পৌষ সংক্রান্তির দিন অনিমেষ-জেঠু আসতেই রিন্টি আর গুগাই, ‘গল্প বলো, গল্প বলো’ বলে ওনাকে চেপে ধরল।
মা শুনেই বকুনি দিলেন, “আমি সকাল থেকে এত খেটেখুটে পিঠে বানাচ্ছি, আগে জেঠুকে খেতে দাও তারপর অন্য কিছু!”
“হ্যাঁ, আগে পিঠে তারপর বাকি সব!” বলে জেঠু রিন্টি-গুগাইয়ের দিকে চেয়ে চোখ টিপলেন।
মুগের ডালের পিঠেতে এক কামড় দিয়ে আর এক চামচ দুধপুলি খেয়ে, “বাহ!” বলে জেঠু শুরু করলেন।
“এটা কিছুদিন আগেরই ঘটনা। তখন আমি গোয়াতে পোস্টেড। ওখানকার এক সহকর্মী ম্যানুয়েল পেরেরা একদিন অফিসে এসে আমাকে বলল যে ওর বাবা একটু সমস্যায় পড়েছেন তাই আমার সাহায্য চান। ম্যানুয়েলের বাবা জোসেফ পেরেরা উকিল মানুষ। ওনার সঙ্গে আমার আগে থেকেই চেনাশোনা ছিল কারণ ম্যানুয়েলের বাড়িতে আমি বেশ কয়েকবার গেছি। ওর মা দারুণ রান্না করেন। এখানে সেখানে অনুষ্ঠানেও ওনার সঙ্গে দেখা হয়েছে। আমি সাহায্য করতে রাজি শুনে উনি সেদিনই বিকেলবেলা আমার বাড়িতে এসে হাজির হলেন।
আমি বললাম, “কী ব্যাপার পেরেরা আঙ্কেল? ম্যানুয়েল বলছিল আপনি নাকি খুব চিন্তায় পড়েছেন, নাহলে তো আমার কথা মনেই পড়ে না!”
আমার ঠাট্টাতেও উনি হাসতে পারলেন না, গম্ভীর মুখে বললেন, “খুব বিপদে পড়ে তোমার কাছে এসেছি! পুলিশে যেতে চাই না। তোমাকেও বলছি, আর কেউ যেন ঘুণাক্ষরেও এ সব না জানতে পারে। আসলে ব্যাপারটার জানাজানি হোক আমি চাই না মোটেই। ওরা সম্ভ্রান্ত পরিবার তাই খবরের কাগজ সাংবাদিক এই সব ওরাও চাইবে না।”
আমি বুঝলাম ব্যাপারটা বেশ সিরিয়াস, তাই ওনাকে বললাম, “আপনি আমার ওপর সম্পূর্ণ আস্থা রাখতে পারেন। আমি কাউকে কিছু বলব না। কী হয়েছে যদি খুলে বলেন।”
পেরেরা আঙ্কেল মুখের ঘাম মুছে, জলটল খেয়ে বলতে শুরু করলেন, “থিওডোর গোমসের সঙ্গে আমার আলাপ প্লেনে। আমরা দুজনে বম্বে থেকে গোয়া ফ্লাইটে পাশাপাশি সিটে বসেছিলাম, সেই থেকেই আলাপ। সেটা প্রায় তিরিশ বছর আগেকার কথা। তারপর থেকেই আমি ওর উকিল আর বন্ধু দুইই। ওর উইল থেকে শুরু করে সব কিছু আমিই করেছি। তবে কিছুকাল হল ও বেশ দুঃখে থাকত কারণ ওর ছেলেমেয়েরা নাকি ঠিক মতন মানুষ হয়নি। মানে বড়লোক বাবার সন্তান তাই কাজটাজ করতে ইচ্ছে করে না ওদের। দামি দামি সব শখ আছে। ব্যবসাতেও মন নেই। তা যাই হোক থিও তিন সপ্তাহ আগে মারা যায়। উইল ছাড়াও একটা দায়িত্ব ও আমাকে দিয়ে গিয়েছিল সেটা হল ওর একটা খুব মোটা আর ভারী সোনার চেন। বেশ অনেকটা সোনা ছিল সেটাতে। সেই চেন আমাকে দিয়ে বলেছিল ওটার চারটে টুকরো করে ওর তিন ছেলে-মেয়ে আর ভাগ্নেকে দিতে। থিওর বোন অনেকদিন আগেই মারা গিয়েছিল তাই ভাগ্নে ওর কাছেই বড়ো হয়। ওর স্ত্রীও বছর পাঁচেক আগেই গত হয়েছেন। ওদের বাড়িটা এখান থেকে বেশ কিছুটা দূরে। ঘন্টা দুয়েক তো লেগেই যায় যেতে। আমার তো বয়স হয়েছে, যাতায়াতের অত ধকল নিতে পারি না। তাই ঠিক হল যে আমি শুক্রবার দিন রাতে ওদের বাড়িতে চলে যাব, সেদিন রাতটা থেকে পরের দিন সকালে উইলটুইল সব পড়ে সোনার জিনিস দিয়ে ফিরে আসব। চেনটা স্যাকরাকে দিয়ে কাটিয়ে নিয়েছিলাম সমান ভাবে। একটা লাল থলিতে আমার ব্যাগেই ছিল সেটা। শনিবার দিন সকালবেলা জলখাবার খেয়ে আমি জিনিসটা নিতে গিয়ে দেখি সেটা আমার ব্যাগ থেকে হাওয়া। থিওর কথা শুনেই আমি অনুমান করেছিলাম যে ওর ছেলে, মেয়ে, ভাগ্নে সবারই টাকার দরকার, আর এক টুকরো চেন পাওয়ার চেয়ে পুরোটা পেলে বেশি লাভ সেটা তো আর বলে দিতে হবে না! এমন কিছু একটা হতে পারে আন্দাজ করে আমি ম্যানুয়েলের কাছ থেকে একটা ছোট সার্ভেলেন্স ক্যামেরা নিয়ে গিয়েছিলাম। সেটা ঘরেই বসিয়েছিলাম। এখন আমি তো বাপু ওই সব ইলেক্ট্রনিক্স ইত্যাদি ব্যাপারে খুব কাঁচা। কোন রকমে ওটাকে বসিয়েছিলাম। সেটা এমন জায়গায় যে ঘরে কে ঢুকছে বেরোচ্ছে সেটা দেখা যাবে। ব্যাগটাকে আলমারিতে ঢুকিয়েছিলাম আর সেটার দিকে মুখ করে ক্যামেরাটা কিছুতেই ফিট করতে পারলাম না। মাঝের জিনিসপত্র দিয়ে ঢাকা পড়ে যাচ্ছিল পথটা। ক্যামেরাটাতে শুধু ভিডিও রেকর্ড হয়, শব্দ কিছু রেকর্ড হয় না। যাই হোক ক্যামেরা সারা সময় ‘অন’ ছিল এবং সেটাতে ওঠা ভিডিওটা প্লে করে আমি দেখলাম ওরা চারজনই আমার ঘরে ঢুকেছে। আমি ওদের সবাইকে জিগ্যেস করলাম ওরা কেন আমার ঘরে গিয়েছিল। ওদের উত্তরগুলো আমি তোমাকে বলছি, তার থেকে যদি তুমি কিছু বুঝতে পারো। তা না হলে তুমি গিয়েও ওদের সঙ্গে কথা বলতে পারো। যা হোক করে ওই চেনটা উদ্ধার করে দিতে হবে, নাহলে স্বর্গে গিয়ে আমি থিওকে মুখ দেখাতে পারব না! তাছাড়া উকিল হিসেবে আমার দায়িত্বটাও অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।”
আমি শুনেটুনে বললাম, “আচ্ছা বলুন দেখি চেষ্টা করে। আমি না পারলে কিন্তু আপনাকে পুলিশের কাছেই যেতে হবে। ও একটা প্রশ্ন ছিল, ব্যবসা আর বাড়িটা কে পেল?”
“ব্যবসা থিও বিক্রি করে দিয়েছিল প্রায় বছর তিনেক আগে। ওর শরীরে কুলোচ্ছিল না আর ছেলেমেয়েরা কেউ চায় না। ওটা বিক্রি করে টাকা সমানভাবে ভাগ করে দিয়েছিল ওদের মধ্যে। ওদের যা অবস্থা সেই টাকা হয়তো এতদিনে ওরা ফুঁকে দিয়েছে। উইলে বাড়িটা সমানভাবে চারজনের মধ্যে ভাগ করে দিয়েছিল কিন্তু ওদের মধ্যে বনিবনা নেই তাই ওই বাড়ি বিক্রি করা নিয়ে ঝামেলা আছে। কে থাকতে চায় কে বেচবে তাই নিয়ে চুলোচুলি তাই সেই পয়সা আপাতত কেউ পাচ্ছে না! উইলে কী আছে সেটা ওরা সবাই আগে থেকেই জানত। বাড়ি, চেন এই সব নিয়ে ওর পরিকল্পনা থিও ওদের আগেই বলেছিল।”
“আচ্ছা। এবার বলুন কে কী বলল।”
“থিওর দুই ছেলে রোনাল্ড (রন) আর ডোনাল্ড (ডন), মেয়ে টেসি আর ভাগ্নে ফ্রেডরিক (ফ্রেড)। এরা চারজনই আমার ঘরে ঢুকেছিল দেখেছি, কেউই বেশিক্ষণ থাকেনি। রন বলে সে আমার ঘরের জানালার ব্লাইন্ডসগুলো ঠিক করতে ঢুকেছিল। আসলে আমি বুড়ো মানুষ জানালার ব্লাইন্ডসগুলো ঠিক মতন ওঠাতে নামাতে না পেরে দড়িটড়ি বিশ্রী ভাবে পেঁচিয়ে একশেষ করেছিলাম। আমার চশমাটা বাইরের ঘরে ফেলে এসেছিলাম, ডন সেটা নিয়েই এসেছিল। ও নাকি নক করেছিল, সাড়া না পেয়ে ঘরে ঢুকে চশমা রেখে দিয়ে চলে যায়। টেসি আমার জন্যে জল নিয়ে ঢুকেছিল। আসলে আমি রাতেও প্রচুর জল খাই। সেটা নিয়ে খাবার টেবিলে কথা হচ্ছিল যে কিডনি ভাল রাখার জন্যে বেশি করে জল খাওয়া উচিত ইত্যাদি। টেসি তখন বলে, ‘ও তাহলে একটা বোতলে আপনার হবে না, ঠিক আছে আরেকটা দিয়ে দেব।’ ফ্রেড বলে সে বিকেলে আমি পৌঁছনোর আগে ওই ঘরে বসে কাজ করছিল তাই ওর ফোনের চার্জারটা ওখানেই ফেলে এসেছিল, ও সেটা নিতেই ঘরে ঢোকে। এই হল সবার উত্তর। সবাই দরকারেই গেছে অথচ চেনটা হাওয়া! আমার তো মাথা ভোঁ ভোঁ করছে! কে নিল তাহলে চেনটা?”
এতটা বলে অনিমেষ জেঠু থামলেন। হাসি হাসি মুখে রিন্টি-গুগাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, “চারজনের মধ্যে কেউ একজন মিথ্যে কথা বলছে। তোমরা বলতে পারবে কে চেন নিয়েছিল?”
রিন্টি বলল, “আমার মনে হয় চেন যে নিয়েছে সে পরিকল্পনা করেই কাজটা করেছে তাই ওদের ঘরে ঢোকার কারণগুলো দেখলেই চোর ধরা পড়ে যাবে। রন জানত না যে মিস্টার পেরেরা ব্লাইন্ডসের দড়ি পেঁচিয়ে ফেলবেন। ও সত্যিসত্যিই ওগুলো ঠিক করেছিল তো?”
অনিমেষ জেঠু মুচকি হাসলেন, “হ্যাঁ, আমিও সেটাই জিগ্যেস করেছিলাম। পেরেরা আঙ্কেল বলেন, ‘হ্যাঁ, ব্লাইন্ডস ঠিক করে দিয়েছিল রন’।”
গুগাই বলল, “মিস্টার পেরেরা যে বসার ঘরে চশমা ফেলে রাখবেন সেটাও ডন জানত না তাই ওর যাওয়াটাও পরিকল্পিত হতে পারে না। টেসিও জানত না যে উনি বেশি জল খান তাই দু বোতল জল লাগবে। একটাও বোতল না থাকলে বলা যেতে পারত যে ও ইচ্ছে করে পরে ঢোকার জন্যে জল দেয়নি!”
তারপর ওরা দুজনেই চেঁচিয়ে উঠল, “তার মানে ফ্রেড!”
রিন্টি বলল, “ফ্রেড জানত ওই ঘরে মিস্টার পেরেরা থাকবেন তাই ইচ্ছে করে আগে থেকে ঢুকে ফোনের চার্জার ফেলে রেখে এসেছিল যাতে পরে ঢোকার একটা ছুতো থাকে ওর কাছে। তার মানে ওই চেনটা চুরি করতে চাইছিল প্রথম থেকেই!”
অনিমেষ জেঠু হেসে ফেললেন, “হ্যাঁ, ঠিক বলেছো তোমরা। এর পর আরও শক্ত রহস্য দিতে হবে তোমাদের! যাই হোক গল্প এখানেই শেষ নয়। থিওডোর গোমস আশা করেছিলেন যে এই রকম কিছু একটা হবে তাই উনি আঙ্কেল পেরেরাকে বলেছিলেন যে যারা যারা চেন অসৎ উপায়ে পেতে চেষ্টা করবে তাদের অংশগুলো দিয়ে ওনার আর ওনার স্ত্রীর নামে দুঃস্থ ছেলেমেয়েদের জন্যে একটা স্কলারশিপ করে দিতে। পেরেরা আঙ্কেল পরে আমাকে বলেছিলেন, “উফফ, থিওর ইচ্ছে অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে গিয়ে কী নাকানিচোবানিই না খেলাম! ভাগ্যিস তুমি ছিলে! তবে আমি গোয়েন্দা নই বটে কিন্তু বোকাও তো নই, এত বছর ধরে ওকালতি করছি! আমি ওই অত দামি জিনিস সঙ্গে করে নিয়ে ঘুরি কখনও? ওটা আমার লকারে সুরক্ষিতই ছিল। আমি একটা মোটা স্টিলের চেনের চারটে টুকরো সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলাম লাল গয়নার থলিতে করে। কার অভিপ্রায় ভাল নয় সেটাই আমার জানার দরকার ছিল! তোমার কাছে শুনেই ফ্রেডকে আমি যখন গিয়ে চুরির দায়ে ধরলাম তখন সে রেগেমেগে চেঁচিয়ে উঠল, “ব্যাটা জোচ্চোর! স্টিলের চেন রেখে সোনার চেন নিজে নিয়ে নিয়েছে!” ব্যস, আমার কাজ সহজ হয়ে গেল। তিনটে টুকরো থিওর তিন ছেলেমেয়েকে দিয়ে বাকিটা দিয়ে আমি থিও আর রোজার নামে স্কলারশিপ করে দিয়েছি। তোমাকে যে কী বলে ধন্যবাদ দেবো তোমার সাহায্যের জন্যে!” আমি হেসে বলেছিলাম, ‘আন্টি তার হাতের রান্না কয়েকদিন রেঁধে খাওয়ালেই ধন্যবাদ দেওয়া হয়ে যাবে!’।”