• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৬৮ | সেপ্টেম্বর ২০১৭ | গল্প
    Share
  • উত্তরবাহিনী : সুবীর বোস


    ফিসের কাজে ভাগলপুর যাবার তাড়া ছিল। ট্রেন রাত দশটায় — জামালপুর এক্সপ্রেস। ফলে বিকেল থেকেই জিনিসপত্র গোছানোর কাজ চলছিল। আর ওই “গোছানো” সারতে গিয়ে আমার সেল ফোনটা হঠাৎ করেই বুক পকেট থেকে একদম বালতির জলে পড়ে ডুব সাঁতার কাটা শুরু করল। তাড়াতাড়ি সে ফোনকে তোয়ালে দিয়ে মাথা-শরীর মুছিয়ে দেবার পর দেখি, ফোন এবং সীম দু’টোই কোমায় চলে গেছে।

    “প্রায়” প্রত্যেকবারই “ফেরিওয়ালা” আমি অফিসের কাজে বেরনোর আগে কিছু না কিছু একটা ঘটিয়ে ফেলি। একবার চেন্নাই যাবার আগে খেয়াল করি মাল-পত্রে ঠাসা আমার সুটকেসের নাম্বার লক আমি ভুলে গেছি। সেদিন আমার বউ সন্ধ্যা উদ্ধার করে আমায় এবং সত্যজিৎ রায়ের “ত্রিনয়ন ও ত্রিনয়ন একটু দাঁড়া” পড়ে উদ্বুদ্ধ সে আমাকে ৮০৯ নাম্বারটা মনে রাখার জন্য শিখিয়ে দেয় “আওনা” মন্ত্র। মন্ত্রটা শিখে পুলকিত আমি সেদিন বেরনোর আগে “সন্ধ্যা” নামক তালাটিকে খোলার জন্যেও আবেগ ভরে একই মন্ত্র উচ্চারণ করেছিলাম, আওনা...। উল্টোদিক থেকে তখন যথারীতি প্রশ্রয়ী অস্ফুট উচ্চারণে, খুব অসভ্য...ইত্যাদি...।

    এমনকি হনিমুনেও আমি হাল্কা “কেলো” করেছিলাম। সেবার হনিমুনে পুরীতে গিয়ে খেয়াল করলাম, আমার টুথব্রাশ নিতে ভুলে গেছি। সেদিনও সন্ধ্যা ব্যাপারটাকে একটা অন্য মাত্রা দিয়েছিল ওর রসবোধ দিয়ে। সেদিনের “নতুন বউ” সন্ধ্যা ঠোঁটে একটা আলগা হাসি ছড়িয়ে দিয়ে বলেছিল, আমি জানি, তুমি ইচ্ছে করেই টুথব্রাশটা আনোনি। তাই না? সন্ধ্যার কথা শুনে তাজ্জব আমি বলেছিলাম, তার মানে?

    — মানে আমাকে তুমি কতটা ভালোবাসো সেটা বোঝানোর জন্যেই টুথব্রাশটা আনোনি।

    — আরেকটু প্রাঞ্জল হলে ভালো হয় ম্যাডাম।

    — দেখ, আমরা এক টুথব্রাশে দু’জনেই দাঁত মাজব, একই ওষুধ দু’জনে ভাগ করে খাব — তবেই না ভালোবাসা। আমি জানি তুমি সে জন্যেই একটা টুথব্রাশ...

    সন্ধ্যার কথা শেষ হবার আগেই আমি সেদিন হো হো করে হেসে উঠেছিলাম।

    বর্তমানে ফিরি। মোবাইলটার অমন কোমায় চলে যাওয়া দেখে মেজাজটা একদম খিঁচড়ে গেল। অফিসের গুরুত্বপূর্ণ কাজ নিয়ে যাচ্ছি ভাগলপুর আর এ সময়ে কিনা এমন একটা ঝঞ্ঝাট...! হঠাৎ করে আগত এ সমস্যা আমার বিরক্ত ভুরু-জোড়াকে সম্ভবত নিচে নামতে দিচ্ছিল না — সেটা দেখেই কিনা জানি না, সন্ধ্যা বলল, তুমি বরং আমার ফোনটা নিয়ে যাও। মোটে তো তিন দিনের ব্যাপার। সন্ধ্যার প্রস্তাবটাই সে মুহূর্তে আমার একমাত্র পথ জেনেও বললাম, কিন্তু...

    — কোনো কিন্তু নয়।

    — না, মানে তোমার ফোন...

    — আরে আমার তেমন ফোন আসে কই? এ ছাড়া ল্যান্ডফোন তো রইলই। সন্ধ্যা আমাকে নিশ্চিন্ত করে।

    তো সন্ধ্যার ফোন হাতে রাত সাড়ে ন’টার মধ্যে হাওড়া স্টেশনে পৌঁছে দেখি জামালপুর এক্সপ্রেস ততক্ষণে স্টেশনে পজিশন নিয়ে নিয়েছে। ট্রেনে নিজের জায়গা খুঁজে নিয়ে সবে একটু থিতু হয়ে বসেছি — শব্দ করে একটা এস.এম.এস. এল। বসের এস.এম.এস. এল কিনা ভাবতে গিয়ে মনে পড়ল যে ফোনটি আমার বউয়ের এবং আমার বস এ ক্ষেত্রে নিতান্তই অবশ।

    দেখলাম, ছোট্ট এস.এম.এস., রাতে আসছি, আমার জন্য খাবার রেখো। লক্ষ্য করলাম এস.এম.এস.টা এসেছে একটা আনসেভড নাম্বার থেকে। তার মানে প্রেরক আমার তো নয়ই, সম্ভবত আমার বউয়েরও পরিচিত কেউ নয়। তার মানে ভুল করে কেউ এই নাম্বারে এস.এম.এস.টা পাঠিয়েছে। বেশ হাসি পেল। মনে হল, বেচারা বাড়ি ফিরে হয়ত খাবার পাবে না এবং এ ক্ষেত্রে বাড়িতে একটা ছোট-খাট অশান্তি অনিবার্য।

    তবে ভিতরে ভিতরে একটু যে খচখচ করছিল না, সেটা বললে মিথ্যে বলা হবে। আসলে আমরা পুরুষেরা অন্যের বউয়ের সঙ্গে হালকা হাসি-ঠাট্টা, গল্প-গুজব থেকে সুযোগ পেলে আরও একটু গভীরে যাওয়া — এগুলো খুব পছন্দ করি। কিন্তু নিজের বউয়ের বেলা...ওটি হবার নয়। তবু যেই মনে পড়ল আজ বেরনোর আগেও আমার শরীরে সন্ধ্যার ডালপালা বেয়ে আবেগী নেমে আসার কথা, আমার ভিতরের খচখচানি অনেকটাই দূর হয়ে গেল। এ’সব ভাবতে ভাবতেই একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম। সম্বিৎ ফিরল ট্রেনের ঝাঁকুনিতে। জামালপুর এক্সপ্রেস হাঁটতে শুরু করেছে, এরপর দৌড়বে।

    আমি ব্যস্ত ফেরিওয়ালা। নিজের কাজে এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত দৌড়তে দৌড়তেই বছর দুয়েক আগে সন্ধ্যার সঙ্গে আমার ঘর বেঁধে ফেলা। তারপর থেকে এত ব্যস্ততা, এত দৌড়াদৌড়ির মধ্যেও আমাদের সংসারের সুখী মলাটটা, কোনো সন্দেহ নেই আসলে সন্ধ্যারই দান। আমাকে প্রায়শই অফিসের কাজে দেশের এ মাথা থেকে ও মাথা দৌড়ে বেড়াতে হয়। সে সময় ঘর-বার দু’টোই খুব নিপুণভাবে সামলায় সন্ধ্যা।

    তবু কেন জানি না “নিপাত যাক” এস.এম.এস. বলতে পারলাম না। ট্রেনের ঝাঁকুনিতে চোখটা লেগে আসার মুখে হঠাৎ মনে হল, এস.এম.এস. এর মালিককে একটা ফোন লাগালে কেমন হয়। লাগালাম। প্রবল ঘড়ঘড় শব্দের মধ্যে উলটো দিক দেখে এক পুরুষ কন্ঠ জানিয়ে দিল, কিছু শুনতে পাচ্ছি না, বাসে আছি, কিছুক্ষণ পর ফোন করলে ভালো হয়।

    এবার একটু যেন ঘেঁটে গেলাম। কারণ উলটো দিক থেকে যে কথা বলল, তার কথা শুনে বুঝতেই পারলাম না যে, সন্ধ্যার মোবাইল নম্বরটা তার অপরিচিত কিনা। “দূর ছাই” বলতে গিয়েই মনে পড়ল তালেগোলে সন্ধ্যাকে ফোন করা হয়নি। ঘড়িতে দেখলাম, রাত প্রায় সাড়ে-দশটা বাজে। এতক্ষণে সন্ধ্যার শুয়ে পড়ার কথা। ফোন লাগালাম এবং ও দিক থেকে সন্ধ্যার দাবড়ানি শুরু হল, এতক্ষণে তোমার সময় হল ফোন করার?

    — ইয়ে, ট্রেনে উঠে গোছগাছ করতে গিয়ে...। আমি আমতা আমতা করি।

    — তোমার ওই গোল-গোল অজুহাত বন্ধ কর। সে যাক, কাল সকালে পৌঁছেই ফোন করবে কিন্তু।

    — হ্যাঁ, হ্যাঁ, এবার আর ভুল হবে না। একটা মজা হয়েছে জানো...

    — মজা?

    — হ্যাঁ মজা। একটা এস.এম.এস. এসেছে। এস.এম.এস. প্রেরক লিখেছে, রাতে আসছি, আমার জন্যে খাবার রেখ।

    — তোমার তো কাণ্ড। দেখ আবার কা’কে সময় দিয়ে রেখেছ। সন্ধ্যা মজা করে বলে।

    — ম্যাডাম, এ’টা কিন্তু তোমার ফোন। আমিও মজা করে বললাম।

    এরপর ও’দিকে কিছুক্ষণ সব চুপচাপ। ভাবলাম, লাইনটা বোধহয় কেটে গেছে। তাই দু’তিনবার বেশ জোরে জোরে হ্যালো, হ্যালো করতেই শুনলাম সন্ধ্যা খুব গম্ভীরভাবে বলছে, হুম্‌ম্‌, তাহলে বোধহয় কোনো টেলিপ্রেমিকের এস.এম.এস. ওটা। সন্ধ্যার কথা শেষ হওয়া মাত্র আমরা দু’জনেই এক সঙ্গে হেসে উঠলাম। আমার এক সহযাত্রী, যে আমার উল্টোদিকের লোয়ার বার্থে চাদর মুড়ি দেবার চেষ্টা করছিল, আমার আচমকা হাসিতে দেখলাম সে এক অদ্ভুত দৃষ্টিতে আমাকে একবার মেপে নিয়ে পাশ ফিরল।

    এরপর ট্রেনের দুলুনিতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়লাম। সে রাতে ছেঁড়া ছেঁড়া কিছু স্বপ্নের মধ্যে কেন জানি না মাঝে মাঝে উঁকি দিয়ে গেল এস.এম.এস.টা। ট্রেন বেশ লেট ছিল, ফলে ভাগলপুর পৌঁছতে প্রায় দশটা বেজে গেল। ষ্টেশনের খুব কাছের একটা মোটামুটি ভালো হোটেলে চেক-ইন করে সন্ধ্যাকে ফোন করে পৌছ (পৌঁছনোর??) সংবাদটা দিয়ে দিলাম। এরপর দ্রুত তৈরি হয়ে হোটেল থেকেই একটা গাড়ি ভাড়া করে বেরিয়ে পড়লাম নিজের কাজে। আগের রাতে হঠাৎ করে উদয় হওয়া “খচখচানি”টা ততক্ষণে অনেকটাই যুক্তিগ্রাহ্য বাতাবরণ খুঁজে পেয়ে মাথা থেকে উড়ে গেছে।

    ভাগলপুরের খাবার ভালো, জল আরও ভালো। কিন্তু রাস্তাঘাট এতটাই খারাপ যে এক বেলার ভ্রমণেই গায়ে-গতরে ব্যাপক ব্যথা হয়ে গেল। তো সেই গায়ে-গতরে ব্যথা নিয়েই সন্ধ্যা নাগাদ এখানকার সুলতানগঞ্জ ব্লকের বিডিওর মুখোমুখি হওয়া গেল। এ কথা, সে কথার পর অমায়িক সেই বিডিও ভদ্রলোক বললেন, জানেন তো সারা দেশে একমাত্র এখানেই গঙ্গা উত্তরবাহিনী। যাবেন নাকি দেখতে?

    সত্যি কথা বলতে কী, গঙ্গা নদী যে সারা দেশে দক্ষিণবাহিনী, আমার সেটাও জানা ছিল না। কিন্তু বিডিও সাহেবের কথা শুনে মনে হল, উত্তরবাহিনী গঙ্গা নিশ্চয়ই বেশ একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। তখন বেশ অন্ধকার হয়ে গেছে, তার উপর ওখানকার রাস্তা-ঘাট কিছুই চিনি না। কী উত্তর দেব ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। বিডিও সাহেব সম্ভবত পড়তে পেরেছিলেন আমার মনের কথাগুলো। তিনি তাঁর দেহরক্ষীকে বললেন, দীপক, অনিকেতবাবুকে একটু মন্দির ঘুরিয়ে আনো।

    — কিন্তু স্যর, মন্দির তো এখন বন্ধ হয়ে গেছে। দেহরক্ষীর বিনীত উত্তর।

    — পূজারীজিকে বোলো যে, অনিকেতবাবু আমার মেহমান।

    — জী সাব।

    বিডিও সাহেবের অফিস থেকে গাড়ি নিয়ে মন্দির পৌঁছতে সময় লাগল মিনিট সাতেক। চাঁদের আলো, হাল্কা ঠাণ্ডা হাওয়া সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছিল ভিতরে ভিতরে। আধো-অন্ধকার অনেকগুলো সিঁড়ি ভেঙে পৌঁছে গেলাম মূল মন্দিরের দোরগোড়ায়। সেখান থেকেই পাশে পড়ে থাকা এক ফালি ছাদ থেকে দেখে নেওয়া গেল উত্তরবাহিনী গঙ্গা। দেখলাম বেশ খানিকটা দূরে গঙ্গা নদী একটা বাঁক নিয়েছে এবং সে বাঁক উত্তরমুখী। ওই বাঁকের জন্যেই এই মন্দির, ওই বাঁকের জন্যেই প্রতিদিন অগণিত মানুষ-জন এখানে আসেন পুণ্যের আশায়।

    আমি তখন অন্য এক বাঁকে। হ্যাঁ, সরকারী অফিসারের বদান্যতায় রাতের বেলাতেও খোলা হল মন্দিরের দরজা। সরকারী অফিসারের মেহমান বলে কথা! মন্দিরের ভিতরে দেখলাম আলোর কোনো ব্যবস্থা নেই ফলে মন্দিরের একজন কর্মচারি মোমবাতি জ্বেলে আমাকে ঘুরিয়ে দেখালেন সব কিছু। আলো-আধারির মধ্যে ছায়া ঘেরা মূর্তি, এখানে-ওখানে সিঁদুরের দাগ — সব মিলিয়ে বেশ একটা গা ছমছমে বাতাবরণ।

    একদম শেষে আমার জন্য একটা চমক ছিল। পুরো মন্দিরটা ঘুরে দেখার পর শেষ যে ঘরে ঢুকলাম, সেটা আসলে ওই মন্দিরের মোহান্তবাবার ঘর। কী আশ্চর্য, ওই ঘরে কিন্তু আলো, পাখা সবই চালু। সৌজন্য আধুনিক ব্যাটারি।

    — কাহা সে আয়ে হো বেটা? আমাকে দেখে দশ আঙুলে এগারটা আংটি পরা মোহান্তবাবার প্রথম প্রশ্ন।

    — কলকাত্তা। আমি এক শব্দেই উত্তর সারলাম।

    পরবর্তী আধ ঘন্টায় মোহান্তবাবা আমাকে মিষ্টি খাওয়ালেন, চা খাওয়ালেন এবং আমাকে বিধ্বস্ত করলেন দীর্ঘ ধর্মালোচনায়। আমি ব্যাজার মুখে সে সব হজম করে বিদায় নেবার সময় মোহান্তবাবা আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন, বেটা, তোর সময়টা মনে হচ্ছে ঠিক ভালো যাচ্ছে না। কথাটা শুনেই আমি কেন জানি না কেঁপে উঠলাম এবং আমার ফের মনে পড়ল আগের রাতের এস.এম.এস.টার কথা। জানি না মোহন্তবাবার শেষ বাক্যই আমাকে উত্তরবাহিনী গঙ্গার সামনে এক অন্যতর প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিল কিনা।

    সুলতানগঞ্জের ভাঙাচোরা রাস্তা ধরে গাড়িতে লাফিয়ে লাফিয়ে ফেরার পথে সময় নষ্ট না করে ফোন করলাম বাড়িতে। দীর্ঘ সময় রিং হয়ে গেল একটানা, কেউ ধরল না। হঠাৎ যেন একটু শীত-শীত করতে লাগল। আরও বার তিনেক বাড়িতে ফোন লাগালাম। ফলাফল একই। কেউ নেই অন্যদিকে। ঘড়িতে সময় দেখলাম রাত সাড়ে ন’টা। অনেক ভেবেও বুঝতে পারছিলাম না এত রাতে সন্ধ্যা কোথায় যেতে পারে।

    এ সময়ই হঠাৎ মনে হল, আগের রাতের এস.এম.এস.-এর প্রেরককে ফোন করলে কেমন হয়। দুরুদুরু ফোন লাগালাম সে নাম্বারে। উল্টোদিক থেকে এক পুরুষ কন্ঠ বলল, হ্যালো। অনুভব করলাম, হঠাৎ করেই আমার শরীরে শীত বেশ জাঁকিয়ে বসেছে। সে অবস্থাতেই বললাম, মানে, ইয়ে, কাল রাতে আপনার মোবাইল থেকে আমার নাম্বারে একটা এস.এম.এস. এসেছিল।

    — আমি নিশ্চয়ই এস.এম.এস. পাঠিয়েছিলাম তাই আপনি পেয়েছেন। উল্টোদিকের জনের নির্বিকার উত্তর।

    — আপনি ঠিক কাকে এস.এম.এস.টা পাঠিয়েছিলেন?

    — এই তো বললেন, এস.এম.এস.টা আপনি পেয়েছেন। তার মানে আপনাকেই পাঠিয়েছিলাম।

    — আমাকে পাঠিয়েছিলেন? আপনি কি আমাকে চেনেন?

    — নিশ্চয়ই চিনি, নইলে খামোখা আপনাকে এস.এম.এস. পাঠাতে যাব কেন? আচ্ছা, কী এস.এম.এস. পাঠিয়েছিলাম বলুন তো?

    বুঝতে পারছিলাম না পাগলের পাল্লায় পড়েছি নাকি বদমাশের। তবু মাথা ঠাণ্ডা রেখে বললাম, আপনি লিখেছেন, রাতে আসছি, আমার জন্য খাবার রেখ।

    — তা, রেখেছিলেন খাবার আপনি?

    — মানে?

    — মানে আবার কী? আগে তো বলুন যে আপনি খাবার রেখেছিলেন কিনা...

    বিরক্তিতে আমি ফোনের লাইন কেটে দিয়ে ফের ফোন লাগাই বাড়ির ল্যান্ডলাইনে। কেউ ধরল না।

    হোটেলে ফিরে খাবারের অর্ডার দিতেই হল। কারণ এরপর বেশি রাত হয়ে গেলে হোটেল আর অর্ডার নেবে না। খেতে গিয়ে বুঝতে পারছিলাম সব খাবারই কেমন যেন বিস্বাদ ঠেকছে। রাত এগারটা নাগাদ ফের ফোন করলাম বাড়িতে। রিং হয়ে গেল একটানা। অন্য প্রান্তে কেউ নেই। ততক্ষণে হোটেলের সাদা ধবধবে চাদরটা আমার চোখের সামনে কেমন যেন হলদেটে হয়ে যাওয়া শুরু হয়েছে। সাড়ে এগারটা নাগাদ ফের চেষ্টা। এবারেও একটানা রিং...। এরপর ঘন্টা তিনেক ঘুমোনোর প্রাণান্তকর চেষ্টার পর এক সময় সত্যিই ঘুমিয়ে পড়লাম।

    সকালে উঠেই ফোন লাগালাম বাড়িতে। কী আশ্চর্য, ও প্রান্তে সন্ধ্যার গলা এবং দাবড়ানি, কাল পৌঁছে একটা ফোন করলে আর তোমার দায়িত্ব শেষ হয়ে গেল? সারাদিনে আর একটাও ফোন করার সময় পেলে না তুমি? আমি এদিকে চিন্তায় মরি। তোমরা সব পুরুষরাই এক... একবার বাড়ি থেকে বেরতে পারলে...

    — কাল সন্ধ্যা থেকে অনেকবার ফোন করেছি, কিন্তু কেউ ফোন ধরেনি। তুমি কোথায় গিয়েছিলে? আমি গলা যথাসম্ভব গম্ভীর করে কথাগুলো বলি।

    — তুমি ফোন করেছিলে?

    — হ্যাঁ, অনেকবার ফোন করেছি আমি।

    এরপর উল্টোদিকে কিছুক্ষণ সব চুপচাপ। তারপর ফের সন্ধ্যার গলা শোনা গেল —

    — ও হো তবে বোধহয় ফোনটা ডেড হয়ে গিয়েছিল।

    — কখন ঠিক হল ফোন? আমি গাম্ভীর্য বজায় রেখেই বলি কথাগুলো।

    — সেটা আমিও ঠিক জানি না। আসলে তোমার ফোন পেয়ে বুঝতে পারছি যে উনি ঠিক হয়েছেন। সে যাক, খাওয়া, ঘুম সব ঠিকঠাক চলছে তো? সন্ধ্যার গলায় একটু চপলতা টের পাওয়া যায়।

    সন্ধ্যার কথা বলার ভঙ্গিতে আমিও সে মুহূর্তে সব ভুলে বলে ফেলি, ও পাড়ায় ঢাক, এ পাড়ায় কাঠি — কী করে সব ঠিকঠাক চলবে বল?

    — এই শুরু হল তোমার অসভ্যতা। সন্ধ্যার প্রশ্রয়ী গলা।

    — দাঁড়াও, ফিরতে দাও আমাকে...তারপর...

    — তুমি কাল সকালেই ফিরছ তো?

    — হ্যাঁ, কাল ভোরবেলা ফিরছি। তুমি সাবধানে থেকো।

    সন্ধ্যার সঙ্গে কথা বলে মেজাজটা বেশ ফুরফুরে হয়ে গেল। এবার যেতে হবে বাঁকা জেলায়। বাঁকা জেলায় ঢোকার আগে পর্যন্ত রাস্তার হাল দেখলাম বেশ খারাপ, যদিও মূল বাঁকা জেলার রাস্তাঘাট দেখলাম বেশ ভালো। তবে যাতায়াতের পথে এ দিনের ভরতনাট্যম অতটা খারাপ লাগছিল না কারণ রাস্তায় যা কিছু দর্শনীয় স্থান চোখে পড়ছিল তার “আঁখো দিখা হাল” শুনিয়ে যাচ্ছিল ড্রাইভার সাহেব। এভাবেই ফেরার পথে উঁকি মারল মন্দার পর্বত। ড্রাইভার সাহেব গাড়ি থামিয়ে বেশ দায়িত্ব নিয়ে আমাকে বুঝিয়ে দিলেন কীভাবে একদা সমুদ্র মন্থনের সমস্ত চাপটা সামলেছিলেন এই পর্বত। আমিও এই সুযোগে খোলা হাওয়ায় দাঁড়িয়ে খোস মেজাজে সিগারেট ধরিয়ে বাড়ির নাম্বারে ডায়াল করলাম। এবারেও অন্তত পাঁচবার চেষ্টা করেও অন্য দিকের নাগাল পেলাম না। মুখটা এবং মুডটা ফের তেতো হয়ে গেল।

    হঠাৎ মনে হল যার জন্য আমার এই অশান্তি সেই এস.এম.এস.-এর মালিককে ফোন করে গাল পাড়ব। ফোন করলাম। আবার সেই পুরুষ কন্ঠ, হ্যালো, কাকে চাই।

    — আপনাকেই চাই। আমি গলা চড়িয়ে বললাম।

    — হ্যাঁ, বলুন।

    — আপনি মেসেজটা কেন করেছিলেন বলুন।

    — কোন মেসেজটা? সারাদিন এত মেসেজ করতে হয় যে মনে থাকে না কাকে কী পাঠিয়েছি।

    — সেই যে, রাতে আসছি, আমার জন্য খাবার রেখ...

    — ধুর, আপনি তো খাবার রাখেননি। তবে এত কথা কীসের।

    লোকটার কথা শুনে এবার কেন জানি না মনে হল লোকটা আসলে বদমায়েশি করছে। গলা চড়িয়ে বললাম, আপনার লজ্জা করে না এভাবে অচেনা লোকজনের ফোনে এস.এম.এস. পাঠাতে।

    — যা বাবা, লজ্জা করবে কেন?

    — দেখুন এটা কিন্তু সাইবার ক্রাইম। আমি আপনার নামে পুলিশের কাছে অভিযোগ জানাব।

    আমি লোকটাকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করলাম। এরপর বেশ কিছুক্ষণ দেখলাম উল্টোদিক থেকে কোনও উত্তর নেই। ফোনটা সবে ছেড়ে দেব ভাবছি — ঠিক সেই সময় লোকটা ফের বলল, কী অভিযোগ জানাবেন?

    — কী অভিযোগ? আপনি মেসেজ করে বিরক্ত করছেন...

    — আপনাকে ঠিক ক’টা মেসেজ করেছি? লোকটা চিবিয়ে চিবিয়ে প্রশ্ন করলো।

    বুঝতে পারলাম লোকটা অত্যন্ত ধূর্ত। শুধু শুধু ফোনের পয়সা নষ্ট করার কোনও মানে হয় না ভেবে লাইনটা কেটে দিলাম।

    রাগের চোটে লাইন কেটে দেবার পরই মনে হল, লোকটা অবশ্যই পাগলামোর ভান করছে। নইলে “আপনি খাবার তো রাখেননি” কথাটা একটুও না ভেবে কী করে বলল। লোকে বলে সন্দেহ খুব খারাপ বস্তু। সেই সন্দেহ যেন আমাকে ঘিরে ধরল। মনে হল, তবে কি লোকটা সন্ধ্যাকেই মেসেজ করেছিল — তারপর বিপদ বুঝে পাগলামির ভান করছে...। আমি পাগলের মতো এরপর সন্ধ্যার “ইনবক্সে” ঢুকে পড়লাম। দেখি, “সার্ভিস প্রোভাইডার”এর কয়েকটা মেসেজ আমার দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে হাসছে।

    মানসিক দিক দিয়ে বিধ্বস্ত আমি হোটেলে ফিরলাম রাত আটটা নাগাদ। ফেরার ট্রেন রাত দশটায়। ষ্টেশনের পাশেই হোটেল ফলে সাড়ে ন’টা নাগাদ হোটেল ছাড়ব ঠিক করে বিছানায় শরীর এলিয়ে দিলাম। হঠাৎ কী মনে হল, শরীরের সমস্ত শক্তি এক করে ফের ফোন লাগালাম বাড়িতে। উল্টোদিকে সন্ধ্যার গলা, হ্যালো।

    — বিকেলে কোথাও বেরিয়েছিলে নাকি? আমি সরাসরি মূল প্রশ্নে ঢুকে পড়ার চেষ্টা করি।

    — না তো। বাড়িতেই ছিলাম তো। তুমি ফোন করেছিলে নাকি?

    — হ্যাঁ, অন্তত পাঁচবার ফোন করেছিলাম। আমি গজগজ করতে করতে বলি।

    — তার মানে ফোনটা আবার বিগড়েছিল। ওহ্‌, এই টেলিফোন কোম্পানিগুলোকে নিয়ে আর পারা যায় না। আমি বুঝতে পারছি তোমার অবস্থা। সে যাক, তুমি ফিরে এসে টেলিফোন কোম্পানিতে একটা রিপোর্ট করে দিও।

    সন্ধ্যার স্বাভাবিক ছন্দের কথায় আমার রাগ, অভিমানের পারদ নেমে আসে। আমি, “শুভরাত্রি” বলে লাইন কেটে দি’।

    ভাগলপুর থেকে ফিরে হঠাৎ করে “সন্দেহপ্রবণ” হয়ে পড়া আমি এরপর বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেছিলাম বিভিন্ন নাম্বার থেকে এবং সন্ধ্যার মোবাইল থেকে এস.এম.এস.-এর মালিককে ফোনে ধরার। কিন্তু ফোনে আমার গলা পেয়েই উল্টোদিকের জন ফোন কেটে দিয়েছে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই। আর হ্যাঁ, ইচ্ছে করেই এ সব নিয়ে সন্ধ্যার সঙ্গে কোনও আলোচনা করিনি।

    আর হ্যাঁ, টেলিফোন দপ্তর থেকে লোক এসে আমাদের টেলিফোনটাকে সমস্যামুক্ত করে দিয়ে গেছে। যে লোকটা টেলিফোন সারাতে এসেছিল তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, দাদা, সমস্যাটা ঠিক কী ছিল বলুন তো।

    লোকটা তার কাজের ব্যাগ গোছাতে গোছাতে খুব ক্যাজুয়ালি উত্তর দিয়েছিল, সমস্যাটা ছোট, কিন্তু মুশকিল হল, এ ধরনের সমস্যাগুলো চট করে ধরা যায় না আর সে জন্যেই কাজটা ছোট হলেও সারাতে সময় লাগে।

    — কিন্তু সমস্যাটা কী, সেটা তো বলুন।

    — সমস্যাটার নাম?

    — হ্যাঁ।

    — লুজ কানেকশন। লোকটা আলতো হেসে উত্তর দিয়েছিল।

    আমার সে মুহূর্তেই কেন জানি না মনে পড়েছিল — সন্ধ্যার মোবাইলের “সেন্ট আইটেম”গুলো আমি চেক করিনি।



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ রাহুল মজুমদার
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments