• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৬৮ | সেপ্টেম্বর ২০১৭ | প্রবন্ধ
    Share
  • কুরুনথোকাই প্রেমগাথা : দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য

    সঙ্গমযুগের প্রাচীন তামিল কাব্যসংগ্রহগুলোর মধ্যে একটি হল কুরুনথোকাই। খৃষ্টিয় প্রথম ও দ্বিতীয় শতকের মধ্যে লেখা। ২০৫ জন কবির লেখা চারশো আটটি কবিতা রয়েছে।

    এখানে কবিরা কখনো স্বকন্ঠে কথা বলেননি। কবিতা তৈরি হয়েছে নায়ক, নায়িকা, তাঁদের বন্ধু, আত্মীয়স্বজন, রক্ষিতা এমন কি কখনও বা কোন পথচারির জবানিতে। এখানে পাঠক, লেখকের কন্ঠে একটি কবিতার ন্যারেশন শোনবার বদলে শুনতে পান তার চরিত্রদের নিজেদের মধ্যে কথোপকথন, কখনো বা প্রকৃতির সঙ্গে তাঁদের একান্ত আলাপচারী, আবার কখনো নিতান্তই কোন স্বগতোক্তি।

    ছোট ছোট নির্মেদ, দৃঢ়পিনদ্ধ বাক্যবন্ধে কাব্যের বহিরঙ্গে রূপ ফেটে পড়ে, আবার একই সঙ্গে অন্তর্লীন দ্যোতনায় ভাস্বর হয়ে থাকে এই ‘আক্কম’ (অর্থাৎ ‘অন্তর’-এর) কবিতাগুলি।

    বিশিষ্ট কোন স্থানকালের নির্দেশ থাকে না এদের মধ্যে। স্থানকালের সংকেতবর্জিত হয়ে কবিতাগুলি হয়ে ওঠে যেকোন সংবেদনশীল পাঠকের একেবারে নিজস্ব অনুভূতির শব্দমালা।

    কুরিঞ্জি, পালাই, মুল্লাই, নেয়তাল ও মারুতম--এই পাঁচটি গাছের নামে পাঁচটি স্থানবৃত্তের পটভূমিতে কবিতাগুলি লেখা। প্রতিটি স্থানবৃত্তের একজন করে অধিষ্ঠাত্রী দেবতা আছেন, কিন্তু তাঁরা সৃষ্টিকর্তা দেবতা নন। প্রতিটি এলাকার দেবতারা সেই এলাকার প্রকৃতির অংশবিশেষমাত্র। প্রতিটি স্থানবৃত্ত সাধারণভাবে প্রেমের একএকটি পর্যায়ের সঙ্গে জড়িত থাকে। কুরিঞ্জি হল পাহাড়ি এলাকা, প্রেমিকপ্রেমিকার মিলনভূমি। পালাই হল মরু অঞ্চল, বিরহের ক্ষেত্র। মুল্লাই--প্রেমিক/প্রেমিকার প্রত্যাশায় অপেক্ষার অরণ্যভূমি, নেয়তাল-- প্রেমিক বিরহের উত্তালহৃদয় সাগরবেলা আর মারুতম হল প্রেমে বিশ্বাসভঙ্গের কৃষিক্ষেত্র। কোন কোন কবিতায় আবার এদের মধ্যে একাধিক থিম মিলেমিশে যায়। বিভিন্ন শ্রেণীর কয়েকটি কুরুনথোকাই কবিতার বাংলা অনুবাদ এখানে সংকলিত হল।

    ক। কুরিঞ্জি


    নায়িকাসংবাদ

    কবি ইরায়ানার

    বৈদেহী হার্বার্টের ইংরিজি অনুবাদের থেকে


    রত্নপাখা মধুকর,
    মধুর সন্ধানে কাটে দিন
    কী মধু পেয়েছ খুঁজে বলে যাও
    (ক্ষতি নেই হয় যদি যাবতীয় স্বাদগন্ধহীন)
    এমন কোন কি ফুল পেলে খুঁজে, মধুগন্ধে যার
    ম্লান হয়ে যেতে পারে
    মধুর কেশের গন্ধ আমার প্রিয়ার


    নায়ক সংবাদ

    কবি তেভাক্কুলাত্তার

    জর্জ হার্টের ইংরিজি অনুবাদের থেকে


    পৃথিবী হতেও বড়,
    উঁচুতর আকাশের চেয়ে
    সাগরের অন্ধকার গর্ভদেশ
    তারও চেয়ে সুদূর গভীর
    এই ভালোবাসা
    কৃষ্ণবৃন্ত মধুবক্ষ কুরিঞ্জির
    পাহাড়ি ভূমিতে তার বাসা-

    (ঘননীল কুরিঞ্জি বারো বছরে একবার ফোটে। পাহাড় তখন নীল হয়ে যায়। সেই থেকে নীলগিরি)


    বিরহিনী বিলাপ

    কবি কপিলার

    এ কে রামানুজন-এর ইংরিজি অনুবাদ থেকে


    বৃষ্টিধোয়া ঐরাবতের মতন
    ওই যে পাহাড়খানি
    তারই কাছে গিয়েছিলাম জানি
    বৃষ্টিশেষে হাতটি ধরে হাতে
    আমার মিলনরাতে
    আজকে আমার শূন্যঘরে
    একলা প্রদীপ ক্লান্ত শিখায় জ্বলে
    পদ্মপলাশ চোখ দুখানি
    ক্লান্ত তোমার আসার আশায়
    আমায় ছেড়ে কোথায় গেলে চলে


    লালমাটি ও বৃষ্টিধারা

    সেমবুলা পেয়ানীরার

    জয়ন্তশ্রী বালকৃষ্ণণের-এর ইংরিজি অনুবাদ থেকে


    আমার মা-বাপ কে হয় তোমার, বলো?
    তোমায় আমায় নেইত পরিচয়
    লাল মাটি আর বৃষ্টিধারা যেন
    তোমায় আমায় তেমনি মিলন হয়



    খ। পালাই


    পথিকের উক্তি-আর্যদেশের বাজিকর

    কবি পেরুমপাতুমানার

    বৈদেহী হার্বার্টের ইংরিজি অনুবাদের থেকে


    পুরুষের হাতে তীর ও ধনুক
    পায়ে যোদ্ধার বালা
    মেয়েটির পায়ে নূপুর
    গলায় বন্যপুষ্পমালা
    বাঁশবনটির গভীর ছায়ায়
    হাতে হাত রেখে তারা হেঁটে যায়
    সর্ষের ক্ষেতে মর্মরধ্বনি
    সঙ্গত করে সাথে
    আর্যদেশের দুই বাজিকর
    লীলায়িত পায়ে দড়ির ওপর
    মাদলের তালে হেঁটে যায় যেন
    দুটি হাত রেখে হাতে


    হৃদয়ের উদ্দেশ্যে বিরহিণীর উক্তি

    কবি মামুলানার

    এ কে রামানুজন-এর ইংরিজি অনুবাদ থেকে


    কোরোনা কোরোনা দ্বিধা হৃদয় আমার
    বিরহবাসর জাগা আর নয়
    ধূলায় লুটিয়ে থাক হাতের কাঁকন
    চলো এইবার
    ‘কাট্টি’দেশ হয়ে গিয়ে পার
    যেতে হবে আরো দূরদেশে
    সেখানে আমার স্বামী
    যুদ্ধ করে প্রাণ রেখে বাজি
    নির্জন এ ঘর ছেড়ে আমি
    তাঁর কাছে চলে যাব আজই।


    পালিকা মায়ের উক্তি

    কবি অভইয়ার

    এ কে রামানুজন-এর ইংরিজি অনুবাদ থেকে


    যোদ্ধার বালা ধরেছে ছেলের বাহু,
    তরবারি তার হাতে
    মা গো তোর হাতে রামধনু রঙা চুড়ি
    সেজে থাক মধু রাতে
    চারটি গ্রামের বৃদ্ধেরা এক হয়ে
    যে কথা শোনায় সবে
    জানি আমি মা গো আজ তোর ভালোবাসা,
    তেমনই সত্য হবে।
    বাজুক নাকাড়া বাজুক শঙ্খ, বাঁশি
    আজ তার সুর মিলনের কথা কবে।


    গ। মুল্লাই


    নায়কের উক্তি

    কবি আয়ুভায়ার

    এ কে রামানুজন-এর ইংরিজি অনুবাদ থেকে


    আমি কি তোমার কথা ভাবিনি কখনো?
    তারপর বারেবারে ভাবিনি আবার?
    জীবনের শত ক্ষত বয়ে বয়ে ক্লান্ত দেহমনে
    ভেবেছি তো তোমাকেই শুধু!
    কামনার ভরাস্রোতে একদিন ডুবে যাওয়া তরু
    আরো একবার শুধু
    একটি অঞ্জলিভরা জলের তৃষ্ণায় বেঁচে থাকি


    ভাবিনি তোমার কথা আমি?



    ঘ। নেয়তাল

    বিরহোন্মাদ

    কবি কামাঞ্চের কুলাথর

    বৈদেহী হার্বার্টের ইংরিজি অনুবাদের থেকে


    বুকের ভেতর বহ্নিসাগর জ্বলে
    চোখপোড়ানো অশ্রুধারা
    যে মোছাত সোহাগভরে
    আমায় ছেড়ে সে গিয়েছে চলে


    নায়িকার উক্তি

    কবি পাতুমানার

    জর্জ হার্টের ইংরিজি অনুবাদের থেকে


    রাত্রি যুবতী হল-
    সমস্ত ঘৃণার অন্তে ক্লান্ত মানুষেরা নিদ্রাতুর।
    পৃথিবী ঘুমায়,
    শুধু সুষুপ্তির অন্ধ দেশে আমি
    একা জেগে বসে থাকি



    ঙ। মারুতম


    নিষ্ঠুর স্বামীর প্রতি স্ত্রীর সখীর উক্তি

    কবি কায়ানামার

    বৈদেহী হার্বার্টের ইংরিজি অনুবাদের থেকে


    কৃষ্ণকলি সখীর আমার
    মলিন তনুখানি
    যে ফুলখানি পায়নি খোঁপায় স্থান
    সোনার তোরংবন্দি হয়ে
    যাচ্ছে ঝরে, সইছে অপমান
    সখী আমার যেন সে ফুলখানি
    নেইকো মুখে ভাষা
    স্বামীর কাছে সখী আমার
    পায়নি ভালোবাসা
    সাগরকূলের দেবতা তার বর
    সেই যেখানে লবনজলে লক্ষ মাছের ঘর
    বেগনিরং শালুকফুলের দল
    ঢেউয়ের ছোঁয়ায় সতত টলমল
    জলের গায়ে শরীরমেশা
    সবুজপাতার ফাঁকে
    গভীর জলে শরীরডোবা যুবতিদের
    চোখের মতন পাপড়ি মেলে
    তাকিয়ে তারা থাকে।
    দুঃখটিকে সখী আমার
    মুক্তোহেন লুকিয়ে রাখে বুকে
    ভাগ পাবেনা কেউ
    জানে কেবল বেগনিরং শালুকফুলের দল
    জানে কেবল লবনজলের ঢেউ





    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ উইকিপেডিয়া থেকে
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments