আমরা একটা নতুন ফ্ল্যাট কিনছি! মা-বাবা তো সারাদিন বাড়িটা ঘুরে ঘুরে দেখছে! ওরা এত খুশি যে বলার কথা নয়। আমিও খুউব খুশি। এবার আমি যত খুশি ঘরের মধ্যে খেলে বেড়াতে পারব কারণ এবার যে চেয়ারগুলো আমরা কিনব, সেগুলোর কোণগুলো একদম ধারালো হবে না। সুতরাং কোনো চিন্তা নেই। তবে এত আনন্দেও আমি আমাদের পুরোনো ফ্ল্যাটটাকে কক্খনও ভুলব না। সেই বাড়িতে এক অপূর্ব কারুকার্য করা কাঠের ফ্রেমের জানলা ছিল। মা বলত এই জানলা এমনি জানলা নয়, এ জাদু করা জানলা। ওখান দিয়ে অনেক কিছু দেখা যেত। আর এখন যাঁরা থাকবেন তাঁরাও নিশ্চয় দেখতে পাবেন! জানলা দিয়ে বাইরে তাকালেই প্রথম দেখা যেত বিশাল একটা ডালপালা-মেলা বটগাছ। একটা খুব লম্বা ডাল যেটাকে মা বেড়ালের পা বলত, সেটা একটা বীভারের সামনের দাঁতের মতো বেড়ে বেড়ে শেষপর্যন্ত আমাদের জানলায় এসে ঠেকেছে। মাঝে মাঝে আমরা জানলার দুটো পাল্লাই খুলে দিতাম, তখন বটগাছটা আমাদের দিকে আরও সরে আসত। আর সেই সময় আমাদের বাড়িটা একটা সবুজ আভা গায়ে মেখে দাঁড়িয়ে থাকত। সোনালি সূর্যের আলো ঘরের ভেতর ভেসে বেড়াত। মা বলত — ‘মনেই হয় না আমরা শহরে আছি!’ শীতকালের ঠিক আগে যখন সব পাতা গাছ থেকে ঝরে পড়ত, তখন আরেকরকম সুন্দর লাগত আমাদের ফ্ল্যাটটাকে। আরও নানারকম ব্যপার হত, যেমন সেই বেড়ালের পা অনেক নাম-না-জানা পাখিকে তার গায়ে বসার জন্য জায়গা করে দিত। ‘কেমন আছ? সব কুশল তো!’ — মা বলত। আমরা জানলার কাঠে অনেক বীজ ফেলে রাখতাম। অবশ্য আমাদের অতিথিরা বেশি দেরি করত না, নেচে গেয়ে ঘুরে নানারকম ভঙ্গি করত ওরা। মা বলত — ‘বাঃ, বেশ সুন্দর লাগছে তো!’ মা ঠিকই বলত, সত্যি সুন্দর লাগত। তাদের কালো ঠোঁট, কালো বুক, সবুজ পিঠ আর সুন্দর ডানা ছিল। তারা কখনো খাবারের উপর সবাই মিলে ঝাঁপিয়ে পড়ত না। তারা ছিল খুব ভদ্র। একজনের পর একজন এসে একটা করে বীজ তুলে নিয়ে বেড়ালের পায়ে বসে তারিয়ে-তারিয়ে খেত। শুধু কিছু চড়ুই পাখি খাবার নিয়ে কাড়াকাড়ি করত। রোজ মা তাদের মিষ্টি ধমক দিত। ‘একটু শেখো, চড়ুইরা!’ — মা বলত। একটা নাম-না-জানা পাখির নাম আমি দিয়েছিলাম হোঁৎকা, কারণ তার লেজ ছিল না। হয়তো বেড়ালের খপ্পরে পড়েছিল। কিন্তু বিনা লেজে তাকে বিন্দুমাত্র খারাপ দেখাত না। একদিন হোঁৎকা জানলায় বসে বীজ খাচ্ছিল। হঠাৎ আরেকটা নাম-না-জানা পাখি হুস করে এসে ওকে একটু ঠেলে সরিয়ে দিয়ে নিজে বীজ খেতে বসে গেল। এই পাখিগুলো কখনো এরকম করে না। কিন্তু এই পাখিটা... ‘ওঃ কী বস্ বস্ ভাব’ — মা হেসে বলেছিল সেদিন। আমি একটু রেগে গিয়েছিলুম পাখিটার উপর বললুম ‘বা রে ! হোঁৎকাকে একটাও বীজ নিতে দিল না’। কিন্তু মা বলেছিল ‘বেশ হয়েছে ও যে লাইন ভেঙেছিল, তার বেলা!’ সেদিন থেকে বসের উপর চোখ রাখতে শুরু করেছিলাম। যাই বলো বস্কে দেখতে মন্দ ছিল না। অন্যদের থেকে একটু বড়ো সড়ো গোছের ছিল সে। অন্য পাখিদের মতো কুচকুচে কালো মাথা ছিল না তার। একটা হলুদ ফোঁটা ছিল কপালের একটু উপরে। দেখে মনে হত কোনো বাচ্চা দুষ্টুমি করে আঙুলের ছাপ দিয়ে দিয়েছে। আমাদের আরও অনেক অতিথি ছিল। যেমন দাদি, যার লেজের দিকের পালকগুলো ঠিক আমার দিদার শালের মতো লাগত। তারপর ছিল দাড়িওয়ালা, যাকে সবসময় খুব অগোছালো আর এলোমেলো লাগত। যখন তাকে দেখতাম তখন কেন জানি আমাদের প্রতিবেশী মারিঙ্কার কথা মনে পড়ত, যে সবসময় চান করার পর চুল উল্টো দিকে আঁচড়াত। একদিন খুব জোর হাওয়া দিল। তাতে জানলার দুটো পাল্লাই বন্ধ হয়ে গেল আর ওপর থেকে কাঠের খিলটা পড়ে গেল দুটো পাল্লার মধ্যে। ঠিক যেন একটা কাচের কুয়োর ভেতর পড়ে গেছে। আর বীজগুলো তো পড়েই গেছে। আমরা জানলাটা খুলতেই পারলাম না, কারণ সেটা শীতকাল ছিল আর বরফ পড়ছিল। তাই জানলার দুটো পাল্লাই জমে গেল। কী হবে? আমি ভাবছিলাম মনে মনে। যখন অনেক দেরি হয়ে গেছে তবুও জানলা খোলার নাম গন্ধ নেই তখন ব্যস্ত হয়ে বাবা মা-ও ভাবতে বসল। যখন আমরা এসব ভাবছি তখন হঠাৎ টাফটির দেখা। খুব জোরে উড়ে এসে বসল জানলার ও পাশের দিকটায়। সে কিন্তু একদম অলস নয়। সঙ্গে সঙ্গে ঠোঁট দিয়ে বরফ ঠুকতে লাগল। তার দেখাদেখি আরও অনেক পাখি উড়ে এসে কাজে লেগে গেল। বেশিক্ষণ লাগল না, মাত্র পনেরো মিনিট। ‘বেশ তুখোড় বুদ্ধির পাখি তো!’ — মা বলেছিল।
আমাদের আগের ফ্ল্যাটে সকালের মজাই ছিল আলাদা। বিশেষ করে রোববারের সকালে যেদিন মা বা বাবা কাউকেই চাকরির জন্য যেতে হত না। চুপটি করে শুনতাম পাখির মিঠে গলার ডাক। মা বলত — ‘শোন, শোন, কীসের আওয়াজ বল তো?’ বলতাম — ‘কীসের মা?’ মা বলত — ‘ওরা মোজা বুনছে রে মোজা। নর্থ পোলে যাবে কি না!’ তারপর যখন বরফ পড়ত, মা বলত — ‘ওই শোন! টিং টিং টিং যেন বৃষ্টি পড়ছে একটা ছোট্ট পুকুরে, তাই না রে?’
‘বৃষ্টি এখন কোত্থেকে পড়বে?’ — বাবা বলত।
‘আহা, কল্পনা তো!’ — আমি বলতাম।
বাবা বলত — ‘আরে কল্পনা তো ভালোই করছ, কিন্তু বাইরে বরফ যে জমে যাচ্ছে। সেটা দেখেও কল্পনা করতে পারো?’ জমলই বা বরফ তাতে আমাদের কী? নাম–না-জানা পাখিগুলো তো কেবল এক কথাই বলছে — বসন্ত তার গান লিখে যায় ধূলির পরে কী আদরে বসন্ত তার গান...
‘বাঃ মেয়েরা, তোমাদের কল্পনাশক্তি তো বেশ ভালো!’ — বলত বাবা। একদিন পাখিগুলোর চিৎকার শুনে জানলার বাইরে তাকিয়ে দেখি আমার সমবয়সী একটি অচেনা ছেলে। সে মুখটা নিচু করে হাঁটছিল কিন্তু তবুও আমায় ওর দেখতে পাওয়া উচিত ছিল। যাইহোক ও কিন্তু আমায় দেখল না। আর কি সাংঘাতিক, ওর হাতে একটা পাখি ধরার জাল আর একটা খাঁচা! ও নানারকম সুর এবং আওয়াজ করে পাখিদের ভোলানোর চেষ্টা করছিল। আমি উঠোনে ছুটে গেলাম। পেছনে মা-ও। তবে তখন ছেলেটি একা ছিল না। আমাদের পাশের বাড়ির দাদু ওকে খুব রেগে গিয়ে বলছিলেন — ‘আমরা রোজ পাখিগুলোকে খাওয়াই, সবসময় খুশি রাখতে চাই আর উনি এলেন খাঁচা হাতে!’ নিজেকে আর সামলাতে পারলাম না। চেঁচিয়ে বললাম — ‘তোমার সাহস কী করে হয় পাখি ধরার? এত নিরীহ জীবকে ধরতে কষ্ট হয় না তোমার?’ কিন্তু মা আমার জামা ধরে টেনে কানে কানে বলল — ‘শুধু চেঁচালে লাভ হবে না। ওকে বোঝানো দরকার।’ বলে ঐ ছেলেটিকে বলল — ‘দেখো বাবা, আমরা এখানে একটি অভয়ারণ্য গড়ে তুলেছি।’
‘হ্যাঁ, তাতো দেখতেই পাচ্ছি!’ — ছেলেটি অবিশ্বাস্য ভাবে বলল।
‘তাই নাকি মা’ আমি উৎসাহের সঙ্গে জিগ্যেস করলাম। ‘হ্যাঁ বইকি! সেটাই তো এতক্ষণ বোঝানোর চেষ্টা করছি। দেখো, এই মিষ্টি পাখিগুলো আমাদের ভরসা করে। এবার আমরাই যদি এদের বন্দি করি এরা আর কাকে ভরসা করবে?’ ছেলেটা বরফে পা দিয়ে গভীর ছাপ ফেলে ফিসফিস করে বলল — ‘অভয়ারণ্য হলে তো দারোয়ান রাখা উচিত আর প্রবেশ নিষেধ লিখে দেওয়াও’। দাদু বলল — ‘কি বললে? একটু জোরে বলো, লজ্জা কীসের? ও দারোয়ান? কিন্তু যদি তুমি নিজের বিবেক অনুসরণ করে যাও সেটাই ভালো হবে নাকি?’ মা বলল— ‘ঠিকই তো। কখনও দেখেছ একটা গাছের ডালে একটা প্যাঁচা বসে চোখ মিটমিট করছে তাও আবার দিনের বেলা?’
‘আমি দেখেছিলাম একবার’ — ছেলেটাও ওভাবে চোখ মিটমিট করলে। তারপর খাঁচা বগলে সে চলে গেল। সেই বাড়িটা এখন ভেঙে একটা বড়ো ফ্ল্যাট হয়েছে। আমরাও নতুন বাড়িতে চলে এসেছি। এখানে জানলা অব্দি কোনো বটগাছ উঠে আসেনি। তবে মা বলে — ‘আকাশ-তারা-মেঘগুলো তো সব আমাদের।’
‘আর পাখিগুলো ?’ — জিগ্যেস করলাম আমি।
‘ওরা এখন গরমের জন্য জঙ্গলে আছে। কিন্তু দেখা যাক শীতের আগে কী হয়।’ — মা বলল। যদি আমাদের এখানেও ওরকম জানলা থাকত, তাহলে খুব তাড়াতাড়ি অতিথিরা আসত। কিন্তু আমি জানি এবার ওরা অন্য জানলায় গিয়ে বসবে। তোমরা দেখলেই চিনতে পারবে। তবে মনে রেখো ওরা মা-দের ভরসা করে।
(গল্পটি K KIRSHINA-র THE YARD of TAMING BIRDS-এর অনুবাদ। বইটির প্রকাশক "প্রগ্রেসিভ পাবলিশার্স"; মস্কো। ছোট্ট অনুবাদকের মন্তব্য গল্পটিতে যে গানের লাইন ব্যবহৃত হয়েছে ‘বসন্ত তার গান’, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন।)