আমাদের যে স্বাধীনতা, তার মানে দেশভাগ। আমাদের যে স্বাধীনতা তার মানে উদ্বাস্তু সমস্যা। আমাদের যে স্বাধীনতা দিবস, তা হয়তো স্বপ্নভঙ্গের জন্মদিন। শিল্পের স্বাধীনতা দিতে পারবে আমাদের চেতনার আশ্রয়? কবিতার কথায় কল্পনা করতে পারব নতুন কোনও পৃথিবী? আমাদের অস্তিত্বকে দেখে নিতে পারব ভালোবাসার বর্ণমালায়? যাপিত জীবন এবং ইচ্ছে পূরণের কাহিনি মিলে যদি গড়ে ওঠে শিল্প, তবে দেশভাগ ও বাংলা কবিতার আলোচনা একরৈখিক ছকে আটকে না থেকে জন্ম দেয় বহু স্বরের। পরতে পরতে অবিরত ইশারায় বিনির্মিত হতে থাকে যদি ইতিহাসের সত্য, তবে আরেকবার ফিরে পড়া যায় অস্তিত্বের নন্দন। আর সে পাঠের শুরু আছে শেষ নেই, কেননা বেদনা যে অন্তহীন!
‘সৃষ্টির মনের কথা মনে হয়- দ্বেষ’। ( ‘১৯৪৬-৪৭’, জীবনানন্দ দাশ) ভারতবর্ষ নামের স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্মের ইতিহাসকে এই সূত্রে পড়া যায় হয়ত। স্বাধীনতার কিছুদিন পরেই দ্বিজাতি তত্ব মিথ্যে হবে, স্বাধীনতা সব খেলেও যে মানুষের দু:খ খেতে পারে না; ’৪৭, ’৭১ পেরিয়ে সে বোধ নিশ্চয়ই আসবে। কিন্তু স্বাধীনতার তাৎক্ষণিক স্বাদেই ‘বাঙলার লক্ষ গ্রাম নিরাশায় আলোহীনতায় ডুবে নিস্তব্ধ নিস্তেল’। (‘১৯৪৬-৪৭’, জীবনানন্দ দাশ) ভারতবর্ষ সূর্যের এক নাম সমবেত কন্ঠে গীত হবে বটে কিন্তু ততদিনে আমাদের হৃদয়ে সাতটি তারার তিমির। জীবনানন্দ দাশের ১৯৪৬-৪৭ কবিতার মধ্যেই যে ইতিহাসের ছবি পাই তাতেই বোঝা যায় জীবনানন্দের ‘রূপসী বাংলা’ তাঁর জীবন কালে অপ্রকাশিত থাকবে। বাসনার দেশ বুকে নিয়ে বিচ্ছেদের কথাকেই ভেবে যেতে হবে। ফেরা যায় বললেই ফেরা যায় না। শঙ্খচিল, শালিকের বেশে তাও সম্ভব, কিন্তু মানুষ....?
।। ১ ।।
আমার মুখে অন্তহীন আত্মলঞ্ছনার ক্ষত(‘দেশহীন’, শঙ্খ ঘোষ)
আমার বুকে পালানোর পালানোর আরো পালানোর দেশজোড়া স্মৃতি
সেই কোন দেশে আমরা যাচ্ছিলাম(নন্দর মা, জয় গোস্বামী)
কোন দেশ ছেড়ে আমরা যাচ্ছিলাম
পেরিয়ে পেরিয়ে উঁচু, নিচু, ঢালু মাঠ
শিশির ভেজানো কাঁটাতার, গাছপালা
তারপর, সমস্ত পথ একটাও কোনো কথা না বলে(দেশান্তর, শঙ্খ ঘোষ)
আমরা হাঁটতে থাকি, হেঁটে যেতে থাকি
এক দেশ থেকে অন্য দেশে
এক ধর্ষণের থেকে আরো এক ধর্ষণের দিকে।
দেশভাগ আর দেশত্যাগ শব্দদুটি একই সঙ্গে উচ্চারিত হতে পারে। আমি কিংবা আমরার এই পালিয়ে আসা, ছেড়ে আসা-র স্মৃতি খুব গুরুত্বপূর্ণ। আসা যাওয়ার পথে যে সব ভাঙা দিনের ঢেলা, তাকে কুড়িয়ে বাড়িয়ে শিল্পে নিয়ে এসেছেন অনেকেই। দেশভাগ নিয়ে বাংলা সাহিত্যে অদ্ভূত নীরবতার উপস্থিতি লক্ষ্য করেছেন সমালোচকেরা। দেশভাগের আখ্যান রচনার সংকটের কারণ অনুসন্ধান করতে চেয়েছেন কেউ কেউ। [১] বাংলা কবিতা কীভাবে ধারণ করল ইতিহাসের এই স্বপ্নভঙ্গকে, তার কিছু প্রবণতার উল্লেখ করতে কেবল। সমগ্রকে ছুঁতে পারব না, এটাই স্বাভাবিক। কেননা ইতিহাসের সত্য শিল্পপিত স্বভাবে প্রতিদিন বিনির্মিত হচ্ছে।
।। ২ ।।
"'স্মৃতি’ আর ‘নতুন অভিজ্ঞতার পুনর্গঠন’ এই দুটি মাত্রায় দেশভাগের সাহিত্য বিকশিত। যে অর্থে ‘মাইগ্রেশন’ শব্দটি আজকের বিশ্বে ব্যবহৃত হয় পার্টিশন আক্রান্ত মানুষ সে অর্থে মাইগ্রেটেড নয়; বলপূর্বক স্থানান্তরিত হবার বাধ্যতা তার উদ্বাস্তু সত্তাকে নির্মাণ করেছে। সর্বোপরি এক স্বাধীন রাষ্ট্রব্যবস্থার মধ্যে থেকেও তার সত্তার অস্বীকৃতি তাকে বিশিষ্ট করেছে। নতুন আত্ম পরিচয়ের সন্ধানে তার পথ চলার অভিজ্ঞতা তার সামাজিক স্বরকে দিয়েছে অন্য মাত্রা। এইসব নিয়েই গড়ে উঠেছে সাহিত্যিক প্রতিমান। সমাজ-সময়-স্মৃতির পরস্পর সাপেক্ষতা এই সাহিত্যের প্রাণবায়ু। ব্যক্তিক অভিযাত্রার বৈচিত্র্যময়তা পার্টিশন সম্পর্কিত সাহিত্যকে দিয়েছে বাস্তব আর কল-বাস্তবের দ্বান্দ্বিকতা।
দেশভাগের সাহিত্যের একতা বড় অংশ জুড়ে এই স্মৃতি আর ফেলে আসা যন্ত্রণার গ্লোরিফিকেশন”।[২] স্মৃতির সূত্রে ছেড়ে আসা গ্রামকে মনে পড়ে। কবিতায় একই সঙ্গে কবির যাপিত জীবনের ছবি যেমন পাওয়া যায়, তেমনই কবির ইচ্ছে পুরাণকেও। আমরা জানি, নস্টালজিয়া শব্দটি এক প্রকার স্বস্তির সঙ্গে আলতো বিষাদকেও জড়িয়ে রাখে। অতীতের জন্য সংবেদনশীলতা কি সমকালীন বাস্তবের পরিপ্রেক্ষিত? আমরা কি পালাতে চাই? স্মৃতি কি আশ্রয় দেয়? পুরনো সে দিনের কথায় মানুষের চিরকালের যোগ, কিন্তু কোথাও কি বর্তমানের উল্টোদিকে কল্প- অতীত বানিয়ে তোলা নেই? আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম — এ বিশ্বাস আমাদের ভেতর থেকে উঠে আসে নাকি এ কথাটি আমাদের ভাবতে ভালো লাগে? শিল্পে বাস্তব আর কল্পনা এমনভাবে মিশে যায়, তাকে আলাদা করে চেনা মুশকিল হয়ে পড়ে।
মনে পড়ে সেই সুপুরি গাছের সারিগভীর গভীরতর অসুখে ছোট ছোট সুখ মনে পড়ে। মনস্কাম শব্দটিও মনে গেঁথে যায়। ‘অর্ধেক জীবন’-এর কথা মনে আসে- “আসলে কিছুই নাকি হারায় না, স্মৃতিরও নানান স্তর আছে, সব কিছুই আমাদের মনে থাকে, কিন্তু মনে পড়ে না”।[৩] কবিতায় যে সব কিছুকে মনে পড়ার সূত্র পাচ্ছি, তার কতটা আদতে কবির মনে পড়েছে? কোথাও কি আরোপ নেই? নেই উদ্ভাবন? উৎসাহী পাঠক দেখতে পারেন একটি প্রবন্ধ।[৪] তারাপদ রায় তাঁর ‘নবাবগঞ্জ’ কবিতায় বৃষ্টি আসার সূত্রে, বাতাসে ভেজা কদম ফুলের গন্ধের অনুষঙ্গে ছোটবেলার নবাবগঞ্জকে মনে পড়ার কথা বলছেন। শেষের লাইনটি অনন্য — “সেই নবাবগঞ্জে একটিও কদমগাছ ছিলো না”। আমাদের বক্তব্যটিও আশা করি পরিস্ফুট হয়েছে। এবারে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘সাঁকোটা দুলছে’ কবিতার শেষ স্তবকটি উদ্ধৃত করবার পালা—
তার পাশে মৃদু জ্যোৎস্না মাখানো গ্রাম
মাটির দেয়ালে গাঁথা আমাদের বাড়ি
ছোট ছোট সুখে সিদ্ধ মনস্কাম।
সাঁকোটির কথা মনে আছে, আনোয়ার?এই সাঁকোর ইমেজটি আবার পাচ্ছি তারাপদ রায়ের ‘গ্রামে আছি’ কবিতায়—
এত কিছু গেল, সাঁকোটি এখনো আছে
এপার ওপার স্মৃতিময় একাকার
সাঁকোটা দুলছে, এই আমি তোর কাছে
‘মনে আছে’ এবং ‘ভুলে গেছি’সাঁকোর ব্যঞ্জনা পাল্টে যাচ্ছে, দোদুল্যমান এই সাঁকো তার শরীরী অবয়বে দেশ কালের চিহ্ন হয়ে ওঠে। দেশভাগ নিয়ে বাংলা কবিতায় ‘দেশ’ ধারাণাটিরও বিনির্মাণ ঘটেছে—
এই দুই পুরনো গ্রামের মাঝখানে
একটি নড়বড়ে বাঁশের সাঁকো।
.... সেই স্মৃতি বিস্মৃতির মাঝখানে
চিরদিন
চিরদিনের বাঁশের সাঁকোটি
নড়বড়ে বাঁশের সাঁকোটি.....
তুমি দেশ? তুমিই অপাপবিদ্ধ স্বর্গদপি বড়ো?(স্বদেশ স্বদেশ করিস কারে, শঙ্খ ঘোষ)
জন্মদিন মৃত্যুদিন জীবনের প্রতিদিন বুকে
বরাভয় হাত তলে দীর্ঘকায় শ্যাম ছায়াতরু
সেই তুমি? সেই তুমি বিষাদের স্মৃতি নিয়ে সুখী
মানচিত্ররেখা, তুমি দেশ নও মাটি নও তুমি!
মনে পড়ে যায় কবির আত্মপ্রলাপ — “মানুষের জন্মভূমি আর স্বদেশ সব সময় এক থাকে না। আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে আমার জন্মভূমি বিদেশ হয়ে গেছে”। [৫] জাতীয়তাবাদী কিংবা সাম্রাজ্যবাদীদের দেশ তো জনসাধারণের দেশ হয়ে ওঠেনি কখনও। কাঁটাতার যেমন সত্য, তেমনই সত্য অসীমান্তিক চেতনা। দীর্ঘশ্বাসের ডালপালার মধ্যেই কোথাও প্রত্যাখ্যানের বয়ান থেকে যায়—
শুধু এক মানচিত্র ভাঙাঘরে দেয়ালে নিয়তভারতবর্ষ মানচিত্র সম্পর্কে আমার ধারাণা টারণা আজও স্পষ্ট নয়। (ভারতবর্ষ মানচিত্র, তারাপদ রায়)
উলঙ্গ রিলিফ ম্যাপ আধাখ্যাপা ড্রয়িং মাস্টার
উপহার দিয়েছিলো রক্তের স্রোতের মতো নদী
দাঁত বের করা হিংস্র অন্ধকার আদিম পাহাড়
এই ট্রাজেডিই চলবে প্রজন্ম পর প্রজন্ম ধরে। মানচিত্র দেশ হবে না কোনওদিন। এক ছিন্নমূল সামূহিক অস্তিত্ব দেশে কলোনির কবিতা লিখবে।
।। ৩ ।।
জল থেকে ডাঙ্গায় উঠে ওরা(সূর্য-পোড়া ছাই, জয় গোস্বামী) প> ‘সূর্য-পোড়া ছাই’ কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৯৯ সালে। একই বছর প্রকাশিত হয় বিভাস রায়চৌধুরীর ‘শিমূলভাষা পলাশভাষা’ বইটি। ‘ঘুঘু’ শীর্ষক কবিতায় কবি বলেছেন—
পালিয়ে চলেছে আজীবন
এক যুগ থেকে অন্য যুগে
উড়ে আসে ক্ষেপনাস্ত্র, তীর
ছেলে বৌ মেয়ে বুড়ো জননী ও শিশু কোলাহল
দাউদাউ উদ্বাস্তু শিবির
মা-বাবার অন্নে অপমানদেশভাগের প্রত্যক্ষ অভিঘাতে লেখা কবিতার কথা উল্লেখ করেছি আমরা, আশি কিংবা নব্বইয়ের দশকে যারা লিখেছেন, তাদের লেখায় বারেবারে উদ্বাস্তু সমস্যা, দেশভাগ ফিরে এসেছে। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, শঙ্খ ঘোষ, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, উৎপল কুমার বসু, তারাপদ রায় প্রমুখেরা দেশভাগকে যেভাবে দেখবেন, রণজিৎ দাশ, জয় গোস্বামী, মৃদুল দাশগুপ্ত সেভাবে দেখবেন না, তেমনই পরবর্তীকালে বিভাস রায়চৌধুরী, বিকাশ সরকার, মন্দাক্রান্তা সেন প্রমুখ কবিদের দেখা ও দেখানো যাবে পালটে। একথা অনস্বীকার্য যে সমকালের প্রত্যাশায় অতীত অধ্যয়নের এক নতুন সমীকরণ তৈরি হয়। বলার বিষয় হল প্রজন্মের পর প্রজন্ম কীভাবে লালন করছে এই গভীরতম অসুখ কে। ভাত কাপড়ের ভাবনা, অস্তিত্বের সংগ্রামে পরবর্তী প্রজন্মেরা কিছুতেই ভুলতে পারছে না ইতিহাসের দায়। শঙ্খ ঘোষের ‘পুনর্বাসন’ কবিতার শেষ দুটি লাইন নিশ্চয়ই মনে আছে আমাদের- “যা ছিল আর যা আছে দুই পাথর ঠুকে/জ্বালিয়ে নেয় প্রতিদিনের পুনর্বাসন”। এবং এর পালা এখনও শেষ হয়নি।
আমাদের জমি কই? ধান?
কবিদের ভিটে কই, ঘুঘু ?
এবার আমরা চলে আসব নব্বই দশকের মাথায়। তৃতীয় বিশ্বে বিশ্বায়নের সূচনা এই দশকেই, প্রযুক্তির উন্নয়ন মানুষের জীবন- মূল্যবোধ পাল্টে দিচ্ছে, এই দশকের শেষেই স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পালিত হচ্ছে। ১৯৯৬ এ জয় গোস্বামী লিখছেন ‘ও: স্বপ্ন! কাব্যগ্রন্থ। বিস্ময়বোধক চিহ্নটি লক্ষণীয়। আর এই বইতেই রয়েছে ‘দেশভাগ: পঞ্চাশ বছর’ শীর্ষক কবিতা। কোথাও মনে হয় না স্বাধীনতার এক রকম ক্রিটিক তৈরি হচ্ছে? কবিদের দশক বিচার আদৌ করা উচিত নয়, তবু নব্বই এর কবি হিসেবে বিভাস রায়চৌধুরীর কবিতায় বিশেষ আলোকপাত করতে চাইছি। এক অর্থে উদ্বাস্তু শিবিরের ছেলে আত্মজীবনীই কি বিভাসের কবিতা? ‘পলাশ ভাষা শিমূল ভাষা’ এই প্রতিনিধি স্থানীয় কাব্য ছুঁয়ে আছে বাংলার ইতিহাস, বাংলার ঐতিহ্যকে।
১৯০৫। বঙ্গভঙ্গ। হাতে হাতে রাখি পরিয়ে দিলেন রবীন্দ্রনাথ বেঁধে বেঁধে থাকবার জন্য, কিন্তু ফুরিয়ে গেল কি অঙ্গীকার? বিভাস লিখছেন ‘রাখি’ কবিতায়—
সেদিনের সেই ভিড় নেই....গান নেই...হাত তবে খালি!অভিজ্ঞান হারানোর যন্ত্রণা কবিকে লিখিয়ে নেয়—
রাখিটা হারিয়ে ফেলে একা হয়ে গিয়েছে বাঙালি.....
বুকের ভেতরে আমি আগলে রাখি ভাঙাবুক(ভাটিয়ালি)
ভাঙা বাংলা জোড়া লাগলে সেরে যাবে আমার অসুখ....
এই অসুখের খণ্ড খণ্ড জীবন চিত্র ধরা পড়ে এই গ্রন্থের ‘হায় চিল’ (উৎসর্গ- ‘রূপসী বাংলা’) কবিতায়। নামকরণ কিংবা উৎসর্গই বুঝিয়ে দিচ্ছে ঐতিহ্যকে আত্মস্থ করে স্বতন্ত্র স্বর সন্ধান করছেন কবি। পরিবর্তিত বাস্তবতা তুলে আনে সত্তার আর্তিকে—
যে জীবন দোয়েলের- ফড়িংয়ের কেড়ে নিল কারা?শেষের লাইনটি চমৎকার। ব্যক্তিগত সময় কীভাবে ইতিহাসের বড় সময়কে তুলে আনতে পারে, তা দেখে আমরা আশ্চর্য হই। ডিসেম্বর, ২০১২ তে বেরোয় বিভাস রায়চৌধুরীর ‘সমস্ত দু:খীকে আজ’ কাব্যগ্রন্থ। নাম কবিতায় এসেছে কলোনির ছেলের ঘুরে দাঁড়ানোর কথা। জীবন নিজেই কবিকে দিয়ে লিখিয়ে নেয়—
দেশ ভেঙে টুকরো হল, সীমান্তের দু’পাশে পাহারা
....... তাঁবুতে জন্মাই আমি....মা জিপসি! বাবা বেদুইন!
না-পেয়ে না-খেয়ে বাড়ছি, আশেপাশে পৃথিবী রঙিন
...... বাবার ঘুসঘুসে জ্বর....মার চোখে আলো নিভে আসে
রিফিউজির ছেলে তবু হেলেঞ্চার ঝোপ ভালবাসে
...... রোজ রোজ হায় চিল পাক খেয়ে ঘুরে ঘুরে ওড়ে
কাঁটাতার লেখা কেন দুই বাংলাভাষার ভেতরে ? .......
হাত পাতলেই জেনো ভিখিরির মতো লাগে!(সমস্ত দু:খীকে আজ)
ভিখিরির চোখে আমি কীভাবে তাকাব, বুনো চাঁদ?
যে যার অশ্রুর জোরে ঘুরে দাঁড়ানোই প্রতিবাদ.....
দেশভাগের কবিতাও এক হিসেবে প্রতিবাদের কবিতা। উত্তর-আধুনিক সময় যখন চৈতন্যে মড়ক ঘনিয়ে তুলছে, ভোগের উৎসাহে বিরত করতে চাইছে ভাবার অভ্যেস থেকে, তখন তার বিপ্রতীপে অতীতের খোঁজ, স্মৃতির খোঁজ জল দিতে চাইছে আমাদের শেকড়ে। বিচ্ছিন্ন, একক, নি:সঙ্গ সত্তাবোধ নয়, যৌথ অবচেতনে আত্মীয়তার সম্পর্ক খুঁজে পেতে চাইছে শিল্পের মধ্য দিয়ে। দেশভাগের সাহিত্যে নস্টালজিয়া হয়ে উঠছে এক অন্তর্ঘাতী বয়ান। যে কোনও রকম প্রতাপ ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে জাগিয়ে রাখছে পাঁজরে দাঁড়ের শব্দকে।
।। ৪ ।।
“দেশবিভাগ নিশ্চয়ই কোনও জাতির জীবনে এক প্রধান ঘটনা। আমাদের এই দ্বিধাখণ্ডিত দেশের বেদনা তেমনভাবে প্রকাশিত হয়নি বলে অনেকেরই ক্ষোভ। উনিশ বছর বয়সে দেশ ছেড়েছিলাম। এই সাতষট্টি-আটষট্টি বছর ধরে সেই বেদনা নানাভাবেই আমার কবিতায় রূপ ধরেছে। এখন সাতাশি বছর বয়সে পড়ন্ত বেলায় বিদায় নেবার আগে সেইসব কবিতা থেকে কিছু রচনা এই কাব্যগ্রন্থে ধরে রাখতে চেষ্টা করলাম”। কবি বেণু দত্তরায় তাঁর “ভাঙাবাঙলার কবিতা’ (জানুয়ারি,২০১৫) বইয়ের ‘কিছু কথা’ শীর্ষক প্রবেশক অংশ এভাবেই ধরিয়ে দিয়েছেন বিভাবটুকু। দেশভাগ নিয়ে লেখা স্বতন্ত্র এই কাব্যগ্রন্থটি কবির জীবন কালে সর্বশেষ প্রকাশিত গ্রন্থ।
জন্মভূমি আর কতদিন, চলে যাবার আগে, মনে পড়ে, আমাদের দিনগুলি, সেদিন ও আজ, এপিটাফ- কবিতার নামগুলি পর পর সাজালে বিষয় সম্বন্ধে খানিক আভাস পাওয়া যেতে পারে। দেশ ভাঙার সূত্রে মন ভাঙনের ছবিটি তুলে ধরতে চেয়েছেন কবি তাঁর বিভিন্ন কবিতায়—
দেশভাগের এতবছর পরে ইছাক-কাকুকে মনে পড়ে(ইছাক-কাকু)
বাবা তো কবেই গেছেন ইছাক-কাকুও কি আর আছে
পা-চালানো সেলাই-কলটার কথা খুব মনে পড়তে থাকে
এক নিমেষে কবিতাটি ছুঁয়ে ফেলে অনেকগুলো স্তর। দ্বিজাতি তত্ত্বের সত্য মিথ্যে হয়ে যায়। সেলাই কলের শব্দ ইতিহাসের কোনও দেবতাকেই আর বিশ্বাস করে না যিনি মিলিয়ে দিতে পারবেন ধানসিঁড়ি নদী আর রূপশালী ধানের বাংলাকে। মধুকূপী ঘাস আর কোনও দিন বেহুলার গল্প বলবে না। হিজলছায়া আঁচল পাতবে না। কেননা “ভাঙাবেড়া-কুঁড়েঘর হাঁকড়ে থাকে/ স্বজনেরা দূর-বিদেশে...” (সেদিন ও আজ)
ঠাকুর্দা বলেছিলেন দ্যাখ দ্যাখ ওটা পানকৌড়ি(পানকৌড়ি)
অনেকদিন পড়ে আজ আবার পানকৌড়িকে দেখলাম
দেশভাগ হয়ে গিয়েছে কবেই তো। মাঝখানটুকু কাঁটাতারের
বেড়া পানকৌড়ি খবর রাখে না
দেশভাগ নিয়ে লেখা সাহিত্যে পাখি এসেছে বারবার। জানি, পাখিদের পাসপোর্ট লাগে না। মানুষের লাগে। পাখির মতো উড়ানের ইচ্ছের কথা পাই ‘বৃন্দাবন ও তাঁর পাখি’ কবিতাটিতে। সেখানের দেখি খাঁচা ছেড়ে পাখি উড়ে চলে গিয়েছে। বৃন্দাবন নামের একটি লোক তাকে খুঁজছে। কবিতাটি এই বলে শেষ হচ্ছে—
“বৃন্দাবনকে বলেছিলামমানুষ স্মৃতিতে বাঁচে। বাঁচে শৈশবে।। সারল্যের স্বর্গ থেকে নির্বাসিত মানুষ বারবার ফিরতে চায় স্ব-স্থানে। “আমি কোন পথ দিয়ে বাড়িতে ফিরব/বলে দাও”। (বাংলাদেশ) কিন্তু ফেরা হয়ে ওঠে না। ফিরলেও নীলুর মতো শুনতে হবে— “এয়্যা তো আর তোগো দ্যাশ না, তোরা তো অ্যাহোন অইন্য দ্যাশের লোক’। [৬] ‘আবার আসব’ কথাটা কিশোর নীলু মুখে বলতে পারেনি। পেছন দিকে যাওয়া যে অসম্ভব সে বুঝতে পেরেছিল। উপলব্ধি হয়েছিল— “এইখানেই, এই শহরেই তো বাঁচতে হবে তাকে”। [৭] নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী যেমন বলেন ‘রূপকাহিনী’-তে—
পাখি কি আর ফেরে
তার অদৃষ্টের মতোই
পাখি কোথায় উড়ছে”
কে কাকে ফিরিয়ে নেবে ?ভাঙা বাংলার কবিরা শেষমেশ ফিরতে পারেন না। তবে নিয়তিকে প্রত্যাখ্যান থাকে নিজের মতো করেই। যেমন করেছেন কবি বেণু দত্ত রায় তাঁর আলোচ্য গ্রন্থের প্রথম কবিতায়—
....... কেউ কি সত্যি কাউকে কোথাও ফিরিয়ে নেয়?
কেউ কি নিতে পারে?
ভাবি আর দেখি যে,
আমার চতুর্দিকে ছড়িয়ে গেছে গোলক ধাঁধাঁ।
পাসপোর্ট ও ভিসা অফিসের বাইরে দাঁড়িয়ে আমার চোখে জল নেই(মা-ভাগ হয় না)
মাটি ভাগ হয়- মা ভাগ হয় না.....
।। ৫ ।।
কবিতা শুধু ভাব দিয়ে লেখা হয় না। লেখা হয় ভাষার মাধ্যমে। আমাদের ভাষা আদৌ সক্ষম দেশভাগের স্মৃতি ও স্তব্ধতাতে ধরে? যে খণ্ড, বিচ্ছিন্ন চেতনা দেশভাগের ফলশ্রুতি, তার উপযুক্ত প্রকাশ সম্ভবপর হতে পারে কিনা কিংবা তা শিল্পসম্মত হল কিনা- তা বিচার করতে বসা অমার্জনীয় অপরাধ। বেঁচে থাকাটাই যেখানে চ্যালেঞ্জ, জীবনই সেখানে শিল্প হয়ে ওঠে।
দেশভাগ ও বাংলা কবিতায় নারীর স্বর আমাদের আলোচনায় উঠে এল না। বাদ থেকে গেল ট্রমা প্রসঙ্গ। দীপেশ চক্রবর্তীর ‘Remembered Villages Reperesentations Of Hindu Bengali Memories in the Aftermath of the Partition’ প্রবন্ধটির কথা উল্লেখ করতে হয়, যেখানে তিনি ইতিহাসের আখ্যানের সঙ্গে ট্রমা তাড়িত মানুষের অনুভূতির গড়নকে পড়তে চেয়েছেন। দেবেশ রায় আবার দেশভাগের সাহিত্যের স্বরূপকে চিহ্নিত করেছেন ‘এক নিরন্তর আত্মবিলাপ’-এর উৎস হিসেবে। বলছেন— ‘সে-সাহিত্যের মহত্ত্ব কোনও লেখাতেই ধিক্কৃত কোনও প্রতিপক্ষ নেই, ধিক্কৃত কেবল আমি নিজে, ধিক্কৃত কেবল আমার নিয়তি, ধিক্কৃত কেবল সেই ইতিহাস- নিয়তি যে- ইতিহাসের আকার নিয়েছে”। [৮]দেশভাগের কবিতা জাতীয়তাবাদের মতো শত্রু সন্ধান করেনি: অসাম্প্রদায়িক, মানবিক পরিচয়েই সে অনন্য।
দেশভাগ বাংলা কবিতার দেহে ও মনে এমনভাবে মিশে গেছে তাকে আলাদা করে দেখা মুশকিল। দেশভাগ যদি অস্তিত্বের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য হয়ে থাকে, তবে শিল্পে বিষয়ের ভিন্নতাতেও চেতনার উপস্থিতিকে সনাক্ত করা সম্ভব। দেশভাগ ও বাংলা কবিতা আমাদের সামনে তুলে ধরে বহুমাত্রিক পাঠসৃজনের অনন্ত সম্ভাবনাকে।
আপাতত থেমে যাবার পালা। অস্তিত্ব জেগে থাকুক অভিজ্ঞান নিয়ে।
কবিতার কথায় নীরবতা অমোঘ হয়ে ওঠে। দেশভাগ ও বাংলা কবিতার আলোচনায় কথাটি হয়ত আরও বেশি সত্য।
সূত্রনির্দেশ :
[১] দেশভাগ: আখ্যান রচনার সঙ্কট, দেশভাগ স্মৃতি আর সত্তা, সন্দীপ বন্দোপাধ্যায়, প্রগ্রেসিভ পাবলিশার্স, কলকাতা জানুয়ারী, ১৯৯৯, পৃ: ১-১২।
[২] ভূমিকা, পার্টিশন সাহিত্য দেশ কাল স্মৃতি, মননকুমার মন্ডল (সম্পা), গাংচিল, কলকাতা, সেপ্টেম্বর ২০১৪, পৃ: ২৬।
[৩] অর্ধেক জীবন, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, পৃ: ১৮।
[৪] স্মৃতির জোর, স্মৃতির দ্বিধা ও দুটি আখ্যানবৃত্তান্ত, জয়দীপ ঘোষ, বিতর্কিকা, প্রসঙ্গ: দেশভাগ, প্রথম বর্ষ, দ্বিতীয় সংখ্যা, অক্টোবর ২০১৩, পৃ: ১৯১-২০০।