এরপর ছবি আমাদের বেড়াতে যাবার প্ল্যানেও থাবা দিল। ট্রিপ প্ল্যান করার সময় যদি দেখি ভাল আর্ট মিউজিয়াম আছে সেখানে, সেটা তরতর করে প্রায়োরিটি লিস্টে উপরে চলে আসে। ক্রিসমাসের সময় লম্বা ছুটিতে গেলাম রোম আর ফ্লোরেন্স। রোমে প্রথম দিনেই উদয় হলাম ভ্যাটিকান মিউজিয়ামে। প্রচুর চেকিং এবং দূর্গাপুজোর ভীড় ঠেলে পৌঁছলাম ভেতরে। প্রথমদিকের ঘরগুলোতে কাঠের প্যানেলে সেই পুরোনো পুরোনো সোনালি রঙের ছবি। ততদিনে জেনে গেছি ওগুলো হল টেম্পেরা পেন্টিংস। টেম্পেরা কালার হল রঙের পিগমেন্টের সাথে ওয়াটার-সল্যুবল কোন লিকুইড মিক্স করে বানানো কালার। অনেক সময়ই ডিমের কুসুমের ব্যবহার হত লিকুইড হিসেবে। খুব তাড়াতাড়ি শুকিয়ে যেত এই রং। এই কালারে আঁকা ছবিকে বলে টেম্পেরা পেন্টিং। ফিফটিন্থ সেঞ্চুরি পর্যন্ত খুবই জনপ্রিয় ছিল টেম্পেরা। তারপর ফাইনালি অয়েলপেন্ট এসে টেম্পেরাকে বলে "হেথা হতে যাও পুরাতন। হেথায় আমার খেলা আরম্ভ হয়েছে"। যাইহোক, নিজের কুকুরের নাক নিয়ে আমার অসীম গর্ব। তা এই ছবিগুলোর বেশ কাছে গিয়ে খুব করে ডিমের গন্ধ খুঁজলাম। কিন্তু কোন গন্ধই পেলাম না। বুঝতে পারলাম সময়ের স্রোতে ডিমের গন্ধও ভেসে যায়!
এঘর ওঘর করে এসে পড়লাম ট্র্যান্সফিগারেশনের সামনে। রাফায়েলের জীবনের শেষ কাজ। ছবিটা উপরনীচে দুটো আলাদা অংশ। নিচের অংশে একটি অসুস্থ বাচ্চা ছেলে যাকে একজন সাপোর্ট দিয়ে আছেন যাতে বাচ্চাটি পড়ে না যায় আর চার পাশের লোকজন প্রায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে ঘিরে আছে এদের। উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে আছে আরো কয়েকজন। ছেলেটি ওপরের দিকে তাকিয়ে আছে। ছেলেটির দৃষ্টি বরাবর মুখ তুললে উপরের ছবিতে মেঘের উপর যীশু। দুদিকে মোজেস আর এলিজা। প্রথমেই নজরে আসে উপরের ছবি আর নীচের ছবির মধ্যে রঙের তফাত। নীচের ছবির গাঢ় রঙে যখন মানুষের জীবনের হতাশা আর অসহায়তা মাখামাখি উপরের ছবির উজ্জ্বল রঙে তখন মুক্তির আলো, অমৃতলোকের আভাস। রাফায়েল নিজে এই বাইবেলিয়ডে ফিনিশনকে চূড়ান্ত সত্য বলে স্বীকার করতেন কিনা, সে প্রশ্নে না ঢুকে শুধু রঙের খেলায় পার্থিব অপার্থিবের এই সীমারেখা টেনে দেওয়াকে মুগ্ধ হয়ে দেখতে হয়।
পরে জেনেছিলাম বাইবেলের যে-গল্প এখানে আঁকা হয়েছে তা আসলে এপিলেপ্সি আক্রান্ত বাচ্চাকে ক্রাইস্টের সুস্থ করে তোলার গল্প। বাচ্চাটির শক্ত হয়ে যাওয়া হাত-পা, ঘোলাটে চোখ, তার দাঁড়াতে না-পারা, বাচ্চাটিকে সাপোর্ট দেওয়া ভদ্রলোকের চোখে অসহায়তা, ক্রাইস্টের ঠিক নীচে বাচ্চাটির পাশে হাঁটুগেড়ে বসা মহিলার দেহের ভঙ্গি — এইসব কিছু মিলে এ ছবির নাটকীয়তা সম্পূর্ণ। সন্দেহ হয় এ ছবি ১৫১৬-২০ তে আঁকা কি করে হয়? এই নাটকীয়তা তো ম্যানারিজমের ট্রেডমার্ক আর ম্যানারিজমের চর্চা শুরুই হয়েছিল ১৫২০ নাগাদ! রাফায়েল সময়ের থেকে অনেক এগিয়ে থাকা একজন আর্টিস্ট, মাত্র সাঁইতিরিশ বছর বয়সে, জীবনের শেষ ছবিতে বোধহয় পরবর্তী আর্টিস্টদের পথ দেখিয়ে গিয়েছিলেন।
আবার এঘর ওঘর। কয়েকটা ছবি বেশ চোখে লেগে রইল। কিন্তু আমার অশিক্ষিত চোখকে আবার দাঁড় করিয়ে দিল একটা প্রবল অন্ধকার ছবি। ক্রাইস্টের মৃতদেহ ঘিরে কজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছেন। সারা ছবিতে কোথাও একটুকু আলো নেই মানুষগুলোর মুখে আর শরীরে ছাড়া। মৃত্যুর হতাশা, শোক, অসহায়তা সবটুকু বুঝি জড়ো হয়েছে ক্যানভাসে। ততক্ষণে জেনে গেছি যে ইটালিয়ান ক্রাইস্টরা রক্তাক্ত হয়ে মরেন না। তাদের শরীরের ভাঁজগুলোই বলে দেয় মৃত্যু। কিন্তু এ কোন ক্রাইস্ট? সাধারণত আর্টিস্টরা ক্রাইস্টকে নিতান্ত শীর্ণকায় করে আঁকেন, বোধহয় তার মানুষের জন্য জীবন উৎসর্গ করাকে সিগ্নিফাই করতে। কিন্তু এ ক্রাইস্ট তো নিতান্ত দোহারা চেহারার, তার পায়ের মাসল, হাতের শিরায় লেখা খেটে খাওয়ার ইতিহাস। ঠিকই ধরেছেন, এনটোম্বমেন্ট অফ ক্রাইস্ট-এর সামনেই দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম। তখনও জানতাম না ক্যারাভাজ্জিও মানেই বিদ্রোহ। স্রোতের উল্টোদিকে হাঁটা একজন মানুষ। এ ছবিতে মা মেরীর পাশে আরো একজনকে প্রায় মধ্যমণি হয়ে থাকতে দেখেও অবাক হয়েছিলাম। মেরি ম্যাগডালেন। এনাকে সাধারণত শিল্পীরা এড়িয়ে যান বা এমনভাবে আঁকেন যাতে সন্ধ্যাশশী বন্ধু কেস হয়ে যায়। এইখানে পিয়েতার(*) কথা বলতেই হবে। পিয়েতা ১৪৯৮-৯৯-তে মাইকেল এঞ্জেলোর বানানো ভাস্কর্য যা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ক্যারাভাজ্জিও ১৬০৩-০৪-এ এনটোম্বমেন্ট অফ ক্রাইস্ট আঁকেন। পিয়েতা রাখা আছে সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকাতে। সেদিনই শেষ বিকেলে পিয়েতা দেখার সুযোগ হল। গল্প আছে যে মাইকেল এঞ্জেলো নাকি বলতেন স্কাল্পচারই হল পুরুষমানুষের যোগ্য কাজ, ছবি আঁকা নয়। তা এমন স্কাল্পচার যিনি সৃষ্টি করতে পারেন তার এমন বলা সাজে। কারারা মার্বেল কুঁদে বানানো এই মূর্তিতে মৃত ক্রাইস্টকে কোলে নিয়ে বসে আছেন মা মেরী।
পূর্ণবয়স্ক ছেলে কি করে মায়ের কোলে পুরোটা এঁটে যায় বা মেরীর বয়েস কি করে এত কম হয় এসব সমালোচনা আগে শুনেছিলাম। কিন্তু যখন দেখলাম, তখন শুধু দেখতে পেলাম ছেলের মৃতদেহ কোলে নিয়ে বসা নতমুখী মা, মেরীর জামার খাঁজগুলো আর যীশুর পাঁজরগুলো যা দেখলে মনে হয় মানুষটা বোধহয় এক্ষুনি শ্বাস নিচ্ছিল। পিয়েতা হল একমাত্র ভাস্কর্য যেটায় মাইকেল এঞ্জেলো নিজের নাম সই করেছিলেন। উনি এর পরেও ছ' ছ'টা দশক বেঁচেছিলেন আর জেনে গিয়েছিলেন যে পিয়েতা আর ডেভিড শুধু এই দুটোর জন্যই মানুষের ইতিহাসে উনি অমর হয়ে থাকবেন। যাকগে এনটোম্বমেন্ট অফ ক্রাইস্টে ফিরি। ক্যারাভাজ্জিওর মেরী কিন্তু বেশ বৃদ্ধা। আদ্যন্ত বিদ্রোহী ক্যারাভাজ্জিওর পক্ষেই বোধহয় সম্ভব ছিল চার্চের চোখরাঙানি পুরোপুরি উপেক্ষা করে, ভার্জিন মেরীর চিরযৌবনের থিওরি জলে ফেলে দিয়ে তেত্রিশ বছরের ছেলের মাকে পঞ্চাশ বছরের প্রৌঢ়া হিসেবে আঁকা।
যাইহোক, আস্তে আস্তে ভীড় ঠেলে পৌঁছলাম রাফায়েল রুমে। এইখানে বলে রাখি যে পোপ দ্বিতীয় জুলিয়াস (Julius II) যখন রাফায়েলকে ভ্যাটিকানের ঘরগুলো নতুন করে সাজাবার ভার দেন তখন রাফায়েলের বয়েস পঁচিশ। ঠিকই পড়েছেন, পঁচিশ। ১৫০৮ সাল সেটা। বাবার কাছেই রাফায়েলের ছবি আঁকার প্রথম পাঠ, আর বাবার মৃত্যুর পর মাত্র এগারো বছর বয়সে বাবার ওয়র্কশপের দায়িত্ব, ষোল বছর বয়সে উর্বিনো ছেড়ে পেরুজিনোর অ্যাপ্রেন্টিস হয়ে পেরুজিয়া যাওয়া। অনেক আর্ট ক্রিটিকের মতে গুরুকে অতিক্রম করে যাওয়ার এতবড় উদাহরণ আর নেই ইতিহাসে। সেই ছেলে যে পঁচিশ বছর বয়সে ভ্যাটিকান রিডেকোরেশনের কাজ পাবেন তাতে আর আশ্চর্য কি? যাইহোক রুমে ঢুকে দেখি চার দেওয়ালে, ছাতে সব জায়গাতেই ফ্রেসকো। সবকটা ফ্রেসকো সে যাত্রা ভাল করে দেখতে পারিনি ভীড়ের চাপে আর সময়াভাবে। কিন্তু স্কুল অফ আথেন্সটা হাঁ করে দেখেছিলাম। প্রথমেই মনে হল আমিই ছবিটার ভেতর ঢুকে গেছি। ইঞ্জিনিয়ারিং ড্রয়িংয়ে পার্সপেক্টিভ শিখেছিলাম আর সেদিন দেখলাম তার চূড়ান্ত রকমের সার্থক প্রয়োগ। তার সাথে যোগ হয়েছে ফোরশর্টেনিং, মানে দূরের জিনিষ ছোট করে আঁকা। মানে ধরুন একটা সোজা রাস্তা আঁকলেন ভার্টিকাল করে ধরা কাগজের নীচ থেকে ওপরে। নীচের দিকে রাস্তাটা চওড়া করবেন আর উপরের দিকে সরু। এটা হল পার্সপেক্টিভের খেলা। এতে করে যে ছবিটা দেখছে সে নরমালভাবে যেমন রাস্তা দেখে তেমনই দেখবে। আর মনে করুন রাস্তার ধারে গাছ আঁকলেন। কাগজের নীচের দিকে গাছগুলো বড় করে আঁকলেন আর কাগজের উপরের দিকের গাছগুলো ছোট করে আঁকলেন। এটা হল ফোরশর্টেনিং। টোটাল এফেক্ট? টুডাইমেনশনাল প্লেনে থ্রিডাইমেনশনাল ছবি। রাফায়েল এই দুটো টেকনিক এমনভাবে কাজে লাগিয়েছেন যে ছবি দেখতে দেখতে মনে হয় এ ছবি ছবি নয়, বাস্তব। ছবিতে অনেক মানুষজন। আমার মতন আকাট তাদের আইডেন্টিফাই করার চেষ্টাও দেয়নি। পরে গুগল করে দেখেছিলাম যে মাঝখানের দুজন প্লেটো আর অ্যারিস্টোটল (তাদের হাতে থাকা বই থেকে আন্দাজ করা হয়)। আর বাকিরাও নানান দিকপাল। পাইথাগোরাস, আর্কিমিডিস থেকে শুরু করে লিওনার্দো হয়ে রাফায়েল নিজে অবধি। বলা বাহুল্য এমন কোন স্কুল এই ধুলোর পৃথিবীতে কোনদিন ছিল না। এ শুধু রাফায়েলের স্বপ্নের স্কুল।
এইখানে এসে একবার আবার ট্র্যান্সফিগারেশনে ফিরতে হবে। কারণ হাই-রেনেসাঁ আর ম্যানারিজমের স্টাইলের তফাতগুলো একই আর্টিস্টের কাজে এত স্পষ্ট করে আমার কাছে এর আগে ধরা দেয়নি। হাই-রেনেসাঁ হল মাত্রাজ্ঞানের চূড়ান্ত আর ম্যানারিজম হল মাত্রাতিরিক্তের সন্ধান, হাই-রেনেসাঁ হল ঈশ্বরের তৈরি পৃথিবীকে ক্যানভাসে সত্যি করে তোলার তপস্যা আর ম্যানারিজম হল বাস্তব দুনিয়া থেকে সরে গিয়ে মানুষের ভাবনাকে ক্যানভাসে তুলে আনার সাধনা, হাই-রেনেসাঁ হল সিমেট্রি আর ব্যালান্সের মাধ্যমে আবহমনতার আবাহন আর ম্যানারিজম হল আলোছায়া আর অতিপ্রাকৃতর মধ্যে দিয়ে নাটকীয়তার পূর্ণ আয়োজন। আসলে হাই-রেনেসাঁর পরে আর্টিস্টদের মধ্যে একটা দিকশূন্যতা আসে যে তারা আর কি করবেন। যা মানুষের পক্ষে সম্ভব সবই তো করা হয়ে গেছে। কিন্তু এনারা আর্টিস্ট। তাই ফজলি আম শেষ বলে ফজলিতর আমের সন্ধান না করে নতুন বাজারে বড় দেখে আতার সন্ধানে যান অমিত রায়ের মতন। রাফায়েলের স্কুল অফ আথেন্সের মানুষরা স্বাভাবিক পোজে আছেন আর ট্রান্সফিগারেশনের মানুষগুলোর শরীরের ভঙ্গিতে মনে হয় এই বুঝি কিছু একটা হবে। ট্রান্সফিগারেশনের নিচের অংশে মাঝের ভদ্রমহিলার উপরে খুব ঊজ্জ্বল আলো আর বাকিরা অনেক বেশি অন্ধকারে। আবার যীশুর মাথার পিছনে মেঘে উজ্জ্বল নীলাভ সাদা আলো। ঠিক যেন স্টেজ লাইটিং। স্কুল অফ আথেন্সে কিন্তু স্নিগ্ধ প্রাকৃতিক আলো। আরো একটু খুঁটিয়ে দেখলে আপনিও এমন অনেক তফাত পাবেন। রাফায়েল কিন্তু ট্রান্সফিগারেশন শেষ করে যেতে পারেননি। শেষ করেছিলেন ওনার শিষ্য জুলিয়ো রোমানো।
এরপর সিস্টিন চ্যাপেল। সিস্টিন চ্যাপেল আমি মোটে দু’বার দেখেছি। সাফাইটা গেয়ে রাখলাম এইজন্য যে, খুব সামান্য কিছুই মাথার মধ্যে করে নিয়ে এসেছি বা বলা ভাল নিয়ে আসতে পেরেছি। অবশ্য সিস্টিন চ্যাপেল কুড়িবার দেখেছেন এমন মানুষও বলেন যে তিনি প্রতিবারই নতুন কিছু খুঁজে পান। প্রথমবার গিয়ে আজকের ফ্ল্যাটবাড়ির হিসেবে ছ’তলা উঁচু ছাতের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত অবধি ছবি, দূরের দেওয়ালে চোখ এপার ওপার করা ফ্রেসকো, দ্য লাস্ট জাজমেন্ট, দুপাশের দেওয়ালে বোত্তিচেল্লি, পেরুজিনোর আঁকা মোজেস, ক্রাইস্ট — সব দেখে কেমন যেন ঘাবড়ে গেছিলাম। আমার আনাড়ির চোখ অসংখ্যর অভিঘাত পেরিয়ে, এককের অসাধারণত্বে পৌঁছতেই পারেনি। তার উপরে চ্যাপেলের ভেতর কথা বলা বারণ। কথা বলা বারণ এই ব্যাপারটা আমাকে একনিমেষে কাবু করে ফেলে, বোধবুদ্ধিতে কারফিউ লেগে যায়। স্কুলবেলা মনে পড়ে যায় কিনা? সেসব কথা তোলা থাক বরং। পরের বার যখন সিস্টিন চ্যাপেল গেছিলাম ফেলুদার উপদেশ মেনে একটু পড়েশুনে গেছিলাম। আর সে করতে গিয়েই কাল হল।
চ্যাপেলের ভেতরে দেওয়ালের ধার ঘেঁষে সার দেওয়া বেঞ্চে একবার বসতে পেতেই স্হানকালপাত্র সব ভুলে গেলাম। মনে পড়ে গেল চার-চারটে বছর লেগেছিল এই সিলিং বানাতে। মাইকেলেঞ্জেলো এই কাজটা প্রথমে করতেই চাননি। ছবি আঁকতে ওনার ভাল লাগতো না। মাইকেলেঞ্জেলোর জন্মের পর থেকেই ওনার মা অসুস্থ থাকায়, বাবা বাধ্য হন ছোট্ট মাইকেলকে দুধ-মায়ের কাছেই রাখতে। সেই পরিবার করত পাথরের কাজ। তাই জ্ঞান হওয়া অবধি মাইকেল ছেনি বাটালিকেই আপন করে নিয়েছিলেন। পোপ জুলিয়াস টু যখন সিস্টিন চ্যাপেলের কাজের কথা বলেন, মাইকেলেঞ্জেলো প্রথমেই মানা করে দিয়েছিলেন। কিন্তু পোপ জুলিয়াস টু ছিলেন দুর্দান্ত যুদ্ধবাজ পোপ। তিনি প্রাচীন মিশরের স্টাইলে এমপেরর এবং পোপ এই ডাবল রোল-এ খেলা করতে চাইতেন এবং কিছুদিনের জন্য তেমন ডাবল রোল প্লে করেনও। সেই পোপ কি এত সহজে ছেড়ে দেবার লোক? ছলে, বলে, কৌশলে রাজী করালেন মাইকেলেঞ্জেলোকে। মাইকেলেঞ্জেলোও ছেড়ে দেবার পাত্র নন। প্রথমে কথা হয়েছিল ক্রাইস্টের বারোজন প্রধান শিষ্য (apostle)-র ছবি আঁকতে হবে। এই সুযোগে মাইকেলেঞ্জেলো পারমিশন আদায় করে নিলেন নিজের ইচ্ছেমতন ছবি আঁকার। পারমিশন তো হল। কিন্তু তারপর শুরু হল নানান সমস্যা।
এইখানে ফ্রেসকো আঁকার কায়দা বা প্রসেস একটু আলোচনা না করলে নয়। ফ্রেসকো আঁকতে গেলে প্রথমেই দেওয়াল/ ছাতের গায়ে পাতলা একটা প্লাস্টারের প্রলেপ দেয়া হত। তার এক-দেড় ঘন্টা পরে শুরু হত আঁকা। আঁকা চলত পরের আট-দশ ঘন্টা। তারপর প্লাস্টার প্রায় পুরো শুকিয়ে যেত। কাজেই ফ্রেসকো করতে গেলে শিল্পীকে এতটা জায়গা নিয়ে কাজ শুরু করতে হত, যতটা জায়গার কাজ তিনি আট-দশ ঘন্টায় শেষ করতে পারবেন। প্লাস্টারে রং করার নিয়ম ছিল খালি রঙের পিগমেন্ট আর জল ব্যবহার করে, প্লাস্টার নিজেই বাইন্ডিং মেটেরিয়ালের কাজ করত। অনেক সময় প্লাস্টারের সামান্য অংশ খুবলে তুলে ফেলা হত, ডেপথের এফেক্ট আনতে। স্কুল অফ আথেন্সে এই টেকনিক ব্যবহার করেই মানুষজনের চোখ আঁকা হয়। ফ্রেসকো শিল্পীরা আগে প্রমাণ মাপের ছবি এঁকে নিতেন কাগজে। তারপর সে ছবি ফুটিয়ে তুলতেন প্লাস্টারে। অনেকে প্লাস্টারের উপর আগে আউটলাইন করে নিতেন। ফ্রেসকো শিল্পীরা সাধারণত বিশেষভাবে বানানো মইয়ের উপর প্ল্যাটফর্ম মতন বানিয়ে নিতেন। তাতে শুয়ে শুয়ে সিলিংয়ের কাজ করতেন। শুয়ে শুয়ে কাজ করার কায়দা মাইকেলেঞ্জেলো মোটেই জানতেন না। কাজেই তিনি কাজ শুরু করলেন নিজেরই তৈরী করা মইয়ের মাথায় চড়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। পরবর্তীকালে মাইকেলেঞ্জেলো নিজেই বলেছেন যে সিস্টিন চ্যাপেলের কাজ করার পরে ওনার শরীর আর কখনোই পুরো রিকভার করেনি। গোদের উপর বিষফোঁড়া, ফ্রেসকোর কাজ শুরু করার পরেই দেখা গেল প্লাস্টারে ছাতা পড়ছে। যতটুকু কাজ এগিয়ে ছিল সব নষ্ট করে আবার শুরু করতে হল। নতুন একরকম প্লাস্টারের মেটেরিয়াল বানিয়েছিলেন মাইকেলেঞ্জেলোরই এক ছাত্র, জ্যাকোপো। সেই মেটেরিয়াল নিয়ে কাজ শুরু করলেন মাইকেলেঞ্জেলো। কয়েকটা ফ্রেসকো আঁকার পরেই মাইকেলেঞ্জেলোর কাছে আগে থেকে প্রমাণ মাপের ছবি কাগজের উপর এঁকে নেবার প্রয়োজন ফুরোলো। তিনি কাগজে ছোট্ট স্কেচ করে নিয়ে সময় বাঁচানো শুরু করলেন। যে মানুষটা আগে কোনদিন ফ্রেসকো করেননি তিনি হয়ে উঠলেন এক্সপার্ট।
সিস্টিন চ্যাপেলের সিলিংয়ের ছবির প্রিন্ট সবাই দেখেছেন। সবগুলো প্যানেলের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত প্যানেল, 'ক্রিয়েশন অফ অ্যাডাম'-এর প্রিন্ট দেখেননি এমন মানুষ মেলা ভার। এ ছবির বিষয় হল ঈশ্বর আদি মানুষ অ্যাডামকে প্রাণ দিচ্ছেন। ঈশ্বরের ডানহাতের আঙুল প্রায় ছুঁয়ে ফেলেছে অ্যাডামের বাঁ হাতের আঙুল। ঈশ্বর আর অ্যাডাম দুজনের মাসলই ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো থেকে ব্র্যাড পিট পর্যন্ত সবাইকে লজ্জা দেবার মতন। খেয়াল করে দেখলে এ ছবিতে বেশ কিছু অদ্ভুত জিনিষ ধরা পড়ে, আমার মতন নিতান্ত অশিক্ষিত চোখেও। প্রথমত, অ্যাডাম তখনো প্রাণ পায়নি, তা’হলে তার চোখ খোলা হয় কি করে? আদি মানুষের নাভি কোথা থেকে আসে? কোনো মায়ের বত্রিশ নাড়ি-ছেঁড়া ধন তো সে নয়? আর্ট হিস্টোরিয়ান থেকে ডাক্তার, সবাই এ ছবিকে ব্যাখ্যা করেছেন নিজের মতন করে। কেউ বলেন ঈশ্বরের চারপাশে যে সব অ্যাঞ্জেল বা দেবদূতের ছবি সেগুলো মিলে পুরোটা আসলে মানুষের ব্রেন-এর ছবি। ঈশ্বর অ্যাডামকে প্রাণ নয়, চিন্তাশক্তি দিচ্ছেন। আরেক দল বলেন যে ঈশ্বরের চারপাশের লাল কাপড়টা আসলে মানুষের জরায়ুর ছবি। স্বাভাবিক মানুষের স্বাভাবিক জন্মকেই এঁকেছেন মাইকেলেঞ্জেলো। যে মাইকেলেঞ্জেলো জীবনের শুরুতে অনেকদিন শবদেহ কেটে মানুষের ভেতরটা তন্ন তন্ন করে দেখেছিলেন, তার পক্ষেই বোধহয় সে যুগে বসে মানুষের ব্রেন বা জরায়ুর এমন নিখুঁত ছবি আঁকা সম্ভব ছিল।
(*) "পিয়েতা" - শহীদের মা; পুলকেশ রায় (পরবাস-১৫, ২০০০)