বাঁশের মত লম্বা, এক মাথা কাঁচা-পাকা ঝাঁকড়া চুল, চোখ দুটো উজ্জ্বল, টিকালো নাক, থুতনিতে ফ্রেঞ্চ কাট দাঁড়ি, মিশমিশে কালো, জিন্সের প্যান্ট, রঙিন টি শার্ট আর সানগ্লাস পরা ছিপছিপে কাকুটার নাম ডেভিশ। আমাদের পাড়ায় থাকে। এই কাকুটা খুব বড় ফটোগ্রাফার। সিনেমায়, টিভি সিরিয়ালে কাকুর নাম দেখা যায়। বাবার সঙ্গে খুব ভাব। আমাদের বাড়িতেও এসেছে অনেকবার।
আজ বাবা হঠাৎ মাকে এসে বলল, ডেভিশের সঙ্গে পথে দেখা হয়েছিল। ও একটা অদ্ভূত প্রস্তাব দিল, ও নাকি কোন এক বড় কোম্পানির বাংলা ক্যালেন্ডার শ্যুট করবে। বিষয়টা খুব ইন্টারেস্টিং- আমাদের ছেলেবেলার হারানো খেলাধূলো। তাই কিছু ছোট ছেলে-মেয়ে দরকার। ও বলল, চিন্টুর কথা।
মা আমাকে টিফিন খেতে দিচ্ছিল। আনন্দে হেসে উঠে বলল, তাই নাকি! দারুণ ব্যাপার তো। চিন্টু শ্যুটিং করবে!
আমি তো অবাক। কিছুই ঠিক বুঝতে পারছি না। বাবা আবার বলল, ‘ডেভিশ বলল, মাত্র তিনদিনের শ্যুটিং। পড়া শোনার কোনও ক্ষতি হবে না। গঙ্গার ধারের এক সুন্দর বাগান বাড়িতে শ্যুটিং হবে। অল্প পারিশ্রমিকও দেবে!......
মা তো এবার আরও খুশি। আনন্দে হেসে বলল, তুমি আবার না বলে দাও নি তো?
বাবা হেসে বলল, কিছুই বলি নি!
তুমি ফোন করে জেনে নাও, কবে শুরু হবে ওদের শ্যুটিং? আর চিন্টুকে কি করতে হবে? মা ভীষণ ব্যস্ত হয়ে উঠল।
আমি স্যান্ডউইচ খাচ্ছি। মা আমার দিকে চেয়ে বলল, চিন্টু শুনলি তো দারুণ খবর। ডেভিশকাকু তোকে নিয়ে শ্যুটিং করবে। কি মজা বল তো!
আমি ভালো করে কিছুই বুঝতে পারছি না। তাই বললাম, আমি তো কোনদিন অভিনয় করিনি। শ্যুটিং কেমন করে হয় জানি না। পারব?
কিচ্ছু ভাবতে হবে না তোকে। ডেভিশ কাকু সব বলে দেবে। মা আরও একটা স্যান্ডউইচের পিস আমার প্লেটে দিয়ে বলল, বাবা, ফোন করে জেনে নিক, তোকে কি করতে হবে? তারপর আমি সব শিখিয়ে দেব।........
স্যান্ডউইচ খেতে খেতে ভাবছি, বাহ্, দারুণ ব্যাপার তো! আমি শ্যুটিং করব! যাই ঠাম্মাকে ছুটে গিয়ে খবরটা দিয়ে আসি।.....
।। দুই।।
পরপর দু’দিন ওয়ার্কশপ হল। পরিচালক সুবীর স্যার সব বুঝিয়ে দিয়েছেন। অ্যাসিস্টেন্ট ডিরেক্টর বাবলা স্যারও সঙ্গে ছিলেন। বাংলা বারো মাসের জন্য বারো পাতার ক্যালেন্ডার হবে। সুবীর স্যার প্রথমেই জিজ্ঞাসা করেছিলেন বাংলা বারো মাসের নামগুলো। কেউ সব নাম বলতে পারে নি। সুনয়না বলেছিল, পরপর পাঁচটা নাম। বাকিরা সবাই এলোমেলো ভাবে দু’তিনমাসের নাম বলেছে। একদম কিচ্ছু বলতে পারে নি অরণ্য। চিন্টুও বলেছে মাত্র বৈশাখ, জৈষ্ঠ, আষাঢ়....আর মনে আসে নি কোনও নাম।
বারো মাসের নামগুলো সুবীর স্যার সবাইকে প্রথমে শেখালেন। তারপর বললেন, শ্যুটিংয়ের দিন সবাইকে বলতে হবে পরপর নামগুলো। যে পারবে না, সে শ্যুটিং থেকে বাদ চলে যাবে।
আজ ফাইনাল শ্যুটিং। চিন্টু ভালো করে মুখস্থ করে এসেছে। বাড়িতে বারবার বলেছে। ঠাম্মাকে শুনিয়েছে। মাও মাঝে মাঝে জিজ্ঞাসা করেছে, চিন্টু একদম ঠিক ঠিক বলতে পেরেছে।
বারোটা হারানো খেলার গল্প নিয়ে আজ ফাইনাল শ্যুট। খেলাগুলোর নাম চিন্টু দু’একটা জানত, বাকিগুলো প্রথম শুনল। দল বেঁধে দু’দিন খুব খেলা হল। ওয়ার্কশপে দারুণ মজা হল। শ্যুটিংয়ের বন্ধুদের সঙ্গে ভাবও হয়ে গেছে খুব।
আর্য, বলাকা, অর্ক, অরণ্য, অপু, সুনয়না, বিক্রম, সুছন্দা, বৃষ্টি এরা সবাই চিন্টুর শ্যুটিংয়ের বন্ধু। সবাই মিলে দু’দিন ধরে হৈ হৈ করে বারোটা খেলা শিখল, খেলল। সুবীর স্যার, বাবলা স্যার বলে বলে দিয়েছেন- কিভাবে দৌড়বে, কিভাবে খেলবে, কিভাবে হাসবে, কথা বলবে, চিৎকার করবে সব। কাল পিট্টু খেলতে খেলতে খুব একটা হাসির ব্যাপার হল। ডাংগুলি খেলাটাও খুব মজার। চাক্কা চালাতে দারুণ লাগছিল। পুতুল বিয়ের গানটা তো খুব সুন্দর। কানামাছি খেলতে খেলতে হেসে পেট ব্যথা হয়ে গেছে। কাঁচের গুলি নিয়ে কি কাড়াকাড়ি সবার। কিৎ কিৎ খেলতে পা ব্যথা হয়ে গেছে। চোখ বেঁধে লুকোচুরি খেলাটাও দারুণ মজার।
।। তিন।।
শ্যুটিং হচ্ছে এক বিশাল বাগান বাড়িতে। খুব সুন্দর বাগান বাড়িটা। সবুজ একটা মাঠ আছে। পুকুর আচ্ছে। পুকুরে রাজহাঁস খেলছে। পদ্মফুল ফুটে আছে। দোলনা আছে দুটো। পাখি আছে অনেক। কত ফুল গাছে গাছে। সব বন্ধুরা চলে এসেছে। অরণ্য এখনও এল না। চিন্টু ভাবছে, অরণ্যর কি বারো মাসের নামগুলো মুখস্থ হয় নি তাহলে !......
সুবীর স্যার লাইট, ক্যামেরা রেডি করছেন। বাবলা স্যার খেলার গুলি, ডাংগুলি, চাকা, বল সব সাজিয়ে ফেলেছেন। ডেভিশ কাকু ক্যামেরা নিয়ে ব্যস্ত। আর দশ মিনিট পর শ্যুটিং শুরু হবে। চিন্টু হঠাৎ দেখতে পেল বাগানের গেটের কাছে একটা ট্যাক্সি এসে থামল। সেই ট্যাক্সি থেকে অরণ্য নেমে দৌড়ে আসছে। পেছনে ওর মা। বন্ধুরা সবাই আনন্দে হৈ হৈ করে উঠল, ‘স্যার, অরণ্য চলে এসেছে!’
অরণ্য এসেই কেমেন নেচে-গেয়ে বলতে শুরু করল, ‘বৈশাখ-জৈষ্ঠ গরম বড়। আষাঢ়.শ্রাবণ বৃষ্টি ঝর ঝর/ ভাদ্র-আশ্বিন পুজোর আনন্দ, কার্তিক-অঘ্রাণ নতুন গুড়ের গন্ধ/পৌষ-মাঘ ভীষণ শীত, ফাল্গুন-চৈত্র গাজন গীত’।
চিন্টুর বন্ধুরা তো সবাই অবাক। সুবীর স্যার, বাবলা স্যার আনন্দে হাততালি দিয়ে বলল, সাবাশ, সাবাশ। অরণ্য, কে শেখাল তোমায় এমন সুন্দর ছড়া-গান?
অরণ্য হেসে বলল, আমার দাদু শিখিয়েছে স্যার।
দারুণ, দারুণ হয়েছে। ডেভিশ কাকু জোরে হাততালি দিয়ে বলল, অরণ্য, আর একবার বল, তো শুনি।......
সুবীর স্যার বলল, তোমরা সবাই এই ছড়াটা শিখে নাও।
এবার সবাই একসঙ্গে অরণ্যর ছড়াটা বলতে শুরু করল,
‘বৈশাখ-জৈষ্ঠ গরম বড়, আষাঢ়-শ্রাবণ বৃষ্টি ঝর-ঝর.......
।। চার ।।
দু’দিন ধরে ওয়ার্কশপ এত ভালো হয়েছিল যে আজ ফাইনাল শ্যুটিং সবই ওয়ান টেকে ফিনিশ হয়ে যাচ্ছে। চিন্টুরা সবাই দারুণ করছে। সুবীর স্যার মনিটরে চোখ রেখে দেখছেন আর ওকে। থ্যাঙ্ক ইউ। থ্যাঙ্ক ইউ বলছেন।
বারো মাসের বারোটা হারানো খেলার শ্যুট্ সত্যিই অনেক কম সময়ে, কম শট নষ্ট করে হয়ে গেল। ডেভিশ কাকুও খুশি।
শ্যুটিং-এ সবার মা এসেছেন। ওরা সবাই গোল হয়ে এক জায়গায়। বসে গল্প করছেন। লাঞ্চ ব্রেক চলছে। লাঞ্চের পর প্যাক আপ ঘোষণা হবে অর্থাৎ শ্যুটিং শেষ।
চিন্টু শ্যুটিংয়ের বন্ধুদের সঙ্গে সবুজ মাঠটাতে খেলছে। ওরা কোন দিন কেই এইসব খেলার নাম জানত না। খেলতেও জানত না। এখন সবাই হারানো খেলাগুলোর নাম জেনে খেলাগুলোও শিখে ফেলেছে। তাই আনন্দে ওরা এই খেলাগুলোই খেলতে শুরু করেছে। খেলা নিয়ে মেতে উঠেছে।
এখন দলবেঁধে কানামাছি খেলছে। বৃষ্টির চোখ বেঁধে দিয়েছে। বৃষ্টি হাত বাড়িয়ে ওদের ধরার চেষ্টা করছে। সবাই দৌড়ে দৌড়ে পালাচ্ছে। আর ছড়া বলছে, ‘কানামছি ভোঁ ভোঁ যাকে পাবি তাকে ছোঁ’...
বৃষ্টি কাউকেই ছুঁতে পারছে না। খেলা জমে উঠেছে। হো হো করে সবাই হাসছে।
সুবীর স্যার প্যাক আপ ঘোষণা করার জন্য সবাইকে ডাকতে বললেন। বাবলা স্যার জোরে ডাকলেন, তোমরা সবাই চলে এসো এবার.....
ওরা কেউ শুনতেই পেল না! ওরা ওদের মতই খেলছে। খেলা নিয়ে মশগুল হয়ে আছে।
সুবীর স্যার অল্প অল্প হাসছেন। বাবলা স্যার আবার ডাকলেন, চলে এসো সবাই।
এবারও ওরা কেউ শুনতেই পেল না। ওরা খেলছে। ওরা হাসছে।
সুবীর স্যার এবার যেন বেশ মজা পেয়ে হাসলেন। ডেভিশ কাকুও খুশির ছহলে হাসলেন। মায়ের দল চুপ। বাবলা স্যার বিরক্ত হয়ে বললেন, কি করি বলুন তো?
সুবীর স্যার হেসে হেসেই বললেন, ওরা তো আমাদের হারানো খেলাগুলোই খেলছে। খেলুক না একটু। আমরা বরং আরেকটু বসি।......
শ্যুটিংয়ের বন্ধুরা হৈ হৈ করে হারানো দিনের খেলায় মেতেই আছে। হঠাৎ ডেভিশ কাকু ওদের কাছে ছুটে গিয়ে বললেন, আমায় নিবি তোদের দলে?
হ্যাঁ-হ্যাঁ, নেব। সবাই আনন্দে চিৎকার করে বলল।
ডেভিশ কাকু ওদের সঙ্গে খেলায় মেতে গেল। একটু পরেই সুবীর স্যার, বাবলা স্যারও চলে এলেন খেলতে। ওরা আর বসে থাকতে পারলেন না। এবার সবাই মিলে হারানো খেলার আনন্দে মেতে হারিয়েই গেল। মায়ের দল দূরে দাঁড়িয়ে খুব হাসতে হাসতে হাততালি দিতে লাগলেন।
প্যাক্ আপ ঘোষণা করা আর হলই না!.....