• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৬৮ | সেপ্টেম্বর ২০১৭ | গল্প
    Share
  • অলোপসামান্য : রঞ্জন ভট্টাচার্য


    ....অতএব আমি স্থির হয়ে গেলাম

    ..... কারণ এইভাবেই আমাদের স্থির হয়ে যেতে হয়

    ..... আমরা যারা অবিচারকে ধ্বংস করতে চেয়েছিলাম

    ..... তারা স্থান পাই ওই অন্ধকারে...আর অপেক্ষা করতে থাকি এই ভেবে— কখন উদ্ধার পাবো...কোন কাহিনীর আলোয় — কোনকালে


    অথচ আমার লক্ষ্য ছিলো নির্দিষ্ট। এবং প্রস্তুতি ছিলো চূড়ান্ত। তাই সেই লক্ষ্য বস্তুটিকে ছিন্ন করা ছিলো শুধু সময়ের অপেক্ষা।

    অপেক্ষা তো আমি করেইছিলাম। বহুক্ষণ। ধাবমান অশ্বের মূর্তির মতো স্থির হয়ে। কিন্তু আমাকে নিক্ষিপ্ত হতে হলো অন্যত্র। সেই লক্ষ্যটি থেকে বহুযোজন দূরে।

    আমার মধ্যে কোনো দৈবগুণ ছিলো না যা মুহূর্তেই ভস্মীভূত করে দিতে পারবে এক বিরাট সৈন্যদলকে। কিংবা আকাশ থেকে নিক্ষেপ করতে পারবে এক ভয়ংকর অগ্নিধারা। অথবা শূন্য থেকে সৃষ্টি করতে পারবে দিব্যসুন্দর কোনো আলোক মালা। নাহ। এসব আশ্চর্য ক্ষমতা আমার কিছুই ছিলো না।

    কারণ কোনো অসীমশক্তি দেবতার দুর্লভবরপ্রাপ্ত নায়কের ধনুকাশ্রিত অস্ত্র যে নই আমি —

    — কোনো মহাযুদ্ধের সাক্ষী নই — কোনো রাজকীয় মৃগয়ার অভিজ্ঞতা নেই আমার — কোনো অকালহতের রক্তবিন্দু লেগে নেই আমার শরীরে — এমনকি কোনো শ্বাপদসংহারের স্বাদও লেগে নেই আমার মুখে —

    বস্তুত কোনো প্রাণিহত্যার স্মৃতিই নেই আমার— কারণ আমি যে এক নগণ্য ব্যাধের তুচ্ছ তীর মাত্র — যা কিনা আবার লক্ষ্যভ্রষ্ট — না না — লক্ষ্যহীন — অযথা নিক্ষিপ্ত — তাই এক আশ্চর্য হত্যাবিমুখ ঘটনাই আমার একমাত্র স্মৃতি — কিংবা সম্বল

    সেই স্মৃতির গহনে এলেই দেখতে পাওয়া যায় —

    তখন রাত্রির শেষভাগ। অর্জুনক প্রস্তুত হলো বেরনোর জন্য। প্রতিদিনের মতো। সঙ্গে তার নিত্যসঙ্গী তীরধনুক। এই সময়টায় তার খুব ব্যস্ততা থাকে। তাকে পৌঁছে যেতে হয় অরণ্যের নির্দিষ্ট কিছু জায়গায়। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে। সেইসময়ে ওইসব বনস্থল থেকে বেরিয়ে আসে কিছু পাখি আর কিছু জীবজন্তু। তখন দিনের শুরুতেই তাদের জীবনের শেষমুহূর্তটা চলে আসে। অর্জুনকের অব্যর্থ তীরে।

    অর্জুনক দ্রুতপদে পার হচ্ছিলো গহন বনের সংকীর্ণ পথগুলি। অন্ধকার ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে আসছিলো। অর্জুনকের গতিও ক্ষিপ্রতর হচ্ছিলো। হঠাৎই এমন সময় সে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো। সাধারণত এমনই ঘটে থাকে — যখন তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় কোনো শিকারের আভাস পায়

    অতি সন্তর্পণে সে এসে দাঁড়ালো এক জীর্ণকুটিরের সামনে। সেখানে স্বল্পালোকে স্থির হয়ে আছে যেন এক পাথরপ্রতিমা।

    অর্জুনক ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলো সেই স্থাণুপ্রায় মহিলার দিকে।

    —"আমি ব্যাধ অর্জুনক... আপনার কোনো প্রয়োজনে..." বলতে বলতেই থেমে গেলো সে। চোখে পড়লো এক মৃত শিশু। ওই মহিলার কোলে।

    — "আমি বিধবা ব্রাহ্মণী গৌতমী। এ আমার একমাত্র সন্তান।" — যেন অন্ধকারকেই উদ্দেশ্য করে বললেন তিনি কথাগুলি।

    — "কি করে এমন হলো?"

    গৌতমী কোনো উত্তর না দিয়ে সামনের দিকে তাকালেন।

    অর্জুনক সেই দিকে দৃকপাত করেই নির্ণিমেষে পরপর দুটি শর নিক্ষেপ করলো। আর সেই শরে আচ্ছন্ন হয়ে পড়লো এক বিষনাগ। অর্জুনক তখনই সেই সাপটিকে তার কঠিন মুষ্টিতে ধরে গৌতমীর সামনে নিয়ে এসে বললো — "এই সর্পটিই আপনার নিরীহ সন্তানটির হত্যাকারী। এখন বলুন কিভাবে এর মৃত্যুদণ্ড দেবো? খণ্ডবিখণ্ড করে? না অগ্নিদগ্ধ করে?"

    — "ওর মৃত্যুর জন্য দায়ী আমার দুর্ভাগ্য, আর ওর নিয়তি। সাপটিকে ছেড়ে দাও।" — বললেন গৌতমী।

    — "এ কথা আমি মানি না। এ দুর্বলের কথা — যারা শুধু অদৃষ্টকেই শেষ কথা ভেবে নেয় তাদের কথা —" বিরক্ত হয়ে উত্তর দিলো অর্জুনক।

    "সাপটিকে হত্যা করলে কি আমার সন্তান প্রাণ পাবে" — শান্তদৃষ্টি অর্জুনকের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন গৌতমী। অর্জুনক এই প্রশ্নে একটু হতচকিত হলো । তারপর কঠিনস্বরে উত্তর দিলো — "না তা পাবে না। কিন্তু এই কাল সর্পটি জীবিত থাকলে এইরকম আরো অনেক দুর্বল আর নিরীহ প্রাণীর প্রাণসংশয় হতে পারে — তাই আর কথাবাহুল্যের প্রয়োজন কি?"

    গৌতমী সেই একই ভাবে যেন অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে উত্তর দিলেন — "একে ছেড়ে দাও"

    অর্জুনক বিস্মিত হয়ে বললো — "ছেড়ে দিতে বলছেন? আপনার সন্তানের হত্যাকারীকে? অসম্ভব।" একথা বলেই ক্ষণিকের জন্য স্থির হয়ে গেলো সে। আর তার পরেই — "আমার সময় বড় সংক্ষিপ্ত " — বলে সে তার তূণীর থেকে আমাকে বের করে দৃঢ় হস্তে জ্যাযুক্ত করলো।

    হ্যাঁ আমার মতো সামান্য একটি শরকে সে তখন গ্রহণ করেছে চরম প্রত্যাঘাতের জন্য!

    কি সৌভাগ্য! আমার সমস্ত তীক্ষ্ণতা নিয়ে সেই কালসর্পটির দিকে উন্মুখ হয়ে প্রতিটি পল গুনতে লাগলাম! কখন ছিন্ন করবো ওই লক্ষ্যবস্তুটিকে! কিন্তু সময় বড় দীর্ঘায়িত হতে থাকলো। কারণ —

    কারণ কালসর্পটি থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে বলে উঠলো — "থামো থামো — আমি নির্দোষ — আমি অন্যের আদেশ পালন করেছি মাত্র"

    — "কার আদেশ? আর সেই বা এই অন্যায় আদেশ দেবে কেন?"

    অর্জুনকের এই কথায় সর্পটি বলে উঠলো — "ওই তো ওই তো সে — ওই কোনায় দাঁড়িয়ে আছে"

    তখুনি অর্জুনক বলে উঠলো — কে ওখানে? দূরে দাঁড়িয়ে না থেকে সামনে আয় সাহস করে"

    কথাটি শেষ হওয়ামাত্র দেখা গেলো সামনের বনস্থলীর পাশ থেকে বেরিয়ে এলেন এক রুক্ষবেশ ব্যক্তি। এসেই কোনো ভণিতা না করে অত্যন্ত কর্কশভাবে বললেন — "কি ব্যাপার? কি এত গোলযোগ এখানে?"

    অর্জুনকও কঠিনস্বরে উত্তর দিলো "তাহলে তুমিই সেইজন যে এই সর্পটিকে এত বড় দুষ্কর্ম করতে পাঠিয়েছিলে"

    ব্যক্তিটি একই প্রকার রূঢ়ভাষণে উত্তর দিলেন — "আমার নাম মৃত্যু। হ্যাঁ আমিই পাঠিয়েছিলাম এই সর্পটিকে ওই শিশুর প্রাণনাশ করার জন্য। কিন্তু তার জন্য কারো কাছে কোনো কৈফিয়ত দেওয়ার প্রয়োজন নেই আমার"

    অর্জুনক বললো — "আমি ব্যাধ। আমিও নিজের কাজের উত্তর দিতে অভ্যস্ত নই। কিন্তু তোমরা দুজনেই সমান পাপী। অতএব শেষ মুহূর্তের জন্য প্রস্তুত হও। এই বলে সে আমায় মৃত্যুর দিকে অভিমুখী করলো।

    তখনই মনে হলো — তাহলে মৃত্যুকে বিদ্ধ করবো আমি! এ তো আশাতীত মর্যাদা! উত্তেজনায় মুহূর্তের জন্য কেঁপে উঠলাম। তারপরেই নিজের সমস্ত চেতনা আমার সূচীমুখে কেন্দ্রস্থ করে প্রস্তুত হলাম জ্যামুক্ত হওয়ার সেই বিশেষ মুহূর্তের জন্য। কিন্তু কই সেই মুহূর্ত তো এলো না।"

    শুনতে পেলাম ওদের কথাবার্তা —

    মৃত্যু : শোনো ব্যাধ — তুমি এভাবে আমায় আঘাত করতে পারো না। কারণ আমিও কারুর দ্বারা প্রেরিত।

    অর্জুনক : আমি মূর্খ ব্যাধ। তোমাদের অত তত্ত্বকথা বুঝি না। সোজা হিসেবে আমি বুঝি তোমরা দুজনেই সমান দোষী।

    সর্প : আমায় মুক্তি দিয়ে দাও — আমি এই কাজের দোষী নই

    মৃত্যু : সে দিক দিয়ে দেখতে গেলে আমিও নিরপরাধ। কারণ আমিও কারুর দ্বারা নির্দেশিত।

    তখনই শুনতে পেলাম এক আশ্চর্য গম্ভীর কন্ঠস্বর।

    —"স্থির হও — শান্ত হও।"

    অবাক হয়ে দেখলাম সামনে দাঁড়িয়ে আছেন এক প্রকাণ্ড পুরুষ। দেখলাম আমার প্রভু অর্জুনকও নির্বাক। এবং নিশ্চল। আবার শুনতে পেলাম —

    "আমি মহাকাল। আমিই নির্দেশ দিয়েছি মৃতুকে এই শিশুটির প্রাণ হরণের জন্য। মৃত্যু সেই নির্দেশে এই কাল সর্পটিকে প্রেরণ করেছে। আর কাল সর্পটি তার স্বাভাবিক ধর্ম অর্থাৎ দংশনকর্মটি করে এসেছে। অতএব এরা কেউই দোষী নয়। এই শিশুটির আয়ু শেষ হয়ে গিয়েছিলো। তাই এই ঘটনা ঘটলো।"

    "তাই ব্যাধ তুমি এদের মুক্ত করে দিয়ে চলে যাও।"

    ঘটনার আকস্মিকতায় অর্জুনক হতচকিত ও নিষ্ক্রিয়প্রায় হয়ে রইলো।

    সেই সময়েই গৌতমী বলে উঠলেন — "আমি তো অনেক আগেই বলেছিলাম এই কথা। তুমি এদের মুক্ত করে চলে যাও ব্যাধ। প্রতিহিংসার কোনো প্রয়োজন নেই। আমরা সবাই নিয়তির অধীন।"

    অর্জুনক বিস্মিত হয়ে তাকালো গৌতমীর দিকে। মনে হলো অস্ফূটে বলে উঠলো — "তাহলে ভাগ্যই শেষ কথা?"

    আর তখনই দেখতে পেলাম এই অবকাশে পালিয়ে গেলো কালসর্পটি। আর মৃত্যুও পালিয়ে গেলো তার পিছুপিছু। এমনকি একটু আগেই যে প্রবলপুরুষটি নিজেকে মহাকাল বলে পরিচয় দিলেন, তিনিও কোথায় অন্তর্হিত হলেন কে জানে।

    আর তখনই প্রবল হতাশায় আমার প্রভু আমায় জ্যামুক্ত করলো উদ্দেশ্যবিহীন ভাবে। তারপর গভীর হতমানে মাথা নীচু করে কোথায় চলে গেলো কে জানে। অর্থাৎ

    — অর্থাৎ আমি নিক্ষিপ্ত হলাম সহজেই — এক হতমান অনালোকে। এরপর কতকাল কেটে গেলো কে জানে — আমি ছুটছিলাম উন্মাদের মতো — অনন্ত নক্ষত্রপথে — আমার প্রভুর সমস্ত আক্রোশ আর আক্ষেপকে আমার সূচীমুখে লিপ্ত করে — জ্যা মুক্ত আমি আমার তীব্রতম গতিতে পরিক্রমা করছিলাম নিখিল শূন্যে — আর প্রশ্ন করছিলাম "— কোথায় — কাকে বিদ্ধ করবো প্রভু?"

    এই প্রশ্নের কোনো উত্তর আসে নি। আমার স্বর আমার কাছেই ফিরে এসেছে মহাশূন্যপুরের ভয়ংকর অনুরণনে। মনে হয়েছে — কোনোদিনই কোনো উত্তর আসবে না। আর কোনোদিনও শেষ হবে না আমার এই অন্ধ পরিক্রমা। হয়তো এটাই আমার ভবিতব্য।

    হঠাৎ একসময় শুনতে পেলাম — "এইবার লক্ষ্য ভেদ করো"

    কার কন্ঠস্বর বুঝতে পারলাম না। তবু জিজ্ঞাসা করলাম — "কোন লক্ষ্যবস্তু প্রভু? কোথায় নিক্ষিপ্ত হবো আমি?"

    উত্তর এলো একই গম্ভীর কন্ঠে — "নীচে"

    "নীচে? কোথায়? "— ফের প্রশ্ন করতে বাধ্য হলাম। কিন্তু এবার আর কোনো উত্তর এলো না। আমার কন্ঠস্বর মহাশূন্যে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে এলো আমার কাছেই — যেন এক প্রেত কন্ঠের মতো।

    এরপরেই যেন এক মন্ত্রবলে তীব্রগতিতে নামতে থাকলাম আমি — ওই কঠিন অন্ধকার ভেদ করে — খানিক বাদেই চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠলো এক নীলাভ জলতল — যার সাথে ওতপ্রোত হয়ে আছে স্ফটিকের মতো কিছু দীপ্র রেখা — আর প্রগাঢ় সবুজ উজ্জ্বলতা — বুঝলাম ওই তো পৃথিবী — যেখানে আমার প্রভুর বাস — তাহলে কি সেই বনস্থলে আবার নেমে আসছি আমি?

    আমার গতিপথে কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিলো না — এক উল্কাপতনের মতো নেমে আসছিলাম পৃথিবীর বুকে — আর ক্রমশ মনে হচ্ছিলো তাহলে নিশ্চয় সেই গভীর অরণ্যেই আবার আসছি আমি — যেখানে বহুকাল আগে বিচারের নামে হয়েছিলো এক নিষ্ঠুর প্রহসন — আর তাদের শাস্তির জন্য উদ্যত হয়েও আমায় ভিন্নমুখী হতে হলো শেষ পর্যন্ত — নিক্ষিপ্ত হতে হলো মহাশূন্যে — কোনো রক্তবিন্দু নয় — শুধু আক্রোশ আর গ্লানি মুখে নিয়ে — যখন দোষীরা স্বচ্ছন্দে মুক্ত হলো কূটযুক্তির আড়ালে।

    মনে হলো — তাহলে কি এতকাল বাদে সেইসব পাপিষ্ঠরা আবার উপস্থিত হয়েছে সেই অরণ্যে?

    তাহলে এবার আর কোনো বিক্ষেপ নয় — সর্বশক্তি দিয়ে বধ করবো ওদের — যাকে পাবো প্রথমেই — রক্ত চাই আমার — বধ্যের জন্য আর কতকাল এভাবে পিপাসার্ত থাকবো?

    এইভাবে উল্কার বেগে নামতে নামতে কথাগুলি অন্তরে বিস্ফোরিত হচ্ছিল।

    কিন্তু তখনই লক্ষ্য করলাম যেখানে নামতে চলেছি সে তো কোনো বনাঞ্চল নয়! — বরং এক বিস্তৃত রক্তপ্লাবিত ভূখণ্ড — সেখানে অসংখ্য মৃত ও মৃতপ্রায় মানুষের স্তূপ — আর তার মাঝে যারা জীবিত — তারা বীভৎস ভাবে রক্তস্নাত ও উচ্ছ্বসিত। এদের মধ্যে কার বুক ছিন্ন করবো তীক্ষ্ণ আক্রোশে?

    এইসব রথী মহারথীরা তো সবাই সমান ঘাতক। আর আমি তো কেবল একজনকেই নাশ করতে পারি আমার সর্বশক্তি দিয়েও।

    কারণ আমি তো এক নগণ্য ব্যাধের সামান্য শর মাত্র — কোনো বরিষ্ঠ দেবতার আশীর্বাদিত বীরের দিব্যাস্ত্র নই — যে এক নিমেষে সহস্রাধিক শত্রু সংহার করতে পারবো? তাহলে কি লাভ হবে এদের মাত্র একজনকে বধ করে?

    হঠাৎ দেখিলাম ওই যুদ্ধক্ষেত্রেই শায়িত এক দেহ যার তিলমাত্র স্থানও নেই যা বাণবিদ্ধ নয়! অথচ তিনি জীবিত! আর কি আশ্চর্য! আমার গতিপথ আমার অহংকে নস্যাৎ করে সেদিকেই ধাবিত হতে লাগলো! মনে হলো একে বিদ্ধ করাই কি আমার ভবিতব্য ছিলো? এত হতমান আমার নিয়তি? নিজের সমস্ত ইচ্ছাশক্তি দিয়ে আমার গতিপথ পরিবর্তন করতে চাইলাম।

    আর তখনই মনে হলো — এই যে শরাচ্ছন্ন ব্যক্তিটি শায়িত রয়েছেন — এই যে বিপুল শোণিতে লিপ্ত হয়ে রয়েছে শতসহস্রনিষ্প্রাণ দেহ — আর তার মাঝে উচ্ছ্বসিত রক্তস্নাত ঘাতকের দল — এদের সবাইকে পালন করছে যে, সেই ধরিত্রীকেই বিদ্ধ করি — সেই তো জন্ম দিয়েছে — সস্নেহে পালন করেছে এত ভ্রষ্টাচারের বীজ — তাহলে সেই বীরভোগ্যাকেই আমার সর্বশক্তি দিয়ে চরম আঘাত করি —

    প্রবল বিক্ষোভে আমি বিদ্ধ করলাম ওই বসুন্ধরাকে। মনে হলো থরথর করে কেঁপে উঠলো তার অন্তঃস্থল

    আর তখনই শুনতে পেলাম এক আশ্চর্য স্নিগ্ধস্বর — "এবার তুমি শান্ত হও — স্থির হও"

    মনে হলো — তাহলে এই কি সেই ধরিত্রীর কন্ঠস্বর? কিন্তু কোনো আর্তি নেই — এত বিপুল আঘাতের পরেও — যন্ত্রণাক্লিষ্টতা নেই — তা কি করে সম্ভব

    ধরিত্রী যেন শুনতে পেলো আমার মনের কথা — আর আমি শুনতে পেলাম আবার সেই স্নেহার্দ্র কন্ঠ — "শোনো — কান পেতে শোনো" — শুনতে পেলাম এক আশ্চর্য সুরধ্বনি -- প্রায় জলস্রোতের মতো — আর তার মাঝেই এক গম্ভীর কন্ঠস্বর — "আমি তৃপ্ত হলাম"। সাথে সাথেই শোনা গেলো প্রায় উচ্ছ্বাসের মতো — কিছু সমবেত কলস্বর — "অর্জুন! অর্জুন!"

    কিছুই বুঝতে পারলাম না। আমার সাধ্যাতীত আঘাতের এ কি ফলশ্রুতি? কি ঘটছে এসব?

    ধরিত্রী যেন আমার মনের কথাটা বুঝেই বলে উঠলো — "তুমি শুনলে মহামতি ভীষ্মের কন্ঠস্বর। শরাচ্ছন্ন মৃত্যু পথিক ভীষ্মের আর্তমুখে জল সিঞ্চন করা হলো অবিশ্বাস্য ভাবে।"

    বললাম — "তার মানে?"

    "তার মানে সবাই দেখলো জগতের শ্রেষ্ঠ ধনুর্ধর মধ্যমপাণ্ডব অর্জুন কি আশ্চর্য ভাবে পৃথিবীকে বিদ্ধ করে ভূতল থেকে জলস্রোতের সৃষ্টি করলেন। সবাই সমস্বরে অর্জুনকে সাধুবাদ দিলো।"

    অত্যন্ত বিস্মিত হয়ে বললাম — "সে কি?"

    সেই স্মিতকন্ঠে উত্তর এলো — "তোমার কাজের ফল তুমি যেভাবে দেখতে চাইছো তা অন্যের কাছে সম্পূর্ণ ভিন্নরূপে উপস্থিত হতে পারে। স্থান কাল পাত্রের আধারে সবই বদলে যায়।"

    চিৎকার করে বললাম — "এ তো মিথ্যা!"

    সেই স্মিত কন্ঠে উত্তর এলো — "সত্য মিথ্যা সবই আপেক্ষিক। অতএব বিস্মিত হয়ো না। ব্যথিত হয়ো না।"

    কোনোক্রমে বলতে পারলাম —"এরপর কি হবে?"

    — "এরপর কালক্রমে তুমি আমার মধ্যে একাকার হয়ে যাবে"

    — "তাতে ফললাভ কি হবে? আমার প্রভুর অপমানের কি প্রত্যাঘাত হবে? গৌতমীর পুত্রহন্তার কি বিচার হবে?"

    —"আমি তোমায় অন্তঃ স্থলে ধারণ করলাম — এইবার নির্লিপ্ত হও"

    —"তার মানে আমি চিরকালের জন্য হারিয়ে গেলাম — হারিয়ে গেলো — আমার প্রভু অর্জুনকের বিচার — বিধবা গৌতমীর সব শোক — এসব কথা বিস্মৃত হবে সহজেই —"

    "নাহ — তা হবে না — কারণ এর কিছুকাল বাদেই তোমাদের কথা বলবেন ওই অন্তিমশয়ান মহামতি ভীষ্ম — প্রাজ্ঞ শ্রেষ্ঠ যুধিষ্ঠিরকে — যা যথাযথভাবে শ্লোকায়িত করে যাবেন মহর্ষি ব্যাস। — সেই বিপুল কাহিনীবিস্তারেও সামান্য হয়েও কোনোদিনও লুপ্ত হবে না তোমাদের কথা। অতএব —



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ লেখক
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments