• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৬৮ | সেপ্টেম্বর ২০১৭ | গ্রম্থ-সমালোচনা
    Share
  • অন্তরে জাগিছ : ইন্দ্রনীল মজুমদার



    সুরের গুরু ওস্তাদ আলাউদ্দীন খাঁ; শোভনা সেন; সম্পাদনা : অনিন্দ্য বন্দোপাধ্যায়; প্রথম প্রকাশ: জানুয়ারী ২০১৭; ঋকাল, কলকাতা; ISBN: 978-81-933223-7-6

    ব্যক্তির বেঁচে থাকার সম্পূর্ণ ব্যাপারটাই আমাদের সামনে যে আদল তুলে ধরে তা পরম্পরার পর পরম্পরা স্তম্ভিত করে রাখতে পারে কখনো কখনো। ওস্তাদ আলাউদ্দীন খানের জীবন সেই গোত্রের। পোষাকি নামে তাঁকে নির্দেশ করতে চাইলে মূঢ়তার মালিন্যে ভাষা ঢাকা পড়ে। “বাবা” শব্দটিই তাঁর সঠিক অভিধা, সঠিক নির্দেশ। লিরিকাল প্রকাশনায়, অনিন্দ্য বন্দোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় শ্রীমতী শোভনা সেন এর “সুরের গুরু ওস্তাদ আলাউদ্দীন খাঁ” পড়ে সেকথাই মনে হবে। ১৯৫৬ সালে সাপ্তাহিক দেশ পত্রিকায় কয়েকটি কিস্তিতে বাবার সঙ্গে তাঁর এই কথোপকথন প্রকাশিত হয়েছিল। আজ সত্তরবছর পরেও এখানে বিছিয়ে আছে সেই ব্যাক্তিত্বের দৈবী প্রভা যাকে লেখিকা বলেছেন, চন্দ্রকিরণের মত স্নিগ্ধ। তাঁকে নিয়ে লেখা হয়েছে অল্প, সে বিন্দুতে তাঁর সিন্ধুগভীরতা মাপা যাবে না। তবু তো বলা যায়, আমি হেথায় থাকি শুধু গাইতে তোমার গান। বহুপঠিত আত্মকথা “আমার কথা” (অনুলিখন শ্রী শুভময় ঘোষ), তাঁর শিষ্য ও সচিব সরোদবাদক শ্রী যতীন ভট্টাচার্য মহাশয়ের “আলাউদ্দীন খাঁ ও তাঁর সময়” (ইংরাজী অনুবাদও আছে), পণ্ডিতজীর (রবিশঙ্কর) মহাগ্রন্থ “রাগঅনুরাগ” ও তাঁর ইংরাজী আত্মজীবনী, শ্রীমতী অনুরাধা ঘোষের “UstadAllauddin Khan- The legend of Music” (With a Tribute to guru by Pandit Ravi Shankar), আর সাম্প্রতিক সময়ে থীমা প্রকাশিত ও তাঁর স্বহস্তে লিখিত পাণ্ডুলিপি থেকে শ্রী অনিন্দ্য বন্দোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় গ্রথিত “আমার জিবনী”। এটি একটি মহাগ্রন্থ। অনিন্দ্য বন্দোপাধ্যায় মহাশয় ঠিকই বলেছেন বইটি স্কুলপাঠ্যে আবশ্যিক হওয়া উচিত। খুব দীন অবস্থা থেকে গৃহত্যাগী এক শিশুর আত্মান্বেষণের দীর্ঘ এ যাত্রা ও সংগ্রাম কোন প্রফেটের যাত্রার চেয়ে কম অলৌকিক ও ঐশ্বরিক নয়। তাঁর ঈশ্বরচিন্তার গভীরতা বা সমস্তরকম ভেদবুদ্ধি ঘৃণার কথা আর নাই বা বললাম। অনিন্দ্যবাবু এই বইটিতেও “বাবা আলাউদ্দিন: একই অঙ্গে এত রূপ” নামে একটি মূল্যবান সংযোজন করেছেন। আরো একটি বিস্ময়কর সংযোজন তাঁর পত্রাবলী মোবারক খাঁর সৌজন্যে। বত্রিশ পৃষ্ঠাব্যাপী একাধিক মূল চিঠির প্রতিলিপিতে জেগে আছে আপাত সারল্যের অন্তরালে নিরন্তর সৃষ্টি, সঙ্গীতবোধ, নিষ্ঠা ও ভক্তির এক প্রগাঢ় বিচ্ছুরণ। প্যারি, লন্ডন, গ্রীস, তেলআবিভ, থেকে লিখছেন ছোটভাই নায়েব আলি ও আয়াত আলি খাঁকে। ভুলতে পারছেন না এদেশে তাঁর যে অনেক কাজ বাকি আছে। বিদেশের সঙ্গীতছন্দ ও যন্ত্রের কলাকৌশল তাঁকে প্রাণিত করছে ভারতের সঙ্গীতকে সমৃদ্ধতর করার চিন্তায়। সারা জীবন অগনণ গুরু, অগনণ যন্ত্রসিদ্ধি তাঁকে পরিণত করেছিল স্রষ্টায়, উর্ত্তীর্ণ করেছিল ঘরাণা সীমাবদ্ধতা অতিক্রান্ত বিশুদ্ধ সঙ্গীতধ্যানে। ওদের দেশের যন্ত্রের বিশ্লেষণ, ওদের স্বরলিপির পাশাপাশি তাঁর অভীষ্ট যন্ত্র সরোদ, বেহালা, চেলো বানানোর ড্রয়িংসহ নির্দেশ, বিশেষ কাঠ ও তন্তুর সুলুকসন্ধান দিচ্ছেন নকসা এঁকে। ইউরোপ হোলে আমরা আর একটা লিওনার্দোর ড্রয়িং ও নোটস এর মত কিছু পেতাম। যন্ত্রবিদ বা সাজবিশারদ হিসাবে তাঁর সমকক্ষ কোন সঙ্গীতনায়ক ছিলেন বা আছেন মনে হয় না। আধুনিক সেতার, সেতারব্যাঞ্জো, সরোদ, রুদ্রবীণা, সুরশৃঙ্গার, চন্দ্রসারঙ, সারিন্দা, নলসারঙ এসব তাঁরই নিজহাতে তৈরি যন্ত্র যা গায়কবাদকেরা নিজেদের প্রয়োজনমত পালটে নিয়েছেন। আর বাজনার আধুনিক পরিচিত ছক বা সিলসিলা, যেটি মাইহার সেনীঘরাণার বাজ বলে পরিচিত, সেটিও তাঁর নির্মাণ। এটির ভিত্তিভূমি ধ্রুপদ ও স্বরসিদ্ধি, খেয়ালের চঞ্চলতা নয়, ধ্রুপদের আরাধনা। যাই হোক ঐ মহার্ঘ পত্রমালা মুদ্রিতরূপে, প্রয়োজনীয় টীকাসহ বই হিসাবে পেলে সেই গ্রন্থ একটি সঙ্গীতশাস্ত্রের কাজ করতে পারে।

    হাজার বছরের দেশীয় মার্গসঙ্গীতধারা, তার নির্ভেজাল সাত্ত্বিকতা আর নিহিত ঈশ্বরভাবনা “বাবা”র রূপ ধরে আমাদের আজও বলছে নত হও, বর্জন করো সকল অলংকার। জীবনে যেমন, সঙ্গীতেও তেমনি অলংকার শেষমেষ বাহুল্যমাত্র। “তান তো তামসিকতা, সাত্ত্বিকতা হচ্ছে শুদ্ধ সুর”, বলছেন লেখিকাকে। নিজে ছুঁচসুতো এনে সরোদের খোলের ছিদ্র সেলাই করতে করতে তাঁর কথা, “বাবা, যে সুর ভিতর থেকে ওঠে, তা ধ্বনিত হয় নির্জনে, আসরে হট্টগোলে সে সুরের বিশুদ্ধ রূপটি হারিয়ে যায়”। মনে পড়ে উদয়শঙ্করের দলে ইউরোপ ভ্রমণের সময় কয়েকদিন ইংল্যান্ডের ডেভনশায়ারের ডার্লিংটন হলে বিরতিকালীন অবস্থান। সেই প্রথম তাঁকে একা ঘরে বসে আত্মভোলা বাজনা বাজাতে দেখলেন ও শুনলেন তরুণ রবিশঙ্কর। পরে তিনি লিখছেন, “It was so soul stirring and soothing listening to his great music thet flowed as is from a shirne of eternity”.সত্যি সহর্ষ উজ্জ্বলতা বা বিশ্বসভায় সম্বর্ধনায় তিনি স্বচ্ছন্দ ছিলেন না। গোয়ালিয়র, বরোদা, ইন্দোর, মাইসোর অনেক বিখ্যাত রাজসভার আমন্ত্রণ না নিয়ে সারাজীবন কাটিয়ে দিলেন ছোট্ট মাইহার রাজ্যের রাজা ব্রীজনারায়ণ সিংজীর নিরাভরণ আশ্রয়ে। সেখানেই যা তাঁর মা সারদার মন্দির। সে মন্দিরের ৬৪ সিঁড়ি বেয়ে তিনি রোজ রাজকুলদেবী, তাঁরও আরাধ্যা সারদা মাকে প্রণাম করতে উঠতেন। আর ছিল গরীব কিশোরদের নিয়ে, সম্পূর্ণ ভারতীয় (অধিকাংশই তাঁর তৈরী) বাদ্যযন্ত্র নির্ভর মাইহার ব্যান্ড। কোন পারিশ্রমিক কারও কাছে কখনো নেন নি। যদিও শিষ্যদের অন্নবস্ত্রআবাস দিয়ে গেছেন। স্থানীয়েরা তাঁকে ফকিরবাবা বলেই মনে করত।

    কিভাবে দেখব তাঁকে? সন্ত হিসাবে? সঙ্গীতগুরু হিসাবে? যিনি এককোণে বসে একা একাই বদলে দিলেন ভারতীয় সঙ্গীতের চালচিত্র? এর যে কোন একটা ভাবতে গেলে তল পাওয়া যাবে না। তাঁর মুখেই যে ফিরে ফিরে আসতো, “আমি তো কিছুই জানি না”। অথবা গুনগুন করে গান,

    “...কালী নামে মাত রে ভাই
    মা আমার পরাৎপরা ...
    খুব স্বাভাবিকভাবেই ঐ ভালবাসা আর মায়া, ত্যাগ আর সরলতা, সকল নারীতে মাতৃভাবের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে লেখিকারও মুখের কথা হারিয়ে গেছে। চোখে জল আনা বিস্ময়ের মাঝে মাঝেই ভেসে উঠছে গান, গানের অশ্রুত দর্শন। তিনিও যে বরেণ্য শিল্প শচীন দাস মতিলালের ছাত্রী। “আমিও শিল্পী হিসাবেই তাঁর সঙ্গে আলাপ করতে গিয়েছি, কাছে গিয়ে তার মনুষ্যত্বের মহিমায় মুগ্ধ হয়েছি। এক একজন মানুষ আছেন যাঁকে দর্শনমাত্রেই ‘বাবা’ বলে সম্বোধন করতে ইচ্ছা করে, পিতৃত্ব যাঁর স্বভাবের সঙ্গে ওতপ্রোত”।

    সন্ন্যাসী ও মুগ্ধ কিশোরের ভালবাসার একটি গল্প মনে পড়ছে। ইউরোপ ভ্রমণের প্রথমদিকে তখন প্যারিতে। রবিশঙ্করজী লিখছেন, ‘In the eraly stages I was very free with him even to the extent of selecting his attire that would befit an occasion. I made him stop dyeing the beard an insisted that he wore a French cut short beard. This transformation made him look fantastic, perhaps more dignified too”.মানে পাশ্চাত্য পোষাক সজ্জা। তাঁর কোন বিকার নেই। ছবিও তোলা হল কলার, টাই, ট্রিম করা গোঁফদাড়ি নিয়ে। চোখে সেই “হেথা নয়, হেথা নয়, অন্য কোনখানে” ভাব। এই মানুষ সারদা মাকে প্রনাম করে পাবলিক বাজনা শুরু করতেন। পণ্ডিতজীকে কপালে সিঁদুরের টিপ নিয়ে মা কালীকে প্রণাম করে অনুষ্ঠান শুরু তো অনেকেই দেখেছেন। পুত্র উস্তাদ আলী আকবর খাঁর সঙ্গীতের দেবী সরস্বতী, সে এখানেই হোক বা কালিফোর্ণিয়ায়।


    কলকাতায় টিভিতে দেওয়া তাঁর শেষ বাংলা সাক্ষাতকারে পণ্ডিতজী শেষ বয়সে দাঁড়িয়ে যখন বাবার কথা বলছিলেন তখন মনে হলো তাঁর সজল চোখের সামনে কোন বিগ্রহকে বেঁচে উঠতে দেখেছেন। তাঁর সম্বন্ধে আর কিছু বলতে যাওয়া প্রগলভতা মাত্র।

    “তুই আমারে শিখিয়ে দে মা,
    কেমন করে তোকে ডাকি,
    এক ডাকেতে ফুরিয়ে দে মা,
    জন্মভরা ডাকাডাকি”।
    শ্রীমতী সেনের বইটি ধর্মগ্রন্থের মত প্রভাতপাঠ্য। এক অমরত্বের ছোঁওয়া।

    পণ্ডিত রবিশঙ্করের পুত্রের নাম মনে হয় শুভেন্দ্রশঙ্কর হবে, শুভেণ্ড্র নয়। তিনি কলকাতাতেও ডোভার লেন মঞ্চে বাবার সঙ্গে বসে বাজিয়েছেন। প্রাসঙ্গিক তথ্যে মাইহার ও মাইহার রাজপরিবার, মাইহারব্যান্ড, শ্রদ্ধেয় গোপাল চক্রবর্তী (নুলো গোপাল), রামপুর ও উজীর খান, সদারঙ প্রভৃতির পরিচিতি থাকলে ভাল হতো। রাগ পরিচিতিগুলি মনে হয় না দিলেও হতো। তিনি শুধু শ্রেষ্ঠতম যন্ত্রবিদই ছিলেন না, খুব ছোট থেকেই অবিশ্বাস্য দক্ষতায় গান বা বাজনার সাথে সাথে তার স্বরলিপি করে ফেলতে পারতেন। সেভাবেই প্রকাশ্যে গোপনে কত রাগ ও বন্দিশের স্বরলিপি তিনি করেছিলেন প্রাচীন গুণীদের কাছে থেকে, শুনে। সেগুলিতেই রয়ে গেল ভারতীয় সঙ্গীতের বহুধারা। তাঁর জন্মের দেড়শ বছর পেরিয়ে গেলাম আমরা ২০১২ সালে। আমরা মনে রাখি নি।


    ছবি পরিচিতিঃ

    (১) পাশ্চাত্য পোষাকে বাবা ওস্তাদ আলাউদ্দিন খান।
    (২) রুদ্রবীণা।
    (৩) সেতার ব্যাঞ্জো।
    (৪) মাইহার-এ মা সারদার মন্দির।
    (৫) মা সারদা।


    ছবিগুলি "Ustad Allauddin Khan The Legend Of Music", Anuradha Ghosh বই থেকে নেওয়া।

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments