সাধে কি বলে জীবনযাত্রা!
ন্না ন্না ন্না! যাত্রা বলেছি বলেই অমনি 'সাক্ষাতে সংহার' বা 'বীণাপাণির কালাপানি পার' বা 'ময়ূর কাঁদে বাড়ির ছাদে' গোছের কিছু ভেবে নেবেন না আবার। এই লোকশিল্পটি সম্বন্ধে আমার যথেষ্ট শ্রদ্ধা থাকলেও, জ্ঞান যৎসামান্য। জীবনে একবারই দেখেছি, তাও ভুল করে (মানে গিরিশ মঞ্চে যে নাটক ছাড়া আর কিছু হতে পারে তা ভাবতেই পারিনি। ঝুপ করে টিকিট কেটে ঢুকে পুরো বেকুব)।
তবে হ্যাঁ, সেই একমাত্র অভিজ্ঞতা কিন্তু বেশ রোমাঞ্চকর। ধরুন খুব করুণ ডায়লগের পর ডায়লগ চলছে। আপনি কাঁদবেন বলে রেডি। ব্যায়লা ক্রমে ঢিমেতেতালা হচ্ছে। এমন সময় আবেগের বশে হিরোইন আপনার ঠিক ভিশন লাইনের সামনে মাটিতে মাথা কোটা শুরু করলেন, আর আপনি, উঁচু সীট থেকে কটকটে আলোতে পরিষ্কার দেখতে পেলেন প্রথম ঝাঁকুনিতেই মাথা থেকে পরচুলোটা ভুশ করে দু ইঞ্চি নেমে এল আর হিরোইনের কপাল নেই হয়ে গেল, আর সব ঝম্পনোদ্যত চোখের জল উবে গিয়ে আপনি নেহাত অসভ্যের মত খ্যাঁক খ্যাঁক করে হেসে ফেললেন - বড় চাপ মশাই, বড় চাপ। কিংবা বীররসে পূর্ণ সীনে আপনি মুহুর্মুহু চমকে চমকে উঠছেন হুহুংকার রবে, নায়ক উষ্ণ, উত্তেজিত, উদ্বেলিত কণ্ঠে ডায়ালগ দিতে দিতে মদহস্তীর মত পায়চারি করছে, ওমা মোক্ষম জায়গায় ঝিং ঝিং ঝাং করে কর্ণপটহ বিদীর্ণ করে বাজনা বেজে উঠল - নায়কও অমনি হাতি থেকে বিবেকানন্দ হয়ে স্ট্যাচু দাঁড়িয়ে পড়ল। কয়েক সেকেন্ড পর আপনার বুকের কাঁপুনি গন, অ্যাড্রিনালিন লেভেল নর্মাল; তারও পর রীতিমত কান ঝালাপালা, মনের মধ্যে পালাই পালাই পালা।
তবে, এটা মনে হয় স্থান কাল পাত্রের দোষ। গিরিশ মঞ্চের মত ছোট হল-এ, তাও মূলত নাটকের জন্য বানানো হল-এ যাত্রার মাত্রা ব্যাহত হওয়াই স্বাভাবিক। আর রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত শাঁওলি মিত্রদের অভিনয়ে অভ্যস্ত চোখে এই ভিন্ন ঘরানার অভিনয়ের আঙ্গিক বোঝা বা কদর করাও মুশকিল। বিস্তৃত তিনদিক খোলা মঞ্চে, আকাশের নিচে শামিয়ানায়, হ্যাজাকের আলোয় আলো আঁধারিতে, মাইক বিহীন অভিনয়ে চারপাশে বসা সাধারণ মানুষের বুকে হাসি কান্না দুঃখ গর্বের ঢেউ তুলতে যে উচ্চকিত অভিনয়ের প্রয়োজন, সেটা করা খুব সহজ কাজ নয়, আর সেটা এঁরা সার্থকভাবে করেন নিশ্চয়।
সে যাই হোক। এই ধরনের যাত্রা নিয়ে আমার এইটুকুই অভিজ্ঞতা। কিন্তু অন্য যাত্রা নিয়ে আমি মাইলের পর মাইল লিখে যেতে পারি। মানে যাতায়াতের কথা বলছি আর কি!
অফিস যাওয়া আর আসা একটা পর্ব। সে বাসেই যাই, ট্রেনেই যাই, অটোতেই যাই কি আজকালকার ওলা-ই ডাকি। প্রথম বোম্বে এসে যেখানে কাজ করতুম সেটার অফিস পাওয়াইতেই ছিল। কিন্তু ছোট কম্পানি, অফিস বাস টাস ছিল না। বাড়ি থেকে অটোয় মানখুর্দ স্টেশন (আমি সেটা বহুকাল না জেনে মানকুড় বলেছি), ট্রেনে কুর্লা, কুর্লায় চেঞ্জ করে আবার ট্রেন, তারপর কাঞ্জুর মার্গ স্টেশনে নেমে আবার অটো ধরে পাওয়াই, পুরো ক্লাসিকাল সঙ্গীত - স্থায়ী অন্তরা সঞ্চারী আভোগ চার স্তবকে নির্মিত। বাড়ি ফেরাও ওই ওই।
বোম্বের লোকাল ট্রেন ঘ্যাম ব্যাপার। লেডিজ কম্পার্টমেন্টে কি কি ইন্টারেস্টিং কাজ করতে দেখেছি লিস্ট দিলে নিজেরই নিজের কান মলে দিতে ইচ্ছে করবে বাজে বকার জন্য। যেমন ধরুন:
১. জুতো খুলে, পা তুলে বসে নেলপলিশ পরা
২. কোলে স্টিলের থালা, প্লাস্টিকের ব্যাগ সব ম্যানেজ করে ছুরি দিয়ে ভিন্ডি কুচোনো
৩. প্রেয়ার বুক টাইপের কিছু একটা চিলতে বই খুলে তদগত ভাবে চোখ বুঁজে বসে থাকা ও মাঝে মাঝে পার্শ্ববর্তিনীর (এক্ষেত্রে এই অধম) পিলে চমকে দিয়ে "ওম্মম্ম" বলে হুংকার ছাড়া
৪. প্রতি দেড় মিনিটে একটা করে খিস্তি দিয়ে নাগাড়ে বিশ মিনিট ফোনে কারো সাথে ঝগড়া করা
তবে এসব দেখার ফুরসত পেতুম ফেরার পথে একটু তুলনায় খালি হলে। সকালের ভীড়ে তো দুপায়ে সাকুল্যে সাড়ে সাতটা আঙুলে ভর দিয়ে আর ভুঁড়িটা সামনের লোকের গায়ে পিভট করে ব্যালেন্স করতে করতেই কেটে যেত! সেই সঙ্গে আচমকা নাকে কনুইয়ের খোঁচা, ব্যাগে বেমক্কা টান, দুঃসাহসিনীর কেশাকর্ষণ - এসব সামলানো।
একবার সে কি কাণ্ড! সেটা অবশ্য এই অফিসের রুটে নয়, এর পরের অফিসে ভিলে পার্লে যাবার পথে। তা গল্পটা মনে যখন পড়ল এখনই বলে নিই। সে যাত্রা দারুভূত পল্লবিনীর মত এক সুরূপা কিন্তু কাঠ কাঠ ললিতার নামার সময়ে কি করে কে জানে তার ব্যাগের চেনে আমার বিনুনী (হায়! তখন মাথায় বুদ্ধি বা চুল কোনটারই এত আকাল হয়নি গো!) গেল আটকে। সে কি গেরো, হাজার টানাটানিতেও ছাড়ে না। এদিকে ট্রেন ঢুকছে প্ল্যাটফর্মে, ললিতার মুখ দেখে মনে হচ্ছে সে সবেগে গুরু তেগ বাহাদুর নগরে নামবেই নামবে, দরকার হলে আমার বিনুনী শুদ্ধুই নামবে - ওদিকে আমি বেণী বা শির কিছুই ত্যাগ করতে রাজি নই, ফলে সমবেত মহিলাকুলের চিয়ারলিডিং এর মধ্যে টাগ অফ ওয়ার এবং আমি বিজয়ী। সে নেমে যাবার পর দেখলুম বিনুনীতে চেনের মাথাটা ভেঙে লটকে রয়েছে। এমন প্যাঁচান পেঁচিয়েছিল যে কামরাশুদ্ধু জনতা চেষ্টা করে ছাড়াতে পারল না, অফিস পৌঁছে কাঁচি জোগাড় করে ওই ক গাছা চুল কেটে ফেলতে হল।
আরেকবার উপচে পড়া ভীড়ে নিজেকে প্রায় গুঁজে দিয়েছি, ট্রেনে ওঠার বেস্ট টেকনিক যেটা। মাঝ বরাবর দাঁড়ালে ভীড়ই তুলে দেবে ঠেলে। ট্রেন আসার আগেই কোমরে কী জোর কাতুকুতু রে বাবা! আমার আবার ভীষণ কাতুকুতু লাগে। ফলে হাসি টাসি যতক্ষণে থামল, ট্রেন তখন টা টা করে চলে যাচ্ছে।
আপিশ পালটানোর পর এই ট্রেনভ্রমণ থামল। কিন্তু তারপর শুরু হল বাস-বিলাস। পরের কোম্পানীটি আবার ভ্রাম্যমাণ প্রকৃতির ছিল। কিছুকাল বাদে বাদেই অফিসের লোকেশন পালটে যেত। শুরু করেছিলুম ভিলে পার্লে বলে এক সুদূর জায়গা দিয়ে। ছাড়লুম যখন অফিস তখন জে বি নগর ঘুরে সুদূরতর গোরেগাঁও গিয়ে পৌঁছেছে। ভিলে পার্লে যেতুম বেস্টের বাসে, সে বাস "অলি গলি চলি রাম" ঢঙে বোম্বের কাঁহা কাঁহা মুল্লুকের গলিঘুঁজি ঘুরে ফিরে নিয়ে যেত। ঘন্টাখানেক তো কম করে লাগত। ট্রেনেও গেছি মনে হচ্ছে মাঝে মাঝে। অটো করে পার্লা স্টেশন, পার্লা টু বড়ালা, বড়ালা টু মানখুর্দ, আবার অটো নিয়ে বাড়ি।
তাপ্পর জে বি নগর - সে একটা রোমহর্ষক জায়গা ছিল। তদ্দিনে অফিসের বাস বলে একটা ব্যাপার গজিয়েছে। সাকি নাকা এবং আসাল্ফা নামে দুটো জ্যামের জন্য কুখ্যাত জায়গার ওপর দিয়ে ছিল সে বাসের রুট। আমরা মোটামুটি একঘুম দিয়ে নিতুম। অনেকে অ্যালার্ম দিয়েও রাখত আবার। যেতে এক ঘন্টা, ফিরতে সোয়া ঘন্টা। বাসে বসে বসে কেতরে ঘুমিয়ে ঘুমিয়েই আমার স্পন্ডি ধরল কিনা কে জানে।
গোরেগাঁও যখন গেলুম আমরা, তখন খুব ফাঁকা চারদিক। অফিসের জানলা দিয়ে সামনে আরে মিল্ক কলোনির খোলা সবুজ জমি দেখি। পার্টি করতে পাশের হাব ম্যলে যাই। আর অনন্ত বাস জার্নি করি দুবেলা। হায়, তখন স্মার্টফোন ছিল না! নইলে কত সময় পেতুম লেখার!
তারপর যখন দেখলুম জাগ্রত অবস্থায় আমি বাড়ির চেয়ে বাসে বেশীক্ষণ বাস করছি, তখন বিদ্রোহ করতে বাধ্য হলুম। এইচ আর ছাড়ার কারণ বাসজার্নি দেখেই 'বাসাংসি জীর্ণায়' গোছের কিসব বলে টলে আমায় খুব বোঝাতে চাইল এত তুচ্ছ কারণে এদ্দিনের সেটল হয়ে যাওয়া জব ছাড়তে নেই। আমি ত্যাঁদড়ের মত বললুম "দিদিমণি, এখেন থেকে আমি যেদিন সবচে' তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরেচি সেদিনও আমার পৌনে ঘন্টা লেগেচিল।" দিদিমণি চক্ষু কপালে তুলে বললেন, "মাত্তর পঁয়তাল্লিশ মিনিট! বোম্বের হিসেবে সে তো চমৎকার!" আমার আবার পঁয়তাল্লিশ শুনলেই "মা খু চিহল পঞ্জম হস্তম" মনে পড়ে যায়, আম্মো তাই এক কথা ফের বললুম, "সে তো যেদিন সবচে' তাড়াতাড়ি গেছি!" দিদিমণি তখন মহা উৎসাহে আমায় ট্রাফিক স্পীড দিয়ে সিগনালের ডিউরেশন গুণ করে তার সঙ্গে জ্যামের (গাড়ির। আম বা পেয়ারার না) ডেনসিটির ফ্যাকটোরিয়াল যোগ করে টরে মাসে অন্তত কদিন এমন কম সময়ে যেতে পারি তার প্রোবাবিলিটি বোঝাতে লেগে গেলেন। আমি তেনাকে থামিয়ে শুধু বললুম, "সেদিন রাত ১১:২০তে বেরিয়েছিলুম, বেস্টের এই রুটের লাস্ট বাস ধরেছিলুম, সমস্ত রাস্তা শুনশান ছিল, বাস হু হু করে সিগনাল টিগনাল কিচ্ছুতে না দাঁড়িয়ে গেছিল। এমনকী বাসে তেমন লোক ছিল না বলে স্টপেজও দেয়নি বিশেষ।"
তারপর দিদিমণি হঠাৎ আমার হাতের বালাটার কারুকার্যে বেজায় মনোযোগী হয়ে পড়লেন, তাঁকে চেম্বুরের জুয়েলারি শপের হালহদিস দিয়ে এক্সিট ইন্টারভিউয়ের পালা চোকালুম।
পরের আপিশ, মানে এখনকার আপিশ বাপু ভারী ভাল। একে তো পাওয়াইতে, তায় খাসা বাস সার্ভিস। নেহাৎ মিস করলেও ওলায় মিনিট পঁচিশ। কিন্তু আমার ওই যে বাসে বসেই ঘুমিয়ে পড়ার অভ্যেসটা হয়ে গেছে সে ভারী মুশকিল করে মাঝে মাঝে। একবার আপিশ পৌঁছে সবাইকে নামিয়ে দিয়ে বাস স্ট্যাণ্ড করার পর ড্রাইভারদাদা আমায় ডেকে দিয়েছিলেন, কী লজ্জা!
কিন্তু ফেরার পথে তো মোট্টে ঘুমোই না। ফেরার পথে তো লিখি। এই যেমন আজ কত দরদ দিয়ে এটা লিখছিলুম। তারপর চোখ ব্যথা করছিল বলে জানলা দিয়ে একটু রাস্তার ধারে কয়েকটা বাচ্চা ছেলে ক্রিকেট খেলছিল তাই দেখছিলুম। দেখতে দেখতে দেখি তাদের উইকেটটাও ভ্রাম্যমান, মানে একটা নধর নেড়ি। তা দেখে ভাবলুম এটা তো বেশ অ্যালিস ইন ওয়াণ্ডারল্যাণ্ডের ক্রোকে খেলার ভারতীয় ভার্শান। তবে ব্যাট করার জন্য ফ্লেমিঙ্গো পেতে গেলে সিউড়ি যেতে হবে, আর বল হিসেবে হেজহগ এর বদলে বোম্বের ধেড়ে ইঁদুর দিয়ে কাজ চলবে কিনা সেটাও প্রশ্ন! বেশ মনোযোগ দিয়ে ভাবছিলুম বুঝলেন, ব্যাটসম্যান মাথায় হেলমেটের মত করে সসপ্যান পরবে না ডেকচি - ভাবতে ভাবতে দেখি আহা কি সুন্দর সুদৃশ্য সুনীল জলধি আদিগন্ত! নৌকো টৌকো চলছে, দূরে দূরে ইলেকট্রিকের খাম্বা।
ভাল করে চোখ কচলে দেখার পর বুঝলুম, ভাসি ব্রীজের ওপর দিয়ে বাস পূর্ণ উদ্যমে সমুদ্দুর পেরিয়ে চলে যাচ্ছে, আমি বাসে বসে নাচতে নাচতে সমুদ্দুরের শোভা দেখতে দেখতে হু হু করে নভি মুম্বইয়ের দিকে নীত হচ্ছি, আমার সাধের মানখুর্দ স্টপেজ বহু পিছনে পড়ে আছে।
আর্তনাদ যেটা ছেড়েছিলুম সেটা নেহাত নগণ্য ডেসিবেলের নয়। কিন্তু ড্রাইভার দাদাও নাচার, ও রাস্তায় বাস থামানোর উপায় নেই। সোজা গিয়ে ভাসি টোল বুথে দাঁড়াল, আমি টপাং করে নেমে পড়লুম। পড়ে বুঝলুম কেলো করলুম, কারণ বেস্টের বাস বা অটো কেউ সেখানে থামে না। তবে কিনা বুথের বালকগুলো মন্দ নয়। আমার এমন আচমকা অবতরণে তারা প্রথমে বিস্মিত হয়েছিল, তারপর আমার তাঁতের মাকুর মত এদিক থেকে ওদিক যাতায়াতে বিলক্ষণ বিব্রত ও বিরক্ত হচ্ছিল, কিন্তু যেই শুনল আমি ভুল করে স্টপেজ মিস করে আতান্তরে পড়ে নেমে পড়েছি, এবং নেমে পড়ে আরো আতান্তরে পড়েছি, অমনি সবাই মিলে হইহল্লা করে একটা বাস দাঁড় করিয়ে আমায় ভারি যত্ন করে তুলে দিল। কে বলে শিভাল্রি নেই, এরকম 'প্রপার ড্যামসেল ইন ডিস্ট্রেস' হলেই টের পাওয়া যায় দিব্যি আছে। তবে তুলে দেবার পর দুনিয়াকে শুনিয়ে হেঁকে ডেকে কন্ডাকটরকে "ম্যাডামকে ধরে মানখুর্দে নামিয়ে দিও, আবার ভুলে স্টপেজ মিস না করে যায়" এই নির্দেশটা না দিলেই কি পারত না, বলুন? এরকম মিচকি মিচকি হাসির ভীড়ে কান লাল করে বসে থাকতে হত না তাহলে আমায়!
সাধে কী আর শুরুতে বললুম, জীবন-'যাত্রা'!