তুলসীতলার প্রদীপটা মাঝে মাঝে নিবু-নিবু হয়ে আসছে আবার মাঝে মাঝে জ্বলজ্বল করে উঠছে। দিদিমা পাঁচালী পড়তে পড়তেই প্রদীপের সলতেটা একটু উস্কে দিলেন। চারদিকে এখন ঘন অন্ধকার নেমে এসেছে। বিকেলের দিকে বেশ মেঘ করে এসেছিল। কিন্তু সন্ধ্যার পর এখন একটু হাওয়া দিচ্ছে। বৃষ্টি আসবে।
আজ সকালেই মায়ের সাথে সোনারপুরে মামাবাড়ি এসেছি। আমাদের দমদমের বাড়ির থেকে মামাবাড়ি ট্রেনে প্রায় এক দেড় ঘন্টার রাস্তা। স্টেশনে নেমে সাইকেল রিক্সায় পিচের বড় রাস্তা আর জলকাদাওয়ালা কাঁচা রাস্তা মিলিয়ে প্রায় চার কিলোমিটার পথ। আমি ক্লাস টেনে পড়ি। পড়াশুনোর বেশ চাপ। কিন্তু এখানে আসলেই খোলামেলা একটা আনন্দের পরিবেশ আমাকে ঘিরে ফেলে। শনি-সত্যনারায়ণের পুজোর জোগাড় সারা দুপুর ধরেই চলেছে। বিকেলের আকাশে একটু মেঘ দেখে দিদিমা আলো থাকতে থাকতেই পুজোতে বসে গেছেন। এই মফস্বলের দিকে কোন বাড়িতে এ ধরনের পুজো হচ্ছে শুনলেই সবাই উপস্থিত হয়। সন্ধে হতে না হতেই তাই পাড়ার লোকজন আসতে আরম্ভ করেছে।
মামাবাড়ি বলতে ঢোল কলমি গাছের বেড়া দিয়ে ঘেরা একটা চৌকোনা মাঝারি মাপের জমির ওপর টিনের চাল দেওয়া ইটের চারটে ছোট ছোট ঘর। মাঝের ঘরটার লাগোয়া একটা ঢাকা বারান্দা আছে। জমির এক পাশে কুয়ো কলতলা চানের জায়গা ইত্যাদি আর গেটের দিকটায় তুলসীমঞ্চ। চারদিক বেশ গাছগাছালি ঘেরা।
নিবুনিবু প্রদীপ আর কয়েকটা হ্যারিকেনের আবছায়া আলোয় উঠোনে প্রায় জনা তিরিশ চল্লিশ মানুষ শতরঞ্চি আর মাদুরে বসে পাঁচালী শুনছিল। দিদিমার পাঁচালীর সুর আর মৃদু ঠাণ্ডা হাওয়া একটা আমেজের সৃষ্টি করেছিল। সন্ধ্যা ঘনীভূত হয়ে উঠছিল। আমি বসেছিলাম তুলসীতলার সামনেই একটা মাদুরের ওপর। ছোটমাসির ঠিক পাশেই। আরো কয়েকজন মহিলা বাচ্চাদের নিয়ে বসেছিল সেখানে। একটি অত্যন্ত দুর্দশাগ্রস্ত পরিবার শনি ঠাকুরের পুজো করার পর কিভাবে আবার সুখ সমৃদ্ধির মুখ দেখল পাঁচালীতে চলছে তারই সুরেলা বর্ণনা। পাঁচালী-পাঠ জমে উঠেছে। হঠাৎ মনে হল পেছনে কেউ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। একেবারে বুকভাঙ্গা দীর্ঘশ্বাস। প্রায় নিঃশব্দে। পেছন ফিরে দেখলাম নানা বয়সি মহিলারা বসে আছেন। আমার তাকানোতে একটি কমবয়সী দীঘল মেয়ে লজ্জা পেয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিল। ঠিকমতো ঠাহর করতে পারলাম না। শুধু দীর্ঘশ্বাসের আওয়াজটা কানে বাজতে লাগলো। তখনই টের পেলাম আমার হাতের ওপর দু একটা বৃষ্টির ফোঁটা।
কাঁসর, ঘণ্টা, হুলুধ্বনিসহ পুজো শেষ হল। দেখলাম ছোটমাসি আমাকে পেছনের দিকে ডাকছে। মাসির পাশেই আবছা আলোতে দাঁড়িয়ে আছে একটি মেয়ে। মেয়েটির জোড়া বিনুনি ও প্রায়-জোড়া ভুরু দেখে বুঝলাম, এ-ই আমার পেছনের সারিতে বসে পাঁচালীর সময় দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিল।
মাসি মেয়েটিকে দেখিয়ে আমাকে বলল ‘ওর সাথে একটু যা আর কবীরদের বাড়ি থেকে দুটো বড় গামলা নিয়ে আয়। ও হল শান্তা। কবীরদের আত্মীয়। তাড়াতাড়ি কর এখনই প্রসাদ দিতে হবে।’ কবীর আমার বন্ধু। ওদের সবাইকেই চিনি। কিন্তু এই মেয়েটি এখানে নতুন বলেই মনে হল। আমি কিছু বলার আগেই দেখলাম মেয়েটি চলতে শুরু করেছে। অগত্যা আমিও তাড়তাড়ি একটা লন্ঠন নিয়ে সঙ্গ নিলাম।
‘এটা আমার মামাবাড়ি। তুমিও কি এখানে বেড়াতে এসেছ?’ আমি চলতে চলতে বললাম।
‘জানি। আপনের মাসী আমারে কইসেন।’ বাঙ্গাল ভাষা এখানে বেশিরভাগ বাড়ির বয়স্করাই বলেন।
‘তুমিও কি এখানে বেড়াতে এসেছো?’
‘হাঃ।’ আবার সেই দীর্ঘশ্বাসটা শুনতে পেলাম মনে হল। ‘গতমাসে আমরা আইসি এইহানে। বাংলাদ্যাশে আমাগো বাড়ি আছিল।’
অবাক হলাম। মেয়েটা পাস্ট টেন্স-এ চলে গেল কেন? আমি তো শুনেছি আমাদেরও বাংলাদেশে বাড়ি। এখনও ওখানে আমার জ্যাঠারা থাকেন। বছর কয়েক হোল বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে।
বৃষ্টিটা এবারে টিপটিপ করে শুরু হল। ছাতা একটা আনলে ভাল হত। ‘একটু তাড়াতাড়ি চলতে হইব। জোরে বৃষ্টি আইতাছে।’ মেয়েটার অস্ফুট গলার আওয়াজ শুনে পা চালালাম জলকাদা ভেঙ্গে।
হঠাৎ আমার হাতে একটা হেঁচকা টান দিয়ে মেয়েটা আমাকে একেবারে থামিয়ে দিল। হারিকেনের আবছা আলোতে দেখলাম একটা সড় সড় আওয়াজ পাশের ঢোলকলমি গাছের জটলার দিকে চলে গেল। একটা সাপ। আমার পায়ের খুব কাছে। মাথাটা ঢুকে গেছে জঙ্গলে আর লেজটাও আস্তে আস্তে ঢুকে গেলো। মেয়েটার অন্ধকারে অভ্যস্ত চোখ দেখে ফেলেছিল ওই মৃত্যুকে। লেজে পা পড়লে মৃত্যু নিশ্চিত ছিল হয়তো। ঘাড় থেকে পিঠ বেয়ে একটা ঠাণ্ডা স্রোত নেমে গেল নিচের দিকে। ওই সাপটাই নেমে গেল হয়তো বা।
‘কি হইল আগে চলেন। শনিবারে বিষ থাকে ওনাগো।’
‘শান্তা তোমার ভয় করছে না? এই অন্ধকার, বৃষ্টি, সাপ।’
‘নাহঃ, অনেক ভয় পার হইয়া আইসি।’
‘মানে?’
‘আমাগো বাংলাদ্যাশে অনেক বেশি অন্ধকার। লড়াই লাগলো। রাজাকার মুক্তিযোদ্ধা, সবকিছু জ্বইল্যা পুইড়া ছারখার হইয়া গেল। দ্যাশ স্বাধীন হইল কিন্তু অত্যাচার চলতে লাগল। টিকতে পারলাম না। আমরা ভিটা মাটি ছাইড়া পলাইয়া আইলাম এই দ্যাশে। অনেক সাপের লগে দেখা হইছে, লড়াই হইছে। জানিনা আর কতদিন এইভাবে চলতে হইব...। ওই তো আইয়া পড়ছি। আসেন আসেন।’
বাঁশের গেটের ওপারে কবীরদের বাড়ির মধ্যে টিমটিমে আলো দেখা যাচ্ছিল। উঠোন পেরিয়ে আমরা দুজন বারান্দায় উঠে দাড়ালাম। আর সেই মুহূর্তেই বাইরে আছড়ে পড়ল মুষলধারে বৃষ্টি।
‘দ্যাহেন কি ভাগ্যি বাড়ি আইসা গেসি।’ শান্তা নিশ্চিন্ত।
‘তাতে কি হল, আমাদের তো আবার ফিরতে হবে এখুনি। তুমি তাড়াতাড়ি যা নেবার নিয়ে নাও।’
ভেতরের টিমটিমে আলোটা আস্তে আস্তে এগিয়ে এলো বারান্দায়।
‘ক্যাডা রে শান্তা নিকি?’
‘হ বড়মাসি, দুইখান গামলা লাগবো তাই লইতে আইসি। প্রসাদ দেওনের লাইগ্যা।’
‘সঙ্গে ক্যাডা। ওই বাড়ির ভাইগ্না যে? আস, আস। বস একটু, বৃষ্টিটা একটু থামুক। একটু জল দিই তোমারে।’ ভদ্রমহিলা মানে কবীরের মা ও শান্তা ভেতরে চলে গেলো। আমি হারিকেনটা রেখে বসলাম।
এদের বাড়িটা বেশ বড়। একটা রেডিও বাজছিল, ‘খবর পড়ছি দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়।’ বিশেষ বিশেষ খবর শুরু হবার আগেই কেউ সেন্টার বদলে দিল। একটা গান ভেসে এলো নারীকন্ঠে, ‘আবার এসেছে আষাঢ়, আকাশ ছেয়ে।’ আমি বারান্দাতেই একটা মোড়ার ওপর বসে আছি। টালির চাল বেয়ে বৃষ্টির জল উঠোনে পড়ছে অনবরত। আমি ভাবতে লাগলাম বাংলাদেশের একটি মেয়ের দীঘির মত দুটো বিষাদগ্রস্ত চোখের কথা। ‘এসেছে এসেছে এই কথা বলে প্রাণ...’ বৃষ্টির শব্দে গানটা হারিয়ে যাচ্ছে মাঝে মাঝে।
ঘরের মধ্যে একজোড়া পায়ের শব্দ কাছে এলো। কবীরের মা আমাকে সন্দেশ ও জল দিলেন।
‘শান্তা তাড়াতাড়ি কর। ভাইগ্না তুমি তো দমদমের ওইদিকে থাক। শান্তারাও ওইখানে বেদিয়াপারায় রেল লাইনের পাশেই থাকে। অগো ঘরে বর্ষার জল ওঠায় এইখানে আইসা আছে। জল নামলেই চইল্যা যাইব।’
‘শান্তা বলছিল ওরা বাংলাদেশে থাকত।’
‘হ। ডাকাইতরা অগো ঘরবাড়ি জ্বালাইয়া দিলো, ওর বাবারে খুন করলো, আর অরা পলাইয়া আইল উদ্বাস্তু হইয়া। লুকাইয়া লুকাইয়া কি যে কষ্ট কইরা আইসে। শান্তার কথা কি আর কমু? এত ভাল আছিল ল্যাখাপড়ায়। এত সুন্দর মাইয়া। কি যে হইব, সবই কপালের ল্যাখা। কত বড় বাড়ি আছিল অগো, এখন রেল লাইনের পাশে ঝুপড়ি বাড়িতে থাকে, সেইখানে বৃষ্টির জল ওঠে।’
একটু পরেই ফেরার জন্য ছাতা নিয়ে উঠোনে নামলাম আমরা। দুটো গামলা আমার হাতে, ছাতা আর লণ্ঠন ধরেছে শান্তা। লন্ঠনের আলোতে একটু ভাল করে দেখতে পেলাম ওকে। লম্বায় প্রায় আমার মাথায় মাথায়, গায়ের রঙ মনে হল উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ। হ্যারিকেনের আলোতে মায়াবী এক উপস্থিতি। চারদিকে বৃষ্টি আর আমাদের চলার ছপ ছপ আওয়াজ। অবশেষে আমিই নীরবতা ভাঙলাম।
‘শান্তা’
‘হু’
‘তুমি তো শুনলাম ভাল স্টুডেন্ট ছিলে। এখানে এসে কোনো স্কুলে ভর্তি হয়েছ?’
‘ওই একটা মিউনিসিপালিটির স্কুলে ক্লাস এইটে। একবছর নষ্ট হইল। গত ছয় মাসে ক্লাস বেশি হয় নাই। এখন তো বন্যার কারণে মানুষজন স্কুল বাড়িতে আশ্রয় নিসে। জানিনা কবে স্কুল খুলব? অথচ বাংলাদ্যাশে আমার ইস্কুল কী ভাল আছিল। দিদিমনিরা কি ভালই না পড়াইতেন। আর বোধহয় আমার পড়াশুনা হইব না।’
‘কেন, অন্য ভাল স্কুলও তো আছে।’
‘কি হইব? আমাগো হাতে এখন আর টাকা পয়সাও নাই। কাকা, মাসিগো ভরসায় এইহানে আইলাম। জানিনা এনারাও আর কতদিন আর আমাগো দ্যাখব?’
আধো অন্ধকারেও দেখলাম ওই বড় কালো চোখদুটো ব্যথাদীর্ণ হয়ে উঠল।
‘সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে দেখো।’
‘কি কইরা হইব? ওরা তো বাবারে শ্যাষ কইরা ফালাইছে। আর দিদিরে যে কই হারাইয়া ফালাইলাম? আর কোন দিন অরে দ্যাখতে পামু কিনা কে জানে?’
‘তোমার মা কে তো দেখলাম না?’
‘মা তো কিরকম হইয়া গ্যাসে। কারো লগে কথা কয় না। এখন আমরা কি কইরা বাইচ্যা থাকুম সেই চিন্তাই করি সবসময়।’
বৃষ্টি মাথায় নিয়েই মামাবাড়িতে পৌঁছলাম। বললাম,
‘শান্তা, মাসি আমাকে পাঠিয়েছিল তোমার গার্ড হিসেবে। কিন্তু তুমি না থাকলে আজ সাপটা আমাকে কাটতেও পারত।’
‘কি যে কন। ওরা কিছু করে না। আসল সাপ তো মানুষের মধ্যেই আছে। আমার এক দিদিমনি বলতেন, মানুষ নিজে খারাপ হইতে না চাইলে কোন সাপ তার খারাপ কিছু করতে পারে না। খারাপ হওয়ার বীজ মানুষের নিজের মধ্যেই থাকে। সেইটাকে উপরাইয়া ফেলতে হয়। এই কথা আমি সারা জীবন মাইন্যা চলুম। আমি অনেক কথা বললাম, কিছু মনে কইরেন না।’ গামলাদুটো নিয়ে শান্তা ভেতরে চলে গেল।
বৃষ্টির জন্য পুরো ভিড়টা ঘরে আর বারান্দায় জড় হয়েছিল। প্রসাদ বিতরণের ব্যবস্থা শুরু হল। আমি ভাবতে লাগলাম এই মেয়েটা যেন অন্ধকারে পথ হারিয়ে ফেলেছে। ওর সম্বল শুধু ওর দিদিমনিদের শেখান মূল্যবোধ। মনে মনে প্রার্থনা করলাম যে এই শান্ত, দীঘল মেয়েটি যেন ভাল থাকে।
রাতে আকাশভাঙা বৃষ্টি নামল। টিনের চালের ওপর বৃষ্টির অর্কেস্ট্রা আমাকে গভীর ঘুমের দেশে নিয়ে গেল। একটা ভীষণ স্বপ্ন দেখলাম। একটা বিরাট জমিওয়ালা বাড়ি আগুনের লেলিহান শিখায় গ্রাস হয়ে যাচ্ছে। অন্ধকার রাত্রি। চারিদিকে বিষাক্ত চিৎকার। বাড়ির উঠোনে একজন মাঝবয়সি লোককে ঘিরে ফেলেছে একদল পিশাচ। তাদের হাতে লাঠি, দা, শাবল, ছুরি। গেটের কাছে একটা লোক বন্দুক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আর বাড়ির পেছনের দরজা দিয়ে কয়েকটি অস্পষ্ট অবয়ব চুপি চুপি বেরিয়ে মাঠের পথ ধরেছে। শান্তার মা আর শান্তাকে তাদের মধ্যে চিনতে অসুবিধে হয় না। গাছগাছালির আড়ালে গিয়ে শান্তার মা যেন আর নিজেকে সামলাতে পারলেন না। ‘আরে তর দিদি কই, দিদি? আরে আমার পোড়া কপাল রে! কি হইল ছেমড়িটার, কই গেল গিয়া?’ বাকি লোকজন ওনার মুখে হাত চাপা দিয়ে অন্ধকারের মধ্যে মিলিয়ে গেল।
সকালে উঠতে দেরি হয়ে গেল। মাসি বলল, ‘আরে তাড়াতাড়ি কর লুচি ঠাণ্ডা হয়ে যাবে তো। কি বৃষ্টি হচ্ছে দেখ।’ চারদিকের ভেজা প্রকৃতি চোখ জুড়িয়ে দিলো। দাদুর ট্রানজিস্টারে গান বেজে উঠল, ‘হায় পথবাসী, হায় গতিহীন, হায় গৃহহারা, ঝর ঝর বরিষে বারিধারা।’ গৃহহারা দুটি টলটলে চোখ মনে পড়ল। আমার কিশোর মন ভার হল। হয়তো জীবনে সেই প্রথম কারো জন্য একটা অন্য রকম অনুভুতি গ্রাস করল আমাকে।
আমি এখন একটা কাগজের অফিসে চাকরি করছি। সেই বৃষ্টি-সন্ধ্যার কথা মনের মনিকোঠায় থাকলেও আর কোন খবর পাই নি শান্তার। কলেজে পড়তে পড়তেই বাবা মারা গেলেন। তাই কোনরকমে কলেজ জীবন শেষ করেই আমাকে চাকরিতে ঢুকতে হয়েছিল। জার্নালিসম নিয়ে পড়ে ভাল রেজাল্ট করেছিলাম। সেই সুবাদে একটা বড় কাগজের অফিসে চাকরি পেতে বিশেষ অসুবিধে হয়নি। প্রথম দু চার বছর খবর সংগ্রহ ও টুকিটাকি লেখালেখির পর আমাদের সাব এডিটর বিমলদা আমাকে ডেকে বলেছিলেন যে আমার মধ্যে একটা বিশেষ কনফিডেন্স আছে। আমি নাকি যে কোন পরিস্থিতি খুব সুন্দর ট্যাকল করতে পারি। এই গুণটা নাকি আমাকে ওপরে উঠতে সাহায্য করবে। উনিই আমাকে শেখালেন কিভাবে খবরকে যাচাই না করে সামান্য ঘু্রিয়ে পরিবেশন করলে অনেক বড় বড় রাজনীতি বিদ, ব্যবসায়ীদের সুবিধে হয়। এই সমস্ত সুবিধাভোগীদের মাধ্যমে এলিট সোসাইটিতে ঘোরাফেরা করা যায় এবং সকলের কাছে সম্মান পাওয়া যায়। আমিও নিজের বিবেককে বুঝিয়েছিলাম যে ওপরে উঠতে গেলে বোধহয় একটু-আধটু বাঁকাপথে চলা অন্যায় নয়। এইরকম সত্য গোপন করা রিপোর্টিং-এর ফলে বিমলদার এবং আমাদের কাগজেরও অনেক সময় সুবিধে হয়েছে। বিমলদা তো অনেকটা ওপরে উঠেছেন এবং আমিও বছর দশেকের অভিজ্ঞতাতে নিজেই এখন একজন সাব-এডিটর হয়ে গিয়েছি। তবে বিমলদা এখনও আমার বস। লোকে বলে যেভাবে আমি ওপরে উঠছি তাতে কিছুদিনের মধ্যেই আমি বিমলদাকে টপকে যেতে পারি।
সেদিন আমাকে চিফ এডিটর তার রুমে ডেকে বললেন যে দিল্লী হেডঅফিস থেকে একটা কাজ এসেছে। ওরা চায় এই অফিসের সবচেয়ে স্মুথ অপারেটরকে এই কাজের ভার দিতে। ওনার নাকি আমাকে ছাড়া আর কারও কথা মনে পড়েনি। কাজটা একটা কভারেজে যাওয়ার। অনেকদিন পর ফিল্ডে যেতে হবে। অফিসের গাড়ি নেওয়া যাবে না গোপনীয়তার কারণে। কাজটা আমাকে একাই করতে হবে। কালই বেরিয়ে পড়বো। বিমলদা আমাকে অন-সাইট গাইড করবেন ফোনে।
পরদিন শিয়ালদা থেকে ঘণ্টা তিনেক ট্রেনে জার্নি করে বনগাঁর কাছাকাছি একটা স্টেশনে নেমে পড়লাম। বৃষ্টিটা সারাক্ষণ আমাকে তাড়া করে এখন বোধ হয় একটু হাঁপিয়ে গেছে। স্টেশনে নেমে সাইকেল ভ্যানে চড়ে কাদা প্যাচপ্যাচে রাস্তা দিয়ে ৩-৪ কিমি. গিয়ে দুপুরের আগেই পৌঁছলাম রসুলপুর। ভ্যানে যেতে যেতেই জানলাম রসুলপুর গ্রামে পুলিশ হানা দিচ্ছে বারে বারে। পরিস্থিতি বেশ উত্তপ্ত। ওখানে মাঝারি মাপের রাজনৈতিক নেতা রানাদার সঙ্গে দেখা করতে চাই শুনে ভ্যানওয়ালা আমাকে ওখানকার বটতলায় নামিয়ে দিয়ে গেল।
আমি যতদূর জেনেছি, গতমাসে এদিককার একটা সরকারী হাসপাতালে বড় রকমের ডাকাতি হয়ে গেছে। বাধা দিতে গেলে একজন সিস্টারকে রেপ করেছে দুষ্কৃতিরা। হাসপাতালের বিল্ডিং বাড়ানো হচ্ছিল। এককালীন পেমেন্টের জন্য বেশ কিছু টাকা তুলে রাখা হয়েছিল। ডাকাতরা নাকি সে খবর আগেই জানত। তাই রাতে চড়াও হয়েছিল। সংবাদ-সূত্র বলছে দুষ্কৃতিরা এসেছিল বাংলাদেশের থেকে নিকটস্থ সীমান্ত পেরিয়ে। তাদের সাথে স্থানীয় কিছু লোকের যোগসাজশ ছিল। পুলিশ প্রচণ্ড চাপের মধ্যে আছে। বাংলাদেশ বর্ডার পেরিয়ে দুষ্কৃতিদের পালিয়ে যাবার সম্ভাবনাও প্রবল। পুলিশ স্থানীয় দুষ্কৃতিদের খুঁজছে। আমাদের বহুলপ্রচারিত দৈনিকও নিজেদের মত করে অনুসন্ধান চালাবে।
বাবুল নামে একজন রাজমিস্ত্রি ধরা পড়েছে যে ওই বিল্ডিং বানানোতে কাজ করত। সে নাকি বিশেষ সাহায্য করছে না পুলিশকে। ওর স্ত্রী এই গ্রামেই থাকে, তার ওপরে পুলিশ নজর রেখেছে। তার কাছে কারা কারা আসে। কি কথা হয় ইত্যাদি। বর্ডারের প্রশাসনিক শিথিলতা প্রকট হয়েছে। এই গ্রামে হিন্দু ও মুসলিম দুই সম্প্রদায়ই বসবাস করে বলে একটা সাম্প্রদায়িক রঙ লাগার সম্ভাবনা প্রবল।
ভ্যান থেকে নামতেই একটি ছেলে আমাকে বটতলার চায়ের দোকানে ডেকে নিয়ে গেলো। বুঝলাম আমার আসার কথা এরা জানে এবং আমার অফিসই এইসব গ্রাউন্ড ওয়ার্ক করে রেখেছে। চায়ের দোকানে আমার জন্য অপেক্ষা করছিলেন সেখানকার স্থানীয় নেতা রানা-দা। তিনি বললেন গ্রামের পরিস্থিতি বেশ জটিল এবং ভীতসন্ত্রস্ত। এখানকার রাজনৈতিক মহল চেষ্টা করছে যাতে পরিস্থিতি হাতের বাইরে না যায়। বাবুল মিস্ত্রী জেলে। ওর স্ত্রীর কাছে নানা প্রলোভন ও ধমকি আসছে নানাদিক থেকে। বিশেষ করে বাংলাদেশী দুষ্কৃতিদের একটি গ্যাং-এর কাছ থেকে। যাতে সে পুলিশের কাছে কোন কথা না বলে। আমার সাক্ষাত্কার ও অন্যান্য কাজ খুব সাবধানে আর তাড়াতাড়ি সেরে ফেলতে হবে। এই গ্রাম মুসলিম-প্রধান। কিন্তু হিন্দুরাও আছে এখানে। বাবুল মিস্ত্রী হল মুসলমান আর ওর স্ত্রী হিন্দু। প্রচার হচ্ছে যে এখান থেকে নাকি পশু পাচারও হয় এবং এই গ্যাঙটাই তার সাথে যুক্ত। ইলেকশন কাছাকাছি বলে অনেক দিক থেকে এখানকার সাম্প্রদায়িক ব্যালেন্স নষ্ট করার চেষ্টা হচ্ছে।
আমি বুঝলাম এখানে আমার কাজটা বেশ কঠিন। তবে রানাদা সাহায্য করবেন। ভেতরের খবর অনুযায়ী, পুলিশ যাকে-তাকে ধরে নিয়ে গিয়ে মারধর করছে বলেও পরিস্থিতি বেশ তেতে আছে। পুলিশ পোস্টিং অনেক জায়গায় করা হয়েছে। বাবুলের গ্রেফতারে কিছু লোকজন খুশি নয়, ওর বিবিকেও বেশ কিছু লোক প্রোটেকশন দিচ্ছে।
বাবুলের বিবির সঙ্গে দেখা করাবার জন্য স্থানীয় ছেলেটি আমাকে প্রায় গ্রামের বাইরের দিকে একটা বিলে নিয়ে গেলো। অনেকটা জায়গা জুড়ে নিচু জমিতে জল জমে আছে — মাঝখান দিয়ে উঁচু সরু আলের রাস্তা। বিলের মাঝামাঝি একটু উঁচু জমিতে একটা টালির চালের বাড়ি। দেওয়াল ছেঁচা বাঁশের বেড়া দিয়ে তৈরি।
আমি আলপথে গিয়ে বাড়ির দরজায় পৌঁছলাম। বাড়ির সামনে একজন পুলিশ বসেছিল। আমি আইকার্ড দেখালাম আর রানা-দা পাঠিয়েছেন বলাতে সে আমাকে ভেতরে যেতে দিল।
একটা পুরনো শাড়ি দিয়ে বানানো পর্দা সরিয়ে ভেতরে ঢুকলাম। ঘরের মাঝখানে একটা মাঝারি মাপের তক্তপোষ। বিছানাটা গুটিয়ে একপাশে রাখা। বিছানার পাশের জানলা দিয়ে হাল্কা আলো আসছে। অন্য পাশের দেওয়ালের দিকে দুটো ছোট ছোট বেতের পুরনো মোড়া রাখা আছে। কিছু না ভেবেই মোড়ায় বসে পড়লাম। ভেতরের আলোটা চোখে সয়ে যেতেই নজরে পড়ল দেওয়ালে একটা ক্যালেন্ডার কেটে বাঁধানো লক্ষ্মী ঠাকুরের ছবি। সারা ঘরে দারিদ্র্যের ছাপ স্পষ্ট। কিন্তু এত দারিদ্র্যের মধ্যেও একটা গোছানো সংসারের আভাসও পাওয়া যাচ্ছে যেন।
একটু পরে ঘরে ঢুকলেন একজন লম্বাটে চেহারার মহিলা। বড় বড় চোখে সুরমা আঁকা, মিষ্টি চেহারা। তবে চোখের দৃষ্টি একটু ঘোলাটে। হাত দুটো বেশ কর্মঠ বলে মনে হোল। গায়ের রঙ রোদে পুড়ে গেছে। হাতজোড় করে নমস্কার বিনিময়ের পরে বললেন, ‘দেখুন আমার স্বামী পুলিশ লক-আপ এ আছেন। আমার এমন সম্বল নেই যে আমি ওনাকে ছাড়িয়ে আনব। যতদূর জানি উনি নির্দোষ।’
‘দেখুন আমি একটা বড় কাগজের একজন সাংবাদিক। আমার অফিস আপনাকে সাহায্য করতে চায়। আপনার জন্য ভাল উকিলের বন্দোবস্ত করে দেবে। আমরা শুধু সত্যি ঘটনা প্রকাশ করতে চাই।’ কিন্তু আমার কথা খুব একটা বিশ্বাসের উদ্রেক করলো কিনা বোঝা গেলো না।
‘আপনার পুরো নামটা জানতে পারিকি?’
‘আমার নাম রোশেনারা বেগম।’
‘কিছু মনে করবেন না, নিছক কৌতূহলে প্রশ্ন করছি। দেওয়ালে লক্ষ্মী ঠাকুরের ছবি টাঙানো আছে। ব্যাপারটা বুঝতে চাইছি।’
আমার কথা শেষ হবার আগেই উত্তর এলো।
এরকম একটা প্রান্তিক গ্রামে দুটি ধর্মের দুটি মানুষ এভাবে ধর্মীয় নিজস্বতা নিয়ে সহাবস্থান করছেন, ভাবতেই একটু অদ্ভুত লাগলো। ভাবতে লাগলাম এটা কি এরা ভীষণ গরিব বলেই সম্ভব নাকি এদের মনের প্রসারতা অনেক বেশি।
‘আপনাদের বিয়ে কীভাবে হয়েছিল?’
‘আমরা ভালবেসে বিয়ে করেছি। আমাদের মুর্শিদাবাদের গ্রামে এই বাবুল মিস্ত্রিরা মন্দির বানাবার জন্য এসেছিল। ওখানেই আমাদের দেখা, ভালবাসা ও পরে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে। টাকাপয়সা আমাদের ছিল না কিন্তু ভালবাসা ছিল। কোন বাজে নেশা ওর ছিল না। বিয়ের বছর দু-এক পরে আমাদের একটা মেয়ে হয়েছিল। কিন্তু রাখতে পারলাম না। অসুখে মারা গেলো সে। তারপর ভগবান আর দেননি। মেয়ের মৃত্যুর পরে লোকটা যেন কেমন হয়ে গেল। ও ভাবত পয়সার অভাবেই মেয়েটা চলে গেছে আমাদের। ও পয়সা রোজগারের দিকে ঝুকে গেলো। কিন্তু আমার বিশ্বাস ও কোন খারাপ কাজ করতে পারে না। আমি নিজে বাংলাদেশের রিফ্যুজি মেয়ে এত দুঃখ কষ্টের মধ্যেও কখনো মিথ্যের, অসততার আশ্রয় নিইনি।’
‘এখানে এলেন কবে?’
‘বছর দু-এক হোল। ও হাসপাতাল তৈরি করতে ঠিকাদারের সাথে কাজ করে, আর আমিও ওই হাসপাতালে একটা আয়ার কাজ জুটিয়ে নিয়েছি। আমি বহু কষ্ট করে উচ্চ-মাধ্যমিক পাস করেছিলাম অনেক বছর আগে। ভেবেছিলাম একটা নার্সিং ট্রেনিং নিয়ে নার্স-এর কাজ করব। কিন্তু কি যে হয়ে গেল...’
‘আচ্ছা, আপনার স্বামী কি কোন চক্রের মধ্যে পড়ে ছিল?’
‘দেখুন আমরা হতদরিদ্র মানুষ। আমার স্বামীও বাংলাদেশ থেকে এখানে এসে পড়েছিল আমার অনেক পরে। এখানে কাজের সুবিধে হবে এই ভেবে। কিন্তু এখন লোকে বলছে যে আমার স্বামীর সাথে কিছু লোক যোগাযোগ রেখেছিলো, তারা নাকি বাংলাদেশ থেকে বর্ডার পার হয়ে মাঝেমাঝেই আসত আর এইসব গ্রামে নানা খারাপ কাজ করে আবার পালিয়ে যেত।’
‘কিন্তু আপনার স্বামীর সাথে এদের যোগাযোগ কি করে হল?’
‘আমি জানিনা। ও ভালমানুষ। সবার সাথেই মিশতো। কেউ বোধ হয় কোনভাবে ওকে ফাঁসিয়ে দিয়েছে। তবে ইদানিং ও বেশ চিন্তায় ছিলো। মাঝে মাঝে বলতো, আবার অন্য কোথাও চলে যেতে হবে গো।’
‘আপনার একটা ছবি তুলতে চাই, আমাদের খবরের কাগজের জন্য, যদি আপত্তি না থাকে।’ খুব অনিচ্ছুক ও লাজুক ভঙ্গিতে আমার ক্যামেরার সামনে দাঁড়াল রোশেনারা। বৃষ্টি-দুপুর কেটে প্রায় বিকেল হয়ে এলো। কথায় কথায় আরও জানা গেল, বাবুল মিস্ত্রী জেলে থাকাতে এর আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ। আয়ার কাজে যা পাওয়া যায় তাই দিয়ে কোনরকমে চালাচ্ছে। কারো কাছ থেকে এখনও আর্থিক সাহায্য নেয়নি। পুলিশ ও প্রশাসন জিজ্ঞাসাবাদের নাম করে তাকে হেনস্থা করছে। বাবুল মিস্ত্রির ওপরও অত্যাচার হচ্ছে। কিন্তু এই গ্রামের হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে সবাই তার সঙ্গে আছে, তাকে ভেঙে পড়তে দেয়নি। ও জানে বাবুলের জামিন খুব সহজ হবে না। সামনে আছে একটা দীর্ঘমেয়াদী লড়াই, কিন্তু সে পিছপা নয়। সারা জীবন লড়াই তার সঙ্গী। সে বিশ্বাস করে যে সৎ থাকবে সবসময় জিত তারই হবে।
বাড়ির পাশের বিলের ওপর মেঘলা একটা সন্ধ্যা নেমে আসছে। কথাবার্তায় সময়টা কেটে গেল। একটা পরিষ্কার কাচের গ্লাসে একসময় চা-ও খেলাম। এবারে যাব। বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। কি মনে হতে ডিজিটাল ক্যামেরাটা খুলে একবার ছবিটা দেখলাম ঠিক উঠেছে কিনা। তখনই মনে হোল ওই জোড়া ভুরু কোথাও দেখেছি। ছবিটা আমাকে জোর করে কোথাও নিয়ে যাবার চেষ্টা করছিল। অন্য কোন সময় সরণীতে। স্মৃতির তোরঙ্গ খুলে হাতড়াতে হাতড়াতে অনেক আগের এক বৃষ্টি-রাতের কথা মনেও পড়ল। বাধা কাটিয়ে জিজ্ঞেস করলাম।
‘যদি কিছু মনে না করেন, একটা প্রশ্ন করব?’
‘বলুন কি বলবেন।’
‘আপনি কি কখনো সোনারপুরে ছিলেন?’
কেমন যেন একটু অন্যমনস্কতার ছায়া দেখলাম ওই জোড়া ভুরুর নিচের ঘোলাটে চোখ দুটোতে।
‘হ্যাঁ। অনেক আগে আমরা ওইখানেই এসেছিলাম বাংলাদেশ থেকে উদ্বাস্তু হয়ে। আমার মাসির বাড়িতে কিছুদিন ছিলাম। এসব এখন আর মনে করার চেষ্টা করি না। কি হবে অতীত নিয়ে বেঁচে থেকে? কিন্তু আপনি জানলেন কি করে?’
‘আমার মামাবাড়ি ওইখানে। আপনার সাথে সেই সময় দেখা হয়েছিল মনে হচ্ছে। কোন শনিপুজার সন্ধ্যায়।’
‘ও সে তো অনেক দিন আগের কথা।’
রোশেনারা সেই রাতের আর কোন কথা বলল না। হয়তো ঢেকে রাখল স্মৃতির ঝাঁপি। কিন্তু আমি খুঁজতে থাকলাম তালগাছ দিয়ে ঘেরা দীঘির মত গভীর দুটো চোখ।
টর্চ জ্বালিয়ে, বিলের ভেতরের আলপথ দিয়ে বড় রাস্তার দিকে চলতে লাগালাম। পেছনে পড়ে রইল মোষের পিঠের রঙের এক আকাশ, দিগন্তপ্রসারী মেঘ, দ্বীপের মত একটি ছোট বেড়া দেওয়া কুঁড়েঘর, আর হ্যারিকেনের সিল্যুটে দরজায় দাঁড়ান এক নারীমূর্তি। যার কাছে ভাল থাকার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ সৎ থাকা। আমার এখানকার মিশন কী ভালো করে জানি না, তবু মনে হোল ওই নারীকে বাঁচিয়ে রাখতেই হবে। বটগাছের নীচে ভ্যান পাওয়া না গেলে রাত ৮.০০ টার শিয়ালদহ লোকাল পাওয়া যাবে না। পা চালালাম তাড়াতাড়ি।
ট্রেনটা খালি ছিল। বসে বসে বড় রিপোর্ট তৈরি করলাম — ‘ডাকাতি ও রেপ-এর ঘটনাকে কেন্দ্র করে শান্তিপূর্ণ রসুলপুর গ্রামে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করার চেষ্টা চলছে। তার সাথে রয়েছে দেশের কয়েকটি সীমান্তের প্রশাসনিক শিথিলতা। কিছু দুষ্কৃতি বাংলাদেশ থেকে এপারে এসে ডাকাতি খুন এসব করছে। পুলিশ তাদের না পেয়ে স্থানীয় লোকেদের ওপর অত্যাচার করছে। বাবুল মিস্ত্রী বা ওর বিবি এইসব ঘটনার শিকার’ ইত্যাদি ইত্যাদি।
রিপোর্টটা ছবি সহযোগে বিমলদার মেইলে পাঠিয়ে দিলাম। কিছুক্ষণ পরে ফোন পেলাম, ‘রিপোর্ট পেয়েছি। এখন বাড়ি যা, কাল সকাল সকাল বাবুলের বিবির বাড়ি পৌঁছে যাস। ওখানে একজন উকিল ভদ্রলোক থাকবেন যিনি ওকে সাহায্য করবেন। আমি তোর সাথে যোগাযোগ রাখব।’
‘জানেন, রাতে আজকাল আর ঘুম আসতে চায় না। অনেক রাত অবধি জেগে-জেগে অন্ধকারের নানারকম শব্দ শুনি আর নানা কথা ভাবতে থাকি।’
‘কি ভাবেন এত?’
‘নিজের জীবনের কথা। কাল আপনার কথায় আবার সেই ভয়ঙ্কর দিনগুলোর কথা মনে পড়ল। যখন সমস্ত কিছু হারিয়ে আমরা বাংলাদেশ থেকে এদেশে চলে এলাম। একটা সুন্দর জীবনের স্বপ্ন দেখতে দেখতে আমরা ও আমাদের মত শতসহস্র পরিবার রাজনৈতিক বলি হয়ে গেল। স্বপ্ন শেষ হলেও জীবন সংগ্রাম চলতে থাকল।’
‘যে যার মত জীবনসংগ্রাম তো সকলেই করছে।’ আমি বললাম।
কথা বলতে বলতে নজর করলাম রোশেনারা বিবির ঘোলাটে চোখে আর বিলের জলে আকাশের ছায়া খেলছে। ও যেন আজ অনেকটা মন খুলে কথা বলছে।
সকাল নটার আগেই রসুলপুর পৌঁছেছিলাম। কালকের বটতলার ছেলেটি এসে আমাকে বলল ‘কাল রাতে কিছু বাইরের লোক বাবুলের বিবির সাথে দেখা করে ওকে ভয় দেখিয়ে গেছে। আপনি একটু সাবধানে ওনার বাড়িতে যাবেন।’ বাবুলের বিবি তো ওদের টার্গেট। এছাড়া যারা ওর সাথে দেখা করছে তারাও টার্গেট।
রোশেনারা বিবির বাড়িতে এসে ওকে বললাম, ‘আমাদের অফিস একজন উকিলের ব্যবস্থা করেছে। উনি বাবুলের জামিনের ব্যবস্থা করে দেবেন। কিন্তু উনি যেভাবে বলবেন সেভাবেই আপনাকে চলতে হবে। গতকাল আপনাকে কেউ বা কারা এসে কিছু বলেছে?’
‘হ্যাঁ, দু তিনজন অচেনা লোক এসে বলছিল, আমি যেন বাবুলের বন্ধুদের ব্যাপারে পুলিসকে বা আর কাউকে কিছু না বলি। অন্যথা হলে জানে মেরে দেবে। অস্ত্র ছিল ওদের কাছে।’
‘আপনি ওদের কি বললেন?’
‘বাঁচা মরার ব্যাপারে শেষ কথা ভগবান বলবেন। তবে এই ব্যাপারে আমি বিশেষ কিছু জানি না।’
উকিলবাবু এলেন কথাবার্তার মাঝেই। জানালেন যে তিনি প্রথমে বাবুলের হয়ে মানবাধিকার রক্ষার ব্যাপারে কেস করবেন। ওনার অনুমতি ছাড়া যেন কাউকে কিছু না বলা হয়। কাল রাতে একজন সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে পুলিশ ধরেছে, বর্ডারের কাছ থেকে। লোকটি বর্ডার পেরিয়ে যাবার চেষ্টা করছিল। রোশেনারা-বিবিকে হয়তো পুলিশ ডাকবে, আইডেন্টিফিকেসন-এর জন্য। কিন্তু উনি যেন হ্যাঁ, না কিছুই না বলেন। যদি কোন কথা বলেন, তবে বাবুলকেও বাঁচানো যাবে না। চলে যাবার আগে বললেন যে উনি বিকেলের দিকে আসবেন, কেস এর কাগজপত্র তৈরি করে।
উকিলবাবু চলে যাবার পর আবার রোশেনারার কথা শুরু হল।
‘আমাদের বিয়ে বা শাদির পর কোন সমাজই আমাদের সেভাবে আপন করেনি। এইসব জ্বালায় জ্বলতে জ্বলতে আমার স্বামী কি করেছে আমি জানিনা। তবে এখন মাঝে মাঝে ভাবি যে সৎ পথে থাকার ব্যাপারটা কি শুধুই ফাঁকা বুলি? তবু আমি টিঁকে আছি এই পথেই। এটুকুই বোধ হয় আমার জোর। রাতে আমার এই দাওয়া থেকে বিলের উপর বিশাল তারাভরা আকাশটাকে বড় মায়াময় মনে হয়। আমি আমার স্বপ্নগুলোকে নিয়ে বিলের ওপর কল্পনার ভেলায় ভাসতে থাকি। একজন সুন্দর মানুষ হবার স্বপ্ন, একটা সুন্দর সংসারের স্বপ্ন। জানেন, আমার মূল্যবোধ আমি বিসর্জন দেবো না। হয়ত আমার স্বামী পারেননি তাকে আগলে রাখতে, কিন্তু আমি রাখবো। কাল যখন অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে কিছু লোক আমাকে জানে মেরে দেবার ভয় দেখাল, তখন আমার হাসি পেলো। ভাবলাম এতদিন পরে কি আমার ছোট্ট ভেলাটাকেও ওরা নিয়ে নিতে চাইছে? এত কম দামে?’
আমি দেখলাম এই মহিলার চোখ দুটো আবার দীঘির মতন হয়ে উঠেছে। হঠাৎ মনে হল এই মেয়েটার তো তবু একটা ভেলা আছে। আমার কি আছে? এই বিলের নিচের বিষাক্ত সাপগুলোর থেকে বাঁচবো কিভাবে? ওনাকে সাবধান-বাণী শোনানো বড় হাস্যকর মনে হল নিজের কাছে। মাথা নিচু করে দাঁড়ালাম কিছুক্ষণ। তারপর বিকেলে আবার আসব বলে বিদায় নিলাম। শুধু বললাম এই অস্থির সময়ে আপনাদের মত মানুষের এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকাটা খুব জরুরী।
ওখান থেকে বেরিয়ে আমি গেলাম থানায়, যদি কোন খবর পাওয়া যায়। কিন্তু থানায় বড়বাবু নেই, বাকিরা কোন খবর দিল না।
ষ্টেশনের কাছে একটা ছোট ঝুপড়িতে দুপুরবেলা খেতে খেতে শুনলাম যে একটা প্রাইভেট টিভি চ্যানেলের লোকজন এসেছিল রোশেনারা বিবির ইন্টারভিউ নিতে। লোকাল রাজনৈতিক দাদারাও এসেছিল দেখা করার জন্য। ওই মহিলা নাকি বলেছেন পুলিশকে সাহায্য করবেন। এইসব নিয়ে গ্রাম অশান্ত হয়ে উঠেছে।
ভ্যান খুঁজতে লাগলাম রসুলপুর যাবার জন্য। গণ্ডগোলের জন্য কোন ভ্যান যেতে চাইছে না। রোশেনারার ভীষণ বিপদ। ঠিক সেই সময় বিমলদার ফোন এল — ‘তুই এখনই ওই জায়গা ছেড়ে চলে আয়। ওখানকার অবস্থা খুব খারাপ। ১০-১৫ মিনিটের মধ্যে ট্রেন না থাকলে বাস ধরে চলে আয়। চ্যানেলের লোকেদের ক্যামেরা ভেঙ্গে দিয়েছে গ্রামের লোক। কয়েকজন আহত হয়েছে। কোনরকমে গাড়ি নিয়ে পালিয়েছে ওরা। তোকেও খুঁজছে। আর রিস্ক নিস না। তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়।’
ট্রেনের দেরি আছে দেখে, আমি বাস রাস্তায় গিয়ে তাড়াতাড়ি কলকাতার বাসে উঠে পড়লাম। রাতে আজকের রিপোর্ট পাঠিয়ে দেবার পরেই বিমলদার ফোন পেলাম — ‘কাল আর বের হস না বাড়ি থেকে। শুনেছি রসুলপুরে খুব গণ্ডগোল হচ্ছে।’
প্রায় বিনিদ্র রাত কাটিয়ে সকালে চিন্তিত মনে আমাদের কাগজটা খুললাম। প্রথম পাতার নিচের দিকে একটা খবর বেরিয়েছে। ‘রসুলপুরে গ্রামের বিলে মহিলার লাশ উদ্ধার। কে বা কারা মহিলাকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে খুন করে গতরাতে বিলের জলে ফেলে গিয়েছিল। সন্দেহ করা হচ্ছে দুষ্কৃতিদের গ্যাং-টি বদলা নিয়েছে, কারণ ওই মহিলা পুলিশ কাস্টডিতে ধৃত বাংলাদেশীকে বাবুলের সঙ্গী হিসেবে সনাক্ত করেছে। এই ঘটনায় ও নানা গুজবে ভর করে এলাকায় সাম্প্রদায়িক উত্তেজনাও ছড়িয়ে পড়ছে’ — ষ্টাফ রিপোর্টার। বিমলদা ফোনে এইসব খবর জোগাড় করেছেন। বুকের একেবারে গভীর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস উঠে এল। নিজের ভালোবাসার মানুষকে বাঁচাবার জন্যেও রোশেনারা সত্যির পথ থেকে সরে যায়নি তাহলে। যার জন্য তাকে নিজের জীবনও দিতে হল। কাল যদি পালিয়ে না এসে ওকে কোন গোপন জায়গায় সরিয়ে দিতে পারতাম! পারলাম না। নিজের ওপর বড় ঘৃণা হোল। কি জানি, আমার মত একজন ‘অসৎ’ মানুষের সাহায্য হয়ত ওর দরকারও ছিল না। কিন্তু পুলিশ তো পাহারায় ছিল, তবে কি সেই সময় পাহারা সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল? কেন? সাম্প্রদায়িক বিভাজনের জন্য কোন রাজনৈতিক খুন নয়ত এটা? নিতান্তই এক অকিঞ্চিতকর মানুষকে।
সেই দীঘির মত চোখদুটো সারাদিন মনের আকাশ জুড়ে রইল। আমার নিজের চোখদুটোও কি দিঘি হয়ে উঠল?
আমি দাঁড়িয়ে আছি একটা ষ্টীমারের ডেকে। সামনে সমুদ্রের দিগন্তরেখা সিঁদুর রঙে রাঙা হয়ে উঠছে। আর দু-এক মিনিটের মধ্যেই সূর্যোদয় হবে। অন্ধকার থাকতে থাকতেই এই জলযানে উঠে এসেছি। আন্দামানের পোর্ট ব্লেয়ার থেকে অনেকটা দূরে একটা আইল্যান্ডে যাবার জন্য সব যাত্রীরা তৈরি। কিছু স্থানীয় লোক, বেশিরভাগ ট্যুরিস্ট, আর আমদের চারজনের একটা টীম। আমি আমাদের দলে শেষতম সংযোজন। আমাদের খবরের সংস্থা থেকে পাঠানো হয়েছে এখানকার জারোয়া উপজাতিদের জীবনযাত্রার প্রতিকুলতার ওপরে একটা ফিচার তৈরি করার জন্য। এই টীমে একজন ক্যামেরাম্যান ও দুজন সিনিয়র সাংবাদিক রয়েছেন যারা রীতিমতো অনেক গবেষণা করে এই যাত্রায় সামিল হয়েছেন। আমি শেষতম এবং কনিষ্ঠতম, যে কোনরকম প্রস্তুতি ছাড়াই এই যাত্রায় সামিল। গতকাল বিকেলেই কলকাতার থেকে এসে আমি যোগ দিয়েছি এই টীমে।
গতপরশু বিকেলে আমার কাছে বিমলদার ফোন আসে যে আমার কলকাতায় এখন আর থাকার দরকার নেই, আমাকে আন্দামানে একটা এক্সপিডিশনে পাঠানো হচ্ছে দিল্লী থেকে, আমার কাগজের কম্পানি আমার কাজে খুশি। এই কাজটা আরও ইম্পরট্যান্ট। আমি কোনও মতে বললাম, ‘কিন্তু বিমলদা, এখানে আমার কাজ তো শেষ হয়নি। বরং শুরু হয়েছে। ওখানে কি হয়েছে তার আসল ব্যাপারটা খুঁজে বার করতে হবে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস খুনটা রাজনৈতিক, অনেক মুখোশ খোলার সময় এখন।’ বিমলদা একটু যেন বিরক্ত হলেন মনে হল। ‘কাল খুব বেঁচে ফিরেছিস। ওই মহিলা বারণ করা সত্ত্বেও পুলিশ কাস্টডিতে থাকা মানুষটিকে শনাক্ত করেছিল দুষ্কৃতি হিসেবে। ওরাই নাকি ডাকাতি ও রেপ কেসে জড়িয়ে আছে। ওর স্বামীকে ওরাই নাকি ভয় দেখিয়ে জড়িয়ে নিয়েছিল। ওখানে তোর আপাতত আর কোন কাজ নেই। এখন নেক্সট ডেস্টিনেশন আন্দামান।’ ইমেইল-এ টিকিট চলে এল। দমদম থেকে বেলা দশটার ফ্লাইট।
পরদিন সকাল আটটায় বিমানবন্দরে পৌঁছলাম। কি মনে হল, চেক ইন করার পর আমাদের কাগজটার পাতা উল্টোতে লাগলাম। প্রথম পাতাতেই খবরটা চোখে পড়ল। ‘রসুলপুরের শান্তি বিঘ্নিত।’ বাবুলের ব্যাপারে লিখেছে — ‘একজন বাংলাদেশী মুসলমান নিয়মবিরুদ্ধ ভাবে এদেশে ঢোকে এবং জোর করে একজন হিন্দু মহিলাকে ধর্মান্তরিত করে বিবাহ করে। মহিলার ওপর অকথ্য অত্যাচার করতে থাকে। মানুষটি পশুপাচার সহ নানা অসামাজিক কাজে জড়িয়ে যেতে থাকে স্থানীয় ও বাংলাদেশ থেকে আগত দুষ্কৃতিদের সাথে নিয়ে। শেষতমটি হল হাসপাতাল বিল্ডিং-এর টাকা লুঠ এবং একজন মহিলাকে বলাৎকার। তার হিন্দু স্ত্রীকে ভিন্ন সম্প্রদায়ের দুষ্কৃতিরা খুন করে যাতে উনি এইসব ঘটনার সাক্ষী দিতে না পারেন। এই ঘটনায় শান্তিপূর্ণ গ্রামের দুই সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে শুরু হয়েছে বৈরিতা। বাবুলের বাড়ি কারা জ্বালিয়ে দিয়েছে। স্থানীয় লোকজন থানা ঘেরাও করেছে। পুলিশ ও প্রশাসনকে রেড এলার্ট করে দেওয়া হয়েছে। যে কোন সময় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগার সম্ভাবনা।’ এটুকুই খবর এবং নিচে সংবাদদাতার জায়গায় আমার নাম লেখা।
এরকম একটা মিথ্যাচারে আমার চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল। ওখান থেকেই বিমলদাকে ফোন করে জিজ্ঞেস করলাম ‘আজ এটা কি রিপোর্টিং হল বিমলদা?’ উনি বললেন ‘ইলেকশনের আগে এটাই তোর কাজ ছিল। ওখানে অশান্তি সৃষ্টি হয়ে গেছে। এর জোরেই তো তোর আন্দামান ট্রিপ পেয়ে গেলি। আর ম্যানেজমেন্ট পরের মাসেই তোকে সিঙ্গাপুরে পাঠাবে রিপোরটিং-এর একটা অ্যাডভানস কোর্স করার জন্য। যেটা করার পর তোর আরও একটা প্রোমোশন বাঁধা। তুই দেখছি আমার চাকরিটা খাবি। হা হা।’
আমি দাঁতে দাঁত চেপে বললাম। ‘এ তো মিথ্যা, এটা তো আমার রিপোর্ট নয়। আমি তো আপনাকে বিশ্বাস করেছিলাম। একজন নির্দোষ মানুষ খুন হয়েছে, অনেকে জেলে আছে, আজ তো দাঙ্গা লেগেই যাবে। অনেক মানুষের হতাহতের কারণ হব আমি। সবাই তাই জানবে। কেন করলেন এটা আমার সাথে? সারা জীবন আমি কি জবাব দেব নিজেকে?’
গলা প্রায় বুজে এলো। চোয়াল শক্ত করে কি কান্না চাপা যায়?
ওপাশ থেকে একদম ঠাণ্ডা গলা ভেসে এল,
‘এরকম রিপোর্ট তো আগের কেসগুলোতেও বেরিয়েছিল। তখন তো এসব মনে হয়নি। যাক গে। তাড়াতাড়ি ফোন বন্ধ কর, আর প্লেনে উঠে পড়। আন্দামানে গিয়ে ল্যান্ড করা পর্যন্ত তোর জীবনের কোন গ্যারান্টি নেই। নিজেকে একটু আড়াল করেই রাখিস। অনেক মানুষ তোকে খুঁজছে। অনেকের ধারণা তুই অনেক কিছু জেনে গেছিস কারণ ওই মহিলাকে তুই আগে থেকে চিনতিস। তবে জানবি যেটা হোল সেটা তোর পক্ষে দারুণ ভাল হল। আর তাছাড়া এটা তো হবারই ছিল। তোর নামটা ব্যবহার করা হয়েছে মাত্র।’
কিছু বলার আগেই ফোনটা ওপাশ থেকে কেটে দিলেন উনি।
আমি বুঝতে পারছিলাম যে একটা চক্রব্যূহের ভেতরে ঢুকে পড়েছি। আমার রিপোর্ট-এর জন্য দাঙ্গা লাগছে। গ্রামের লোক আমাকে খুঁজছে, দুষ্কৃতিদের পুরো গ্যাং আমাকে খুঁজছে। পুলিশও আমাকে কেস দিতে পারে। বিমলদাই কি নিজের কারণে আমাকে ব্যবহার করে এলিমিনেট করে দিলেন? এই ঘটনার পরে সাংবাদিক মহলে আমার আর কোন ক্রেডিবিলিটি থাকবে না। আমি নিশ্চিত যে ভোটের আগে এক ভয়ানক রাজনৈতিক খেলাই ওই শান্তিপূর্ণ গ্রামে সাম্প্রদায়িক বৈরিতা সৃষ্টি করছে। ঘটনা কবে থিতিয়ে যাবে তাও জানিনা। ততদিনের জন্য আমার ছুটি অবেলাতেই।
আপাতত আমি থাকবো জঙ্গলে। প্রাচীন ‘অসভ্য’ উপজাতিদের সঙ্গে। সভ্যতার আলো যাদের স্পর্শ করেনি। এর পরের ঠিকানা অজানা। ঘণ্টা দুয়েক চলার পর ষ্টীমারের ডেক থেকে একটা ছোট সবুজ দ্বীপ দেখা গেলো। কেউ একজন বলল যে আমাদের নাকি এই জঙ্গলেই নামতে হবে। কিছু লোক পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে, যারা আমাদের নিয়ে যাবে গভীর জঙ্গলে জারোয়াদের কাছে। সেটাই হবে আমাদের আগামী কয়েকদিনের আস্তানা।
জঙ্গলের কাদাজলের মধ্যে নেমে প্রাণভরে শ্বাস নিলাম। কেন জানিনা অদ্ভুত একটা প্রশ্ন মনে এল। আমি কি শ্বাপদসঙ্কুল অরণ্যে, তথাকথিত ‘অসভ্য’ উপজাতি জারোয়াদের কাছে সভ্যতার আলো নিয়ে যাচ্ছি, নাকি যাচ্ছি ওদের অন্ধকারে আশ্রয় নিতে? আমি সত্যিই জানিনা। পথ ক্রমশ আরও কঠিন হয়ে উঠতে লাগলো।
*(গল্পটির সব চরিত্র কাল্পনিক। একটি সংবাদ সূত্রের ছায়া গল্পটির কিছুটা অবলম্বন)