—আপনাদের হয়তো মনে পড়বে বিলাসপুর বিধানসভার সীটটা কোন বছরে অনুসূচিত জাতি, মানে ওই সতনামীদের জন্যে রিজার্ভ সীট হয়ে গেল। মনে নেই? আরে সে বছরটা তো রাজনৈতিক ইতিহাসের পাতায় দগদগে হয়ে লেখা আছে।
—ওঃ, যেবার ইন্দিরাজী 'জরুরী অবস্থা" তুলে নিয়ে ইলেকশান করালেন আর মায়ে-পোয়ে গো-হারা হারলেন, অর্থাৎ ১৯৭৭।
—ঠিক বলেছেন। তাহলে এটাও মনে থাকা উচিত যে সেবার অধিকাংশ সীটে নবগঠিত জনতা দলের ক্যান্ডিডেটের কাছে কংগ্রেস যা-তা রকমের হারলেও বিলাসপুরে ওদের নয়নদাস ভলপহরী নামের এক অখ্যাত আধবুড়ো গেঁয়ো অল্প লেখাপড়া করা এক প্রার্থী ভালভাবে জিতে যায়।
—তাতে কি হল? ওদের কোন উন্নতি হল? এইসব আরক্ষণ-সংরক্ষণ নিয়ে অনেক পরীক্ষণ তো হল। এতে কারও লাভ হয় নি। শুধু গ্রামীণ সমাজে আকচা-আকচি খেয়োখেয়ি বেড়ে গিয়েছে।
বর্মা চটে উঠলেন।
—থামুন তো! আমায় শেষ গল্পটা শেষ করতে দিন। তারপরে না হয় ওসব পলিটিক্যাল তক্কো শুরু করবেন।
তখন ছত্তিশগড় আলাদা রাজ্য হয় নি। মধ্যপ্রদেশের অঙ্গ ছিল। রাজধানী ভোপাল। নয়নদাস প্রত্যেক অধিবেশনের আগে নিয়মিত ভোপালে গিয়ে এম এল এ হোস্টেলে উঠত। একবেলা অধিবেশনে হাজির হত। চুপচাপ পেছনের সারিতে বসে ঝিমোত, দুপুরে বিধানসভার লাগোয়া ক্যান্টিনে থালা ভরে মাংসভাত সাঁটিয়ে নিজের রুমে গিয়ে টেনে ঘুমোত। সন্ধেবেলা দু-বোতল মহুয়া টেনে বক্স হারমোনিয়াম বের করে ছত্তিশগড়ি দদরিয়া (একধরনের লোকগীত) গাইতে শুরু করতঃ
"চানাকে দার রাজা, চানাকে দার রানী,অবশ্যি একা নয়, সঙ্গে থাকে ওর তৃতীয় পক্ষের সুন্দরী বৌ সহোদা বাঈ।
চানাকে দার গোঁদলী মেঁ করকয়থে।
আরে, টুরা রে পর বুধিয়া, হোটেল মেঁ ভাজিয়া
ঝরকয়থে।"
(ছোলার ডাল যে আমার রাজা, ডাল যে আমার রানী,
পেঁয়াজ সাথে কড়া করে ভাজে।
বোকাসোকা এক ছেলে, আড্ডা জমায় হোটেলে,
ভাজিয়া খেয়ে বড্ড ন্যাকা সাজে।)
ব্যস্, এমনি করে পাঁচবচ্ছর কাটিয়ে দিল, কোন দিন কোন প্রশ্ন-টশ্ন করল না। এমনকি কখন হাত তুলতে হবে বা ধ্বনিভোটে "অ্যাই" করে চেঁচাতে হবে সেসব কিছুই জানত না, চেষ্টাও করে নি।
লোকটা হাঁদা মত। গাঁয়ের মাটির বাড়িটা পাকা করার বেশি কিছুই করে নি। এমনকি ছোট মত কোন মারুতি গোছের মটরগাড়িও নয়। এমন অপদার্থ লোককে কে দ্বিতীয়বার টিকিট দেবে?
পরের ইলেক্শানের জন্যে ক্যান্ডিডেট ঠিক করার সময় ওর নাম উঠতেই প্রবল আপত্তি। সবার এক কথা—ও ব্যাটা হল বেড়ালের হাগু, কোন কাজে আসে না, না ঘর লেপা যায়, না ঘুঁটে বানানো যায়!
জনগণের সোজা হিসেব,—আরে যে লোকটা পাঁচবছরে নিজের পরিবারের জন্যে কিছু করে উঠতে পারেনি, সে কি করে গাঁয়ের উবগার করবে, দেশের-দশের জন্যে কিছু করবে? আগে তো নিজের আখের গুছিয়ে এলেম দেখা, তবে তো লোকে তোকে নেতা বলে মানবে! ঢোঁড়া সাপ আবার সাপ নাকি?
যাকগে, এইভাবে লোকে বিধায়ক নয়নদাসকে দশবছরের মাথায় বেমালুম ভুলে গেল।
কিন্তু পনের বছরের মাথায় বিলাসপুরের যুব-ছাত্রসমাজ চোখ কচলে দেখল এক শ্যামলা দীঘল মেয়েকে, যার পোশাক-আশাক নবীন তপস্বিনী গোছের বটে, কিন্তু তাকে তেজস্বিনীও বলা যায়।
বিলাসপুরের নতুন ইউনিভার্সিটিতে ও অ্যাডমিশন নিয়েছে সোশিওলজি ডিপার্টমেন্টে, রোজ নিজে স্কুটার চালিয়ে ক্লাসে আসে। একদিন বে-পাড়ার ক'টা বাঁদর ছেলে বিকেলে ওর ফেরার সময় বাস স্টপের পানঠেলা থেকে সবাইকে শুনিয়ে গাইল--"হম কালে হ্যায় তো ক্যা হুয়া দিলওয়ালে হ্যায়"।
মেয়েটি স্কুটার ঘুরিয়ে সোজা ওদের সামনে এসে দাঁড় করাল। তারপর দুটো ছেলেকে ঠাস-ঠাস করে দুটো চড় কষাল। হতভম্ব ছেলেগুলো কি হচ্ছে বোঝার আগেই ওদের একটা রোগাপটকা গোঁসাইকে টেনে-হিঁচড়ে স্কুটারে বসিয়ে সোজা ভিসি'র চেম্বারে নিয়ে হাজির করল।
ইউনিভার্সিটি টিচিং ডিপার্টমেন্টের ছাত্রসমাজ শ্রদ্ধা-ভক্তির বন্যায় ভেসে গিয়ে ওর জন্যে কোরাস গাইলঃ
"বুন্দেলো কে হরবোলোঁ সে হমনে শুনি কহানী থী,তারপর?
খুব লড়ি মর্দানী ও তো ঝাঁসিওয়ালী রানী থী"।
(বুন্দেলখণ্ডী চারণের গানে অনেক শুনেছি কাহিনী,
মরদের মত লড়েছিল সে যে ঝাঁসির রানীর বাহিনী।")
সে এক ইতিহাস।
ছত্তিশগড়ের ছাত্র-রাজনীতিতে ছেলেরাই সব সময় প্রেসিডেন্ট হয়। মেয়েরা বড়জোর জয়েন্ট সেক্রেটারি বা সেক্রেটারি। সে বছর গুরু ঘাসীদাস ইউনিভার্সিটি বিলাসপুরের ছাত্র সংসদের নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হল একটি মেয়ে, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়!
তার নিক-নেম ঝাঁসির রানী!
আসল নাম লক্ষ্মীবাঈ ভলপহরী, সোশিওলজি বিভাগ। ওর বাবার নাম নয়নদাস ভলপহরী। উনি নাকি বছর পনের আগে বিধানসভায় রিজার্ভ সীটে বিধায়ক হয়েছিলেন!
কী আশ্চর্য ব্যাপার! গভর্নমেন্ট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে এ'বার প্রেসিডেন্ট হয়েছে একটি ট্রান্সফার নিয়ে রেওয়া থেকে আসা থার্ড ইয়ারের ছেলে! আউটসাইডার।
এখানে কংগ্রেসের এন-এস-ইউ-আই বা বিজেপির এ-বি-ভি-পি-র নাম নিয়ে কেউ ছাত্র নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে না। সবাই দাঁড়ায় বিভিন্ন প্যানেলের নাম নিয়ে; ছত্তিশগড়িতে সেটা হয়ে যায় "পেনল"; যেমন 'আশীর্বাদ পেনল', 'প্রগতি পেনল'।
কিন্তু জনতা জানে যে কোন প্যানেল কোন রাজনৈতিক দলের বা কোন বিখ্যাত ব্যক্তির অভয় বা বরপ্রাপ্ত।
সবাই জানত যে এইবার শহরের বিখ্যাত ঠাকুর পরিবারের বলিয়ে-কইয়ে ছেলেটি, থার্ড ইয়ারের সমরজিত সিং প্রেসিডেন্ট হবে। সেভাবে প্রচার চলছিল। অন্য প্যানেল থেকে দুর্বল ক্যান্ডিডেটকে প্রেসিডেন্টের জন্যে নমিনেশন দেয়া হল। এই সব সমীকরণের পেছনে ওই পরিবারের বাহুবল-অর্থবল, অন্য দলের নেতাদের সঙ্গে কয়লা ও জমির দালালির, রেলের ঠিকেদারির ভাগ-বাঁটোয়ারা সবই কাজ করছিল।
ওই সমরজিত সিং নিজেও কম যায় না। শুধু বাবা-কাকা-ভাইদের ওপর ভরসা না করে ও নিজের পাত্র-মিত্র-অমাত্যদের নিয়ে নেটওয়ার্ক বানিয়ে নানান দাঁও-প্যাঁচ কষছে।
তার কিছু নমুনাঃ
এক, গাঁয়ের ছেলেদের এক এক করে কলেজের ফুটবল গ্রাউন্ডের গলিতে নিয়ে গিয়ে খুঁটিতে বাঁধা সাদা বাছুরের লেজ ছুঁইয়ে শপথ করানো যে ছেলেটি ভোট শুধু সমরু ঠাকুরকেই দেবে, অন্যকে দিলে গোহত্যার সমান পাপ হবে।
দুই, ইলেক্শনের দিন তিনেক আগে নিজের দলের জনাতিনেক সক্রিয় সদস্যকে নাগপুরে রেলভাড়া আর হোটেলের খরচা দিয়ে পিকনিক করতে পাঠিয়ে দেওয়া এবং থানায় ওদের বাড়ির লোকজনকে দিয়ে কমপ্লেন লেখানো যে ছেলেগুলোর কোন খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।
সম্ভবতঃ বিরোধী দলের অমুক-তুসুক ছেলেগুলো কিডন্যাপ করেছে।
আর কি আশ্চর্য, অভিযুক্ত ছেলেগুলোরও কোন পাত্তা নেই! পাবলিক ভাবছে যে ওরা পুলিশের ভয়ে পালিয়েছে। লিচ্চয় অপরাধী, নইলে গা-ঢাকা দিল কেন?
সত্যি কথাটা হচ্ছে যে অপহরণকারীরা এবং অপহৃত—দুটো গ্রুপই একসঙ্গে নাগপুরের একটি হোটেলে অজ্ঞাতবাসে আছে। খাচ্ছে, দাচ্ছে, ক্যাবারে দেখছে আর এই অলীক কুনাট্য-রঙ্গের প্রযোজক হলেন সমরজিত সিং ঠাকুর।
এই ফর্মূলাটা শিওর সাকসেস হওয়ার গ্যারান্টি ছিল, কিন্তু কি থেকে যে কি হয়ে গেল!
ফুগ্গাদাদা! (বেলুনদাদা!)
যেমন নাম, তেমনি চেহারা। গভর্নমেন্ট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের দ্বিতীয় গেটের উল্টোদিকে পান-সিগ্রেটের ঠেলা (কিওস্ক), সেটাই এই গুণ্ডাটির ঠেক। ন্যাড়া মাথায় ছোট টিকি, অর্থাৎ ইনি ব্রাহ্মণ বা বাহমন বটেন! নাম আলোক পাণ্ডে। বয়স তিরিশ ছোঁয়-ছোঁয়।
হলুদ টি-শার্ট ও জিনের প্যান্টে বিশাল মধ্যপ্রদেশটি ঢাকা পড়ে নি, বলতে হয় ফুগ্গাদাদা সার্থকনামা।
ওঁর আয় বলতে কলেজের সাইকেল-স্ট্যান্ড ও ক্যান্টিনের ঠিকেদারি।
ভর্তির সীজনে ওঁকে রোজই দেখতে পাওয়া যায়। দোকানের সামনে একটি টিনের চেয়ারে উনি বিরাজমান। নতুন কেউ ভর্তি হলে এঁর চেলা-চামুণ্ডারা তাকে পাকড়ে সহবৎ শেখায়। তখন সে সোজা পান-দোকান থেকে একটি উইলস্-এর প্যাকেট নিয়ে শ্রদ্ধার সঙ্গে দেবতার সামনে নৈবিদ্যি চড়ানোর মত করে ফুগ্গাদাদার সামনে নিবেদন করে।
মধুর-মুনাক্কার নেশায় অর্ধনিমীলিত চোখ খুলে দাদা এই মেষশাবকটিকে দেখেন। তারপর দুজনের মধ্যে এবংপ্রকার বাক্যবিনিময় হয়--
ছেলেটিঃ--প্যার লাগু দাদা! ম্যায় ফার্স্ট ইয়ার মেঁ অ্যাডমিশন লিয়া হুঁ।
দাদাঃ-- লাগে রহো লাগে রহো! (লেগে থাকো, লেগে থাকো।)
ফাটে ফাটে, ইজ্জত না ঘটে; ভালে প্রাণ চলি জায়, বাকি হরি ইচ্ছা!
(নিগলিতার্থঃব্যস, নবাগত ছেলেটি দাদার সংঘে দীক্ষিত হয়ে গেল। ওর চ্যালারা ওকে বিরক্ত করবে না। কলেজ থেকে শহরে যেতে যেকোন অটোয় বসে "হরি ইচ্ছা" বললেই ড্রাইভার ভাড়া চাইবে না। সিনেমা হলে আদ্দেক দামে সিনেমা দেখবে। দর্জির দোকানে সাফারি-স্যুট তৈরি করতে কম চার্জ দেবে। বদলে ইউনিয়ন ইলেকশনে ওকে ফুগ্গাদাদার আশীর্বাদপ্রাপ্ত পেনলের হয়ে খাটতে হবে। এই আর কি!
লেগে থাক মোর বাছা!
গেলে যাক প্রাণ,
থাকে যেন মান,
ফাটলে ফাটুক পাছা।।)
এই ছত্তিশগড়ি যাত্রাপালায় এবার প্রবেশ করছেন বিমলেশ দ্বিবেদী।
বাবার বদলির চাকরির সূত্রে সেশন শুরু হওয়ার তিনমাস পরে জবলপুর থেকে এসে বিলাসপুরের সরকারি কলেজে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংএর থার্ড ইয়ারে ভর্তি হল বিমলেশ। সুন্দর মুখশ্রী, ছিপছিপে একহারা চেহারা। আগাগোড়া ভালো রেজাল্ট। মেয়েরা ফিরে তাকায়।
যথারীতি ফুগ্গাদাদার চ্যালাদের চোখে পড়ল একটি নতুন মুর্গা। ওরা উৎফুল্ল, জবাই করা যাবে।
একদিন জনাদুই চ্যালা এসে ভারিক্কি চালে বলল—কি হে! সাতদিন হয়ে গেল এখনো ফুগগাদাদার দরবারে সেলাম বাজাতে যাওনি? তোমার কি ভয়ডর নেই? জানো, উনি চাইলে--। যাকগে, তুমি নতুন ছেলে। যদি র্যাগ থেকে বাঁচতে চাও তো--
—আমি এখন থার্ড ইয়ার। ফার্স্ট ইয়ার নই, আমার কেন এসব হবে?
—ওসব ফুগ্গাদাদাকে গিয়ে বল, উনি কনসিডার করতে পারেন। এখন চল আমাদের সঙ্গে।
—আমি কোথাও যাব না। একজন ছাত্রের লাইফে দু-দুবার এসব হতে পারে না।
—আবে দেড়-হোঁশিয়ার! ফুগগাদাদা কে আদমিয়োঁ সে কানুনবাজি ? তেরি মাঁ কী—
হঠাৎ কিছু ঘটে যায়। মা নিয়ে চিরপরিচিত গালিটি মুখ থেকে পুরোপুরি বেরোনোর আগেই ও 'ওঁক' করে পেট চেপে বসে পড়ে। দুবলা-পাতলা ছেলেটি সোজা ওর তলপেটে একটি মোক্ষম লাথি কষিয়েছে, যেন কোন স্ট্রাইকারের নেওয়া পেনাল্টি কিক।
চ্যালার দল পত্রপাঠ রণে ভঙ্গ দিয়ে চলে যায়। নতুন ছেলেটি যায় ক্লাশে।
কিন্তু নাটক সেখানেই শেষ হয় না।
ছুটির মুখে সবাই যখন বাড়ি ফিরে যাচ্ছে খেলার মাঠের পাশে বিমলেশের রাস্তা আটকায় প্রায় জনা তিরিশেক ছেলে, অনেকের হাতে হকিস্টিক, আর ওদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে ফুগগাদাদা।
ছেলেটা সবাইকে দেখে, ভয় পায়।
ফুগগা বলিউডি ফিল্মের কায়দায় টেনে টেনে বলে—কিঁউ বে? চিটি কী পংখ নিকল আয়ী? (কি রে, পিঁপড়ের পাখা গজিয়েছে?) নয়া নয়া আকে ইঁহা ফুগগাদাদা কী কালেজ মেঁ দাদাগিরি? মেরে আদমিকো মারা?
ও ক্ষীণ আওয়াজে বলার চেষ্টা করে—দাদা, মুঝসে গলতি হো গয়ি, পর উনলোগোঁ নে মুঝকো মাঁ কী গালি দী।
—আমি কিছু শুনবো না। তুমি আমার কাছে এসে নালিশ করতে, আমি শাস্তি দিতাম। কিন্তু তুমি আইন নিজের হাতে তুলে নিলে কেন? হমারে আদমী পর হাত উঠায়া ক্যায়সে? অব ভুগতো।
আবে চুনমুন! লগা ইসে দো ঝাপড়! সব কে সামনে। লোগোকো সবক শিখানা হ্যায়।
সকালের মারখাওয়া দুটো চ্যালার একটা এগিয়ে আসে, চোখে পড়ে ওর আকর্ণ বিস্তৃত হাসি ও পানখাওয়া কালো দাঁতের সারি। সোজাহাত-উল্টোহাত করে দ্রুতলয়ে মারা গোটা কয় থাপ্পড়ে বিমলেশের মাথা ঝিমঝিম করে, চোয়াল নড়ে যায়।
—হয়েছে, হয়েছে! এবার বাড়ি যা! আর কাল একশ' টাকা নিয়ে আসবি, তোর বাপ জিগ্যেস করলে বলবি—ফুগগাদাদার জরিমানা, বেয়াদপির জন্যে।
ছেলেটা থাপ্পড়ে লাল হওয়া গালে হাত বুলোয়, সামনে এগিয়ে যায়, তারপর কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই হাওয়ায় লাফিয়ে উঠে ফুগগাদাদার দিকে ফুটবলের ভলি মারার মত করে পা চালায়। তারপর প্রাণপণে রাস্তার দিকে দৌড়য়।
লাথিটা লাগে ছেলেদের যেখানে মারলে সবচেয়ে বেশি লাগে ঠিক সেইখানে। ফুগগাদাদা মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছেন এমন বিরল দৃশ্য সবাই অবাক হয়ে দেখতে থাকে। তাই ছেলেটাকে চেজ করা মুশকিল হয়ে পড়ে। ও তো একশ' মিটার স্প্রিন্ট-এর মত দৌড়চ্ছে। বাকিরা ফুগগাদাদাকে দেখবে, ধরে তুলবে, না পাজি ছেলেটার পেছনে দৌড়বে—সেটা ঠিক করতে করতেই ও ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যায়।
বিকেলের মধ্যে স্থানীয় থানায় দুটো ডায়েরি লেখা হয়।
একটি নতুন ছেলেটির বিরুদ্ধে; অপরাধ—কলেজে মারপিট করা, ফুগগা, চুনমুন ও আরও কয়েক জনকে মারা ও মা-বাপ তুলে অশ্লীল খিস্তি করা এবং প্রাণে মারার হুমকি দেওয়া। সাক্ষী প্রায় পনের জন।
দ্বিতীয়টি, বিমলেশের তরফ থেকে ফুগগার বিরুদ্ধে; অপরাধ—কলেজে ঢুকে নতুন ছাত্রদের থেকে পয়সা নেয়া, প্রতিবাদ করলে গালমন্দ-মারপিট, সাক্ষী কেউ নেই।
কিন্তু সন্ধের মুখে ফুগগা ও তার দলবল গ্রেফতার হয়ে থানায় রাত কাটাল এবং ওদের জামিন হতে সাতদিন লেগে গেল।
কারণ, নতুন ছেলেটির বাবা জেলা কলেক্টরের অফিস সুপারিনডেন্ট।
ব্যস্, পুরনো খেলুড়েদের হাতে হ্যারিকেন।
সমরজিতের ছক কষে শিওর সাকসেস ফর্মূলা দমকা হাওয়ায় উড়ে গেল।
নতুন ছেলের জোড়া লাথিতে দুপায়ের ফাঁকে হাত চেপে ফুগগাদাদার মাটিতে গড়াগড়ি খাওয়া অনেক ছেলেমেয়ে গোলগপ্পা চোখে দেখেছে।
তারপর ফুগগাদাদার সাতদিন হাজতবাস হতেই চ্যালাচামুণ্ডারা হাওয়ায় মিলিয়ে গেল।
ফার্স্ট ও থার্ড ইয়ারের ছেলেমেয়েরা মিলে নতুন প্যানেল তৈরি করল—প্রেসিডেন্ট পদের প্রার্থী জবলপুর থেকে ট্রান্সফার নিয়ে আসা থার্ড ইয়ারের নতুন ছাত্র বিমলেশ দ্বিবেদী যার পিতৃদেব কালেক্টরের স্টাফ হওয়ায় ওর গায়ে হাত তোলার সাধ্যি কারো নেই।
বলাবাহুল্য যে প্রথম তিন ইয়ারের অধিকাংশ ভোট বিমলেশ দ্বিবেদী পেল আর পুরনো ভাম সমরজিৎ পেল ফোর্থ ইয়ারের ভোট।
এরপর জেলার কংগ্রেসি নেতারা ফন্দি করে বিমলেশকে ইউনিভার্সিটি প্রতিনিধি করে এগিয়ে দিলেন।
আর বছরের শেষে যুবশাখা ও মহিলাশাখার রাজ্যস্তরের সম্মেলনের সময় দু'জোড়া চোখের মিলন হল।
উদীয়মান মহিলা নেত্রী লক্ষ্মীবাঈ ভলপহরী ও যুবনেতা বিমলেশ দ্বিবেদী।
কংগ্রেস জাতপাত মানে না। কংগ্রেসের একটি অনুসূচিত জাতি-প্রকোষ্ঠ বা সেল আছে। দেখা গেল লক্ষ্মীবাঈ ও বিমলেশ দুজনেই বেশ বলিয়ে কইয়ে। আস্তে আস্তে ওদের দুজনের কামরেদারি সবার চোখে পড়ল। বুড়োদের চোখ টাটাল।
--দেখো, হম সব হ্যাঁয়, কাংরেসি; গান্ধীবাবাকে চেলে। সার্বজনিক জীবন মেঁ জাতপাত নহী মানতে। পর শাদি-বিহাও মেঁ, খান-পান মেঁ, বিরাদরি মেঁ ইয়ে সব তো মাননা পড়েগা। ইয়ে তো ভগবান কে বনায়া হুয়া নিয়ম হ্যায়।
(আমরা কংগ্রেসি বটে, গান্ধীবাবার চেলা। পাবলিক লাইফে জাতপাত মানিনে। কিন্তু বিয়েশাদি-খাওয়াদাওয়া—নিজেদের গুষ্ঠিতে এসব না মানলে চলে? এ তো ভগাবানের তৈরি নিয়ম।)
ছেলের বাবাকে ব্রাহ্মণসমাজের মাথারা দলবেঁধে বোঝাতে গেলেন—একটু চোখ খুলে চলুন পণ্ডিতজী! শেষে কি মুচি-বৌ এসে ঘরে কুলদেবতার পুজো করবে? ছেলেমেয়ে দুটোর ভাবসাব ভালো বুঝছি নে।
দ্বিবেদীজি ওঁদের আশ্বস্ত করলেন। —ওসব কিছুই হবে না। আমার ছেলে সেয়ানা আছে। নীচুজাতের মেয়ে যতই ছলাকলা দেখাক ভবি ভুলবে না।
কিন্তু হঠাৎ দৈনিক পত্রিকাগুলোর প্রথম পাতায় বক্স দিয়ে খবর!
—আদর্শ বিবাহ! আজকের নতুন প্রজন্ম শুধু মুখে নয় কাজেও করে দেখাচ্ছে।
বাবাসাহেব আম্বেদকর লিখে গেছেন যে বিভিন্ন জাতের মধ্যে বিয়ে না হলে শুধু আইন করে অস্পৃশ্যতা ঘুচবে না।
কংগ্রেসের দুই তরুণ-তরুণী বিমলেশ ও লক্ষ্মীবাঈ এটা করে দেখিয়েছে। ওরা আর্যসমাজের মন্দিরে গিয়ে রেজিস্ট্রি করে মালাবদল করেছে।
এ নিয়ে দুই পরিবারের মধ্যে টেনশন হলেও পাত্র-পাত্রী অনড়। আপাততঃ বিমলেশ নিজের শ্বশুরবাড়িতে আছে। বিমলেশ প্রেসকে বলেছে যে আমার বাবা এখন না বুঝলেও শীগ্গিরই বুঝতে পারবেন যে আমরা ভুল করিনি। তখন নিশ্চয়ই আশীর্বাদ দেবেন।
গোটা শহর উত্তাল।
কেউ বলল যে মেয়ের বাড়ি ছল করে বিমলেশকে আটকে রেখেছে। ওর স্টেটমেন্ট ব্ল্যাকমেইল করে দেওয়ানো হয়েছে। কেউ ধন্য ধন্য করতে লাগল।
কিন্তু কিছুদিন পরে আরেকটি গুজব শহরের পারা চড়িয়ে দিল। এবার বিলাসপুর শহরের মেয়র হিসেবে লক্ষ্মীবাঈয়ের প্রার্থী হওয়ার সম্ভাবনা আঠেরো আনা ছিল। এটা এখন মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত আসন হয়ে গেছে। কিন্তু লিস্ট বেরোলে দেখা গেল দেখা গেল যে ওর নাম নেই। গুজব--দলের ব্রাহ্মণ লবির চাপে এটা হয়েছে।
দুমাস পরে আবার নতুন হৈ-চৈ। কোর্টে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে বিমলেশ দ্বিবেদী নাকি শপথ নিয়ে বয়ান দিয়েছে যে ওর কোন বিয়ে হয় নি। আগের খবরগুলো একশ্রেণীর প্রেসের তৈরি করা। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করার জন্যে বিরোধী দলের চক্রান্ত হতে পারে। ওর আর লক্ষ্মীবাঈয়ের মধ্যে সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক বন্ধুত্ব ছাড়া কোন সম্পর্ক আগেও ছিল না, এখনো নেই।
বর্মাজী এবার থামলেন। ফ্লাস্ক থেকে ছোট গেলাসে করে একটু জল খেলেন।
—তারপর?
—এর পরেও কিছু হয় নাকি? ইলেকশনে মেয়েটি নির্দলীয় প্রার্থী হয়ে দাঁড়িয়ে গো-হারা হারল। দলের লোকেরাই পেছন থেকে ছুরি মেরেছিল।
—আর বিমলেশ?
—ও হ্যাঁ, বিমলেশ। ও সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হয়ে কোরবাতে কন্স্ট্রাকশন কোম্পানি খুলে ফ্ল্যাট আর শপিং কমপ্লেক্স বানিয়ে করে খাচ্ছে। একদিন ওর অফিসে উঁকি দিয়েছিলাম। খুব খাতির করল, কফি খাওয়াল। ওদের নতুন প্রোজেক্টের প্রস্পেক্টাস গছিয়ে দিল। আমি একটু কিন্তু কিন্তু করে জানতে চাইলাম যে কয় বছর আগের উঠতি যুবনেত্রী লক্ষ্মীবাঈ ভলপহরী এখন কোথায়? আজকাল কি করছেন?
ওর চেহারা পাল্টে গেল। মুখের চেহারা কঠিন করে বলল--"কে ভলপহরী? আপনি কার কথা বলছেন বুঝতে পারছি না। ওই নামে কাউকে চিনতাম না। আচ্ছা, আংকল, এখন আপনি আসুন। আমাকে একটু সাইটে যেতে হবে।"
আমার গল্প শেষ। এবার মিশ্র বলুক।
কোথায় সুর কেটে গেছে, রোদ্দুরও চড়েছে।
সবাই কালকে শুনবো বলে উঠে পড়লেন।