আজ থেকে ছাপান্ন বছর আগের কথা। তখন টিনের দেওয়াল টিনের চাল একটা ঘরে বাবা মা ভাইয়ের সঙ্গে থাকি। ঘরের বাইরে এক চিলতে জমি, তাতে সকালের দিকে পড়তে বসতে হয়, সামনে দরমার বেড়া দেওয়া রান্নাঘর। সেকালে বিভুতি চৌধুরীর রচনার বই খুব চলত। কিভাবে যেন একটা হাতে এসেছিল। একটি লেখা কেন যেন আটকে যায় মনে। যখন আর কিছুই ভালো লাগত না, তখন সে বই খুলে একটা প্রবন্ধ উচ্চৈস্বরে পড়তাম। বিষয় জীবনানন্দ দাশের কবিতা। সে লেখার প্রধান মায়াবী আকর্ষণ ছিল জীবনানন্দ দেশের কবিতার একগাদা উদ্ধৃতি। জানতাম না জীবনানন্দ দাশ কে ও কিরকম। আর উদ্ধৃতির আগে পরে ভাষ্য। সেটা ছিল অদ্ভূত লাগসই। লিখেছিলেন নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়। লেখাটি বেরিয়েছিল নতুন সাহিত্য কার্তিক ১৩৬১তে। পরে ‘সাহিত্য ও সাহিত্যিক’ বইতে। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় নামটা অবশ্য তখন আমার জানা হয়ে গেছে। ক্লাস নাইনে স্কুল থেকে প্রাইজ পেয়েছিলাম — মহানন্দা। অনেকবার পড়তে পড়তে বন্ধুদের পড়াতে পড়াতে সে উপন্যাসটা কোথায় যেন হাওয়া হয়ে যায়। টেনিদার গল্প, চারমূর্তি সে সবও পড়েছি স্কুল জীবনে। উনিই কি জীবনানন্দের ওপর মায়াবিস্তারী প্রবন্ধটি লিখেছেন?
এর কয়েক বছরের মধ্যেই এসে গেল রবিঠাকুরের শতবর্ষ। ঘটনাচক্রে কলেজের রবীন্দ্র শতবার্ষিকী কমিটির সম্পাদক করে দেওয়া হল আমাকে। ঠিকঠাক লোক না পেলে যা হয়। কথা হল — এই উৎসবে আনতে হবে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়কে। একদিন দল বেঁধে গেলাম আমরা, পেয়েও গেলাম ওঁকে। গাঁইগুঁই একটু করছিলেন, কিন্তু আমাদের আগ্রহ দেখে করুণা হল হয়ত। রাজি হয়ে গেলেন। টেনিদার কল্যাণে পটলডাঙার গলি তখন আমাদের চেনা। নির্দ্দিষ্ট দিনে নারায়ণবাবুকে আনতে যেতে হবে। দায়িত্ব পড়ল আমার ওপর। ভীরু ভীরু বক্ষে পৌঁছালাম যথাসময়ে। খবর দিতেই বেরিয়ে এলেন। এসে গেছো? একটু বোসো, তৈরি হয়ে নিই। সেই অপরিবর্তনীয় সাদা ধুতি পাঞ্জাবী। আর মুখভরা হাসি। চলো — বেরিয়ে এলাম দুজনে। গলির মুখ থেকে উনিই ট্যাক্সি ডাকলেন। তারপর এ গল্প সে গল্প পড়া গল্প শোনা গল্প প্রধানত উনিই কথা বলছিলেন। আমার তখন ধন্য হবার বয়স। শুনতে শুনতে চলতে চলতে কখন যে কলেজ গেটে পৌঁছে গেছি খেয়াল ছিল না। তারপর কলেজ হলে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে ওঁর সেই অনুপম ভাষণ, বক্তব্য মনে নেই, কিন্তু ধ্বনি ঝঙ্কার, রবীন্দ্রনাথ তাঁর সাহিত্য, বিচিত্রতা — হাঁ ক’রে শুনছিলাম আমরা।
গল্প উপন্যাসের ক্ষুধার্ত পাঠক ছিলাম বলেই এম.এ. ক্লাসে ভর্তি হয়ে বিশেষ পত্র কথাসাহিত্য নেওয়ার ব্যাপারে মনে সংশয় ছিল না। তাছাড়া এক্ষেত্রে কাণ্ডারী নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় এবং রথীন্দ্রনাথ রায়। যাঁদের ‘সাহিত্যে ছোট গল্প’ এবং ‘ছোট গল্পের কথা’ আমাদের মনোহরণ করেছিল ইতিপূর্বেই। তাছাড়া গল্প লিখছি, ২/১ টা ছাপা হচ্ছে, দেমাক একটু গজাচ্ছে। এঁরা দুজন অবশ্য অন্য অনেক বিষয়ও পড়াতেন। নারায়ণবাবুর সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কবিতা পড়ানোর একটা ব্যাপার আজও মনে আছে। উনি সত্যেন্দ্রনাথের অনুবাদ কবিতা পড়াতে পড়াতে ‘সন্ধ্যার সুর’ কবিতাটির আলোচনা ধরলেন। একটা অনুচ্ছেদ পড়ালেন, তারপর বোদলেয়র এর মূল কবিতাটি Harmonis de Soir এর ওই অনুচ্ছেদটি শোনালেন, তারপর ওই একই কবিতার আর দুটো বাংলা অনুবাদের অংশ শোনালেন। হাতে কিন্তু ফরাসী বা বাংলা কোনো বই ছিল না। আলোচনা করলেন মূল টেক্সট ও অনুবাদের ধরণ ধারণ নিয়ে, হাসি হাসি মুখ। তুলনামূলক সাহিত্য বিচারের একটা দীক্ষা হয়ে গেল। ত্রৈলোক্যনাথ পড়ানো শুরু হল। লজ্জা লাগে তখনও ত্রৈলোক্য মাহাত্ম্য কিছুই জেনে নিতে পারিনি। ত্রৈলোক্যজীবনী পুরো একটা ক্লাস। তা যে গল্পের মতো বিস্ময়কর, ওঁর অনবদ্য উপস্থাপনায় যখন ঢেউয়ের মতো হাজির হল আমাদের কাছে আমরা ভেসে গেলাম। আমি ও আমার এক বন্ধু ত্রৈলোক্য সন্ধানে বেরিয়ে পড়লাম। শেষ পর্যন্ত ঘুরতে ঘুরতে খুঁজতে খুঁজতে শিয়ালদহ বসুমতী অফিস থেকে কয়েক টাকায় গ্রন্থাবলী কিনে শান্তি হল। নারায়ণবাবুর বড়ো গুণ ছিল তিনি সম্যুৎসুক ছাত্রছাত্রীদের মনে পাঠ্যবিষয়ের প্রতি স্থায়ী আগ্রহ বুনে দিতে পারতেন। ওঁর আলোচনায় প্রশ্নোত্তর সহায়ক ভঙ্গিটা ছিল না (যেটা আমরা রথীনবাবুর নাট্য আলোচনায় পেয়েছি)। কিন্তু বিষয়ের প্রতি দুর্নিবার আগ্রহ গড়ে দেবার ব্যাপারে জুড়ি ছিল না। আলোচ্য বিষয়কে করে তুলতেন প্রাণবন্ত অথচ তথ্য সমর্থিত। উপস্থাপনার এই ভঙ্গি গড়ে তুলত ছাত্রদের মন ও মনন — প্রান্তরে পলিমাটি প্রবাহের সঙ্গে যার তুলনা করা চলে। এক বর্ষাচ্ছন্ন দিনে গল্পগুচ্ছের ‘অতিথি’ গল্পটি পড়ানোর কথা আজও ভুলতে পারিনি। তারাপদ চরিত্রের বৈশিষ্ট্য বলতে বলতে পৌঁছে গেছেন শেষাংশে, যেখানে শুরু — “আকাশে নববর্ষার মেঘ উঠিল”। তারপর “দেখিতে দেখিতে পূর্বদিগন্ত হইতে ঘন মেঘরাশি প্রকাণ্ড কালো পাল তুলিয়া দিয়া আকাশের মাঝখানে উঠিয়া পড়িল, চাঁদ-আচ্ছন্ন হইল ....” উনি দেখালেন কিভাবে ঝড়ের আবহাওয়া বদলাচ্ছে, তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে এবং একই সঙ্গে ক্রিয়াপদের ধরন বদলাচ্ছে। যখন ব্যাপারটা সুতীব্রতায় পৌঁছাল তখন তারাপদ ভেসে গেল জীবনস্রোতে, ছিন্ন বাধা পলাতকের মতো। স্টাইলিস্টিক্স এর এই ধরণ, তত্ত্ব বিশ্লেষণের নীরসতা বর্জন ক’রে যে ছাত্রমনে সঞ্চার করে দেওয়া যায় তার পরিচয় পেয়ে মুগ্ধ ও বিমূঢ় হয়ে পড়ি। যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের ‘দু:খবাদী’ কবিতার সঙ্গে তাঁর হাত ধরেই পরিচয়। পরে জেনেছি স্যার লেখেন ‘কবি ভাবের কবি’ (পৌষ ১৩৬১), ‘মানুষ ও কবি যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত’ (চৈত্র ১৩৭৩), ‘কবি মোহিতলাল’ (ভাদ্র ১৩৫৯)-এ। যতীন্দ্রনাথ পড়াতে গিয়ে সমবয়সী কবিদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথকেও হাজির করেছিলেন আর বিশেষ বিশেষ পংক্তির রহস্যকে ভেঙে সাজিয়ে দিতেন আমাদের চোখের সামনে। সমস্ত বিষয়গুলো পড়ানোর কমন ব্যাপার — তুলনামূলকতা, জীবনপ্রসঙ্গ আর হাসি হাসি মুখ। শীতের দিনে সাদা ফিনফিনে পাঞ্জাবীর ওপর একটা ঘিয়ে রঙের শাল। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পড়ানোর মধ্যে শালটা ঝরে ঝরে পড়ত আর হাসতে হাসতে কথা বলতে বলতে সেই শালটা একটু তুলে কাঁধে তুলে দিতেন, আবার ঝরে পড়ার সুযোগ করা থাকত। ভাবতাম শালটা ঠিক মত রাখেন না কেন। তখন অনেক কিছুই ত ঠিকমত জানতাম না। অবাক করা ব্যাপার ছিল স্মৃতিশক্তি। স্মৃতিশক্তির লম্বা বহর সেকালের খ্যাতকীর্তি মাস্টার মশাইদের অনেকের মধ্যেই ছিল। শুনেছি নানা পূর্বজ শিক্ষকদের স্মৃতির অসামান্যতার কথা। কিন্তু কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাবিভাগে ষাটের দশকে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় এ ব্যাপারে একক। গদ্য মুখস্থ বলতেন হাসতে হাসতে। টিউটোরিয়াল ক্লাসের স্বল্প সংখ্যক ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে একদিন তিনি কি এক কথায় আমাদেরই এক সহপাঠীর সদ্যপ্রকাশিত একটি কবিতা আবৃত্তি করে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। কে একজন সাহস করে জিজ্ঞেস করেছিল টেনিদার সেই ডি লা গ্রান্ডি মেফিস্টোফিলিস ইয়াক্ ইয়াক্ কথার অর্থ। একটু হেসেছিলেন, কিন্তু বিচিত্রতা ছিল সে হাসিতে। টিউটোরিয়াল খাতা আগাগোড়া পড়তেন, বানান বা তথ্যভ্রান্তি দূর করতেন, শেষে খুদে খুদে অক্ষরে, বাঁ দিকে মন্তব্য লিখতেন। সই থাকত — না.গ.। একবার ক্লাসে ঢোকার আগে করিডরে চলতে চলতে রবীন্দ্রনাথের ‘শেষের কবিতা’র প্রসঙ্গ উঠে পড়েছিল। অল্পবয়সী উষ্ণতায় জানিয়েছিলাম বইটা আমাদের মোটেই আকর্ষণ করে না। শুনে হাসতে হাসতে বলেছিলেন, আরো বয়স হোক, তখন মর্ম বুঝবে বইটির। ওঁর ঈষৎ মেয়েলি বাচনভঙ্গি অবশ্য বিরক্তি আনত আমার মনে। তবে বিষয়ের অসামান্য উপস্থাপনা, প্রসঙ্গ সমূহের ব্যাখ্যা এবং পুনরাবৃত্তি বর্জন করে উপভোগ্য করে তোলা — এসব বৈশিষ্ট্যের কথা সিটি কলেজ পার হয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এবং আরো বহুদূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল। আমাদের সময়ে বাংলার একাধিক সেকশন ছিল। আমাদের সেকশনে ছাত্রছাত্রী সংখ্যা ছিল ১৬০ এর আগে পরে। এতদসত্ত্বেও শেষ দিকের দরজায় হাজির হত রবাহুত নারায়ণভক্তের দল, আমাদের কাছে ক্লাসে বসার অনুমতি চাইত। আমরা তাদের অনুমতি দিয়ে কিঞ্চিৎ আত্মতৃপ্তি পেতাম। নারায়ণবাবু বৈঠকখানা রোডের নতুন কেনা বাড়ি থেকে রিক্সায় বা গাড়িতে আসতেন। কলুটোলার দিকের গেট দিয়ে ঢুকতেন — একহাতে গোল্ডফ্লেকের টিন, অন্য হাতে ধুতির কোঁচা। এ ভাবেই দেখেছি দু বছর।
নারায়ণবাবু যে গল্পদক্ষ সেটুকু তাঁর গল্প পড়ে জেনেছি। কিন্তু নতুন পরিচয় পেলাম ক্লাসে পাঠ্য বিষয় স্থগিত রেখে গল্প বলা থেকে। একদিন হল সুনীতি চট্টোপাধ্যায়ের গল্প। সুনীতিবাবু পড়াচ্ছেন তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব — ঝড়ের বেগে। ছাত্ররা মুহুর্মুহু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ ছেলেদের ফিসফিসানো মুখের দিকে চোখ পড়ল সুনীতিবাবুর। সে ঘরে ছিল মাঝারি মাপের বোর্ড। সুনীতিবাবু ডায়াস থেকে নামলেন, দু’হাতে বোর্ড নিয়ে এগিয়ে গেলেন কথারত ছেলেদের দিকে। বোর্ডটা রাখলেন তাদের সামনের হাই বেঞ্চের ওপর। কোথায় বুঝতে পারছ না? এ প্রশ্নের উত্তর দেবে কে? ভয়ে তাদের মুখ বন্ধ। সুনীতিবাবু একটু আগে যা বলেছেন আবার তা বোঝাতে লাগলেন। বলাবাহুল্য মস্তিষ্ক ঘূর্ণ্যমান। আর একদিনের কথা। সুনীতিবাবু পড়িয়ে চলেছেন। দরজা দিয়ে কে যেন উঁকি মেরেই মুখ সরিয়ে নেয়। নজরে পড়েছে সুনীতিবাবুর। ত্বরিত গতিতে বই নামিয়ে রেখে ডবল কোঁচা মারা শিক্ষক ডায়াস থেকে নেমে দরজা খুলে ছুটে বেরিয়ে গেলেন। নারায়ণবাবুর ভাষায় — আমরা শুধু শুনতে পাচ্ছি করিডরে দুপদাপ শব্দ। কে যেন দেখতে পেল সুনীতিবাবু দৌড়ে ধরবার চেষ্টা করছেন ছেলেটাকে। সে দৌড়াচ্ছে প্রাণপণ। ভীত ছেলেটি এবার শুরু করে উল্টো দৌড়, সুনীতিবাবুও তাই। দুপদাপ শব্দ। কিছুক্ষণ পর গলদঘর্ম সুনীতিবাবু ক্লাসে ফিরে এলেন — না: ধরতে পারলাম না। বিভূতিভূষণের অন্যমনস্কতার কথা উঠল আর একদিন। তখন নারায়ণবাবু সিটি কলেজে। গ্রীষ্মের ভর দুপুরে হঠাৎ হাজির বিভূতিবাবু। সময়টা স্যারের কলেজ বেরুবার মুখে। আসুন দাদা, কি সৌভাগ্য আমার। শোনো নারাণ, শিয়ালদা তে নেমে ভাবলাম তোমার সঙ্গে একটু দেখা করে যাই। তবে হ্যাঁ, বেশীক্ষণ বসব না কিন্তু। ঠিক আছে, ঠিক আছে, আসুন আসুন বসুন। তারপর এ গল্প সে গল্প গাল গল্প কতোকথা। অল্পক্ষণ কখন যে দীর্ঘক্ষণে রূপান্তরিত তার খেয়াল নেই বিভূতিবাবুর। বিকেল গড়িয়ে আসছে। এবার সম্বিৎ ফিরল। উরেঃ বড্ড দেরী করে ফেললাম। তড়িঘড়ি উঠে পড়লেন। নারায়ণবাবু তাঁকে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরুলেন। বিভূতিবাবু যাবেন ট্রামে করে সজনীকান্তের কাছে শনিবারের চিঠির অফিসে। ট্রাম এল। বিভূতিবাবু ঝটপট উঠলেন। কিন্তু কি জানো, সে ট্রাম যাচ্ছে শনিবারের চিঠির গন্তব্যের বিপরীতে। এক্কেবারে সার্থক ছোটগল্পের আকস্মিক সমাপ্তি। ছাত্র ছাত্রীরা হেসে উঠল, স্যারও হাসলেন। আমাদেরও climax এবং ending শেখা হয়ে গেল।
১৯৭০ এর ৬ নভেম্বর স্যারের চলে যাওয়া। তখন উনি পঞ্চাননতলার বাসিন্দা। সে বাড়িতে অবশ্য সঙ্কোচবশত যাওয়া হয়ে ওঠেনি। তখন ওই পাড়ার কাছাকাছি একটা স্কুলে পড়াই। মনে আছে সন্ধ্যার প্রাক্কালে এক পেট্রোল পাম্পের সামনে স্যারকে দেখতে পেলাম, কিছু চপ জাতীয় খাবার নিয়ে চলেছেন বাড়ির দিকে। প্যাকেট অতিরিক্ত তৈলাক্ত বলেই এমন অনুমান। তার ২/১ দিন পরেই দু:সংবাদ পেলাম। ভীষণ মন খারাপ লাগল — আর তো পাব না সেই অসামান্য বাক্প্রভা। হারিয়ে গেল স্বপ্নস্নাত দিনগুলো।
আমি ছিলাম স্যারের ছাত্র, তবে একলব্যের মতো। ঘিরে ধরা সহপাঠী সহপাঠিনীদের থেকে দূরে ছিলাম, তার জন্য অবশ্য কোনো আক্ষেপ ছিল না। ওর ছাত্রীমনস্কতা পছন্দ হয় নি, উদার প্রগতিপনাও নয়। ওই সত্তর দশকেই বাংলা ছোটগল্পের এক পর্ব নিয়ে যখন গবেষণায় প্রবৃত্ত হই তখন নারায়ণবাবুর কথাসাহিত্য বিষয়ক চারটি বই আমাকে নিরন্তর প্রেরণা জুগিয়েছে। বিয়েতে উপহার পেয়েছিলাম, এক সহপাঠীর কাছ থেকে ‘সাহিত্যে ছোট গল্প’। সে বই আজও আছে, যদিও ‘মহানন্দা’ হারিয়েছি। ‘সাহিত্যে ছোটগল্প’ বইটা নাড়াচাড়া করতে করতে এ বিষয়ে স্যারের মডেল যে বই, সেটি অর্থাৎ Sean O’ Faolain এর The Short Story পড়ার সুযোগ পাই। ফাওলেন এবং নারায়ণবাবু দুজনেই প্রথিতযশা কথাসাহিত্যিক, এ দুটো বইয়ের প্যাটার্ন অনেকটা এক। অর্থাৎ গল্পচ্ছলে বলা, গল্প বলতে বলতে বিশ্লেষণ।
একদিনের কথা মনে পড়ে। কথাসাহিত্যের কিছু একটা আলোচনা করতে করতে চলে গিয়েছিলেন ভিক্টর হুগো প্রসঙ্গে। খাদ্যসংকট, দমদম দাওয়াই এবং অন্যান্য ক্রমবিক্ষোভ পার হতে থাকা আমাদের সেই ছাত্রজীবনে রাজনৈতিকতা সম্পৃক্ত গল্প উপন্যাসের দিকে নজর পড়েছিল বারংবার। ভিক্টর হুগো বোনাপার্ট এবং রাজা লুই ফিলিপ থেকে সরে পক্ষপাতী হয়ে উঠছিলেন গণতন্ত্রের দিকে, ৩য় নেপোলিয়নের প্রতি তীব্র অসহিষ্ণুতার জন্য তিনি ১৮৫১তে নির্বাসিত, ১৮৭০এ ফিরে পারীতে অভ্যর্থিত বীর ও দ্রষ্টা হিসেবে। তাঁর ‘ক্রমওয়েল’ নাটকটির ভূমিকা হয়ে উঠেছিল ফরাসী রোমান্টিক আন্দোলনের ম্যানিফেস্টো। হুগো ঘোষণা করেছিলেন সাহিত্য বিষয়ের স্বাধীনতা, চাইতেন সক্রিয়তার ঐক্য। Les Miserables (১৮৬২) তাঁর জনপ্রিয় উপন্যাসটি থেকে আমরা শিখছিলাম মানুষ মুলত: এক, গরীবেরা ধ্বংস হয়ে যায় সুবিন্যস্ত সমাজের অহং-এর চাপে, জাঁ ভালজার দুর্গতি সে তো তাঁরই। নারায়ণবাবু ছিলেন উদারপন্থী মার্কসবাদী, যার পরিচয় মেলে নানা সূত্রে। তাঁর মধ্যে ছিল রোমান্টিক বিপ্লবমনস্কতা। এসব আঁচ করেছিলাম তাঁর লেখা ‘প্রগতি সাহিত্যের গতি ও প্রকৃতি’ (আশ্বিন ১৩৫৮), ‘আমাদের স্তালিন’ (চৈত্র ১৩৫৯), মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় (পৌষ ১৩৬৩তে ৩টি লেখা), ‘হুইটম্যানের শ্রেষ্ঠ কবিতা’ (আশ্বিন ১৩১৫), ‘পাকা ধানের গান’ (মাঘ ১৩৬৫), ‘তৃতীয় ভুবন’ (শ্রাবণ ১৩৬৬), ‘দিনেশ দাসের শ্রেষ্ঠ কবিতা’ (আশ্বিন ১৩৬৬), ‘ছোটগল্প এবং এ যুগ’ (ফাল্গুন ১৩৬৬), ‘গোর্কীর উত্তরাধিকার’ (বৈশাখ ১৩৬৮) পড়ে। যাক্ সে কথা। হুগোর একটি তরঙ্গক্ষুব্ধ উপন্যাস প্রসঙ্গ তুলে পড়া থামিয়ে আমাদের হঠাৎ জিজ্ঞেস করেছিলেন নামটি। উপন্যাসটির নামটি কিভাবে যেন আমার জানা। দাঁড়িয়ে বলার পর তারিফ পেয়েছিলাম। এই আন্তর্জাতিক দৃষ্টিকোণ, তুলনামূলকতা কিভাবে অর্জন করতে হয় তার সবিস্ময় উদাহরণ দেবার মতো আর কেউ বোধহয় আমাদের চারপাশে ছিলেন না। এসব অবশ্য বুঝতে শিখি অনেক পরে। ওঁর কাছ থেকেই শিখেছি বাংলা ছোট গল্পকে বিশ্বসাহিত্যের পাদপীঠে স্থাপন করতে। তিনি দেখান বিশ্বসাহিত্যের শ্রেষ্ঠ ছোট গল্প সূচিত হয় যে চারজনের হাতে রবীন্দ্রনাথ তাঁদেরই একজন। আজ দীর্ঘদিন ধরে ছাত্রদের একথা বলে নারায়ণবাবুর নামোল্লেখ করে গুরুকৃত্য করে চলেছি। রবীন্দ্রনাথের ‘একরাত্রি’ প্রসঙ্গে আলফঁস দোদের Les Etoiles বা ‘নক্ষত্রেরা’? গল্পটি পড়ার সুযোগ পেয়ে দেখেছি কি অব্যর্থ নির্বাচন। অথবা তারাশঙ্করের ‘নারী ও নাগিনী’ প্রসঙ্গে বালজাকের A passion in the Desert. দোদের la Derniere classe বা ‘শেষ ক্লাস’ গল্পটি ওঁরই সূত্রে পড়া। ফরাসী গল্পের ফরাসী নাম, ফরাসী উচ্চারণ - ভাষাটা শেখবার প্রেরণা জুগিয়েছে। উনি ফরাসী ভাষাট অতীব যত্নে শিখেছিলেন, শুনেছি রুশটাও ভালই জানতেন। যত্ন করে পড়লে ‘সাহিত্যে ছোটগল্প’ বা ‘ছোটগল্পের সীমারেখা’ থেকে অনেক খণ্ড আলোর সংকেত মেলে।
১৩৫৬ তে জগদীশ ভট্টাচার্য জানিয়েছিলেন ‘নারায়ণ শুধু প্রতিভাবানই নন, সমসাময়িক যুগের প্রতিনিধিস্থানীয়ও বটেন। ....জীবন ও জগৎকে দেখার অতন্দ্র দুটি চোখ আছে লেখকের আর আছে খাপখোলা তলোয়ারের মত ঝকঝকে গল্পবলার ভাষা। তাঁর গল্পে আছে চরিত্র ও বিষয়বস্তুর বিস্ময়কর বৈচিত্র্য, বিচিত্রস্বাদী গল্প রচনার অনায়াস পটুত্ব। ২য় মহাযুদ্ধ ও মন্বন্তরের পটভূমিতে তাঁর বিকাশ। নক্রচরিত, দু:শাসন আর পুষ্করা গল্পে মানবসৃষ্ট যুদ্ধ ও মন্বন্তরের ক্রোধ স্পষ্ট উচ্চারিত। দুঃশাসন বাংলাকে করেছিল বিবস্ত্রা। তাই নারায়ণ লেখেন ‘দুঃশাসন’, মানিক লেখেন ‘দুঃশাসনীয়’। সোমনাথ লাহিড়ী লেখেন ‘কাপড় চাই’। শেষেরটি অবশ্য তথ্যমুখ্য প্রবন্ধ। উত্তমপুরুষে লেখা ও গল্পে ভগ্নস্বপ্ন আদর্শভ্রষ্ট স্কুল শিক্ষকের আত্মাধিক্কারের কাহিনী। ব্যবসাদার দেবীদাস কাপড় দিতে চায় না। যাত্রা পালার জন্য পঞ্চাশ টাকা চাঁদা। অর্ধনগ্ন অর্ধভুক্ত মানুষদের সামনে পালা। দেবীদাস ভুলেছে ‘করুক্ষেত্রের যুদ্ধ ফিরে এসেছে বাংলা দেশে। গৌরদাস বোঝে সারা পৃথিবী জুড়েই দ্রৌপদীর আর্তনাদ। পালা দেখে জাগরণক্লান্ত দেবীদাস দেখে ফসলরিক্ত মাঠের ধারে চাষীরা হেঁসোতে শান দেয়। দেখে ভয় ধরে। সার্থক ইঙ্গিতবাহী সমাপ্তি। ‘হাড়’ আর একটি বিখ্যাত গল্প। উত্তমপুরুষে বর্ণিত গল্পটি শ্লেষ ব্যঙ্গে ভূষিত। দুর্ভিক্ষের পটভূমিতে বেকার যুবক পিতৃবন্ধু বিত্তশালী রায়বাহাদুরের কাছে চাকরীপ্রার্থী হয়ে যায়। আবহ নির্মিত হয় বুভুক্ষু মানুষের জমায়েতে, চতুর্দিকে যেমন ক্ষুধার্ত মানুষ, বাড়ির ভিতরে উগ্রমধুর পুষ্প গন্ধ। বাবা ছিলেন আদর্শবাদী, বাবার বন্ধু উঠেছেন বিত্ত শিখরে তাই চাকরি না দিয়ে অ্যাডভেঞ্চার ও অ্যাকটিভ সার্ভিসে নামার জ্ঞান দেয়। আত্মপ্রসাদে গরিমাময় রায়বাহাদুর বেকার যুবককে দেখান ছোট বড় হাড়ের টুকরো। দুর্ভিক্ষ ও ভিখারীতে পরিণত হওয়া সমাজ দেখে যাদুবিদ্যায় বিশ্বাস না করে উপায় থাকে না। নিপুণ কনট্রাস্ট ও শ্লেষে বঙ্গসমাজের চেহারা দেখাতে চান লেখক। হাড়সার মানুষ তারা আজও পায়নি বিদ্রোহের মন্ত্র। এ গল্প পড়তে পড়তে সুকান্তের বেশ কিছু কবিতা, দীনেশ দাসের ‘কাস্তে’ কবিতাটি মনে পড়ে। গল্প বক্তব্যবাহী, কিন্তু শিল্পধর্ম অক্ষুন্ন।
‘রেকর্ড’ গল্পের আবহ ক্ষুব্ধ স্বদেশ ভূমি থেকে প্রসারিত হয়ে চলে ক্ষুব্ধ বিশ্বভূমিতে। বৈঠকখানা বাজারের অন্তরালে পুরোনো রেকর্ডের দোকান থেকে কেনা হয় এক দুর্বোধ্য ভাষার একটি গানের রেকর্ড, যার সুর শুনলেই মনে জেগে ওঠে তীব্র এক অস্বস্তি। বক্তার অধ্যাপিকা স্ত্রী, বক্তা, স্ত্রীর বান্ধবী কেউই এই অস্বস্তি বাড়ানো গানের ভাষা উদ্ধার করতে পারে না। কেউ বলে খাসিয়াদের গান, কেউ বলে ছৌ পরবের গান, মনে আসে বিয়াল্লিশে পুলিসের বুলেটের সামনে দাঁড়ানো বালুরঘাটের সাঁওতালি সম্প্রদায়ের স্বর। শেষ পর্যন্ত এক ভূপর্যটক জানেন এ রেকর্ড নাৎসী বিরোধী গান, যার শিল্পিরা নাৎসীদের রাইফেলের গুলিতে প্রাণ দিয়েছে। গোপনে তৈরি হওয়া এ রেকর্ড নষ্ট করে ফেলার চেষ্টা হয়। গল্প শেষ হয় বক্তার স্ত্রীর অসহ্য ঘৃণার স্বরে — এ রেকর্ডকে কেউ নিশ্চিহ্ন করতে পারেনি। কেউ পারবে না। এ গল্প থেকে লেখকের অনির্বাণ প্রতিবাদ মনস্কতার দিকটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। গল্পটি পড়তে পড়তে পড়াতে পড়াতে বহুবারই কল্পনা করেছি খুঁজতে খুঁজতে আমিও হয়ত একদিন এমন একটা প্রতিবাদী রেকর্ডের সন্ধান পেয়ে যাব। সত্যি কথা বলতে গেলে প্রতিবাদী শিল্পের এমন নিদর্শনের সামনাসামনি হয়ে ওঠার সৌভাগ্য যে হয়নি, তা তো নয়। ‘একটি শত্রুর কাহিনী’ গল্পে আছে বিচিত্র এক প্রসঙ্গ। পাদ্রি ডোনাল্ডস বুড়ো হয়ে যাওয়ায় জার্মান যুবক হ্যানস এল ভারতে, বাংলার রুক্ষ এক অঞ্চলে। যুবক হ্যানস্ খেলে দৌড়ে মিশে যেতে চায় এ দেশের বাচ্চাদের সঙ্গে। জোসেফ অভিভূত হয় ভিন্নধাঁচের আচরণ দেখে। হ্যানস ধর্মপ্রচারের বিরোধী। বুড়ো ডোনাল্ডস ভারতবর্ষে এসে প্রেমধর্ম প্রচার করতে ম্যালেরিয়াগ্রস্ত হয়, তার মধ্যে জাগে এক অমানুষিক ঘৃণা। ডোনাল্ডস্ হ্যানসকে মারামারি করতে দেখে তাকে চলে যাবার আদেশ দেয়। জোসেফ বলে হ্যানস খৃষ্টত্বের মধ্যে এক নব জুডাস। গ্রেপ্তার হয়ে যাবার পথে যুদ্ধজয়ের কামনায় কালী পূজা হচ্ছে, সরকার টাকা দিয়েছে, উদ্যোক্তা ম্যাজিস্টেট জেনে জলের ফ্লাস্ক ছুঁড়ে হ্যানস কালীমাতার মাথা চূর্ণ করে দিয়ে শিবের গাজন নাচতে থাকে, ঘোষণা করে এবার সে সত্যই ভারতের শত্রু। বহুমাত্রিক এই গল্পে আছে খৃষ্টধর্মপ্রচারের মাধ্যমে নয় মিশে একাত্মতা তৈরির চেষ্টা, ইংরেজ ও জার্মান দ্বান্দ্বিক মনোভাব ইত্যাদি। অন্যদিকে ইংরেজবিরোধিতা ও কালী বিরোধিতাও। ‘কালনেমি’ গল্পে ভারতের স্বাধীনতা, চা বাগিচার সাহেবদের শঙ্কা এবং নেপালীদের গোর্খাল্যান্ড কামনা। পনেরই আগষ্ট সাহেবের জাতীয় পতাকা তোলা, ইংল্যান্ডে শ্রমিক সরকারের সমালোচনা, নেপাল সরকারের সঙ্গে নতুন কলোনী গড়ার পরিকল্পনা ইত্যাদি মিশিয়ে থিমেটিক পটভূমিটি বৃহৎ। সাম্রাজ্যবাদী অ্যাঞ্জেল গোর্খাল্যান্ডের দাবিকে উস্কে দেয় ধনরাজ গুরুংকে সামনে রেখে। উত্তরবঙ্গ আসামব্যাপী ভাটিয়া খেদাও আন্দোলনের কথা ও আছে। ধনরাজের নেতৃত্বে ভাটিয়া আক্রমণ, খাসিয়া পাহাড়ে বেআইনি বেতারে সমতল বিরোধিতা, তারাপদ ডাক্তারের নিরপেক্ষ থাকার ব্যর্থতা, শোষকদের মূলধন রক্ষার চক্রান্ত ফাঁসে পরিতোষের স্থানান্তর, আড়াইশ কুলির পদযাত্রা, জাতীয় পতাকার মর্যাদা রক্ষায় তারাপদর রক্তাক্ত হওয়া, অ্যাঞ্জেল সাহেবের রাইফেল গর্জনে মৃত্যু মুহুর্মুহু নাটকীয়তা গড়ে তুলেছে। ‘ইঁদু মিঞার মোরগ’ গল্পে আছে এক ঝলক সরসতা। ‘ইঁদু মিঞা অনেক মোরগ মেরেছে কিন্তু কোলে ঝাঁপিয়ে পড়া একটি মোরগের প্রতি তার দুর্বলতা। লোকে ঠাট্টা করে বলত ওটা ‘ইঁদুর ধর্মব্যাটা। দফাদার মোরগটি জোর করে নিয়ে যায়, দারোগা তার কাছ থেকে কিনে নেয়, ইনস্পেকটর আবার কিনে জিপে উঠতেই মোরগটা ড্রাইভারের হাত ঠুকরে পালায়, তাড়া করে ধরতে গিয়ে ইনস্পেকটর হাঁটু ভাঙে। তার হাঁটু জোড়া লাগে একসময় কিন্তু কর্তব্যচ্যুতি দফাদায়ের চাকরি যায়, ঘুষ নেবার অভিযোগে দারোগা সাসপেন্ড হয়। ‘ইতিহাস’ গল্পটি অনেকটা ডাইডাকটিক হলেও নারায়ণবাবুর স্বদেশ ও ইতিহাসচেতনা হয়েছে স্পষ্টবাক। রিটায়ার্ড হেডমাস্টার অমরেশ নতুনভাবে পঞ্চগৌঢ়ের ইতিহাস লিখছেন। মেয়ে প্রণতি বি.এ. পড়ে, ছেলে লোকেশ ইকনমিক্সে এম.এ., বিয়াল্লিশের আগষ্ট বিপ্লবে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, কারাবরণও হয়েছে। বৃদ্ধ অমরেশ বলে — ‘ভাবনা ছাড়া আর কী করব বল। বাইরে যখন পথ বন্ধ তখন মনের মধ্যেই ইচ্ছেমতো চলে বেড়াই’। তার ইতিহাস রচনার লক্ষ্য স্বদেশবাণীকে সচেতন করা। থানা আক্রমণে লোকেশ নিহত, তার বন্ধুরা কারারুদ্ধ। প্রবল বন্যায় বিপন্ন গ্রামবাসীদের সঙ্গে দারোগা তার বৌ বাচ্চা সবাই এসে আশ্রয় নেয় অমরেশের বাড়িতে। ‘লালঘোড়া’ গল্পে বর্ষণমুখরিত এক রাত্রে বর্ণনাকারী তার ছোটবেলার বাড়িতে থাকা লালঘোড়ার কথা স্মরণ করছে। অত্যন্ত তেজী ঘোড়া বাবার বাহন। ইরানী বেদেদের গ্রাম ছাড়া হবার আদেশ দেওয়ায় তারা সম্ভবতঃ ঘোড়াটিকে বিষ খাওয়ায়, সে পাগল হয়ে যায়। নিষেধ অগ্রাহ্য করে একদা এই পাগল ঘোড়ায় চেপে বসতে সে দৌড়তে থাকে। তারপর শ্মশানে আসে, বর্ণনাকারী অজ্ঞান হয়ে পড়ে। জ্ঞান এলে লক্ষ্য করে সমাগত শিয়ালের আক্রমণ ঠেকাচ্ছে এই ঘোড়াটি। তার বাবা দলবলসহ খুঁজতে খুঁজতে এসে ছেলেকে ও পাগলা ঘোড়াকে খুঁজে পায়। বাবার গুলিতে নিহত হয় ঘোড়াটি। লেখক গল্পশেষে মন্তব্য করেন ঘোড়াটি যেন খুঁজে নিতে চেয়েছে — মৃত্যু আর মুক্তি।
‘একটি কৌতুকনাট্য’ সিরিও কমিক গল্প। মামার ছোট ছেলের অন্নপ্রাশনে নিমন্ত্রিত হয়ে যান গল্পকথক। উৎসব বাড়িতে বাচ্চাটার সোনার হার চুরি যায়। মামার বড় ছেলে টোকনদা একটা বাইরের লোককে চোর সাব্যস্ত করে। গালাগালি মারধর প্রচুর করে এই টোকনদাই। সে লোকটা কাঁদতে কাঁদতে বলে সে ভিক্ষুক, কিছু উচ্ছিষ্ট সন্ধান করছিল। কিন্তু টোকনদা তা বিশ্বাস করতে নারাজ। মামা লোকটাকে সন্দেশ খাওয়ায়। কারণ জানা যায় তার ছেলে টোকনদা নিজেই চুরি করে স্যাকরাকে বেচে দেয়। মামা সেটা জানতে পেরে লোকটাকে সন্দেশ খাইয়েছিল। সবার সামনে নিজের ছেলের চুরির কথা ফাঁস করেনি। গল্পটিতে নাট্যগুণ যথেষ্ট, কিন্তু কৌতুকরস যথেষ্ট নয়। নদী জল, জেলে, নদীর আবহ নিয়ে অনেকগুলি গল্প আছে। যেমন — কালো জল, তীর্থযাত্রা, গন্ধরাজ, দোসর, ঘূর্ণি, কালাবদর, সাধুভাষায় লেখা গল্প- ছলনাময়ী, আত্মহত্যা।
‘শিল্পী’ বক্তব্যমুখ্য গল্প। কোনার্কের পটভূমিতে জানা যায় শিল্পসাধক সনাতনের বিড়ম্বনাময় জীবনের কথা। যুগ পরিবর্তনে, শিপ্লের মর্যাদা হারায়, অর্থ ঘরে আসে না বলে বৌ যায় ক্ষেপে। শেষে সনাতন পুরীর পাণ্ডাদের সাকরেদগিরি করে পেটের ভাত জোগাড় করে। যুগ পরিবর্তনে শিল্প মর্যাদার ভ্রষ্টতা এ গল্পের মধ্যে গুরুত্ব পেয়েছে। ‘উস্তাদ মেহেরা খাঁ’ সমগোত্রীয় গল্প। ওস্তাদি গানের কদর গেছে কমে, কিন্তু এইসব শিল্পীদের বিশেষ করে মেহেরা খাঁর ফাঁকির কারবার ছিল না। মেহেরা আততায়ীর হাতে বিপর্যস্ত হয়। ‘বিসর্জন’ গল্পে এক আশ্রিত অতিবৃদ্ধা সব সময় খিদের কথা বলে। তাতে অভাবী সুদাম আর তার বৌ তুলসী স্বাভাবিক ভাবেই বিরক্ত বোধ করে। একদিন বৌ বাপের বাড়ি গেলে সুদাম বুড়িকে মন্দির দেখানোর ছলে নিয়ে চলে নৌকায় নদীচরে বিসর্জন দেবে বলে। বুড়ি এই যাত্রাপথে খিদের কথা বলেনি, বরং কাশি হচ্ছে বলে সুদামের বুকে হাত বুলিয়ে দিতে চায়। সুদাম বিচলিত হয়। বৌ ছেলের কথা জিজ্ঞেস করলে একের পর এক মিথ্যে কথা বলে। বুড়ি মরার কথা ভাবছিল, সুদাম ভাঁটার টানে নৌকা নিয়ে গিয়ে চরে রেখে পালাতে চায়। শীত করছে বলায় বুড়ির গায়ে কোমরের লাল গামছাটা জড়িয়ে দেয়। কি ভাবে লোকের, বউয়ের প্রশ্ন সামাল দেবে ভাবতে থাকে। বুড়িকে চরে বসিয়ে রাখার পর চলে আসতে গিয়ে কুমির দেখে বিরক্ত হয়। কুমীর পড়ায় এবার বুড়ি চেঁচিয়ে খিদের কথা বলে। সুদাম এবার পরাভূত। চমৎকার রচনা হয় সাসপেন্স। দুটো চরিত্র আবহ জীবন্ত হয়। ভূশণ্ডীর কাক, ধূমাবতী প্রভৃতি ঘৃনার্হ উপমা বুড়ি চরিত্রে প্রযুক্ত হয়ে গল্পটিকে বিশিষ্টতা দেয়। ‘নেতার জন্ম’ গল্পে তীব্র তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গে ঝলসে উঠেছে লেখকের ক্ষুরধার লেখনী। ডাক্তার বটব্যালের আচরণে বৈপরীত্যে আদর্শবাদের স্বপ্নে, স্বপ্নভঙ্গে, দেশজ পরিস্থিতির অপ্রত্যাশিত পরিণতি প্রদর্শনে লেখক তাঁর ক্ষুব্ধ সত্তার উন্মোচন করেছেন। বটব্যাল ডাক্তারি পাশ করে স্বদেশসেবার ব্রত নিয়েছিলেন। কিন্তু চিকিৎসার বিরূপ পরিস্থিতি, শহর ও গ্রামের বৈপরীত্য, টাকার স্বাদ বটব্যালকে ক্রমশ: বদলে দিতে থাকে। এক গরীব বিধবার সন্তানকে বাঁচাতে ব্যর্থ হন, কিন্তু তালুকদার রামদাসের স্ত্রীর প্রসব হয়, একশ টাকা মেলে। সেই শিশু সন্তানই একদিন হয়ে ওঠে রাজনৈতিক নেতা, যাদের লোভ ও স্বার্থসিদ্ধির কাছে দেশ সমর্পিত। গল্পে বাহুল্য নেই, কিন্তু উনি যাকে বলতেন pointing finger তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে লেখনী নৈপুণ্যে।
আমার আর এক মাস্টারমশাই উজ্জ্বলকুমার মজুমদার বলেন — নারায়ণবাবু যেসব গল্পে খ্যাতি পেয়েছিলেন সেগুলির অধিকাংশই চল্লিশ দশকের যুদ্ধ, মন্বন্তর, অপশাসন, খাদ্যাভাব, বস্ত্রাভাব, আন্দোলন, শ্রেণীগত ব্যবধান, উঁচুতলার অমানুষিকতা, দাঙ্গা ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে লেখা। তাছাড়া বিষয়বৈচিত্র্যে এই লেখক ছিলেন অফুরন্ত। শেষপর্বে তাঁর গল্পে অতিশয়োক্তি ও নাটকীয় আলংকারিকতা কমে এসেছিল, খুবই সংযত ও পরিমিত ভাষায় সুখদু:খ ও আকাঙ্ক্ষার পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারতেন তিনি। তাঁর মধ্যে ছিল এক তীব্র রোমান্টিক ভাবনা। ছাত্রজীবনের অপরিণত মানসিকতা নিয়ে মাস্টারমশাইকে পরিমাপ করার চেষ্টা করতাম। উপন্যাসে বা ছোটদের পরিহাস সমুজ্জ্বল টেনিদা গল্পে যে লেখক মানুষটি ধরা দিতেন, সুনন্দর জার্নালে তা অবশ্য নয়। রোমান্টিক নারায়ণবাবু মজা করতে করতে যুগ ও জাতীয় জীবনকে নিজের মতো করে পরিমাপ করার চেষ্টা করতেন। পঞ্চাশের ও ষাটের দশকে বাংলা কথাসাহিত্য যে নানা মোড় নিচ্ছিল তার মধ্যে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় কম আকর্ষণীয় হয়ে পড়লেন এটা ঘটনা। আজ মনে হয়, নারায়ণবাবু পরিণত বয়সে হয়ে পড়েছিলেন উদারনৈতিক মার্কসিস্ট। তার সঙ্গে অ্যাকাডেমিক সত্তার এক অপূর্ব সম্মেলন ঘটে গিয়েছিল যাতে আমরা যাদের মার্কসিস্ট লেখক বলে গণ্য করি তাতে তাঁকে রাখাও চলে না আবার সরাসরি ভিন্ন শিবিরেও ফেলা চলে না। রুশ সাহিত্যের নিবিষ্ট পাঠক ছিলেন তিনি। কয়েকবছর আগে ‘উপনিবেশ’ নতুন করে পড়তে গিয়ে দেখলাম সলোকভ খুব বেশি করে মনে পড়ছে। বিশেষতঃ ডন নদী সংস্পৃষ্ট মহাকাব্যিক উপন্যাসগুলি। And quiet Flows the Down বা Virgin soil upturned মনে রেখেই কথাটা বলছি। ম্যাক্সিম গোর্কি বলতেন লেখক হবেন কালের কন্ঠস্বর। লেখক পিতার মতো পরম স্নেহে পরম যত্নে পাশে থেকে বুঝিয়ে দেবেন কোনটা উচিত, কোনটা অনুচিত। নারায়ণবাবু, আমার সন্দেহ নেই, হতে চেয়েছিলেন কালের কন্ঠস্বর। তিনি আমাদের কাছে পিতৃপ্রতিম শিক্ষক। গোর্কির পরবর্ত্তীকালে চিনুয়া আবেবে লেখককে শিক্ষকরূপেই পেতে চেয়েছিলেন। নাদিনে গর্দিমারও তাই। এইসব দেখে আমার মনে হয় কথাসাহিত্যের দুনিয়ায় এ আর এক ঘরাণা। লেখা হবে শিক্ষকের এই ধারণাটা মোটেই অপাংক্তেয় নয়। তবে তিনি কতোদূর প্রচ্ছন্ন থাকবেন তা নিয়ে বিতর্ক চলতে পারে। আজকে, কয়েকদশক জুড়ে, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে লেখা ও লেখককে এই শিক্ষাপ্রেরণার জগৎ থেকে সরিয়ে দূরে নিয়ে যাবার একটা চক্রান্ত চলছে। একে কাউন্টার না করলে সম্পূর্ণ বিনাশ অবশ্যম্ভাবী।
ছোটগল্পের টেকনিক নিয়ে বইপত্রের সংখ্যা কম। বাংলায় আরও কম। আমরা যখন ছাত্র তখন নারায়ণবাবুর ‘সাহিত্যে ছোটগল্প’ এবং তারপরে রথীন্দ্রনাথ রায়ের ‘ছোটগল্পের কথা’ বই দুটি থেকে টেকনিক সংক্রান্ত অনেক কিছু শিখেছি। তারও পরে এসেছে অরুণ মুখোপাধ্যায়ের ‘কালের পুত্তলিকা’। নারায়ণবাবুর পড়ানোতে টেকনিকের উদাহরণ সহ আলোচনার কথা পূর্বে কিছু বলেছি। তাঁর বিষয়বস্তুর আলোচনা হল। এবার আসা যাক টেকনিকে।
ভাষা ও বর্ণনা:
নারায়ণবাবুর গল্পে রোমান্টিক প্রবণতার প্রকাশ পর্যাপ্ত। এই প্রবণতা ভাষা ও শব্দ নির্বাচনে প্রভাব ফেলেছে। তার মধ্যে কবিত্ব আছে, তেমনি আছে বুদ্ধির দীপ্তি। তিনি বর্নদীপ্ত চিত্ররচনা করতে ভালবাসেন, তবে আবেগকে উচ্ছ্বাসের হাতে কখনই সঁপে দেন না।
১) সুন্দরলালের ওপর এখন পুরোপুরি ঠাকুরের আবির্ভাব। বুড়ো জেঠা টুডুকে সে বাতলে দিচ্ছে হাঁপানির ওষুধ। দিগদিগন্ত উদ্ভাসিত করে নির্মল চাঁদের আলো অসীম প্রীতি আর বিশ্বাসের মতো ঝরে পড়েছে — ছড়িয়ে যাচ্ছে যেন রজনীগন্ধার অসংখ্য ছিন্ন পাপড়ি। মহুয়ার গন্ধে শালফুলের বিষাক্ত বিশ্বাস চাপা পড়ে গেল। (বীতংস)।
[সুন্দরলাল চা বাগানের আড়কাঠি। সরল সাঁওতালরা তাকে বিশ্বাস করেছে, কিন্তু তাদের আসন্ন বিপদ সম্পর্কে তারা অজ্ঞাত। আপাত রোমান্টিকতার আড়ালে এই বিপদসংকেত নাটকীয়তার স্বাদ বহন করে।]
গ্রাম ও অরণ্য পটভূমির গল্পে প্রয়োজনীয় পর্যাপ্ত প্রকৃতির সান্নিধ্য গল্পকে যেমন পরিবেশগত করে, তেমনি শহর ও নাগরিক পটভূমির গল্পে বুদ্ধির দীপ্তি, ব্যঙ্গের বিদ্যুৎ ঝলসে উঠেছে বারে বারে। দুই ক্ষেত্রেই তৎসম শব্দ বাহুল্য লক্ষণীয়। ভাষা কিন্তু কখনও নির্জীব নয়, তা ক্ষিপ্রগতি সম্পন্ন।
২) প্রসারিত রাসবিহারী অ্যাভিনিউ। মোটর-ট্রাম-মানুষের অবিচ্ছিন্ন স্রোতধারা। মাথার ওপর এরোপ্লেনের পাখার শব্দ — জাপানী দস্যুর আক্রমণ আশঙ্কায় পাহারা দিচ্ছে। দি লায়ন হ্যাজ উইংস। (হাড়)
৩) শ্মশানের ওপর হাড়ের স্তূপ আকাশ ছোঁয়া হতে থাকবে, তত উঁচু হয়ে মাথা তুলবে মথুরা দাসের কড়ির পাহাড়। (কালোজল)
লেখক অত্যন্ত বর্ণনা নিপুণ — প্রকৃতি ও মানব বর্ণনায়।
৪) মেয়েদের উজ্জ্বল চোখ গুলিতে, সুঠাম সম্পূর্ণ দেহশ্রীর ওপর দিয়ে জ্যোৎস্না গড়িয়ে পড়তে লাগল তরল লাবণ্যের মতো। (বীতংস)
৫) মাথার ওপরে বুনোহাঁসের পাখা জ্যোৎস্নার রঙ মেখে ভেসে চলে গেল। (তৃণ)।
দুর্ভিক্ষ, মহামারীর ছায়াপাত বর্ণনা।
৬) পচা মাটি আর পাতার অত্যুগ্র গন্ধ ভাসছে যা বাঘের গায়ের গন্ধের মতো। একটা রক্তাক্ত হিংস্র হাসির আভায় দিগন্তকে উদ্ভাসিত করে চাঁদ উঠল — শেষ প্রহরের খণ্ড চাঁদ। (কালোজল)
বীভৎস বর্ণনার উদাহরণও কম নেই
৭) মাথার ধুলো মাখা চুলগুলো জট পাকানো। সমস্ত মুখে ব্রণ অথবা বসন্তের গভীর ক্ষতাঙ্ক; একটা রক্তাক্ত ক্ষতে নাকটা খসে পড়বার উপক্রম করছে, নিশ্চয়ই অকথ্য ব্যাধিতে। দুটো বড় বড় কীট দষ্ট দাঁত বেরিয়ে আছে ফাটা ঠোঁটের দরজা দিয়ে। (নিশাচর)।
ন্যারেশনের তির্যকতা:
৮) রেশন কার্ডের অবরুদ্ধ অঞ্জলি দিয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় ঘা চুঁইয়ে পড়ে তাতে চিঁড়ে ভেজে না। (ভাঙাচশমা)
৯) চলুক, চলুক, যুদ্ধ চলুক। বোমারই বুম নয়, ব্যবসায় বুম, চায়ের বাজারে বুম। যুদ্ধ দেবতার কুঠার মানুষকে হত্যা করে, কিন্তু তার ফলটা সোনায় তৈরি। (সোনালী বাঘ)।
রোমান্টিকতা এবং নাটকীয়তার দিকে নারায়ণবাবুর প্রবণতা থাকায় তাঁর রচনায় উপমার বহুল প্রয়োগ চোখে পড়ে।
১০) বিদ্রোহী প্রমিথিয়ুসের যজ্ঞকুণ্ডে জ্বলছে আগুন। কিন্তু আকাশ থেকে আজ আর দেবতার অভিশাপ নেমে আসছে না, একরাশ ঝরা শেফালীর মতো মুঠো মুঠো সোনালী রোদে যেন আশীর্বাদ ঝরে পড়ছে। (নীলা)।
১১) উত্তর থেকে পূর্ব বাংলার বুক অবধি পৈতের মতো টানা রেখায় সুগার কেন লাইন। (ঐ)
১২) মড়ক বিশেষ না হলে জীব বিশেষের পার্বণ হয় না। আমাদের দিকটাও তো দেখতে হবে। (ভাঙা চশমা) (শকুনের সঙ্গে মানুষের তুলনা)
সংলাপ বৈচিত্র্যও লক্ষণীয়।
নাট্যগর্ভ সংলাপ:
দুনিয়ার তমাম মানুষ বকরি হয়ে গেছে বেটি, তাই বকরি আর বানাই না। তা হলে তো দেশভর জবাই করতে হয়। তাই খাসি কেটেছি। (আলু খলিফার শেষ খুন)
১৩) শহরবাসী ধনীর ইংরেজি মিশ্রিত সংলাপ:
তারপর, চাকরি পাচ্ছ না যুদ্ধের বাজারে? এম.এ. পাশ করে কেরানীগিরির উমেদারি করছ? বী এ ম্যান ইয়াং ফ্রেন্ড, বেরিয়ে পড়ো অ্যাডভেঞ্চারে। চাকরি নাও অ্যাকটিভ সার্ভিসে, ভিড়ে পড়ো নেভিতে। (হাড়)
নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের গল্পে দেখা যাবে তিনি উত্তম পুরুষে কিছু গল্প উপস্থিত করেছেন, যেখানে ‘আমি’ গল্পের কথক এবং একটি চরিত্র যেমন — হাড়, টোপ, ডিনার, লালঘোড়া।
আবার কখনও গল্পের কথক চরিত্র নয়, নিছক অভিজ্ঞতার বর্ণক মাত্র যেমন- তমস্বিনী। কিছু গল্প প্রথম পুরুষে — শেষ চূড়া, নতুন গান।
কখনও গল্প পত্র আঙ্গিকে যেমন- একটি চিঠি, শুভক্ষণ, মাননীয় পরীক্ষক মহাশয়। কখন ও ভাষণ ভঙ্গিতে যেমন - শ্রীযুক্ত গোপীবল্লভকুন্ডু, কালপুরুষ।
নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় এক বিরল ব্যক্তিত্ব- তাঁর গুণকীর্তন আমার কাছে মহা আনন্দের।