|| ১ ||
মেয়েটাকে বাড়ি থেকে না তাড়িয়ে মণিকঙ্কনা মানবে না, জানতাম। মণি সাংঘাতিক গোঁয়ার। মাথায় একবার কিছু ঢুকলে তা করেই ছাড়বে। কারো কথা শুনবে না। অথচ ওই মেয়েটাকে মণিই উদ্ধার করে এনেছিল। সাধারণত গ্রাম পরিদর্শনে একা একাই যায় মণি। সঙ্গে অবশ্য জিপের ড্রাইভার আর একটা বন্দুকধারী কনস্টেবল থাকে। সেদিন আমিও ছিলাম।
মাঝে মাঝে কলকাতা অসহ্য হয়ে ওঠে। সব ছেড়ে-ছুড়ে চলে আসি। মণি কখনও মানা করেনি। বরং এলে খুশিই হয়। অন্তত আমার তাই মনে হয়। মণিকঙ্কনা এই অঞ্চলের দণ্ডমুণ্ডের একছত্র অধিকারী। ওর বাংলোটা ছবির মত সাজানো, অনেকটা জায়গা নিয়ে। কম্পাউন্ডের মধ্যে ঘাসের লন, কেয়ারী করা বাগান, গাছ-গাছালি, সারভেন্ট কোয়ার্টার। এমনকি এই মহকুমা শহরেও বাংলোর পিছন দিকে একটা তিরতিরে নদী। এখানে এলেই মন ভাল হয়ে যায়। সন্ধেবেলা ফিরে এসে মণিও রাশভারী প্রশাসকের ধরাচুড়ো ছেড়ে খুকুটি হয়ে যায়। কাজের লোকেদের ছুটি দিয়ে দেয়। চায়ের কাপ সেন্টার টেবিলের ওপর নামিয়ে রেখে আদুরে বেড়ালের মত আমার বুকের কাছে গুটিসুটি হয়ে সরে আসে। আমার মনে হয় ও’ও অপেক্ষা করে বসে থাকে। আমার এই বিনা নোটিশে আচমকা চলে আসার দিন গোনে।
এমনই চলে আসছে গত আড়াই তিন বছর। মানে যবে থেকে মণি এই মফস্বল শহরে পোস্টিং নিয়েছে। মুখে না বললেও আমি জানি, মণিকঙ্কনা আমাকে ছেড়ে অন্য কারো সঙ্গে ঘর বাঁধবে না। কিন্তু আমার উপায় নেই। ও সেটা জানে, জোর করে না। মণি আর অদিতির এক সময় গলায় গলায় ভাব ছিল। অদিতির খুব রাগ মণির ওপর, এখনও। আমাকে কেড়ে নেবার জন্যে। অদিতি বোঝে না, একটা মানুষ জিনসের পকেটে রাখা ওয়ালেট নয়। তাকে ভয় দেখিয়ে বা ভুলিয়ে ভালিয়ে কেড়ে নেওয়া যায় না। অদিতিকে বোঝানো আমার কর্ম নয়। সে চেষ্টা করি না। শুধু জানি অদিতি আমাকে ডিভোর্স দেবে না। আজ বলে নয়, কোনোদিনই দেবে না।
প্রথম বার যখন এখানে এসেছিলাম, তখন শীত কাল। বিকেল বিকেল পৌঁছেছিলাম। বাসের ছাদ থেকে হ্যাভারস্যাকটা নামিয়ে পিচ রাস্তার ধারে, লাল মাটির ওপর সরে দাঁড়িয়েছিলাম। বাসটা এগিয়ে যেতেই চোখের সামনে দিগন্ত খুলে গিয়েছিল। আকাশ পর্যন্ত বিস্তৃত ফসল কাটা চাষ-জমি। দূরে হালকা রঙে তুলিতে আঁকা পাহাড়। মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। মণি ইচ্ছে করেই এই পোস্টিংটা নিয়েছিল। কলকাতা ছেড়ে যত দূরে যাওয়া যায়! ভেবেছিল দূরে গেলেই সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে।
বাংলোর দরজা খুলে মণি অবাক হয়ে গিয়েছিল সেদিন। ওকে দেখে মনে হচ্ছিল ও নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। তারপর ঝাঁপিয়ে এসেছিল। অকারণে কেঁদে-কেটে একসা করেছিল। সে রাতটা প্রায় জেগেই ছিলাম দুজনে। কত কথা যে জমা হয়ে ছিল মণির। গল্প আর ফুরোয় না। পরের দিন সকালবেলা ঝকঝকে রোদ উঠেছিল। ব্রেকফাস্ট শেষ করার পর মণি বলেছিল, ‘চল তোমায় আমার রাজ-পাট দেখিয়ে আনি।’
কী যেন নাম ছিল গ্রামটার? শহর ছাড়িয়েই একটা আধা-সরকারি শিল্প-সংস্থার পরিত্যক্ত কঙ্কাল। সরকার রুগ্ন ঘোষণা করার পর কারখানার লোহার গেটে পেটমোটা তালা ঝুলেছে। এদিকে বাউন্ডারি ওয়াল ভেঙে পড়েছে জায়গায় জায়গায়। ফাঁক দিয়ে দেখা যায় অযত্নের ঘাস, ঝোপ-ঝাড়, আগাছা, সাপের খোলস। লোহার ফ্রেম আঁকড়ে বন্য লতা শেডের মাথায় চড়ে বসেছে। মাতাল-চাতাল নেশাখোররাও এ চত্বর মাড়ায় বলে মনে হয় না। অথচ একদিন এখানে দিনরাত হাঁকডাক, মানুষের সোরগোল যাতায়াত ছিল। যে মানুষগুলো এখানে কাজ করত তাদের কী গতি হয়েছে কে জানে? তারাও হয়তো ধ্বংসস্তূপ হয়ে গেছে, জিপে বসে মণি আমায় শোনাতে শোনাতে যাচ্ছিল। এই অঞ্চলে জনসংখ্যার শতকরা আশী ভাগ আদিবাসী। নাম সই করতে পারে এমন মানুষ খোঁজার জন্য অন্তত দু মাইল হাঁটতে হবে। কিছু গ্রামে ইলেক্ট্রিফিকেশান হয়েছে। মাঠের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা কতগুলো আখাম্বা হাই টেনসান টাওয়ার, ঝুলে থাকা ট্রান্সমিশন লাইন তার প্রমাণ। কিন্তু পাওয়ারের পরিস্থিতি শোচনীয়। দিনে সাত আট ঘন্টার বেশি কারেন্ট থাকে না। হেলথ সেন্টার আছে, ডাক্তার নেই। স্কুল আছে, টিচার নেই। অন্যদের কথা ছাড়ো, এদের মধ্যে যারা শহরে গিয়ে পড়াশুনো করেছে, তারাও আসতে চায় না। দু-একটা এনজিও এদের উন্নতি সাধনের যথাসাধ্য চেষ্টা করে। কিন্তু হালে পানি পায় না। তবে আঞ্চলিক রাজনীতি আছে, বুঝে না বুঝে মানুষ ভোট দেয়। পঞ্চায়েত আছে, পঞ্চায়েত প্রধান আছে, সরকারী প্রকল্প আছে। খাতায় কলমে যা যা থাকার কথা, সবই আছে, অথচ প্রায় কিছুই নেই।
গ্রামটায় ঢুকতেই বোঝা গিয়েছিল... খিদে আর দারিদ্রের ছাপ লেগে আছে সর্বত্র। পালিত পশুগুলিও রুগ্ন, হাড় জিরজিরে। দু একটা বোতাম-ছেঁড়া হাফপ্যান্ট পরা বাচ্চা এদিক ওদিক ঘুরছে। তা ছাড়া রাস্তা-ঘাট শুনশান, জনমানবহীন। মণিকঙ্কনাও অবাক হয়েছিল। ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘দয়ারাম, দিন-দুপুরে লোকজন সব গেল কোথায়? কোনো মেলা টেলা লেগেছে নাকি?’
দয়ারাম গাড়ি থামিয়ে একটা পেটে পিলে ঠেলে ওঠা বাচ্চাকে ডেকে সন্ধান নিয়েছিল। বাচ্চাটা মুখে কিছু বলেনি, হাত তুলে দেখিয়ে দিয়েছিল। পিচ রাস্তার থেকে নেমে কাঁচা রাস্তায় জিপ তুলেছিল দয়ারাম। মিনিট পাঁচেকের উবড়-খাবড় পেরিয়ে আমরা একটা খোলা জায়গায় পৌঁছেছিলাম। দূর থেকেই চিৎকার চেঁচামেচি শোনা যাচ্ছিল। কাছে যেতে দেখেছিলাম একটা জমায়েত, মেয়ে-মদ্দ সকলেই ভিড় করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। জিপের শব্দ শুনে লোকগুলো সামান্য সন্ত্রস্ত হয়ে সরে দাঁড়িয়েছিল। ফাঁক দিয়ে দেখেছিলাম একটা অর্ধনগ্ন যুবতী মেয়েকে গাছের গুঁড়িতে পিছমোড়া করে বেঁধে রেখেছে। গাছটা মরা, ফুল পাতা নেই। নয়ানজুলির পাশে একাবোকা দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটার মাথা বুকের ওপর ঝুঁকে পড়েছে। কপাল ফেটে রক্ত পড়ছে, সম্বিৎ নেই।
মণিকঙ্কনা জিপ থেকে নামতেই ভিড়ের মধ্যে বিরুদ্ধতার গুঞ্জন উঠেছিল। মণির সাহস বলিহারি। ভিড় ঠেলে সামনে এগিয়ে গেল। যে হাতগুলো ছোঁড়ার জন্য পাথর তুলেছিল, সেগুলো সাময়িক ভাবে নামল। পঞ্চায়েত প্রধানের কাছ থেকে ব্যাপারটা জানা গেল। সে বেচারা ভিড়ের এক কোণে অসহায় হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। তার কথা কেউ শুনছিল না। মেয়েটার নাম কালোমণি। মেয়েটা ডাইনি। নিজের মরদটাকে তো খেয়েইছে, পরিবারের কাউকেই ছাড়ে নি। গত দু-বছরে এক এক করে শ্বশুর, শাশুড়ি, দেওর সবাইকে মেরে খেয়েছে। এখন গ্রামের অন্যদের দিকে নজর দিয়েছে। গত সপ্তাহে একটা বাচ্চার গাল টিপে আদর করেছিল। আজ সকালে সেই বাচ্চাটা ভেদ-বমি করতে করতে হিক্কা তুলে মরেছে।
মণিকঙ্কনা হাত তুলে থামিয়েছিল সবাইকে। ফিরে যেতে বলেছিল। জনতার মধ্যে অসন্তোষ গুমরোচ্ছিল। এমন একটা আমোদ অর্ধেক ছেড়ে যেতে তাদের মন সরছিল না। জনতার কোন নির্দিষ্ট মুখ থাকে না, বিবেকবোধও না। কুকুরের পালের মত সময় সুযোগ বুঝে শিকারকে কোণঠাসা করে মারে। বুঝতে পারছিলাম অসন্তোষ আস্তে আস্তে আপত্তিতে বদলে যাচ্ছে। নিশ্বাসের নিচে সম্মিলিত অস্থিরতা ফুঁসছিল। খিদের মুখ থেকে শিকার কেড়ে নিলে জানোয়ারেরা যেমন ক্রুদ্ধ হয়, দাঁত বার করে গজরায়, লাফ দেবার সুযোগ খোঁজে। দু এক জন জোয়ান মদ্দ বারণ না শুনে এগিয়ে আসছিল। আমি আর কনস্টেবল ভদ্রলোক মণিকে আড়াল করে দাঁড়িয়েছিলাম। মণি আচমকা কনস্টেবলের হাত থেকে রাইফেলটা টেনে নিয়ে আকাশের দিকে মুখ করে ফায়ার করল। মুহূর্তে ভিড় ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। রাইফেলের গুলি মানুষ মারে, সেই সাধারণ জ্ঞানটা এদের আছে। পাথর ছুঁড়ে মেয়ে খুন করা নিরতিশয় সুখের, সন্দেহ নেই। কিন্তু তার জন্য প্রাণের ঝুঁকি নেওয়াটা তেমন সঙ্গত নয়। সামনের লোক ধাক্কাধাক্কি করে পিছনের দিকে দৌড়োল। দু-একজন বয়স্ক মানুষ মাটিতে পড়ে গেল। অন্যরা নির্দ্বিধায় তাদের পায়ের নিচে মাড়িয়ে গেল।
গোলমালের মধ্যেই মণি গিয়ে মেয়েটার হাতের বাঁধন খুলে দিয়েছিল। মেয়েটা টলে পড়ে যাচ্ছিল। তাকে ধরে ধরে কোনোমতে জিপে এনে বসিয়েছিল। দয়ারামকে বলেছিল তাড়াতাড়ি জিপ স্টার্ট করতে। হ্যান্ড টাওয়েল দিয়ে কপাল, ঠোঁটের কোণের রক্ত মুছিয়ে দিয়েছিল। চলন্ত জিপের মধ্যেই জলের বোতল থেকে আঁজলা ভরে জল নিয়ে চোখে মুখে ছিটিয়ে দিয়েছিল। মেয়েটা চোখ মেলে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়েছিল। মণি জিজ্ঞেস করেছিল, কেমন লাগছে, ঠিক আছিস? মেয়েটা জবাব দিতে পারেনি। তখন মনে হয়েছিল তার বাক-রোধ হয়েছে। সে বিশ্বাস করতে পারছে না অবশ্যম্ভাবী মৃত্যুর হাত থেকে রেহাই পেয়েছে। পরে জেনেছিলাম কালোমণি জন্ম-বোবা। মুখ দিয়ে অস্ফুট কিছু শব্দ করতে পারে শুধু। কথা বলতে পারে না।
|| ২ ||
বাংলোয় ফিরে আসার পর মেয়েটার জ্বর এসেছিল। ধুম জ্বর। ডাক্তার বলেছিল ভয়ের কিছু নেই। তবে হাসপাতালে ভর্তি করে দিলে ভালো হয়। মণি পাঠায়নি। নিজের হাতে শুশ্রূষা করে কালোমণিকে সারিয়ে তুলেছিল। চিকিৎসা এবং আশ্রয় পেয়ে সেরে উঠতে বেশি সময় নেয়নি মেয়েটা। ঘাটে আঘাটায়, রোদে জলে ফন-ফন করে বেড়ে ওঠাই ওদের স্বভাব। জেলাশাসকের বাংলো তো সেই তুলনায় স্বর্গ, মণিকঙ্কনা অধিষ্ঠাত্রী দেবী। বাংলোটা ব্রিটিশ আমলে তৈরি। মোজাইক করা মেঝে, উঁচু ছাত, বারান্দায় কাঠের রেলিং, ছড়িয়ে ছিটিয়ে জায়গার অভাব নেই। কালোমণি তার এক কোণে নিজের জায়গা করে নিল। সার্ভেন্ট কোয়ার্টারে দয়ারাম থাকে তার পরিবার নিয়ে। কালোমণি রাতে ভাঁড়ার ঘরের মেঝেতেই কম্বল পেতে শুত। মণির পুরোন জামা কাপড় পরে দিন-রাত মণির পায়ে পায়ে ঘুরত, ফুট-ফরমাস খাটত। কিছুদিন যেতে না যেতেই মণির জামা কালোমণির শরীরে আঁটো হতে লাগল। দুবেলা ভাত পেয়ে তার চামড়া চকচকে হল, গায়ে গত্তি লাগল। স্বাস্থ্য বসন্তের রক্ত-পলাশের মত ফুটে উঠল। মণি তাকে নতুন জামা কিনে দিল। কালোমণি আহ্লাদে আটখানা। নতুন জামা পরে দয়ারামের বৌকে দেখিয়ে এল।
আমি যখন যেতাম, আমাকেও সেবা যত্ন করত কালোমণি। মণি সকালে অফিসে বেরোলে চা জলখাবার করে দিত। মণি যাবার সময় ওকে বুঝিয়ে দিয়ে যেত। আমি গড়িমসি করে বিছানা ছাড়তাম। ইজেলে লাগানো ক্যানভাসে যখন তুলির আঁচড় দিতাম, তখন কখনও কখনও কালোমণি পিছনে এসে দাঁড়াত। অবাক চোখে দেখত কেমন করে একটা ছবি ফুটে উঠছে।
দেবীর মুখ, নদীর জলে অর্ধেক ভেসে আছে। মুখের আদলটা চেনা মনে হয়, অথচ স্পষ্ট নয়। যেন অতীত স্মৃতির থেকে উঠে আসা। আমার মাকে কি এমন দেখতে ছিল? মা মারা গেছে অনেক ছোটবেলায়, মনে নেই। পুরোন অ্যালবামে মায়ের একটা সাদা-কালো ছবি ছিল। কোথায় আছে অ্যালবামটা? এবার কলকাতায় ফিরে গিয়ে খুঁজে দেখতে হবে। আমার গড়িমসিতে ছবিটা শেষ করতে সময় লাগছিল। যখন কলকাতা ফিরে যেতাম, ধুলো থেকে বাঁচানোর জন্য মণি ওর একটা ওড়না দিয়ে ঢেকে রাখত ছবিটা। আসতাম যখন ওড়নাটা খুলে দিত, যাতে আমার মনে পড়ে যায় ছবিটা সম্পূর্ণ হয়নি।
মণি একবার বলল, ‘মেয়েটা বড্ড গায়ে পড়া।’
আমি একটা বইয়ের মধ্যে মুখ ডুবিয়ে ছিলাম। মণি সবে ফিরেছে। চোখ তুলে বললাম, ‘কার কথা বলছ?’
‘কার আবার? কালোমণির... সব সময় ঘাড়ের ওপর এসে বসে থাকবে।’
অন্যান্য হেল্পিং হ্যান্ডরা সন্ধেবেলা কাজ সেরে যে যার নিজের ঘরে চলে যায়। কিছু দরকার পড়লে দয়ারামের বৌ এসে করে দিয়ে যায়। কালোমণি আসার আগে সেই রাতের খাবার গরম করে টেবিলে সাজিয়ে দিত। এখন সেই ভার কালোমণি নিয়েছে। মণি অফিস থেকে ফিরে হাত মুখ ধুয়ে একটা ঢিলে-ঢালা রাতপোষাক চড়িয়ে লিভিংরুমের সোফায় এসে বসে। এই সময়টা কেবল মাত্র আমাদের। আমরা কৃপণের মত নখে টিপে টিপে সময়টা ভোগ করি। দরকার থাকুক না থাকুক সে সময় কালোমণি এসে আমাদের মুখের দিকে চেয়ে এক পাশটিতে বসে থাকে। যেন তার সমস্ত ইন্দ্রিয় দিয়ে আমাদের অন্তরঙ্গতা শুষে নেয়। বুঝলাম আমাদের সন্ধের প্রাইভেসির ওপর উৎপাত মণির সহ্য হচ্ছে না। হেসে বললাম, ‘তুমি ওকে নতুন জীবন দিয়েছ। তাই তোমায় ছেড়ে যেতে পারে না।’
মণির চোখে বিরক্তি, ‘বললেও শোনে না... কালো, যা তো, নিজের ঘরে গিয়ে বোস।’
নিতান্ত অনিচ্ছায় কালোমণি উঠে গেল। দশ মিনিট যেতে না যেতে কালোমণি ফিরে এল। হাতের ইশারায় জিজ্ঞেস করল, চা করে আনবে কিনা। মণি বলল, ‘না...।’
কালোমণি আর ফিরে গেল না। মণির পায়ের কাছে মেঝের ওপর বসে পড়ল। নির্লজ্জের মত হাঁ করে আমাদের খোসগল্প শুনতে লাগল। দয়ারামের বৌ কমলা এসেছিল কী কাজে। সে বলল, ‘কালো, আমার সঙ্গে চল না একটু, আমার ছেলেটাকে ধরবি, আমি রুটি বানাব।’
কালোমণি গেল না। তার নাকি ভূতের ভয়। সার্ভেন্ট কোয়ার্টার থেকে অন্ধকারে ফিরে আসতে পারবে না।
পরের দিন ফিরে যাব। মণি ছাড়তে চাইছিল না। বলছিল, থেকে যাও আর কটা দিন। এমন নয় যে কলকাতায় দরকারি কাজ পড়ে আছে, না গেলে খুব অসুবিধে। তবু সেই অজুহাতটাই দিলাম। হয়তো সত্যিই কলকাতায় ফিরব না। টাটানগর পৌঁছে ঠিক করব আপ ট্রেন নেব, না ডাউন। আসলে কোনো এক জায়গায় স্থির হয়ে বসা আমার ধাতে নেই। মনে হয় পায়ের নিচে শ্যাওলা জমে উঠছে। হড়হড়ে, ছুঁলে গা ঘিন ঘিন করে। সরে না গেলে ওই শ্যাওলা পা বেয়ে উঠে এসে বুকে চাপ দেবে। অতএব চলো মুসাফির, তোলো লোটা কম্বল। কাল অন্য সরাইখানায়।
সারা জীবন কত যে সরাইখানার বুড়ি ছুঁয়ে গেলাম! সব সরাইখানারই মনে হয় একটা কমন চরিত্র থাকে। সন্ধে হলেই মাঝখানে খোলা চবুতরায় আগুন জ্বলে। আগুনের চারপাশে গোল হয়ে বসে বেদেরা হই-হল্লা করে। মেয়েরা উনুনের ওপর উল্টো কড়াই বসিয়ে রুটি সেঁকে নেয়। যুবতী মেয়েরা নতুন যুবকদের দিকে কটাক্ষে তাকায়। কখনও মেঠো সুরে দু-চার কলি গান গেয়ে ওঠে। আচমকা উটের মাথা ডিঙিয়ে পাঁচিলের ওপর চাঁদ উঠে আসে। পাঁচিলের অন্য দিকে বালু, ছায়ামারীচের বন, ইচ্ছা হয় হেঁটে আসি। যদি ফিরে আসার রাস্তা হারিয়ে ফেলি? জনমানবহীন বালুকা প্রান্তরে কাকে জিজ্ঞেস করব, “নিশানা কী তার? চাঁদ ছিল চাঁদে লেগে।” আচ্ছা, এই লাইনটাই মনে এল কেন? বেদের মেয়েদের চাঁদ-মাখা, চাঁদের মত আধখোলা স্তনের কথা ভেবে? যে বোঝে সে বোঝে। এর মধ্যে যুক্তি নেই, যৌনতা নেই।
বেদেদের সঙ্গে ভাগ করে রসুনের চাটনির টাকনা দিয়ে বাজরার রুটি খাই। আগামী কাল এখান থেকে কোথায় যাব জানি না। আমার কোনও পার্মানেন্ট অ্যাড্রেস নেই। ওহে বড়মিয়াঁ, বলে দেবে নাকি? যুক্তি মুক্তির টানাপোড়েনে ক্লান্ত হয়ে ঘুরতে ঘুরতে আবার কি কোনদিন অদিতির কাছে ফিরে যাব? কে জানে? কলিং বেলের শব্দ শুনে অদিতি এসে আই-পিসে চোখ রাখবে। দরজা খুলে ভিতরে ডাকবে কি? নাকি চৌকাঠ থেকেই বিদায় করে দেবে? ছেলেটা কত বড় হল? অদিতির পা জড়িয়ে চোখ তুলে দেখবে, একজন অচেনা মানুষ। অথচ যেন খুব চেনা লাগে।
|| ৩ ||
সে রাতে তুমুল বৃষ্টি নেমেছিল। শহরতলীর মাঠ-ঘাট রাস্তায়, ঘরের ভিতরেও। ছেড়ে দেবার আশঙ্কা থাকলে মানুষ আরও আঁকড়ে ধরে। অথচ মণি জানে আমি আবার ফিরে আসব। যাবার সময় কোনোবারই বলে যাই না আবার কবে আসব। কিন্তু ফিরে তো আসিই। তবুও প্রতিবার যাবার সময় মণি এমন করে বুকের মধ্যে চেপে ধরে যে দম বন্ধ হয়ে আসে। যেন আর কোনদিন দেখা হবে না। অনেক রাতে ওয়াশরুমে যাব বলে উঠে দেখি ডাইনিং স্পেসের ঢিমে লাইটটা জ্বলছে। খোলা জানলার গ্রীল ধরে দাঁড়িয়ে আছে কালোমণি। বৃষ্টির ছাটে আগাপাশতলা ভিজে যাচ্ছে। জামা কাপড় সপসপে ভিজে, গায়ের সঙ্গে লেপ্টে লেগে আছে। তেল-পাতা চুলের ডগা বেয়ে পিঠের ওপর জল গড়াচ্ছে। আমার পায়ের শব্দ পেয়ে চমকে সরে গেল। আশ্চর্য লাগল এত রাতেও সে ঘুমোতে যায়নি। বৃষ্টি দেখছিল। বৃষ্টিপাতের শব্দ শুনছিল। আমি জানলার পাল্লাটা বন্ধ করে দিলাম। নইলে থইথই জলে মেঝে ভেসে যাবে।
পরের দিনও বৃষ্টি ধরল না। রাস্তা, রেল-ট্র্যাক ডুবে, বাস-ট্রেন বন্ধ হয়ে আমার ফেরা বানচাল হয়ে গেল। বন্যা পরিস্থিতি সরজেমিনে দেখতে মণিকঙ্কনা সকাল সকাল বেরিয়ে গেল। আকাশের মুখ ভার। নকল আলোয় ছবি আঁকতে ইচ্ছে করে না। সারাটা দিন গড়িয়ে গড়িয়ে কেটে গেল। ভাত খাওয়ার পর এক ঘুম দিয়ে উঠে জানলার দিকে চেয়ে দেখলাম মেঘ সরছে। গাছপালার মাথায় মায়াবী আলো ফুটছে। গলা উঁচু করে মণিকে ডাকলাম। সাড়া পেলাম না। তার মানে সে এখনও ফেরেনি। ডাক শুনে কালোমণি চা নিয়ে এল। স্কেচ-বইটা টেনে নিয়ে বললাম, ‘কালো, এক কাজ কর, সামনে এসে দাঁড়া তো, তোর একটা ছবি আঁকি।’
খুব খুশি হল কালোমণি। জানলার পাশে গিয়ে কোমরে হাত দিয়ে, চিবুক তুলে দাঁড়াল। দেখে চমকে উঠলাম। যেন মহেঞ্জোদরোর নারীমূর্তি। জিনকোডের মধ্যে লোল বিভঙ্গ সযত্নে লুকিয়ে রেখেছিল, পাঁচ হাজার বছরের পর এই যাদু বিকেলের আলোয় জানলার পাশে এসে দাঁড়াবে বলে। সেই আদিম নারীর গ্রীবা, খোলা কাঁধ, বুকের ডৌল আঁকার সময় আমার হাত কেঁপে গেল, শরীরে অস্বস্তি উঠে এল। যেন আমি নই, যৌবনের চৌকাঠে পা রাখা তেরো চোদ্দ বছরের নবীন কিশোর। রাজা রবি বর্মার পেন্টিঙ্গের সামনে দাঁড়িয়ে আছি, রগের কাছে দপ দপ... রক্তে রিমঝিম উত্তেজনা।
তুলনাটা সম্ভবত ভুল হল। কালোমণির সঙ্গে রাজা রবি বর্মার পেন্টিঙ্গের নারীদের সাদৃশ্যর থেকে বৈসাদৃশ্যই বেশি। রাজার নারীরা যদি দাঁড়ের পাখি হয় সে বরং বেদিনীর ঝুড়ির থেকে ফণা তোলা হিলহিলে কালসাপ, অল্প অল্প দুলছে, ছোবল দেবে। কালোমণির ছোবলে কি বিষ আছে? মণিকঙ্কনা জানতে পারলে বলবে, ‘কালো, মুখ খোল তোর বিষদাঁত ভেঙে দেব।’
নিজের ওপর বিরক্ত হয়ে স্কেচবুকটা সরিয়ে রাখলাম। কালোমণিকে বললাম, ‘যাঃ! পালা আজ। পরে... অন্য কোন সময়...।’
কালোমণি গেল না। বিছানায় বসে স্কেচ করছিলাম। আমার পিছনে এসে কাঁধের ওপর দিয়ে স্কেচ বুকের খোলা পাতায় চোখ রাখল। আমার পিঠে কালোমণির নিঃশ্বাসের ভাপ লাগল। শরীরের ভাঁজ থেকে উঠে আসা সোঁদা গন্ধে আমার নাক জ্বালা করে উঠল। যখন জানলার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল মনে হচ্ছিল পাথরে কোঁদা। ছুঁয়ে দেখলাম পাথর নয়, কালোমণির মৃত্তিকা শরীর, বর্ষার জল পেয়ে নম্র।
সেদিন সন্ধেবেলা খোঁজ নিলাম, বাস চালু হয়ে গেছে। ওভার নাইট জার্নি করে কলকাতা ফিরে এলাম। মণি একটু অবাক হল, আমার তাড়াহুড়ো দেখে। কিন্তু কিছু বলল না। জানত যে কলকাতায় আমায় জরুরী কাজ আছে। ফিরে এসে পুরনো অ্যালবাম খুঁজে বার করলাম। দেখলাম আমার ছোটবেলায় মরে যাওয়া মায়ের মুখের সঙ্গে জলে ভেসে থাকা দেবী মুর্তির মুখের কোনো মিল নেই।
|| ৪ ||
পরের বার গিয়ে দেখলাম মণিকঙ্কনার মুখ থমথম করছে। চোখে আষাঢ়ের ঘন বাদল। কী হয়েছে জিজ্ঞেস করাতে বলল, কালোমণিকে নিয়ে হাজারো সমস্যা হচ্ছে। কালোমণি কেবলই দয়ারামের ছেলেমেয়েকে টানে। সেটা দয়ারামের বৌয়ের পছন্দ নয়। প্রথম প্রথম কিছু বলেনি। এখন পাড়ার বৌ-ঝিরা তাকে পরামর্শ দিয়েছে ছেলেমেয়েকে কালোমণির নজরের আড়াল করে রাখতে। কালো বোঝে না, বারণ শোনে না। ছেলে মেয়ে দুটোর সঙ্গে যখন-তখন খেলা করে। বাচ্চা দুটোও তাকে ছাড়তে চায় না।
তারপর সে নাকি বাংলোর পিছনে কাঠ চাঁপা গাছের গোড়ায় মন্ত্রপূত ঘট পেতেছে। দুপুরবেলা তার সামনে উবু হয়ে বসে নিঃশব্দে কী সব বিড়বিড় করে। শওকত মালি দেখেছে, শব্দ হয় না কিন্তু তার ঠোঁট নড়ে। হাওয়া নেই, গাছের একটা পাতা নড়ছে না, তবু হঠাৎ ওপর থেকে টুপ-টুপ করে দুটো ফুল খসে পড়ে। দয়ারামের বৌ ফিস ফিস করে মণিকে বলে, “কালো অনেক তুক তাক, বশীকরণ জানে গো দিদি। ছেলে মেয়ে নিয়ে ঘর করি, ভয় লাগে। ওই ডানকে তুমি তাড়াও।’
বললাম, ‘পাত্তা দিও না। প্রোফেশনাল রাইভ্যালরি... দয়ারামের বৌ ইনসিকিউরিটিতে ভুগছে।’
কথাটা মজা করেই বলেছিলাম। মণির গায়ে লেগে গেল। মুখ কালো করে বলল, ‘কমলা অমন মেয়ে নয়। মিছিমিছি কেন বলবে? নিশ্চয়ই কিছু দেখেছে...।’
আমি সন্দিগ্ধ হয়ে বললাম, ‘মণি, তুমিও এসবে বিশ্বাস করতে শুরু করলে নাকি?’
মণি মাথা নাড়ল। কিন্তু ওর কপাল থেকে ভ্রূকুটির ভাঁজ গেল না। বলল, ইদানীং কালোমণি সত্যিই একটু অদ্ভুত বিহেভ করছে। বাংলোর পিছনে আদাড়ে বাদাড়ে ঘুরে কী সব শেকড় বাকড় তুলে নিয়ে আসে। শিলে বেটে খায়। দু-একবার বমিও করেছে ওই সব হাবিজাবি খেয়ে। জিজ্ঞেস করলে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। আকারে ইঙ্গিতেও জবাব দেয় না।
কথা বলার সময় কালোমণি এসে দাঁড়িয়েছিল। যেমন তার স্বভাব। দেখলাম তার ঠোঁটের গাঢ় রঙ সরে গিয়ে চোখের নিচে জমা হয়েছে। ক’দিন চুলে তেল দেয়নি, কে জানে? উস্কো-খুস্কো চুল কোনমতে একটা লাল ফিতে দিয়ে বাঁধা। মণি তাকে দেখে বলল, ‘যা তো কালো, দাদার জন্য এক কাপ চা করে নিয়ে আয়।’
কালোমণি শ্লথ গতিতে সরে গেল। তার চলা ফেরার ছন্দেও একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম। পুজো ছুঁই-ছুঁই বর্ষার মেঘের মত। যাবার ইচ্ছে নেই, অথচ নিজেকে জোর করে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। মণিকাঞ্চনা চোখে সন্দেহ নিয়ে কালোমণির চলে যাওয়া দেখছিল। বলল, ‘ভাবছি, কালোমণিকে ওর গ্রামেই ফিরে যেতে বলব।’
আমি চমকে উঠলাম, ‘সে কী? ওরা তো ওকে মেরে ফেলবে।’
মণি নিস্পৃহ গলায় বলল, ‘আমি আর কতদিন ওকে রক্ষা করব। আমার যখন ট্রান্সফার হয়ে যাবে, তখন ও কোথায় যাবে? আমি ওদের গ্রামের পঞ্চায়েত প্রধানের সঙ্গে কথা বলেছি। সে গ্রামের লোকেদের বোঝাবে যাতে ওর গায়ে কেউ হাত না দেয়। না বুঝলে, দলের লোক ডাকবে, পুলিশে খবর দেবে। জঙ্গলের জানোয়ার আহত হলে তার শুশ্রূষা করে আবার জঙ্গলেই ছেড়ে দিয়ে আসতে হয়।’
আমি আহত গলায় বললাম, ‘ও কি জানোয়ার?’
মণি মুখ ফিরিয়ে নিল। কথার জবাব দিল না। বুঝলাম, কালোমণিকে বাড়ি থেকে না তাড়িয়ে মণিকঙ্কনা মানবে না। সে একবার যা স্থির করে তার নড়চড় হয় না। কালোমণি চা নিয়ে এল। মণি এক চুমুক দিয়ে তীক্ষ্ণ গলায় বলল, ‘চায়ে চিনি দিসনি। মন কোথায় পড়ে থাকে? সব কাজে ভুল করিস!’
অন্য সময় হলে কালোমণি জিভ কেটে লঘু পায়ে ছুটত, কিচেন থেকে চিনির কৌটো আর চামচ আনার জন্য। আজ চায়ে চিনি দিতে ভুলে যাবার এবং যাবতীয় অন্য দোষ ঘাড়ে নিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। যেন জানে না ঠিক কী করা উচিত। কী করলে মণির মন পাবে। তাকে দেখে মনে হল মণির কথাই ঠিক, সে সত্যিই কোন জানোয়ার... গর্ভিনী শিঙ্গাল। জানে বিপদ, ঝোপের আড়ালে চিতা এগোচ্ছে, গুঁড়ি মেরে। কিন্তু দৌড়ে পালাবার জন্য যে পরিশ্রম করার দরকার, তার সাধ্য নেই।
জিজ্ঞেস করলাম, ‘ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিলে?’
মণি বলল, ‘কী দরকার? দেখেই তো বোঝা যাচ্ছে...।’
‘এই অবস্থায় বার করে দেবে?’
মণিকঙ্কনা ফুঁসে উঠল, ‘ওর এই অবস্থার জন্য কি আমি দায়ী? কার না কার বাচ্চা...। পেটে ছেলে নিতে পারে, আর নিজের দেখাশুনো নিজে করতে পারে না?’
‘ওকে জিজ্ঞেস করনি?’
‘করেছিলাম, কিছু বলে না।’
‘আন্দাজ করতে পারো না?’
‘শওকতের সঙ্গে ক’দিন খুব ঢলাঢলি করছিল...।’
‘শওকতকে ডেকে জিজ্ঞেস করতে পারতে।’
‘করেছিলাম। জিজ্ঞাসাবাদ করার পরের দিন থেকেই সে বেপাত্তা।’
কারো কথা শুনল না মণি। পরের দিনই দয়রামকে ডেকে বলল, কালোমণিকে গ্রামে ছেড়ে দিয়ে আসতে। কালোমণি যেন জানত, কোনো আপত্তি করল না। চোখের জল ফেলতে ফেলতে জিপে উঠল। দয়ারামের বৌ আঁচলে চোখ মুছল। যতই যাই হোক, মেয়েটার ওপর মায়া পড়ে গিয়েছিল সবারই। মণি মুখ ফিরিয়ে রইল। দুদিন পরে শওকত ফিরে এল। তার বাবা বাথরুমে পড়ে গিয়ে মাথায় চোট পেয়ে হাসপাতালে এডমিট হয়েছিল। ঘর থেকে জরুরী তলব পেয়ে সে মুর্শিদাবাদ চলে গিয়েছিল। যাবার সময় তাড়াহুড়োয় জানিয়ে যেতে পারেনি।
সপ্তাহ ঘুরতে না ঘুরতেই দয়ারাম খবরটা আনল। গ্রামের লোকেরা কালোমণির ঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে। সদর দরজার শেকল তোলা ছিল বাইরে থেকে। ঘরের সঙ্গে সঙ্গে অজাত সন্তান সমেত কালোমণিও পুড়ে মরেছে। কেউ পুলিশে খবর করেনি। দয়ারাম জানতে পেরেছে হেঁড়্যার ঠেকে। আকন্ঠ মদ গিলে এক ছোকরা চোখের জল সামলাতে পারেনি। বেফাঁস বলে ফেলেছিল, মেয়্যাটাকে পুড়াই মারে ফেইল্ল গ! হোক না বোবা ডাইনি, উদ্ভিন্ন-যৌবনা মেয়ে তো। বেঁচে থাকলে একরকম, মরে গেলে জোয়ান ছেলেদের বুক ফাটবে না? যেদিন খবরটা এল, সে রাত্তিরে অফিস থেকে ফিরে মণি কিছু খেল না। পাথরের মত মুখ করে লিভিং রুমের সোফায় বসে রইল। রাত বাড়লে ওর পাশে গিয়ে বসলাম, ‘শোবে না? মন খারাপ করে কতক্ষণ এইভাবে বসে থাকবে?’
মণি আমার হাত চেপে ধরল জোরে। তার আঙুলের নখ আমার হাতের চামড়া কেটে বসে যাচ্ছে। আঃ! মণি, ছাড়ো, লাগছে। মণি আমার হাত ছাড়ল না। বিকৃত স্বরে বলল, ‘বেশ হয়েছে! ডাইনিটা মরেছে...।’