রাস্তাটা আগে কাঁচা ছিল। মাটির সরু উঁচু নিচু এবড়ো খেবড়ো রাস্তা — গরুর গাড়ি ছাড়া আর কোন যান চলত না। বর্ষাকালে তাও বন্ধ — চিটচিটে আঠার মত কাদায় গাড়ির চাকা আটকে গেলে গরুর সাধ্য নেই মালবোঝাই গাড়ি সেখান থেকে টেনে তোলে। তখন এটা শুধু পায়ে চলা পথ — হাঁটুর কাছে লুঙ্গি উঁচু করে তুলে পরা মানুষের জন্যে।
তারপর সরকার পেল ধার — রাস্তা বানাবার জন্যে। টাকা দিল গ্রাম উন্নয়নের ব্যাঙ্ক। রাস্তায় পড়ল খোয়া, পাথরকুচি, পিচ। ভারী ভারী রোডরোলার চলল রাস্তার ওপর — সমান হয়ে গেল পিচঢালা রাস্তা। এখন হুশ্ হাশ্ করে গাড়ি চলে এ রাস্তায়, ঘন কালো ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে মন্থর গতিতে যায় অতিরিক্ত মাল বোঝাই ক্লান্ত লরী। বাসও যায়। দু তিন ঘন্টায় একটা। পেট আর ছাদ মানুষে ভর্তি — দূরের হাট থেকে আসে, দৌড় শেষ করে গাজোল হয়ে মালদা বাস স্ট্যান্ডে।
রাস্তার ডানদিক ধরে জমিটা খুব নিচু। বারোমাসই দেড় দুমানুষ জল থাকে সেখানে। জায়গাটা চেহারা নিয়েছে একটা প্রকাণ্ড বিলের। তার মধ্যেই জলের বুক থেকে মাথা তুলেছে ছোট ছোট দ্বীপের মত জমি — সেখানে মানুষের ঘর। সবই প্রায় এক রকম। টিনের দেয়াল, টিনের চাল, ঘরের লাগোয়া জমিতে অল্প ঝোপঝাড়। কয়েকটা কলাগাছ তাদের লম্বা পাতা মেলে ঘরের চালের ওপর ছায়া ফেলেছে।
বর্ষায় বিল ফুলে ওঠে। হাওয়া দিলে বিলে ঢেউ দেয় — জল এসে ঘরের টিনের দেয়ালে ঘা দিয়ে আবার সরে যায়। মহা আনন্দে ডাকতে থাকে ব্যাঙের পাল। কিন্তু তখন মুখ বাড়ায় কলাগাছের গোড়ায় জড়িয়ে থাকা একটি প্রাণী — তার হাঁ মুখ থেকে লাল সরু চেরা জিভ বেরিয়ে লকলক করে। সে চাবুকের মত ছুটে যায় ব্যাঙের দিকে, কোঁক করে একটা শব্দ হয়। ঘরের বাসিন্দারা বুঝে নেয় — লতায় ব্যাঙ ধরেছে।
শীতকালে সন্ধেবেলা বিল থেকে উঠে আসে কুয়াসা — সাদা ঘন ভেজা ধোঁয়ার মত। পরের দিন সকালে রোদ ভাল করে ওঠার আগে কাটে না। তখন পাশের রাস্তায় গাড়ি চলে ধীরে ধীরে, সাবধানে, ফগ লাইট জ্বেলে — একটু এদিক ওদিক হলেই বিলের জলে গিয়ে পড়বে।
টিনের ঘরের দেয়ালের জানালায় টিনের পাতের পাল্লা। তার ফাঁক দিয়ে এই কুয়াসা ঘরে ঢুকে পড়ে। অদ্ভুত সব চেহারা নেয়। মানুষের বা ভূতের। ঘরের ভেতরের ঠান্ডাটা বাড়ে। শ্রীধর তখন পাশে শোয়া লক্ষ্মীকে ধাক্কা মেরে জাগায়। বলে, এই লক্ষ্মী, আগুনটা একটু বাড়িয়ে দে।
লক্ষ্মী ওঠে। শীতে কাঁপতে কাঁপতে। ঘরের কোণে রাখা আংটার আগুনটা খুঁচিয়ে দেয়। কাঠকয়লার গুল আবার লাল টকটকে হয়ে ওঠে। লক্ষ্মী চৌকিতে শ্রীধরের পাশে উঠে আসে। শ্রীধর ততক্ষণে মোটা তূলোর কম্বলটা ভাল করে মুড়ি দিয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়েছে। লক্ষ্মী যেটুকু কম্বল পায় তাতে ওর পুরো শরীর ঢাকা পড়ে না। শীত শীত করে, ঘুম ভেঙে ভেঙে যায়। তারপর রোদ উঠলে চৌকি ছেড়ে ওঠে — সংসারের সব কাজ সারতে হবে ওকে।
এই ঘর বানিয়েছিল ভূধর মালো। এখন তা ছেলে শ্রীধরের। বাপ মা মরে গেছে। একটা বোন ছিল। শ্রীধর তার বিয়ে দিয়েছে বহুদূরে একটা গাঁয়ে। তারপর বোন বেঁচে আছে কি মরে গেছে তা নিয়ে কোন খোজঁখবর করে নি। বোনের শ্বশুরবাড়িও কোন রকম যোগাযোগ রাখে নি। হয়তো বোন মরে গেছে। হয়তো শ্বশুরবাড়িতে মারধোর খেয়ে বেঁচে আছে। এ সব জায়গায় কেউ আইনের চারশো আটানব্বই (এ) ধারার খোঁজ রাখে না।
সে প্রায় সাত আট বছর আগেকার কথা। শ্রীধর গিয়েছিল লক্ষ্মীর বাপের কাছে। বর্ডারের ওপারে নুন পাচার করতে হবে, সেই ব্যবসার ধান্দায়। বাপ মানে সৎ বাপ। আসল বাপ মরে যাবার পর ওর মা এই লোকটার ঘরে এসে উঠেছিল — সঙ্গে মেয়ে লক্ষ্মী। বেশ ক’বার এই ব্যবসার জন্যে ওখানে যাতায়াত করেছিল শ্রীধর। সৎ বাপ লক্ষ্মীকে তাড়াতে পারলে বাঁচে, মাও মোটামুটি তাই। কাজেই লক্ষ্মীকে প্রায় দান করে দেওয়া হোল শ্রীধরকে। লক্ষ্মীকে দেখে শ্রীধরের যে খুব একটা ভাল লেগেছিল তা নয়। শ্যামলা রং, রোগাটে চেহারা — পরে আছে নোংরা ছেঁড়া একটা শাড়ি — ঘরের সব কাজ করতে হয় বলে হাতে লেগে আছে গোবরের দাগ, বাসনমাজার ছাই। খালি ওর চোখ দুটো বড় বড় — টানা টানা। লক্ষ্মীর মাকে বরঞ্চ শ্রীধরের চোখে লেগেছিল। যদিও চল্লিশের কাছাকাছি বয়েস, মেয়েমানুষটার ভরাট শরীর, ভারী বুক। যাক্, যা পাওয়া যায় তাই ভাল। রোগা হলেও লক্ষ্মী মেয়েমানুষ তো বটে। নিখর্চায় পাওয়া গেলে মন্দ কি?
তবে মেয়েটা স্বভাবেও লক্ষ্মী। শ্রীধর খুশি থাকলে ওর শরীর নিয়ে খেলা করে। আবার চোরা চালান আটকে গেলে ওর মেজাজ খারাপ হয়। তখন ও লক্ষ্মীর খুঁত ধরে, পাত ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে পাতের সামনে মাটিতে বসে থাকা লক্ষ্মীর কোমরে লাথি মারে। লক্ষ্মী মাটিতে গড়িয়ে পড়ে, আবার ওঠে, শ্রীধরের জন্যে নতুন করে রান্না চাপায়। শ্রীধর জল খেতে চাইলে ঘড়া থেকে খাবার জল গড়িয়ে মুখের কাছে ধরে। এই সব দ্বীপের বাসিন্দারা সবাই বড় বড় ঘড়ায় করে জল ধরে রাখে। সকলেরই একটা করে ছোট নৌকা আছে — এই বিলের দ্বীপ থেকে বেরোবার একমাত্র বাহন। ডাঙ্গায় বড় রাস্তার ধারে রয়েছে টিউবওয়েল — সেখান থেকে খাবার জল ভরে নৌকা করে বাড়ি নিয়ে আসে সবাই।
ওদের কোন বাচ্চা কাচ্চা হয় নি। লক্ষ্মীর গর্ভ রসস্থ হয় না। শ্রীধর একেবারে চিকিৎসা করায় নি তা নয়। হাটের বাস স্ট্যান্ডে চালাঘরে দোকান সাজিয়ে প্র্যাকটিস করে অবনী ডাক্তার। আগে ছিল এক ডাক্তারের কম্পাউন্ডার। এখন নামের বোর্ড লাগিয়ে হোমিও ডাক্তার হয়ে বসেছে। ওষুধ দিয়েছিল — কাগজের পুরিয়াতে পাউডার। ছোট্ট শিশিতে টলটলে জল। কোন কাজ হয় নি। লক্ষ্মীর গর্ভটাই খারাপ, শুকনো বালি।
বিলটার উত্তর পূব কোণে নৌকা বাঁধবার জায়গা আছে। এখানকার বাসিন্দারা ওখানে নৌকো বেঁধে ঢালু পাড় বেয়ে ডাঙ্গায় ওঠে। ডাঙ্গা এখানে সরু একটা টুকরো — সামনেই বাগলা নদীর খেয়াঘাট। বাঁশের ওপর ত্রিপল খাটানো একটা চায়ের দোকান আছে। সেখানে একই চা বারবার ফুটিয়ে চা বানানো হয় — প্রচুর দুধ আর চিনি দিয়ে তৈরী একটা পাঁচন। যাদের পেট একটু নরম ধাতের তাদের অনেকেরই এই চা খাবার পর নদীর পাড়ে যাবার দরকার পড়ে। সেজন্যে জেটির দুদিকের পাড় খুব নোংরা।
জেটি বলতে বাঁশের একটা মাচা। একটা নৌকো নদীর এপার ওপার করে। মানুষ নদী পার হয়। সেই সঙ্গে তাদের পোষা গরু, ছাগল। নৌকো চলে দিনের বেলায়। সূর্য পাটে বসার আগেই তার সার্ভিস বন্ধ।
শ্রীধর নিজের নৌকো লাগায় বিলের কোণে। দক্ষ হাতে মোটা কাছি দিয়ে নৌকো বেঁধে ফেলে মানিক। মানিকের সতেরো আঠেরো বছর বয়েস — একেবারে বেওয়ারিশ ছেলে। বাপ মায়ের কোন খোঁজ কোন জন্মে নেই। ছোটবেলায় মালদা স্টেশনের প্ল্যাটফরমে শুয়ে থাকত। ট্রেনে উঠে কামরা ঝাড়ু দিয়ে যাত্রীদের কাছে পয়সা চাইত। ভূধর মালো ওকে বাড়ি নিয়ে আসে — খালি গায়ে আধ ইঞ্চি পুরু তেল চিটচিটে ময়লা, পরণের নোংরা পেন্টুলটা চার পাঁচ জায়গায় ছেঁড়া। এখন মানিক শ্রীধরের ঘোর সাকরেদ, কুকুরের মত বিশ্বাসী, শ্রীধরের জন্যে জান দিতে তৈরী।
শ্রীধর বলল, মানকে, তুই জল টল ভরে নৌকোয় রাখ। তারপর আমি না ফেরা অবধি এখানেই থাক। আমার ফিরতে একটু দেরী হতে পারে।
কালো মুখে সাদা চকচকে দাঁত বের করে মানিক বলল, আজ্ঞে।
বিলের ঢালু পাড় বেয়ে শ্রীধর ওপরে উঠল। সবে বর্ষা শেষ হয়েছে। মাটি এখনও নরম — সাবধান না হলে পা হড়কে যেতে চায়। নৌকোটা এক্ষুণি ছাড়ছে। প্রচুর লোক আর জানোয়ার নৌকোয় দাঁড়ানো — মনে হয় ভার একটু বাড়লেই নৌকো ডুবে যাবে। ছুটে গিয়ে লাফিয়ে নৌকোয় উঠল শ্রীধর — নেমে যাবার সময় মাঝির হাতে কিরায়াটা দিয়ে দেবে। নৌকোটা একটা টাল খেয়ে আবার সোজা হোল।
ওপারে এক ফালি জমি, তারপরই বড় গঙ্গা। গত অনেকগুলো বর্ষা ধরে বড় গাঙ আর বাগলা নদী মিলে জমি গিলে গিলে ঐ ফালিটাকে ক্রমশ: সরু করে আনছে। হয়তো কিছুদিন পরে পুরো জমির ফালিটা চলে যাবে ঐ দুই নদীর পেটে।
সে পরে যাই হোক না কেন, আপাতত জমির টুকরোটা আছে। আছে একটা খোয়ার সরু রাস্তা — খেয়াঘাট থেকে শুরু হয়ে সোজা চলে গেছে ঐ জমির বুক চিরে। একটু এগিয়েই সে রাস্তার পাশে একটা চায়ের দোকান — দর্মার বেড়া দিয়ে বেশ খানিকটা জায়গা ঘিরে নিয়ে। সন্ধের পর এখানে চোলাই বিক্রী হয় — এখানে বসেই খাওয়ার ব্যবস্থা।
এই চায়ের দোকানে শ্রীধরের জন্যে অপেক্ষা করে আছে খোকন মন্ডল আর তার দুই সাকরেদ। যাদের হাত দিয়ে শ্রীধর মাল পাচার করে খোকন তাদের একজন। ও শ্রীধরকে বলল, দাস সাহেব, কি মাল দিচ্ছেন এবারে?
শ্রীধর স্কুলে পড়েছে, মাধ্যমিক পাশ করেছে — যদিও প্রচুর টুকে। সে নিজের পদবীটাকে পাল্টে নিয়েছে। সে এখন শ্রীধর দাস। তার ব্যাঙ্কের খাতায়, জমির পরচায় এখন এই নামই লেখা আছে।
কথাবার্তা হোল। নেপাল থেকে মাল চালান আসছে। ঘড়ি, ইলেকট্রনিক জিনিষপত্র। অল্পস্বল্প কথা আগে মোবাইলে হয়েছে। তবে মোবাইলে সংক্ষেপে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কথা বলে শ্রীধর। কোন খবর বেকায়দায় ফাঁস হয়ে গেলে এক চক্কর। হয় মাল বাজেয়াপ্ত হয়ে যাবে, নয়তো আরো বেশী টাকা খাওয়াতে হবে সব জায়গায়। সবাই তো হাত পেতেই আছে। এই রুটের আসল ব্যবসাটা রয়েছে কয়েকজন বড় চাঁই এর হাতে। শ্রীধর তাদের লেজ ধরা একজন চুনোপুঁটি। ওর হাত দিয়ে অল্পস্বল্প মাল যায় — ওর পকেটে যা আসে ওর পক্ষে তাই যথেষ্ট।
রাতে খেতে বসেছিল শ্রীধর। ডাল, তরকারী আর মাছের বাটি লক্ষ্মী ওর থালার পাশে সাজিয়ে দিয়েছে — এখন গরম গরম রুটি সেঁকে শ্রীধরের পাতে দিচ্ছে। ঘরে কেরোসিনের লন্ঠন জ্বলছে — এই দ্বীপগুলোতে তো আর বিদ্যুৎ নেই। সেই আলোয় শ্রীধর রুটি ছিঁড়ে ছিঁড়ে তরকারী দিয়ে মুখে তোলে আর লক্ষ্মীর দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে। ওকে আজকাল বড় আলুনি আর একঘেয়ে লাগে। ওর শরীরটা যেন বড্ড বেশী চেনা। কখন ঠিক কিভাবে জেগে উঠবে, সাড়া দেবে — সব শ্রীধরের জানা। অনেকদিন ধরে চালানো পুরনো একটা মোটরগাড়ির মত। শ্রীধর একসময় মালদা চাঁচল রুটে শেয়ার ট্যাক্সি চালিয়েছে — গাড়ি সম্পর্কে সবকিছু ও ভালই বোঝে। পাতের রুটি ছিঁড়তে গিয়ে ওর নজর যায় ঘরের মেঝের দিকে। মেঝের একটা ফাটল থেকে একটা বড় গুবরে পোকা বেরিয়ে গুটি গুটি পায়ে হেঁটে ঘরের দরজার দিকে চলে যায়। মেঝেটা মাটির ওপর ইঁট দেওয়া। শান বাঁধিয়ে পাকা করার কথা শ্রীধর আজকাল মাঝে মাঝে ভাবছে। কিন্তু পাকা করতে বেশ ভাল টাকা লাগবে। এসবে শ্রীধর এখন খরচা করবে না। ওর টাকার দরকার অন্য কারণে।
শিলিগুড়ি থেকে ফিরছিল শ্রীধর। ওখানে গিয়েছিল একটা নতুন লাইনের খোঁজে। উত্তরবঙ্গের রাস্তার ধারের ছোট বড় সব ধাবাতে আজকাল সস্তার বনস্পতিতে খাবার তৈরী হয়। জানোয়ারের চর্বি থেকে তৈরী এই বনস্পতির ব্যবসা ধরতে পারলে ভাল লাভ থাকবে। শ্রীধর সুবিধে করতে পারে নি — অনেক টাকা ঢালতে হবে গোড়ার দিকে। বিগড়ে যাওয়া মেজাজ নিয়ে ফেরবার ট্রেনে উঠেছিল। অসংরক্ষিত কামরা — একটু ধাক্কাধাক্কি করে তবে বসতে জায়গা পেয়েছিল। মেজাজের তেতো ভাবটা কেটে গেল সীটে বসার পর।
উল্টোদিকের লম্বা সীটটাতে বসে আছে চারটে হিন্দুস্থানী মেয়ে — অল্পবয়েসের যুবতী বলাই ভাল। গ্রামের মেয়ে সেটা বোঝা যায়। তবে চেহারায় শহরের পালিশ আছে — অল্পবিস্তর চটক আছে। যে মেয়েটার চেহারা সবচেয়ে বেশী চোখ টানে সে বসেছিল শ্রীধরের থেকে একটু কোণাকুণিভাবে। তার কোলে একটা বাচ্চা।
শ্রীধর তাকিয়ে তাকিয়ে মেয়েগুলোকে দেখছিল। বাচ্চা কোলে মেয়েটার সঙ্গে একবার চোখাচোখি হোল — মেয়েটার চোখ একটা ঝিলিক দিল। কোলের বাচ্চাটা ছটফট করছিল, এবার ট্যাঁ ট্যাঁ করে উঠল। জামা সরিয়ে বাচ্চাটার মুখ নিজের বুকে নিল মেয়েটা। তারপর শাড়ির আঁচল দিয়ে বাচ্চাসমেত নিজের গা ঢাকল। শ্রীধর আর চোখ ফেরাতে পারছিল না সেদিক থেকে।
কামরার উল্টোদিকের জানালার পাশের সীটে বসেছিল একজন প্রৌঢ়া। দশাসই কুস্তিগীরের চেহারা, কঠিন মুখের মেয়েমানুষ। এবার সে উঠে সে শ্রীধরের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল — মেয়েটাকে একেবারে আড়াল করে।
শ্রীধর ব্যাপারটা বুঝে নেয়। মেয়েগুলো লাইনের। কোথাও একটা ডাক পেয়েছিল, বা পেয়েছে — হয়তো নাচ গান করার জন্যে — হয়তো বা আনুষঙ্গিক কাজের জন্যেও। ঐ দুঁদে চেহারার মেয়েমানুষটা ওদের অভিভাবিকা। মেয়েগুলোর দিকে তাকিয়ে একটা তীব্র শারীরিক আকর্ষণ বোধ করে শ্রীধর। বাজারের মেয়ে হলেও ওদের বোধহয় অসুখ বিসুখ নেই — ওদের চেহারার তরতাজা ভাব দেখে তো সেরকমই মনে হয়। আজকাল তো এখন লাইনের মেয়েরাও সতর্কতা সম্বন্ধে যথেষ্ট সচেতন। এই কিছুদিন আগে শ্রীধর মালদা গিয়েছিল একটা কাজের ধান্দায়। কাজ শেষ হতে অনেক দেরী হয়ে গিয়েছিল। যে ওস্তাদের সঙ্গে কাজ ছিল একটু বেশী রাত না হলে তার দেখা পাওয়া যায় না। রাত কাটাবার জন্যে গিয়েছিল এক রেন্ডিখানায়। সুনশান রাত — অত দেরীতে একটু ভাল অল্পবয়েসী মেয়ে কেউ পড়ে থাকে না। ওর কপালে জুটেছিল কালো মাঝবয়েসী একটা মোটা মেয়েমানুষ। দাঁতে মিশি, মুখে দুর্গন্ধ — কিন্তু দরটা সস্তা। তারপর ঘরের দরজা যখন বন্ধ তখন ঐ মুটকী একটা নিরোধ শ্রীধরের দিকে বাড়িয়ে ধরে বলেছিল, বাবু, এই রবাটটা লাগিয়ে নাও।
মেয়েগুলো মালদায় নামল। ওদের সকলেরই কাঁধে একটা ব্যাগ আর হাতে ধরা চাকা লাগানো ছোট স্যুটকেসের হ্যান্ডেল। শ্রীধরও নামল ওদের পেছন পেছন। ও আন্দাজ করেছে মেয়েগুলো এবার পশ্চিমমুখো কোন একটা ট্রেন ধরবে। ওদের রক্ষী মেয়েমানুষটা কড়া চোখে শ্রীধরের দিকে তাকায় — শ্রীধর জবাবে একটু হাসে। মেয়েছেলেটার মুখ আরও কঠিন হয় — গলা থেকে কর্কশ স্বর বেরোয়, তুমার কি কাম আছে হামাদের সঙ্গে!
শ্রীধর আগে থেকেই নিজের শার্টের পকেটে দুটো পাঁচশো টাকার নোট রেখে দিয়েছিল। ও বাঁ হাত দিয়ে নোট দুটো একটু বার করে — পাশাপাশি রাখে এমনভাবে যাতে বোঝা যায় নোট একটা নয়, দুটো। আর কুস্তিগীরের দিকে ইঙ্গিতপূর্ণভাবে তাকায়। প্রৌঢ়ার নজর পড়েছিল নোটদুটোর ওপর। তার মুখের ভাব নরম হয়ে আসে। এবার শ্রীধর বড় করে একগাল হাসে। বলে, এই আর কি মাসী — তোমরা মালদায় নামলে — মালদার লোক তো নও তোমরা?
পাতানো মাসী ঘাড় নাড়ে। না, তারা মালদার লোক নয়।
শ্রীধর চোরাই মাল বেচার দালালি করে খায় — লোকের মন ভিজিয়ে কথা বলার কায়দা ওর ভালই রপ্ত আছে। ও প্রৌঢ়ার সঙ্গে খেজুরে আলাপ শুরু করে দিল। স্টেশনের প্ল্যাটফরমের স্টলে গরম গরম সুগন্ধী এবং সুস্বাদু দোসা ভাজে — লোকে হুমড়ি খেয়ে পড়ে তা খায়। শ্রীধরের আন্দাজ ঠিকই ছিল — ওরা পশ্চিমমুখো গাড়ি ধরবে। তার এখনও দেরী আছে বলে শ্রীধর ওদের সবাইকে দোসা খাওয়াতে নিয়ে গেল। প্রকাণ্ড সাইজের দোসা — পাতানো মাসী একাই খান তিনেক খেয়ে ফেলে। শ্রীধর সমানে ভ্যাজর ভ্যাজর করতে থাকে — যত সব অপ্রয়োজনীয় অবান্তর কথা। আর সে সব কথার ফাঁকে ওদের সব খবর বার করার চেষ্টা করে। মেয়েগুলো দোসা চিবোয় আর মুখ টিপে টিপে হাসে। ওরা জানে ওদের হয়ে যা বলার মাসীই বলবে। বাচ্চা কোলে মেয়েটি এক ফাঁকে আবার বাচ্চাকে একটু দুধ খাইয়ে নেয় — শ্রীধর নির্লজ্জের মত ওকে দেখতে থাকে।
ওরা যতক্ষণে ট্রেনে উঠে গেল শ্রীধর ততক্ষণে ওদের সব খবর নিয়ে নিয়েছে। অবশ্যি ওকে নোটদুটো মীরামওসীর হাতে গুঁজে দিতে হয়েছে। ও যা ভেবেছিল তাই — মেয়েগুলোর পেশা শরীর বেচা। ওদের ডেরার ঠিকানা জেনে নিয়েছে শ্রীধর। বাচ্চা কোলে মেয়েটার নাম রেওতী। মেয়েগুলোর মধ্যে ওর দরটাই নাকি সবচেয়ে বেশী। ওদের গাড়ির গার্ডের কামরার পেছনে লাগানো লাল বাতিটা যখন আর দেখা গেল না তখন শ্রীধর রেওতীর কথা ভাবতে ভাবতে বাড়ি ফিরল।
ঘরটা আয়তনে খুব বড় না হলেও বেশ ছিমছাম করে সাজানো। একটা বড় আয়না লাগানো লোহার আলমারি, পাশে একটা ড্রেসিং টেবিল — সেখানে সব মেয়েদের সাজগোজ করার জিনিষ সাজানো রয়েছে। একটা চোদ্দ ইঞ্চির আধুনিক টিভি, তার সঙ্গে লাগানো ডিভিডি প্লেয়ার। খাটটা খুব চওড়া নয় — এই ফুট চারেক হবে। কিন্তু গদী ফোমের — নরম আর আরামদায়ক। তার ওপর দামী বিছানার চাদর পাতা। খাটের পাশে একটা টি পয় — তার ওপর একটা হুইস্কীর আর কয়েকটা সোডার বোতল। মদের বোতলটা অর্ধেক খালি — সোডার বোতলগুলোতে আর কিছু নেই। দুটো প্রায় খালি কাঁচের গেলাস — সোডা মেশানো হুইস্কীর তলানি রয়েছে ওতে। মেঝেয় একটা স্টীলের বড় থালা — ঝালবড়া, চানাচুর আর টোমাটো সস্ এর ধ্বংসাবশেষ পড়ে রয়েছে তাতে। খাটের মাথার ধারের দেয়ালে একটা ব্র্যাকেট লাগানো — সেখানে এখন ঝুলছে শ্রীধরের শার্ট আর প্যান্ট। ঘরের দরজার ওপর লাগানো একটা টিউবলাইট — তার আলোর অনেকটাই শুষে নিচ্ছে ঘরের দেয়ালের নীল রং।
এখন সন্ধে পেরিয়ে গিয়েছে। শ্রীধর লম্বা হয়ে শুয়েছিল রেওতীর বিছানায় সঙ্গমোত্তর সুখের একটা জড়তা সারা গায়ে মেখে। ওর কোন তাড়া নেই — সারা রাতের হিসেবে টাকা গুণে দিয়েছে মীরামওসীর হাতে। শ্রীধরের বুকের কাছে ঘন হয়ে শুয়েছিল রেওতী। ওর বাচ্চাটা এখানে নেই — বোধহয় ব্যবসার সময়টাতে অন্য লোকের কাছে রাখা থাকে। টিভির পর্দায় একটা নীল ছবি — সেই দৃশ্য আর রেওতীর উষ্ণ এবং নরম শরীরের মৃদু চাপ শ্রীধরের ভেতর আবার একটা ছটফটানি জাগিয়ে তুলছিল।
শ্রীধরের আলিঙ্গন শিথিল হয়ে গেল। কপালে ভাঁজ পড়ল। এতো চিন্তার কথা। খুবই চিন্তার কথা।
সেদিন ট্রেনে দেখা হওয়ার পর শ্রীধর বেশ কয়েকবার রাত কাটিয়েছে রেওতীর কাছে। এ বাড়ির অন্য মেয়েরা সবাই জেনে গেছে শ্রীধর রেওতীর খদ্দের। আজকাল শ্রীধরকে দেখলেই ওই রেওতীরমন আসছে — বলে হেসে গড়িয়ে পড়ে ওরা। প্রথম দিন শ্রীধর এসেছিল খালি হাতে — শুধু টাকা দিয়েছিল। হাসি মস্করার ভেতর মাঝে মাঝে মুখ গোঁজ করছিল রেওতী। বলছিল আমার এই বাবু আমাকে এটা দিয়েছে, ওই বাবু সেটা দিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে জিনিষগুলো দেখাচ্ছিল। শাড়ি, জামা, রুপোর গয়না, টুকটাক সোনা।
পরের দিন শ্রীধর গেল একটা সোনার হার নিয়ে। ওর গলায় পরিয়ে দিয়ে বলল, তোকে কি সুন্দর দেখাচ্ছে, রেওতী।
রেওতী খুসীতে ডগোমগো। শ্রীধরকে জড়িয়ে ধরে বলল, তুই এত ভাল, এত সোনা দিলি আমাকে।
ও সেদিন শ্রীধরকে নাচ দেখিয়েছিল। সব কিছু খুলে ফেলে — খালি ঐ সোনার হারটা পরে থেকে।
শ্রীধরের মনে কিন্তু কাঁটা খচখচ করে। শালি ছেনাল মাগি — এতগুলো টাকার ধস দিয়ে দিল। সেই সঙ্গে আরও হিসেব মনে আসে। রেওতীর কাছে যাওয়া মানে সকালে বেরোন। বাসে ঘণ্টা চারেকের হটরানি, ট্রেনে ঘন্টা দুই — লেট করলে আরও বেশী। আবার বিকেল বিকেল পৌঁছতে না পারলে রেওতীর ঘরে লোক ঢুকে যেতে পারে — তখন এক ঝামেলা। যাওয়া আসায় পুরো দুটো দিন। তার মানে পুরো দুদিনের ব্যবসার রোজগার লোকসান। প্রত্যেকবার রেওতীর কাছে যাওয়ার খরচাও আছে। আর মাঝে মাঝেই যদি এরকম সোনার জিনিষ দিতে গিয়ে গাদা গাদা টাকা ঝাড় হতে থাকে তবে তো শ্রীধরের বারোটা। কিন্তু – কিন্তু - শ্রীধর বুঝেছে রেওতীকে ছাড়া ওর চলবে না। যতই ও রেওতীর কাছে যাচ্ছে ততই রেওতী ওকে গ্রাস করছে — একটা মাদী ময়াল সাপ। রেওতীর চাউনি, হাসি, শরীরের নরম উষ্ণতা ওর রক্ত ফুটিয়ে তোলে। আর কোন মেয়েমানুষের সঙ্গে শ্রীধরের এরকম হয় নি — লক্ষ্মীর সঙ্গে তো নয়ই। যা হোক আর তা হোক, রেওতীকে ওর চাই। চাই-ই চাই।
ও কথা বলেছে মীরা মওসীর সঙ্গে। রেওতীকে নিয়ে যাবে নিজের ঘরে — কত খরচা পড়বে? মীরা মওসী পাকা কথা দিয়েছে ওকে। রেওতী যখন বছর দশেক তখন ওকে ওর মা বাপ এ বাড়িতে ছেড়ে গিয়েছিল। হাজার টাকায় রফা হয়েছিল। এখন ওর দাম দু লাখ। এ বাড়ির মেয়েদের যে মালিক সে এই এলাকার একজন দুর্ধর্ষ মাফিয়া ডন। সে রেওতীর ওই দাম ঠিক করে দিয়েছে। মীরা নেবে টেন পারসেন্ট — কুড়ি হাজার। আর সেই সঙ্গে রেওতী কিছু গয়নাগাঁটি চাইতে পারে — সে সবও নিশ্চয়ই শ্রীধর দিয়ে দেবে।
শ্রীধরের মুখে কথাটা শুনে রেওতী প্রথমে রেগে গিয়েছিল। চীৎকার করেছিল, আরে খানকির আওলাদ, আমি রোজ রাতে তোর মত দশটা মরদের মুখে মুতি। আমি যাব তোর ঘর করতে? বিজলী নেই, পাখা নেই, টিভি নেই, কলের জল নেই — সেই ঘরে যাব আমি? সাল্লা ভিকিরী, যা বেরো এখান থেকে।
তখন শ্রীধরের পকেট থেকে বেরোল সোনার দুল — রেওতীর রাগ জল হয়ে গেল। শ্রীধর তারপর ওকে বুঝিয়েছে — ছ মাসের মধ্যে শহরে ঘর দেখে ওরা সেখানে উঠে যাবে। শেষ পর্যন্ত রাজী হয়েছে রেওতী। কিন্তু একটা শর্ত। শ্রীধরের ঘরের আওরাৎটাকে ভাগাতে হবে। সতীনের ঘর করবে না রেওতী।
নিতু সাহার সঙ্গে দেখা করে ফিরল শ্রীধর। শহরে নিতুর বড় কাপড়ের দোকান, আবার তেজারতির কারবারও আছে। ধার দেয় মাসে শতকরা দশ টাকা সুদ হিসেবে। হাতে লোকজন আছে — কেউ সুদসমেত টাকা ফেরৎ না দিলে ওর লোক বাড়ি এসে ঠেঙায়, বাড়ির জিনিষপত্র তুলে নিয়ে যায়। থানা পুলিস করে কোন লাভ হয় না। পুলিস থানা, পার্টি অফিস, স্থানীয় ছেলেদের ক্লাব — সব জায়গাতেই ওর গুড় ঢালা আছে। শ্রীধরের রোজগারের বেশীর ভাগ টাকাই জমা থাকে নিতুর কাছে — ওর তেজারতি কারবার খাটে। শ্রীধরের যে লাইনের রোজগার তাতে তো বেশী টাকা ব্যাঙ্কে রাখার উপায় নেই। তবে নিতু বেইমানি করে না — শ্রীধরকেও লাভের একটা ভাগ দেয়। সেটা ওর টাকার সঙ্গেই জমা হয়। শ্রীধর হিসেব করে দেখেছে রেওতীকে ছাড়ানোর টাকা, মীরামওসীর টাকা, বাড়ির সকলের বকশিষ, রেওতীর গয়নাগাঁটি — সব মিলিয়ে লাখ চারেকের মত খরচা হবে। তিন লাখের মত নিতুর কাছে জমা আছে — ধার নিতে হবে আরও এক লাখ। নিতুর ব্যবসার নিয়ম খুব কড়া, শ্রীধরের জন্যেও সুদের হার ওই একই। শালা, ভাড়াটে মেয়েছেলে পোষা খরচার ব্যাপার। তার চেয়ে বিয়ে করা অনেক সস্তা।
রাতে ট্যারা কানাই এল ওর বাড়িতে। মানিক গিয়ে নৌকো করে নিয়ে এল ওকে। ওর নাম কানাই দলুই না সাঁতরা — ওরকম কিছু একটা। কিন্তু প্রচণ্ড ট্যারা বলে ওর চলতি নাম ট্যারা কানাই। শহরে খুচখাচ ব্যবসা করে — বিল্ডারদের ইট বালি সিমেন্ট জোগাড়ের দালালি। কিন্তু ওসব লোক দেখানো। ওর আসল ব্যবসা মেয়েমানুষ কেনাবেচার। ট্যারা রাতে এখানে খাবে। আর লক্ষ্মীকে দেখবে। যদি পছন্দ করে তবে পঞ্চাশ চাইবে শ্রীধর। আর তার কমে ছাড়বেই বা কেন? ট্যারা কি কম লাভ করে এক একটা মেয়ের থেকে? আর দরাদরি হলে খুব জোর দশ হাজার কমাবে — তার বেশী কিছুতেই নয়। ট্যারাকে খবর দেওয়ার আগে লক্ষ্মীর বাপের বাড়িতে খোঁজ নিয়েছিল শ্রীধর। ওর মা — ঐ ভারী চেহারার মেয়েছেলেটা — হঠাৎ মারা গেছে কয়েক বছর আগে। ওর সৎ বাপেরও মাথায় টিউমার না কি হয়েছে। লোক চিনতে পারে না, হাত পা কাঁপে, শরীর টলমল করে — একেবারে জড়পদার্থ। ওদের ঘর বসত এখন ঐ সৎ বাপের ছোট ভাইয়ের দখলে। লক্ষ্মী বলে কারোর অস্তিত্ত্বই নেই ঐ ভাইয়ের কাছে। অতএব শ্রীধর নিশ্চিন্তে দেখা করেছে ট্যারা কানাইয়ের সঙ্গে।
তারিয়ে তারিয়ে খেল ট্যারা। কুচো মাছ ঝাল ঝাল করে রান্না। যদিও ট্যারার চোখ অন্যদিকে ছিল লক্ষ্মী বুঝতে পারছিল ট্যারার নজর ওর গায়ের ওপর ঘোরাফেরা করছে। ও খাবার বেড়ে দিচ্ছিল আর গায়ের কাপড় টেনে টেনে দিচ্ছিল। লোকটার চাউনি ভাল নয়।
খাওয়া শেষ করে নৌকোয় উঠল ট্যারা। এবার শ্রীধরও সঙ্গে এল। মানিক নৌকো বাইল, ওরা দুজন এটা সেটা আবোল তাবোল কথা বলল। আসল কথা তো মানিকের সামনে হতে পারে না। বিলের কোণে পৌঁছে মানিক নৌকো বাঁধল। ট্যারা আর শ্রীধর ওপরে ডাঙ্গায় উঠল, মানিক নৌকোতেই বসে রইল। তখন ট্যারা ঘাড় নাড়ল। মাল পছন্দ হয় নি — নেবে না।
শ্রীধর যেন একটা ধাক্কা খেল। বলল, কেন, কি হোল?
বয়েসটা একটু বেশী হয়ে গেছে। আর বড্ড রোগা। এ জিনিষ পড়তায় পোষাবে না।
একটা ঢেঁকুর তুলল ট্যারা। তারপর আবার বলল, তোর বৌটা রাঁধে ভাল। এবার চলি। আর বেশী দেরী করলে লাস্ট বাস মিস করব।
হেঁটে হেঁটে বাস রাস্তার দিকে চলে গেল ট্যারা। শ্রীধর বিলের পাড়ে বোকার মত দাঁড়িয়ে রইল। তারপর বিল থেকে উঠে এল একঝলক ঠান্ডা জোলো হাওয়া। তখন শ্রীধর ঘরে ফিরল।
রাতে ওরা পাশাপাশি শুয়েছিল। লক্ষ্মী ঘুমোচ্ছে, শ্রীধর জেগে। গভীর ঘুম ঘুমোচ্ছে লক্ষ্মী — মুখ দিয়ে ফুসফুস করে আওয়াজ হচ্ছে, ঠোঁটের কষে বেরিয়ে এসেছে থুতু। একটু আগেই শ্রীধর প্রায় অভ্যেসের জন্যেই ওকে ভোগ করেছে। বোদা, স্বাদহীন একটা শারীরিক কাজ — যেন মোটা রাঙা চালের ভাত নুন দিয়ে গিলে ফেলা। শাড়িটা এলোমেলোভাবে ওর গায়ে জড়ানো — হাঁটুর নিচে দুটো রোগা রোগা শ্যামলা রঙের পা দেখা যাচ্ছে। পরশু রাতে ট্যারা কানাই এসে কুচো মাছের ঝোল দিয়ে একগাদা খেয়েছে। তারপর বলেছে, রোগা — বড্ড রোগা।
শ্রীধর বিছানা ছেড়ে ওঠে। লন্ঠনটা জ্বালে — মৃদু আলো হয় ঘরে। ও ঘরের জানালাগুলো বন্ধ করে — পাল্লাগুলো টেনে দিয়ে হুড়কো লাগিয়ে দেয়। ঘরের ভেতর দড়িতে টাঙানো আধভেজা গামছাটা পেড়ে আনে।
তক্তপোষে উঠে আসে শ্রীধর। লক্ষ্মীর পাশেহাঁটু গেড়ে বসে। দ্রুত হাতে ও বৌ এর গলার চারপাশে গামছাটা জড়িয়ে একটা ফাঁস তৈরী করে ফেলে — তারপর সেই ফাঁস দিয়ে গলাটা পিষতে থাকে। লক্ষ্মীর চোখ খুলে গিয়ে বিস্ফারিত হয়ে যায়, মুখ দিয়ে অস্ফুট গোঁ গোঁ করে আওয়াজ হয়। ওর দুটো রোগা হাত গলার ফাঁসটা টেনে খোলবার চেষ্টা করে, পা খিঁচতে থাকে। কিন্তু শ্রীধর ওর বুকের ওপর চেপে বসেছে, পুরুষমানুষের গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে ফাঁসটা জোরে, আরও জোরে পিষছে। লক্ষ্মীর চোখ এবার ঠিকরে বেরিয়ে আসে, জিভ বেরিয়ে পড়ে, মুখের কষ দিয়ে রক্ত গড়িয়ে আসে। ওর হাত পায়ের দাপানি থেমে আসে, শরীরটা নিথর হয়ে যায়। শ্রীধর ওর গায়ের কাপড় সরিয়ে বুকে কান রাখে। ধুকপুকুনি আছে কি? অনেকক্ষণ ধরে শোনার চেষ্টা করে। নেই।
শ্রীধর তক্তপোষ থেকে নামল। এখনও অনেক কাজ বাকী। তাড়াতাড়ি সব সারতে হবে। ও বাইরে যাবার জামা জুতো পরে নিল। ঘরের দরজাটা ভাল করে খুলে দিল। তারপর লাশটাকে তক্তপোষ থেকে টেনে নামাল, হিঁচড়ে টেনে ঘরের বাইরে বার করে নৌকোয় তুলল। এ সবে অল্প স্বল্প আওয়াজ হোল — তবে তাতে মানিকের জেগে উঠে দেখে ফেলার কোন ভয় নেই। মানিক আজ এখানে নেই। শ্রীধর ওকে ইসলামপুরে পাঠিয়েছে একটা লোককে টাকা দেওয়ার জন্যে। ও কাল সকালে ওখান থেকে বাস ধরবে, এখানে আসতে দুপুর গড়িয়ে যাবে। শ্রীধর রাতে ফিরে ওকে একটা গল্প শোনাবে। লক্ষ্মী ঝগড়া করে বাপের বাড়ি চলে গেছে। আর আসবে না। শ্রীধর নিজে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে লক্ষ্মীকে ওখানে ছেড়ে এসেছে।
আবার ঘরে ঢুকে বাক্স খুলে লক্ষ্মীর জামাকাপড়গুলো বার করল শ্রীধর। সামান্য কয়েকটা শাড়ি জামা, গয়নাপত্র কিছুই নেই। ও সেগুলো একটা পুঁটলি করে বাঁধল। তারপর সেই পুঁটলি হাতে ঝুলিয়ে নিল, লন্ঠন নিভিয়ে বেরিয়ে এসে ঘরের দরজা বাইরে থেকে ভেজিয়ে দিল।
চাঁদ অনেকক্ষণ অস্ত গিয়েছে — চারপাশ অন্ধকার। রাত নিশুতি, চারদিক একেবারে নি:শব্দ। খালি মাঝে মাঝে অল্প হাওয়া দিচ্ছে — কলাগাছের পাতা নড়ে সরসর করে মৃদু আওয়াজ হচ্ছে। শ্রীধর লক্ষ্মীর পুঁটলি নৌকোয় তুলল। নিজে নৌকোয় উঠে নৌকো খুলে দিল — জলে বৈঠা ডুবিয়ে সাবধানে টান দিল। আওয়াজ যেন না হয়।
নৌকো পাড়ে লাগিয়ে বাঁধবার পর আবার অনেক কাজ। লক্ষ্মীর একটা শাড়ি দিয়ে একটা বড় ফাঁস তৈরী করে পুঁটলিটা গলায় ঝুলিয়ে নিল শ্রীধর। তারপর ঢালু পাড় বেয়ে লাশটাকে টেনে উঁচু ডাঙায় তুলল। ও খেয়াঘাটের দিকে গেল না। সেখানে রাতে লোকে ঘুমিয়ে থাকতে পারে। চায়ের দোকানের ছোকরাটাও দোকানের ঝাঁপ বন্ধ করে ভেতরেই ঘুমোয়। চল্লিশ পঞ্চাশ গজ আগে নদীর পাড়টা প্রায় সমতল। সেখানে একটা বড়সড় নৌকো বাঁধা রয়েছে। কোন লোক নেই। শ্রীধরের ব্যবস্থা। গণেশ মন্ডল ওর পুরনো চেনা। মাল চালানের জন্যে মাঝে মাঝেই এরকমভাবে গণেশের নৌকো ভাড়া নেয় শ্রীধর। গণেশের বাড়ি বর্ডারের পাশে একটা গ্রামে। আগে অবস্থা একেবারে ভাল ছিল না — দুবেলা খাওয়া জোটানোই মুস্কিল ছিল। তারপর গণেশ নিজের পরিবারকে ভাড়া দিল এক সরকারী জওয়ান, অর্থাৎ ‘বর্ডার বাবু’র কাছে। পরিবার ওর ঘরেই থাকে — খালি যেদিন বডারবাবু আসে সেদিন ও গরুর ঘরে গিয়ে শুয়ে থাকে। সেই ভাড়ার টাকায় এই নৌকো কিনেছে — এখন দুধে ভাতে আছে। প্রথমদিকে ওর বৌ একটু কান্নাকাটি করেছিল। এখন বডারবাবুর আসার দিন নানারকম খাবার বানিয়ে রাখে — কাঁচালঙ্কা পেঁয়াজ দেওয়া ঝাল ঝাল ফুলুরী, আলুর চপ — ঘরের গরুর দুধের ক্ষীর বানিয়ে পাটিসাপটা পিঠে। গণেশ ওকে চড়, থাপ্পড় মারলে পাল্টা হাত চালায়। বলে, দাঁড়া বডারবাবুকে বলে দেব — তোকে বেঁধে নিয়ে যাবে। কোনদিন গণেশ রতিক্রিয়ায় ঢিলে দিলে বলে, বডারবাবু তোর থেকে অনেক ভাল।
গণেশ আজ ওর নৌকো এখানে বেঁধে রেখে চলে গিয়েছে। ও জানে শ্রীধরের সঙ্গে থাকবে চালানের মাল, ওর সব সাঙাৎ। রাতে রাতে কাজ শেষ করে শ্রীধর আবার এখানেই নৌকো রেখে যাবে। খুব ভোরে নিয়ে যাবে গণেশ।
শ্রীধর যখন নৌকোর কাছে পৌঁছল তখন ওর জিভ বেরিয়ে পড়েছে। লক্ষ্মীর শরীরটা রোগা হলে কি হবে — ওটাকে টেনে আনতে ওর দম বেরিয়ে গেছে। খানিকক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে নিজেকে সামলে নিল। তারপর দেশলাই বার করে নৌকোর হাতবাতি জ্বালল। নৌকোর খোলে প্রচুর ছোটছোট পাথর, আর একটা শক্ত মোটা কাছি। শ্রীধরের ফরমাস মত গণেশ এসব নৌকোয় রেখেছে। ওর গাঁয়ের কাছে একটা রাস্তার কাজ হচ্ছে — রাস্তার পাশে পাথর ডাঁই করে রাখা আছে। গণেশ এই পাথর ওখান থেকে ঝেড়ে এনেছে — আবার শ্রীধরের থেকে তার দামও নিচ্ছে।
পুঁটলির ফাঁসটা মাথা দিয়ে গলিয়ে বার করে নিয়ে নৌকোয় ছুঁড়ে দেয় শ্রীধর। তারপর মুর্দাটাকে টেনে নৌকোয় তোলে। এত টানা হেঁচড়া ঘষটা ঘষটিতে লক্ষ্মীর গায়ে জড়ানো কাপড় প্রায় খুলে গেছে — ছিঁড়েও গেছে। দেহটা বেআব্রু হয়ে পড়েছে। শ্রীধর তাড়াতাড়ি কাপড়টা টেনেটুনে শরীরটা ঢাকাঢুকি দেয়। একবার ভাবে — থাক্ না, ওটা তো এখন খালি একটা লাশ। কিন্তু তবুও ঢাকে। তারপর নৌকো ছাড়ে।
বাগলা নদী বেয়ে ও এসে পড়ল বড় গাঙে। এখন ভাটা চলছে — নদীর তীব্র স্রোত বয়ে চলেছে বহু দূর সমুদ্রের দিকে। শ্রীধর পাড়ে নৌকো লাগাল। একটা বড় গাছ নদীর ওপর ঝুঁকে পড়েছে — তার সঙ্গে বাঁধল। এসব শ্রীধরের চেনা জায়গা — আগে অনেকবার এখানে নৌকো লাগিয়েছে। শ্রীধর লক্ষ্মীর কাপড়ের পোঁটলা খুলে ফেলে — বেশ কিছু পাথর ঢুকিয়ে একটা ভারী পোঁটলা তৈরী করে। মৃতদেহের দুপা জড়ো করে এই নিরেট ভারী পোঁটলাটা তার সঙ্গে শক্ত করে কাছি দিয়ে বাঁধে। ঠেলে ঠেলে লাশটাকে নৌকোর ধারে নিয়ে এসে রাখে।
এবার নৌকো ছাড়ে শ্রীধর — নদীর একটু ভেতরদিকে নিয়ে আসে। তারপর একহাতে হাল ধরে নৌকো সামলায় আর অন্য হাতে লাশটাকে জোরে একটা ঠেলা দেয় — জয় মা গঙ্গা। ঝপ করে একটা শব্দ — দেহটা জলে পড়ে ডুবে যায়। শ্রীধর ঝুঁকে পড়ে দেখার চেষ্টা করে — লাশটা আবার ভেসে উঠছে না তো। নাঃ লাশের চিহ্ন নেই — এবার নিশ্চিন্ত। কাজ হয়ে গেছে — কেউ দেখে নি।
কিন্তু দেখল। মাথার ওপরের নিকষ কালো আকাশ, বহু দূরের মিটমিট করে জ্বলা তারারা, নৌকোর হাতবাতির মৃদু আলোর আওতার বাইরের তাল পাকানো অন্ধকার, হু হু করে বয়ে চলা গাঙের জোরালো হাওয়া — এরা সবাই দেখে রাখল লক্ষ্মীর শরীরটা কোথায় কিভাবে ডুবে গেল, কিভাবে মাছে ঠোকরাতে লাগল লাশটার চোখ, মুখ আর শরীরের বিভিন্ন জায়গা। শ্রীধর সে সব জানতে পারে না, ও বাগলা নদীর স্রোত ঠেলে বৈঠা বেয়ে ফেরে। কানের পাশ দিয়ে ছুটে যায় হাওয়া। তার গোঁ গোঁ আওয়াজে শ্রীধর চমকে চমকে ওঠে — বিসর্জন দেওয়া মেয়েমানুষটা কি আওয়াজ করছে এখনও? নৌকোটা একটু ভারী ভারী লাগে — কেউ পেছনে বসে নেই তো? বুকের ভেতরটা ধড়াস করে ওঠে — চট করে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে শ্রীধর। নাঃ কেউ নেই, নৌকোর পেছনটা একেবারে ফাঁকা। তবুও নৌকো বাইতে কষ্ট হয় — শ্রীধর সব পাথর ফেলে দেয় নদীতে। তারপর জোরে জোরে বৈঠা টানে।
গণেশ ঠিক একই জায়গার থেকে নৌকো ফেরৎ নিয়ে যাবে। ফিরে এসে জায়গামত নৌকো বাঁধে শ্রীধর। নামবার আগে একবার নৌকোটা ভাল করে দেখে নেয়। লক্ষ্মীর কোন চিহ্ন থেকে না যায়। তারপর নৌকোর হাতবাতি নিভিয়ে পাড়ে নামে — বিলের কিনারায় এসে নিজের নৌকো খোলে।
এখন বর্ষা গিয়ে শীত আসবে আসবে করছে। বিল থেকে উঠে আসে শেষ রাতের কুয়াসা। একটা অবয়ব নেয় — শ্রীধরের নৌকোর পাশে পাশে ভেসে চলে।
শ্রীধরের নি:শ্বাস ঘন ঘন পড়ে — বুকের খাঁচার ভেতরের যন্ত্রটা লাফিয়ে লাফিয়ে ওঠে। প্রাণপণে নৌকো বায় শ্রীধর। আর একটু গেলেই ওর ঘরের জমিটা। একটু — আরও একটু — আঃ, পৌঁছে গেছে শ্রীধর। কুয়াসায় তৈরী জিনিষটা এখন আর ওর সঙ্গে নেই। বিলের ভেতরেই মিলিয়ে গিয়েছে।
নৌকো বেঁধে বেশ কিছুক্ষণ দম নিল শ্রীধর। তারপর দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকল।
ঘরে জমাট অন্ধকার। আবার গা ছমছম করে উঠল। কেউ যেন সঙ্গে সঙ্গে রয়েছে — যাই যাই করেও যাচ্ছে না।
লন্ঠনটা জ্বালল শ্রীধর। এবার খানিকটা সাহস ফিরে এল। খালি জুতোটা খুলে জামা কাপড় না ছেড়েই বিছানায় গড়িয়ে পড়ল। লন্ঠনটা জ্বলতে লাগল। জ্বলুক ওটা, ঘরে একটু আলো থাকা দরকার।
রেওতী এল শ্রীধরের ঘরে। বিলের পাড় থেকে শ্রীধরের সঙ্গে নৌকোয় উঠল। পরনে ডগডগে লাল শাড়ি জামা। মাথায় টিকলি, নাকে নথ, কানে দুল, গলায় হার আর হাতে চুড়ি। কোলে সেই বাচ্চা। পেছনে শ্রীধর। কাঁধে রেওতীর ব্যাগ, দুহাতে ওর দুটো স্যুটকেস। মানিক মুখে একগাল হাসি মেখে বড় বড় চোখ করে রেওতীকে দেখছিল। শ্রীধর ধমকের সুরে বলল, তোর নতুন বৌদি, প্রণাম কর্।
এবার পুরো দাঁত বার করে হাসল মানিক। রেওতীর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম সেরে নিয়ে নৌকো খুলে দিল। চটপট নতুন বৌদিকে নিয়ে গিয়ে ঘরে তুলতে হবে।
শ্রীধরের ঘর দেখে রেওতীর মুখ ভার হয়ে গেল — যদিও সবই জানা ছিল তবুও। শ্রীধর মন ভোলানো কথা বলে, আবার ছমাসের ভেতর শহরে উঠে যাবার প্রতিজ্ঞা করে। তখন ঘরে ঢোকে রেওতী। শ্রীধরের আগের আওরাৎটার সঙ্গে দেখা হবার সম্ভাবনা নেই। ওকে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে — এ কথা শ্রীধর বলে রেখেছে রেওতীকে।
শুরু হয়ে গেল শ্রীধরের নতুন গৃহস্থালি। কিন্তু ছোট ছোট অসুবিধে দেখা দিতে লাগল। রেওতী রান্নাবান্না প্রায় কিছুই জানে না। কৈশোর থেকেই এ লাইনে নেমেছে — রান্না ওকে করতে হয় নি। রান্না এখন মানিকের দায়িত্ব। বাসনকোসন পরিষ্কার করা — সেও পড়েছে মানিকের ঘাড়ে। মানিককে এখন মোটামুটি বাড়িতেই থাকতে হয়। আগে শ্রীধর ছোট খাট কাজে ওকে এদিক ওদিক পাঠাত। এখন সে সব ওকে নিজেকেই করতে হয়। আগে ঘরে মদ থাকত না। শ্রীধর ইচ্ছেমত বাইরে থেকে খেয়ে আসত। কিন্তু রেওতীর লালপানি ছাড়া চলে না — ওর অনেকদিনের পুরনো অভ্যেস। কাজেই শ্রীধরকে নিয়ম করে লাল জলের জোগাড় রাখতে হয়। দৈবাৎ কখনো ফুরিয়ে গেলে রেওতী চেঁচামেচি করে একাকার কাণ্ড করে। যখন লক্ষ্মী ঘরে ছিল তখন শারীরিক মিলনটা নির্ভর করত শ্রীধরের মর্জির ওপর। এখন ব্যাপারটা তা নয়। রেওতী বহু পুরুষের স্বাদ পেতে অভ্যস্ত — ও নিজের পাওনাগণ্ডা আদায় করে নেয়। কোনদিন শ্রীধর ক্লান্ত থাকলে রেগে যায়, চেঁচিয়ে ওকে গালমন্দ করে — সাল্লা হিজড়া কাঁহিকা। মাল চোরা চালানের ব্যবসায় অনেক জায়গায় ঘুরতে হয়, অনেক লোকের সঙ্গে কথাবার্তা বলতে হয়। আগের মত আর পেরে ওঠে না শ্রীধর। ও বোঝে যে ওর কাজ অন্য লোকে বাগিয়ে নিচ্ছে, ওর ব্যবসায় ভাটা পড়েছে। গত মাসে নিতু সাহার সুদটা পুরো দিতে পারে নি। হারামির বাচ্চা লোক পাঠিয়ে তাগাদা দিয়েছে। আর কানহাইয়া — রেওতীর ছেলেটা। শালা বেজন্মা যখন তখন পেচ্ছাপ পায়খানা করে ঘর নোংরা করছে। ওকে পরিষ্কার করাও মানিকের দায়িত্ব। শ্রীধরের বিছানায় এখন অয়েল ক্লথ পাতা থাকে। ছেলেটার আবার হিসির তোড় খুব বেশী। এমনও হয়েছে যে শ্রীধর রেওতীকে আঁকড়ে ধরেছে, আর পাশ থেকে ঈষদুষ্ণ জলের ধারা ফিনকি দিয়ে এসে শ্রীধরকে ভিজিয়ে দিয়েছে। শালা আপদ একটা। রেওতীর নেশাটা একটু একটু করে ফিকে হয়ে যাচ্ছে কিনা ঠিক বুঝে উঠতে পারে না শ্রীধর।
আর একটা কারনেও অবশ্য শ্রীধরের একটু ঝটকা লেগেছে। রেওতীকে নিয়ে আসার ঠিক আগে ও খবরটা পেয়েছিল। ওকে বলেছিল বিরজু, এ বাড়ির একজন দালাল এবং বড় গুণ্ডা। মালিক রেওতীর ওপর খুব একটা খুসী ছিল না। কারণটা হল রেওতীর বাচ্চা। বাড়ির আর কোন মেয়ের বাচ্চা নেই, খালি রেওতীরই আছে। মালিক এসব ঝুটঝামেলা পছন্দ করে না। মতলব করছিল রেওতীকে বেচে দেবে অনেক উত্তরে একটা সস্তার রেন্ডীখানায়। সেসব জায়গা একেবারে নরক। রেওতী সেটা জানত। শ্রীধর ব্যাপারটা বুঝেছিল। ও যে শ্রীধরের সঙ্গে চলে আসতে রাজী হয়েছে তা শ্রীধরের ওপর যত না টানে তার চেয়ে বেশী ওখানে বিক্রী হয়ে যাওয়ার ভয়ে। আর সেজন্যেই আর এক বাবুর কথা ওর কাছে মিথ্যে করে বলে ওকে তাগাদা লাগিয়েছিল। কিন্তু ততক্ষণে পাশার দান পড়ে গিয়েছে — শ্রীধর নগদ দু লাখ টাকা ধরে দিয়েছে মীরামওসীর হাতে। মেয়েমানুষটা ডান হাতের আঙুল জিভে দিয়ে দিয়ে থুতু লাগিয়ে লাগিয়ে একটা একটা করে নোট গুনে নিয়েছে। গোনা শেষ হলে পেট কাপড়ে টাকার বান্ডিলটা গুঁজে নিয়ে শ্রীধরের দিকে তাকিয়ে হেসেছে, আর ওর পুরুষালি হাত দিয়ে শ্রীধরের থুতনি নেড়ে দিয়ে ওকে আদর করে দিয়েছে।
একটা ব্যাপার শুরু হয়েছিল — শ্রীধরের অগোচরে। মানিক কাঁচা বয়েসের ছেলে, রেওতীর মত মেয়েমানুষ আগে কখনো দেখে নি। ও এখন বেশীর ভাগ সময় বাড়িতে থাকে বলে কারণে অকারণে রেওতীর কাছে ঘুরঘুর করে। এটা ওটা কথা বলে, রেওতীকে খুশি করার চেষ্টা করে। রেওতী সবই বোঝে। ও-ও মানিকের সঙ্গে মিটি মিটি হেসে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে। মানিককে নাচিয়ে ও আনন্দ পায়। বাড়িতে টিভি ডিভিডি এসব নেই — ওরও তো সময় কাটানোর জন্যে একটা খেলনার দরকার। কানহাইয়া কাঁদলে ও মানিকের সামনেই বাচ্চার মুখে স্তন গুঁজে দেয়। বহু লোককে নিজের শরীর দেখিয়েছে রেওতী — ওর মানিককে লজ্জা পাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। মানিক যা দেখার দেখে নেয় — ওর পা থেকে মাথা পর্যন্ত রক্ত ছোটাছুটি করে, শরীরের ভেতর কেমন কেমন লাগে। রেওতী বাচ্চাকে খাওয়ানো শেষ করে মানিকের কোলে দেয় — বাচ্চা রাখাও এখন মানিকের একটা দায়িত্ব।
দুপুরে রেওতী একাই খায়, কারণ শ্রীধর তখন বাড়ি থাকে না। মানিকের রান্না বিশেষ স্বাদু নয় বলে প্রায় দিনই শ্রীধর রাতে ফিরবার পথে বাইরের থেকে খাবার কিনে আনে। রাতে খাওয়াটা দুজন একসঙ্গে খায়, যদি না মাল চালানের জন্যে শ্রীধরের বেশী রাতে কাজ পড়ে। এখন রেওতী একাই খেতে বসেছিল। ডাল, একটা তরকারী, মাছের ঝোল আর রুটি — রেওতী ভাত খেতে অভ্যস্ত নয়। খাবার বেড়ে দিয়ে মানিক সামনে বসেছিল। রোজই দুপুরে বসে। রেওতী খেতে খেতে ওর সঙ্গে গল্প করে — ওরা কি কাজ কি ভাবে করে সে সব খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করে। মানিক খুব উৎসাহ পায় এ সব কথা বলতে। খালি রেওতী যখন শ্রীধরের আগের আওরাৎটার কথা তোলে তখন মানিক চুপ মেরে যায় — প্রসঙ্গটা এড়িয়ে যায়। আজ আবার রেওতী জিজ্ঞেস করল, হ্যাঁরে, তোর আগের ভাবী বাপের বাড়ি যাওয়ার সময় খালি ঝগড়াই করল? একটুও কাঁদে নি?
মানিক হঠাৎ নিভে গেল। ঘরের অন্যদিকে কানহাইয়া হামা দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। সেদিকে তাকিয়ে জবাব দিল, আমি জানি না।
সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে রেওতী। ওর ডান হাতটা এঁটো — বাঁ হাত দিয়ে মানিকের মুখটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে দিয়ে বলে, ঝুট বাত বলছিস। বল্ না ঠিক সে — কি করেছিল?
রেওতী সামনে ঝুঁকে পড়ায় ওর বুকের অনেকটা অনাবৃত হয়ে গিয়েছিল। তাতে মানিকের চোখ আটকে গেল। মাথার ভেতর কেমন একটা করে উঠল। আর তখন দুম করে কথাটা বলে ফেলল মানিক।
মানিক সে রাতে ইসলামপুর থেকে ফিরে এসেছিল। ঘটনাচক্রে ওর কাজটা তাড়াতাড়ি হয়ে গিয়েছিল। একটা লরী ড্রাইভারকে কুড়ি টাকা দিয়ে লরীর পেছনে বোঝাই মালের ওপর খালাসীদের সঙ্গে বসে ও ফিরেছিল। ঘরে এসেছিল ওদের প্রতিবেশী দীনুর নৌকোয় চড়ে। ওর খুপরিটার জন্যে আলাদা দরজা — বাইরে থেকে সোজা ঢুকে আসা যায়। রাতের খাওয়া বাইরেই সেরে এসেছিল — একদম ওর খুপরিতে ঢুকে সারাদিনের ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছিল। মাঝরাতে একটা গোঁ গোঁ আওয়াজে ওর ঘুম ভেঙে যায়। ওর খুপরি আর শ্রীধরের ঘরের মাঝে দর্মার পার্টিশন। তার ফুটোয় চোখ লাগিয়েছিল। যা দেখেছিল আজ আর তা চেপে রাখতে পারল না। রেওতীর চোখে চোখ রেখে কথাটা উগরে দিল।
রেওতীর মুখ রক্তহীন — সাদা। বড় বড় দুই চোখে ফুটে বেরোয় ভয়। ও খাওয়া বন্ধ করে চুপ করে বসে থাকে অনেকক্ষণ। মানিক সামনে বোকার মত বসা। ও এখন বুঝতে পারছে না এই লুকোন কথাটা বলে ফেলার পর কি হবে।
আস্তে আস্তে রেওতীর মুখ স্বাভাবিক হয়ে আসে। চোখে কটাক্ষ ঝিলিক দেয়, ঠোঁটের কোণে মনভোলান হাসি। ও বাঁ হাত বাড়িয়ে মানিকের গাল টেপে। বলে, তু বহুত আচ্ছা লড়কা। আচ্ছা কাম করেছিস কথাটা আমাকে বলে দিয়ে।
শ্রীধর বসার জায়গা পেয়েছে বাসের একেবারে পেছনের সীটটায়। রাস্তা ভাঙাচোরা। খাটারা বাস চলতে চলতে সমানে লাফাচ্ছে। বিশেষ করে পেছন দিকটা। সীটের ওপরের গদী হয়তো একসময় নরম ছিল। এখন তা লোহার মত শক্ত। বাসের ঝাঁকুনির সঙ্গে সঙ্গে শ্রীধরের পশ্চাদ্দেশে ভালরকম চোট লাগছে। বাসে যথেষ্ট ভীড়। একটা নোংরা দুর্গন্ধ শার্ট আর ধুতি পরা লোক শ্রীধরের দিকে ঝুঁকে পড়ে দাঁড়িয়েছিল আর বিড়ি খাচ্ছিল। ওর নাক থেকে বেরোন বিড়ির ধোঁয়া ঢুকে আসছিল শ্রীধরের নাকে মুখে। উপায় নেই — সারা রাস্তাটা এভাবেই যেতে হবে। লোকটার থেকে একটা বিড়ি চেয়ে নিয়ে ধরিয়ে ফেলল শ্রীধর।
একটা খবর ছিল। সীমান্তের ওপারে গরু চালানের ব্যবসা। প্রচুর গরু যায় এপার থেকে ওপারে। এক এক সারে দশ পনেরটা — গলায় গলায় দড়ি দিয়ে বাঁধা। এরকম সার সার গরুকে রাস্তা দিয়ে তাড়িয়ে নিয়ে যায়। দুপাশে পেছনে লোক থাকে — লাঠি হাতে পিটতে পিটতে গরুগুলোকে হাঁটায়। জবাই হয় ওপারে গিয়ে। যে বুড়ো গরু একেবারেই অকেজো খালি সীমান্তটা পার করতে পারলেই তার ভাল দাম। লাভের ব্যবসা — ঢুকতে পারলে ভাল পয়সা পেটানো যাবে। শ্রীধর গিয়েছিল মদন সরকারের সঙ্গে দেখা করতে। বর্ডার এলাকার দাদা লোক। ষণ্ডা চেহারা। রাইস মিল, ইঁটের ভাটা আচ্ছে। স্থানীয় পঞ্চায়েতে খুব প্রতিপত্তি। শ্রীধরের কথা মদন মন দিয়ে শুনল। চা খাওয়াল। তারপর বলল, আম্নি তিনটের বাসটায় চেপে এখান থেকে চলে যান। এ তল্লাটেই আর থাকবেন না। এ লাইনের লোকজন যদি জানতে পারে যে আম্নি ওদের রুজিতে ভাগ বসাতে এসেছেন তাহলে গরুর সঙ্গে আম্নাকেও জবাই করে দেবে।
শ্রীধর মালদায় পৌঁছল — তখন সন্ধে হয়ে এসেছে। পশ্চাদ্দেশ বেশ ব্যথা করছে। হাত দিয়ে পেছনটা একটু ডলে নিল। বাস স্ট্যান্ডে অনেকগুলো চায়ের দোকান। এক ভাঁড় চা খেল শ্রীধর। তখন বুঝল বেশ ক্ষিদে পেয়েছে। আর এক ভাঁড় চা নিল। তার সঙ্গে উনুনে সেঁকা মোটা মোটা দু পিস পাঁউরুটি — মাখন আর বড় বড় দানার চিনি দিয়ে। তারপর বাড়ি যাওয়ার বাসে উঠল।
ওদের বিলের ঘাটে যখন শ্রীধর পৌঁছল তখন বেশ রাত হয়েছে। রাস্তায় কোন আলো নেই। খেয়াঘাটে টিমটিম করে আলো জ্বলছে, তাতে খুব ঝাপসা একটা আলো হয়েছে এখানে। ওর নৌকোটা আছে, মানিক নেই। সকালে শ্রীধরকে এখানে পৌঁছে দিয়ে নৌকো নিয়ে ফিরে গিয়েছিল — এখান আবার এখানে ওর নৌকো নিয়ে থাকার কথা। নিশ্চয়ই নৌকো রেখে প্রতিবেশীর নৌকোয় ফিরে গিয়েছে। রেওতী ওকে দিনরাত খাটায়। মাগিটা নিজে কোন কাজ করে না, খালি হাত কোলে করে বসে থাকে। শ্রীধর মানিকের মোবাইলে ফোন করল। কোন সাড়া নেই। বোধহয় ফোনে চার্জ দেয়নি ছোঁড়া।
নৌকো খুলল শ্রীধর। শরীর আজ ক্লান্ত — নৌকো বাইতে ভাল লাগছে না। কিন্তু উপায় তো কিছু নেই। বাড়ি গিয়ে ভাল করে খেতে হবে — খিদেটা ফের পেয়েছে।
নিজের জমিতে পৌঁছে নৌকো বাঁধল শ্রীধর। তারপর পা বাড়াল ঘরের দিকে।
ঘরটা অন্ধকার। ভেতরে লন্ঠন জ্বলছে না। রেওতী বোধহয় ঘুমুচ্ছে। ঘরের দরজাটা ভেজানো ছিল। চাপ দিতে খুলে গেল। ঘরে ঢুকতে গিয়েই কিরকম একটা খটকা লাগল। ঘরে কেউ নেই নাকি? লন্ঠনটা দরজার কাছেই ছিল। পকেট থেকে দেশলাই বার করে সেটা জ্বালল।
ঘর খালি। রেওতী নেই। ওর ব্যাগ, স্যুটকেস কাপড়চোপড় নেই। ওর বাচ্চা নেই। ঘরের কোণে একটা কাঠের বাক্স — সেখানে গরু চালানের জন্যে নগদ টাকা রেখেছিল শ্রীধর। বাক্সের তালা ভাঙা। বাক্সের ডালা খুলল। বাক্স খালি — কোন টাকা নেই। পাশের খুপরির ভেজানো দরজা ঠেলে উঁকি মারল শ্রীধর। অন্ধকার হাঁ হাঁ করে উঠল। মানিক নেই।
মানিকের খুপরি থেকে বেরিয়ে এসে আবার নিজের ঘরে ঢুকল শ্রীধর। ওর গলা এখন শুকনো। একটা গেলাস নিয়ে জলের ঘড়া কাৎ করল। ঘড়া খালি — জল নেই।
এই বিল থেকে বেরিয়ে অনেক জায়গায় যাওয়া যায়। পাকা রাস্তা ধরে এগিয়ে গিয়ে বাসে উঠে রেলস্টেশন। সেখান থেকে লম্বা পাড়ি। উত্তর, দক্ষিণ বা পশ্চিমে। অথবা খেয়াঘাট থেকে নৌকো করে বাগলা নদী পেরোন। তারপর কোন একটা মালের নৌকোকে পয়সা দিয়ে তাতে চড়ে বর্ডারের ওপার।
ঘর থেকে বেরিয়ে জলের ধারে এল শ্রীধর। আকাশে চাঁদ রয়েছে। বেশ বড় মাপের চাঁদ — জ্যোৎস্না ভালই দিচ্ছে। হাওয়া নেই, জল নিস্তরঙ্গ — একেবারে কাঁচের পাতের মত। সাদা ফুটফুটে আলো — কলাগাছের পাতার ফাঁক দিয়ে জলের ওপর পড়েছে — ঠিক যেন একটা মানুষের চেহারা। শরীরটা শ্রীধরের ঘরের জমির সঙ্গে লেগে আছে, মাথাটা জলের দিকে। একটা শাড়ি পরা মেয়েমানুষ নয়?
ভাল করে দেখার জন্যে শ্রীধর কলাগাছের দিকে এগিয়ে যায়। তখন একটা হাওয়া ওঠে, কলাগাছের পাতা সর্ সর্ আওয়াজে মাথা দোলায়। জলে ছোট ছোট ঢেউ ওঠে — জলের ওপরের মেয়েমানুষটা ট্টুকরো টুকরো হয়ে যায়।
চাঁদ ডুবতে এখনও দেরী আছে। এই হাওয়াটাও একসময় থামবে। কলাপাতা স্থির হয়ে থাকবে — জলের ঢেউ বন্ধ হবে। তখন মেয়েটার শরীর মুখ পরিষ্কার হয়ে উঠবে।
শ্রীধর সেখানে দাঁড়িয়ে থাকে। অপেক্ষা করে।