• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৬৮ | সেপ্টেম্বর ২০১৭ | ভ্রমণকাহিনি, প্রকৃতি, বাকিসব
    Share
  • নমি নরদেবতারে : নিবেদিতা দত্ত

    দেশ ধরা দেয় তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে, তার দ্রষ্টব্য স্থানে, না এক ঝিলিক হাসিমাখা আন্তরিকতায়--এই দোটানাই মনে ঘুরে ফিরে এসেছে ভুটানে বেড়াতে গিয়ে।

    সে দেশ তো নিজেই নিজের তুলনা। সবজে ছাই রঙা পাহাড় বেয়ে নেমে আসা হাল্কা ছেয়ে মেঘের দল, পুণ্যতোয়া ছোট ছোট সব নদী, গাঢ় মেরুন ভিক্ষু পোশাকে সদ্যসন্ন্যাসে অনভ্যস্ত ক্ষুদে ক্ষুদে শিশুদের স্নানের নামে খেলা, সোনা-রঙা বুদ্ধমুর্তি--সিল্ক জরির টেপেস্ট্রীতে মোড়া জং বা দূর্গ মন্দির, গোলাপী চেরীফুলে সাজা পাহাড়ি পথ--

    মন ভোলাতে এর চেয়ে বেশি আর কি চাই? বিশেষ যখন এমন এক শহর থেকে গিয়েছি যেখানে শব্দদানবকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বেঁচে যে আছি সেটাই সাহসিকতার পরিচয়। হঠাৎ বেপরোয়া তীব্র হর্ন ঝাঁঝিয়ে বেরিয়ে যাওয়া মোটরবাইকের আস্ফালন সে শহরে নিয়মের মধ্যেই পড়ে গেছে আর পথচারী দেখলে গাড়ির স্পিড বাড়িয়ে দেওয়া, সে তো আছেই। আশপাশ থেকে ভেসে আসা টিভি, এফ এম-এর শব্দ ডেসিবল কানের ভিতর দিয়ে মস্তিষ্ক বোবা করে দেয় এমনিই যে সংগীতকেও মনে হয় আর এক দূষণ। আর যদি বলি এসব ভুলতে চাই তাহলে পপকর্ন হাতে আইনক্সে মুভি দেখা হাতের পাঁচ একমাত্র পথ।

    এমনি এক শহর থেকে ভুটান যাওয়া তো ভিক্ষুর রাজদর্শনের মতই হতবাক করা। রাজ সকাশে গিয়ে বৈভব দেখে ভিখারি যেমন ‘কি চাইব’ ভুলে যায় তেমনিই দশা হয়েছিল আমার। মনে হয়েছিল নাই বা সব ট্যুরিস্ট স্পটগুলো দেখা হয়ে উঠল, হোটেলের বে উইন্ডো সীটে এলিয়ে পাহাড়ের সাথে মেঘের লুকোচুরি দেখে কাটিয়ে দিলেও তো সাত রাজার ধন পাওয়া হয়ে যায়। মজার কথা এই যে নৈঃশব্দ্যের ব্যক্তিত্ব ভুটান গিয়েই উপলব্ধি করেছি। সার দিয়ে গাড়ি চলেছে, শব্দহীন, যেন হঠাৎ বলা নেই, কওয়া নেই চ্যাপলিনের নির্বাক ছবিতে ঢুকে পড়েছি সশরীরে। তাতে তবু ব্যাকগ্রাউণ্ড মিউজিক আছে, এখানে তাও না।

    শব্দহীনতার প্রশান্তি এইভাবে আগে কখনো অনুভূত হয়নি। এক একটি সকালে বাঁধা-পড়া মনের শিকলের গাঁট একটি একটি করে খুলে গিয়েছিল। খাঁচায় ডানা ঝাপটানো সেই যে মনে হওয়া ‘The world is too much with us--- ‘কখন অজান্তে টুপ করে মিলিয়ে গিয়েছিল এক ম্যাজিক প্রলেপে।

    তাই যদি হয় শেষ কথা তাহলে তো আর কিছু বাকি থাকে না। কিন্তু ছিল, বাকি ছিল। সর্বত্রই চোখে পড়েছে দারিদ্র মাখানো হাসিমুখের স্বাভিমান। হোটেলের বেশিরভাগ মেয়েরাই দূর গ্রাম থেকে আসা। কোনোমতে স্কুলের গণ্ডী ডিঙিয়ে হোটেলের ফাই ফরমাশ খাটছে। সবার মুখেই এক কথা--অনেক দূরে ঘর, বাড়ীতে অনেকজন, এই চাকরি তাই মূল্যবান। যত্নের ত্রুটি ছিল না তাদের, ফুটফুটে সব মেয়ে, হাল্কা চেহারায় দমে ছোটাছুটি করা দেখে অবাক লেগেছে আমার।

    আরও কত ছোট ছোট ছবি মনে জায়গা করে নিয়েছে। বৌদ্ধ গুরু দ্রুপকার স্মৃতিসৌধ পথে কাঁচা কচি হাতে আঁকা ছবির পসরা নিয়ে ধুলোয় বসে থাকা দুই যমজ বোন তুয়া আর নিমা ওয়াংমো ও তাদের ক্ষুদে ভাই কুসি, গুটিকয়েক তরুণীর আত্মাভিমান মাখা আন্তরিকতা, এক অতি সাধারণ ট্যুরিস্ট কার ড্রাইভারের আপনাপন, এক বেকারি মালকিনের উদারতা; — বার বার মনে করিয়েছে রূপসাগরের মনের মানুষ বোধহয় এমনি হয়। বাউল তো গেয়েই গেছেন ‘রূপসাগরের মনের মানুষ কাঁচা সোনা’ তারা ছোঁয়া দেয়, তাদের চিরকালের জন্য ধরে রাখা যায় না।

    বিমানে বসে থাকাকালীনই ভুটানের ন্যাশনাল পোশাক পরিহিতা হোস্টেসরা চোখ ও মন দুইই টেনেছিল। পোশাকে এক অনবদ্য রাজকীয়তা ও আধুনিকতার মেলবন্ধন পেয়েছিলাম। পরে জেনেছিলাম ড্রেস সেটটির নাম তেগো ও কিরা। তেগো হল পরপর উপরে পরার দুটি সিল্ক বা সাটিনের ঢোলা ব্লাউজ আর কিরা এক ধরনের লেপ্টে পরা লং স্কার্ট। ব্লাউজ দুটি কনট্রাস্ট রঙের হয় যেমন সবুজ ও কমলা, গাঢ় নীল ও মেরুন বা রুপোলি ও ব্রাউন। আমার মনে হয়েছিল প্রায় সারা পৃথিবীর পোশাকই তো আমরা বাঙালিরা পরে থাকি, ভুটানি পোশাক পরলে কেমন হয়! কিন্তু ট্যুরিস্ট হয়ে গেছি সে দেশে, দরদাম কিছুই বুঝছি না। যাকেই পাচ্ছি জিঞ্জাসা করছি, ঠিক মনের মত হচ্ছে না। এমনি এক পরিস্থিতিতে থিম্পু হোটেল সংলগ্ন উঠান দিয়ে দুটি মেয়েকে যেতে দেখে তাদেরই ধরে ফেললাম। ‘তোমরা এই যে পোশাক পরেছ কোথা থেকে কিনেছ, আমি কিনতে চাই,’ ইত্যাদি বলাতে তারা স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে বললে ‘ম্যাডাম আমরা সাহায্য করব, তুমি এসো না দোকানে, ট্যুরিস্ট দেখলে দাম বাড়তে পারে।’ সেইমতোই কথা হল। কিন্তু কতটা আন্তরিকতা দিয়ে পুরো ব্যাপারটা ওরা সামলালো দেখে অভিভূত হলাম। মোবাইলে পোশাকের ছবি তুলে আমাকে দেখিয়ে গিয়ে দরদাম করে তারা আমাকে নিয়ে গেল দোকানে, কেনাকাটার পর তার ফিটিংসও হয়ে গেল এক বেলার মধ্যে। আমরা সাধারণত সাহায্যের বদলে অর্থই এগিয়ে দিই; আমিও তাই করলাম কিন্তু তারা তা নিতে অস্বীকার করলে যদিও প্রথম পরিচয়েই তারা বলেছিল অর্থাভাবে স্কুলের গণ্ডী ডিঙিয়ে ওরা চাকরির চেষ্টায় আছে। এ-হেন স্বাভিমান আমি এর আগে দেখিনি। ওদের এই মনকে কুর্নিশ করে ভাবলাম অন্তত মধুরেণ সমাপেয় তো করা যেতেই পারে। কিন্তু অনেক আঁতিপাতি খুঁজেও মিষ্টির দোকান চোখে পড়ল না। ভুটানে এমনিতেই চা খাবারে নুন চিনির ব্যবহা্র খুবই পরিমিত। শেষে আইস্‌ক্রিম পাওয়া যেতে, ওরা চারজন, আমরা তিন এক সাথে মিষ্টিমুখ করে যে যার বাড়ি ফিরলাম--ওরা ঘরে, আমরা হোটেলে। ওরা যেভাবে আমাকে সাহায্য করেছিল তা আশ্চর্যের আরও এই জন্য যে ট্যুরিস্ট দেখলে সাধারণত কেউই তেমন সততার ধার ধারে না। তখন মনে হয় যতটা গুছিয়ে নেওয়া যায়, মওকা তো এই একটাই। কিন্তু সেসবের ধার দিয়েও মেয়েগুলি যায়নি। যাবার সময় বলেছিল ‘যখন তোমায় জানতাম না তখন একরকম ছিলাম, আজ চেনা হয়ে তোমার অভাব বার বার মনে হবে।’

    এমনি আর একজনের মুখ মনে আঁকা হয়ে গেছে। হোটেলের সুন্দর জানলার ধারে বসে কেক পেস্ট্রি দিয়ে চা ভারি লোভের ব্যপার হয়েছিল আমাদের কাছে। বিস্কেট মুখে রুচতই না।

    কেকের সন্ধানেই একদিন পুনাখায় এক পেস্ট্রি শপে পৌঁছে যাই ভরদুপুরে। দোকানের মালকিন ঝাড়াঝাড়ি করে সবে দোকান খুলছেন। পেস্ট্রি চাইতে বেছে বেছে সবচেয়ে টাটকাগুলোই দিলেন আর না চাইতে সদ্য বেক করা দুটো বান রুটিও উপহার দিয়ে বললেন ‘এক মাম্মা অউর এক পাপ্পাকে লিয়ে।’ বুঝতে না পেরে মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকতে বললেন ‘বান দুটো তোমাদের দুজনের জন্য।’ — এমন বিক্রিবাটা এর আগে কখনও দেখেছি বলে তো মনে পড়ল না। যাইহোক ব্যবসা যাই করুন, মনে তো জায়গা করেই নিলেন ভদ্রমহিলা।

    বাইশ-তেইশ বছরের উগেন দোরজির কথা না লিখলে অধুরাই থেকে যাবে লেখা। আমাদের প্রায় পুরো ট্রিপের (একদিন বাদে) গাড়ির ড্রাইভার উগেন। যা দেখার তা সবই দেখিয়েছিল ও, কিন্তু ওকে মনে আছে আরও অন্য কারণে। মনের চোখে ওকে দেখছি — অবিশ্রান্ত বৃষ্টিতে স্টিয়ারিং ধরে বসে আছে, টাইগারস নেস্ট দেখাবেই দেখাবে। দূরে মেঘে ঢাকা নেস্ট, নীচে, অনেক নীচে আমরা, পাশে উগেন, কথা দিয়েছে দেখাবেই মঠ, — প্রায় চল্লিশ মিনিট পর মেঘ সরল, দেখলাম তাক সাঙ।

    যেদিন চলে যাব উগেন এয়ারপোর্টে ছাড়তে এসেছিল। হঠাৎ বলে ‘তোমাদের ফ্লাইট নাম্বারটা দাও।’ আমরা বেশ হকচকিয়ে গিয়ে ইতস্তত করাতে ও বুঝিয়ে বলে ‘হোটেল ছেড়ে দিয়েছ, যদি ফ্লাইট ছাড়তে দেরী হয়, ফ্লাইট ক্যান্সেল হয়, তাই আমি আর আজ থিম্পু ফিরব না, পারোতেই থাকব, দরকার হলে কল করো, টাকা দিয়ে না পারি, থাকার ব্যবস্থা করে দেব।’ মুহূর্তে কেমন হয়ে গেলাম, বিদেশে এমন আপন কেউ হয় নাকি! স্বদেশেই তো এমন নজির দেখি না। ঝট করে ভালবাসতে নেই, অপরিচিতকে তো নয়ই। কিন্তু কে যে আপন কে পর তা বোধহয় মাঝে মধ্যে ভাবায়। ওই দূর দেশের, আর কোনোদিনও দেখা হবে না মানুষগুলো কিন্তু আমার মনে নিজেদের আসন পাকা করেই নিল।

    এত নূতনকে জানার আনন্দের মাঝে হরিষে বিষাদের মত জেগে আছে ছ-সাত বছরের ক্ষুদে সন্ন্যাসীর দল। কেউ খালি জলের বোতল নিয়ে খেলছে, কেউ মন্দিরের চৌকাঠে বসে খাচ্ছে কুরকুরে, কুতূহলে চেয়ে আছে আমাদের দিকে। আমার তো বার বার মনে হচ্ছিল শিশু তো দেশের ভবিষ্যৎ, তারা লড়ে গড়ে তুলবে তাদের দেশ। দুঃখময় ধরা স্বীকার করি, কিন্তু সংসারে থেকেও তো কাঁটার পাশ ফুল ফোটানো যেতে পারে, বুদ্ধমূর্তি, পুঁথি রক্ষার জন্য ওরা কেন? একি দেবতার প্রস্তরবেদীতে জীবনের বলিদান নয়? কিন্তু আবহমান কাল থেকে তো তাই হয়ে এসেছে--ধন সম্পত্তি রক্ষার জন্য শিশুই হয়েছে যখ, ইনকা, মায়া যুগে শিশুকে পবিত্র মনে করে দেওয়ানো হয়েছে বলিদান।

    এ মতামত সবার গ্রহণযোগ্য নাও হতে পারে, কিন্তু নিজে মা হওয়ার দরুনই বোধহয় শিশুকে তার পিতামাতার থেকে আলাদা করার ব্যাপারটা আমার ভাল লাগেনি। এই প্রসঙ্গে অনেক আগে পড়া কিছু অংশ মনে পড়ে গেল। বইটির নাম ‘দ্য রেনবো’। লেখক লরেন্স শিশু আনা সম্বন্ধে লিখছেন ‘She looked from one to the other, and she saw them established to her safety, and she was free. She played between the pillar of fire and the pillar of cloud in confidence having the assurance on her right hand and the assurance on her left---Her father and her mother now met to the span of the heavens, and she, the child, was free to play in the space beneath, between.’ (‘The Rainbow’- chapter 3, childhood of Anna Lensky, page 97, Penguin edition) পিতা মাতার এই আর্চ হয়ে দাঁড়ানো শিশুকে পরবর্তী জীবনে নির্ভীক করে তোলে বলে মনে করি।

    শেষ করব অবশ্য খানিক কৌতুকের মাঝে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ যে বিশ্বকবি তার প্রমাণ পেয়েছিলাম বেশ নূতন ভাবে। এক ট্যুরিস্টের নাম রবীন্দ্রনাথ শুনে ভুটান এয়ারপোর্ট অথরিটির এক মহিলা অফিসর কাগজপত্র মিলিয়ে চোখ তুলে বেশ গম্ভীরভাবে বললেন ‘আপনি রবীন্দ্রনাথ টেগোর দত্ত?’-- পদবীশুদ্ধ কবির পুরো নামের এ-হেন প্রয়োগ আগে কখনো কানে আসেনি। এমনিই কিছু টকমিষ্টি, ঈষৎ বিষণ্ণতা মাখনো অভিজ্ঞতায় ভরপূর হয়ে রইল আমাদের ভুটান বেড়ানো।




    অলংকরণ (Artwork) : ছবিঃ লেখক
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments