ছবির দেশে কবিতার দেশে; সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়; প্রথম প্রকাশ: জানুয়ারি ১৯৯১; আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা, প্রচ্ছদ- পূর্ণেন্দু পত্রী; পৃষ্ঠাঃ ২৬৬; ISBN: 81-7066-963-3
প্যারিসে বেড়াতে যাবার কথাবার্তা চলছিল, তারই প্রস্তুতিতে স্থানীয় লাইব্রেরি থেকে ধার চেয়ে আনলাম সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের জনপ্রিয় গ্রন্থ “ছবির দেশে কবিতার দেশে” (পঞ্চম মুদ্রণ, ১৯৯৭; আনন্দ পাবলিশার্স) — অনেকের মুখে প্রশংসা শুনেছি বইটির। ধূলিজ্যাকেটের ভেতরের অংশে একদিকে গ্রন্থটির কথা, অন্যদিকে লেখকের। গ্রন্থটির কথা শেষ হয়েছে এইভাবে — “এ-গ্রন্থের প্রতিটি অধ্যায়ের শুরুতে রয়েছে বিখ্যাত একেকজন ফরাসি কবির কবিতা থেকে উদ্ধৃতি। এই অনুবাদের কাজে গদ্যলেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সহযোগী হয়েছেন কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়”। ভাল কথা। প্রবাদপ্রতিম “অন্যদেশের কবিতা”র রচয়িতা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের অনুবাদ কবিতাগুলিও সাবলীল, সতেজ ও সুপাঠ্য। তাই প্রথমেই পাতা ওলটাতে শুরু করি ফরাসি কবিতাগুলির অনুবাদ উপভোগ করবো বলে; এবং তার সাধও কিছুটা মেটে। কিন্তু অষ্টম অধ্যায়ের শুরুতে অ্যালেন গিনসবার্গের (১৯২৬ - ৯৭) কবিতা — তিনি আদ্যোপান্ত মার্কিন কবি — ফরাসি কবিতার সঙ্গে যোজন দূরত্ব। যদিও অধ্যায়টি গিনসবার্গ সংক্রান্ত এবং কবিতাটি তার সঙ্গে প্রাসঙ্গিক, ধূলিজ্যাকেটের বর্ণনাটি যিনি লিখেছেন তাঁর পুরোপুরি চোখ এড়িয়ে গেছে।
ষোড়শ অধ্যায়ের শুরুতেও আরেকটি ভুল, যদিও তুলনামূলক ভাবে অনেকটা কম অপরাধের — সেখানে লেওপোল্ড সেঙ্ঘরের (১৯০৬ - ২০১১) কবিতা। যদিও তাঁর জীবনের অনেক বছর কেটেছে ফ্রান্সে, কবিতাও লেখেন ফরাসি ভাষায় এবং শেষ নি:শ্বাসও ফেলেছেন ফ্রান্সে ২০ ডিসেম্বর ২০০১, সেঙ্ঘর সেনেগালের মানুষ এবং আফ্রিকান স্বাধীনতা-সংগ্রামী ও কবি। তিনি দীর্ঘ ২১ বছর ধরে (১৯৬০ - ৮১) সেনেগালের রাষ্ট্রপতির পদেও ছিলেন। তিনি অনেকবার অকপটে জানিয়েছেন, যদিও বোদলেয়ারের কবিতা দ্বারা তিনি অনুপ্রাণিত, বিষয়বস্তু ও শৈলির দিক থেকে তিনি পুরোপুরি আফ্রিকান কবি, ফরাসি কবি নন। ১৯৯১ সালে একটি সাক্ষাৎকারে, তিনি বলেছিলেন, “In my poetry, I certainly express my personal life, but I express myself as a black man, an African.” অতএব তিনি নিজেও অসন্তুষ্ট হতেন তাঁকে ফরাসি কবি বলা চলে।
ধূলিজ্যাকেটের পেছনের ফ্ল্যাপে লেখক পরিচয় — সেখানেও উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে। লেখক পরিচয়টি “সেই সময়” উপন্যাসের লেখক পরিচয় থেকে হুবহু টোকা — ফলে “নদী” রচনা লিখতে গিয়ে “গরু” রচনা লেখার মতন দাঁড়িয়েছে। প্রকাশনা সংস্থার যিনি বুক এডিটর, তাঁর উচিত ছিল বই প্রেসে যাবার আগে এই ভুলগুলি ধরে ফেলা।
যাই হোক মলাট পেরিয়ে এবার বইয়ের ভেতরে ঢোকা যাক। দ্বাদশ অধ্যায়ে দামী, অভিজাত ফরাসি রেস্তোরাঁয় ডিনার খাওয়ার গল্প — “খাওয়ার ব্যবস্থাও এলাহি। অর দ্যভর দিয়ে আরম্ভ। তারপর একটার পর একটা ডিশ। ফোয়া গ্রা, অর্থাৎ হাঁসের লিভার, কাভিয়ের অর্থাৎ স্টার্জন মাছের ডিম....” ইত্যাদি (পৃষ্ঠা ৮৬)। আবার উনবিংশ অধ্যায়ে, পরে আরেকবারর ফ্রান্স ভ্রমণ বেরিয়ে প্রাগৈতিহাসিক গুহাচিত্রের জন্যে বিখ্যাত লাস্কো গ্রামের রেস্তোরাঁয় কথোপকথন—
“অসীম বললো, ফোয়া গ্রা। তোমরা নাম শোনোনি?
“আমরা তিনজনেই মাথা ঝাঁকালাম দু'দিকে। ভাস্কর বললো, কী রে, সুনীল, তুই তো একটু-আধটু ফ্রেঞ্চ জানিস, তুইও শুনিসনি? তোর বান্ধবী মার্গারিট তোকে ওই ফোয়া-মোয়া কী বলছে অসীম, সেটা খাওয়ায়নি?
“আমি বললাম, আমরা সেবার যখন প্যারিসে এসেছিলাম, আমাদের পয়সা খুবই কম ছিল, দামী খাবারের কথা চিন্তাও করিনি”। (পৃষ্ঠা ১৩৮) এবং, “... ফোয়া গ্রা প্রথম মুখে দিয়েই মনে হলো, এমন সুস্বাদু দ্রব্য আগে কখনো খাইনি। মুখের মধ্যে যেন একটা আনন্দের উপলব্ধি ছড়িয়ে যায়।” (পৃষ্ঠা ১৩৯)। পনের-কুড়ি বছর আগের ঘটনা ভুলে যাওয়া কিছুই অস্বাভাবিক নয়, কিন্তু একটি গ্রন্থকে সম্পূর্ণ ত্রুটিমুক্ত রাখার দায়িত্ব কিন্তু লেখক ও প্রকাশক দুজনেরই।
নবম অধ্যায়ে আরেকটি অসঙ্গতি। প্রথম দর্শনে প্যারিসের বর্ণনা — “তখনকার ফ্রান্স কী গৌরবোজ্জ্বল, মহীরুহ সদৃশ লেখক-শিল্পীরা সেখানে বিচরণ করছেন। জাঁ পল সার্ত্র তখনো বেঁচে, তিনি এক রেস্তোরাঁয় প্রতিদিন সকালে কফি পান করতে যান, জীবিত আছেন আরি মিশো, রেনে শ্যার-এর মতন কবিরা। ছবি আঁকছেন পিকাসো, রাস্তায় হঠাৎ দেখা যায় আর্নেস্ট হেমিংওয়ে কিংবা চার্লি চ্যাপলিনকে।” (পৃষ্ঠা ৬৯) হেমিংওয়ের (১৮৯৯ - ১৯৬১) কিন্তু মৃত্যু ঘটেছে এর কয়েক বছর আগেই।
ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদে ভার্সাই-এর রাজপ্রাসাদ ভ্রমণ। সেই সূত্রে মাইকেল মধুসূদন দত্তের প্রসঙ্গ এসেছে। “আমি বললাম, এই ভার্সাইয়ের সঙ্গে আমাদের বাংলা কবিতারও খানিকটা যোগ আছে। আমাদের একজন বাঙালী কবি এখানে কিছুদিন ছিলেন, এখানে বসে লিখেছেন, তাঁর নাম মাইকেল মধুসূদন দত্ত! ... তিনি ভার্সাইতে এসেছিলেন ফরাসি বিপ্লবের অনেক আগে, অন্তত বছর পঁচিশেক আগে।” শেষ বাক্যটিতেই বিপত্তি। খতিয়ে দেখা যাক। ফরাসি বিপ্লব অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দিকের ঘটনা। ১৭৮৯ সালে বাস্তিল কারাগার আক্রমণ দিয়ে মূল ফরাসি বিপ্লবের শুরু এবং তা চলেছিল দশ বছরের কিছু কম। ১৭৯৯ সালে ক্ষমতা দখল করেন সম্রাট নেপোলিয়ান এবং জাঁকিয়ে বসে রাজতন্ত্র। তার আগেই অবশ্য নিভে এসেছিল ফরাসি বিপ্লবের বহ্নিশিখা। অন্যদিকে মাইকেল মধুসূদন দত্ত উনবিংশ শতকের কবি (১৮২৪ - ৭৩) — ফরাসি বিপ্লব শেষ হবার পঁচিশ বছর পরে তাঁর জন্ম এবং জন্মের পঞ্চাশ বছর আগে তিনি ভার্সাইতে এসে উপস্থিত হবেন কিভাবে? গোলাম মুরশিদ রচিত মাইকেল জীবনী অনুযায়ী... "তেমনি এবার যাত্রা করলেন সম্পূর্ণ অজানা ভার্সাই শহরের দিকে। ১৮৬৩ সালের জুন মাসের ১৭ তারিখে গ্রেজ ইনে ট্রিনিটি টার্মের লেখাপড়া শেষ করার পরপরই লন্ডন ছেড়েছিলেন।” (“আশার ছলনে ভুলি”, দ্বিতীয় সংস্করণ, ১৯৯৭, পৃষ্ঠা ২৫০) এর পরের ঘটনা কিছুটা ধোঁয়াটে — লন্ডন ছেড়ে তিনি সোজা ভার্সাই এসেছিলেন, নাকি আসার পথে প্যারিসে বাস করছিলেন কিছুদিন? খুব সম্ভবত করেননি, কারণ খরচ কমাতেই তাঁর লন্ডন ত্যাগ এবং প্যারিসে থাকার খরচা ছিল তখন লন্ডনের চেয়ে বেশি। মাইকেল ভার্সাই শহরে বাস করেছেন ১৮৬৩ থেকে ১৮৬৫ এবং যে বাড়িতে তিনি থাকতেন সেখানে লাগানো স্মৃতিফলকেও সেই একই কথা লেখা আছে। অর্থাৎ ফরাসি বিপ্লব শেষ হবার ৬৪ বছর পরে মাইকেল ভার্সাই শহরে আসেন।
নেপোলিয়ানের বিষয়ে আরেকটি ঘটনা বলে এই প্রসঙ্গের দাঁড়ি টানবো। ঘটনাটি মনে এলো গ্রন্থের ৩৪ পৃষ্ঠায় নেপোলিয়ান বিষয়ে লেখক ও মার্গারিটের কথোপকথনে —
“আমি মার্গারিটকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমরা ফরাসিরা বুঝি নেপোলিয়ানকে এখনো খুব ভক্তি-শ্রদ্ধা করো?
"একটু থতোমতো খেয়ে মার্গারিট বললো, না। আমরা, অন্তত আমি, ভালোবাসি বোনাপার্টকে। যে বোনাপার্ট ছিলেন সেনাপতি ও কনসাল, যিনি ফরাসি দেশে প্রথম আইন-শৃঙ্খলার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যিনি দর্শন-কাব্য-সাহিত্য-শিল্পকলার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। কিন্তু যেদিন থেকে তিনি শুধু নেপোলিয়ান হলেন, সেদিন থেকে তাঁকে আর পছন্দ করতে পারি না।
"আমি বললাম, অর্থাৎ যেদিন থেকে তিনি সম্রাট হলেন! পোপের সামনে নেপোলিয়ান রাজমুকুটটা নিজেই নিজের মাথায় পরে নিয়েছিলেন বটে, কিন্তু সেই মুকুটটা তার দিকে কে এগিয়ে দিয়েছিল?”...
ভার্সাই রাজপ্রাসাদের একটি কক্ষে নেপোলিয়ানের রাজ্যাভিষেকের বিশাল তৈলচিত্রের সামনে দাঁড়িয়ে সেই কথাই ভাবছিলাম, এমন সময় আমাদের আধা-ইংরেজ-আধা-ফরাসি আগুন যুবতী ট্যুর গাইড সিমোন জানালো যে ছবিটিতে প্রচুর ভুলভ্রান্তি আছে। নেপোলিয়ানের রাজ্যাভিষেকের অনুষ্ঠানে পোপ যোগ দিতে আসেননি, আসার কথাও নয়, কারণ প্রচুর আপত্তি ছিল তাঁর নেপোলিয়ানের সম্রাট হওয়াতে। এমনকি নেপোলিয়ানের নিজের মা-ও আসেননি। তিনি সাধারণ পরিবারের কন্যা, তাঁর সন্তান নিজের কর্মকুশলতায় সেনাবাহিনীর প্রধান হয়েছে, এটাই তাঁর কাছে স্বপ্নের অধিক সাফল্য। তাই নেপোলিয়ান যখন মাকে জানালেন তিনি সম্রাট হয়ে সিংহাসনে আরোহণ করবেন, তাঁর মা তাঁকে জোরালোভাবে সাবধান করে দিয়েছিলেন — অধিক বাড় বাড়লে তাঁর নিশ্চিত পতনের সম্ভাবনা। কুডাক ডাকছিল মায়ের স্নেহপ্রবণ মন, এবং পাছে সন্তানের কোনরকম অমঙ্গল ঘটে সেই আশংকায় তিনি অভিষেকের ধারেকাছেও যাননি। পরে যখন রাজসভার শিল্পী অভিষেকের ছবি আঁকতে বসলেন, সম্রাট তাঁর কাছে বারবার জানালেন তাঁর দু:খ ও হতাশার কথা — সন্তান হল সম্রাট কিন্তু তার নিজের মা চোখের দেখা দেখলো না। রাজশিল্পী বুঝলেন সম্রাটের মনের কথা (এবং খুব সম্ভবত নিজের মাইনে, তোফা ও গর্দানের কথাও) এবং ছবিতে সম্রাটের কাছাকাছি এঁকে ফেললেন তাঁর জননীকে। আর কোন প্রবল অনুপ্রেরণায় তার সঙ্গে জুড়ে দিলেন স্বয়ং পোপকেও। নেপোলিয়ান মহাখুশি — পারিতোষিক পেলেন শিল্পী এবং ইতিহাসে অমর হয়ে থাকলো ভুলভ্রান্তিভরা অভিষেকের তৈলচিত্র।
যে গ্রন্থের অন্তত পাঁচটি মুদ্রণ হয়েছে (দশম মুদ্রণ ২০১১--সম্পাঃ) এবং বিক্রি হয়েছে কুড়ি হাজার কপি, সেখানে ভুলভ্রান্তির ব্যাপারে সতর্ক হওয়া লেখক ও প্রকাশকের গুরুদায়িত্ব। বিশেষ করে এক্ষেত্রে সেই প্রকাশক যখন গ্রন্থটির অন্যতম প্রধান চরিত্র। পরবর্তী মুদ্রণের সময়েও খতিয়ে দেখা যেতে পারতো তথ্যের অসঙ্গতিগুলি। ভেবেচিন্তে সম্পাদনা করলে গ্রন্থটির উৎকর্ষ আরও অনেকটাই বাড়তে পারতো।