“একবার উইলসনের হোটেলে দুই বাঙ্গালীবাবু আহার করিতে গিয়াছিলেন। এক বাবুর গোরু ভিন্ন চলে না, তিনি খানসামাকে বলিলেন, ‘বীল’ (veal) হ্যায়?’ খানসামা উত্তর করিল, ‘নহি হ্যায় খোদাওন্দ্’। বাবু পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘বীফষ্টিক’ (beefsteak) হ্যায়?’ খানসামা উত্তর করিল, ‘ও ভি নহি হ্যায় খোদাওন্দ’। বাবু পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘অক্স্টং’ (oxtongue) হ্যায়?’ খানসামা উত্তর করিল, ‘ও ভি নহি হ্যায় খোদাওন্দ’। বাবু পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘কাফস্ফুট জেলি (calf’s foot jelly) হ্যায়?’ খানসামা উত্তর করিল, ‘ওভি নহি হ্যায় খোদাওন্দ’। বাবু বলিলেন, ‘গোরুকা কুচ হ্যায় নহি?’ এই কথা শুনিয়া দ্বিতীয় বাবু, যিনি এত গোমাংসপ্রিয় ছিলেন না, তিনি বিরক্ত হইয়া বলিলেন, ‘ওরে! বাবুর জন্যে গোরুর আর কিছু না থাকে তো খানিকটা গোবর এনে দে না’।”
এইরকম একটা সরস বর্ণনা দিয়েছেন রাজনারায়ণ বসু ‘সে কালের’ কথা বলতে গিয়ে। সেই রাজনারায়ণ, যাঁকে ‘জীবনস্মৃতিতে’ রবীন্দ্রনাথ উল্লেখ করেছেন ‘বৃদ্ধ রাজনারায়ণ’ বলে। রবীন্দ্রনাথ যখন বালকবয়সী, সেজদাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের উদ্যোগে এক স্বাদেশিকের সভা বসত কলকাতার এক গলির মধ্যে। বৃদ্ধ রাজনারায়ণবাবু ছিলেন তার সভাপতি। রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, “ছেলেবেলায় রাজনারায়ণবাবুর সঙ্গে যখন আমাদের পরিচয় ছিল তখন সকল দিক হইতে তাঁহাকে বুঝিবার শক্তি আমাদের ছিল না। তাঁহার মধ্যে নানা বৈপরীত্যের সমাবেশ ঘটিয়াছিল। তখনই তাঁহার চুল দাড়ি প্রায় সম্পূর্ণ পাকিয়াছে কিন্তু আমাদের দলের মধ্যে বয়সে সকলের চেয়ে যে-ব্যক্তি ছোটো তাহার সঙ্গেও তাঁহার বয়সের কোনো অনৈক্য ছিল না। তাঁহার বাহিরের প্রবীণতা শুভ্র মোড়কটির মতো হইয়া তাঁহার অন্তরের নবীনতাকে চিরদিন তাজা করিয়া রাখিয়া দিয়াছিল। এমন-কি, প্রচুর পাণ্ডিত্যেও তাঁহার কোনো ক্ষতি করিতে পারে নাই, তিনি একেবারেই সহজ মানুষটির মতোই ছিলেন। ...একদিকে তিনি আপনার জীবন এবং সংসারটিকে ঈশ্বরের কাছে সম্পূর্ণ নিবেদন করিয়া দিয়াছিলেন, আর-একদিকে দেশের উন্নতিসাধন করিবার জন্য তিনি সর্বদাই কত রকম সাধ্য ও অসাধ্য প্ল্যান করিতেন তাহার আর অন্ত নাই। ...দেশের সমস্ত খর্বতা দীনতা আপমানকে তিনি দগ্ধ করিয়া ফেলিতে চাহিতেন। ...এই ভগবদ্ভক্ত চিরবালকটির তেজঃপ্রদীপ্ত হাস্যমধুর জীবন, রোগে শোকে অপরিম্লান তাঁহার পবিত্র নবীনতা, আমাদের দেশের স্মৃতিভাণ্ডারে সমাদরের সহিত রক্ষা করিবার সামগ্রী তাহাতে সন্দেহ নাই”।
উদ্ধৃতি ইচ্ছাকৃতভাবেই দীর্ঘ হল আমাদের স্মৃতিকে কিছুটা প্ররোচিত করার মানসে, আর আলোচ্য বইটির লেখককে ব্যক্তিমানুষ হিসাবে নতুন পাঠকের কাছে পরিচিত করানোর উদ্দেশ্যে। রাজনারায়ণ বসুর ‘সে কাল আর এ কাল’ রচিত আর জাতীয় সভায় পঠিত হয়েছিল ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে, এবং পরের বছর প্রকাশিত হয়েছিল এক ক্ষীণ কলেবরের বই হিসাবে। বইটির প্রথম বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৩৫৮ বঙ্গাব্দে ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায় ও সজনীকান্ত দাসের সম্পাদনায়। দ্বিতীয় সংস্করণের সপ্তম মুদ্রণ হয়েছে ১৪২২ বঙ্গাব্দে। বোঝা যাচ্ছে অনুসন্ধিৎসু পাঠকমহলে বইটির সমাদর অক্ষুণ্ণ রয়েছে, এবং সেটা সঙ্গত কারণেই। বাংলার সামাজিক পটপরিবর্তনের যুগসন্ধিক্ষণের এক সনিষ্ঠ বিবরণ বিবৃত হয়েছে বইটিতে। ‘সে কাল’ হিসাবে তিনি চিহ্নিত করেছেন ইংরেজি আমলের প্রথম থেকে ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দ অর্থাৎ ‘হিন্দু কালেজ’ সংস্থাপনের সময় পর্যন্ত কাল। সে কালের সঙ্গে তুলনায় পরবর্তী কালে ইংরেজি শিক্ষা ও সভ্যতা বিস্তারের প্রভাবে ‘কোন্ কোন্ বিষয়ে প্রকৃত উন্নতি হইতেছে আর কোন্ কোন্ বিষয়ে প্রকৃত অবনতি হইতেছে’ সেই আলোচনায় সচেষ্ট হয়েছেন। হিন্দু কালেজে রিচার্ডসন সাহেবের প্রিয় ছাত্র এবং ইংরেজি শিক্ষায় সুশিক্ষিত রাজনারায়ণের পাণ্ডিত্য প্রদর্শনের কোন প্রকাশ নেই বইটিতে—তাঁর সহজাত সরলতা হাস্যরস আর দেশপ্রেম বিধৃত রয়েছে আগাগোড়া।
সে কালের কথা বলতে গিয়ে প্রথমেই তিনি সে কালের সাহেবদের কথা বলেছেন, কেননা ‘সাহেবরা আমাদিগের শাসনকর্তা ও তাঁহাদিগের সহিত আমাদের ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ।’ তখন বিলাতে যাতায়াতের তেমন সুবিধা না-থাকায় আর সংখ্যাল্পতার কারণে এ-দেশীয়দের সঙ্গে সাহেবদের সামাজিকতার আদানপ্রদান গড়ে উঠেছিল। ‘তখনকার সাহেবরা পান খেতেন, আলবোলা ফুঁকতেন, বাইনাচ দিতেন ও হুলি খেলতেন’, দেওয়ানদের বাড়ি গিয়ে তাঁদের ছেলেদের হাঁটুর উপর বসিয়ে আদর করতেন ও চন্দ্রপুলি খেতেন। এদেশের শুভানুধ্যায়ী তৎকালীন পাঁচজন সাহেবের প্রশংসায় রচিত হয়েছিল—
