• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৬৯ | ডিসেম্বর ২০১৭ | গল্প
    Share
  • মিতুর অঙ্কের মাস্টারমশাই : নূপুর রায়চৌধুরি


    তুমুল ঝড় বাদলার দিন। সন্ধে পাঁচটা বাজতে না বাজতেই অমাবস্যার ঝুপঝুপে অন্ধকার নেমে এসেছে এই আধা শহুরে পাড়াতে। ইলেক্ট্রিসিটি এলে কি হবে, বেশির ভাগ রাতেই এই তল্লাটে তিন চার ঘন্টা আলো থাকে না লোডশেডিংয়ের জ্বালায়। অবশ্য মিতুদের বাড়িতে এমনিতেই সারা বছর হ্যারিকেন জ্বলে। ওদের সাধ্য হয়নি এক কাঁড়ি টাকা খরচ করে বিদ্যুতের লাইন আনার। এই ঘুপচি ঘরেই পড়তে বসে বইয়ের পাতার সঙ্গে মিতু ওর স্বপ্নগুলোকে নিয়েও নাড়াচাড়া করে। ও এবার উচ্চ মাধ্যমিক দেবে, বিজ্ঞান ওর ভালোবাসার বিষয়, অঙ্কে ওর মাথা ভালোই খোলে, স্কুলের মাস্টারমশাইদের ওকে নিয়ে অনেক আশা। মিতু অঙ্ক নিয়ে ভবিষ্যতে গবেষণা করতে চায় ঠিক মিহিরদার মতো।

    মিহিরদা হলো গিয়ে ওদের কোচিং ক্লাসের মাস্টারমশাই। স্ট্যাটিস্‌টিক্‌স-এ পিএইচডি করছেন বরানগরে আই এস আই থেকে। পুরোনো উচ্চ মাধ্যমিকের সময়ে জেলা থেকে অঙ্কে সবচেয়ে বেশি নম্বর পেয়েছিলেন, সেই রেকর্ড আজও কেউ ভাঙতে পারেনি।

    দশবছর আগেকার অঙ্কের সিলেবাস মিতু দেখেছে ওর পশ্চিম দিনাজপুরের জ্যাঠতুতো দাদার কাছে, সে সব ভারী গোলমেলে অঙ্ক, ভীষণ কঠিন। শুভদাদা এখন কলকাতায় সরকারি ব্যাঙ্কে বড়োবাবু হয়ে ছড়ি ঘোরায় আর মাঝে মাঝে মায়ের হাতের ভালোমন্দ খাবার তাগিদে চলে আসে মিতুদের বাড়ি। শুভদাদা মিতুর এখনকার অঙ্ক দেখে হতছেদ্দা করে বলে, “এ কি রে! এ তো বালখিল্যদের কাজ রে, সে ছিল আমাদের সময়ের অঙ্ক।'' মিতুর ভারী রাগ হয় এই সব কথা শুনলে, ওর ওই অঙ্ক ভালো জানে বলে তেন্ডাই-মেন্ডাই করা দেখলে গা জ্বলে যায় মিতুর, তাও যদি না জানতো যে বোর্ডের পরীক্ষায় অঙ্কে সত্তর তুলতে তার দাদাটির দাঁত ভেঙে যাবার উপায় হয়েছিল। জেঠিমার কাছে মিতু সবই শুনেছে । যাক গিয়ে, মিতু ওসব ছোটোখাটো ব্যাপার নিয়ে ঘোঁট পাকাতে চায় না, তবু তো বড় দাদার সঙ্গে দু চারটে পুরোনো জমানার অঙ্ক নিয়ে কসরত করা যায়, তাই বা কম কি? প্রথম প্রথম ওই সব আঁক কষার সে এক দু বার চেষ্টা করেছে বটে দাদার সঙ্গে গোঁ ধরে, কিন্তু বেশি দূর এগোতে পারেনি। শুভদাদা অবশ্য এখন যোগ বিয়োগ গুন ভাগ আর শতকরার হিসেবেই মজে থাকে, অন্য সব অঙ্ক তার কাছে এখন বেদরকারি বৈ কিছুই নয়।

    এই দেখো, কিসের থেকে কি! হচ্ছিল মিহিরদার কথা, চলে এলো শুভদাদার গল্প। মিতুর এই দোষ--ধান ভাঙতে গিয়ে শিবের গল্প জুড়তে ওস্তাদ সে।

    প্রথম যেদিন মিতু কোচিং ক্লাসে আসে মিহিরদা তাঁর নমস্য শিক্ষকের কথা দিয়ে পড়া শুরু করেছিলেন, আজিমগড় সরকারি হাইস্কুলের অঙ্কের দুঁদে শিক্ষক কালীকিঙ্করবাবু। নিম্ন মধ্যবিত্ত এলাকার স্কুল, আহামরি কোনো জেল্লা নেই স্কুলবাড়ির, ছাত্র শিক্ষক সবই সাধারণ ছাপোষা ঘরের। কিন্তু একটি সম্পদে বলীয়ান এই জেলা স্কুল, তাদের অঙ্কের ভিত জব্বর মজবুত। হবে না-ই বা কেন? স্বয়ং কালীকিঙ্করবাবু হাতে ধরে ছাত্রদের অঙ্ক শেখান। না, সিলেবাস ধরে অঙ্ক শেখানোতে তাঁর বিশেষ কোনো উৎসাহ ছিল না, তিনি শুধু চাইতেন কি করে গণিতশাস্ত্রের রসটি ছড়িয়ে দেওয়া যায় বেরসিক ছাত্রদের মধ্যে। নতুন নতুন অঙ্ক মাথা থেকে বের করতেন। জটিল অঙ্কের সহজ সমাধানের মুন্সিয়ানা ঢুকিয়ে দিতে চাইতেন ছাত্রদের মগজে; যে দু-একটি ছাত্রের মধ্যে প্রতিভার সন্ধান পেতেন, সন্তানস্নেহে তাদের জন্য নিজের জ্ঞানের পুঁজি উজাড় করে দিতেন। শিক্ষকতার অপরাহ্নে পেয়েছিলেন সেরকম উজ্জ্বল একটি ছাত্র রত্ন--সে এই মিহির সাহা।

    একটু থেমে মিহিরদা বলেন ‘আমার পরম সৌভাগ্য যে আমি এই অঙ্কপাগল শিক্ষকের সান্নিধ্যে কাটিয়েছি আমার স্কুলজীবনের কয়েকটি বছর।’ যদিও মাস্টারমশায়ের তখন কর্মজীবনের সায়াহ্ন আর কর্মবিরতির পরে অকস্মাৎ যতিচিহ্ন নেমে আসে এই মানুষটির জীবনে। আজকের মিহিরদার নামডাক দেখার সুযোগ হয়নি তাঁর। মুগ্ধ হয়ে শুনছিলো মিতু, না শুধু ও একা নয়, সকলেই। একটা সূক্ষ্ম আলপিন পড়ার শব্দও বোধ হয় শোনা যেত সেই মুহূর্তে, সেই সন্ধ্যায়। কথার মাঝেই মিহিরদা ঝোলা ব্যাগ থেকে পরম যত্নে বের করে আনেন কাঠের ফ্রেমে বাঁধাই করা একটা হলদেটে পুরনো ছেঁড়া খাতার কাচবন্দি ছবি। প্রথম বেঞ্চে বসা মিতু দেখে খাতার পাতায় কষা আছে অনেকগুলো অঙ্ক, মিহিরদা তার থেকে গোটা কয়েক বোর্ডে টুকে দেন আর ক্লাসের ছাত্রছাত্রীদের উদ্দেশে বলেন, তোমরা কি একটু এগুলো চেষ্টা করবে? টেস্ট পরীক্ষার ঠিক আগের দিন আমার মাস্টারমশাইয়ের কাছ থেকে পাওয়া এই অমূল্য সাজেশন। চেনা লাগে মিতুর বেশ কয়েকটি অঙ্ক । সেই শুভদার সাথে প্রতিযোগিতার দিন তার দাদাভাই যে অঙ্কগুলো এনেছিল তাদের সঙ্গে মিল আছে এদের। মিতু দেখে ওর সহপাঠীরা গুনগুন করে অসহিষ্ণুতা প্রকাশ করছে। কেউই বেশিদূর এগোতে পারছে না, এসব ঠিক ওদের চেনাশোনা নয়। মিহিরদা খুঁটে খুঁটে সবার চেষ্টাগুলো দেখলেন, মিতুর কাছে এসে উনি থেমে গেলেন, চোখদুটো জ্বল জ্বল করে উঠলো; বললেন, এই তো তুমি ঠিক পথেই এগোচ্ছ, বাহ্। টেনে টুনে গোটা দুই অঙ্ক মিতু উদ্ধার করতে পারে মাত্র, মিহিরদা হেসে বললেন--আমি জানি এই ধরনের অঙ্ক তোমাদের সিলেবাসের সাথে খাপেখাপে মেলে না। কিন্তু এই অঙ্কগুলো একটু এদিক ওদিক করে আমরা সমাধান করার চেষ্টা করবো। আমার বিশ্বাস এই অনুশীলন তোমাদের মতো পড়ুয়া ছাত্রছাত্রীদের সাধারণের মান থেকে বেশ কয়েক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাবে, লক্ষ্যের আরও একটু কাছাকাছি। হতাশ হয়ো না। এই বছরের শেষ দিনে টেস্ট পরীক্ষার আগে, আরেকবার আমি এই অঙ্কগুলো তোমাদের সামনে আনব। আমার বিশ্বাস তখন আমি সম্পূর্ণ অন্য ছবি পাবো। তোমাদের মধ্যে অনেকেই এই সব অঙ্কগুলোই করে ফেলবে, সেই দিনটার দিকে আমি তাকিয়ে থাকবো। সেই দিন আমার পিতৃসম শিক্ষক কালীবাবুর ঋণ একটু হলেও হয়তো শোধ হবে।

    কী ভালো যে অঙ্ক করান মিহিরদা তা মিতু ব্যাখ্যা করতে পারবে না। উনি যখন একটা অঙ্ক-ই বেশ কয়েকটি আলাদা আলাদা নিয়মে করে দেখান মিতু ভাবে এই লোকটা কি জাদুকর না কি ভগবান? মিতু ওঁকে শ্রদ্ধা যেমন করে তেমন নকল করতেও চায়। পল্লববাবুর কোচিং সেন্টার-এ অনেক টিচারই তো আছেন। কিন্তু মিহিরদার ক্লাসে উপচে পড়ে ভালো ছাত্রছাত্রীদের ভিড়। ওই ভিড়েও মিতু অনন্যা। তাই মিতুর দিকে মিহিরদারও দৃষ্টি পড়েছে। ওনার জহুরি চোখ চিনতে ভুল করেনি মিতুর অঙ্কে সহজাত ব্যুৎপত্তি। উনি মিতুকে নামমাত্র পয়সায় সপ্তাহে একদিন এক ঘন্টা করে বাড়িতে পড়াতে আসেন, এ নিয়ে কোচিং সেন্টারের আনাচে-কানাচে বেদম কানাঘুষো হয়। কিন্তু মিতুর বাবা এ-নিয়ে মাথা ঘামাননি। বাবার নিরন্তর উৎসাহ আছে বলেই এই ব্যবস্থা এখনো চলছে, যদিও মিতুর মাঝে মাঝেই ভয় হয় যে ওর এই বাড়তি সুবিধে যে-কোনো দিনই তাসের ঘরের মতো ভেঙে যাবে।

    এই হয়েছে জ্বালা। মিতু এত বেশি আগডুম বাগডুম ভাবে যে ওর বন্ধুরা ওকে খেপায় পাগলী বলে। ও যেন সব সময় এক ঘোরের মাঝে থাকে আর তার জন্য সাধারণ অনেক ব্যাপারেই ওর ভুল ভ্রান্তি হয় বেশ বড়ো রকমেরই। এই দেখো না সেদিন নাকতলায় যাবার বাসে না উঠে ও উঠলো কোন বাসে? না লায়েলকা যাবার বাসে, তার উপর বাসে উঠেই একটি বইয়ে মুখ গুঁজে রইলো। হুঁশ এলো কন্ডাক্টর-দাদার হাঁকাহাঁকিতে—‘শেষ স্টপেজ, শেষ স্টপেজ’। মিতু তাকিয়ে দেখে এ কোন অজানা জায়গা রে বাবা। এ তো ওর চেনা স্টপেজ নয়, আর কি চিত্তির! তখন উল্টো বাস ধরো আবার।

    ঝোড়ো হাওয়ায় লণ্ঠনের আলোটা দপ দপ করছে, বৃষ্টির ছাঁটটা জোরে আসছে, মিতু উঠে খোলা জানালার পাট দুটো বন্ধ করে দেয়। ফিরে আসতে চোখ পড়লো দেয়ালের ঘড়িতে--রাত পৌনে আট। আজ আর বোধহয় মিহিরদা পড়াতে আসতে পারবেন না।

    শ্রদ্ধার মানুষটির জন্য এই অপেক্ষা, এই পথ চাওয়া, মিতুর অনাঘ্রাত কিশোরী মনে ভালো লাগার দোলা জাগায়। মাস্টারমশাই যখন মাথা নিচু করে দুরূহ অঙ্কের সহজ সমাধান খোঁজেন মিতু অপলক দৃষ্টিতে তাঁর অঙ্গুলি সঞ্চালন দেখে, প্রিয় মানুষটির উপস্থিতির নির্যাস সে আকণ্ঠ শুষে নিতে চায়, সময় তখন থমকে দাঁড়িয়ে থাকে ওই ছোট্ট ঘরটির চৌকাঠে, মুহূর্তগুলো সেজে ওঠে অনন্তের প্রার্থনীয় সৌরভে।

    দুই-একবার অঙ্ক করতে করতে মিতু চোখ তুলে তাকিয়েছে সামনে বসা মানুষটার দিকে, ওর মনে হয়েছে অপর দুটো চোখেও আছে কিঞ্চিৎ উষ্ণতার ছোঁয়া, একটা আমকাঠের পড়ার টেবিলের মুখোমুখি দুটো চেয়ারে বসা সাঁকোর দূরত্ব সেই আঁচ লুকাবে কিভাবে? প্রশ্ন-উত্তর মেলাবার সময় দুই একবার দুজনের আঙুলে ছোঁয়াছুঁয়ি হয়েছে, মিতুর সারা শরীরে তখন সহস্র সূর্যের তাপ, ও জানে না অন্য পক্ষের কি অবস্থা, কিন্তু ওর সূক্ষ্ম অবচেতন বলে সেখানেও বিদ্যুতের মরণ শিহরণ।

    মিতুর মা একবার উঁকি মেরে গেছেন ঘরে এসে। ওনার পছন্দ হয় না মাস্টারমশাইয়ের এই এত রাত করে আসা। শহরতলির মানুষেরা অনেক কৌতূহলী, পড়শীর বাড়ির কিশোরী মেয়ের তরুণ পুরুষ মাস্টারমশাইকে নিয়ে তাদের দারুণ মাথাব্যথা। নেহাত মিতু পড়াশুনায় বরাবর ভালো তাই তারা রেখে-ঢেকে কথা বলে কিন্তু মিতুর মা ওদের কথার অলিগলি ধরতে পারেন আর অস্বস্তিতে বিব্রত হয়ে ওঠেন। এই মাসের পর উনি ঠিক করেছেন মাস্টার কে না করে দেবেন। মাসকাবারির বেতন দিয়েই এই যন্ত্রণার হাত থেকে রেহাই পাবেন। মিতুর উঠতি বয়স, কোথা থেকে কি হয়ে যায় কেউ কি বলতে পারে? মিতুর বাবার মতো জগৎসংসারটা তো ভালোমানুষ নয়!


    সদর দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হতেই মিতু উঠে গিয়ে দরজাটা খোলে।

    একটা জোলো দমকা ঠান্ডা হাওয়া মিতুকে কাঁপিয়ে দেয়, মিতু দেখে মিহিরদা বেশ ভিজে গিয়েছেন। ওনার সঙ্গে কোনো ছাতাও নেই। একটা কালো শালে ওর মাথা আর মুখটা অনেকটাই জড়ানো। উনি চেয়ারে বসেও শালটা মুখ মাথা থেকে সরালেন না। মিতু একটু অবাক হলেও কিছু বললো না। যা রাশভারি মানুষ, হয়তো কিছু মনে করবেন। ওনার চোখে এই রাতের বেলাতেও একটা কালো চশমা, এই রাতের বেলা উনি কেন ওটা পরে আছেন? মিতু উসখুস করতে করতে জিজ্ঞেসই করে ফেললো—“মিহিরদা আপনি কি ভালো দেখতে পারবেন? যা অবস্থা এই হ্যারিকেনটার, কালিঝুলিতে মাখামাখি--আমি না হয় এক ছুটে এটা একটু মুছে নিয়ে আসি।'”

    “না, না, তুমি ব্যস্ত হয়ো না।”--মিহিরদা তটস্থ হয়ে উঠলেন যেন, “আমার চোখে একটা সূক্ষ্ম কাচ ঢুকেছে, সেটা বের করার জন্য বেশ ছুরিকাঁচি চলেছে, কড়া আলো সহ্য হবে না। এই কম আলোটাই থাক না হয়।”

    মিতুর বুকটা ধড়াস করে ওঠে, সে কি? কিভাবে হলো? উনি কি কোথায়ও আঘাত পেয়েছিলেন, গবেষণাঘরে কোনো দুর্ঘটনা হয়েছে কি? মিতুর মাথায় একরাশ প্রশ্ন, কিন্তু অপরপক্ষের নিরাসক্ত ভাবভঙ্গি ওকে আর এগোতে উৎসাহী করলো না। মিতু শুধু বলে—“এত শরীর খারাপ নিয়ে আজ এতো বৃষ্টিতে না এলেই পারতেন তবে।’’

    মিহিরদার মুখে একটু ম্লান হাসির আভাস, “তা কী করে হয়। কাল তোমার টেস্ট পরীক্ষার দিন, আজ অঙ্কগুলো একটু ঝালিয়ে নেওয়া তো বিশেষ দরকার। আমি তোমার বেশি সময় নেবো না। এই... এই সাজেশন পেপারটা তোমার কাজে লাগতে পারে—” উনি হাতের মুঠোয় দলা পাকানো হলদেটে পুরোনো ধরনের একটা ছেঁড়া খাতার পাতা টেবিলের উপর রাখলেন।

    মিতু চমকে উঠে দেখলো এ তো সেই পুরোনো অঙ্কের লিস্টিটা। ওটা তো ফ্রেমবন্দি ছিল, কিভাবে ওটা উনি বের করে আনলেন? আজ কি সেই শেষ দিন যার কথা মিতু মনে আনতেও চায় না। এত নির্বিকার কোনো মানুষ হয় কিভাবে?

    মিতুর কিচ্ছু ভালো লাগছে না। সেই সন্ধে থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ঘন্টা দুয়েক জ্বলেছে হ্যারিকেনটা। ওটার তেলও শেষ হয়ে এসেছে, কালো কালিতে চিমনিটাও অস্বচ্ছ হয়ে এসেছে। ঘরটা একটা ভুতুড়ে আলোআঁধারিতে ডুবে আছে যেন। মিতুর কেমন অস্বস্তি হচ্ছে, মিহিরদার গলাটাও কেমন ধরা ধরা, উনি কি খুব বেশি অসুস্থ?

    মিতু মাথা নিচু করে সাজেশন পেপারের অন্য অঙ্কগুলো উদ্ধার করার চেষ্টা করে আর ভাবে এ কোন প্রত্নতাত্ত্বিক যুগের সিলেবাস রে বাবা! একটু বাদেই ও লক্ষ করে মিহিরদা কেমন যেন অস্থির হয়ে উঠেছেন, ঘন ঘন দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছেন আর ওনার হাতের আঙুলগুলো কেমন যেন কাঁপছে।

    রান্নাঘর থেকে মিতুর মা ডেকে ওঠেন—“মিতু মাস্টারমশাইয়ের চা টা নিয়ে যা।’’ মিতু ওর চেয়ার ঠেলে ওঠার মুখেই সশব্দে বাইরের সদর দরজা খোলার আওয়াজ পায়, বাবা কারখানা ফেরত বাসায় এলেন বুঝি!

    মিহিরদাও তৎক্ষণাৎ কেমন একটা ঝটকা মেরে ত্বরিৎগতিতে উঠে দাঁড়িয়ে বলেন, “মিতু আমার একটু তাড়া আছে আজ, তুমি তো কালকের জন্য প্রস্তুতই আছো, শুধু এই সাজেশনের বাড়তি অঙ্কগুলোয় একটু চোখ বুলিয়ে নিও। আজ আমি আসি... আর একটা কথা। তুমি অঙ্কটা কোনোদিন ছেড়ো না মিতু। অনেক বড়ো দৌড়ের ঘোড়া তুমি। আমার যা বিদ্যা ছিল তোমায় আমি দেবার চেষ্টা করেছি। আমি স্বপ্ন দেখি তুমি একদিন বিদেশে যাবে, গবেষণা করবে। আমি পারিনি। তুমি পারবেই। আমি তোমার সঙ্গে সেদিন থাকবো না কিন্তু এই সময়ের সুবাস তুমি ছড়িয়ে দিও মধুছন্দা তোমার কাজের তপস্যায়।” বলতে বলতেই উনি এক মুহূর্তের জন্য স্পর্শ করলেন মিতুর হাতের পাতা, হিমশীতল সেই ছোঁয়ায় কেঁপে উঠলো মিতুর সবটুকু সত্ত্বা, শরীরের সমস্ত অনুভূতির কেন্দ্রস্থল কেমন করে হয়ে উঠলো ওই করপল্লব।

    তারপর কিরকম একটু হেসেই ঘর ছেড়ে যেন একরকম দৌড়েই বেরিয়ে গেলেন মিহিরদা। মিতুর মনে হলো হাসিটা কেন যেন খুব করুণ। মিতুর বুকের ভিতরটা চিনচিন করে উঠলো। একটা অশনিসংকেত যেন ওকে জানান দিলো, “মিতুরে এই সেই মাহেন্দ্রক্ষণ, যেতে দিস না মুখপুড়ি, জাপ্টে ধরে রাখ।'' মিতুর বুক জুড়ে এ কেমন হাহাকার! মাহেন্দ্রক্ষণ বুঝি হারিয়ে যায় কালগর্ভে কত অবহেলে, কিছু বলা হলো না, কিচ্ছু শোনা হলো না, সব বাকি রয়ে গেলো। না, না ওকে কিছু একটা করতেই হবে। মিতু একটু অবাক হয়ে ওনার পেছন পেছন সদর দরজা অবধি দৌড়ে এসে দেখে মিহিরদা নেই, দরজার মুখে দাঁড়িয়ে বাবা আর পাড়ার অমিতকাকু নিচু স্বরে কি যেন কথা বলছেন। মিতুকে দেখেই সব কেমন চুপ হয়ে গেল। ইতিউতি তাকালো মিতু। কি আশ্চর্য সব ব্যাপার-স্যাপার, মানুষটা কি উবে গেলো!

    মিতু বাবাকে বলে, “আচ্ছা বাবা, তুমি যে এলে। তোমার সাথে কি মিহিরদার এইমাত্র দেখা হয়েছিল?” বাবা আর অমিতকাকু এ ওর মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেন, বাবা এবার একটু জোরের সাথেই জিজ্ঞেস করলেন, “কে? মিহির? কি সব যা তা বকছিস? সে কি করে আসবে? তোকে বলতে চাইছিলাম না, কাল তোর পরীক্ষা, এসবে তোর মনে কষ্ট হবে। আজ সকালের হাবড়া লোকালে একটা বিচ্ছিরি রকমের দুর্ঘটনায় মিহির মাথায় গুরুতর আঘাত পায়। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় অনেক তদবির করে, কিন্তু ওর মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণ কোনো ভাবেই আয়ত্তে আনা যায়নি। সন্ধের দিকেই—” বাবা কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। নিজেকে একটু সামলে নিয়ে বললেন,

    “ওই ট্রেনে অমিতও ছিল, ও হাসপাতাল থেকে এই ফিরছে খবরটা নিয়ে। এত বড়ো একটা সম্ভাবনাময় জীবন কেমন অকালে হারিয়ে গেল।”

    মিতুর মাথাটা ঘুরছে, না না এ হতে পারে না, এ কিছুতেই হতে পারে না। দৌড়ে গেলো ওর পড়ার টেবিলের কাছে, হ্যাঁ, এই তো সেই মিহিরদার দেওয়া সাজেশন পেপারটা। এটা তো মিথ্যে নয়। আর ওনার সেই কথাগুলো? ওর কানে বাজছে এখনও—“তুমি অঙ্কটা কোনোদিন ছেড়ো না মিতু। অনেক বড়ো দৌড়ের ঘোড়া তুমি... ’’ আর, আর ওর এই যে হাতটা যেখানে মিহিরদা স্পর্শ করেছিলেন, সেই অনুভূতি তো এখনো অণুতে পরমাণুতে ওর সত্তায়। মিতু পরম মমতায় স্পর্শ করলো ওর করপল্লবে। কি আশ্চর্য! ওই ছোট্ট জায়গাটুকু আর ছোট্ট নেই এখন, হয়ে গেছে একটা অনন্ত কালসায়র, অনাদিকালের জীবনের কালো সাদা স্বপ্নের ঢেউয়ের চুড়োগুলো সেখানে অবিরল ভাঙছে আর গড়ছে নতুন নতুন ছন্দে। তার কোনও ক্ষয় নেই লয় নেই।





    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ অনন্যা দাশ
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments