পকেটমারিকে খারাপ চোখে দেখলে কিছু বলার নেই কিন্তু পকেটমারার মধ্যে যে সূক্ষ্ম শিল্প আছে সেটা মানতেই হবে। শিল্পীর, থুড়ি পকেটমারের হাতের হাল্কা ছোঁয়ায় পেটমোটা অফিসবাবুর হিপ পকেট থেকে সমান পেটমোটা মানিব্যাগ গায়েব হয়ে যায় কিন্তু পকেটটা অল্প রিফু করিয়ে নিলেই প্যান্টটা আবার পরার যোগ্য হয়ে যায়। খাণ্ডারনি মাসিমার ব্যাগের প্রত্যন্ত খাপে লুকিয়ে রাখা টাকা চক্ষের নিমেষে গায়েব হয়ে যায় অথচ ব্যাগের গায়ে ব্লেডের দাগ খুঁজতে মাসিমাকে চশমা পরতে হয়। এহেন শিল্পের সাথে যুক্ত থাকা মানুষরা স্বাভাবিকভাবেই নিজেদের পেশার সম্পর্কে অত্যন্ত গর্বিত। এমনই এক গর্বিত মানুষ পঞ্চা। শুরু থেকেই তার লক্ষ্য ছিল আরো বড় শিল্পী হয়ে ওঠা। চুরিডাকাতি রাহাজানির মতন মোটা দাগের কাজকে সে অত্যন্ত নীচু নজরে দেখে। ফলে ওসব দিকে যাবার কোনো ইচ্ছে তার কোনদিনই ছিল না। সে নিজের লক্ষ্যে বরাবর স্থির ছিল। ফলে এই আঠাশ বছর বয়সেই আশেপাশের অঞ্চলের শিল্পীরাও তাকে সেলাম ঠোকে। পঞ্চা ফটফটে দিনের আলোয় ফাঁকা গলিতে ফেরিওয়ালার পকেট মারাতে স্পেশালাইজ করার পরে বয়সে-বড় শিল্পীরাও তাকে সম্মান দিয়ে কথা বলেন।
এহেন পঞ্চার জীবনে একটাই দুঃখু।জীবনে তার পড়াশোনা শেখা হয়নি। বাংলা সাইনবোর্ড পড়তেই দিন কাবার হয়ে যায়; বাকি কথা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তা তিন কুলে কেউ-না-থাকা পঞ্চাকে যখন পাড়াতুতো মাসি-পিসির দল বলল, "পঞ্চা এবার একটা বে কর" পঞ্চা মনে মনে ঠিক করে ফেলল বে যদি করতেই হয় তবে পড়াশোনা জানা মেয়ে ছাড়া বে করবেই না। তার সুন্দরী চাই না, টাকাপয়সা চাই না, কিন্তু পড়াশোনা জানা মেয়ে চাই। সেইমতন খোঁজ শুরু হল। অচিরেই বোঝা গেল দেশে শিল্পের কদর নেই। লোকে পঞ্চার অর্ধেক রোজগার করা টাক মাথা নাদা পেটা আধবুড়ো সরকারী অফিসের পিওনকেও জামাই করতে রাজী কিন্তু পঞ্চার মতন টল ডার্ক হ্যান্ডসাম অ্যাম্বিশাস কেপেবল শিল্পীকে জামাই করতে চায় না। এই অবস্থায় পঞ্চার মনে স্বভাবতই বৈরাগ্যের উদয় হল। রাতের দিকে বস্তির ধারের বড় রাস্তার ওপারে নতুন গজিয়ে ওঠা ফ্ল্যাট বাড়িগুলোর বিহারী দারোয়ানদের চুল্লু খইনির আসরে তাকে ঘনঘন দেখা যেতে লাগল। তার চেয়েও চিন্তার কথা আসরের সবার মালকড়ি আসরের শেষে ও তাদের লুঙ্গির গেঁটেই রয়ে যেতে লাগল। এই অবস্থায় হাল ধরল পঞ্চার ঘুনসিবেলার বন্ধু ন্যাপা। ন্যাপা হল পকেটমারি, চুরি, ডাকাতির ডাউন স্ট্রীম। মানে চোরাই মাল বিক্রী করে। তা এহেন বেচুবাবু ন্যাপা খুব সহজেই পঞ্চাকে বিয়ের হাটে বেচে দিল। কনে — শেফালি, আটক্লাস পাশ। বাপমরা মেয়ে। মা আর মেয়ের সংসার। তিনকুলে আর কেউ নেই। খালি বিয়ে করতে যাবার সময় ন্যাপা পঞ্চাকে কানে কানে বলে দিল, "তোর শাউড়ী কিন্তু জানে যে তুই হকার। দূরপাল্লার রেলে, বাসে হকারি করিস। বে'র কিছুদিন পরে বৌ পটে গেলে আসল কথা বলিস। এখন চেপে থাক।"
বিয়ে, ফুলশয্যা ভালয় ভালয় মিটে গেল। পঞ্চা নতুন বৌ-এর প্রেমে হাবুডুবু। একরত্তি মেয়ে এ-কদিনে পঞ্চার ছন্নছাড়া ঘর বারান্দাটুকু পরিষ্কার করে, বিয়েতে পাওয়া টুকিটাকি দিয়ে কেমন গেরস্থবাড়ি করে তুলেছে। আবার পাশের বাড়ির বিশে যে লোকের বাড়ি বাড়ি কাগজ দেয় তার কাছ থেকে পুরোনো কাগজ নিয়ে এসে পড়ে। পঞ্চাকে দুনিয়ার হাল হকিকত বলে। পঞ্চার সব জামাকাপড় রগড়ে ঘষে কেচে সাফ করে ফেলেছে। এত কাজ করতে বারণ করলে বলে বাবা মারা যাবার পরে তাকে স্কুলের পড়া ছেড়ে লোকের বাড়ি কাজ করতে হয়েছে। মা মেয়ে ওই করে বেঁচে থেকেছে। আর এ তো নিজের সংসারের কাজ। এ নাকি গায়েই লাগে না।
বিয়ের হপ্তাখানেক পরে এক সন্ধেতে পঞ্চা নতুন কেনা ডবল তক্তপোশে বসেছে। হাতে চা। বৌ-এর সাথে একসাথে বসে খাবে।
"হ্যাঁ গো তুমি আসবে না? সেই কখন থেকে বসে আছি একসাথে চা খাব বলে। চা যে জুড়িয়ে গেল!" ঘরের বাইরের বারান্দার ধারের 'কিচিন' থেকে শেফালি সাড়া দিল, "আসছি ই ই ই।"
এমন সময় বাইরে থেকে হাঁক কানে এল, "পঞ্চা আ আ ও পঞ্চা! আছিস না কি? লতুন বৌ দেখতে এলাম।"
ক্যানক্যানে গলা শুনেই বোঝা গেল মনা ঠাকমা। ডাকতেই ডাকতেই বুড়ি ঘরের ভেতরে। আর ঢুকেই "অ, চা খাচ্ছিস বুঝি পঞ্চা? তা আরেক কাপ হবে না? লতুন বৌ এর হাতের চা আমিও খেয়ে দেখি কেমন মিষ্টি!"
পঞ্চা বুঝে গেল বুড়ি সহজে যাবে না এখন। গোটা সন্ধ্যাটা গেল আর কি। ইতিমধ্যে দেখে শেফালি ঢুকছে ঘরে। হাতে চা আর একটা ছোট থালায় মুড়ি বাদাম। দেখে বুড়ির তো মুখে হাসি আর ধরে না। তারপরেই বুড়ি শুরু করল শেফালির হাঁড়ির খবর নেওয়া। পঞ্চা সবে ভাবছে এইবেলা কেটে পড়বে কিনা আচমকা বুড়ি পঞ্চার দিকে তাকিয়ে বলে,
"তা হ্যাঁরে বাপ আমার সেই আয়না ফিট করা পাউডার কৌটো এনে দিবি না না কি?"
পঞ্চার তো একগাল মাছি। সেই কবে বুড়িকে বলেছিল দিদিমনিদের ব্যাগ কেটে সে বস্তু এনে দেবে সে তো নিজেই ভুলে গেছে। তা শেফালি তো আর এ বস্তিতে নতুন আসা বৌদের মতন কাপড়ের পুঁটুলি নয়। সে ঠোঁট টিপে চোখ মটকে জিজ্ঞেস করে বসল, "সে কি ব্যাপার গো ঠাকমা? দাদু বুঝি বলেছে সাজুগুজু করতে?"
"দূর হ মুখপুড়ি! তোর দাদু বলে ভাল করে চোখে দেখতেই পায় না। আরে আমার মেয়ের ঘরের নাতনিটা তো আমার কাছেই থাকে। তারই জন্যি।"
"তা হ্যাঁ গো তুমি তো দুদিন আগে ওই নতুন বাজারে গেলে। আর ঠাকমার জিনিষটা কিনে আনতে ভুলে গেলে?"
"কিনে আনবে? সে আবার কি কতা? পঞ্চার কি চোখে ছানি পড়ল নাকি হাতে হাজা হল? বলি ও পঞ্চা?"
এই অবস্থায় পঞ্চাকে মুখ খুলতেই হয়। মরিয়া হয়েই পঞ্চা বলে বসল, "ও ঠাকমা অনেক তো হল। তোমার জিনিষ আমি এনে দেবখন। এখন শেফালিকে ছাড়তো? ও এইবেলা রান্না না করলে খেতে খেতে রাত গড়িয়ে যাবে যে।"
বুড়ি তো বিদেয় হল কিন্তু পঞ্চা গেল ফেঁসে। পুলিশের জেরার থেকে বৌ-এর জেরা যে কত ভয়ানক তা মর্মে মর্মে টের পাওয়া গেল। পুলিশের জেরার মুখে চুপ করে থাকলে পুলিশ আর যাই করুক অভিমানও করে না আর ঠোঁটও ফোলায় না। এখানে চুপ করে থাকার উপায়ই নেই। পঞ্চা আগডুম বাগডুম কিছু বকার পরে শেষটায় মরিয়া হয়ে বলল, "আরে মনা-ঠাকমার ভিমরতি ধরেছে। কি বলতে কি বলে।"
"কই তা তো মনে হল না? সারা সন্ধে তো দিব্যি গপ্পো করলেন।"
"আরে ঠাকমার নিয্যস ভিমরতি হয়েছে। নইলে তোমার হাতে চা খেয়ে একবারও ভাল বলল না? আমার ঘরের এই শুধরে যাওয়া হাল দেখেও কিচ্ছুটি বলল না!"
মনে হল ওষুধ ধরেছে। আর জবাব না দিয়ে শেফালি মুখ টিপে হেসে উঠে গেল। একটু পরে "কিচিন" থেকে ছ্যাঁক ছোক আওয়াজে বোঝা গেল রাতের রান্না হচ্ছে। পঞ্চাও নিশ্চিন্ত হয়ে এ যাত্রা ফাঁড়া কেটে যাওয়ায় মোড়ের শনি ঠাকুরকে পাঁচসিকে প্রমিস করে ফেলল।
আরো দিনকতক পরে পঞ্চা কাজে বেরোনো শুরু করল। আর বেরোনোর দুদিনের মাথাতেই লটারি লেগে গেল। এক মোটাসোটা কমলা লাল চুলওয়ালা মাঝ বয়সী মহিলা ভর সন্ধেবেলা গড়িয়াহাটের ফুটপাথে দাঁড়িয়ে একটা খাতার সাইজের ফোনে কাউকে লেট করার জন্য প্রবল হড়কাচ্ছিলেন। চেঁচানোর বহর শুনে পঞ্চা দুটো মেজর ইনফারেন্স ড্র করে ফেলল ঝটপট। ওদিকের লোকটা নিঘ্ঘাত এনার বর, আর এনার এখন যা হাল তাতে করে ব্যাগের মাল কেন পরনের শাড়ি খুলে নিলেও ইনি টের পাবেন না। সুতরাং পঞ্চার কাজের আদর্শ সময়। পঞ্চা টাকার ব্যাগ, একটা লিপস্টিক, বেশ কটা ট্যাবলেটের পাতা, একটা ছোটমতন সেন্টের শিশি, স অ অ ব হাতিয়ে ফেলল। টাকা ছাড়া আর কিছু নেবার যে ইচ্ছে ছিল তা নয় কিন্তু টাকার খোঁজে এনার ব্যাগের দু জায়গাতে ব্লেড চালাতে হল কিনা। আর হাতের লক্ষ্মী পায়ে ঠেলার মতন বোকা পঞ্চা নয়। পরে টাকার ব্যাগ খুলে দেখে তিন তিনটে কড় কড়ে নতুন দু হাজারের নোট আর গোটা পাঁচেক একশো টাকার নোট। খুচরা মিলিয়ে আরো সাঁইতিরিশ টাকা।
পঞ্চা খোশমেজাজে সন্ধ্যার বাজার থেকে মাছ সবজী সব কিনে, কুড়ি টাকার আলুর চপ বেগুনী কিনে "তোকে নিয়ে যাব আমি একশ বৃন্দাবন, আমি আর অন্য কিছুর মুডে নেই এখন" ভাঁজতে ভাঁজতে বাড়ি ঢুকলো। বাজারটা নামাতেই শেফালি বলল, "হাতমুখ ধোও। আমি আসছি চা নিয়ে।"
পঞ্চা হাতমুখ ধুয়ে নিজের রোজগারপাতি মেলে বসতে না বসতেই শেফালি ঢুকলো হাতে চা নিয়ে। আর ঢুকেই কুইজ কন্টেস্ট শুরু হয়ে গেল।
"ওষুধ কিনলে কেন? শরীরটা খারাপ?"
"ওই একটু অম্বল করছে দুদিন ধরে..."
"এ তো ক্রোসিন। অম্বলের ওষুধ তো নয়?"
"দোকান থেকে যা দিল আর কি।"
"এ কেমন দোকান গো যে অম্বল হলে জ্বরের ওষুধ দেয়?"
"না — মানে গাটা একটু ম্যাজম্যাজও করছে কিনা!"
"কই দেখি? না কই? গা তো বরফ!"
পঞ্চা সবে মনে মনে ভাবছে ফুর্তির চোটে কেন যে ভুলে গেল মালপত্তর লুকাতে আর পুরোনো অভ্যেসের বশে ছড়িয়ে নিয়ে বসল এসে গেল সেকেন্ড প্রশ্ন।
"এই আর্ধেক খরচ হওয়া সেন্টের শিশি আবার কোথা থেকে কিনলে?"
"ওই মানে ঠিক কিনিনি..."
"কেননি মানে? অন্যের ব্যবহার করা আর্ধেক খরচ হয়ে যাওয়া সেন্টের শিশি তুমি আমার জন্য চেয়ে আনলে? আমি কি তোমার কাছে চেয়েছিলাম সেন্ট? গরীব বলে কি সম্মান নেই?"
"না মানে ঠিক চেয়ে আনিনি..."
এরপর ঠিক একঘন্টা সাড়ে তেত্তিরিশ মিনিটে পঞ্চার গলায় গামছা দিয়ে ওই তিন আঙুলে মেয়ে শেফালি পেটের কথা ঠিক টেনে বার করল। পঞ্চা প্রথমটায় খুব বেকায়দায় পড়লেও পরের দিকে পকেটমারা যে কত উঁচুদরের শিল্প তা নিয়ে অনেক কথা বলল। তার এ লাইনে কত নামডাক তাও খোলসা করে বলল। সব শুনে শেফালি খালি ঠান্ডা গলায় বলল, "তুমি আমাদের মা মেয়েকে মিছে কথা বলে ঠকালে? বাপ মরার পর এত কষ্ট করেছি, একবেলা খেয়েও থেকেছি তবু বাবুদের বাড়ির একটা কিছুতে হাত দিইনি।"
সে ঘরে দোর দিল।
পঞ্চা প্রথমে কাকুতি মিনতি তার পর হাঁকডাক সবই করল। কিন্তু শেফালি আর সে-রাতে উঠলোও না, রান্নাও করল না, দোরও খুললো না। অগত্যা পঞ্চাকেও পেটে কিল মেরে, গায়ের চাদরখানা মুড়ি দিয়ে বারান্দায় বসে রাতটা পার করতে হল। ভোরের দিকটায় চোখ লেগে গেছিল। চোখে চড়া রোদ্দুর পড়তেই পঞ্চা ধড়ফড় করে উঠে বসল। আর বসতেই খেয়াল হল দোর এখনো বন্ধ। আবার এক প্রস্হ ডাকাডাকি। পঞ্চা স্বীকারও করে নিল যে মিছে কথা বলা উচিত হয়নি।
ভেতর থেকে খালি আওয়াজ এল, "গলায় দড়ি দিইনি।"
এরপরে আর কি বা বলার থাকে। পঞ্চা যখন রুট কজ অ্যানালিসিস করতে করতে কেন সে ঠাকমাকে কথা দিয়েছিল থেকে আদৌ কেন বে করার সখ হয়েছিল অবধি পৌঁছেছে তখনই দেখতে পেল ন্যাপা এদিকেই আসছে। ন্যাপাকে দেখেই পঞ্চা ডুকরে উঠল "ন্যাপারে..."
"কিরে কি হল? মুখ চোখ এমন কেন? ধরা পড়েছিলি?"
"ধরাই পড়েছি বটে। কিন্তু পাবলিকের হাতে না, বৌ এর হাতে!"
"সে কিরে? এখনই?"
পরের পাঁচ মিনিটে পঞ্চা ন্যাপাকে রাজধানী এক্সপ্রেসের স্পীডে সামারি দিয়ে ফেলল।
"তা তুই দোষ স্বীকার করেছিস?"
"না মানে কাল করিনি কিন্তু আজ করেছি।"
"তাতে কি বলল?"
"তাতে খালি বলল এখনো গলায় দড়ি দেয়নি।"
"হুঁ।"
"হুঁ কিরে? কিছু বল?"
"ভাবতে দে।"
আরো মিনিট দশেক পরে ন্যাপা গলা খাকরানি দিয়ে শুরু করল, "বুঝলি পঞ্চা, ছেড়ে দে।"
"পাগল নাকি? বৌকে ছেড়ে দেব? আমি তো ছেলেমেয়ের নাম অবধি ভেবে ফেলেছি রে!"
"আহা বৌকে না। পকেটমারা ছেড়ে দে।"
"মানে?"
"এটা কি এমন শক্ত কথা যে তোর মানে বই লাগবে?" (মানে বই চোর বাজারে হট আইটেম। সুতরাং...)
পঞ্চা পুরো আমার সাজানো বাগান শুকিয়ে গেল স্টাইলে হাহাকার করে উঠলো, "ওরে আমি পকেটমারা ছেড়ে দিলে পকেটমারির কি হবে রে আর আমারই বা কি হবে রে! সবাই যে বলে আমাকে দেখেই নতুন ছেলেরা এ লাইনে আসার উৎসাহ পায়। আমি যে পরের বছর থেকে বিশ্ব বাংলা পকেটমার সমিতি শুরু করব ভাবছিলাম রে..."
"তবে বৌকে ছেড়ে দে!"
এ কথায় পঞ্চা গুম হয়ে গেল। ন্যাপা আরো খানিকক্ষণ বসে শেষে কেটে পড়ল। সূর্য যখন প্রায় পাটে বসেছে তখন পঞ্চা মন ঠিকই করে ফেলল। মন ঠিক করে দুরুদুরু বুকে আবার দোরের কাছে গিয়ে ডাক দিল, "শেফালি! ও শেফালি!"
এবার সাড়া এল, "কি?"
"আমি ছেড়ে দেব। আর পকেট মারব না।"
"এখন ঝগড়ার মুখে বলছ ও কথা। পরে যে মনে থাকবে তার কি ভরসা?"
"কি করলে ভরসা হবে?"
"দিব্যি কাট।"
"কার নামে?"
"পকেটমারির নামে।"
"এত শক্ত দিব্যি?"
"হ্যাঁ।"
অগত্যা বুক ফাঁকা করে শ্বাস ফেলে পঞ্চা বলল, "পকেটমারির দিব্যি আমি আর পকেট মারব না।"
এর ঘন্টাখানেক পরে নতুন বাজারের ধারে একটা ছোট ঝুপড়ি মতন দোকানে দুজনকে বসে থাকতে দেখা গেল। তাদের হাতে শাল পাতার বাটিতে কি বলুন তো? বলতে পারলেন না তো? জিলিপি। গরম জিলিপি। ভাব হয়ে যাবার পরে শেফালি ওটাই খেতে চাইল যে!
আর একটু কান পাতলেই শুনতে পাবেন ওরা কি বলছে।
"আচ্ছা বিরিয়ানি, কষা মাংস, নিদেনপক্ষে চিকেন রোল ছেড়ে তুমি গরম জিলিপি খেতে চাইলে কেন গো?
"বাবা ফি রবিবার আমার পড়া ধরত জান? আর পড়া পারলেই গরম গরম জিলিপি এনে খাওয়াত। বাবা মারা যাবার পর আর কখনো গরম জিলিপি খাওয়াই হয়নি। আজ যখন তুমি পকেটমারির দিব্যি দিলে তখন মনে হল আজ জিলিপি খাওয়াই যায়।"
আরো খানিক ঘুরে ফিরে টুকিটাকি কটা জিনিষ কিনে আর আরো কটা জিলিপি ঠোঙায় ভরে নিয়ে ঘরে ফিরে পঞ্চা তক্তপোশে বসে বলে উঠল, "আচ্ছা পকেট তো আর মারব না। কিন্তু করব কি? ঘর চলবে কি করে?"
"তুমি আর কোন কাজ জান না?"
পঞ্চা উদাস চোখে, শূন্য হৃদয়ে দেওয়ালের র্যা কে রাখা তার জীবনের প্রথম উপার্জন নস্যির ডিবেটার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, "আমি তো পকেটমারির জন্যিই জীবন উচ্ছুগ্গু করেছিলাম গো। আর কিছু কাজ শেখার কথা কোনোদিন ভাবিইনি!"
পঞ্চার এমন করুণ দশা দেখে যে-কোনও নব্য কবি হাইলি লিখে ফেলতেন, "পকেটে পকেটে ব্লেডের চিহ্ন দিয়ে যাও। শেষে নাও ঝেঁপে এ এ..."
কিন্তু শেফালি তো আর কবি নয়? সে বেশ কিছুক্ষন মাথা নিচু করে কি যেন ভাবল। তারপর বলল, "উমমম তুমি এক কাজ কর। ওই বাজারে যে লেডিস টেলরের দোকান দেখলাম কাল ওখানে গিয়ে কথা বল।"
"সেখানে কথা বলে কি হবে? আমি কি ওদের কাজ জানি?"
"জান গো জান। ওদের থেকেও ভাল জান। মেয়েদের জামা তো। যত কাটবে ততই ফ্যাশনের হবে। দাম বেশি হবে। পকেট কাটার জায়গাতে জামা কেটো।
"বাবাঃ! তোমার এতটুকু মাথায় এত বুদ্ধি আসে কোথা থেকে গো?"
এ কথায় লজ্জা পায় না এমন নতুন বৌ দেশে অমিল। সুতরাং পরবর্তী সিনে শেফালি মাথা নীচু করে বসে আছে আর পঞ্চা তার মুখে গরম জিলিপি গুঁজে দিচ্ছে।