হিমালয়ের কোলে ছোট এক দেশ ‘ভুটান’। সেদেশে বেড়াতে গিয়েছিলাম ২০১৬ সালের গরমকালে। মাত্র কয়েকটি দিন ছিলাম কিন্তু সবসময় মনে হচ্ছিল প্রকৃতি যেন অকৃপণ হাতে ভুটানকে সাজিয়েছে পাহাড়ে-নদীতে-ফুলে-ফলে। শুধু কি তাই! সে-দেশের মানুষজন দেখতে যেমন সুশ্রী, তেমন চমৎকার তাদের ব্যবহার – দু’দণ্ড তাদের সঙ্গে কথা বললে মন ভাল হয়ে যায়।
ভুটানের উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমে রয়েছে চিনের অন্তর্গত তিব্বতের অংশ (Tibet Autonomous Region) আর দক্ষিণ, দক্ষিণ-পশ্চিম ও পূর্বদিকে রয়েছে ভারতের চারটি রাজ্য। ভারতের তুলনায় ভুটানের সময় আধঘন্টা এগিয়ে আর ভারতীয় টাকা দিয়ে ওখানে কেনাকাটা করা যায়। বাগডোগরা এয়ারপোর্ট থেকে যে গাড়িতে ভুটানের দিকে রওনা হলাম তার চালক প্রবীণও আমাদেরই মতো প্রথমবার ওদেশে যাচ্ছেন। জাতীয় সড়ক ধরে চললাম আমরা — ঘন্টা চারেকে ফুন্টশলিং (Phuentsholing) পৌঁছনোর কথা।
রাস্তার অবস্থা ভাল তবে কয়েকবার গাড়ি থামিয়ে ‘চেকিং’ হ’ল। কখনো দেখছি পথের দু’ধারে চা-বাগান, কোথাও একপাশে চা-বাগান আর অন্যদিকে রেললাইন আবার কোথাও বা জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পথ। শুকিয়ে যাওয়া চেল নদী, জলদাপাড়া ন্যাশনাল পার্ক আর মাঝে মাঝে ছোট ছোট বসতি ছাড়িয়ে চলেছি। যতক্ষণে ভারতীয় সীমান্তের অপরিচ্ছন্ন বসতি জয়গাঁও পৌঁছলাম, সূর্য অস্তাচলের পথে। সেখানে এক বাহারি তোরণ পার হতেই পড়শি দেশের তকতকে পরিষ্কার শহর ফুন্টশলিং! এ যেন এক ভানুমতীর খেল! আশ্চর্যের কথা যে ভারতের দিক থেকে ঐ তোরণ দিয়ে ঢুকে খানিকদূর অবধি কোনোরকম ‘কাগজপত্র’ ছাড়াও যাওয়া যায়! তা সত্ত্বেও এমন পরিচ্ছন্নতা বজায় রেখে ভুটানবাসীরা যে কৃতিত্ব দেখিয়েছেন তাতে অবশ্যই মুগ্ধ হ’লাম! পরে দেখেছি যে সাধারণভাবে দেশটি খুব পরিচ্ছন্ন।
যাহোক, ফুন্টশলিং হ’ল দেশের বাণিজ্য কেন্দ্র ও সেখানে প্রথমেই আমার চোখে পড়ল এক ‘শপিং কমপ্লেক্স’ যার দেওয়াল ও পিলারে সুন্দর কারুকাজ আর তার দোতলার জানলার বাইরে লাগানো রয়েছে ওদেশের রাজা জিগমি কেসর নামজিয়েল ওয়াংচক-এর বড়সড় মাপের ছবি। একটিতে তিনি একা আর অন্যটিতে তাঁর সঙ্গে রাণী জেটসুন পেমাও রয়েছেন। শুনলাম যে রাজা-রাণীকে ওদেশে এভাবে সম্মান জানানো হয়। যাহোক, আমরা নিজেদের ও গাড়ির অনুমতিপত্র দেখিয়ে পাহাড়ি পথে খানিক উঠে আমাদের হোটেলে পৌঁছলাম। হোটেলের জানলা থেকে নিচের পার্ক ও তার মধ্যের ছোট এক বৌদ্ধমঠ বা মনাস্ট্রি দেখতে পাওয়া যায়।
হোটেলে রাখা গাইড-বুক-এ দেখলাম যে ভুটানের মুখ্য (৭৫%) ধর্ম মহাযান (তান্ত্রিক) বৌদ্ধধর্ম। এছাড়া প্রায় ২৫% হিন্দু ছাড়া কিছু অন্যান্য ধর্মের মানুষও ওদেশে আছেন। অষ্টম শতকে গুরু পদ্মসম্ভব (গুরু রিনপোচে) — যাকে নেপাল, ভুটান বা তিব্বতে দ্বিতীয় বুদ্ধ বলা হয় — এখানে বৌদ্ধধর্মের সূচনা করেন। তার আগে ওখানে লৌকিক ধর্মের প্রচলন ছিল। দেশের সংবিধান তার নাগরিক ও পর্যটক সকলকেই নিজের নিজের ধর্ম পালনের অধিকার দেয় তবে তা যেন অন্য কারো অধিকারে হস্তক্ষেপ না করে।
ভুটানের বর্তমান রাজপরিবারের সূচনা হয় ১৯০৭ সালে। বংশের তৃতীয় রাজা জিগমি দোরজি ওয়াংচক (Jigme Dorji Wangchuck) ১৯৫২ সালে মাত্র ২৫ বছর বয়সে রাজা হন (রাজত্বকাল ১৯৫২-১৯৭২)। তাঁর সময় থেকে দেশের শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তনের শুরু। তিনি দাসত্ব-প্রথা বন্ধ করে সেই দাসদের দেশের নাগরিকত্ব ও জমি দান করেন। তিনি কর ও আইনী-ব্যবস্থারও অনেক উন্নতি করেন। ১৯৫২ সালে এই রাজা পুনাখা থেকে থিম্পু-তে রাজধানী আনবার পরিকল্পনা করলেও তা রূপায়িত হয় ১৯৬১ সালে। ১৯৯৮ সালে চতুর্থ রাজা জিগমি সিঞ্জায়ে ওয়াংচক (Jigme Singye Wangchuck) অনেকটা শাসন ক্ষমতা জনগণের দ্বারা নির্বাচিত এক মন্ত্রীসভার হাতে তুলে দেন। তিনি ভারতের সাহায্য নিয়ে দেশের উন্নতির জন্য অনেক প্রকল্পেরও সূচনা করেন এবং ২০০৬ সালে তাঁর পুত্র জিগমি কেসর নামজায়েল ওয়াংচক (Jigme Khesar Namgyal Wangchuck)-কে রাজ্যভার দিয়ে নিজে অবসর নেন। তবে রাজপরিবারের উদ্যোগে ২০০৮ সাল থেকে ভুটানে parliamentary democratic constitutional monarchy-র সূচনা হয়েছে। দেশের সংবিধান ধর্ম ও রাজনীতির সুন্দর সমন্বয় ঘটিয়েছে — বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে বৌদ্ধদর্শন ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের রীতিনীতি। ১৯৭২ সালে চতুর্থ রাজা জিগমি সিঞ্জায়ে ওয়াংচক ঘোষণা করেন যে দেশের উন্নতির মান GDP (Gross Domestic Product) দিয়ে পরিমাপ না করে GNHI (Gross National Happiness Index) দিয়ে পরিমাপ করা হবে। এই নতুন মাপকাঠিতে দেশবাসীর সুখ ও স্বস্তির দিকে নজর দিতে শাসন ব্যবস্থা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের সঙ্গে অর্থনীতি-বহির্ভূত দিকগুলোও, যেমন সংস্কৃতি ও পরিবেশ-রক্ষণ, সমান গুরুত্ব পেয়েছে।
ভুটানের রাষ্ট্রীয় ভাষা হ’ল জ়ংকা (Dzonkha) তবে আরো অন্ততঃ চব্বিশটা ভাষার ব্যবহার আছে। তিব্বতী লিপিতে লেখা রাস্তার নাম ইত্যাদি দেখে কিছুই মর্মোদ্ধার করতে পারছিলাম না। হোটেল বা অধিকাংশ দোকানে হিন্দি বা ইংরিজিতে দিব্যি কাজ চালানো যায়। ১৯৫০-এ ভুটানে স্কুল শুরুর আগে শিক্ষাগ্রহণ সম্ভব ছিল একমাত্র মনাস্ট্রিতে। এখন স্কুল-কলেজে জ়ংকা পড়ানো হ’লেও শিক্ষার মাধ্যম হ’ল ইংরিজী। স্থানীয় লোকজনদের সঙ্গে কথা বলে জানলাম যে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা অবৈতনিক আর তারপর মেধার ভিত্তিতে সরকারী বৃত্তি নিয়ে উচ্চশিক্ষা অর্জন করা যায়।
আমাদের হোটেলের অধিকাংশ কর্মী মহিলা। ওদেশের অন্য জায়গার হোটেলেও তাই দেখেছি। এমনকি মহিলারাই হোটেলের তিনতলা বা চারতলায় আমাদের মালপত্র অবলীলায় বয়ে নিয়ে যেতেন। সাধারণভাবে ভুটানের মেয়েদের ভারি মিষ্টি দেখতে আর তেমন শান্তভাবে তারা কথাবার্তা বলে। নারী-পুরুষ-শিশু-বৃদ্ধ সকলে যে জাতীয় পোষাক পরে তা দেখতে খুব ভাল লাগছিল। ছেলেদের পোশাককে বলে ‘ঘো’ যা আদতে কিমোনোর মতো লম্বা কিন্তু সেটিকে পেটের কাছে গুটিয়ে তুলে হাঁটু অবধি ঝুল রাখা হয় ও ‘কেরা’ নামের কোমরবন্ধনী দিয়ে সেটিকে আটকানো হয়। ‘ঘো’ গোটানোর ফলে পেটের কাছে কাপড়ের যে ভাঁজ হয় সেখানে পান-সুপুরির কৌটো ইত্যাদি নিত্যব্যবহার্য জিনিস রাখার চল আছে। এর সঙ্গে ছেলেরা হাঁটু অবধি লম্বা মোজা ও জুতো পরেন আর বাঁ-কাঁধের ওপর নেন চাদর। মজা হ’ল যে চাদরটির রঙ থেকে সেই ব্যক্তিটির সামাজিক অবস্থান জানা যায়। যেমন, রাজা পরেন হলুদ, বিচারক পরেন সবুজ আর সাধারণ মানুষের জন্য নির্দিষ্ট সাদা রঙের চাদর। মেয়েদের পোশাকটি অনেকটা মেখলা-র মতো (পা পর্যন্ত ঝুলের স্কার্ট) যা কোমরে ‘কেরা’ দিয়ে বাঁধা হয় ও তাঁরা ঊর্ধ্বাঙ্গে ব্লাউজের ওপর ছোট-ঝুলের, লম্বা-হাতা জ্যাকেট পরেন। মেয়েরা খুব সুন্দর কাজ-করা স্কার্ফ বাঁ-কাঁধে রাখেন কিন্তু সেখানে রঙের ব্যাপারে কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। খুব উজ্জ্বল রঙের এই পোষাক দেখতে ভারী সুন্দর। স্কুলে ও সরকারী অফিসে এই জাতীয়-পোষাক পরা বাধ্যতামূলক।
পরদিন সকালে আমাদের যাত্রা শুরু ৯০ কিমি দূরে ‘পারো’-র (৭২১৮ ফিট উচ্চতা) উদ্দেশ্যে। পাহাড়ি পথে আধ-ঘন্টা খানেক যেতেই গাড়ি থেমে গেল। সামনে বিশাল লম্বা গাড়ির সারি। কোনো এক উৎসবে যোগ দিতে প্রচুর লোক আসছে। সেই ভিড় পেরিয়ে যেতেই পেলাম অনেক ‘দাজা’ দিয়ে সাজানো সুন্দর এক মনাস্ট্রি। বৌদ্ধরা যে সাদা ও অন্য চারটি বিশেষ রঙ-এর চৌকোণা কাপড়ে মন্ত্র লিখে ও পবিত্র ছবি এঁকে সাধারণত পাহাড় বা মন্দির ইত্যাদি বিশেষ জায়গায় টাঙিয়ে রাখেন তাকে বলে ‘দাজা’ বা ‘প্রার্থনা পতাকা’ (Prayer Flag)। আমার স্বামী বললেন ‘দাজা নিশ্চয়ই ধ্বজার অপভ্রংশ’। পাঁচটি রঙ পাঁচ রকম প্রাকৃতিক শক্তির প্রতিভূ — সাদা (মেঘ), নীল (আকাশ), লাল (আগুন), সবুজ (জল) ও হলুদ (পৃথিবী)। দাজা কিন্তু ঈশ্বরের প্রতি নিবেদিত নয়, বরং পরিপার্শ্বে শান্তি, সহানুভূতি, জ্ঞান, প্রেম ইত্যাদি হাওয়ার মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য এই দাজা টাঙানো হয়। ভারী চমৎকার এই বিশ্বাস!
তিনদিকে পাহাড় দেখতে পাচ্ছি। হাওয়াও আস্তে আস্তে ঠান্ডা হচ্ছে। নিষ্পত্র গাছে পলাশের সমারোহ। গেদু নামে এক জায়গায় পাহাড়ের সামনে এক বিশাল সাদা বাড়ি যাতে নানারঙে মিনে করার মত দেওয়াল ও জানলা। সেটি হ’ল ইয়্যুনিভারসিটি অফ ভুটান-এর কলেজ অফ বিজনেস স্টাডিস্। চলতে চলতে পাশে দেখলাম লালপাতায় ভরা সঙ্গীহীন একটি গাছ। যতো উঠছি পাহাড়ি-গাছে-ভরা ঘন জঙ্গল দেখতে পাচ্ছি। আমাদের ওখানে যাবার কয়েকমাস আগে জেনেছিলাম যে ভুটানবাসীরা বর্তমান রাজা-রাণীর প্রথম সন্তানের জন্ম উদযাপন করেছেন ৮২০০০ গাছ লাগিয়ে। ওখানে গিয়ে জানলাম যে ভুটানের সংবিধান অনুযায়ী দেশের ৬০% অঞ্চলে গাছ থাকতে হবে। বর্তমানে দেশের ৭২% সবুজে ঢাকা তাই ইদানীংকালে যে কার্বন ফুটপ্রিন্ট নিয়ে সারা পৃথিবীতে তোলপাড় হ’চ্ছে ভুটানে তার মান ঋণাত্মক অর্থাৎ সেদেশের মানুষের কার্যকলাপে যতোখানি কার্বন-ডাই-অক্সাইড তৈরী হয় তার পরিবেশ তার থেকে বেশী কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ করতে পারে।
অনেক জায়গায় দেখছি পাহাড়ের খাঁজে কারুকার্য করা বড় বড়ির মতো জিনিস সার দিয়ে রাখা রয়েছে। প্রবীণ বললেন, ‘ওখানে বাতি জ্বালায়’। পরে জেনেছি যে একে বলে ‘সা সা’ (Tsa Tsa) যা হ’ল মন্ত্রপূত স্তূপ। সাধারণত, পূর্বপুরুষদের স্মরণ করে অথবা আত্মীয়-বন্ধুর মঙ্গলকামনা করে এই ‘সা সা’ উৎসর্গ করা হয়। তাই মূলত ধর্মীয় স্থানে — তা পবিত্র পাহাড় বা মন্দির হ’তে পারে — এই ‘সা সা’ দেখতে পাওয়া যায়।
যাহোক, পারোর বাজার এলাকায় পৌঁছতে পৌঁছতে বেলা গড়িয়ে গেল। দু’ধারে সুদৃশ্য এক বা দু’তলা বাড়ির অধিকাংশতেই রয়েছে নানারকম দোকান। রাস্তার ধারে সার দিয়ে দাঁড়ানো গাড়ি। আমরা ছোট এক রেস্তোঁরায় খেয়ে নিলাম। গুড়গুড়ে শিশুকে সামলে এক মহিলা দোকানী আমাদের লালচালের ভাত ও মুর্গীর মাংস পরিবেশন করলেন। তাঁর নিজের বাড়ির মধ্যেই রেস্তোঁরা বুঝতে পারলাম।
বসতি ছাড়িয়ে একটু দূরে এক্কেবারে নদীর ধারে আমাদের হোটেলটি। কাঠের বাড়ির দোতলায় আমাদের ঘরের মস্ত ‘বে উইন্ডো’ থেকে অনেকদূর অবধি পারোনদী দেখা যায়। পারো তো উপত্যকায়, তাই চারপাশে যে পাহাড় দেখা যাচ্ছে তাদের বিশেষ উঁচু বলে মনে হচ্ছে না। নদীর ধারে টিনের-চাল-দেওয়া কিছু একতলা বাড়িও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে আর রয়েছে ধানের খেত। এঁকে বেঁকে চলা এই পাহাড়ি নদীতে বেশ স্রোত আছে কিন্তু নদীটি খুব চওড়া নয়। পারে নুড়ি-পাথর ছড়ান আর তার দু’ধারেই রয়েছে পাকা রাস্তা। ওই রাস্তা ধরে বিকেলে আমরা ‘খিচু মনাস্ট্রি’ দেখতে বেরোলাম।
একটি লোহার পুল পেরিয়ে নদীর অন্যদিকে গিয়ে পেলাম ভুটানের সবথেকে পুরনো এই মনাস্ট্রিটি। পাশাপাশি দু’টি সুন্দর মন্দির। তার একটি সপ্তম শতাব্দীতে নির্মাণ করিয়েছিলেন তিব্বতের রাজা সংস্তেন গাম্পো ও অন্যটির নির্মাণকাল উনবিংশ শতাব্দী। দুটি মন্দিরেই নানারঙ দিয়ে কারুকাজ করা। উঠোনে আছে একসার ধর্মচক্র আর আছে ফলে ভরা এক কমলালেবুর গাছ। চেরি ব্লসম, ডালিম ছাড়া আরো নানারকম সুন্দর সুন্দর ফুলের গাছ রয়েছে মন্দির চত্বরে। অনেক পর্যটক ও লামা ওখানে রয়েছেন কিন্তু লামাদের ধর্মচক্র ঘোরাতে ঘোরাতে গুনগুনিয়ে মন্ত্র বলা ছাড়া কোথাও আর কোনো আওয়াজ নেই! আমরাও খানিকক্ষণ চুপচাপ মন্দিরের বাইরে ফুলে-ভরা গাছের পাশে বসে পাহাড়ের দিকে চেয়ে রইলাম।
সেখান থেকে ফিরে আমরা বাজারে কয়েকটি কিউরিও শপ-এ ঘুরলাম। প্রায় সব ক’টি দোকানেই বিক্রেতা মহিলা। নানারকম পাথরের ছোট-বড় মূর্তি, ধর্মচক্র, গয়না, ইত্যাদির সঙ্গে সব দোকানেই এক অভিনব জিনিস বিক্রি হচ্ছে। সেটি হ’ল কাঠ বা পাথরের তৈরি নানা মাপের ও রঙের পুরুষ-জননেন্দ্রিয় বা লিঙ্গ। ভুটানের মানুষের বিশ্বাস যে বাড়িতে এই লিঙ্গ রাখলে সবরকম অমঙ্গল দূরে থাকে ও পরিবারে সন্তান-জন্ম হয়! এক দোকানী আমাকে বললেন, ‘এ বিশ্বাস অনেকটা আপনাদের লেবু-লঙ্কা দিয়ে অশুভকে দূরে রাখবার চেষ্টার মতো।’ অনেক বাড়ির দেওয়ালেও ধার্মিক চিহ্ন পদ্ম, শঙ্খ বা চক্রের ছবির সঙ্গে এই লিঙ্গের ছবিও থাকে।
বাজারের কাছে এক বড় চত্বরে বিশাল একটি ধর্মচক্র ও এক আম্ফিথিয়েটার রয়েছে যেখানে নিয়মিত গানের অনুষ্ঠান হয়। বেশ ইওরোপিয়ান ধরনের এক কাফেতে চমৎকার কফি ও কেক খেয়ে হোটেলে ফিরতে ফিরতে অন্ধকার হয়ে গেল। তখন রোগা-পাতলা নদীর বয়ে চলার আওয়াজ আরো বেশী স্পষ্ট শোনা যাচ্ছিল। আস্তে আস্তে ঠান্ডাও বাড়ছিল তাই আমরা তাড়াতাড়ি জিরা আলু, ডাল ও চমৎকার হাল্কা পর্ক স্টু সহযোগে রাতের খাওয়া সেরে নিলাম।
পরদিন ভোরে পাহাড়-নদী-আকাশ মিলে জানালার বাইরে যে দৃশ্য তৈরী হয়েছে দেখলাম তাকে এক কথায় বলা যায় ‘স্বর্গীয়’! প্রাতরাশের পরে বেরোলাম ৩৬ কিমি দূরে ‘চেলে লা’ পাস দেখতে। পাহাড়ি পথে উঠতে শুরু করে নীচের উপত্যকায় এয়ারপোর্ট দেখতে পেলাম। একটু দাঁড়িয়ে দেখলাম সেখানে একটা প্লেনের ‘ল্যান্ডিং’। ঝাউ ইত্যাদি বড় বড় গাছের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে আমাদের রাস্তা আর তার পাশে ঘন ঘাসের মধ্যে কার্পেটের মতো ফুটে রয়েছে সুন্দর থোকা থোকা বেগুনী ফুল। মোটা মোটা পাতার মধ্যে থেকে বেরনো একটি করে ডাঁটির মাথায় ফুলগুলো ফুটেছে। এই ফুলের নাম হ’ল ড্রামস্টিক প্রিমরোজ (Drumstick Primrose)। খানিক বাদে পেলাম রাস্তার ধারে স্তূপ-স্তূপ জমাট বরফ। দেড়ঘন্টা লাগলো পাস অবধি যেতে।
নানা রঙের দাজায় ভরা ১২৪০২ ফিট উঁচুতে এই পাস ‘হা’ ও ‘পারো’ এই দুই উপত্যকার বিভাজক ও পরিষ্কার দিনে ওখান থেকে আশপাশের কয়েকটি পর্বতশৃঙ্গ খুব ভাল দেখা যায়। ‘হা ভ্যালি’ যাবার রাস্তা দেখলাম। মেঘলা দিন বলে পাহাড়-টাহাড় খুব ভাল দেখতে পাবো তেমন আশা ছিল না কিন্তু তেজে বয়ে চলা কনকনে ঠান্ডা হাওয়ার দাপটে একটু যে ঘুরে-ফিরে বেড়াবো তাও পারলাম না। হাওয়া থেকে বাঁচতে মিনিট দশেকের মধ্যেই গাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়লাম ও তড়িঘড়ি ফেরার পথ ধরলাম।
দুপুরে ছোট এক রেস্তোরাঁয় থুকপা ও মোমো খেলাম। তার মালিকের সঙ্গে একটু গল্পও হ’ল। ভদ্রলোক বললেন, ‘আপনাদের বোধহয় মনে হয় সব কিছু এখানে খুব ধীরে চলে কিন্তু এই আমাদের জীবনধারণের রীতি।’
বাজারে ‘পারো ফেস্টিভ্যাল’-এ যোগ দিতে প্রচুর স্থানীয় লোকের সমাবেশ হয়েছে। এ প্রসঙ্গে বলি ওদেশের জনসংখ্যার কথা। ২০১৭ সালের এক গণনা অনুযায়ী ভুটানের জনসংখ্যা ৭,৯৩,৯০৮ আর দেশের আয়তন হ’ল ৩৮,৩৯৪ স্কোয়ার কিমি। অর্থাৎ তার আয়তন কেরালার কাছাকাছি কিন্তু কেরালার বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় ৩৪০ লক্ষ!
আমরা চললাম ড্রুকইয়েল জ়ং (Drukyel Dzong) দেখতে। জ়ং মানে দুর্গ। সেই নদীর ধারের পাকা রাস্তা ধরে চলা শুরু আর তারপর পাহাড়ে ওঠা। আধঘন্টা পরেই পৌঁছলাম বিখ্যাত পারো তাক্তসাং (Paro Taktsang) বা টাইগারস্ নেস্ট (Tiger’s Nest) মনাস্ট্রির পাদদেশে। খাড়া পাহাড়ের গায়ে, পারো উপত্যকা থেকে আর প্রায় ৩,০০০ ফিট উঁচুতে থাকা মনাস্ট্রিটিকে দেখে মনে হয় যেন আঠা দিয়ে আটকে রাখা হয়েছে। বলা হয় যে গুরু রিনপোচে ওখানে এক গুহায় সাধনা করেছিলেন তাই এটি অত্যন্ত পবিত্র স্থান। শুনলাম যে অনেক সুন্দর পেন্টিং ইত্যাদি ওখানে আছে কিন্তু পাহাড়ি পথে হেঁটে ওখানে উঠতে ঘন্টা তিনেক লাগবে জেনে নিচ থেকেই তার শোভা দেখে এগিয়ে চললাম আরো মাইল দশেক দূরের জ়ং-টির দিকে। পাহাড়ের ওপরে অবস্থিত এই জ়ং-টি তৈরী করা হ’য়েছিল ১৬৪৬ সালে তিব্বতী হানাদারদের পরাজিত করার স্মারক হিশেবে কিন্তু ১৯৫১ সালে আগুনে পুড়ে তার আর কিছুই প্রায় বাকি নেই। সেখানে যাবার রাস্তা খুঁজে বের করতে আমাদের একটু সময় লাগলো। বেশ এবড়ো-খেবড়ো রাস্তায় অনেকদূর অবধি উঠলাম। পাথরে তৈরী কিছু দেওয়াল ও একটি তিনতলা সমান গম্বুজের পাশ দিয়ে উঠে একটা বড় প্রাচীর ঘেরা উঠোন ও তার একপ্রান্তে একটি বাড়ির ধ্বংসাবশেষ দেখতে পেলাম। তবে ওখান থেকে নীচের বসতি ও খেতগুলো দেখতে খুব ভাল লাগছিল। ঘন্টাখানেক পরে নেমে এসে জানলাম যে আমাদের গাড়ির টায়ার ফেটে গিয়েছে। এই নিয়ে আমাদের বেশ খানিক ভোগান্তি হ’ল তবে সেই সুযোগে পারোর সাদারঙের ট্যাক্সি চড়া হয়ে গেল।
পরদিন সকাল আটটায় যখন বেরোলাম আকাশ মেঘে ঢাকা ও তাপমাত্রা ২-৩ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। থিম্পু যেতে হবে গাড়ির টায়ার মেরামত করতে ও পুনাখা যাবার ‘পারমিট’ করাতে। এদেশে প্রতিটি শহরে ঢুকতে আলাদা ‘পারমিট’ লাগে। রাস্তায় তখন লোকজন বিশেষ নেই। সাদা রডোডেন্ড্রন-এ ভরা কয়েকটি গাছ দেখলাম। এখানকার বাড়িগুলোতে জানলার কাঠের ফ্রেমের কয়েক রং-এ চিত্রিত শিল্পকর্ম দেখবার মতো। শস্যহীন খেত, একটি হাইডেল পাওয়ার প্লান্ট, কাঠচেরাইয়ের কারখানা ইত্যাদির পাশ দিয়ে এসে ঠিক একঘন্টায় থিম্পুর ‘গেট’–এ এলাম।
শহরে ঢুকতেই চোখে পড়ল বিরাট এক কলস ও ৪-লেন রাস্তা। আর দেখলাম চার বা পাঁচতলা বাড়ি যার গায়ে শঙ্খ, চক্র, পদ্ম ইত্যাদি শুভ চিহ্ন আঁকা। এখানেও কাঠের ফ্রেমে রঙিন কাজ-করা জানালা এই বাড়িগুলোর শোভা বাড়িয়ে দিয়েছে আর দোকানে বা বাড়ির বাইরে টাঙানো আছে ওদেশের রাজা-রাণীর ছবি। চারদিকে উঁচু পাহাড় ও অনেক পাহাড়ের গায়েও রয়েছে ঘর-বাড়ি। এই শহরে ফ্লাইওভার রয়েছে আর দোকানপাটও বেশ চকচকে। রাস্তার একদিকে স্পোর্টস ট্রেনিং সেন্টার-এ কালো-পোশাক পরা ছেলেমেয়েরা অনুশীলন করছে আর অন্যদিকে রয়েছে ‘ইন্সটিট্যুট ফর হস্পিটালিটি ম্যানেজমেন্ট’। শহরের নানা জায়গায় কালো রঙের য়্যুনিফর্ম-পরা পুলিশদের দেখতে পেলাম।
আমরা প্রধান বাজার এলাকা ‘নর্জ়িন লাম’ ঘুরে ‘পারমিট’ নিতে গেলাম। শহরে কোনো ট্রাফিক লাইট নেই কিন্তু গাড়ির চালকরা খুব ভদ্রভাবে একজন আরেকজনকে জায়গা করে দিচ্ছে। খেয়াল করলাম যে ওখানে হর্ন বাজিয়ে হল্লা করে গাড়ি চালানোর রেওয়াজ নেই। ট্রাফিক সার্কেলে পুলিশ বিভিন্ন রকম নাচের ভঙ্গীতে হস্ত-সঞ্চালন করে গাড়ি সামলাচ্ছেন। প্রচুর ট্যাক্সি ছাড়া ঝকঝকে ও বড় সিটি বাস চলছে আর শহরটিও খুব পরিষ্কার। অনেকটা সময় লাগলো ‘পারমিট’ পেতে ও টায়ার সারাতে।
‘দোচুলা পাস’-এর ঐ চত্বরের একধারে এক রেস্তোঁরা ও তার পাশ দিয়ে উঠে গিয়েছে একটু ওপরে থাকা মনাস্ট্রি-র পথ। মনাস্ট্রিতে বিয়ে সেরে লামা-সমেত বর-কনে ও তাদের আত্মীয়রা রেস্তোঁরাটিতে খেতে এলেন। আশ্চর্য লাগল যে জাতীয় পোষাকের বদলে কনের পরনে সাদা গাউন ও বর পরেছেন স্যুট! কারণটা জানা হ’লনা তবে কাঁচের জানলা দিয়ে প্রকৃতির শোভা দেখতে দেখতে আমরা এলাহি এক কন্টিনেন্টাল বুফে লাঞ্চ খেলাম।
আবারো চলা। রাস্তার ধারে মাঝে মাঝে একদম নিষ্পত্র সাদাফুলে ভরা এক গাছ দেখতে পাচ্ছিলাম। একরকম বাঁদর দেখলাম যার মুখটা কালো ও মুখের চারধারে সাদা সাদা লোম। রাস্তা বেশ খারাপ। দেড় ঘন্টা লাগলো পুনাখা পৌঁছতে। অনেক জায়গায় পাহাড়ের গায়ে থাক কেটে চাষ হচ্ছে। এই উপত্যকাটি ধান উৎপাদনের জন্য ভুটানে বিখ্যাত। পারো বা থিম্পুর তুলনায় পুনাখার উচ্চতা কম (৪৪৩০ ফিট)।
আমাদের হোটেলটি এক পাহাড়ের ওপর। ভারি সুন্দর সাজানো। বাগানে গোলাপ-কামিনী-মর্নিং গ্লোরি ছাড়া অনেক অচেনা ফুলও রয়েছে। একপাশে রয়েছে একটি প্রদীপ ও ধর্মচক্র। সেই ফুলের হাটে চমৎকার বসবার ব্যবস্থা যেখান থেকে চারদিকের পাহাড়, নীচের উপত্যকা ও সেখানে বয়ে চলা এক নদী দেখা যায় আর শোনা যায় নানা ধরনের পাখির ডাক। চা-এর কাপ হাতে ওখানেই বসে থাকতে ইচ্ছে করছিল কিন্তু উঠতে হ’ল পুনাখা জ়ং দেখতে যাবার ডাকে।
পরদিন খুব ভোরে ওঠায় হোটেলের বারান্দা থেকে বুলবুল, টুনটুনি, দোয়েল ইত্যাদি পাখির মেলা দেখতে পেলাম আর শুনলাম তাদের নানাসুরের গান। পুনাখা ছেড়ে যাবার আগে আবার গিয়েছিলাম জ়ং-এ ঢোকবার আশা নিয়ে কিন্তু তখন শুনলাম অতো তাড়াতাড়ি জ়ং খোলে না। নিজেকে বললাম, ‘ঠিক আছে। আবার কোনোদিন এই অপূর্ণ সাধ মেটানোর জন্যই পুনাখা আসবো।’
নদীর ধারে সুন্দর এক পার্ক রয়েছে। আমরা সেখানে খানিকক্ষণ বসলাম। পার্কের গায়ের রাস্তা পার হ’লে ‘পুনাখা হাই স্কুল’ যেখানে ছেলেরা ও মেয়েরা এক সঙ্গে পড়াশুনো করে। উঁচু ক্লাসের কয়েকজন ছাত্রছাত্রী পার্কে একসঙ্গে বসে পড়াশুনো করছিল। আমি কখনো প্রাণভরে নদী ও তার বুকে জড়ানো জ়ং দেখছিলাম আর কখনো দেখছিলাম প্রকৃতির কোলে বেড়ে ওঠা ঐ উজ্জ্বল কিশোর-কিশোরীদের।
আবার থিম্পুর পথে চললাম। দিনটা পরিষ্কার, রাস্তার পাশে নানা রকম ফুল ফুটে আছে। ভেবেছিলাম মাত্র ৭২ কিমি দূরত্ব এইসব সুন্দর দৃশ্য দেখতে দেখতে পৌঁছে যাবো কিন্তু মাঝে মাঝে রাস্তা তৈরী হ’চ্ছে ব’লে ঝাঁকানির চোটে প্রাণ বেরিয়ে যাচ্ছিল। রয়্যাল বট্যানিকাল পার্ক-এর মধ্যে দিয়ে চলে আবার এলাম ‘দোচুলা পাস’-এ। এবারে অবশ্য অল্প সময়ের জন্য ওখানে থামলাম ও পাক-খাওয়া রাস্তা ধরে নেমে চল্লিশ মিনিটে থিম্পু পৌঁছলাম। ওখান থেকেও একাধিক পাহাড় দেখতে পাওয়া যায়। হোটেলের দিকে যেতে যেতে একটি পাহাড়ের ওপর বিশাল এক বুদ্ধমুর্তি দেখতে পেলাম। সেদিনই বিকেলে আমারা ঐ ‘বুদ্ধ পয়েন্ট’ নামে খ্যাত পাহাড়চূড়ায় গিয়েছিলাম। শহরে ঢুকেই যে অঞ্চলটি তার নাম ওলাখা। প্রচুর ঘরবাড়ি সেখানে কিন্তু আমাদের হোটেলটি শহরের আরেকটু ভেতরে এক নিরিবিলি জায়গায়। হোটেলের সামনের বসত-বাড়িটির দেওয়াল থেকে ঝুলছে মর্নিং গ্লোরি ও ম্যাজেন্টা রঙের এক রকমের অর্কিড। পাশের বাড়িটি রেডিও স্টেশন। তার বাইরের বোর্ড-এ লেখা ‘Please come in Formal Dress’.
থিম্পু যে শুধু ভুটানের রাজধানী তাই নয় দেশের একমাত্র শহর-ও। এক্কেবারে খাঁটি ট্যুরিস্টদের মতো হোটেলে মালপত্র রেখে ও লাঞ্চ করেই শহর দেখতে বেরিয়ে পড়লাম। শহরের রাস্তা যে বেশ চওড়া ও পরিষ্কার তা তো আগেই বলেছি। মাঝে মাঝে সুন্দর চিত্রিত তোরণ দেখছি — বোধহয় শহরের অঞ্চলগুলো চিহ্নিত করে তারা। আগেই বলেছি যে বেশিরভাগ বাড়িই ৪-৫ তলা ও কাঠের রঙিন জানলার বাহার ও দেওয়ালের পবিত্র ছবি বাদ দিলে বেশ সাদাসিধে। তবে এবার দেখলাম বেশ কিছু নতুন বহুতল বাড়িও আছে। শহর হ’লে কী হবে কোনো স্তূপ বা বিশেষ জায়গায় ‘দাজা’ রয়েছে।
সুন্দর বাঁধানো রাস্তা ধরে সাদা রঙের বিরাট স্তূপটির কাছে গেলাম। দুই ধাপে থাকা তার চূড়াটি দেখবার মতো। কয়েকধাপ সিঁড়ির পরে ঘোরানো বারান্দা ও তাতে চারদিকে চারটি বাহারি তোরণ। স্তূপটির পাশে বিরাট বিরাট ধর্মচক্র। সাধারণ মানুষ ও কয়েকজন লামা হাতে জপের মালা অথবা ধর্মচক্র নিয়ে ঘড়ির গতির দিকে বারবার স্তূপটি প্রদক্ষিণ করে চলেছেন। আমিও একবার প্রদক্ষিণ করে এসে একপাশে দাঁড়ালাম। আমার দৃষ্টি আপনা থেকে চলে যাচ্ছিল চারদিকের রাজকীয় পাহাড়গুলোর দিকে যদিও আমার সামনে দিয়ে চলেছিল ভক্তদের আনাগোনা। স্তূপের পাশে যে কয়েকটি লম্বা তক্তা রাখা আছে সেখানে কিছু স্ত্রী-পুরুষ ‘সূর্য নমস্কারে’ ব্যস্ত। সেই সময় সূর্যদেব বেশ তেজের সঙ্গে প্রকাশিত বলে একটা পাতলা সোয়েটারেই ঠান্ডা সামাল দেওয়া যাচ্ছিল। একটি ফুটফুটে শিশুকন্যাকে নিয়ে তার তরুণ বাবা আমার পাশ দিয়ে গেলেন স্তূপের দিকে। বাবা তো বটেই বছর দুয়েকের কন্যাটিও জাতীয় পোশাকে সজ্জিত! শিশুটিকে মনে হচ্ছিল একটি পুতুল।
আমাদের তালিকায় তারপর ছিল ‘টেক্সটাইল মার্কেট’-এ গিয়ে একটু কেনাকাটা করা। রাস্তার ধারে সার দিয়ে দোকান। সব দোকানেই বিক্রেতা মহিলা ও বেসাতি তাদের মোটামুটি একই — ওদেশের পোশাক, থাংকা (সূতি বা সিল্ক-এর কাপড়ের ওপর বুদ্ধের অথবা বৌদ্ধধর্মের কোনো দেবতার বা প্রতীক আঁকা), সোয়েটার, স্কার্ফ, সুতির চাদর, বাহারি ব্যাগ ও মুখোশ ইত্যাদি নানারকম স্যুভেনির। ওই মহিলারা সুন্দর ইংরিজি বলছিলেন। তবে ওদেশের অধিবাসীদের অভ্যাস অনুযায়ী এঁরা পান বা সুপুরি চিবোচ্ছিলেন। ভুটানে কাঁচা বা মাটির-নিচে-রাখা সুপুরি খাওয়ার চল আছে। কেউ তা শুধুই খায় আর কেউ খায় পান-চুনের সঙ্গে। ফার্মেন্টেড সুপুরির গন্ধটা বেশ অস্বস্তিকর তবে কোথাও কাউকে যেখানে-সেখানে থুতু ফেলতে দেখিনি।
পরদিন সকালে গেলাম ‘টাকিন সংরক্ষণালয়’ দেখতে। টাকিন হ’ল ভুটানের জাতীয় পশু ও যাকে দেখলে মনে হয় সুকুমার রায়ের কল্পনাকে মনে রেখে এই প্রাণীটিকে সৃষ্টি করা হয়েছে। মুখটা তার ছাগলের মতো ও শরীরটা বাছুরের মতো আর গায়ের রঙ কালো। দেশের চতুর্থ রাজা যখন কোনো প্রাণীকে আটকে রাখা বৌদ্ধধর্মের পরিপন্থী বলে ‘টাকিন চিড়িয়াখানা’ বন্ধ করে তাদের জঙ্গলে ছেড়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন, এই নিরীহ প্রাণীরা ততোদিনে এতোটাই গৃহপালিত হয়ে গিয়েছিল যে তারা খাবারের খোঁজে শহরের এদিক-ওদিক ঘুরতে শুরু করল। তখন, থিম্পুর একটু বাইরে মোতিথাং অঞ্চলে পাহাড়ের ওপর প্রচুর গাছপালার মধ্যে জালে-ঘেরা এক বিরাট খোলা জায়গায় এই সংরক্ষণালয়ে তাদের রাখা হয়। থিম্পু থেকে সুন্দর রাস্তা ধরে জনবসতির মধ্যে দিয়ে পাহাড়ের নিচে পৌঁছলাম। টাকিন দেখবো বলে পাহাড় বেয়ে অনেকটা হেঁটে উঠলাম কিন্তু জালের ওপারে থাকা শ্রীরূপ খুব যে ভালো দেখতে পেলাম তা বলতে পারি না।
একটু হতাশ হয়েই এবারে চললাম থাংতং দেওয়াচেন দুপ্থপ নানারি (Thangtong Dewachen Dupthop Nunnery) দেখতে। পঞ্চদশ শতাব্দীর এক বিখ্যাত বৌদ্ধ সন্ন্যাসী থাংতং জিয়ালপো যিনি ভুটান ও তিব্বত অঞ্চলে বৌদ্ধ স্তূপ ও পাহাড়ি নদীর ওপর লোহার ব্রিজ (যার ৫৮ টি এখনো টিঁকে আছে) নির্মাণ ও তিব্বতীয় অপেরার সূচনা করেন, তাঁর স্মৃতিতে এটি তৈরি।
থিম্পুর জ়িলুখা অঞ্চলে এক পাহাড়ের ওপরে এসে আমরা গাড়ি থেকে নামলাম কারণ একটু চড়াই পথে হেঁটে মঠে পৌঁছতে হবে। একটু এগোতেই দেখি ন্যাড়ামাথা ও মেরুন কাষায়-বস্ত্র পরা ৪-৫টি কিশোরী সন্ন্যাসিনী রাস্তার ধারে কোদাল দিয়ে মাটি কেটে জল নামার রাস্তা পরিষ্কার করছে আর সঙ্গে কলকল করে গল্প করছে। আমরা তাদের পাশ দিয়ে যাবার সময় একটি মেয়ে হঠাৎ পা দিয়ে একটা ফ্রুট জুসের প্যাকেট চাপলো ও তার থেকে জুস এসে ছিটকে লাগল আমার গায়ে। এমন ঘটনায় যে কোন বাচ্চার মতোই গোড়ায় মেয়েটি একটু মজাই পেয়েছিল কিন্তু তারপর আমার থেমে গিয়ে স্থিরদৃষ্টিতে তার দিকে তাকানো ও একইসঙ্গে মঠের দিক থেকে দু’জন বয়স্ক সন্ন্যাসিনীর আবির্ভাব তাকে স্পষ্টতই বেশ বিচলিত করে দিল। অন্যরা কাজ ফেলে কী-হয় দেখতে চুপ করে দাঁড়িয়ে গেল আর সেই মেয়েটি হাতজোড় করে নিজের ভাষায় আমাকে কিছু বলতে লাগল। তার ঐ মুখখানা দেখে না হেসে পারলাম না আর আমার হাসি দেখে মেয়েটিরও স্বস্তি হ’ল। কিছুই যেন হয়নি এমন ভাব করে বড়রা পৌঁছনোর আগেই তারা নিজেদের কাজে ফিরে গেল আর আমরা ওপরে চললাম।
ঠিক দরজা নয় কিন্তু খিলানওয়ালা বাহারি স্তম্ভ পার হয়ে মঠে ঢুকলাম। ছোট্ট একটুখানি খোলা জায়গার মাঝখানে একটি স্তম্ভ যার মাথায় দু’টি হরিণ তাদের মধ্যে থাকা একটি চক্রের দিকে মাথা তুলে আছে। সেই উঠোন ঘিরে আড়ম্বরহীন উপাসনাগৃহ, ধর্মচক্রের সারি ও সন্ন্যাসিনীদের বাসগৃহ। খুব ছোট জায়গা কিন্তু শুনলাম যে ঐ মঠে ভিন্ন বয়সের ৬০ জন সন্ন্যাসিনী থাকেন! নিজের মনে সব ক’টি ধর্মচক্র ঘুরিয়ে পরিক্রমা শেষ করলাম আর ভাবছিলাম পরিবারের থেকে দূরে আসা এই মেয়েদের জীবনকাহিনী যদি জানা যেতো!
ফেরার সময় গাড়িতে ওঠার আগে থেমে গেলাম নিচের দৃশ্য দেখে। ধাপে ধাপে চাষের জমি নেমে গিয়ে ওয়াং ছু নদীর পশ্চিম পারে যে উপত্যকায় পৌঁছেছে সেখানে গাছপালার মধ্যে একটি চমৎকার প্রাসাদ। ম্যাপ দেখে জানলাম যে এই হ’ল বিখ্যাত তাশিছো জ়ং (Tashichho Dzong)। আদতে এটি ছিল মনাস্ট্রি এবং দূর্গ কিন্তু ১৯৫২ সাল থেকে হয়েছে ভুটান সরকারের শাসনব্যবস্থার কেন্দ্রস্থল (সেক্রেটারিয়েট বিল্ডিং) ও বৌদ্ধ-সন্ন্যাসীদের গ্রীষ্মকালীন আবাস। বিকেলে অফিস ছুটির আগে তো ওখানে ঢুকতে দেবে না তাই আমরা আবার শহরের দিকে চললাম।
যে কোনো নতুন জায়গায় গেলে সেখানকার বাজার দেখলে নাকি তার চরিত্র সম্বন্ধে ধারণা হয়। তাই এবার গেলাম থিম্পুর সপ্তাহান্তের হাট দেখতে। সেখানে নানারকম শাক-সব্জী-ফল ছাড়া মাংসও বিক্রি হয়। একটি দোকানের একধারে স্তূপ করে রাখা রয়েছে বড়-বড় সসেজ্ যা দেখে লোহার শিকল বলে মনে হচ্ছিল। শখ করে খানিকটা চীজ কিনলাম কিন্তু এমন চড়া গন্ধ তার যে খেতে পারলাম না।
বাজারের পাশে রয়েছে ১৯৯০ সালে তৈরী জ়াংথোপেলরি লাখাং (Zangthopelri Lakhang) যার গায়ের কাঠের কাজ ও তার ওপরকার রঙিন চিত্র দেখবার মতো। সেখানকার উঠোনে রাখা আছে বিশাল বিশাল ধর্মচক্র কিন্তু মূল মন্দিরে দেখি তালা দেওয়া রয়েছে। অনেক বলে-কয়ে সেই তালা খুলিয়ে ভেতরে গেলাম। তখন মনে হ’ল ভাগ্যিস তালা দেখে ফিরে যাইনি। ভেতরে ৪ মিটার উঁচু কয়েকটি মূর্তি — তাতে রাজা ও কয়েকজন বৌদ্ধগুরু ছাড়া বুদ্ধদেবের মূর্তি আছে আর আছে চমৎকার কিছু পেন্টিং। সব মিলিয়ে খুব শান্তির পরিবেশ।
আমরা শুনে গিয়েছিলাম যে ভুটানের খাবার খুব ঝাল ও ওখানকার অন্যতম প্রিয় পদ হ’ল ‘এমা দাত্শি’ যা হ’ল চীজ সসে (দাত্শি) সেদ্ধ করা চেরা কাঁচালঙ্কা (এমা)। আমাদের কখনোই ওখানকার খাবার অতিরিক্ত ঝাল বলে মনে হয়নি। তবে যেহেতু ‘এমা দাত্শি’ পাতে নেবার সাহস ছিল না তাই সেদিন দুপুরে আমরা ফ্রায়েড রাইস ও মোমোর সঙ্গে ‘সাগ্ দাত্শি’ নিলাম। চীজ সসে সেদ্ধ করা সর্ষে শাকের এই পদটি আমাদের রীতিমতো উপাদেয় লাগল।
বিকেলে তাশিছো জ়ং-এ ঢুকতেই আমরা মন কাড়ল তার অপূর্ব ফুলের বাগান ও লন। সাদা চুনকাম করা জ়ং-এর প্রধান অংশটি দোতলা আর প্রধান টাওয়ারটির ও তার চার কোণায় থাকা তিনতলা টাওয়ারগুলির ছাদের রঙ লাল কিন্তু তার ওপর রয়েছে আরো দুটি ছোট সোনালি ছাদ ও সোনালি চূড়া। এখানেও জানলার বাইরে কাঠের কাজের ওপর রঙের বৈচিত্র্য। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে প্রতিষ্ঠিত যে জ়ং-টি মূলে এখানে ছিল সেটি বারবার আগুনে পুড়েছে কিন্তু বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা প্রতিবার তার পুনর্নির্মাণ করেছেন। ১৯৬২ সালে থিম্পুতে যখন রাজধানী নিয়ে আসা হ’ল, তৃতীয় রাজা জিগমি দোরজি ওয়াংচক এই জ়ং-টির পুনর্নির্মাণ করান। ১৯৬৮ সাল থেকে তাই দেশের সরকারী কাজকর্ম হয় এখান থেকেই। আগের জ়ং-এর কয়েকটি মন্দির সহ বেশ কয়েকটি মন্দির ও প্রার্থনাগৃহ এখানে আছে। আর আছে রাজার সিংহাসন ও তাঁর দফতর।
প্রাসাদের সামনের অংশের বিশাল উঁচু উঁচু অনেকধাপ সিঁড়ি পেরিয়ে লম্বা লাইনে দাঁড়াতে হ’ল সিক্যুরিটি চেকের জন্য। ভেতরে ঢুকে সামনেই বিশাল চত্বর। সব মন্দিরে ঢোকা যায় না। প্রাসাদের গায়ের নানাধরনের শিল্পকর্মের সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে ইতস্তত এদিক-ওদিক ঘুরলাম। বেরোতে বেরোতে সন্ধে হয়ে গেল আর সেই সময় জ্বলে উঠল জ়ং-এর লাল-হলুদ আলো। এতো সুন্দর লাগছিল দেখতে যে আমরা আবার পাহাড়ি রাস্তায় উঠে গিয়ে সেই আলোকমালায় সাজানো তাশিছো জ়ং-এর রূপ দেখলাম অনেকক্ষণ ধরে।
পরদিন সকালে ভুটান ছাড়ার প্রস্তুতি শুরু হ’ল। এতো কম সময়ে তো কোনো দেশ দেখা সম্পূর্ণ হয় না তাই ফেরার সময় সেই অপূর্ণতাবোধ সামান্য পীড়া দিচ্ছিল। কিন্তু তখনই মনে হ’ল যে অংশমাত্র হ’লেও এই সুযোগে দেখলাম এক তুলনাহীন দেশ যেখানে ধর্ম ও রাজনীতি একসঙ্গে মিলে দেশের উন্নতি ও দেশবাসীর কল্যাণে ব্রতী। অনেক ব্যাপারে দেশটি আধুনিক কিন্তু দেশবাসীর মূল বিশ্বাসের ভিত্তি বুদ্ধদেবের শিক্ষা। এবারে তাই ‘ঝাঁকি দর্শন’-এই সন্তুষ্ট হয়ে ফেরার পথ ধরলাম।