সেদিন শ্রাবণ মাস, আর দুদিন পর ঝুলন পূর্ণিমা। বর্ষা-ভেজা আকাশে কিছু কিছু মেঘ এখনো লেগে আছে কালো কাজল ছোপের মত। রাতে অবিশ্রান্ত বর্ষণে সামনের মাঠ জলে ভরে উঠেছে — জলমগ্ন শ্যামল ঘাসের আগায় জলের ফোঁটায়, সবুজাভ কালো মেঘের ছায়া ও নীল আকাশের ছবি মিলে মিশে মাঠটির রূপ বড় খুলেছে। ঝিরি ঝিরি মৃদু বর্ষণ বাতাসের দমকে গায়ের রোমকূপে রোমাঞ্চ তুলে যাচ্ছে — এই বর্ষায় যমুনা নদী কুলে কুলে ভরা। ছোট ছোট জলের ঘুর্ণার্বত তুলে খরস্রোতা পাগল পারা ছুটেছে।
রাধা ভোর থেকে চিন্তায় আছে। গোপবধূ, হলেই বা আয়ানরাজার ঘরনী, যমুনার তরঙ্গের ওপর জীবন জীবিকা নির্ভরশীল। গত দুদিন বৃষ্টির দাপটে খেয়া আসে নি নদীতে, হাটে যাওয়া হয় নি। আজ বৃষ্টি একটু কম, আশা আছে মাঝিরা রোজকার মত নৌকা নিয়ে বসে থাকবে ঘাটের কাছে, সওয়ারির সঙ্গে দরাদরি করবে পার করার জন্য। সকাল থেকে তাই গোপপাড়া আজ ব্যস্ত। ভোরে সূর্য ওঠার আগে ঘুম থেকে উঠে রাধা ঘরে সম্মার্জনী বুলিয়ে মেঝে নিকিয়ে, স্নান করে গোশালায় গেছে দুধ দুইতে, অনেকগুলি গাভী — বেশিরভাগই সবৎসা, দুধের পরিমাণ কম নয়। দেখাশোনার জন্য রাখাল নিযুক্ত থাকলেও দিনের প্রথম দোহন বাড়ির বধূকে নিজ হাতে করতে হয়, এটাই নিয়ম। তৈল, হরিদ্রা আর সিন্দুরে একটি দুগ্ধবতী গাভীকে বরণ করে তাকে দোহন করে বধূ, কিছুটা দুধ অবশিষ্ট থাকে বাছুরের জন্য — বাছুর সুস্থ না থাকলে দুধের পরিমাণ কমে যাবে। দোহনের পর আসল কাজ শুরু হয় বাড়ির মেয়ে-বৌদের। দুধ থেকে ছানা, ননী, মিষ্টান্ন, ঘি বানানো, তারপর তাদের বাঁকে সাজিয়ে যমুনা নদী পার হয়ে হাটে বেচে আসা। বেলা একটু গড়ালেই দেখা যাবে পাড়ার সব তরুণী মেয়ে বৌ কয়েকটি বয়স্কা গিন্নির তত্ত্বাবধানে ঝাঁকা কলসী নিয়ে ব্রজের পথে বেরিয়েছে। তাদের রঙ্গিন ঘাঘরা চোলি, ওড়না — বুনোফুলে সাজানো বেণী, হাঁটার তালে হাতের চুড়ি, কোমরের বিছে, গলার হার আর পায়ের মল শব্দ তোলে রুনুঝুনু। নদী পারাপার করতে খেয়া আছে বেশ কয়েকটা, মাঝিরাও মুখ চেনা — ঘর সংসারের খবর নেয়, হাসি ঠাট্টা করে, অল্পস্বল্প রসের কথাও যে হয় না তা নয় — নির্দোষ চিমটি কাটা কথা, কেউ কিছু মনে করে না।
বিনোদিনী রাধা আয়ানরাজের রূপসী বৌ, সবেমাত্র ষোড়শ বর্ষে পা দিয়েছে। কৈশোর আর তারুণ্যের সন্ধিস্থলে দাঁড়িয়ে যে প্রগলভতা, উচ্ছলতা আশা করা যায়, তার বদলে কেমন যেন এক বিষন্নতা জড়িয়ে আছে রাধার চোখের তারায়। বয়সের তুলনায় বড় স্বল্পবাক, অন্তর্মুখী। প্রাণান্তেও ও নিজের কথা কারোকে বলে না, কিন্তু কানাকানি আছে আয়ানরাজের শারীরিক সক্ষমতা নিয়ে, রাধার বিষাদের কারণ নাকি লুকিয়ে আছে সেই রহস্যে। রাধা গোপবধূদের মাঝে সুন্দরীতমা, ওর রূপে চপলতা কম, আভিজাত্য আর রহস্যের মিশেল আছে — যা ওর চারিপাশে রচেছে এক দূরত্বের ঘেরাটোপ। এই ভরা বর্ষায় যখন গোপরমণীর দল যমুনার দুকুল ছাপানো তরঙ্গে সিনানে মাতে, পরস্পরের সঙ্গে রঙ্গ-রসিকতা করে, কানাকানি করে, গলা জড়িয়ে গত রজনীর রভস সংবাদ শোনায়, রাধা তখন একাকী পৈঠায় বসে নিজের রাতুল পদতলের অকারণ পরিচর্যা করে — বিবাহের পরেও কোন গোপন কথা না থাকার দুঃখ রাধা একাই বহন করে। আয়ানরাজার শয্যাকক্ষ অন্দরে নয়, তিনি শয়ন করেন উদ্যানের একপ্রান্তে, ওনার সাধন-ভজনের নাকি সুবিধা হয়। গুরুর মানা আছে প্রকৃতি দর্শনের, তাই রাধার মুখে সরাসরি তাকিয়ে কথা বলে না আয়ান, সম্বোধনেও কোন ঘনিষ্ঠতা নেই, শুধু আদেশ আর নির্দেশ। তাও বোধহয় রাধা মানিয়ে নিত, কারণ শাসনের মধ্যে নিষ্ঠুরতা আছে — কোন নীচতা বা হীনতা নেই। ওর যা সহ্য হয়না তা হল আয়ানের অকারণ সন্দেহ, নিশ্ছিদ্র পাহারা। ননদী জটিলা ও কুটিলার একমাত্র কাজ ওকে চোখেচোখে রাখা। রাধা স্বভাবে চপলা নয়, পুরুষকে মুগ্ধ করার কোন বাড়তি প্রচেষ্টা ওর নেই, রূপসজ্জা সুন্দর হলেও সংযত — তবু আয়ান ওকে বারবিলাসিনীর মতই অবিশ্বাস করে। নিজেকে বড় ছোট, বড় কদর্য লাগে রাধার। নিজের শরীরটাকে মনে হয় কোন লোভনীয় মিষ্টান্ন, আর আয়ান যেন এক শর্করা রোগী, খেতেও পারে না, প্রাণে ধরে ফেলেও দিতে পারে না — লোভীর মত শুধু আঁকড়ে রাখে। এসব ভুলে থাকতে ঘর সংসারের কাজে প্রয়োজনের চেয়ে মনোযোগ দেয় ও, ভোর থেকে শুরু করে মধ্যরাত পর্যন্ত কোন না কোন কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে। কাজের শেষে নিঃশব্দ রাতে নিজের শয্যায় শরীর বিছোতে না বিছোতেই ঘুমের অতলে তলিয়ে যায়। কোন অবান্তর চিন্তাকে প্রশ্রয় দেয় না — বিবাহসূত্রে নিজের সামাজিক মর্যাদা নিয়ে যথেষ্ট সচেতন রাধা, আয়ানরাজের ঘরনী হওয়ার ব্যবহারিক সুবিধা সর্ম্পকেও উদাসীন নয় ও — নিজেকে কড়া শাসনে বেঁধে রাখে সচরাচর। আজ সহসা কে জানে কেন এর ব্যতিক্রম ঘটছে। ঘরে জমে থাকা মিষ্টান্ন, ভিজে কাঠের ধোঁয়া, অবিশ্রান্ত বর্ষণে প্লাবিত উঠান, রাখাল ছেলেটা আসছে না দিন দুয়েক — জড়ো হওয়া জঞ্জালের স্তূপ ইতস্তত ছড়িয়ে আছে গোয়ালে, অহরাত্র ধুনো দেওয়া সত্ত্বেও মশার ঝাঁক ঢেকে রেখেছে ঘরের চালা, মাকড়সার জালের মত। তবু রাধা সমস্ত মনটি সংসারে দিতে পারছে না যেন, বাদল হাওয়ায় মন তার ভেসে যাচ্ছে, বড় একা লাগছে নিজেকে। বুকের ভিতর হাহাকার করছে কে, দেওয়া হল না, দেওয়া হল না — এই বর্ষার সকালে, ঘন মেঘের ভরা আঁধার, জল মাখানো দমকা হাওয়া — রাধার বড় ইচ্ছে জাগছে কারো হাত ছুঁয়ে বসে থাকতে, নিজেকে খুলে মেলে এই বৃষ্টি ধারার মত একেবারে বিলিয়ে দিতে, যত কথা বুকের মধ্যে জমে আছে কারো কাছে বসে শোনাতে। এমন সব পাগলের মত ইচ্ছে — যা হিসেবী গৃহবধূর জমাখরচের খাতায় লেখা থাকে না।
অন্যমনস্কভাবে রাধা প্রসাধনে বসে, হাটে যেতে হবে, মেঘের আড়ালে বেলা বাড়ছে। জটিলা কুটিলা বার কয়েক তাড়া দিয়ে গেছে — কিগো মহারানী, সাজের পাট চুকলো? তা আজ কি এমন যোগিনী বেশেই যাওয়া হবে হাটে? রাধা শেষ অবধি বলেছে — তোমরা এগোও, আমি আসছি।
— বাড়ির বউ একা হাটে যাবি? আয়ান রক্ষে রাখবে আমাদের?
— একা নয়, ললিতা, বিশাখাকে সঙ্গে নেব। বৃন্দাবুড়ি থাকবে আমাদের পাহারা দিতে।
— দেরি করিস না, বৃষ্টির জোর বাড়লে খেয়া বন্ধ হয়ে যাবে। গত দুদিন হাট বসে নি, দধি মিষ্টান্ন আর ঘরে রাখা যাচ্ছে না, পচে যাছে। আর সাবধান — কানুর দৌরাত্ম্য বড় বেড়েছে আজকাল। বলতে বলতে এগিয়ে গেল তারা, পা মেলালো গোপবধূ, গোপদুহিতার ছোট দলটির সংগে, ঝিরঝিরে বৃষ্টি অগ্রাহ্য করে হাসি গল্পে, নিক্কণে, শিঞ্জনে শব্দ তুলে এগিয়ে চললো ব্রজের পথ ধরে।
কানুর নাম শুনে নিজের অজান্তে শিউরে উঠলো রাধা। কিছুদিন ধরেই যমুনার তীর থেকে এক মন-মাতাল বাঁশির শব্দ ভেসে আসে প্রভাতে, দ্বিপ্রহরে, সায়াহ্ণে, গভীর রাতে — সর্বনাশা সুর তার। রাধার মনপ্রাণ ভেঙেচুরে তচনছ করে দেয়। সব ছেড়ে যেদিকে দুচোখ যায় চলে যেতে ইছে করে। ও বাঁশি যেন খাঁচাবন্ধ পাখিকে ঝড়ের আকাশে উড়তে বলে, নোঙরবাঁধা নৌকোকে মাঝ দরিয়ায় ঝাঁপ দিতে বলে — ও পাগল করা বাঁশি। বাঁশি বাজায় কৃষ্ণ — যশোদা আর নন্দরাজের কনিষ্ঠ সন্তান, লোকে আদর করে কানু বলে ডাকে। রাধা বনের পথে আনাগোনার কালে দেখেছে এই নবনীতকোমল সুঠাম শিশুটিকে। গায়ের রঙ বর্ষার জলদের মতই গাঢ় শ্যাম, পীতবাসে ছেলেকে সাজাতে ভালবাসে যশোদারানি, মাথায় দেন ময়ূরপুচ্ছের চূড়া আর হাতে মোহনবাঁশি। দুরন্ত বালক, ঢিল মেরে মটকা ভেঙে দিত, চুরি করত ছানা ননি। বাঁশির তানে গরুগুলিকে ডেকে নিত কোন বনে জংগলে, বাছুরদের ছেড়ে দিয়ে খাইয়ে দিত সব দুধ। রাধা গ্রাম সম্বন্ধে মামীমা হয় কানুর, সেই সুবাদে সখীদের সঙ্গে কতবার গেছে যশোদারানির কাছে কানুর নামে নালিশ করতে। সে যেন অন্য যুগের, অন্য কারো কথা।
সেই ছটফটে বালকটি কখন যেন হয়ে উঠেছে এক অপরূপদর্শন কৃষ্ণ কিশোর, বাঁশির সুরে লেগেছে সর্বনাশা তান, গোপরমণীরা ঘরের কাজ আধা সমাপ্ত রেখে যখন তখন ছুটে যায় যমুনার তীরে, কলস ভরা শেষ হয়না আর, ভরা কলস বার বার উলটে ফেলে ঘরের আঙিনায়। কানুর এই পাগলকরা বাঁশিতে অশান্তির ঝড় উঠেছে ব্রজের ঘরে ঘরে। প্রিয় রাখালরাজাকে কিছু বলতে পারে না গোপের পুরুষ, বউদের পিঠে চেলা কাঠ ভাঙে, ঘরে বন্ধ করে রাখে — কিন্তু ফল হয় না কোন। বউরা ঠিক তাক বুঝে হারিয়ে যায় যমুনার তীরে, গভীর জংগলে। তাদের বন্ধ করে রাখলে ননী ছানা বানাবে কে আর হাটে নিয়ে বেচবেই বা কে — গ্রাহকরা সুন্দরী রমণীর পসরা দেখে আকৃষ্ট হয়, মেঠো পুরুষের শক্তপোক্ত হাঁড়ির দিকে ফিরেও তাকায় না। এমনিতেও কৃষ্ণের ওপর তেমন রাগতে পারে না ব্রজবাসী, কী যেন আছে ওর হাসিতে, চোখের মায়ায়, কটু কথা বলাই যায় না। আর কে না জানে কৃষ্ণ জন্মেছে অলৌকিক শক্তি নিয়ে, কালীয়নাগ দমন করেছে, পুতনা রাক্ষসীকে মেরেছে — কতবার যে বৃন্দাবনকে বাঁচিয়েছে বাইরের আক্রমণ থেকে তার ইয়ত্ত্বা নেই। আর সবচেয়ে বড় কথা, রমণীর ব্যাপারে কানু সমদর্শী, সে কারোকে আহ্বানও করে না, প্রত্যাখ্যানও করে না। যে অভিযাচিকা হয়ে কানুকে চায় তাকে পূর্ণ করে কিন্তু ইচ্ছার বিরুদ্ধে স্পর্শ করে না কখনও। রাধা কখনো মুখোমুখি কথা বলে নি এই ব্রজকিশোর কৃষ্ণের সাথে – সচরাচর এড়িয়েই চলে। কিন্তু সে জানে দৈনন্দিন তুচ্ছ ধুলো কাঁকর মাখা জীবনের প্রান্তসীমা ছাড়িয়ে, রাধার বুকের অনেক গভীরে, ইচ্ছে ঘরে কানুর বাস।
বৃষ্টি আরেকটু জোরে এসেছে, ডাকতে এল ললিতা আর বিশাখা, এরা ঠিক সমমর্যাদাপন্ন নয়, সখী আর দাসীর মাঝামাঝি, তবু রাধা এদের কাছেই একটু মন খুলে কথা বলে।
যেটুকু প্রসাধন বাকি ছিল দ্রুত হাতে সারতে লাগল রাধা, অলকাতলকা এঁকে নিল মসৃণ কপালে, নীলাম্বরীর আঁচলের প্রান্ত জড়িয়ে নিল কোমরে, দীর্ঘ বেণীতে গেঁথে নিল যূথীর মালা, কাঁধে তুলে নিল ননীর বাঁক, বেরিয়ে পড়ল পথে। পিছনে চলল বৃন্দা বুড়ি — ওরা ডাকে বড়াই বুড়ি। চোখ কান খুব সজাগ। পুরোনো দিনের দাসী কিন্তু জটিলা কুটিলার সঙ্গে সম্পর্ক ভাল নয়। রাধা বরং কিছু প্রশ্রয় পায় ওর কাছে। আয়ানের হাত তেমন দরাজ নয়, রাধা সংসারের চোখ এড়িয়ে এটা ওটা সাহায্য করে বুড়িকে, তার বদলে রাধাকে মাঝে মাঝে পাহারার ঘেরাটোপ থেকে বের করে একা একটু সময় কাটানোর সুযোগ করে দেয় বড়াই বুড়ি।
রাস্তা বড় পিছল, জল দাঁড়িয়ে গেছে নানা জায়গায়, মাথায় অতগুলো ভাঁড় বসিয়ে পথ চলতে বড় অসুবিধে হচ্ছিল। দুধারের গাছের পাতায় লেগে থাকা জল টপটপ করে পড়ছে সর্বাঙ্গে, হাওয়ার দাপটে শাড়ি, মেখলা এলোমেলো। হাত জোড়া থাকায় ওড়না বা আঁচল টানা যাচ্ছে না। এদিকে যমুনা তীরে এসে দেখা গেল একটিও খেয়া কুলে নেই। ছোট দলটি বিপদে পড়ল। গত দুদিন বেরনো হয় নি, অনেকের ঘরে চলাচলতির অভাব ঘটেছে। যেভাবেই হোক হাটে যাওয়া আজ চাই। এদিক ওদিক খুঁজতে লাগল ওরা, কুলের কাছে ঢেউএর উথাল পাথাল চলছে, জোয়ারের টানলাগা কালচে সবুজ জল আছড়ে পড়ছে ঘাটের ওপর। সাবধান মেয়েরা, জলের বড় ধার — হাঁক দিয়ে ওঠে বড়াই বুড়ি। হঠাৎ রাধার চোখে পড়ে এমন দুর্যোগে ঢেউ-এর মাথায় উঠে এক ভাঙা ডিঙি মরণনাচন নাচছে যেন বিপুল আহ্লাদে, ডিঙির ওপর হাল ধরেছে সেই দুরন্ত বালক কানু, যে আর বালক থাকতে চাইছে না। গরজ বড় বালাই, ললিতা ডাক দেয় — কানু, মাঝিরা সব কোথায়? শ্রীদাম, সুদাম, দাম, বসুদাম — কারো যে দেখা নেই।
— সবাই নাও ভিড়িয়েছে ওদিকের ঘাটে, মাধ্বী পান করছে আরাম করে।
— পার করবে না কেউ?
— পাগল, দেখছ না জলে লাল ঘূর্ণি লেগেছে, এই স্রোতে কেউ নাও বায়?
— তুমি বাইছো যে?
— আমার ভাঙা নাও, ও আর কি ভাঙবে, তাই সাহস করে নেমে পড়লাম জলে। পার হবে?
— ঐ খেয়াতে? নৌকাডুবি হলে?
— আমার ডিঙায় পাড়ি দিলে আমার ওপর ভরসা রাখতে হবে।
— নাও বাইতে জানো তুমি?
— শিখে নিতে কতক্ষণ?
মেয়েদের রাগ হয়ে যায়, তামাসা করছে ছেলেটা!
— নাও বাওয়া শিখে তবে তুমি আমাদের পার করবে, তাও এই ঝড় তুফানের মাঝে? ঠাট্টা করছ আমাদের বিপদ দেখে? যাও পথ দেখ। আমরা অন্য মাঝি খুঁজে নেব। চল রে তোরা” বলে ললিতা। “তোমার মতলব ভাল নয় কানু, আমাদের ডোবাতে চাও মাঝনদিতে। তুমি তো সর্বনাশা ছেলে।“ “ডানপিটের মরণ গাছের আগায়“ গজগজ করে বড়াই বুড়ি। আয় তোরা আমরা বরং ও ঘাট থেকে ডেকে নেব কারোকে, তেমন মোটা মাশুল দিলে পার করবে না মানে? মেয়ের দল পিছিয়ে আসে পায়ে পায়ে।
কানু রঙ্গ-রসিকতা করতেই ডেকেছিল মেয়ের দলকে, পার করার জন্য নয়। যমুনার কালো জলে কালো মেঘের নীচে একা একা ডিঙি বাইতে বড় ভাল লাগে ওর, ঢেউ-এর উথাল পাথালে বইঠা চেপে ধরে নাওকে বশে আনার মধ্যে নেশা আছে, নাও শাসন না মেনে ডুবতে চায় অতলে আর কানু তাকে ভাসিয়ে রাখে নদির বুকে। কখনও নাও জেতে কখনও কানু। যমুনাকে তখন মনে হয় অহংকারী লীলাবতী রমণী, পুরুষের সাথে রভস রংগে গা ভাসিয়েছে।
চপলস্বরে বলে কৃষ্ণ, “তা যা ভাল বোঝ তোমরা, তবে পরে দোষ দিও না যেন, বোলো না যে আমি পার করতে চাই নি।“ ভালমানুষের মত নৌকার মুখ ঘুরিয়ে নেয় কানু।
হঠাৎ রাধা বলে ওঠে — পারের মাশুল কত তোমার?
কৃষ্ণ চকিতে ফিরে তাকায় — এ স্বর তো চেনা, এই তীব্র মধুর স্বর তো সেই নারীর যাকে কৃষ্ণ এতক্ষণ দেখেও দেখে নি, বহুকষ্টে চাউনিকে নিরাসক্ত করেছে। এ সেই বিনোদিনী গরবিনী রাই যে আজ অবধি কখনও শ্যামের সাথে ঝুলন পূর্ণিমায় ঝুলায় দোলে নি তমাল শাখে, হোলিতে আবীর কুমকুমে স্নান করে নি যমুনা তীরে, বাঁশির ডাকে এলায়িত কুন্তলা, লাজলজ্জা ভুলে ছুটে আসে নি কদম্ব তলে। রজনীগন্ধার স্তবকের মত এই নারী, পরনে নীলাম্বরী, কবরীতে যূথীর ডোর, দুই কানে দুই নবকদম্বের কর্ণাভরণ, গলায় বেলির গোড়ে মালা। মুখে পরাগরেণুর সাথে চূর্ণ বিষাদ লেগে আছে যেন। এই সন্নতা, অহংকারী গোপবধূটি, সম্পর্কে নাকি মামীমা হয়, কি আকর্ষণে টানে তাকে, অথচ পথে দেখা হলে ওর কালো চোখের তারায় লেগে থাকে এক উদাসীন উপেক্ষা। অপমান হয়েছে বৈকি মনে — রমণীমোহন কানুকে অবজ্ঞা করে চলে যায় এমন নারী ব্রজে বিশেষ নেই। তাই এই বিশেষ রমণীকে একটু আঘাত করার লোভ ছাড়তে পারে না কৃষ্ণ। বলে — তুমি তো আয়ানরাজার রানী, তোমাকে পার করতে হলে তো মাশুল কিছু বেশি ই পড়বে।
— ক আনা দিতে হবে বল শুনি।
— আমি আনা কড়ির সওদা করি না গো মেয়ে, কানুর নাওয়ে পা রাখতে হলে আরো অনেক বেশি দাম দিতে হয়। সে কি দিতে পারবে তুমি?
— কি চাই বল না কেন, আমিও এক কথার লোক, আনার দরাদরি করি না, আর কিছু না থাক, হাতে কানে সোনা আছে তো, তাতে হবে না?
কানুর অহংকারে ঘা লাগে। বলে সোনা নিয়ে কি হবে, আমার নৌকা বাওয়ার দাম দু কুচি সোনায় তোলা কর নাকি?
— তো কি চাই?
— তোমার কুল, মান, লাজ লজ্জা, তোমার সর্বস্ব, রাজী?
রাধার চোখে চোখ রেখে কৃষ্ণ যেন রাধাকে আহ্বান করে এক কঠিন যুদ্ধে। “বলে কি ছেলেটা? সাহস তো কম নয়!” শিউরে ওঠে রাধার সঙ্গী রমণীরা, জিভ কাটে বড়াই বুড়ি, তেড়ে আসে ললিতা, বিশাখা।
কিন্তু রাধার গায়ে তো আজ লেগেছে বরষার ছাঁট, লজ্জা শরম, বুদ্ধি বিবেচনা সব এই বাদল হাওয়ায় উড়ে গেছে। নিচোল ছেড়ে উড়ে যাওয়া চুনরিকে খোলা হাওয়ায় উড়ে যেতে দিয়ে সে অনায়াসেই বলে ফেলে—
— দেব, কিন্তু তার বদলে আমায় নিয়ে যেতে হবে মাঝনদিতে, ঢেউ-এর ওপর সওয়ার করে, মাথায় ভাসবে কালো মেঘ, আমার চুলের মত কালো। বিদ্যুত ঝিকিয়ে উঠবে সেই কালো মেঘের পালে — নীল জলে ছায়া পড়বে তার, তুমি বাঁশি বাজাবে — তোমার ওই পাগল করা বাঁশি, সেই সুরে গায়ে আমার জেগে উঠবে কদম ফুলের জোয়ার। এমন অতল জলে নিয়ে যাবে, যে ঘূর্ণি থেকে আর সাঁতরে ফিরে আসা যায় না। আমাকে সেই সর্বনাশের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিতে তুমি পারবে তো কৃষ্ণ?”
স্তব্ধ হয়ে যায় কৃষ্ণের প্রগল্ভতা। স্থির বিস্ময়ে দেখেন নিরাপত্তার ওম মাখা, এক লালিত পারাবত, অতলান্ত আকাশে উড়ান দিতে মেলে দিয়েছে ডানা, সর্বস্ব পণ করে, শেষ পর্যন্ত নাম না জানা কোন মাটিতে আছাড় খেয়ে ডানা ভাঙবে সেই পরিপূর্ণ ভরসায়। বিকেলের পড়ে আসা আলোর ছটায়, আকাশজোড়া মেঘের নীচে রাধাকে বড় ভাল লাগল কৃষ্ণের। বড় মায়া করে, স্নেহ করে বুঝিয়ে বলল — কিন্তু রাই, আমি তো পার করে আবার চলে যাব নতুন সওয়ারির খোঁজে — হয়ত আর ফিরে আসব না। মনেও থাকবে না কবে কাকে খেয়ায় তুলেছি। এমনকি হয়ত মাঝ দরিয়ায় ভাসিয়ে দিয়েই চলে গেলাম কোন অচেনা স্রোতের টানে। আমার ওপর ভরসা করে কুল ছেড়ো না রাধা।
— তোমার ভরসায় আমি নেই তো কৃষ্ণ, আমার মনে বড় সাধ জেগেছে অকুলে ভাসার — আমায় শুধু অকুল পর্যন্ত পৌঁছে দাও তুমি।
জলে আবার জোয়ার আসছে, মাতন লেগেছে ঢেউএর — শ্যাম হাত বাড়িয়ে রাধাকে তুলে নিল ভাঙা ডিঙিতে, শ্যামের বুকে জড়ো হল রাধা ডানা ঝাপটানো পাখির আদলে। ললিতা বিশাখা কিছু বোঝার আগেই, বড়াইবুড়ি হাঁ হাঁ করে বাধা দেবার আগেই, নৌকো ভেসে গেল তুফানী হাওয়ায়, নদীর বুকে ভাঙা খোলার মত।