• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৬৭ | জুন ২০১৭ | ভ্রমণকাহিনি, প্রকৃতি, বাকিসব
    Share
  • লাদাখপর্ব : রাহুল মজুমদার


    ডাল লেক

    ১৯ জুন ২০১৬

    বেলা ১১:৪৫- কলকাতা স্টেশন থেকে জম্মু- তাউই এক্সপ্রেসে জম্মু যাবার জন্য কলকাতা ছাড়ল। আমরা দু-জন ছাড়া সন্দীপদা-গার্গীদিও নিশ্চিন্তে কমলেশ-এর ভরসায় পাড়ি দিচ্ছি লা-দ্‌ভাগ্‌স্‌ (উচ্চ গিরিবর্ত্মের দেশ) বা লাদাখ। শ্রীনগরে আমাদের সঙ্গে যোগ দেবে অর্ণব সরকার।

    বিকেল ৫.৫০- পথে বেশ কয়েকবার কারণে অকারণে বিশ্রাম নিয়ে ট্রেন তখন ‘নেতাজী সুভাষচন্দ্র বোস গোমো’-য় দাঁড়িয়ে বোধহয় নেতাজীকে স্মরণ করছে।

    ২০জুন ২০১৬

    সকাল ৬.২৮- রাতে ঘুমটা দিব্যি হয়েছে। এ গাড়ির স্বভাব বেশ ধীর স্থির- দাঁড়ালে চট করে নড়তে চায় না।

    সকাল ৮.৫২- দরিয়াবাদ। দরিয়া তো দরিয়া, ডোবা পর্যন্ত বাদ। এখানে ট্রেন কিসের আশায় দাঁড়িয়ে ছিল কে জানে।

    সকাল ৯.৩০- বারাবাঁকী। বারোটা বাঁক! বাপ রে বাপ!

    সকাল ১০.২০- লক্ষ্মণের রাজধানী লখনউ। নবাবদের রাজধানী লখনউ।

    সকাল ১১.২৫- দিলাওয়ারনগর।

    সকাল ১১.৪২- সান্ডিলা। সান ডিলা, না সান ভিলা! বোঝার আগেই পিছিয়ে পগার পার।

    দুপুর ১২.০৫- বালামউ জংশন। বালা আর মধুর কম্‌বিনেশন!

    দুপুর ১২.৪০- হরদোই- শিবের দই, না দই চুরি করতে বলছে?

    বেলা ২..২৪- তিংর। এই কি সেই জেলখ্যাত জায়গা?

    বেলা ২.৫০- পীতাম্বর। কেষ্ট ঠাকুরের দেশ?

    বেলা ৩.০৮- রসুইয়া। শুনেই খিদে পেয়ে গেল।

    বেলা ৩.২৭- চনেহটী। ছোলা সরল। কেন?

    বেলা ৩.৩৪- বরেলী। এখানকার বাজারেই ঝুমকা গিরেছিল! পেয়েছে কিনা, কে জানে!

    সন্ধ্যা ৭.২২- নাগীনা। রত্ন! কার?

    রাত ৮.২০- রুদৌলি। কান্নাকাটির দেশ মনে হয়।

    রাত ১১.১০- মলীহাবাদ। গুড নাইট।

    ২১ জুন ২০১৬

    ভোর ৫.১১- উতারিয়া। কেউ উতরালো না।

    সকাল ৬.২৫- সুজানপুরে সুজন হয়ে দাঁড়িয়ে।

    সকাল ৭.০৩- কাঠুয়া। দিব্যি তো ইট, সিমেন্ট, লোহা সবই চোখে পড়ছে।

    সকাল ৭.৪৩- হীরানগর। ভাই, গোটা দু-ত্তিন পিস বানে দে না।

    সকাল ৮.০২- সাম্বা। কেউ দেখি নাচছে না!

    সকাল ৮.২০- বিজয়পুরজামনী। জামরঙা মেঘের ঘনঘটা।

    সকাল ৮.৩৬- বাড়ি ব্রাহ্মণ। যা জোর তুমুল বৃষ্টি! ব্রাহ্মণ কেন, সবারই বাড়ি ভাসল বলে।

    সকাল ৯.২২- জম্মু তাউই-তে জমা পড়ল ট্রেন।

    সকাল ৯.৫৩- ভিজতে ভিজতেই গাড়িতে ওঠা গেল। ভেজা গাড়ি গড়াল ভেজা রাস্তা ধরে।

    সকাল ১০.০১- আকাশের একঘেয়ে ঘ্যানঘ্যানে কান্না কমেছে।

    সকাল ১০.২০- তাউই নদী উল্লঙ্খন, জম্মু বাইপাস ধরে।

    বেলা ১.০১- সমরোলি। দিব্যি ট্র্যাফিক জ্যাম।

    বেলা ১.২৬- সিনথাল টপ। এখান থেকে কিশ্‌তোয়ারের পথ বেরিয়েছে। পথের দু-ধারে ডালিম গাছের সারি।

    বেলা ১.৫৫- কুদ। প্রকৃতির রূপে বুঁদ হতে হতে দৌড়।

    বেলা ২.২৪- রামবন। রামকে হিংসে করতে ইচ্ছে করছে।

    বেলা ২.২৮- পাটনী তোপ। সৌন্দর্যের স্টপ।

    বেলা ২.৫০- বটোত। ’৭৯তে এখানেই হয়েছিল লাঞ্চ।

    বেলা ৩.৩৫- পীড়া। লাঞ্চ খেয়ে সব পীড়া দূর। সঙ্গী এখন ঝিলস নদী।

    বেলা ৪.২০- চন্দরকোট। আমি কবে বললাম, আমারকোট?

    বেলা ৪.৩২- রামবন। কতগুলো বন ছিল রে বাবা রামের!

    বেলা ৫.০৭- খুনী নালা। প্রাণ বাঁচিয়ে সটকানো গেল!

    বেলা ৫.১৭- রামসু। রামের জুতো!

    বেলা ৫.৪৬- খারপোরা। ক্ষার পোরা! কিসে?

    বেলা ৫.৪৮- বানিহাল। সরস্বতীর হাল- বলদের দরকার পড়ল!

    বেলা ৬.২৯- জওহর টানেল। সুড়ঙ্গে প্রবেশ এবং দীর্ঘক্ষণ পরে নিষ্ক্রমণ।

    বেলা ৬.৪৫- লোয়ার মুদ। চক্ষু মুদে পেরিয়ে এলাম।

    বেলা ৭.০৬- কাজীগুণ্ড। কাজীও, আবার গুণ্ডাও!

    বিকেল ৭.৩৩- মীরবাজার। ব্যপ্‌স্‌, মীর এতদূরে বাজার করতে আসে!

    বিকেল ৭.৩৭- অনন্তনাগ। বিষ্ণুর বিছানা!

    বিকেল ৭.৪৯- বিজবেহারা।

    সন্ধে ৮.২৭- পমপোর। নামছে আঁধার।

    রাত ৯টা- শেষমেশ শ্রীনগর।

    রাত ১০টা- হাউসবোটের শিকারা ডাল লেকের বুকে গেলাম মহম্মদের ‘অ্যাক্রোপলিস’ হাউসবোটের রাজকীয় আরামে। দিনের শেষে সুখের দেশে। নতুন বন্ধু জুটল অর্ণব।

    ২২ জুন ২০১৬

    ভোর ৪টা- রাত কাটল রাজসিক আরামে। আজ ভোরে ডাল লেকের floating market দেখতে যাওয়া হবে।

    সকাল ৪.৫০- সবাই তৈরি হয়ে শিকারায়।

    সকাল ৫.১১- ডালের বুক চিরে ভাসমান বসতি, ভাসমান ক্ষেত, ভাসমান বাগান ঘেঁষে শিকারা চলেছে বাদশাহী চালে।

    সকাল ৫.২৭- ডাল লেকের বুকে সবজির আশ্চর্য ভাসমান বাজার বা মান্ডি। শিকারা শিকারায় নানান সবজি, ফুলফলের পসরা। চলছে দরাদরি, কেনাকাটা- সবই ভাসতে ভাসতে।

    সকাল ৬.৩১- হাউসবোটে প্রত্যাবর্তন। সুয্যিমামার কিরণ যেন গোটা উপত্যকাকে উজ্জ্বল করে তুলেছে। ফুলের পসরা, রকমারি শিল্পসামগ্রী নিয়ে শিকারার আনাগোনা। স্কুলের ছাত্রছাত্রীরাও সব স্কুলে চলেছে শিকারা চালিয়ে। নারী পুরুষ সকলেরই কাজে যাবার বাহনও শিকারা।

    সকাল ৯.৩২- বেরিয়ে পড়েছি কারগিল অভিযানে জাভেদ ভাইয়ের ভরসায়।

    সকাল ৯.৫৬- আপাতত ডাল লেক অর্ধ-পরিক্রমা চলছে। চার-চিনার, হজরতবাল মসজিদের দূর-দর্শন চলছে।

    সকাল ১০.৩২- হামা দিয়ে গাড়ি পৌঁছল গান্দেরবন-এর বীহামায়। এই ট্র্যাফিক জ্যাম-য়ে হামা দেওয়া ছাড়া আর উপায় কী!

    সকাল ১০.৫৩- সিন্ধ নদীকে টপকে ঢুকে পড়া গেল হরিপোরায়। এবার সিন্ধকে বাঁয়ে নিয়ে তার উজানে চলা। দুপাশের সবুজ পাহাড়ের বুক চিরে মাঝেমধ্যে চঞ্চল জলধারা বসে ঝাঁপিয়ে পড়ছে সিন্ধ-য়ের বুকে।

    সকাল ১১.৫৭- ভরদুপুরে কম্পন। কম্পনের অঙ্গনে আবার গাড়ির সারির বাড়াবাড়ি।

    দুপুর ১২.৩০- গুড়গুড়িয়ে তহশীলদার গুন্ড-য়ে। এত জ্যাম বহশীলদার গুণ্ডাদের কীর্তি কিনা কে জানে!

    দুপুর ১২.৩৯- কুলান। জ্যামের জ্বালারকুল তো দেখতে পাচ্ছি না। অমরনাথে পুণ্যার্থীর ঢল নেমেছে।

    দুপুর ১.১১- সোনমার্গের দোরগোড়ায়। তবু হলুদ সোনমার্গ দূর অস্ত্‌।

    দুপুর ১.২৩- সবুজের ওপর তুষারের আলপনা আঁকা সোনমার্গ। সোনামুখ করে সকলে খাদ্যসামগ্রীর ওপর দুরন্ত আক্রমণে ব্যস্ত।

    বেলা ২.২৫- সোনমার্গের সবুজ ছেড়ে জোজি-লা-র তুষারক্ষেত্রের উদ্দেশে আমাদের অভিযান শুরু।

    বেলা ২.৫৭- অনেকটা উঠে এসেছি। নীচে বালতালের অমরনাথ শিবির, হেলিপ্যাড আর অমরগঙ্গার ধার ধরে অমরনাথের পথ ছবির মতো বিছিয়ে রয়েছে।


    জোজি লা
    বেলা ৩.৫৮- জোজি লা। পথের জলধারের সব পাহাড়চূড়া থেকে হিমবাহ নেমে এসে বিশাল তুষারক্ষেত্র তৈরি করেছে। তাতে শ্রীনগর থেকে আসা টুরিস্টের দঙ্গল হুটোপাটি করছে— এখান থেকে মনে হচ্ছে, একদল যেন দম দেওয়া পুতুল। শীতের বাতাসের হিমেল আদর খেতে খেতে সব ‘অবলোকন’ করছি আমরা।

    বেলা ৪.২১- ১১৬৩২ ফুটের জোজিলা ছেড়ে আবার শুরু হলো আমাদের কারগিল অভিযান।

    বেলা ৪.৫৪- কারগিল গেট। দ্রাস নদীর দু-ধারে এখনও বরফের পুরু আস্তরণ।

    বেলা ৫.০৬- দ্রৌপদী কুণ্ডু। দ্রৌপদী বোধহয় এখানে স্নান-টান সেরেছিলেন- ধন্যি তাঁর সাহস!

    বেলা ৫.২০- পানদ্রাস। দ্রাসে পানের চাষও হয় নাকি!

    বেলা ৫.৪১- দ্রাস। পৃথিবীর ২য় শীতলতম জনপদ- অথচ দেখ, শীতের লেশমাত্র নেই! তাতে অবশ্য চা খাওয়ার আনন্দ একটুও কমল না। মোটামুটি বড় জায়গা, তবে হই হট্টগোল নেই।

    বেলা ৬.২৩- আমাদের বাঁদিকে এখন ভারতীয় সেনার বীরত্বের নজির তোলোলিং শৃঙ্গ।

    বেলা ৬.২৬- দ্রাস ওয়ার মেমোরিয়াল। ভারতীয় সেনাবাহিনীর বীরগাথার স্মারক এই সুন্দর জায়গাটাকে পাহারা দিচ্ছে টাইগার হিল। একটু তফাতে তাকে সঙ্গ দিচ্ছে তোলোলিং। যুদ্ধে শহীদ সেনানীদের সমাধিক্ষেত্রে দেখে সবাই আপ্লুত। নানান অস্ত্রশস্ত্র, বিমান, ট্যাঙ্ক, সাঁজোয়া গাড়ি আর গগনস্পর্শী ভারতের জাতীয় পতাকা সম্ভ্রমের উদ্রেক করে। খানিক তফাতে নিরন্তর বয়ে চলেছে দ্রাস নদী।

    বেলা ৭.১৮- বেলাশেষে Flag Down দেখে মুগ্ধচিত্তে আবার গাড়িতে।

    সন্ধ্যা ৭.৫৮- সূয্যিমামা এদিকে ওভারটাইম করেন। এবার তিনি অস্ত যাওয়ার তোড়জোড় করছেন।

    রাত ৮.১৯- সাঁঝ পেরিয়ে রাতের সঙ্গে আমাদের আবির্ভাব হলো কারগিল-য়ে। যুদ্ধের দৌলতে যে ছবি মনে আঁকা ছিল, এই আঁধারে তার সঙ্গে তেমন মিল পেলাম না। পাশ দিয়ে দুরন্ত গতিতে বয়ে চলা সুরু নদী মুচকি হাসল।

    রাত ৮.৩১- কারগিল-য়ের (৯০২০ ফু: ) পুরোনো টুরিস্ট লজ রক্ষণাবেক্ষণের গাফিলতিতে জীর্ণ।

    রাত ৯.৩৭- এই রমজানের সময় খোলা থাকা একমাত্র ‘রেস্তোরাঁ’ থেকে তেলমাখা নুড্‌ল্‌স এনে ক্ষুন্নিবৃত্তি হলো। এবার লক্ষ্য বিছানা।

    ২৩ জুন ২০১৬


    সুরু নদী, কারগিল
    ভোর ৫টা- এরই মধ্যে আঁধারের ছুটি হয়ে গেছে। পশ্চিম আকাশে ফ্যাকাশে চাঁদ ন্যাড়া পাহাড়ের আড়ালে অস্ত যেতে ব্যস্ত।

    সকাল ৬.১২- দ্রাং দ্রুং হিমবাহ; দর্শনার্থে নিষ্ক্রমণ।

    সকাল ৭.১৪- ছোট্ট, শান্ত বসতি সাংকু। তুষারশৃঙ্গের নজরদারিতে ব্রেকফাস্ট।

    সকাল ৮.৪২- সুরু নদীর কূলে তেইসুরু।

    সকাল ৯.১২- টংগোল। পাঁচ-দশটা পাথর ছাড়া কিছু তো গোল দেখছি না! ঢং!

    সকাল ৯.৩৩- পারকাচিক। নুন আর কুন-য়ের উদ্ধত উপস্থিতি সবুজ গ্রামটার রক্ষীরূপে। প্রাণভরে পারকাচিক-য়ের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করলাম। কমলেশ আর অর্ণব তো ফটো-সেশনই করে ফেলল পারকাচিকের; মূল চরিত্র নুন কুন (২৩০০০ফু: )।

    সকাল ১০.০১- আবার যাত্রা।

    সকাল ১০.৫৫- সুরু নদীর উজানে উচ্চতা বাড়ছে। এমনিতে ঊষর হলেও মাঝেমধ্যে ফুলঝাড়েরা রং ছড়াচ্ছে। মারমটদেরও দু ঝলক দেখা মিলল। কাঠবেড়ালিদের কেউ যেন ইয়ামোটা করে ছেড়ে দিয়েছে!

    সকাল ১১.৪৩- রংদুম (১১৯৩২ ফুঃ ) অবশ্য দুম করে এলো না। দূর থেকেই হাতছানি দিচ্ছিল। লঞ্চের সঙ্গে চাফ্‌-দের ব্যস্ততা ফ্রী। হলুদ ঠোঁটের এই পাখিগুলোকে হঠাৎ দেখলে কাক বা কোকিল বলে ভুল হয়।

    দুপুর ১২.৩৩- দ্রাংদ্রুং ডাকছে। ঊষর পথের ধূসর চড়াই এবার দাঁড়কাকের চেহারা নিচ্ছে।

    দুপুর ১.২১- সুরু নদী ক্রমশ সরু হচ্ছে।


    পেনজিলা
    দুপুর ১.৫৮- পেন্‌জিলা (১৪৪০০ ফুট)। রঙীন নিশান দিয়ে নিশানা করা পেন্‌জিলা-র কাছেই সুরু নদীর শুরু। দ্রাং দ্রুং আর দূর নয়।

    দুপুর ২.১৪- চক্ষু চড়কগাছ করার মতো হিমবাহ দ্রাং দ্রুং (১৪৪০০ ফুট) দুটো S-য়ের মতো বাঁক নিয়ে নেমে এসেছে। সুবিশাল দ্রাংদ্রুং থেকেই জন্ম নিয়েছে জাঁসকার নদী। দুরন্ত হিমেল বাতাস উড়িয়ে নিয়ে ফেলতে চাইছে- অবশ্য দ্রাংদ্রুং-য়ের উলটো দিকে। ভাগ্যিস।

    দুপুর ২.৫৭- মন পুরোপুরি না ভরলেও ফিরতে হচ্ছে।

    বেলা ৩.০১- পেন্‌জিলা-র পাশের ছোট্ট হ্রদ টা-র টানে কিছুটা সময় তার কাছে কাটাতেই হলো।

    বিকেল ৭.৫৪- সাংকুতে পাংমর। না, প্রেস্টিজ নয়, টায়ার। বাধ্য হয়ে কিছুক্ষণের জন্য রিটায়ার করতে হচ্ছে। অবশ্যই চা-সংযোগে।

    রাত ৯.১৫- ৮টা ১৭-য় সাংকু ছেড়ে এক ঘণ্টায় কারগিল-য়ে এনে আমাদের জমা করে দিল জাভেদ।

    রাত ১০.৪৮- রাজসিক ভুরিভোজ সমাপনান্তে দ্রাংদ্রুং, নুন-কুনের স্বপ্ন দেখার আশায় ঘুমের দেশে পাড়ি।

    ২৪ জুন ২০১৬

    ভোর ৫টা- কারগিলের শেষ ভোরকে উপভোগ করতে বেরিয়ে এলাম ঘর ছেড়ে। চাঁদের শেষ পাহারায় কারগিলেরও ঘুম ভাঙছে আজানের ডাকে। আজ আমাদের লাদাখ প্রবেশের দিন।


    কারগিল

    সকাল ৮.৫০- কারগিলের শেষ ব্রেকফাস্ট।

    সকাল ১১.১০- আবার সুরু নদী ধরে চলা শুরু হলো— একটা দু:সংবাদকে সঙ্গী করে। বাটালিকে ভয়ানক বন্যা ভাসিয়ে দিয়েছে আর্যগ্রামের পথ— পথ ঠিক হবার কোনও আশু সম্ভাবনাই নেই।

    সকাল ১১.৫১- “প্রাকৃতিক সিটিস্কেপ” দেখতে দেখতে চলেছি। এই রুক্ষ্ম প্রদেশে বাতাসের খেয়ালী কারিগরীতে শুষ্ক পাহাড়ের গায়ে ফুটে উঠেছে ঘরবাড়ির সারি!

    দুপুর ১২.৩৩- মুলবেক চাম্বা। এখানেই রয়েছে বিখ্যাত মৈত্রেয় (ভবিষ্য) বুদ্ধের মনোলিথিক রিলিফ মূর্তি, যা দেখতে দেশবিদেশ থেকে ভক্ত আর পর্যটকেরা আসেন।

    দুপুর ১২.৫৩- অপূর্ব! মূর্তির সামনে প্রবেশদ্বার গড়ে ওঠায় রাস্তা থেকে পুরো মূর্তিটা দেখা যায় না। প্রায় ৩৫ ফুট উঁচু এই ভবিষ্যবুদ্ধের (মৈত্রেয়), চতর্ভুজ মূর্তির সঙ্গে শিবঠাকুরের আশ্চর্যরকম মিল- মাথায় জটা, হাতে গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, কমণ্ডুল।

    দুপুর ১.১১- মুলবেক বুদ্ধকে শান্তি দিয়ে আমরা জাদুকরী প্রকৃতির আশ্চর্য কারিগরী দেখতে দেখতে এগিয়ে গেলাম। সবুজ বিদায় নিয়েছে অনেকক্ষণ। ধূসর পাটকিলে পাহাড়ের মাঝ দিয়ে চলা।

    দুপুর ১.৩২- নামিক লা (১২১৪৬ ফু: ) থেকে এবার নামা শুরু।

    দুপুর ১.৪৫- সনজক মোড়। হতাশ চোখে আর্যগ্রামের পথটাকে একঝলক দেখে লামায়ুরুর পথে পাড়ি দিচ্ছি। সনজকের পুলটাই আর লাদাখের একমাত্র সংযোগের উপায়।

    দুপুর ২.০২- হানিসকোট। মধু-র কোট- খুউব মিষ্টি নিশ্চয়ই।

    দুপুর ২.০৭- এবার আমরা লেহ জেলায় ঢুকে পড়লাম। আবার চড়াই।

    দুপুর ২.২৯- ভিউ পয়েন্ট। পথ ছেড়ে বই টংয়ে চড়লে গোটা দিগন্তজুড়ে চাঁদের পাহাড় (মুনল্যান্ড) কে পাখির চোখে দেখা যায়। ঊষরতর যে এত রূপ হতে পারে, কে ভেবেছিল!

    বেলা ৩.১৯- ১১৪৩ খ্রিস্টাব্দে তৈরি হাঁ করে দেওয়া গুম্‌বা লামায়ুরু। প্রায় ১২০০০ ফুট। পাথরের মতো শক্ত নুড়ি-মাটির পাহাড়ের গায়ে, গড়ে ওঠা বা গুম্‌বা লামায়ুরুকে চাঁদের পাহাড়ের পাহারাদার বলা যায়। অনেক নিচে নদীর দুধারে সবুজ আটকে রয়েছে। বাকিটায় রুক্ষ শুষ্ক কিন্তু জোরালো বাতাসের ছেনি হাতুড়িতে গড়ে উঠেছে অপূর্ব শিল্পকীর্তি।


    লামায়ুর গুম্‌বা

    বেলা ৩.৫৩- গুম্‌বার ভিতরটা আশ্চর্যরকম শান্ত আর ঠাণ্ডা। সতর্ক শিশুলামাদের কঠোর অনুশাসনে গুম্‌বার প্রধান প্রার্থনাকক্ষের অন্দর রয়ে গেল ছোঁয়ার বাইরে। লাদাখের গুম্‌বাগুলো বিশাল- অনেকটা দুর্গের ধাঁচে গড়া, আমাদের এতদিনের দেখা বৌদ্ধগুম্‌বার মতো নরম সরম নয়।

    বেলা ৪.০৮- লামায়ুর থেকে বেরিয়ে এসে দাঁড়ালাম চাঁদের দেশে। বলে বা লিখে বোঝানোর বাইরে এর রূপ। নেহাৎ মাছি নেই, তা না হলে আমাদের সবারই একগাল মাছি হয়ে যেত।

    বেলা ৪.৪০- সিন্ধু দর্শন। এখন আমাদের সঙ্গী সিন্ধুনদ। আমাদের সমবেত খাই খাই আন্দোলনে গাড়ি এখন ৯৫২৬ ফুটের খালসি (খালাৎসে) তে আরাম করছে। আমরা বুভুক্ষুরা অধীর আগ্রহে খাবারের থালার অপেক্ষায়।

    বেলা ৬টা- খেয়ে দেয়ে চেয়ারে গা এলিয়ে বিশ্রামটা বাড়াবাড়ির পর্যায়ে পৌঁছবার পর আবার আমরা চলমান। অবশ্য চলছে গাড়িটাই- আমরা যে যার সিটে এলিয়ে।

    বেলা ৬.১১- নুরলা। আলো আনব? কোত্থেকে আর কেন? আকাশে তো দিব্যি ফটফটে আলো!

    বেলা ৬.১৯- দেখা পেলাম হেমিস চু-র।

    বেলা ৬.২৮- ওপার থেকে লারদু আমাদের দৌড় দেখতে লাগল চুপটি করে।

    বেলা ৬.৩২- সাসপোল। শাশুড়ির সেতু! চোখে তো পড়ছে না। ওপারে আলচির পথ।

    বিকেল ৭টা- নিম্মু। নিম্মু তো বটেই, দিম্মু না কিস্‌সু। সেনাবাহিনীর হেডকোয়ার্টাস অবশ্য নির্লোভ। সে চায়ও না কিছু।

    বিকেল ৭.১৩- চুম্বক পাহাড় পেরিয়ে গেলাম না আটকেই।

    বিকেল ৭.১৮- ছুটতে ছুটতে লাদাখের রুক্ষ রূপ উপভোগ করছি। গুরু নানক-য়ের এক আলৌকিক কীর্তির সাক্ষী পাত্থর সাহিবকে পেন্নাম ঠুকলাম ছুটতে ছুটতেই।

    বিকেল ৭.৪২- বিমানবন্দরের ধার ঘেঁষে ঢুকে পড়লাম লেহ-তে (১১৬৩৬ ফু: )।

    সন্ধে ৮টা- কমলেশদের Hernit Hut-য়ে চা-পান (অবশ্যই টা সহ যোগে) জলির দৌলতে।

    রাত ৯টা- ভিড়ে ঠাসা খোঁড়াখুঁড়িতে খোঁড়া লেহবাজার পেরিয়ে আমাদের আগামী ক-দিনের আস্তানা। নতুন Hotel Eco Exotica-য় এসে আজকের মতো গাড়ি চড়ায় দাঁড়ি পড়ল।

    (ক্রমশ)



    অলংকরণ (Artwork) : স্কেচ : রাহুল মজুমদার
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments