প্যারাসেইলিং-এর ডানায় ভাসতে ভাসতে একসময় বিধানবাবু সবুজ সমুদ্রের মাঝখানের ওই অপূর্ব সুন্দর দ্বীপটায় টুক নেমে পড়লেন।
বিধানবাবু যাকে বলে এক্কেবারে ছাপোষা বাঙালি। বিবাহিত, দুটি সন্তান, সরকারী চাকরি; ভবানীপুরে পৈত্রিক বাড়িতে থাকেন গত ছেচল্লিশ বছর ধরে। রবিবার সকালে শ্রীহরির দোকানের ডাল-কচুরি খান, মাসে একটি করে হিন্দি ছবি (শাহরুখ হলেই বেশি ভালো হয়) দেখেন আর বছরে একটি বার সিমলা-কুলু-মানালি-পুরী গোছের নির্ঝঞ্ঝাট জায়গায় সপরিবারে বেড়াতে যান। কোন কালে এই সব বিপজ্জনক “অ্যাডভেনচার স্পোর্টস” করেন নি। এই প্রথম পরিবার-বিনা কলেজের বন্ধুদের সঙ্গে ২৫ বছরের রিইউনিয়নে গোয়াতে বেড়াতে এসেছেন। আর এইখানেই জীবনে প্রথম প্যারাসেইলিং করতে গিয়ে এই কাণ্ডটা ঘটলো।
প্যারাসেইলিং করতে হয় নৌকোর ওপর থেকে। নৌকো মানে একটি বিশাল স্পীডবোট গোছের জিনিস। তার ওপরে ওই প্যারাসেইলিংএর রংচঙে প্যারাসুট, যাতে বাঁধা থাকে যিনি চড়তে চান, তিনি। প্যারাসেইলিং-এর প্যারাসুটটার পোশাকি নাম প্যারাসেইল উইং — অর্থাৎ ডানা। হাওয়ার ধাক্কায় প্যারাসেইল উইং ডানা মেলে উড়ে যেতে চায় — বাধা কেবল স্পীডবোটের সঙ্গে বাঁধা ওই লম্বা দড়িটা। স্পীডবোটটা এগিয়ে যেতে থাকে, আর তার লেজে বাঁধা হয়ে হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে চলে এই প্যারাসেইলের ডানা। তার সঙ্গে যিনি এই ডানায় বাঁধা আছেন, তিনিও। এক্ষেত্রে বিধানবাবু।
দিব্যি উড়ছিলেন বিধানবাবু। ভিজে আকাশ মুখে মেখে সীমাহীন সবুজ-নীল সমুদ্রের ওপর দিয়ে ভেসে যাওয়া। পাখিদের মতন। একসময় একটা সাদা মেঘ আচমকা ভেসে এসে ওনাকে ঘিরে ধরলো। ঝলমলে রোদমাখা আকাশে আবার মেঘ এলো কোথা থেকে ভাবতে ভাবতে হঠাৎ বিধানবাবু খেয়াল করলেন যে প্যারাসেইলিং-এর দড়িটা আর স্পীডবোটটার সঙ্গে বাঁধা নেই। উনি এমনিই ভেসে চলেছেন হাওয়ায়। মেঘ কেটে গেছে। ওনার পায়ের নিচে শুধু আদিগন্ত ঢেউ। আর কিচ্ছু নেই।
আর তার চেয়েও অবাক কাণ্ড যে বিধানবাবুর একটুও ভয় করছে না। বাপের জম্মে এই ধরনের কিছু না করলেও বেশ লাগছে। একটা আচ্ছন্ন অনুভূতি। নেশায় বুঁদ হয়ে থাকার মতন।এই ভাবে ভাসতে ভাসতে এসে পড়লেন সবুজে মোড়া দ্বীপটার কাছে। আশ্চর্য সুন্দর একটা দ্বীপ।
“আসুন স্যার” — স্পষ্ট বাংলা স্বর শুনতে পেয়ে ঘাড় ঘোরালেন বিধানবাবু। একটি গোলগাল চেহারার টাক মাথা লোক হাসি হাসি মুখে ওঁর দিকে এগিয়ে আসছে।
“আসুন স্যার। আমার নাম জাহরি আহমেদ শাহ। জাহরি বলেই সবাই ডাকে।”
“নমস্কার। আপনি কি বাঙালি নাকি?” জিগ্যেস করলেন বিধানবাবু।
“না স্যার। মালয়েশিয়ার লোক। তবে আমাদের এখানে তো ভাষার কোন সমস্যা নেই। আপনা আপনি অনুবাদ হয়ে যায়। আমি যেমন মালয় ভাষায় কথা বলছি, আপনার কানে সেটা আপনাআপনি বাংলা হয়ে যাচ্ছে।”
এই অদ্ভুত কথাটা শুনেও বিধানবাবু অবাক না। এই আশ্চর্য সুন্দর দ্বীপ, চারপাশে সবুজ জল আর বয়ে যাওয়া সুবাতাস কেমন একটা ভালোলাগা ছড়িয়ে দিয়েছে সারা শরীরে। মনে হচ্ছে এই জায়গায় এরকমই কিছু হবার কথা।
জাহরির সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে এদিক ওদিক তাকাচ্ছিলেন বিধানবাবু। দ্বীপটায় একসময় লোকালয় ছিলো বোঝা যায়। জঙ্গলের মধ্যে কিছু পুরনো কলকাতার থামওয়ালা বাড়ি দেখা যাচ্ছে। পরিত্যক্ত, শ্যাওলা ধরা — কিন্তু বাসযোগ্য। আরেকটু এগিয়ে দেখলেন জঙ্গলের মাঝখানে একটা ফাঁকা জমি — আর সেখানে একটা প্রমাণ সাইজের প্লেন রাখা আছে। যদিও এয়ারপোর্ট রানওয়ে-টানওয়ে কিচ্ছু নেই কোথাও।
প্লেনটার দিকে আঙুল দেখিয়ে বিধানবাবু জিজ্ঞেস করলেন “এটা এখানে এলো কি করে?”
“আমিই তো ওটার পাইলট ছিলাম স্যার। শেষ দিন অব্দি আমিই চালিয়েছি ওটাকে। তবে আমিই এখানে এনেছি, তা অবশ্য বলা চলে না।” বললো জাহরি।
“এই জায়গাটা কি বলুন তো? ঠিক বুঝতে পারছি না—” বললেন বিধানবাবু।
“এই জায়গাটার আসলে কোনো নাম নেই, স্যার। আপনাদের বাংলার এক সাহিত্যিকের একটা বই থেকে ধার নিয়ে আমরা এর নাম দিয়েছি দিকশূন্যপুর। আপনিও তাই বলে ডাকবেন নাহয়।”
বিধানবাবু একটু ভাবলেন। তারপর একটু কিন্তু কিন্তু ভাবে বললেন “আমি কি মারা গেছি? এটা কি স্বর্গ বা ওইরকম কিছু?”
জাহরি হাসলো। তারপর বললো “না স্যার। এটা স্বর্গ নয়। আপনি মারাও যান নি। শুধু একটি অল্টারনেট ইউনিভার্সে এসে পৌঁছেছেন। নিতান্ত কালক্রমে। শুধু আপনি নন, আমরা সকলেই এখানে এই ভাবেই এসে পড়েছি।”
একটু দম নিলো জাহরি। তারপর বললো “২০১৪র মার্চ মাসে মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সের একটা প্লেন মালয়েশিয়া থেকে ব্যাংকক যাবার পথে ফুকেট দ্বীপের কাছ থেকে উধাও হয়ে যায় মনে আছে? অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও তার খোঁজ পাওয়া যায় নি? ওই প্লেনটা সেইটাই। আর আমি সেই প্লেনের পাইলট। প্লেন ক্র্যাশ হয় নি, অন্য ইউনিভার্সে এসে পড়েছিলো মাত্র।”
বিধানবাবু অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন দেখে জাহরি বললো “আপনি বারমুডা ট্র্যাঙ্গেলের নাম শুনেছেন?”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ — ওই চিরঞ্জীব সেন বলে এক লেখক এই নিয়ে মেলাই গাঁজাখুরি গপ্পো লিখে বেশ টু-পাইস কামিয়েছে একসময়।”
“গাঁজাখুরি নয়। সেই বারমুডা ট্র্যাঙ্গেল রহস্যের মূলে আছে এই জায়গাটা। শুধু বারমুডা ট্র্যাঙ্গেল নয়, আরো অনেক জায়গায় অনেক কিছু আর খুঁজে পাওয়া যায় নি। তার অনেকগুলোকেই এখানে খুঁজে পাবেন। অনেক মানুষকেও।”
শুনতে শুনতে আরেকটা কথা বিধানবাবুর মাথায় এলো। “আচ্ছা, এখানে কি পৃথিবীর সব নিয়ম চলে? অর্থাৎ জন্ম, মৃত্যু ইত্যাদি?”
জাহরি হাসলো। “আপনি এখনো ভাবছেন যে আপনি মারা গেছেন? আসলে এখানে মৃত্যু বলে কিছু নেই। শুধু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আপনার শরীর হালকা এবং বায়বীয় হয়ে উঠবে। একসময় এই শরীরটা আর থাকবে না। কিন্তু আপনি থাকবেন।”
জাহরি নিজের বাঁ-হাতটা তুলে দেখালো। বিধানবাবু দেখলেন যে বাঁ হাতের আস্তিনের পর থেকে হাতটা কেমন ঝাপসা মতন দেখাচ্ছে। জাহরি বললো “এই ভাবে আস্তে আস্তে আমরা বায়বীয় হয়ে যাই। মোটামুটি ১১০ বা ১২০ বছর বয়েস হয়ে গেলে কেউই আর স্থূল শরীর নিয়ে থাকেন না।”
বিধানবাবু কথাগুলো নিয়ে মনে মনে নাড়াচাড়া করতে থাকলেন। এই প্রথম শুনলেও কথাগুলি ওনার কাছে খুব স্বাভাবিক মনে হলো। বিদেশে গিয়ে যেমন লোকেরা সেখানকার ব্যবস্থায় দ্রুত অভ্যস্ত হয়ে যেতে থাকে, অনেকটা তেমনি।
“তার মানে আপনার প্লেনের সব যাত্রীরা আছে এখানে?” জানতে চাইলেন বিধানবাবু।
“শুধু তারা কেন, আরো কতো লোক আছে। সবথেকে পুরোনো দুই ভদ্রলোক তো এই সামনের বাগানবাড়িটাতে থাকেন। গত মাসেই দুজনে বায়বীয় হয়ে গেছেন। ওই দেখুন না, দালানে দাবার ছক আর ঘুঁটিগুলো এখনো পড়েই আছে।”
দেখলেন বিধানবাবু। তারপর জিজ্ঞেস করলেন “এরাও কি প্লেন দুর্ঘটনা...”
“সবাই নয়। বাঁদিকে যিনি বসতেন, তিনি আপনাদের পৃথিবী থেকে হারিয়ে যান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে। জার্মান ভদ্রলোক। বার্লিনের কাছে একটি ভূগর্ভ বাঙ্কারের মধ্যে ছিলেন। বাইরে তখন প্রবল গোলাগুলি চলছে। উনি বাঙ্কারের নীচের গোপন সুড়ঙ্গপথ দিয়ে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করতে গিয়ে উধাও হয়ে যান।” বললো জাহরি।
“আর ডানদিকের ব্যক্তি?”
“ইনি অবশ্য প্লেন ক্রাশের পরেই এখানে আসেন।” উত্তর দিলো জাহরি। “আপনাদের পৃথিবীতেও এনার সঙ্গে ওই জার্মান ভদ্রলোকের যোগাযোগ ছিলো। সিঙ্গাপুর থেকে প্লেনে সাইগন অবদি এসে তারপর নিখোঁজ হয়ে যান। বাঙালি — কলকাতায় নিবাস ছিলো। আরে — আপনার পাড়াতেই তো থাকতেন। চিনতে পারলেন না?”
(এই সংখ্যায় অতনু দে-র অন্য গল্পঃ 'কবিতার জন্ম ও মৃত্যু')