছে। বারান্দার দরজার কাছে এসে দেখল পকেটে চাবি নেই। তাড়াহুড়োতে নিয়ে বেরোতে ভুলে গেছে। ভোর হতে আর মাত্র কয়েক ঘন্টা বাকি। কাউকে ডাকবে না বলেই ঠিক করল। কুয়োতে হেলান দিয়ে বসল রজতাভ। কেমন ছমছম করছে চারিধার। মাথা যন্ত্রণায় ফেটে যাচ্ছে, চোখ জ্বালাও করছে। বন্ধ হয়ে আসছে দুটো চোখের পাতা।
*****
লাল নীল সবুজ আলো জ্বলছে খালি পার্টি অফিসে। ছেঁড়া সোফায় একজন বসে আছে। চোখদুটো বাঘের মতো। কোথাও যেন দেখেছে মনে হল রজতাভর। রজতাভকে দেখামাত্র আদেশ করলেন মাটিতে শুয়ে পড়তে। কাঠের পুতুলের মতো নিচে কাটা গর্তের মধ্যে শুয়ে পড়ল রজতাভ। খালি ঘরটা ধীরে ধীরে ভর্তি হয়ে যাচ্ছে লোকে। ওকে দেখে সকলেই নোংরা দাঁতগুলো বের করে হাসছে। একজন সুন্দর করে দেওয়াললিখন করছেন 'রজতাভ সান্যালের অকাল প্রয়াণে আমরা শোক-স্তব্ধ।' ভিড়ের মধ্যে রাতুলাকে খুঁজে পেল পিছনের সারিতে। ওরই কেবল চোখে জল।
মাটিতে ঢেকে যাচ্ছে রজতাভর সমস্ত শরীর। নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। রাতুলাকে চেঁচিয়ে বলার চেষ্টা করল, 'চাকরিটা আমার আর ছিল না, শুধু এটুকুই গোপন করেছি আমি তোমার থেকে।' মুখ নড়ল কিন্ত শব্দ বেরোলো না। রাতুলা কেঁদেই চলেছে অবিরাম। আলো নিভে যাচ্ছে এক এক করে। আর কিছু দেখা যাচ্ছে না। দূরে পেঁচা ডাকছে। চারিধার অন্ধকার হয়ে আসছে।
বিষম বিকট অন্ধকার।