হেয়ার কল্বিন পামরশ্চ কেরি মার্শমেনস্তথাসাহেবদের এই ছবি ‘এ কালে’ অর্থাৎ পরবর্তী সময়ে অনেক বদলে গিয়েছিল। প্রভুত্বভাব ও তজ্জনিত দূরত্ববোধ ক্রমশই প্রাথমিক যুগের ঘনিষ্ঠতার স্থান দখল করে নিয়েছিল। রাজনারায়ণ আক্ষেপের সঙ্গে লিখছেন: ‘ইংরাজী শিক্ষার দ্বারা আমাদিগের হৃদয়ে উচ্চ উচ্চ বাসনার উদ্রেক হইতেছে, কিন্তু রাজপুরুষেরা আমাদের সেই সকল বাসনা পূর্ণ করিতেছেন না। আমরা গবর্নমেন্টের দোষ সকল বিলক্ষণ বুঝিতে পারিতেছি, কিন্তু আমাদিগের হাত পা বাঁধা, সে সকল দোষ সংশোধন বিষয়ে আমাদিগের কোন কথাই চলে না। ...আমরা ইংরাজী শিক্ষা না করিতাম, এ বিড়ম্বনা অপেক্ষা সে বরং ভাল ছিল।’
পঞ্চ গোরা: স্মরেণ্ণিত্যং মহাপাতকনাশনম্।
ইংরেজি শিক্ষা বাঙালির ব্যবহারিক আর ভাবগত জীবনে এক বিরাট পরিবর্তন নিয়ে এসেছিল। প্রাথমিক পর্যায়ে সাহেবদের সঙ্গে ভাববিনিময়ের জন্য কিছু ইংরেজি শব্দ আয়ত্ত করা আবশ্যক ছিল। পাঠশালায় ইংরেজি শব্দ শেখানোর জন্য শ্রেণিগতভাবে বিভিন্ন দ্রব্যের নাম পয়ারছন্দে গ্রথিত করে ছাত্রদের ‘ঘোষাণো’ হত, অর্থাৎ সুর করে মুখস্থ করানো হত। যেমন, ‘গার্ডেন’ বিষয়ে—
পমকিন লাউ কুমড়া, কোকোম্বার শসা,এইরকম ইংরেজি বিদ্যা নিয়ে বাঙালি কর্মচারী সাহেব মনিবের কাছে রথযাত্রার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছেন—
ব্রিঞ্জেল বার্তাকু, প্লোমেন চাসা।
থ্রিষ্টারিস হাই/গড অলমাইটি সিট আপন/যাঁরা একটু ভালো করে ইংরেজি শিখতে চাইতেন তাঁদের পাঠ্য ছিল স্পেলিং বুক, ‘স্কুল মাষ্টর’ নামক বই যার মধ্যে ছিল গ্রামার স্পেলিং ও রীডর, আর কিছু দেশি ও ফারসি গল্পের ইংরেজি অনুবাদ। তার উপরের পর্যায়ে শিক্ষণীয় ছিল Port Royal Grammar, Port Royal Logic ইত্যাদি। ‘যিনি রয়্যাল গ্রামার পড়িতেন, লোকে মনে করিত তাঁহার ন্যায় বিদ্বান আর কেহ নাই।’
লং লং রোপ/ থৌজন্ড মেন ক্যাচ/
পুল পুল পুল/রানওয়ে রানওয়ে/হরি হরি বোল।
ইংরেজি শিক্ষার এই দুর্দশা হিন্দু কলেজ সংস্থাপনের ফলে অনেকখানি দূরীভূত হল, আর সেই সঙ্গে ইংরেজি শিক্ষার প্রভাবে নব নব ভাব হিন্দু সমাজে প্রবৃষ্ট হল। হিন্দু কলেজ থেকে প্রথম যে যুবকদল বার হন তাঁরা ডিরোজিও সাহেবের শিক্ষাগুণে প্রাচীন হিন্দুধর্মে আর হিন্দু রীতিনীতিতে অনেক দোষ অনুভব করতে সমর্থ হয়েছিলেন। রাজনারায়ণ লিখছেন—“তখনকার সময়গুণে ডিরোজিওর যুবকশিষ্যদিগের এমনি সংস্কার হইয়াছিল যে মদ খাওয়া ও খানাখাওয়া সুসংস্কৃত ও জ্ঞানালোকসম্পন্ন মনের কার্য। তাঁহারা মনে করিতেন এক এক গ্লাস মদ খাওয়া কুসংস্কারের উপর জয়লাভ করা। কেহ কেহ উদ্ধত বেশে দোকানদারের নিকটে গিয়া বলিতেন ‘গোরু খেতে পারিস, গোরু খেতে পারিস?’ এইরূপে প্রচলিত রীতিনীতির মস্তকে পদাঘাত করিয়া তাঁহারা মহা আস্ফালন করিয়া বেড়াইতেন।” মুসলমানের দোকানে গিয়ে কিংবা মুসলমান ফেরিওয়ালার ঝুড়ি থেকে কেক রুটি বিস্কুট কিনে খেয়ে তাঁরা রাস্তায় সম্মিলিত জয়ধ্বনি করতেন। এইভাবেই তাঁরা জাতির কুসংস্কারের বন্ধন শিথিল করতে প্রয়াসী হন। আলোচনার প্রারম্ভে যে উদ্ধৃতি দেওয়া হয়েছে তা এই প্রয়াসেরই এক উৎকট অভিব্যক্তি। রাজনারায়ণ তা সমর্থন করেন নি। তাঁর মতে: ‘প্রাচীনতম হিন্দুরা গোমাংস ভক্ষণ করিতেন শাস্ত্রে এমন উদাহারণ পাওয়া যায়। কিন্তু মধ্যসময়ের হিন্দুগণ গোরুর উপকারিত্ব ও এদেশে তাহার মাংস ভক্ষণের অস্বাস্থ্যকর দোষ প্রতীতি করিয়া গোমাংস ভক্ষণ শাস্ত্রে নিষেধ করিয়া গিয়াছেন। গোরু যেরূপ উপকারী জন্তু, তাহার সম্বন্ধে এই রূপ ব্যবহারই নিতান্ত কর্তব্য।’
ডিরোজিও শিষ্যদের এইসব আচরণই যে হিন্দুসমাজে পরিবর্তনের একমাত্র কারণ রাজনারায়ণ তা মনে করেন নি। তাঁর মতে, সেইসময়ের ধর্ম ও সমাজসংস্কারের প্রকৃত কারণ ইংরেজি শিক্ষার স্থির ও স্থায়ী প্রভাব আর ব্রাহ্মসমাজের উপদেশ যা ‘সাধারণ লোককে এখনও তত কার্যে প্রবৃত্ত করিতে পারে নাই, যত মতের পরিবর্তন করিয়াছে।’ তাঁর মন্তব্য, ‘মত পরিবর্তন যত শীঘ্র হয়, কার্যের পরিবর্তন তত শীঘ্র হয় না।’ তবে পরিবর্তন এসেছে নানা বিষয়ে—নগরে ও গ্রামে বহুসংখ্যক বিদ্যালয় স্থাপন, স্ত্রীশিক্ষার প্রসার এবং তার ফলে অধিক বয়সে স্ত্রীলোকের বিবাহ, বিধবা বিবাহ, অসবর্ণ বিবাহ, স্ত্রীলোকের বহির্গমন বিষয়ে স্বাধীনতা, বিলাত যাওয়ার ব্যাপারে মানসিকতার পরিবর্তন। কিন্তু রাজনারায়ণের মতে ‘পরিবর্তন হইলেই যে উন্নতি, তাহার নিশ্চয়তা নাই।’ তাই তিনি প্রবৃত্ত হয়েছেন সাতটি বিষয়ে প্রকৃত উন্নতি বা অবনতি নির্ধারণে। বিষয়গুলি হল— শরীর, বিদ্যাশিক্ষা, উপজীবিকা, সমাজ, চরিত্র, রাজ্য এবং ধর্ম।
সে কালের তুলনায় তাঁর সময়ের লোকজনের শারীরিক বল ‘কিছুই নাই বলিলে হয়’, তারা খর্বকায় এবং ক্ষীণদৃষ্টি। এর জন্য তিনি এগারোটি কারণ চিহ্নিত করেছেন—দেশের নৈসর্গিক প্রকৃতির পরিবর্তন, অতিশয় পরিশ্রম ও অকালে পরিশ্রম, ব্যায়াম চর্চার হ্রাস, পুষ্টিকর খাদ্যদ্রব্য ভক্ষণের হ্রাস, কৃত্রিম খাদ্যদ্রব্যের ব্যবহার, পানদোষের প্রবলতা, শরীর সম্বন্ধীয় ইংরেজি আচার ব্যবহার অবলম্বন, দুর্ভাবনা বৃদ্ধি, আমোদপ্রমোদের অভাব এবং বাবুগিরির বৃদ্ধি। ষাট সত্তর বৎসর আগের তুলনায় শীতকালে শীত অনেক কমেছে এবং তার প্রভাব পড়েছে দেশের লোকের শারীরিক বলবীর্যের উপর। ইংরেজরা যে দশটা থেকে চারটে পর্যন্ত কাজের সময় নির্ধারণ করেছেন তা তাঁর মতে এদেশের আবহাওয়া অনুসারে অনুকূল নয়, এবং ফলত ক্লান্তিকর। তাছাড়া ইংরেজরা চান এদেশীয়রা যেন তাঁদের মতো পরিশ্রম করে, কিন্তু প্রকৃতিগতভাবে তাদের পক্ষে সেটা করা সম্ভবপর নয়। পুষ্টিকর খাদ্যদ্রব্য ভক্ষণের হ্রাস বিষয়ে তাঁর পর্যবেক্ষণ হল, মাংসাহার আগের তুলনায় বৃদ্ধি পেলেও অধিকাংশ লোকের পক্ষে তা জোটানো ভার এবং ‘পূর্বে আপামর সাধারণ সকলেই যেমন দুগ্ধ খাইতে পাইত, এক্ষণে দুগ্ধ মহার্ঘ হওয়াতে সেরূপ পায় না।’ খাদ্য সম্বন্ধে তাঁর আর এক আক্ষেপ, ‘আমরা বাল্যকালে ঘৃত দুগ্ধ তৈল প্রভৃতি দ্রব্য যেমন অকৃত্রিম পাইতাম এখন আর সেরূপ পাই না। ...মুসলমানদিগের আমলে এরূপ ছিল না। আমাদিগের বর্তমান রাজপুরুষদিগের আমলে সকলেতেই ভেজাল, মানুষেতেও খাদ, মানুষও গিল্টি।’ আমাদের বর্তমান সময়ের পরিস্থিতি দেখলে তিনি কী মন্তব্য করতেন জানতে ঔৎসুক্য হয়।
দুর্ভাবনা বৃদ্ধির কারণ হিসাবে তিনি জানাচ্ছেন যে পূর্বে দেশের লোক অনায়াসে জীবিকা লাভ করতেন ও অল্পে সন্তুষ্ট থাকতেন, কিন্তু ‘এক্ষণে ইউরোপীয় সভ্যতার সঙ্গে সঙ্গে ইউরোপীয় অভাব, ইউরোপীয় প্রয়োজন ও ইউরোপীয় বিলাসিতা এসে ঢুকেছে, অথচ সেই সকল অভাব ও বিলাসেচ্ছা পূরণের ইউরোপীয় উপায়, অর্থাৎ শিল্প ও বাণিজ্য বিশিষ্টরূপে অবলম্বিত হইতেছে না।’ তাঁর এই মন্তব্য বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। শিল্প উদ্যোগ আর বাণিজ্যের বাঙালি পথিকৃৎ দ্বারকানাথ ঠাকুর ও রামদুলাল সরকারের উত্তরসূরীরা সে পথের পথিক হন নি, নূতন উদ্যোগীরা তখনও অনাগত।
বিদ্যাশিক্ষা বিষয়ে তৎকালীন পরিস্থিতির বর্ণনা তিনি সবিস্তারে দিয়েছেন। ‘সে কালের’ তুলনায় তখন বাংলাভাষার ও বাংলাভাষা শিক্ষার অনেক উন্নতি হয়েছে, কিন্তু তাঁর আক্ষেপ সংস্কৃত চর্চায় ভাঁটা পড়েছে এবং সেই কারণে ভট্টাচার্য পণ্ডিতেরা দুর্দশার সম্মুখীন। তাঁর গভীরতর আক্ষেপ, ‘ইংরাজী ভাষা শিক্ষার শ্রীবৃদ্ধি বটে, কিন্তু আমি বলিতে বাধ্য হইতেছি ইহার দ্বারা যথার্থ বিদ্যা উপার্জন যাহাকে বলে তাহা হইতেছে না। শিক্ষাপ্রণালীর দোষ ইহার প্রধান কারণ।’ তিনি নিজে মেদিনীপুর গর্ভনমেন্ট স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন এবং বেদনার সঙ্গে লক্ষ করেছিলেন যে ‘ছেলেরা যাহা কী-তে আছে তাহাই অবিকল মুখস্থ করে। ...পূর্বে হিন্দু কালেজে কোন নির্দিষ্ট পুস্তক হইতে প্রশ্ন দেওয়া হইত না ও এ গ্রন্থের একটু ও গ্রন্থের একটু এরূপ করিয়া পড়ানো হইত না, ছাত্রদিগকে নিজে কতই পড়িতে হইত তাহার সীমা নাই। ...এখনকার এন্ট্রান্স কোর্স ফার্স্ট আর্টস্ কোর্স ও বি.এ. কোর্স সমস্ত একত্র কর, কত বড় বই হইবে?’ এই সঙ্গে তিনি ব্যক্ত করেছেন স্কুলে নীতিশিক্ষার অভাবে ছেলেরা দুর্নীতিপরায়ণ হয়ে উঠছে। স্ত্রীশিক্ষার বিষয়ে তাঁর অনুযোগ যে স্কুলে দশ বারো বৎসরের শিক্ষায় তাদের কেবল বর্ণপরিচয় ও শব্দপরিচয় মাত্র হয়, তারপর লেখাপড়ার কোন চর্চাই থাকে না। তাই তাঁর অভিমত, ‘হয় স্ত্রীদিগের রীতিমতো শিক্ষা দেও, নতুবা শিক্ষা দেওয়ায় কাজ নাই।’
কথোপকথনে বাংলার সঙ্গে ইংরেজির যথেচ্ছ ব্যবহার তিনি সমর্থন করতে পারেন নি, এবং তার সমালোচনায় সোচ্চার হয়েছেন। স্বদেশীয়দের মধ্যে ইংরেজিতে পত্রালাপ এবং যে সব সভার সভ্যরা বাঙালি সেখানে সভার কার্যবিবরণী ইংরেজিতে রাখার যৌক্তিকতা নিয়ে তিনি প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁর কাছে এগুলো মাতৃভাষার অবমাননা এবং এর নিরসন প্রয়োজন, কেননা ‘এই সকল ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয়ে জাতীয় গৌরবতা সঞ্চারিত হইতে হইতে মহৎ বিষয়ে জাতীয় গৌরবেচ্ছা সঞ্চারিত হইবে।’ দেড়শো বছর পরে আজকের স্বাধীন ভারতে বাংলাভাষার বিষয়ে কতটা পটপরিবর্তন হয়েছে সে প্রশ্ন থেকেই যায়।
তৎকালীন সামাজিক চরিত্র বিষয়ে তিনি বহুলাংশে হতাশ এবং তাঁর মন্তব্য রীতিমতো নির্মম। তিনি লিখছেন: ‘চরিত্র বিষয়ে এক্ষণকার লোকের প্রথম দোষ, পিতৃভক্তির হ্রাস। নিজ কর্মস্থলে বৃদ্ধ পিতা আসিলে তাঁহাকে পিতা বলিয়া লোকের নিকট পরিচয় দিতে বাবু লজ্জিত হয়েন। ...এক্ষণকার লোক পানাসক্ত ও পূর্বাপেক্ষা অধিকতর বেশ্যাসক্ত। ...এখনকার লোকেরা পূর্বকার লোক অপেক্ষা অধিক অসরল। এখন পদে পদে খলতা, অসরলতা। ...এক্ষণে প্রতারণা অত্যন্ত বৃদ্ধি পাইয়াছে। ...এখনকার লোকের স্বার্থপরতা বড় প্রবল। এ কাল অপেক্ষা সে কালে পল্লির লোকদিগের মধ্যে পরস্পর সহানুভূতি অধিক ছিল। ...কৃতজ্ঞতাধর্মেও এক্ষণকার লোকদিগের পূর্বকার অপেক্ষা হীন দেখা যায়। ...এক্ষণে সুখপ্রিয়তা, বিলাসপরায়ণতা ও বাবুগিরির অত্যন্ত প্রাদুর্ভাব হইয়াছে। ...চরিত্র বিষয়ে বর্তমান বঙ্গসমাজের আর এক অবনতির চিহ্ন যুবকদিগের অশিষ্ট ব্যবহার।’ তাঁর আক্ষেপ, ‘আমরা আমাদের পুরাতন গুণগুলি হারাইতেছি, অথচ ইংরাজদিগের সদ্গুণসকল অনুসরণ করিতেছি না।’ তাঁর মতে, চরিত্র বিষয়ে দেশস্থ লোকের অবনতির কারণ ধর্ম বিষয়ে অবনতি—‘ধর্মের প্রধান উপাদান শ্রদ্ধা ভক্তি ও পরকালের ভয়, সে সকল ক্রমে তিরোহিত হইতেছে। ...যে সমাজের ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা নাই, সে সমাজের কি উন্নতির আশা করা যাইতে পারে?’
রাজনারায়ণের বর্ণনা থেকে বোঝা যাচ্ছে ইংরেজি শিক্ষা প্রবর্তনের ফলে ও ইংরেজ শাসনের কারণে পুরাতন মূল্যবোধের পরিবর্তন ঘটছে দ্রুতগতিতে যার অভিঘাতে সামাজিক বিধিনিষেধের শৃংখল ভেঙে পড়ছে, কিন্তু নূতন মূল্যবোধের শৃংখলা তখনও অনায়ত্ত। বেশ কিছু ত্রুটি বিচ্যুতির উল্লেখ করেও সে কালের প্রতি তাঁর সস্নেহ পক্ষপাতিত্ব, আর এ কালের প্রতি তাঁর উদ্বিগ্ন ভর্ৎসনা। তিনি স্বয়ং এ কালের প্রতিনিধি, ইংরেজিতে সুশিক্ষিত হয়ে পাশ্চাত্য ভাবধারার সঙ্গে পরিচিত এবং নবলব্ধ জাতীয়তাবোধের প্রেরণায় স্বদেশীয় সমাজের সর্বাঙ্গীণ উন্নতির প্রত্যাশী। কিন্তু সমসাময়িক সামাজিক পরিস্থিতিতে তিনি আশাহত। কিন্তু তিনি সম্পূর্ণ হতাশ নন। অভিভাবকের ভূমিকা নিয়ে সামাজিক অবনতির বিষয়ে শিক্ষিত মহলকে অবহিত করতে চেয়েছেন এই আশা নিয়ে যে সম্মিলিত সজ্ঞান প্রচেষ্টায় এই সব দুর্বলতা কাটিয়ে উঠে ‘হয়ত এই দুর্বল বাঙালি জাতি ভবিষ্যতে পৃথিবীর মধ্যে এক প্রধান জাতি হইয়া উঠিবে।’
মূল্যবোধের সংঘাত যে কোনো প্রজন্মান্তরের অবশ্যম্ভাবী সংঘটন—
We think our fathers fool, so wise we grow,মানবসভ্যতার বিবর্তনের ইতিহাস এই সংঘাত সমর্থন করে। ঐতিহাসিক এ.জে.পি. টেলরের ভাষায়, ‘If man were conformist, he would have never come out of the caves’—মানুষ যদি পুরানো ধ্যানধারণাকে আঁকড়ে নিয়ে থাকত তাহলে সে গুহা থেকে বেরিয়ে আসতে পারত না। The Prophet কাব্যগ্রন্থে খলিল জিবরান বলেছেন, ‘You may give them your love but not your thoughts,/For they have their own thoughts’—তোমার সন্তানদের তুমি স্নেহ ভালোবাসা দিতে পারো, কিন্তু তোমার চিন্তাধারা নয়, /কেননা তাদের চিন্তাধারা তাদের নিজস্ব। রাজনারায়ণের অব্যবহিত পূর্ববর্তী ইয়ং বেঙ্গলদের আচরণ এবং তাঁর সমসাময়িক যুবকদের অশিষ্ট ব্যবহার তাই প্রজন্মান্তরের চিন্তা পরিবর্তনের স্বাভাবিক অভিব্যক্তি হিসাবেই মেনে নেওয়া সঙ্গত। তবে পুষ্টিকর খাদ্যের অপ্রতুলতা, খাদ্যে ভেজাল মানুষে ভেজাল, শিক্ষাপ্রণালীর ত্রুটি ও অসম্পূর্ণতা, ইঙ্গবঙ্গ কথোপকথনের প্রবণতা ও মাতৃভাষার প্রতি যথাযথ মনোযোগের অভাব, অর্থনৈতিক বিকাশের জন্যে প্রয়োজনীয় শিল্পোদ্যমের ঘাটতি— এই সব বিষয়ে রাজনারায়ণের মন্তব্য আমাদের এ কালেও তাদের প্রাসঙ্গিকতা হারায় নি।
Our wiser sons will think us so.
একবিংশ শতাব্দীর প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে বাঙালির ‘সে কাল আর এ কাল’ পাঠ ও অনুধ্যানের প্রয়োজন রয়েছে।