ভর দুপুরের ঠা-ঠা রোদ্দুরে যতীন একেবারে কাহিল। সেই সক্কালবেলা দুটো মুড়িমুড়কি খেয়ে সে বেরিয়েছিল, সে তো কখন হজম হয়ে গেছে। সঙ্গে জলের বোতলটাও একেবারে খালি। এখনো ওর সামনে ধূ-ধূ তেপান্তরের মাঠ।
যতীন যাবে তার মাসীর বাড়ি। সেই শিয়ালপোতা গাঁয়ে। বড় রাস্তা দিয়ে গেলে অনেকটা দূর পড়ে। শটকার্ট করতে গিয়ে সে মাঠে নেমেছিল। ভেবেছিল বেলা থাকতে থাকতেই পৌঁছে যাবে। কিন্তু এ মাঠ যে শেষই হয় না।
একটা ছোট টিলার ওপর চড়তেই যতীনের নজরে পড়ল দূরে একটা ছোট্ট বাড়ি। বাড়ি না বলে কুটির বললেই হয়। ধূ-ধূ মাঠের মধ্যে একমাত্র বাড়ি। ভারি অদ্ভুত তো। তা হলেও যতীনের মনে একটু বল এল। কুটিরের এক কোণে একটু ধোঁয়ার আভাস দেখে আরও আশ্বস্ত হল — হয়তো কেউ আছে। একেবারে ভূতুড়ে পোড়ো বাড়ি নয়।
বাড়ির দোরগোড়ায় পৌঁছে আরও স্বস্তি পেল সে। ছোট হলেও বেশ ছিমছাম ঘরদোর। সামনে এক চিলতে বারান্দা। দরজায় কড়া নাড়তে একটি মাঝবয়সী মহিলা এসে দরজা খুললো। লম্বা, একহারা চেহারা, মাথায় ঘোমটা বা সিঁদুরের চিহ্ন নেই — নিশ্চয়ই বিয়ে-টিয়ে হয়নি। ত্রিশ-বত্রিশের বেশি বয়স হবে না।
— “আসুন, ভেতরে আসুন। ইস্, রোদ্দুরে মুখচোখ একেবারে শুকিয়ে গেছে।”
— “এক গেলাস জল--”
“নিশ্চয়ই। এক্ষুনি নিয়ে আসছি।”
জল খেয়ে একটু ঠান্ডা হয়ে যতীন চারদিকে চোখ বুলাল। একপাশে একটা তক্তপোশ, দু-তিনটে মোড়া, এক কোণে গুটোনো মাদুর। দেয়ালে একটা পুরনো ক্যালেন্ডার ঝুলছে। এক ধারে খোলা দরজা দিয়ে রান্নাঘরের কিছুটা দেখা যাচ্ছে। একটা ছ্যাঁকছোঁক শব্দ হচ্ছে। হয়তো মেয়েটি কিছু রান্না করছিল।
— “এই জায়গাটার কী নাম যেন?” যতীন কথা চালাবার চেষ্টা করল।
— “গঁদখালি।”
— “এখান থেকে শিয়ালপোতা কতদূর পড়বে?”
— “বেশি নয়। মাইল দু-তিন হবে।”
— “আচ্ছা, আপনি এখানে একলা থাকেন? এমন সুনসান জায়গায়?” যতীন জিগ্যেস না করে পারল না।
— “একদম একলা নই। আত্মীয়স্বজনরাও যাতায়াত করেন সব সময়। তাছাড়া আপনার মত পথ-ভোলা পথিকও কখনো সখনো--” — মেয়েটি একটু হাসলো। হাসলে ওর একটি গজদন্ত বেশ পরিষ্কার দেখা যায়।
— “আপনাকে ব্যস্ত করলাম। আমি একটু বিশ্রাম করেই বেরিয়ে পড়বো।”
— “না, না। সেকি কথা। দুপুরে খাওয়াদাওয়া সেরে তারপর না হয়। ইচ্ছে করেন তো চান করে নিতে পারেন। ঠান্ডা জল তোলা আছে। রান্নাও প্রায় হয়ে এল। বিকেলে রোদটা একটু পড়লে বেরিয়ে পড়বেন। অন্ধকার হওয়ার আগেই পৌঁছে যাবেন।”
আরাম করে ঠান্ডা জলে চান করে নিল যতীন। রান্নাঘরের দরজাটা একটু ফাঁক। দেখা যাচ্ছে মেয়েটি পিছন ফিরে বসে উনুনে কিছু নাড়ছে খুন্তি দিয়ে। যতীন সে দিকে তাকিয়ে আনমনে ভাবতে লাগল, কি আশ্চর্য মানুষ — একলা এই তেপান্তরের মাঠে থাকে। দিনদুপুরে তার মত অজানা, অচেনা লোককে আশ্রয় দেয়। প্রাণে কি ভয়ডর কিছু নেই? ঘরদোর তো বেশ অবস্থাপন্ন বলেই মনে হয়। স্বামী নেই, অবিবাহিতা, চাকরি-বাকরিও করে বলে মনে হয় না। ওর চলে কী করে? শিয়ালপোতায় গিয়ে মাসীকে একটু জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। স্বাভাবিকভাবেই একটা কৌতূহল দানা বাঁধছে ওর মনে।
যতীন রান্নাঘরের দিকে তাকিয়ে এইসব ভাবছে হঠাৎ সে লক্ষ করল যে মেয়েটি হাত বাড়িয়ে আশেপাশে কিছু খুঁজছে। না পেয়ে সে সামনে জানলার দিকে হাত বাড়ালো। তারপর...ওমা! একী কাণ্ড! তার হাতটা জানলা পেরিয়ে বাইরে চলে গেল লম্বা হয়ে! সেটা বেড়ে চলেছে তো বেড়েই চলেছে জানলার গরাদ পেরিয়ে, বাইরের বারান্দা ছাড়িয়ে সামনের লেবু গাছ পর্যন্ত চলে গেল হাতটা। মট মট করে দু-তিনটে লেবু ছিঁড়ে হাতটা আবার গুটিয়ে রান্নাঘরে ফিরে এল আগের আকারে!
যতীন তো থ হয়ে গেছে। তার নি:শ্বাস পর্যন্ত পড়ছে না। একি দেখল সে? চোখের ভুল নয়তো? না, আর সব কিছুই সে চোখে পরিষ্কার দেখছে। তবে কি এসব স্বপ্ন? সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘুমোচ্ছে? নিজের হাতে চিমটি কাটল। না:, সে জেগেই আছে। লক্ষ করে দেখল মেয়েটি বসে বসেই হাতটা একটু বাড়িয়ে এদিক ওদিক থেকে বাসন, মশলার কৌটো ইত্যাদি আনছে, সরিয়ে রাখছে — তাহলে মেয়েটি কি ডাইনী, প্রেতিনী কোনোরকম জাদুকরী? তাই কি সে একলা এখানে থাকতে পারে? তার নিশ্চয়ই কোনো অন্য মতলব আছে। সেইজন্যেই যতীনকে এত আদরযত্ন দেখাচ্ছে।
যতীন খুব আস্তে আস্তে, সাবধানে, একটুও শব্দ না করে ওর জুতোজোড়া পায়ে গলিয়ে নিল, তারপর ব্যাগটা বগলে করে নি:শব্দে দরজা খুলে বাইরে পা দিয়েই দে দৌড়! যত দূর যাওয়া যায়। নি:শ্বাস বন্ধ করে দৌড়চ্ছিল সে। পিছন ফিরে তাকাতেও ভয়। ঐ লম্বা হাতটা হয়তো তার পেছনে তাড়া করে আসছে। লম্বা থেকে আরও, আরও লম্বা হয়ে...
সম্পাদকের ঘোষণাঃ এই সূত্রে 'পরবাস' আপনাদের সবাইকে আহ্বান জানাচ্ছে এই মূল অংশটুকু অবলম্বন করে পরবাসের জন্যে আপনার নতুন লেখা পাঠান। ভয়ের, হাসির, যে-কোনো রসের, বা যে-কোনো আঙ্গিকের (গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ) লেখাই বিবেচনা করা হবে প্রকাশের জন্যে। আরো একটা অনুরোধ, কোথায় এই গল্পটা পড়েছেন, বা শুনেছেন সেটাও জানতে ইচ্ছে করছে সকলের কাছ থেকে।