• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৬৮ | সেপ্টেম্বর ২০১৭ | সাক্ষাৎকার
    Share
  • সাক্ষাৎকার—বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : শ্রীকুমার চট্টোপাধ্যায়


    পরবাস : কিন্তু কবিতা তো শুধু ক্রাফট্‌সম্যানের কাজ নয়....

    বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : ক্রাফট্‌সম্যানেরও কাজ।

    পরবাস : কবিতাতে তো একটা বদল হয়। আপনার গভীর এরিয়েলে আপনি যেভাবে বলেছেন, সেটা আস্তে আস্তে আপনার চেতনা যত ঋদ্ধ হচ্ছে, বয়সের সঙ্গে সঙ্গে হয় মানুষের, সেখান থেকে ‘ভূতেরা যেখানে থাকে’, আপনি অনেক বদলে গেছেন। এই যে বদলটা, এইটা আপনি যে বললেন খুঁটি।

    বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : এটা খুঁটি ঠিকই, কিন্তু আমাদের মধ্যে আমি সবচেয়ে বেশীদিন বেঁচে আছি বলে বদলটা হয়েছে এইভাবে এবং চোখেও পড়ছে বার বার।

    পরবাস : ভাস্কর চক্রবর্তীতেও হয়েছে।

    বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : ভাস্কর চক্রবর্তীতে খুব কম।

    পরবাস : ‘জিরাফের ভাষা’তে এসে যেন উনি একদম শান্ত হয়ে গেলেন।

    বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : জিরাফের ভাষা একদম শেষ। যখন ভাস্কর অলরেডি মৃত্যুর মুখোমুখি। একটা হাত মৃত্যুর দিকে রেখে জিরাফের ভাষা কবিতা লিখেছিল। কিন্তু তার আগে ভাস্করকে আমি বলেছিলাম। বড় বেশী নিজেকে নিয়ে লেখা। পরে আমার মনে হয়েছে এটারও দরকার ছিল।

    পরবাস : মানে একধরনের আত্মরতিপরায়ণতা?

    বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : রতি শব্দটা বলব না। রতি শব্দটা ভাস্করের লেখালেখির সঙ্গেই যায় না। অন্বেষণটা বলা যায়। এই অন্বেষণটা ঘুরপাক খেত ওর জীবন দিয়ে। যেমন ধরো ভাস্কর ইচ্ছে করলেই একটা বড় চাকরি করতে পারত। একটা অন্য ধরনের চাকরি করতে পারত। তোমরা বোধহয় জানো ভাস্কর একটা প্রাইমারি স্কুলে পড়াত। ১৭০ টাকা মাইনে ছিল। তখনকার দিনে মাইনে খুব কম ছিল। বিশেষ করে সিগারেটের খরচ, মদের খরচ, বই কেনার খরচ, জামাকাপড় কেনার খরচ। এইসব জোগাড় করার জন্য ১৭০টাকা তখনো যথেষ্ট কমই ছিল। সাংসারিক দায়দায়িত্ব কিছুই ছিল না ভাস্করের। সেখান থেকে যখন টেনে আনল, সেই টেনে আনার জায়গা থেকে আরও ছড়িয়ে পড়ার সময় আর নেই। সুব্রত কিন্তু নিজেকে বদলানোর চেষ্টা করেছে বারবার। শামসেরও অনেকটাই, মা কিংবা প্রেমিকাস্মরণের যে কবিতাগুলো, তারই অনুসরণ-অনুরণন ওর অন্যান্য কবিতা ছড়িয়ে ছিল। যেটা বলছিলাম ৭০-দশকের কবিদের মধ্যে কবি হিসেবে সবচেয়ে সাকসেসফুল জয়। কবি হিসেবে তুমি যদি সাকসেস শব্দটি ব্যবহার করতে চাও। একজন ফুটবল প্লেয়ার সাকসেসফুল হয়। একজন ক্রিকেট প্লেয়ার সাকসেসফুল হয়। এমনকি একজন জাদুকরও সাকসেসফুল হয়। কিন্তু কবিরা সাকসেসফুল হয় না। হয় যখন, তখন তারা আর থাকে না। পৃথিবীর ইতিহাসে বার বার এটা হয়েছে। জীবিত অবস্থায় খুব সাকসেসফুল বায়রন কিছুটা হয়েছিল। আর বাদবাকি অনেকেই সেভাবে সাকসেসফুল হননি। কিন্তু জয় হয়েছে। কিন্তু আমার ভয় হয় সাকসেসফুল হওয়ার তো একটা যাতনা আছে। এবং সাকসেসফুল হওয়ার যাতনাটা এমনই, যে তোমাকে ওরকম লেখাই লিখে যেতে হয়। যে লেখা লিখে তুমি সাকসেসফুল হয়েছো। আজও সুনীল গাঙ্গুলী নেই কিন্তু সেই নীরা আছে। মুস্কিল হচ্ছে অনেক কবিই সুনীল গাঙ্গুলীকে নীরার কবি হিসেবে ধরে নিয়েছিল। তো এই বিপদটা কিন্তু সাকসেসের একটা দিক।

    পরবাস : সাকসেস এবং কবিতা এই দুটোর মধ্যে একটা বিরোধ থেকে যায় অনেক সময়...

    বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : হ্যাঁ, বিরোধ থেকে যায়।

    পরবাস : আমরা এবার সিনেমার দিকে আসব। কবিতা থেকেই তো আপনি সিনেমায় এলেন. এবং আপনার মতে কবিতাতে এবং সিনেমায় কোন বিরোধ নেই। আমরা ১৯৯৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল করেছিলাম। আপনি এসেছিলেন উদ্বোধন করতে। আপনার বন্ধু আশিস ব্যানার্জি ছিলেন তখন ভাইস চ্যান্সেলর। সেই দিন থেকে আমার কানে বাজে, আপনি বলেছিলেন, যে আমার সিনেমাতে আর কবিতাতে কোন বিরোধ নেই। সত্যিই আমরাও পাই না আপনার সিনেমাতে এবং কবিতাতে কোন বিরোধ। ইমেজ দু-জায়গাতেই খুব সক্রিয়। খুব জোরালো। আমি একটা অন্য প্রসঙ্গে কথা বলে তারপর এই জায়গাতে আসবো। আপনি ৬০-দশকে কবিতা লিখছেন ৭০-দশকে কবিতা লিখছেন, ছবি বানাচ্ছেন। ৬০-দশকে বড় হচ্ছেন আপনারা চার বন্ধু। পলিটিক্স টানেনি আপনাদেরকে? তখন তো কলকাতার অবস্থা, পশ্চিমবঙ্গের অবস্থা ভয়াবহ।

    বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : দেখো, আমি যখন কাঁটাকলে যেতে শুরু করলাম তখন কলকাতা জ্বলছে--নকশালবাড়ি আন্দোলন। ৬৮-র পর। এবং ওখানে অসীম চ্যাটার্জি আমাদের সিনিয়র ছিল, প্রায় আসত। দেখো রাজনীতির আঁচটা আমি তো অন্তত পেয়েছি সাংঘাতিকভাবে। ভাস্কর, সুব্রত, শামসের এ আঁচটা কতটুকু পেয়েছিল আমি জানি না।

    পরবাস : অথচ ভাস্কর চক্রবর্তী বরানগরেই থাকতেন।

    বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : বরানগরেই থাকত। এবং যে পাড়ায় থাকত সে পাড়ায় সাংঘাতিক সব ঘটনা ঘটেছে। ভাস্কর দাড়ি কেটে, শার্ট-প্যান্ট পরে ওখান দিয়েই হেঁটে যেত।

    পরবাস : কিন্তু ডাইরেক্টলি পলিটিক্সে যোগ দেননি কখনও? বা ছাত্র রাজনীতি?

    বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : না। ছাত্র-রাজনীতি যে একান্ত করিনি তা নয়। কিন্তু ওটা ওই ক্লাসঘরের মধ্যেই থেমে গেছে। আর এইসময় আমার মনের মধ্যে একটা অসম্ভব দ্বন্দ্ব শুরু হয়ে গেল। এই নকশালবাড়ি আন্দোলন নিয়ে। আমি চোখের সামনে দেখেছিলাম নকশালবাড়ি আন্দোলনের জন্ম হতে, চোখের সামনেই দেখলাম যে ভেঙে যাচ্ছে। ভেঙে যাওয়াটা খুব তাড়াতাড়ি শুরু হয়ে গেল। বছরখানেকের মধ্যেই দলের মধ্যে ভাঙন ধরতে শুরু করল। দল গোষ্ঠীতন্ত্রে বিশ্বাস করতে শুরু করল। আমি দূর থেকে এগুলো দেখে সতর্ক হয়ে গেছিলাম। তখন কিন্তু আমি পাগলের মতো কবিতায় জড়িয়ে পড়েছি। পাগলের মতো ভালোবেসে ফেলেছি সিনেমাকে। আমার কবিতায়, সিনেমায় এই দিনগুলি এসেছে। কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনযাপনে রাজনীতি কোনোদিন ঢুকতে পারেনি। আমাদের কারুর মধ্যেই নয়। আমাদের কবিদের মধ্যে নকশাল আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন অনেকেই। বা আমার মতো একটু ইনডাইরেক্ট যোগাযোগ ছিল অনেকেরই। কিন্তু সক্রিয়ভাবে রাজনীতি করেছেন ৬০-এর দশকের কোনো কবি, নকশাল আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েছেন, তার কথা আমার মনে পড়ে না।

    পরবাস : নকশালবাড়ি আর বাংলা কবিতা বললে মণিভূষণ ভট্টাচার্যের কথা মনে পড়ে।

    বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : মণিভূষণ ভট্টাচার্যর সঙ্গে আমি খুবই ঘনিষ্ঠ ছিলাম। উনি থাকতেন নৈহাটিতে।

    পরবাস : গান্ধী নগরে রাত্রি

    বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত :

    ওই সিমপ্যাথি। খুবই সিমপ্যাথিটিক ছিলেন। কিন্তু মণিদা কখনোই রাজনীতি করেননি। মণিদার সঙ্গে আমার খুবই ঘনিষ্ঠতা ছিল। পার্ক সার্কাসে তখন আমি থাকতাম, মামাবাড়িতে। আর মণিদা এলে আমি আর মণিদা বেরিয়ে পার্ক সার্কাস ময়দানে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমরা আড্ডা মারতাম। নৈহাটি চলে যেতাম। নৈহাটি গিয়ে গঙ্গার ধারে বসে আড্ডা মারতাম। মণিদা একটা কথা প্রায়ই আমাকে বলতেন — এই দিয়ে কিছু হবে না। অসামান্য মানুষ ছিলেন। বলে বোঝানো যাবে না। আসলে এরা প্রত্যেকে আমাকে কিছু দিয়ে গেছেন। বেঁচে থাকার যে চাবিকাঠি, বেঁচে থাকার তো একটা চাবিকাঠি হয় না। অনেকগুলো চাবিকাঠি দিয়ে, অনেকগুলো দরজা খুলতে হয়। আমরা মা একটা চাবিকাঠি দিয়ে গেছিলেন। যা দিয়ে ইমেজকে আমি চিনতে শিখেছিলাম। সেভাবে প্রত্যেকেই কোথাও না কোথাও আমাকে কিছু না কিছু দিয়ে গেছেন। দরজা খোলার মন্ত্র। মণিদাও তাই। বুদ্ধদেব বসু মণিভূষণ ভট্টাচার্যের কবিতা ভয়ঙ্কর পছন্দ করতেন। সুনীল-শক্তির যে রেটে কবিতা বেরুতো ‘কবিতা’ পত্রিকায়, মণিদা তার চেয়ে বেশি কবিতা লিখেছেন ‘কবিতা’ পত্রিকায়। তুমি যদি দেখো কবিতার বাঞ্চ, চারটে-পাঁচটা করে কবিতা বেরোচ্ছে মণিভূষণ ভট্টাচার্যের। সাংঘাতিক। অহংকারহীন। উনি তো কোথাও কোনো স্রোতে ভাসেননি। কোনও দলে পড়েননি। দলে মেশেননি, যাননি। কোনও প্রতিষ্ঠানের কাছে হাত পাতেননি। প্রাতিষ্ঠানিক ছাউনি চাননি, ছাতাও চাননি। প্রতিষ্ঠানের ছুঁড়ে দেওয়া গেঞ্জি গায়ে দিয়ে ঘুরে বেড়াননি।

    পরবাস : আপনারা একটা অদ্ভুত সময়ে বড় হচ্ছিলেন, যেটা আমাদের থেকে অনেকটা আলাদা, প্রযুক্তির কারণে। আপনারা একটা সিনেমা একবার দেখতে পেতেন। আমরা বহুবার, যতবার খুশি দেখতে পাই। আপনার ছবি ইচ্ছে করলে এখানে বসে মোবাইলে দেখতে শুরু করতে পারি। আপনাদের অপেক্ষা করতে হত কবে ফিল্ম ক্লাব দেখাবে বা কোনো একটা ফেস্টিভ্যালে দেখাবে। তো এভাবে যে ছবির প্রতি টান, আর ছবির প্রতি টানটাই তো শুধু নয় আপনাকে তো কাজটাও শিখতে হয়েছে। ছবি বানানো তো একটা কমপ্লেক্স প্রসেস। এগুলো যখন শুরু হচ্ছে তখন কাদের ছবি আপনাকে খুব অনুপ্রাণিত করত? দেশি বা বিদেশের ছবি?

    বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : দেখো, আমি ছিলাম সর্বভুক। কবিতায় বলো, সিনেমাও বলো। তোমাকে একটা ঘটনা বলি। তখন নন্দনের পাশে অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টসে সিনেমা দেখানো হত। আমি কলেজে পড়ি, দেবাশিস এম.এ. পড়ে। আমি বোধহয় ফার্স্ট ইয়ার না সেকেন্ড ইয়ারে।

    পরবাস : দেবাশিস বন্দোপাধ্যায়?

    বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : হ্যাঁ। ও আমার হোস্টেলে থাকত। তো সেদিন দেখাচ্ছিল রিভেতের ‘প্যারিস ইজ আওয়ার্স’। দেখেছ কি না জানি না। ‘প্যারিস ইজ আওয়ার্স’ রিভেতের প্রথম ছবি। দেখে, মানে আমরা উঠতে পারলাম না। বসে থাকলাম। অন্য দর্শক এল, দ্বিতীয় শো শেষ হয়ে গেল। তৃতীয় শো রাতের, বসে বসে দেখলাম। একটা ছবি একবারও না উঠে বসে দেখলাম। বাথরুম করতে গেলেই যদি সিটটা চলে যায়।

    পরবাস : টানা তিনবার দেখলেন রিভেতের ছবিটা?

    বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : দেখে হাঁটতে হাঁটতে অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টস থেকে যাদবপুর পৌঁছলাম। আমি আর দেবাশিস। গল্প করতে করতে। হোস্টেলে পৌঁছে ওর-ই খাবার ভাগ করে দুজনে খেলাম। তারপর ওর বিছানাতে আমি আর দেবাশিস দুজনে শুয়ে পড়লাম।

    পরবাস : তখন আপনারা কোলকাতায় গোদার, ত্রুফো এইসব দেখতে পাচ্ছেন?

    বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : হ্যাঁ। দেখতে পাচ্ছি। তবে তুমি যেভাবে বললে একাধিকবার দেখতে পেতাম না। একবারই দেখার ভাগ্য হত। দেখছি আরো ভালোবাসছি। সিনেমাকে। দেখছি আর আরো বুঝতে পারছি সিনেমা ছাড়া আমি বেঁচে থাকতে পারবো না। দেখছি আর বুঝতে পারছি আমাকে অনেক কিছু ছাড়তে হবে। অনেক কিছু ছেড়ে দিতে হবে। ইকনমিক্স-ও আমার খুব ভালোবাসার বিষয় ছিল, ছাড়তে হবে। এসব করলে আমার আর চলবে না। আর একটা জিনিস বুঝতে পেরেছিলাম মধ্যবিত্তের যে গেঁথে পড়ার ব্যাপারটা থাকে না, সেটা আমাকেও গ্রাস করবে। ওই মাস্টার হয়েই সারাজীবন কাটিয়ে দেব। আশিস যেমন ছিল, আমাদের ব্যাচে ফার্স্টক্লাস ফার্স্ট হয়েছিল।

    পরবাস : মানে যিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাইস চ্যান্সেলর ছিলেন, আশিস ব্যানার্জী।

    বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : হ্যাঁ। রতন হয়েছিল ফার্স্ট ক্লাস সেকেন্ড। রতন খাসনবীশ।

    পরবাস : বুদ্ধদা, আমাদের বাংলা ছবি আপনাদের আগে যারা ছবি বানাচ্ছিলেন--সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেন এদের থেকে তো আপনার পথ আলাদা ছিল, আপনি বুঝতেই পারছিলেন। ঋত্বিক ঘটক সম্পর্কে আপনি খুব শ্রদ্ধাশীল। আপনার লেখাতেই সেটা পড়েছি। ‘জরুরী মানুষ’ বলেছেন। সত্যজিৎ রায় একধরনের রেনেসাঁ পুরুষ। আমরা যেভাবে ওনাকে বর্ণনা করি সাধারণত। রবীন্দ্রনাথের পর ওরকম একজন মানুষ। এদের মধ্যে মৃণাল সেন একদম আলাদারকম ছিলেন। একটু বলুন মৃণাল সেন সম্পর্কে। আপনারা কি ভাবতেন মৃণাল সেনের ছবি দেখে...

    বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : দেখো, সিনেমাকে সিনেমা হিসেবে ব্যবহার করার যে ক্ষমতা এটা সত্যজিৎ রায়ই প্রথম দেখালেন। পাশাপাশি দেখালেন ঋত্বিক ঘটক। তোমরা এটা খেয়াল করেছ কিনা জানি না, যখন অপরাজিত তৈরী হচ্ছে বা অপুর সংসার তৈরী হচ্ছে তখনই ঋত্বিক ঘটক অযান্ত্রিক তৈরী করছেন। প্রথম ছবিটা অসম্ভব খারাপ। ‘নাগরিক’ আমার ভাল্লাগেনি। আমি দেখতে বসে বিরক্ত হয়েছিলাম। এই একটা অদ্ভুত ব্যাপার দেখেছিলাম--প্রথম ছবি, যে কারণে নিজের সঙ্গে মিল খুঁজে পাই ঋত্বিকের। নাগরিকের পর একটা বিশাল লাফ, ‘অযান্ত্রিক’। অযান্ত্রিকের মতো ছবি সত্যজিৎ রায়ও বানাতে পারেননি। ভাবতেও পারেননি। অপুকে চেনা যায়। অপু, অপুর সঙ্গে বাবার সম্পর্ক বা অপুর সঙ্গে মায়ের সম্পর্ক আমরা বুঝতে পারি। কিন্তু একটা গাড়ির সঙ্গে একটা মানুষের সম্পর্ক! যে গাড়িটা কথা বলে না, যে গাড়িটা নড়ে-চড়ে না। যে গাড়িটা এক্সপ্রেস করতে পারে না। তার সঙ্গে এরকম অদ্ভুত জটিল ভালোবাসায় জড়িয়ে পড়া নিয়ে একটা প্রথম বাংলা সিনেমা তৈরী হল যেটা দিয়ে নন-ন্যারেটিভ ফর্মটাকে প্রথম ভারতবর্ষে কনসিভ করেছিলেন ঋত্বিক ঘটক। আর কেউ না। মৃণাল সেন অনেক দূরে। আজও তুমি যদি অযান্ত্রিক দেখ কেঁপে যাবে। আমাদের সময় আরেকজনের কথা আমি বলতে পারি, দুজনের কথা আমি বলব ওই সময়। ভীষণ ভালো ছবি করছেন। একটু পরে শুরু করলেন তাঁরা। রাজেন তরফদার। যাকে নিয়ে চর্চাটা খুব কম হয়েছে। কিন্তু খুব পাওয়ারফুল। কয়েকটা ছবি খুব পাওয়ারফুল, ভয়ংকর পাওয়ারফুল। রাজেন তরফদারের প্রথম ছবি অন্তরীক্ষ। ভাবা যায় না। বারীন সাহার ‘তেরো নদীর পারে’। দেখে আবার সেই ভয়ংকর মুগ্ধ হয়ে গেলাম।

    পরবাস : বারীন সাহা তো আপনার থেকে বয়সে বড় ছিলেন?

    বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : অনেক বড় ছিলেন। অনেক-অনেক বড় ছিলেন বারীন সাহা। বছর ১৫-১৬-র বা ২০ বছরের বড় ছিলেন। বারীন সাহার ‘তেরো নদীর পারে’ প্রথম দেখেছিলাম যাদবপুর ইউনিভার্সিটির ত্রিগুণা সেন অডিটোরিয়ামে। দেখে না, মানে আমি ভাবতে পারিনি এরকম ছবি তৈরী করতে পারেন। বারীন সাহা অসম্ভব পাওয়ারফুল ছিলেন। মনে আছে হেঁটে যখন বেরোচ্ছি আমি বারীন সাহার পাশে পাশে হাঁটছি। জাস্ট গা’টা ছোঁয়ার জন্য। এরকম মানুষকে সত্যি ছোঁয়া দরকার। তেরো নদীর পারে তারপর আমি অনেকবার দেখেছি। আর ঋত্বিক ঘটক তারপর যেসব ছবি করেছেন সেসব তো ইতিহাস হয়ে থাকবে। ঋত্বিক ঘটকের প্রত্যেকটা ছবিই--‘মেঘে ঢাকা তারা’, ‘সুবর্ণরেখা’, ‘কোমল গান্ধার’ ভোলা যায় না ওসব। বেশী ছবি তো করতে পারেননি।

    পরবাস : যুক্তি তক্কো আর গপ্পো আপনার ভালো লেগেছিল?

    বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : না। সবটা ভালো লাগেনি। যুক্তি তক্কোর কিছুটা অংশ বিশেষ করে আমার মনে আছে, একটা গান ছিল রবীন্দ্রনাথের ‘কেন চেয়ে আছ গো মা’--তার এডিটটা অসামান্য ছিল। অসম্ভব ট্যালেন্ট না থাকলে ওইভাবে ছবি কাটা যায় না। অতটা কনফিডেন্স নিয়ে ওইভাবে ছবিটাকে এডিট করা ভাবা যায় না! যুক্তি তক্কো-তে এডিটিং অসামান্য। আরেকটা ছবি তোমরা দেখনি, যেটা বাংলাদেশে তৈরী করেছিলেন, তিতাস।

    পরবাস : আমরা দেখেছি, এখন দেখা যায়। ডিভিডি-ও পাওয়া যায়। রেস্টোরেশানের পর ঝকঝকে ছবি হয়েছে।

    বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : তিতাস খুব ভালো। ঋত্বিক ঘটক আরেকজন... সত্যজিৎ রায় যেমন রীতি মানতেন, নীতি মানতেন। ঋত্বিক ঘটক কিচ্ছু মানতেন না। উনি যে এডিটটা করছেন, কেউ তাঁকে বলে দেয়নি। কোন ছবি থেকে দেখে উনি ওটা করেননি। মাথায় যা এসেছে করেছেন। এবং সে কাটিংগুলো অদ্ভুত।

    পরবাস : ইনস্টিঙ্কট নির্ভর?

    বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : মানে ছবি যে ওরকমভাবে কাটা যায়...

    পরবাস : ম্যানুয়ালের বাইরে গিয়ে...

    বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : হ্যাঁ, ম্যানুয়ালের বাইরে গিয়ে। সেটা পরে কিন্তু বাংলা সিনেমার অনেকের ছবি করার খোলনলচে বদলে দিয়েছিল। এমনকি মানিকদাও নিজেকে বদলাতে শুরু করলেন ঋত্বিকের ছবি দেখে। মানিকদার মধ্যে শৈলী যাকে বলে তার কোন তুলনা নেই। এই শৈলী ঋত্বিকের ছিল না।

    পরবাস : সেটা কি একটু ক্লাসিক্যাল?

    বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : শৈলী যে সবসময় ক্লাসিক্যাল হবে তার কিন্তু মানে নেই। শৈলী একটা নৈপুণ্যের কথাই বলে। যেমন আমার ঠাকুমা বা তোমার ঠাকুমা দিদিমার সুতোর কাজ করা। একটা শৈলী ছিল, নৈপুণ্য ছিল। সত্যজিৎ রায়ের তেমন অসম্ভব নৈপুণ্য ছিল, শৈলী ছিল। কিন্তু সাহস, উদ্দম অন্য জিনিস। সে সাহস ছিল ঋত্বিকের। যাতে কোন কিছু উনি মানেননি। সত্যজিৎ রায় ফিল্মের গ্রামারকে মেনে ছবি করেছিলেন। এবং গ্রামারকে মেনেই অসামান্য সমস্ত কাজ করেছেন।

    পরবাস : মৃণাল সেন তো আবার ওদের থেকে একটু আলাদা...

    বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : হ্যাঁ। মৃণাল সেনের ‘বাইশে শ্রাবণ’ খুব ভালো। খুব ভাল ছবি। অত সুন্দর ছবি, কিন্তু বাঙালির যে সমস্যা-- যে বাইশে শ্রাবণকে ওরা ধরতে পারল না। বাইশে শ্রাবণকে ওরা মনে করল যে পথের পাঁচালীর আরেকটা কপি। যেটা একেবারেই নয়।

    পরবাস : না, আমি বলতে চাইছি যে মৃণাল সেন যে ছবিগুলি কলকাতা নিয়ে...

    বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : দেখো আমি মৃণাল সেনকে খুব বড় মাপের ফিল্ম-মেকার বলে মনে করি না। আমার কখনোই মনে হয়নি যে he can inspire me বা, he was ever a source of inspiration in my life. ছবি দেখেছি, আড্ডা মেরেছি, কথা বলেছি এই অবধি। তার বেশী কিছু নয়।

    পরবাস : ভারতের অন্য ভাষায় যারা ছবি করছেন আপনাদের সময় বা আপনার একটু আগে...

    বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : আমার সময়ে, আমার সমসাময়িক বা একটু আগে শুরু করেছে শ্যাম। অরবিন্দন, আদুর। আমি আর অরবিন্দন খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধু।

    পরবাস : সেটা আমি পড়েছি। আপনি লিখেছেন ‘কাগের ছা বগের ছা’-তে।

    বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : আদুর-ও বন্ধুস্থানীয়। কিন্তু বন্ধুত্বের যে নিবিড়তা তাতে আমি অরবিন্দনকেই কাছে রাখব।

    পরবাস : আব্রাহামের সঙ্গেও তো আপনার বন্ধুত্ব ছিল...

    বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : হ্যাঁ। জন আব্রাহামের সঙ্গে ভীষণ বন্ধুত্ব ছিল।

    পরবাস : তার ছবি আপনার ভালো লাগে? সে সময় নিশ্চয় দেখেছেন।

    বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : ছবি আর কটা করেছেন?

    পরবাস : বিদ্যার্থীকালে ইথিলে ইথিলে... আম্মা আরিয়ান

    বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : ‘আম্মা আরিয়ান’ ওর সবচেয়ে ভালো ছবি বলা হয়। ছবি করেছে। অন্যরকম করতে চেয়েওছে। কিন্তু ওর মধ্যে যেটা সবচেয়ে বড় গুণ ছিল একটা হাওয়া তৈরী করা। ভালো ছবির একটা হাওয়া। ও একটা সংগঠন তৈরী করেছিল সেটা হচ্ছে যে অনেকের ছবি নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন। তার একটা নাম ছিল। একবার আমার দু'টো ছবি নিয়ে একমাসের জন্য কেরালার বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে বেড়িয়েছিল।

    পরবাস : ছবি দুটোর নাম মনে আছে আপনার?

    বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : এখন আর মনে নেই। আমার নিজের খরচে প্রিন্ট করে। মালায়ালামে সাব-টাইটেল করে আর কী...। ও আমার খুবই ভালো বন্ধু ছিল। ওরকম আরেকজন দেখিনি যে সন্ন্যাসী। নিজের সম্পত্তি বলতে ছিল ওর ঝোলা ব্যাগ। একটা ব্রাশ, কিছু কাগজ একটা পেন। টুথপেস্টটাও কিনত না। নিমডাল নিয়ে ব্রাশ করত।

    পরবাস : ওঁর ওপরে ঋত্বিক ঘটকের প্রভাব বোধহয় খুব বেশি ছিল?

    বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : না, না। তুমি একটা জিনিস মনে রেখো, আমাদের সমসাময়িক ফিল্ম-মেকারদের মধ্যে ঋত্বিক ঘটক সবচেয়ে প্রিয় মানুষ ছিলেন। সাংঘাতিক প্রিয়।

    পরবাস : এম. এস. সথ্যু, সৈয়দ মির্জা...

    বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : সৈয়দ মির্জা। আমার অসম্ভব ঘনিষ্ট বন্ধু ছিল। আমরা একই সময় শুরু করি। সৈয়দ, কেতন মেহতা -- সমবয়সী বন্ধু আমরা।

    পরবাস : পরবর্তীকালে কিছু কমার্শিয়াল কাজও করেছেন...

    বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : কমার্শিয়াল কাজও করেছে। হারিয়েও গেছে সেজন্যে। এদের মধ্যে সবচেয়ে পাওয়ারফুল বলব আমি কেতনকে।

    পরবাস : একটু আপনার বন্ধু অরবিন্দনের কথা বলুন...

    বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : অরবিন্দন অসামান্য মানুষ ছিল।

    পরবাস : ওঁর ছবিকেও আপনি গুরুত্ব দেবেন...

    বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : হ্যাঁ, অবশ্যই। কিছু কিছু ছবি অসম্ভব ভালো। প্রথম দু-একটা ছবি বাদ দিলে। পক্কুভেল, থাম্পু বেশ ভালো ছবি করেছে। নামগুলো সব মনে পড়ছে না।

    পরবাস : ওঁর শেষ ছবি ‘বাস্তুহারা’ তো উনি পশ্চিমবঙ্গে এসে শ্যুট করেছিলেন।

    বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : ‘বাস্তুহারা’, শেষ ছবি। ওর সঙ্গে গভীর বন্ধুত্ব হবার আর একটা কারণ ছিল ও খুব বাঙালি-প্রিয়। তখন আমি ম্যাড্রাসে গেছি। ফেস্টিভ্যালের সময়। ও বলছে বুদ্ধদেব তোমাকে কালকে ছবি দেখাব। কাল হল না। পরশু দেখাব। যেদিন দেখাবে সেদিন আমার চলে যাওয়া। আমি বললাম তোমার ছবি আমি দেখতে পারব না। বলল না, তুমি না দেখলে তো হবে না। দেখতেই হবে। একটা কাজ করছি আমি গাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছি। তুমি হোটেল ছেড়ে গাড়িতে সমস্ত জিনিসপত্র রেখে দাও। গাড়ি এখানে দাঁড়িয়ে থাকবে। তুমি ছবি দেখে আবার গাড়িতে উঠে পড়বে, যথেষ্ট সময় পাবে এয়ারপোর্টে পৌঁছে যাবার। প্লেন মিস করবে না। তো ছবি দেখানো হল। প্রথমে দেখলাম আমরা। আমার মনে আছে আমার পাশে বসেছিলেন চিদানন্দ দাশগুপ্ত। বার বার ঘুমিয়ে পড়ছেন। ডেকে তুলতে হচ্ছে আবার। কিছুই দেখেননি। অরবিন্দন বলেছিল আমাকে যে Bengal is my second motherland. বাঙলার প্রতি ওর তীব্র ভালবাসা ছিল। সেই ওর সঙ্গে শেষ দেখা। তারপর আর দেখা হয়নি। তার এক বছর পরেই ও মারা গেল। আমার অসম্ভব ভালো বন্ধু ছিল। দেশে-বিদেশে বহু সময় একসঙ্গে থেকেছি। অসামান্য মানুষ। কি বলব ৬টা-সাড়ে ৬টার পর ওকে আর চা-টা খাওয়ানো যেত না। মদ ছাড়া কিছু খেত না। খাবারও খেত না। আর নাচত। নাচ শুরু করত রবীন্দ্রনাথের গান দিয়ে। তারপর নিজের ছেলের গান-ফান নিয়ে নাচত। এই সবটাই ওর নিজের তৈরি করা নাচ।

    পরবাস : এক ধরনের আত্মমগ্নতা...

    বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : হ্যাঁ। আসর শুরু করা এবং শেষ করার জন্য আমরা ওকে মধ্যমণি করেছিলাম। যদিও কথাবার্তা খুব কম বলত। মদ খেয়ে একটু কথা বলত। ওর ইন্টারভিউ একটা বেরিয়েছিল। ওরকম হাসির ইন্টারভিউ আর আমি দেখিনি। বিশাল বড় বড় সব প্রশ্ন। ৪-লাইনের ৬-লাইনের। ওর উত্তর শুধু ইয়েস, নো, মে বি।

    পরবাস : বুদ্ধদা, এবার অন্যদিকে যাব, সেটা হল আপনি তো ছবিতে ইমেজটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন। ছবির সঙ্গে সাহিত্যের যোগ কতটা? আদৌ আধুনিক সময়ে কি ছবি এবং সাহিত্য...

    বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : কোনো যোগ নেই। আধুনিক সময়ে কেন, কোন সময়তেই যোগ ছিল না। আমরা যোগাযোগ তৈরি করেছিলাম। এ নিয়ে গলা ফাটিয়েছিলাম। সিনেমা কেন সাহিত্যনির্ভর হবে না?

    পরবাস : কিন্তু আপনি তো অনেকবার অন্যের গল্প নিয়ে ছবি করেছেন।

    বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : হ্যাঁ, গল্প নিয়ে ছবি করেছি। এখনো করছি।

    পরবাস : আপনার শেষ ছবিও নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের গল্প নিয়ে।

    বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : এখন যে ছবি করতে চলেছি সেটাও একদম তরুণ একজন লেখকের গল্প নিয়ে। অসামান্য লেগেছে তার লেখা আমার। সাদিক হোসেন।

    পরবাস : আমি পড়েছি তার লেখা। খুবই তরুণ লেখক।

    বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত :

    কিন্তু খুব নাম করেছে। ভাল লেখে। প্রতিষ্ঠানকে একদম বর্জন করে নিজের মতো করে লিখেছে। কিন্তু মুস্কিল হয়েছিল কমলদার ছবি করতে গিয়ে। কমলদা আমাদের খুব প্রিয় মানুষ ছিল। আমি বার্লিনে বসে শুনলাম কমলদা মারা গেছেন। ওখানেই ঠিক করলাম ফিরে গিয়ে ‘নিম অন্নপূর্ণা’ করব। ‘নিম অন্নপূর্ণা’ করতে গিয়ে ভীষণ গণ্ডগোল হয়েছিল। ওনার স্ত্রীর ছবি একদমই ভাল্লাগেনি। আর আমারও দোষ ছিল; কিছু। অনেক পরে ‘তাহাদের কথা’ করতে চাই। তো তখন আমি সুনীলদাকে বললাম—সুনীলদা আমি ‘তাহাদের কথা’ করতে চাই। কিন্তু ওনার স্ত্রীকে বলার আমার উপায় নেই, কারণ আমায় দেখলেই উনি রেগে যাবেন। তা সুনীলদা ওনাকে চিঠি দিলেন। তারপর বুঝিয়ে রাজি করালেন। কিন্তু ‘তাহাদের কথা’ দেখে উনি আরও খেপে গেলেন। খেপে গিয়ে বিশাল বড় একটা চিঠি লিখলেন কোন কাগজে যেন।

    পরবাস : তাহাদের কথা তো অ্যাওয়ার্ড পেয়েছিল।

    বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : তাহাদের কথায় বেস্ট অ্যাক্টর পেয়েছিল মিঠুন।

    পরবাস : কমলবাবুর গল্প নিয়ে ছবি করা প্রসঙ্গে কিছু কথা বলার আছে। সে ছবি নিয়ে সমালোচনা হতেই পারে, কিন্তু কখনো কখনো সেটা শালীনতার সীমাও ছাড়িয়ে গেছে। ব্যথা দেয় না আপনাকে?

    বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : ব্যথা দেয় না, তা নয়। কিন্তু আমার একটা সময় মনে হয়েছিল কোন ব্যথা পাবার প্রয়োজনই নেই। কেননা এরা হচ্ছে ঘুঁটের মত। খুব অল্প সময় জ্বলে। নিজস্ব তো কিছুই নেই। গোরুটাকে যদি মেরে ফেলে গোবরটা তো আর বেরোবে না। তা ওরা ছিল সেই জিনিস, গু-গোবরের সমতুল্য। ফলে ওসবে খুব মাথা ঘামাইনি।

    পরবাস : লেখক কমলকুমারের সাথে আপনি কানেক্ট করতে পারতেন খুব ভালোভাবে...

    বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : কানেক্ট করতে পারতাম। কমলকুমার মজুমদারের...এদের সমস্যা ছিল যে ফিল্মকে ভালো করে না বোঝা, না জানা। সাহিত্যে যে জিনিসগুলো তৈরি হয়, তৈরি করা যায়, সিনেমায় তা করা যায় না। সাহিত্যে তুমি অনেক জিনিস বলে ফেলতে পারো একটা-দুটো লাইনের মধ্যে বা চার-পাঁচটা শব্দের মধ্যে, যেটা কমলদা করতেন। ওঁর ভাষার যে স্বাতন্ত্র্য ছিল, সেটা একদম কমলদার ভাষা। কোনো ভাষা অনুকরণ করে কমলদার পক্ষে লেখা সম্ভব ছিল না। কিন্তু ওটা সিনেমার ভাষা নয়, যদিও কমলদা সিনেমাটা খুব ভালো বুঝতেন।


    অরণি বসু, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত ও শ্রীকুমার চট্টোপাধ্যায়

    (* পরবাসে প্রকাশিত 'টোপ'-এর ইংরেজি অনুবাদ, The Bait-এর জন্য এইখানে ক্লিক করুন।)

    (ক্রমশ)



    অলংকরণ (Artwork) : ছবিঃ রাজীব চক্রবর্তী ও অরণি বসুর সৌজন্যে
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments