"এষ পুষ্পাঞ্জলি সপরিবারসবাহনস্থপশুপতিনাথায় নমোহ" — কি গম্ভীরমুখে বলতেন ঠাকুরমশাই। "এষ পুষ্পাঞ্জলি রাধাকান্তগোপিকাকান্তগোবিন্দায় নমোহ" — কি দরদ দিয়ে বলতেন ঠাকুরমশাই। পাঁচ বছরের অঞ্জু মহা ভক্তিভরে ফুল হাতে নিয়ে চোখ বন্ধ করে শুনতো মন্ত্রগুলি। এষপুষ্পাঞ্জলির পরের খটোমটো কথাগুলি তার ছোট্ট জিভের উচ্চারণে আসতো না। তাই ব্যাপারটাকে সে নিজের মতো করে নিয়েছিলো। "এষ পুষ্পাঞ্জলি নমো নমো" এই কথা নিজের মনে বলেই তার খুদে খুদে আঙুলে ধরে থাকা ভিজে ফুলগুলি আরাধ্যদেবতার মূর্তির পায়ে ছুঁড়ে দিতো।
অঞ্জলি একটু হাসলো। লজ্জার হাসি। অঘোরনাথও হাসলেন। হেসে বললেন — " অঞ্জু! তুই না আমার মেয়ে? আমার মতো কি কিছুই পাস নি?" অঞ্জলি অর্থাৎ অঘোরনাথের একমাত্র কন্যা তাঁর অঞ্জু এবার হেসে উত্তর দিলো — "কেন বাবা? এইবার তো ঠিক হয়েছে।" অঘোরনাথ তাঁর ছ'বছরের মেয়েকে কোলে টেনে নিয়ে বললেন — "তা বটে! তিনবারের বার! তাও ই-কারের মাথাগুলো দেখো — যেন খাড়া তীরের মতো। এর পাশে এই বয়সে আমার হাতের লেখাটা দ্যাখ দেখি! স্কুলে হেড স্যার বলতেন .... "অঞ্জলি তার বাবার বুকে মাথা রেখে ভাবতো — 'সত্যিই বাবার হাতের লেখাটা যেন মুক্তো। তার পাশে তার নিজের হাতের লেখাটা দেখলে কি বিচ্ছিরিই না লাগে! কতো চেষ্টা করে সে, কিন্তু কিছুই হয় না। মনটা ভারী খারাপ হয়ে যায় তার। ছোটো ছোটো আঙুলে অঘোরনাথের হাতটা চেপে ধরে সে। আর নিজের মনেই বলে — " দূর! আমি পারি না কিছুতেই।"
অঞ্জলি একটু হাসলো। বোকার মতো। তার মায়ের দিকে তাকিয়ে। অঞ্জলির মা সুভদ্রা চেঁচিয়ে উঠলেন — "হাসতে লজ্জা করে না তোর? এটা একটা সাজ হলো? এইভাবে আমার বন্ধুর বাড়ি নিয়ে যাবো তোকে?" অঞ্জলি থতমত খেয়ে জিজ্ঞাসা করলো — "কেন? কি অসুবিধে?" অঞ্জলির মা আরো গলা চড়িয়ে উত্তর দিলেন — "কি হয়েছে? বাড়িতে আয়না নেই? একটু তো বড়ো হয়েছিস? চোখ নেই?" অঞ্জলি একদৌড়ে আয়নার সামনে এসে দাঁড়ালো। 'কি ভুল হলো তার! — সে পরেছে একটা লাল ফ্রক — এটা তো সে পরে মাঝেসাঝে বাইরে যাওয়ার সময় — আর মাথায় দিয়েছে বড়মামার দেওয়া সেই নীল পাথর বসানো হেয়ারব্যান্ডটা — এটা বড়ো প্রিয় জিনিস তার — তাহলে কি এইজন্যেই খুব বিচ্ছিরি লাগছে? — হয়তো তাই — মায়ের মতো চেহারা তো সে পায় নি — পায়নি সেই ধবধবে ফর্সা রং — কিংবা দুগ্গা ঠাকুরের মতো মায়ের টানা টানা চোখমুখ — 'এইসব ভাবতে ভাবতে নিজের মুখটা আয়নায় আরো কাছে নিয়ে যেতে গিয়ে সব কিছু হঠাৎ আবছা লাগলো অঞ্জলির। তখনই শুনতে পেলো — " কি হলো? হাঁ করে আর আয়নার সামনে না দাঁড়িয়ে সাদা ফ্রকটা পরে আয় তাড়াতাড়ি।" মাথা নীচু করে চোখের জল মুছতে মুছতে নিজের মনেই সে বলতে থাকলো — " কিচ্ছু পারি না... কিচ্ছু পারি না আমি... এমনকি সাজতেও না।"
অঞ্জলি একটু হাসলো। হয়তো খুসির হাসি। একান্তে। যদিও তা চোখ এড়ালো না তার সদ্য বিবাহিত স্বামী প্রভাতের কাছে। প্রভাত গম্ভীর হয়ে জিজ্ঞাসা করলো — "হাসলে কেন?" অঞ্জলি থতমত খেয়ে উত্তর দিলো — "না তো। হাসিনি তো।" প্রভাত গম্ভীর ভাবে উত্তর দিলো — "তাহলে কি আমি মিথ্যে কথা বলছি?" অঞ্জলি অত্যন্ত কুন্ঠিতভাবে বললো — "না না সেকি! তা কেন?" প্রভাত বলে যেতে লাগলো — "আমি কিন্তু তোমাকে কোনো মজার কথা বলিনি। বিয়ের পর স্বামী স্ত্রীর দৈহিক সম্পর্ক হবে সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তার ফলাফলটাও স্মরণ রাখা উচিত। তাই তোমায় জিজ্ঞাসা করছিলাম যে তোমার শীগগিরই মা হওয়ার ইচ্ছে আছে কিনা। কারণ তোমার উত্তরের উপর আমার কাজের ধারা নির্ভর করছে।" এই বলে একটু থামলো প্রভাত। তারপর আরো ধীরে ধীরে আরো গম্ভীরমুখে সে বলে গেলো — "কেউ কোনো কথা সিরিয়াসলি বললে তাতে হাসতে নেই। এইসব ম্যানার্সগুলো তো শিখতে হবে তোমায়।" অঞ্জলির মুখটা কালো হয়ে গেলো তার স্বামীর কথায়। সে বলতে যাচ্ছিলো যে অত কিছু ভেবে সে হাসে নি। কিন্তু বলতে পারলো না। কারণ তার কানে আসছিলো — "সব শিখতে হবে তোমায়... শিক্ষিত ভদ্র সমাজে কি ভাবে... ।" অঞ্জলি মাথা নীচু করে ভাবছিলো 'সত্যিই কি কিছুই শেখেনি সে এতদিন? এইবার তাহলে শিখতে হবে সঠিক আচার ব্যবহার?' তার ঘোর ভাঙলো প্রভাতের কথায় — "রান্নাঘরে ভাত বসিয়ে এসেছো খেয়াল আছে?" অঞ্জলি নিজেকে বললো — " আমার দ্বারা কিচ্ছু হয় না! কিচ্ছু না!"
অঞ্জলি একটু হাসলো। সামান্য সন্তুষ্টির হাসি। অঞ্জলির একমাত্র মেয়ে পিয়া স্কুলের ফ্রকটা বিছানায় ছুঁড়ে দিয়ে চেঁচিয়ে বলে উঠলো — "রাবিশ।" অঞ্জলির মুখ থেকে হাসির চিহ্ন মুছে গেলো। সে একটু যেন ভয়ে ভয়েই বলে ফেললো — "কেন রে? কি হলো?" পিয়া চেঁচিয়ে বলতে লাগলো — "কি হলো? আবার জিজ্ঞাসা করছো কি হলো? এইভাবে কেউ সেলাই করে? এর চেয়ে ছেঁড়া জামা পরে স্কুলে যাওয়া ভালো! ঘরে কি আর কোনো সুতো ছিলো না? সাদা ফ্রকটাকে সেলাই করেছো হলুদ সুতো দিয়ে?" এক নিশ্বাসে ঝাঁঝিয়ে বলে গেলো অঞ্জলির সতের বছরের মেয়েটি। অঞ্জলি ম্লান হেসে বললো — "না রে মা। হলুদ সুতো নয় রে। সাদা সুতোই। আসলে সুতোটা খুব পুরোনো হয়ে গিয়েছিলো তো। আর ফ্রকের তো একবারে নীচের দিকটায়। তাই আমি ভাবলাম..." "থামো তুমি! ঢের বকেছো। কিচ্ছু যদি পারতে তুমি। ঝাঁঝিয়ে উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো অঞ্জলির সতেরো বছরের পিয়া। অঞ্জলি ফ্রকটা হাতে নিয়ে ভাবতে লাগলো কি ভাবে ব্যাপারটা এখন ঠিক করা যায়। ফ্রকটাকে উল্টে সেলাইটা খোলার চেষ্টা করতে লাগলো সে। আর তখনই শুনতে পেলো মেয়ের আরেক দফা মুখঝামটা — "আবার ওটাকে নিয়ে পড়লে কি করতে?" "নাহ কিছু না। বলতে গিয়ে টপটপ করে চোখের জল পড়লো সেই হলুদ সুতোর উপর। অঞ্জলি নিজের মনেই বলতে লাগলো — "কিচ্ছু পারি না আমি — দুটো সেলাইও না।"
অঞ্জলি একটু হাসলো। বড়ো লজ্জার সে হাসি। ধ্রুবও হাসলো। তবে হো হো করে। অঞ্জলি আরো লজ্জা পেয়ে বললো — "দাঁড়াও দাঁড়াও। ওটা বদলে দিচ্ছি।" ধ্রুব একই ভাবে হাসতে হাসতে বললো — " না না থাক। কিন্তু এর ফর্মুলাটা কি? কি ভাবে বানালেন এই সাংঘাতিক জিনিষটা?" অঞ্জলি চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো ধ্রুবর সামনে। ধ্রুব তার জামাই। ইঞ্জিনিয়ার। পিয়ার সঙ্গে বিয়ে হয়েছে মাস ছয়েক হলো। খুব হাসি খুসি ছেলে। "বলুন না -বলুন না- কি করে বানালেন এই স্যাম্পলটা।" অঞ্জলি ম্লান হেসে বললো — "গুড়টা একটু বেশি পুরনো হয়ে গিয়েছিলো — তাই ওটা দিয়ে ভাবলাম পিঠে বানাই — বেশ ভালোই হয়েছিলো — আমি নিজে মুখে দিয়ে দেখেছি — কয়েকটা অবিশ্যি একটু তেঁতো লাগলো — সেগুলো কিন্ত আলাদা করে রেখে দিয়েছিলাম — কিন্তু তোমায় দেওয়ার সময় যে কি করে এমন গোলমাল হলো কে জানে।" "তা বেশ হয়েছে। আপনি আপনার ওই স্পেশাল স্টক থেকে খানকতক আমায় দিন তো। আপনার মেয়েকে খাওয়াবো। আজ রাতেই। মাস খানেক আর বাইরে খেতে যেতে হবে না তাহলে।" — বলে হো হো করে হেসে উঠলো ধ্রুব। ধ্রুব চলে গেলে রান্না ঘরে একা মাথা ঠুকতে ঠুকতে অঞ্জলি বলছিলো — "কিছুই পারি না আমি। কিচ্ছু না। দুটো পিঠে বানাতে গিয়েও এত হেনস্থা হতে হয়!"
অঞ্জলি একটু হাসলো। প্রায় নির্লজ্জের মতো। অহনা, মানে তার ষোল বছরের নাতনি বলে উঠলো — "হেসো না দিম্মা। তোমার দ্বারা যদি কোনো কাজ হয়!" অঞ্জলি হাসি মুখেই বললো — "কেন রে? যেমন বললি তেমন ভাবেই করবো।" অহনা বললো — " ছাই করবে। সব গোলমাল পাকাবে। তোমায় আমি জানি না যেন।" অঞ্জলি সেই হাসি মুখেই জিজ্ঞাসা করলো — "কি জানিস তুই আমার?" অহনা এবার তার দিদিমার দিকে তাকিয়ে ঝড়ের মতো বলতে শুরু করলো — "সব জানি। তোমার দ্বারা কিচ্ছু হয় না। কিচ্ছু পারো না তুমি — আচ্ছা এতকাল কি করে কাটালে বলো তো? তোমার বাবা নাকি খুব পণ্ডিত ছিলেন। অথচ তুমি তো লেখাপড়ায় রাম গঙ্গা। তোমার মা নাকি দারুণ গান গাইতে পারতেন। আর অসাধারণ সুন্দরী ছিলেন। তার কোনো কিছুই তো তুমি পাওনি। দাদাই দ্যাখো কি ডিসিপ্লিন্ড, মেথডিকাল। এমন পারফেক্ট বর পেয়েও তুমি ঢ্যাঁড়স মার্কাই রয়ে গেলে। এমনকি মার থেকে রান্নাটাও তো শিখলে পারতে। সেদিন একটা টোস্ট করেছিলে যার একটা দিক পুরো পোড়া।" যেন এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে গেলো অহনা। অঞ্জলি একসাথে এতগুলো কথার ধাক্কা বোধহয় সামলাতে পারলো না। একটু থতমত খেয়ে চুপ করে গেলো। তারপর খুব আস্তে করে বললো — "ঠিক আছে। শেষ বয়সে না হয় তোর থেকেই শিখবো।"
—"কি শিখবে?"
—"কেন? যা শেখাবি। ওই যা বলছিলি"
—"কি বলছিলাম?"
—"ওই বানিয়ে বানিয়ে কথা বলতে। তোর বন্ধুরা এলে। শেষ বয়সে না হয় একটু মিথ্যে কথা বলাই শিখবো"
—"মিথ্যে কথা? আমি তোমায় মিথ্যে কথা বলতে শেখাচ্ছি? এগুলোকে মিথ্যে বলে না। বলে হোয়াইট লাইস। তোমাকে বোঝানো যাবে না। কিন্তু তুমি আমায় ইনসাল্ট করলে। কি করে কথা বলতে হয় তুমি সেটাই শেখোনি। তোমার হেল্পের কোনো প্রয়োজন নেই আমার।" ঝড়ের মতো কথাগুলো বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো অহনা। অঞ্জলি একা ঘরে পাথরের মতো স্থির বসে রইলো। আর ভাবতে লাগলো — 'সত্যি কথাই তো বলে গেলো মেয়েটা — সারাজীবন কিছুই ঠিক করে করতে পারলাম না আমি — গুছিয়ে যে দুটো বানানো কথা বলতে বলেছিলো তাও হয়তো পারতাম না —'
অঞ্জলি একটু হাসলো। তাঁর দিকে তাকিয়ে। বড়ো অপ্রস্তুতের সেই হাসি। কারণ বিরাট ভুল হয়ে গেছে তার। গতকাল পার হয়ে গেছে দিনটা। খেয়ালই ছিলো না অঞ্জলির। ভুল করে আজকেই সব আয়োজন করেছে সে। সব বলতে বিরাট কিছু নয়। বরং বলা যায় খুব সামান্যই। সামান্য কিছু মিষ্টি। আর কিছু ফল। আর একটু বেশি করে পুজোর ফুল। এই আয়োজন। অঞ্জলির জন্মাষ্টমীর। যদিও তিথিটি পার হয়ে গেছে গতকাল। আজ সকালে ক্যালেন্ডারের দিকে তাকিয়ে অঞ্জলির মাথায় হাত!
তাই বড়ো অপ্রস্তুতের হাসি হেসে অঞ্জলি এসে বসলো তার ইষ্টদেবতার সামনে — নৈবেদ্যের থালা হাতে নিয়ে — "নিয়ে নাও ঠাকুর — নিয়ে নাও — খালি ভুল হয়ে যায় আমার — তুমিই সবচেয়ে ভালো ভাবে জানো সে কথাটা " — বলতে বলতেই যেন হঠাৎ চোখে অন্ধকার ঘনিয়ে এলো তার — প্রাণপণে ফুলপ্রসাদের থালাটা শক্ত করে ধরে তার ইষ্টদেবতার দিকে এগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলো সে। মুহূর্তের জন্য তার মনে হলো — '— আজকেও কি ঠাকুরকে প্রসাদটা ঠিকমতো দিতে পারবো না আমি? কোনোক্রমে থালিটা ঠাকুরের পায়ে ঠেকাতে না ঠেকাতেই মেঝেয় গড়িয়ে পড়লো অঞ্জলি। চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লো তার সমস্ত নৈবেদ্য।
আর তারপর? এরপর ও ভাবে মেঝেতে ছড়িয়ে থাকা ফুল ফল গুলো আর কি ঠাকুর নেবেন কখনো? বোধহয় না।
কারণ তখন শঙ্খচক্রগদাপদ্মেস্থিত নারায়ণ নিঃশব্দে এসে স্মিতমুখে দাঁড়ালেন সেই অপারদর্শী অঞ্জলির সামনে — এবং তাকেই গ্রহণ করলেন সযত্নে — পাথরের মতো স্থির হয়েও যার মুখে তখনো লেগে রয়েছে সেই অমলিন হাসিটি —
তাই পড়ে রইলো নৈবেদ্যসমূহ — পড়ে থাকলো অঞ্জলির এষ পুষ্পাঞ্জলি ....