বিকেলে কাজ থেকে ফিরে খবরের কাগজ নিয়ে খানিকক্ষণ গড়ানো ঈশার অনেকদিনের অভ্যেস। বেশ লাগে এই আলসেমিটুকু। এটুকু তার নিজের সঙ্গে সময় কাটানোর বিরল সুযোগ। ফোনটা বাজতে একটু অন্যমনস্ক ভাবে ঈশা যন্ত্রটি কানে তোলে — ওপারে তার ভাইঝি টুটুর আধা-উত্তেজিত গলা। ‘পিসি, আজ লিস্ট বেরিয়েছে। কুড়িজনের মধ্যে রিমির নাম আছে কিন্তু ওর আগে এগারোজনের নাম। প্রতিবার তো দশ-বারোজনকে নেয়। রিমির হয়তো হয়ে যাবে।’
‘ওমা, তাই’ — খুশির আভাস ফোটে ঈশার গলায়। টুটু ফোন করলে সাধারণত বেশ খানিকটা সময় তারা গল্প করে। আজ বোধহয় চাপা উত্তেজনার কারণেই ঈশা তার সঙ্গে এপাশ-ওপাশ দু’চারটে কথা ব’লেই ফোন ছেড়ে দিল। আর তারপরেই সে টের পেল যে অনেক দিন পর সেই অবুঝ পাখিটা তার বুকের ভেতর ডানা ঝাপটাচ্ছে।
ঈশার মেয়ে রিমি সদ্য কলেজের শেষ পরীক্ষা দিয়েছে। তিনদিন আগে সে তার বাবা হিমাংশুর সঙ্গে গিয়ে দেশের এক নামী গবেষণা সংস্থায় ইন্টিগ্রেটেড পিএইচডি করার জন্য ইন্টারভ্যু দিয়ে এসেছে। এক সঙ্গে এমএসসি ও পিএইচডি করবার এই সুযোগটি অনেক ছেলেমেয়ের কাছেই আজকাল অত্যন্ত লোভনীয়। সেখানকার ব্যবস্থাপত্র যতটুকু দেখেছে তাতেই মেয়ে তো উচ্ছ্বসিত; হিমাংশুরও ভালো লেগেছে ওখানকার পরিবেশ। টুটু ওখানেই গত চারবছর হ’ল পিএইচডি করছে। সেই সুবাদে ওদের খানিকটা ঘুরেফিরে দেখার ও জানার সুবিধেও ছিল।
ঈশার মনটা ফলাফল জানার জন্য যে উদগ্রীব হয়ে ছিল না তা নয় কিন্তু টুটুর ফোনটা পেয়ে সে যেন কেমন ভ্যালভেলে হয়ে গেল। রিমি যদি নির্বাচিত হয় তাহ’লে তাকে আগামী সাত বছর বাবা-মাকে ছেড়ে দেড় হাজার কিলোমিটার দূরে থাকতে হবে। তার মানে তো ঈশাদের এই তিনজনের সংসার এক-পা-হারানো তেপায়ার মতো নড়বড়ে হয়ে যাবে! ঈশা নিজেকে বোঝায় যে তার মায়েদের সময় — কিছু ক্ষেত্রে তার নিজের সময়েও — রিমির বয়সের মেয়েরা বিয়ে করে শ্বশুরবাড়ি চলে যেতো। আর রিমি তো সে তুলনায় কতো স্বাধীন, কতো সম্ভাবনাময় জীবনযাত্রার সূচনা করতে যাবে।
হাতের থেকে কখন যে খবরের কাগজটা খসে পড়েছে ঈশা তা খেয়াল করেনি। প্রজাপতির ডানার নানা রঙ নিয়ে তার ভাবনা রিমির সম্ভাব্য ঝলমলে ভবিষ্যতের ছবি আঁকবার চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু মনটা এমন অবাধ্য যে অল্পক্ষণের মধ্যেই ঈশা আবারো বিষণ্ণ বোধ করতে শুরু করল। মনে হ’ল আর তো তাহ’লে এখন থেকে ‘দুধে কেন সর পড়েছে’ ব’লে তার সঙ্গে রিমি নিয়মিত বায়না করবে না। হস্টেল থেকে যখন সে বাড়ি আসবে তখন কি মা ও মেয়ে পরস্পরকে মান্যিগণ্যি করে চলবে! এখন যেমন ‘ভিজে তোয়ালে দলা ক’রে রেখেছিস কেন’ আর ‘তুমি আমাকে ফোনে কথা বলতে দেখলেই চেঁচাও’ ইত্যাদি নিয়ে দু’জনের কথা কাটাকাটি হয় তেমনি চলবে! ঈশার হাসি পেল রিমির জন্মের পর ওর নিজের একটা আচরণের কথা ভেবে। ঈশা একটা গোটা দিনেরও বেশি সময় প্রসব-যন্ত্রণা ভোগ করার পর রিমি জন্মায়। হিমাংশু, ঈশার মা ও কয়েকজন বন্ধু মা-মেয়েকে দেখে যাবার পর ঈশা স্নান ও জলখাবার সেরে নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছিল। এমন সময় সদ্যজাত রিমিকে তার পাশে দিয়ে নার্স বলেন, ‘ওকে খাওয়ান — বাচ্চার ক্ষিধে পেয়েছে।’ ঈশার মনে হয়েছিল এসব আবার কেন! এ যেন বার্ষিক পরীক্ষার ফল বেরোনোমাত্র আবার পড়তে বসানোর জুলুম! কিন্তু ভাবলে অবাক লাগে যে কতো তাড়াতাড়ি তার সেই মনোভাবটা বদলে গেল; ঈশার জীবন, বলা ভালো ঈশা ও হিমাংশুর মিলিত জীবন, আবর্তিত হতে থাকল রিমিকে ঘিরে। তবে সবকিছুর মধ্যেও ঐ পাখিটা মাঝেমধ্যেই ছটফটিয়ে উঠতো আর বুঝেও না বোঝার ভান করে ঈশা সংসারে ডুব দিয়ে মানিক তোলার চেষ্টা করে চলত।
ঘড়ির দিকে তাকাল ঈশা। ঠিক করল যে নিজেকে আরেকটু সময় দেবে সে আলসেমি করবার জন্য। শুয়ে আছে সে আর মনটা তার তরতর করে অতীতের নানা পথে হেঁটে চলেছে। রিমিকে বড় ক’রে তোলা, তাদের তিনজনের সংসারের নানারকম অভিজ্ঞতা — কতো কথা যে মনে আসছিল তার। মনে পড়ল বেবী-সিটার-এর কাছে রিমিকে ছাড়তে প্রথম প্রথম কী ভয়ানক অস্বস্তি ছিল ঈশার। সেখানে তো মেয়ে সুন্দর মানিয়ে নিল। রিমির প্রথম দিন স্কুলে যাওয়ার কথাও মনে এলো। দিনের শেষে তার ক্লাস-টীচার যখন বললেন, ‘আপনাদের মেয়ে বাদে আজ সবাই কাঁদছিল’ তা শুনে ঈশা বেশ গর্বিতভাবে বাড়ি ফিরেছিল। কিন্তু পরদিন স্কুলে পৌঁছেই রিমির সে কী কান্না — যেন ক্লাসের সবার থেকে আলাদা হবার ভয়ে! পড়াশুনোর সঙ্গে কিছুদিন পরে রিমি নাচ শিখতে শুরু করল। ঈশা নিজেও বিয়ের আগে অবধি নিয়মিত নৃত্য-চর্চা করেছে ব’লে রিমির তাল-লয়-বোধ ও নাচের প্রতি আগ্রহ দেখে দক্ষ এক গুরুর কাছে তাকে ভর্তি করে। ফলে, গুরুর পরিশ্রমে ও মায়ের উৎসাহে এতোদিন রিমির নৃত্য-শিক্ষা পড়াশুনোর সঙ্গে সমান্তরাল ভাবে এগিয়েছে। হস্টেলে গেলে রিমির নাচের কী হবে তা নিয়েও এবার ঈশার দুশ্চিন্তা শুরু হ’ল।
উঠে পড়ল ঈশা। রিমি তার এক বন্ধুর বাড়ি গিয়েছে সারাদিন থাকবে ব’লে। সেখানে ওকে ফোন ক’রে খবরটা জানাল। তারপর জানাল হিমাংশুকে। দু’জনেই স্বভাবতই খুশি; সারা দেশের মধ্যে থেকে ছেঁকে নেওয়া তালিকায় নাম থাকা তো মুখের কথা নয়! রোজকার কাজে ঈশার সন্ধেটা কাটল। রাত্রে তিনজন খেতে ব’সলে তাদের কথাবার্তার সিংহভাগ জুড়ে রইল সম্ভাব্য এই সুযোগটি নিয়ে আলোচনা।
কয়েকদিন ‘কী হয়, কী হয়’ ক’রে কাটল। তারপর এল সেই আকাঙ্ক্ষিত চিঠি — রিমি নির্বাচিত হয়েছে। খুব আনন্দ হ’ল ঈশার, রিমিও খুশি। হিমাংশু কিন্তু যত না খুশি তার চেয়ে বেশি মনমরা হয়ে গেল। মেয়েকে দূরে পাঠানোয় তার মনের সায় নেই অথচ সে জানে যে এমন সুযোগ হাতছাড়া করার কোনো মানে হয় না। ঈশাদের পরিবারে এবার শুরু হয় রিমিকে হস্টেলে পাঠানোর প্রস্তুতি। টুকটাক কেনাকাটা, নানাজনের সঙ্গে দেখা করা আর সেই সঙ্গে অ্যাডমিশন ফী, হস্টেল ফী ইত্যাদি পাঠানোর ব্যবস্থা করা। হিমাংশুর অবস্থা দেখে ঈশার ভারী ভাবনা হয়। কন্যাকে কাছছাড়া করার উদ্বেগে ধীরস্থির মানুষটা কেমন শিশুর মতো উতলা হ’চ্ছে। তাকে যতো দেখে ঈশা, ততো সে নিজেকে শক্ত করে; আবার স্বামীর আড়ালে মেয়েকে বোঝায় যে কেন সে এমন আচরণ করছে।
ঠিক হয়েছিল যে রিমির প্রয়োজনের অধিকাংশ জিনিস হস্টেলে পৌঁছনোর পর কেনা হবে। বাকি জিনিসপত্র গোছানোর সময় ইচ্ছে করে ঈশা নিজেকে সরিয়ে রেখেছিল। তিনজন প্রাপ্ত-বয়স্ক মানুষ একই ব্যাপারে মতামত দিলে সহজেই খিটিমিটি বাধে তাই বাবা-মেয়ের ব্যবস্থাপত্রে সে বিশেষ নাক গলায়নি! তবু রিমি যখন ডেকে বলে, ‘মা, দেখতো এই সবুজ কুর্তাটা কি নেব’ বা ‘প্লীজ, এই শালোয়ার-এর ‘পা’-টা একটু ছোট করে দাও’, হাতের কাজ ফেলে ঈশা তখুনি সেদিকে মন দেয়। ‘মা, তুমি আমাকে রোজ ফোন করবে তো?’ রওনা হবার আগের দিনে রিমির এই প্রশ্নে বাঁধ ভাঙল ঈশার সংযমের। তার উছলে পড়া চোখের জল যেন থামতে জানে না; মেয়েকে বুকের কাছে ধরে বারবার ‘করবো তো’ ব’লেও যেন বলা হ’চ্ছিল না ঈশার। রিমিকে জড়িয়ে ধরে তার মনে হ’ল মায়ের স্নেহচ্ছায়াকে ছিন্ন ক’রে এবার যেন তার মেয়ের দ্বিতীয় জন্ম হ’তে চলেছে।
রিমি রওনা হবার দু’দিন আগে ঈশার কলেজের সহকর্মী মায়াদি হঠাৎ-ই বললেন, ‘রিমি হস্টেল-এ চলে গেলে তুই তো ঝাড়া হাত-পা। টোনাটুনির সংসারে কতো আর কাজ! নিজের জন্য কিছু কর এবারে।’ কথাটা শুনে ঈশার কেমন যেন মন খারাপ হয়ে গেল। মেয়েটা বাড়ির থেকে দূরে থাকবে সেই কথাটা ভাবলেও ঈশার চোখ ছলছল করে। কিন্তু মায়াদির ঐ কথাটা বোধহয় পাখিটা শুনে ফেলেছিল। তখন থেকে ঈশা টের পেতে লাগল যে সে আবার তার বুকের মধ্যে বড্ড বেশি নড়াচড়া শুরু করেছে।
বৃষ্টি ভেজা এক সকালে ঈশারা রওনা হ’ল রিমিকে তার ইন্সটিট্যুট-এ পৌঁছে দিতে। বেরোনোর আগে নিজেদের চা ও রিমির দুধ-এর ব্যবস্থা করার সময় যত্ন করে দুধটা ছেঁকে দিল ঈশা যাতে মেয়ে দুধ খেতে গিয়ে বিরক্ত না হয়। প্লেন-এ মাত্র দেড় ঘন্টা সময় নিল কিন্তু ইন্সটিট্যুট-এ ঢুকে ইস্তক ঈশার মনে হচ্ছিল সে যেন অন্য এক জগতে এসে পড়েছে। প্রথমেই অ্যাডমিশন নেওয়া হ’ল, তারপর হ’ল হস্টেল-এর ব্যবস্থা। ভাগ্যক্রমে সবচেয়ে ভালো হস্টেল-এই রিমির ঘর। সঙ্গের জিনিসপত্র ঘরে রেখে হালকা মনে ওরা সবুজে ভরা ক্যাম্পাসে হাঁটতে বেরোল। নিজেদের দেখার সঙ্গে-সঙ্গে বাবা-মা-এর উদ্দেশ্য বুঝি-বা মেয়ের সাথে তার পরিপার্শ্বের পরিচয় করানো।
হাঁটতে হাঁটতে ঈশারা তিনজন কথাবার্তা বলছে। ঈশা তার স্বভাবমতো রিমিকে নানারকম গাছ ও ফুল চেনানোর চেষ্টা করছে। রিমির যে তাতে খুব একটা উৎসাহ আছে তা নয় তবে সে জায়গামতো হুঁ হাঁ করছে। সে নিজের মতো ফিরিস্তি দিয়ে চলেছে তার কলেজের কোন বন্ধুর কী ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা আর ঈশা ও হিমাংশু সে ব্যাপারে নিজেদের মতামত দিচ্ছে। কখনো বা সে মায়ের বাহু জড়িয়ে ধরছে। আসন্ন বিচ্ছেদের চিন্তা তিনজনেরই মনে কিন্তু মুখে কেউ তা প্রকাশ করছে না। কথায় কথায় অনেকটা হেঁটেছে তারা। ঈশার নিজের একটু ক্লান্ত লাগছিল তাই সে মেয়েকে বলে ‘তোদের এতো বড় ক্যাম্পাস যার এক প্রান্তে হস্টেল আর আরেক প্রান্তে তোর ডিপার্টমেন্ট! তোকে একটা সাইকেল কিনতে হবে রে রিমি।’ কথাটা নিজের কানে যেতেই হঠাৎ কী যে হ’ল ঈশার! কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসবার মতো এক অজানা অনুভূতি তার মনের গভীরে আকুল-করা এক ঢেউ তুলল। ঈশা টের পেল যে এ তার সেই বুকের ভেতর লুকিয়ে থাকা ইচ্ছে-পাখির কারসাজি - উপযুক্ত পরিবেশ পেয়ে আজ যেন সে নিজের অস্তিত্বকে প্রকাশ করতে চাইছে। আসলে, এই গাছপালায়-ঘেরা বিশাল ক্যাম্পাস, চারদিকে গবেষণা করতে আসা জ্বলজ্বলে চেহারার ছেলেমেয়েরা আর ঐ ‘সাইকেল’ শব্দটি অপ্রত্যাশিতভাবে তাকে যেন তার অনেকদিন আগে ফেলে আসা জীবনে নিয়ে গেল। পরিস্থিতির চাপে তার নিজের যে পিএইচডি করতে না পারার অতৃপ্তি সে এতোদিন গোপনে বয়ে বেড়িয়েছে আজ যেন তা প্রবল উচ্ছ্বাসে আসা বন্যার জলের মতো তাকে ভাসিয়ে নিয়ে চলেছে।
*
ঈশা নিজেও পড়াশুনোয় খুব ভাল ছিল। বিশেষত ওর বাবার আশা ছিল যে কৃতি ছাত্রী হিশেবে পড়াশুনোর জগতে সে বিশেষ স্বীকৃতি পাবে। কিন্তু তা তো হয়নি। হয়নি যে তার কারণ ঈশা নিজেই। হিমাংশুর প্রেমে পাগল হয়ে পোস্ট গ্রাজুয়েশন-এর শেষের দিকে সে ঝপ করে বিয়ে করে বসল। হিমাংশু তখন তার পিএইচডি-র মাঝামাঝিতে। তারপর অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে একলাই সে আমেরিকা পাড়ি দিল পিএইচডি করবার আশায়। মনে ভেবেছিল যে সবাইকে সে দেখিয়ে দেবে যে ইচ্ছে থাকলে নিজের জগৎটাকে কেমন করে গুছিয়ে নেওয়া যায়। কিন্তু পারল কই! একদিকে নতুন এক জগৎ ও পড়াশুনোর বিশাল চাপ আর অন্যদিকে সর্বদা মনে এক একাকীত্ব বোধ তাকে ওদেশে তিষ্ঠোতে দিচ্ছিল না। সে তো ইন্টারনেট আসবার আগের যুগ! অভ্যস্ত জীবন, হিমাংশু, বাবা-মা সবার জন্য মন-কেমন-করা ঈশার একটা অসুখে দাঁড়িয়ে গেল। দেশে লম্বা-লম্বা চিঠি লিখতো, বাড়ির চিঠি পেতে একটু দেরি হ’লেই উতলা হ’ত। স্কলারশিপ-এর সীমিত পরিমাণের কথা মাথায় রেখে দেশে ফোন করলেও তার পয়সা গুণে কথা বলতে হ’ত। ফলে বুকের মধ্যে জমে ওঠা একাকীত্বের কষ্টটাও তাতে লাঘব হ’ত না। নতুন পরিবেশকে চেনবার উৎসাহ ছাপিয়ে চেনা-জগতের আকর্ষণ ঈশাকে প্রতিদিন ছিন্ন ভিন্ন করতে লাগল। ছ’মাস বাদে হঠাৎ-ই বাড়িতে কিছু না জানিয়ে সবকিছু ছেড়েছুড়ে দেশে ফিরে এলো সে। সেখানেও আত্মীয়-বন্ধুদের কতোরকম যে প্রতিক্রিয়া! কেউ বলে ‘এমন সুযোগ পেয়ে কেউ ছাড়ে’ আবার কেউ বা বলে ‘যাক বাবা, ঘরের মেয়ে ঘরে ফিরে এসেছে!’
স্থিরভাবে তার সিদ্ধান্তকে গ্রহণ করেছিল একমাত্র হিমাংশু। বলেছিল, ‘আমার মতো দেশেই নাহয় পি এইচ ডি করো।’ সেইমতো গবেষণা শুরুও করেছিল সে। কিন্তু খুব অল্পদিনের মধ্যে হঠাৎ-ই ঈশা কলেজে পড়ানোর একটা চাকরি পেয়ে গেল। খুব সাধারণ কলেজ সেটি কিন্তু আর্থিক সচ্ছলতার কথা ভেবে গবেষণা স্থগিত রেখে পরম উৎসাহে সে পড়াতে শুরু করে দিল। সেই শুরু তার বুকের কাছে ইচ্ছে-নামের পাখিটার ছটফটানি। প্রাণোচ্ছল ঈশাকে দেখে কারোর বোঝার সাধ্য ছিল না যে তার মনের মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে এক অপূর্ণ বাসনা। অপরিণত বুদ্ধিতে তখন ভেবেছিল কিছুদিন পড়িয়ে আবার সে ফিরে যাবে গবেষণার জগতে। মাঝে মাঝে বিদেশের ক্লাসরুম, বন্ধু ও অধ্যপকদের বা তার গোলাপি সাইকেলটার কথা মনে পড়তো কিন্তু বর্তমানের চাহিদার তোড়ে মুহূর্তে ভেসে যেত তার সেই অতীত দিনের স্মৃতি। ভালো পড়ানোর জন্য ছাত্রছাত্রীরা ঈশাকে খুব পছন্দ করতে লাগল। তাদের পড়াশুনো ছাড়া অন্যান্য নানা সমস্যা নিয়েও তারা ঈশার কাছে আসতো। এইভাবে ঈশার সময়ের অনেকটা জুড়ে থাকতো তার ছাত্রছাত্রীরা। ততোদিনে হিমাংশু পিএইচডি শেষ করে চাকরি নিয়েছে এক ফার্মাসিউটিকাল কম্পানিতে। সেই সময় ঈশা চাকরি ছেড়ে আরেকবার ছাত্রীজীবনে ফিরে যাবার কথা যখন ভাবছে তখনি জানা গেল রিমির আগমনের সংবাদ। মাতৃত্ব-লাভের আনন্দে তখনকার মতো সব অপূর্ণতা সে ভুলে গেল। সন্তানকে বড় করে তোলা যে কি মোহময় এক অভিজ্ঞতা! ঈশা চাকরি-কন্যা-সংসার-আত্মীয়বন্ধু সামলাতে নাজেহাল হ’লেও নিত্যিদিনের জীবনযাত্রায় নিজের কর্তব্য যথাযথভাবে সম্পন্ন করার ঐকান্তিক চেষ্টায় সর্বদাই ব্যস্ত থেকেছে। তবে হিমাংশু কিন্তু মাঝে-মধ্যে বলেছে, ‘এই ডিগ্রীটি থাকলে তোমার কাজের জায়গায় সুবিধে হবে। শুরু করে দাও।’ সে নিজেও জানতো সেকথা কিন্তু কলেজের গতানুগতিক কাজকর্ম আর রিমিকে বড় করা ও সংসারের আর পাঁচটা দায়িত্বের চাপে ইচ্ছে থাকলেও গবেষণা শুরু করবার তার উপায় ছিল না। এতোসবের মধ্যে সে ঠিক টের পায়নি কবে যেন তার ইচ্ছে-পাখিটা মনমরা হয়ে থেকে থেকে প্রায় নীরব হয়ে গিয়েছে।
‘এবার কি ডানদিকে গেলে লাইব্রেরী?’ রিমির প্রশ্নে সম্বিৎ ফিরে পায় ঈশা। মনে মনে কোথায় চলে গিয়েছিল সে!
হিমাংশুর প্রিয় রসিকতা, ‘সেন্স অফ ডিরেকশন্-টা তুই তোর মায়ের কাছ থেকে পেয়েছিস, রিমি। ডানদিকে কেন...’ ইত্যাদি শুনতে শুনতে হাঁটতে থাকে ঈশা। তখনো যেন পুরোটা বর্তমানে ফিরতে পারেনি সে। বুকভ’রে গাছপালার গন্ধে আমোদ-করা বাতাসে নিঃশ্বাস নেয় ঈশা। সে খুব পরিষ্কার বুঝতে পারে যে এই পরিবেশ তার ইচ্ছে-পাখিকে করেছে বাঁধন-ছাড়া আর ঈশাকে তার অতীতে নিয়ে গিয়ে জাগিয়ে তুলেছে তার সুপ্ত বাসনা। মনে মনে ঈশা পাখিকে বলে ‘ঠিক আছে, আর অতীত নয় আমি এবার ভাববো ভবিষ্যৎ নিয়ে।’ আর তখনই হঠাৎ মনে পড়ে সেই দিনগুলোর কথা যখন রিমিকে সাঁতার শেখাতে গিয়ে নিজেও সে সাঁতার শিখতে চেষ্টা করছিল। রিমি চটপট শিখে গেলেও ঈশা খুব একটা ভাল শিখতে পারেনি বটে কিন্তু সুইমিং-পুলে গিয়ে যে চমৎকার সময় কাটতো তাদের দু’জনের সে তো ঈশার এক অনন্য সম্পদ! পুরনো দিনগুলোর কথা ভেবে আর কিছুটা অপূর্ণ আশার ধিকধিক আগুনে স্বস্তির প্রলেপ দিতে ঈশা কেন জানি একটু আহ্লাদী গলায় বলে ফেলে, ‘আচ্ছা, আমিও তো এখানে পিএইচডি শুরু করতে পারি’?
কথাটা শেষ করতে পারেনি, তীক্ষ্ণ কন্ঠে হিমাংশু বলে, ‘তুমি এখানে পিএইচডি শুরু করবে! কী যে বাচ্চাদের মতো আবোল তাবোল বল তার ঠিক নেই!’ ঈশার ফুরফুরে মেজাজটাকে এক ধমকে হিমাংশু যেন কঠিন জমিতে এনে আছড়ে ফেলল। খুব রাগ হ’ল ঈশার, নাকি দুঃখ অথবা স্বামীর ওপর অভিমান! গভীর একটা অনুভূতি তার ভেতরে উথাল-পাথাল ক’রছে এর থেকে বেশি বোঝার বোধ-ও যেন ঈশার হারিয়ে গিয়েছে। কথাটা রূঢ় সত্য তাই, নাকি সংযত স্বভাবের হিমাংশুর পক্ষে এহেন আচরণ একেবারেই অপ্রত্যাশিত-- সেই কারণেই ঈশার এই ধাক্কা তা সে ঠিক বুঝে উঠতে পারে না।
আস্তে করে সে বলে ‘মানে, এখানে না হ’লেও এখন তো করতে পারি।’
হিমাংশু তার কথার কোনো উত্তর দেয় না। স্পষ্টত তার নিজেরও খারাপ লেগেছে এমন স্বভাব-বিরুদ্ধ আচরণ করে। রিমি চুপ করে আছে। ঈশা ঠিক করে সে তার ভেতরের উত্তেজনা প্রকাশ করবে না। হিমাংশু কি ভাবছে যে সে তার মেয়ের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামতে চাইছে। পরমুহূর্তে ঈশা ভাবে ‘নাহ, ঐসব জটিল চিন্তাকে আমি প্রশ্রয় দেবো না।’ ‘হিমাংশু কেন এমন করল’ তা জেনে কী লাভ তার! পরের বছর কলেজ থেকে ছুটি নিয়ে সে কি পিএইচডি করবার চেষ্টা করবে? নাকি এসব ‘ছেলেমানুষী’ জীবনে আর কখনো যাতে তাকে পীড়া না দেয় মনকে শক্ত করে সেই চেষ্টা করবে? অথবা রিমির উচ্চ-শিক্ষা-প্রাপ্তিতেই তার নিজের সিদ্ধিলাভ সে কথা মেনে নিয়ে নিজের গতানুগতিক অভ্যাসে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেবে! এইসব ভাবতে ভাবতে ঈশা তার স্বামী-কন্যার সঙ্গে নীরবে হাঁটতে হাঁটতে ততক্ষণে লাইব্রেরীর সামনে এসেছে যেখানে বড় বড় গাছগুলো দু’দিক থেকে এসে রাস্তার মাথায় সবুজ ছাতা ধরে আছে। তাদের পাতার ফাঁক দিয়ে চুঁইয়ে আসছে অবাধ্য রোদ্দুর। ঈশা হঠাৎ ওপরদিকে চায়। নরম আলো তার মুখে ছড়ায় যেন দোলের দিনে প্রেমিকের মাখানো গোলাপী আবীর। গভীর আশ্লেষে সেই আলোয় নিজের সমস্ত অস্ত্বিত্বকে ডুবিয়ে দেয় ঈশা। নিজের মনে সে ভাবে ‘আমার আমি-কে চেনার এই কি আয়োজন।’ একটু আগে সামনে আসা প্রশ্নগুলোকে মনে মনে তাসের মতো সামনে ছড়িয়ে তার থেকে সে খুঁজে নিতে চেষ্টা করে উপযুক্ত উত্তরটি। মনের ভেতরে লুকনো অবাধ্য সেই পাখিটার ঝটপটানি সামলাতে সামলাতে নির্লিপ্ত মুখে মনস্থির করে ফেলে ঈশা; অদ্ভুত এক তৃপ্তিতে আবিষ্ট হ’য়ে খানিকক্ষণ সে চুপ করে থাকে। তারপর মাথা নামিয়ে ধীর পায়ে চলতে চলতে শান্তভাবে সে তার স্বামী-কন্যাকে বলে, ‘চলো, এবারে খেতে যাই।’