‘অ’ (কবিতা-সংগ্রহ; অরুণাচল দত্তচৌধুরী; সৃষ্টিসুখ প্রকাশন; প্রথম প্রকাশ: জানু ২০১৭; ISBN: 978-1-63535-148-4
নিজে কবিতা লিখতে না জানলে যদি কবিতার গ্রন্থ-সমালোচনা না করা যায় তবে স্যর নেভিল কার্ডাস তো ক্রিকেট নিয়ে লিখে ভুল করেছিলেন, বা নীলাক্ষ গুপ্ত সঙ্গীত নিয়ে। সমালোচনা না হোক্ নিদেন নির্ণিমেষ তাকিয়ে তো থাকা যায় হিমালয়ের ঐ উত্তুঙ্গ শৃঙ্গের দিকে, তার তুষার ধবল ধ্যানমগ্নতা ... (গোড়াতেই বাক্যি হারা হলে চলবে না)
কোনো কাব্যগ্রন্থের পাঠ কোত্থেকে শুরু হওয়া উচিত? বিশেষতঃ, তার নাম যদি ‘অ’ হয়? আর, রক্তবর্ণ প্রচ্ছদে যদি থাকে বর্শা-গৃধ্র-শৃগাল পরিবেষ্টিত অভিমন্যু? সেখান থেকেই। হয়তো। এ’অধম তো শেষ থেকে শুরু করেই ‘অরুণালোকে চন্দ্রাহত’।
ব্লার্ব! জানি না, তাঁর এতো কবিতা থাকতে শ্রেষ্ঠটিকে কে বেছে নিতে পারলেন চতুর্থ প্রচ্ছদের জন্যে, পুরোটাই এখানে তুলে দেবার লোভ সামলাতে পারছি নাঃ
“এই কুরুক্ষেত্র রোজ ভরে যাচ্ছে শেয়ালে দালালে।চাবুকের মত এ’হেন লাইন পড়ে শেষ কবে খাড়া হয়ে গেছে শিরদাঁড়া, ভাবতে বসি। পাতা উল্টিয়ে অন্দরে প্রবেশ। আশিটি কবিতা, ক্কচিৎই কোনোটি এক পৃষ্ঠার চেয়ে দীর্ঘতর। প্রথম কবিতাটিই ‘বেহাল’। তাই? ও, পরে পড়বো। চোখ গেল ‘ইউথেনেশিয়া’-র প্রতি (সেটা কি কবি পেশায় এক বরিষ্ঠ চিকিৎসক বলে?):
কে দেখবে আমাদের, অভিমন্যু তুমিও পালালে?
মৃতভুক শকুনিরা মেলে দিচ্ছে নিউজপ্রিন্ট ডানা
মৃতের জবানবন্দী খুঁজে নিচ্ছে বিকৃত ঠিকানা।
বিষাক্ত যত অস্ত্র সপ্তরথী করেছে সংগ্রহ।
কোলাহলে খুব ব্যস্ত শিক্ষক…পিতা…পিতামহ।
এই ব্যূহে তুমি একা। ভঙ্গী আছে। সঙ্গী নেই কোনও।
অস্ত্র নেই অভিমন্যু। অস্ত্র তুমি পাওনি কখনও।”
“ও অসুখ ফিরে এসো দিনে, মাঝরাতে……………
আর কোনও দিন দেখো চাইবোনা তোমাকে সারাতে
আমাকে করুক গ্রাস চাইছি না এর বেশি আরবা,
বেঁচেই এই যে মরা এটাও তো ইউথেনেসিয়া”
পরেই ‘চন্দ্রাহত’:
“ও চাঁদ, আমাদের পুড়িয়ে দিয়েছিলে!আচ্ছা, এটা কি প্রেমের কবিতা?
কলঙ্কের দাগ সবই তো মোছা হল
তবু কি রয়ে গেল কিছু?
অবুঝ কোনও কোনও অচেনা অদ্ভুত
স্বপ্ন ছাড়ছে না পিছু।”
চন্দ্রাহত! চন্দ্রাহত হই।
‘গন্তব্য’
“আমার শোকে ভেসো না থই থই……
এই শহরে তত সময় কই?
তোমার ওমন একলা ভিজে ভিজেহায় রে, কবিদের তো বয়েস বাড়ে না আর! মধ্যষাটেও তাঁদের অষ্টাদশী প্রেমিকা থাকতে পারে, নীরার মতো।
উঠে পড়ুক গড়িয়াহাট ব্রিজে
জানলা ঘেঁষা সিটের মালিকানায়
জল পড়েছে গালে দু-এক ফোঁটা
ঠোঁটের ভাঁজে পুরনো তর্কটা
এমন যাওয়া তোমায় শুধু মানায়… ”
হিংসে হয়।
কীভাবে লিখতে হয় কাব্যগ্রন্থের সমালোচনা (বা, নিদেন, ‘পরিচিতি’), সেটা অজানা। কেবল ‘আহা, কী পড়িলাম,... আহা, কী পড়িলাম,...’ লিখিলেই চলিবে? গানের তো তবু ব্যাকরণ হয়, স্বরলিপি; তুলনা তার নিরিখে। কিন্তু, কবিতার?
না, গানের কেবল ব্যাকরণ মানা মানি দিয়ে যেমন উৎকর্ষের বিচার হয় না, তার উর্ধ্বেও কিছু থাকে, কবিতার ক্ষেত্রেও তো ঠিকই তাই। কে রচবে সেই গ্রামার যা দিয়ে ‘সোনার তরী’-র বিচার হবে, বা ‘বনলতা সেন’-এর?
কবি অরুণাচল দত্তচৌধুরীকে আগে পড়িনি কেন? কবি মধ্যষাটে, লিখছেনও বহুদিন। কবিসুলভ অবজ্ঞায় কবিতার মুদ্রণ ও প্রকাশকে পিছিয়ে দিয়েই চলে এসেছেন, পিছিয়ে দিয়েই। ভাগ্যিস ততটা নয়, যাতে আমরা অবোধ পাঠকরা এক্কেবার বঞ্চিত হই।
বধাঈ। বধাঈ।
কোন্ সে গুণ যাতে প্রথম পাঠেই ধরাশায়ী করে দিলেন কবি অরুণ? তা কি (১) কাব্যছন্দের প্রতি এ’ কলমচির এক অমোঘ আকর্ষণ আছে বলে? বিষ্ণুর চেয়ে সুধীন দত্ত চিরকাল বেশি আকর্ষণ করে এসেছে বলে (সমর ব্যতিক্রম)? এটা একটা প্রধান কারণ, মানি। কবি ছন্দ নিয়ে অনায়াস খেলা করে গেছেন আশিটি কবিতা ধরে, কোত্থাও চ্যুত হননি এতোটুকু। (২) শব্দচয়ন আরেকটি ভাল লাগা দিক এঁর লেখায়। এখানে সুধীন্দ্রসম আভিজাত্যপনা নেই, ভাষা অনেক ‘বিনয়ী’, যেন ‘ফিরে এসো, চাকা’-র মতো স্বতঃগতি, প্রাঞ্জল (যদিও ভাবে অন্যপ্রকার)। যেমন, “তুমি নীতিবাক্য দাও মেপে মেপে বিঘতপ্রমাণ” (‘প্রিয় অন্ধকার’ পৃঃ ১০২), বা, “....শব্দদের বিনির্মাণ পড়ে আছে আনাচে কানাচে.....” (‘ঋণাত্মক’, পৃঃ ৭১)-- এ’সকল লাইনে ঐ ‘বিঘতপ্রমাণ’ বা ‘বিনির্মাণ’ শব্দগুলির ব্যবহার সোজা এসে গেঁথে যায় প্রাণে। (৩) বিষয়চয়ন আরেকটি অতি উল্লেখ্য দিক। ‘রঙ দাও পার্বতীকে’ কবিতাটি পড়ি...হ্যাঁ, সেই দলিত কন্যেটি যাকে মৃত্যপূর্বে ধর্ষণ করা হয়নি। রক্ত টগবগে ছোটে, ঘেন্না হয় ‘নিধিরাম কানুনগুলির’ প্রতি। সমাজের প্রতি কবির অঙ্গীকার আরেকবার প্রতিষ্ঠিত হয়ে ওঠে। ‘ক্যারম’ তো খেলছি আবাল্য, কিন্তু তা নিয়ে যে এমন লাইন লেখা যায় (“...হাইপার স্পেসের অজস্র বুদবুদে/ দানে...পালটা দানে ছড়িয়ে যাচ্ছে সৃষ্টি...”)---কবে ভেবেছিলাম? ‘ঈশ্বরকণা’ এমন আরেকটি চমকদেওয়া বিষয় নিয়ে লেখা এক একপাতার কবিতা, যেটি এই নিয়ে বার দশেক পড়লাম।
প্রথাসিদ্ধ না হলেও কবি অরুণাচল জনপ্রিয় যথেষ্টই। তাঁর কবিতায় সুর দিয়ে গান বেঁধেছে নবীন সঙ্গীতদল (ইউ টিউবে শুনলাম)।
ছোট জেলাশহরে তিনি যথেষ্ট নিবেদিতপ্রাণ ডাক্তারবাবু হিসেবে শ্রদ্ধেয় — এটাও জানা গেল অন্যসূত্রে। কেবল, এদ্দিন এ’সব জানিনি কেন, কবিকে পড়িনি কেন ভেবে আক্ষেপ। কবিই তো লিখেছেনঃ ‘চিরকাল এই নিয়মে/সঙ্গীত থামবে সমে/মাঝে দুই একটি প্রহর/ ভালোবাসি কোনওক্রমে’
হ্যাঁ, ‘কোনওক্রমে’।
হ্যাঁ, তাই তো অ আ ক খ থেকে জীবনের পুঁথির পাতায় সব বর্ণ ছুঁয়ে ছুঁয়ে অনুস্বর বিসর্গ এলেও চন্দ্রবিন্দু নেই শীর্ষনামে।
কারণ ‘অ’-এর পুনঃপাঠ শুরু করতে হবে যে! আবার, আবার পড়বো কবি অরুণাচলকেঃ অরুণ যেথায় অচল, স্থির, সদাদীপ্তমান!!
‘শারদীয়া কিশোর ভারতী’; চতুর্থ বর্ষ প্রথম সংখ্যা অক্টোবর ১৯৭১; সম্পাদকঃ দীনেশ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। নবরূপায়ণঃ ত্রিদিবকুমার চট্টোপাধ্যায়; পত্রভারতী প্রকাশনা, কলকাতা-৯; ISBN 978-81-8374-348-8
পরবাসের এই কলমটি নামে ‘গ্রন্থ-সমালোচনা’ হলে কী হবে, এতে যেমন ‘গ্রন্থ-পরিচয়’ পড়া গেছে, তেমনি পূর্ণ ‘গ্রন্থ-তর্পণ’-ও। নৈলে ‘খেরোর খাতা’ বা ‘থোড় বড়ি খাড়া’-কে আর কোন্ গোত্রে ফেলা যায়?
যেমন বর্তমানেরটিও।
‘অ হো...আমাদের কালে কী ছিলো, আর এখন...’-ভাব বুড়োবয়সের প্রকৃষ্ট লক্ষণ। নিশ্চয়ই। ঊনিশশ’ ষাট-সত্তরের দশকে আমাদের বাল্য-কৈশোরে কম্প্যুটার k না c দিয়ে লিখতে হয় আমরা জানতুম না, ফেসবুক, উইকিপিডিয়া বা স্মার্টফোন তো স্বপ্নের বস্তু ছিলো...যে-সবে এই ২০১০-এর দশকের বালক-বালিকা অতি সড়গড়।তবে একখানি বিষয়ে আজও গর্ব করে বলতে পারি সেকালে যা ছিলো আজ তা প্রায়-সম্পূর্ণ বিলুপ্ত; আজকের বাঙালি কিশোর সে-রসে সম্পূর্ণ বঞ্চিত বলে আক্ষেপ হয়ঃ সেটা বাঙলা শিশুসাহিত্য। সুকুমার-যোগীন্দ্রনাথ-দক্ষিণারঞ্জন আরও আগের কালের, আমরা যাঁদের যাঁদের রসাস্বাদন করতে পেয়েছি, সেই হেমেন রায়-প্রেমেন্দ্র-শিব্রাম-আশাপূর্ণা-লীলা-সত্যজিৎ...তারও ভাণ্ডার অপরিমিত, আজকের দিনে তার ছিটেফোঁটাও নেই বলে আক্ষেপ।
সেকালে আমাদের মনপ্রাসাদের চার দরোজা ছিলোঃ ‘শুকতারা’, ‘সন্দেশ’, ‘কিশোর ভারতী’ আর ‘আনন্দমেলা’। এরমধ্যে সিংদরজা কোন্টি, বাছাই করা যাবে না। শুকতারায় ‘সোনার ঘণ্টা’ বাজে তো ‘...ভারতী’-তে ওঠে ‘নীল ঘূর্ণি’! সন্দেশের অজেয় রায়ের এডভেঞ্চার রাতের ঘুম কেড়ে নিলে আনন্দমেলার ‘কাপালিকরা এখনও আছে’! সে ভূরিভোজ... সে ভূরিভোজ... (বুড়ো বাক্যিহারা)।
কালের নিরিখ সৎ-সাহিত্যের মস্ত এক কষ্টিপাথর! অনেক লেখাই পুনঃপাঠে পান্সে লাগে, না? যেগুলো তেমন লাগে না, তারাই ক্লাসিকের দর্জা পায়।
যেমন, এই হাতেরখানি!!! পড়বো কি এ’বই, কতোবারই আর মুছবো চশমার কাচ, চোখই যে ঝাপসা?! মুহূর্তে মনে হয় সরু সরু ঠ্যাঙের হাফপ্যান্ট পরিহিত এক কিশোর ঐ যে দরজার পিছনে ওৎ পেতে আছে, কখন জ্যাঠামশায় ঘুমিয়ে পড়বেন আর সে ছোঁ মেরে শারদীয়া কিশোর-ভারতীটা নিয়ে লোডশেডিং এ পিদিম জ্বেলে...
‘পত্রভারতী’ প্রকাশনালয় ইদানীং এক মহান কাজ ধরেছেন (দেব সাহিত্য কুটীরও করছেন এ’-ধারা): ষাট-সত্তরের দশকে প্রকাশিত এঁদের অসাধারণ শারদ-সাহিত্যের ভাণ্ডার, যেগুলি এতোদিনে প্রকাশন-নিঃশ্বেস হয়ে পড়েছিলো, তাদের পুনঃপ্রকাশ করে বর্তমান প্রজন্মের হাতে তুলে দিচ্ছেন। এ’প্রয়াসের কোনো তুলনা হয়না। নৈলে, শ্যামাদাস দে, দিলীপ চট্টোপাধ্যায়, ধীরেন্দ্রলাল ধর মশাই কী স্তরের সাহিত্যিক ছিলেন তার আন্দাজ আজকের বাঙালি কিশোর পাবে কী করে? আর ভবিষ্যতের কাছে এক দায়বদ্ধতাও কি নেই? ‘ঘরের কাছেই রুণু’-র মতো এক উপন্যাসকে হারিয়ে যেতে দেওয়া যায়? ইন্দ্রজিৎ রায়-ব্ল্যাক ডায়মন্ড রহস্যরোমাঞ্চ সিরিজকে? বা, শৈল চক্রবর্তী-নারায়ণ দেবনাথের সে-সব লা-জবাব ইলাসট্রেশন? ময়ূখ চৌধুরীর ‘কায়না’-র মানের দ্বিতীয় রোমহর্ষক কাহিনি তো এতাবৎ আর পড়লুম না। সবমিলিয়ে নমস্য দীনেশ চট্টোপাধ্যায় মশায় যেভাবে শারদীয়া ‘কিশোর ভারতী’র ডালি সাজিয়ে তুলতেন বৎসরের পর বৎসর... শুধু এই সম্পাদনার জন্যই এক কার্নেগি মেডেল প্রাপ্য হয় তাঁর।
না, বন্ধু, পঁয়তাল্লিশ বছর পরে পুনঃপ্রকাশিত “শারদীয়া কিশোর ভারতী, ১৯৭১”-এর ‘গ্রন্থ-সমালোচনা’ করতে এ’কলম ধরিনি আজ, না সে ক্ষমতা/ইচ্ছা আছে। আব্দুল করিম সাহেবের কণ্ঠে মল্লকৌষিকের শুদ্ধ নি-র লাগ্ প্রসঙ্গে কুমারপ্রসাদ গল্প শুনিয়ে গেছেন, সে-সুর ঠিক যখন লাগতো কিছু যেন আর শোনাই যেতো না তখন কিন্তু ঘরভর্তি সমঝদারেরা ‘হায় হায়’ করে কেঁদে ভাসাতেন। তেমন এখানেও পুরো সাদা পৃষ্ঠা ছেড়ে দিলে গ্রন্থ-আলোচনা সম্পূর্ণ হয় যেন! সম্পাদক দীনেশ চন্দ্র আদিযুগের কম্যুনিস্টদের একজন ছিলেন, যাঁদের কাছে সাম্যের শিক্ষা শিশুস্তর থেকে শুরু।তাই শিশুসাহিত্য (মস্কোর ‘প্রগতি’ ‘রাদুগা’ যেমন)! আর তাঁর এই ভাবনাটা জড়িয়ে থাকতো ‘...ভারতী’র অঙ্গে অঙ্গে। ‘নয়টি উপন্যাসোপম বড়গল্প’, বা ‘অষ্টবজ্রসম্মেলন — আহ্লাদে আটখানা হবার মতই আটখানা উপন্যাস’---এ’ধরনের বুকের-রক্ত-ছলাৎ -করানো বিজ্ঞাপনীয় ভাষা এঁরাই শুরু করেছিলেন শিশুসাহিত্যের অঙ্গনে। সেই শুরু। তারপর পরতে পরতে খুলে যাওয়া ‘অশান্ত কৈশোরের উপন্যাসঃশিহরণ-জাগানো সংশয়ের’ [সংকর্ষণ রায়] বা, ‘দুরন্ত অভিযান-উপন্যাসঃ দূরারোহ মেঘলোকের’ [সুন্দরডুঙ্গা অভিযান]...আরও...আরও...!
সংকলনটি থেকে দু’-একটি রচনার বিশেষ উল্লেখ না করে পারছি না, কারণ এদের উপমা বিশেষ পাইনি আর। বাঙলাভাষায় কল্পবিজ্ঞানের কাহিনি প্রেমেন্দ্র-ক্ষিতীন্দ্র-অদ্রীশ ব্যতিরেক মুষ্টিমেয় আর কয়েকজন লিখে গেছেন, তাঁদের মধ্যে নারায়ণ চক্রবর্তী মহাশয়ের নাম বড় শোনা যায় না; আমরাও ওঁর আর লেখা পড়েছি বলে মনে করতে পারি না। কিন্তু এখানে ‘ভাদুড়ী টিউটোরিয়াল হোম’ নামের যে বিজ্ঞান-নির্ভর উপন্যাসখানি লিখে গেছেন উনি, তার জুড়ি বাঙলাসাহিত্যে আর পড়েছি কিনা অনেক ভেবেও পেলাম না। প্রখ্যাত ভূবিদ্যাবিশারদ সংকর্ষণ রায় মশাই সর্বদাই বিজ্ঞানের-ছোঁয়া-মাখানো কিশোর উপন্যাস লিখতেন, যেমন এখানেও ‘অষ্টভূজার চোখের মণি’ লিখেছেন (যদিও সেখানি ‘বিজ্ঞাননির্ভর’ বলে চিহ্নকৃত নেই)। ছদ্মনামে লিখতেন ‘নটরাজন’, এখানে কী অপূর্ব করুণরসের বড়গল্প লিখেছেনঃ ‘ক্যামেলিয়া’! বিপ্লবী রাসবিহারী বসুর জীবনীভিত্তিক উপন্যাস ‘বিপ্লবী মহানায়ক’ লিখেছেন মনোরঞ্জন ঘোষ, যিনি প্রতি বৎসরই ভারতের স্বাধীনতা-সংগ্রামের ওপর কিশোরপাঠ্য উপন্যাস লিখতেন। প্রেমেন্দ্র মিত্র এককালে সম্বৎসর কেবলমাত্র একখানিই ঘনাদা কাহিনি লিখতেন, দেব সাহিত্য কুটীরের পুজোবার্ষিকীটিতে, পরে উনি ‘কিশোর ভারতী’র জন্যেও ঘনাদা লেখেন, যেমন এখানে লিখেছেন ‘কাঁটা’ [‘পৃথিবী বাড়লো না কেন’ সম্ভবতঃ এই বছরই লেখেন,শারদীয় আনন্দমেলাতে]। আশাপূর্ণার ‘একটি ক্ষুদে আঙুলের জন্যে’ উপন্যাস নিয়ে দু’লাইন লিখতে পারি,সে-তাকত নেই, যার পাঠশেষের দোলাচলে অনুভূতি পাঁচ দশক পূর্বেও যা ছিল আজও তাই রয়ে গেছে, যেখানে গল্পটির কালোত্তীর্ণ জয়। মজার কথা হচ্ছে, আজ প্রায় পাঁচ দশক পরে পুনঃপাঠে দেখছি সেকালের সে-অনুভূতিও হুবহু ফিরে আসছে, এতো ডিটেইলে যে মনে থেকে গিয়েছিলো, তাই কি জানতুম হে? বড় মায়াময় গো, বড় মোহময়।
১৯৭১ যে কোনো বঙ্গভাষীর জীবনের এক উল্লেখযোগ্য বৎসর, যখন এক খাঁটি বাঙালি রাষ্ট্র এই প্রথম জন্ম নিলো বিশ্বমানচিত্রে। বাঙালি যে পেলব ভীতু জাত নহে, ১৯১১-র পরে বোধহয় তখনই পুনঃপ্রমণিত হলো। এপার-ওপার বাঙালির কণ্ঠে সেদিন ‘শোনো একটি মুজিবরের কণ্ঠ থেকে লক্ষ মুজিবরের...’। এই শারদ-সংখ্যাতেও তাই মুক্তিযুদ্ধ একটা বড়ো স্থান করে নিয়েছিল হাসান মুরশিদের চিঠিতে, শৈল চক্রবর্তীকৃত কাহিনিচিত্রে, হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়ের গল্পে।
বিভাগ ছিলো ‘ধাঁধা-হেঁয়ালি’-র, ম্যাজিকের, বৈজ্ঞানিক কারিগরির---সব দিকে কেমন নজর ছিল সম্পাদক মহাশয়ের। হর্ষবর্ধন নিয়ে হাজির ছিলেন এক ও অদ্বিতীয় শিব্রাম, টেনিদা নিয়ে নারায়ণজায়া আশা দেবী। না, নারায়ণবাবুও ছিলেন, টেনিদা নয়, রবীন্দ্র-প্যারোডি এক ‘হৃদয় আমার নাচে রে আজিকে...’ নিয়ে। আর লিস্টি দীর্ঘ করে লাভ কী?
শৈল চক্রবর্তী, নারায়ণ দেবনাথের অঙ্কন আমরা দেবেদের বার্ষিকীতেও পেতাম, ভারতীর এক্সক্লুসিভ ইলাস্ট্রেটর ছিলেন ময়ূখ চৌধুরী, সূর্য রায় (প্রচ্ছদ)। কী অপূর্ব মনোহরা কাজ! নণ্টেফন্টে তো ছিলোই, দেবেদের বাঁটুল-হাঁদাভোঁদার জুড়ি (সে বছর দেবনাথদা অসুস্থ ছিলেন বলে ময়ূখ এঁকে দেন! কমরাডরি!)
কিশোর-ভারতী-সন্দেশ-কেন্দ্রিক বাঙলা শিশুসাহিত্যের ধারায় পলি কেন পড়ে এলো, গবেষণার বস্তু সেটা। বেদনারও। তবে, বর্তমান প্রয়াসের মাধ্যমে সে-গাঙে একটা বান এসে পড়লে সার্থক হয় এ-প্রয়াস।
ইদানীং এখানে ওখানে বেশ কিছু লেখা দেখে আশা জাগছে ফের--এটাই আনন্দের, এটাই বুক বাঁধার।
একেনবাবু সমগ্র (খণ্ড ১) —সুজন দাশগুপ্ত; দ্য কাফে টেবল, ব্যাণ্ডেল, হুগলি, পশ্চিমবঙ্গ – ৭১২১২৩; ISBN নেই।
গোড়ায় চোখটা গিয়েছিলো প্রচ্ছদের চরিত্রটির টেরচা চাউনিতে। পিছনের রক্তিমাভ ল্যান্ডস্কেপটি অভ্রান্তভাবে নিউ ইয়র্কের, কিন্তু সামনে ঐ কুঁচকোনো কোটপরা গালে দু’দিনের বাসী দাড়ি লম্বকর্ণটি কিনি? শিরোনামানুযায়ী এঁরই একেনবাবু হবার কথা, কিন্তু একেন আবার কেমন নাম? একেন্দ্র থেকে? রাজেন্দ্র, দেবেন্দ্র না হয় বুঝলুম, কিন্তু একের মধ্যে আবার ইন্দ্র (শ্রেষ্ঠ) কে?
সে না-হয় রইলো, থাক্, নামের কুলুজী খুঁজতে থোড়াই বসেছি। পৃষ্ঠপ্রচ্ছদ অনুযায়ী ডিটেকটিভ নভেলমালা ইটি, তাই তেমত মুড তো বনেই গেছে, পড়বার।
প্রথম উপন্যাসটির নাম ‘ম্যানহাটানে মুনস্টোন’। কী সমাপতন, উইলিয়ম কলিন্সের যে উপন্যাসকে (১৮৬৮ খৃ) প্রথম ডিটেকটিভ নভেলের মর্যাদা দেওয়া হয়, তার নামও ‘দ মুনস্টোন’! তবে, মিল শুধু নামেই। কারণ যে আপাতঃ ঠাট্টাবাজির মধ্যে দিয়ে অতি-জটিল এই গল্পের প্লট ফাঁদেন সুজন, যেমন তার নিরীহদর্শী আবহ এবং শেষাবধি যে মুন্সীয়ানায় একেন-দা তার উদ্ঘাটন করেন, সত্যি বলতে, এই মানের গোয়েন্দাগল্প বাঙলাভাষায় অল্প, অতি অল্প পড়া গেছে এতাবৎ। একেনবাবুর সমালোচনা একটাই হতে পারে সেটা হলো পো বা মার্জারি এলিংগামের মতো ইঙ্গ ক্লাসিসিস্টদের প্রভাব। তা, ব্যোমকেশ-কিরীটি-ফেলুদার মতো কোন্ বঙ্গীয় গোয়েন্দার ওপর না হোম্সীয় প্রভাব আছে? পরাশর বর্মা মশাই, হয়তো অনেকটা স্বকীয় ছিলেন। গোয়েন্দা একেনের এলেম দেখে আমার অবিশ্যি জাসন গুডউইনের বৃহন্নলা-গোয়েন্দা ইয়াসিমকে মনে পড়েছে। সে ইস্তাম্বুলের, একেন বাঙালি হয়েও মার্কিনদেশে — এ-ই ফারাক। তবে, এটি ও দ্বিতীয়টি (‘ম্যানহাটানে ম্যানহান্ট’)-কে শিশুপাঠ্য কেন বলা হলো এটা বিভ্রান্তিকর, কারণ শিশুদের বোধশক্তির উপর যথেষ্ট শ্রদ্ধা রেখেই বলি, ‘গোয়েন্দা গণ্ডালু’ বা ‘ফেলুদা’ যে-অর্থে শিশুপাঠ্য, একেনবাবুর প্লটগুলি তার নিরিখে অতীব জটিল, বুড়োরাই খেই হারিয়ে ফেলে। তাতে, অবিশ্যি, কাহিনিমান ঘাটে না।
ফিকশনের গ্রন্থ-সমালোচনা লেখা বড্ড দুরূহ, আগেও বলেছি, কারণ তা করতে গিয়ে গল্পটা বলে ফেললে অন্যায্য করা হয় পাঠকের প্রতি, আবার গল্পটা না-ছুঁয়ে সমালোচনাই বা লেখা যায় কীমতে? এই সমস্যাটা গোয়েন্দা নভেলের ক্ষেত্রে আরও বেশি করে খাটে। তবু সদ্য সদ্য একেনবাবু শেষ করার ঘোরে এ বই সম্পর্কে বেশ দু’কথা না বলে আর থাকা যাচ্ছে না।
মত ব্যক্তিগত, তাই দ্বিমত থাকতেই পারে। তবু বিচারী, এক সফল গোয়েন্দাগল্পের কী কী লক্ষণ থাকা উচিত? এর আলোচনায় এ’গোত্রের কালোত্তীর্ণ কিছু নিদর্শনের কথা এসে পড়া স্বাভাবিক। বাঙলা থেকেই নিই। যেমন, ‘দুর্গরহস্য’। প্রথমতঃ, আবহ। দুর্গরহস্য উপন্যাসের আবহটাই অসাধারণ, নয়? সেই পলাশী-পরবর্তী বাঙলার টলোমলো ইতিহাস, তার প্রেক্ষাপটে এক প্রাচীন পরিবারের গল্প...। শুরুতেই জমিয়ে দেয়। দ্বিতীয়তঃ, এই প্রেক্ষার কোন্ পরতে পরতে যে রহস্যগল্পের ইঁটগুলো গাঁথা হয়ে যায়, পাঠক যখন বুঝতে পারলো ততক্ষণে তার বোল্ড আউট হয়ে যেতে আর দু’চারটে বল মাত্তর বাকি। তৃতীয়তঃ এক প্রাচীন স্টাইল আছেঃ যে চরিত্রটিকে কালপ্রিট বলে ভেবে নিয়ে নিয়ে পাঠক পড়ে যাচ্ছেন পাতার পর পাতা (অর্থাৎ, লেখক তাঁর মুন্সীয়ানায় পাঠককে ন্যাজে খেলাচ্ছেন) গল্পশেষে এক মোচড়ে তাঁকে ঘোল খাইয়ে সে চরিত্রকে মুক্তি দিয়ে আপাত-নিরীহ ভাইটিকেই খুনী বলে কিস্তিমাত করে দিলেন লেখক। শুধু তা-ই নয়, শেষ অধ্যায়ে ন্যাড়াযজ্ঞির পরমান্নের মতো তারিয়ে তারিয়ে পাঠক সেই রহস্যোন্মোচন উপভোগ করবেন। তাতেই শান্তি, অন্যথায় মনঃক্ষুণ্ণতা। সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ গুণ/লক্ষণ--বইয়ের শেষ পর্যন্ত রহস্যখানিকে টলটলায়মান টেনে নিয়ে যেতে হবে যাতে তা উন্মোচিত হয়েও উন্মোচিত না হয়ে পড়ে।
হ্যাঁ, এ’সব নিরিখেই একেনবাবু দশে নয় পান। তারওপর একেনবাবু চরিত্রের যে ইন-বিল্ট ক্যাবলামি, সেটা যে আসলে প্যাটারিং, এটা বুঝে উঠতে উঠতে দক্ষজাদুকরসম নিজের কাজ হাসিল করে বেরিয়ে গেছেন বিনয়ে বিগলিত সকলকে ‘স্যর’ ‘স্যর’ করা একেন্দ্রনাথ!
বন্ধুবর তারেক আলী ঠিকই ধরেছেন। পার্শ্বচরিত্র বাপি-প্রমথ যেহেতু মার্কিন-বাসিন্দে তাই কথায় কথায় ‘যুক্তি’ বা ‘কেন’ না বলে ‘বেসিস’ আর ‘হোয়াই’ বলেন। বাঙলা উপন্যাসে এতো এতো ইঙ্গবাক্য কানে লাগে, আমাদের মতো প্রাচীনপন্থীদের কাছে বিশেষত। নতুন এই প্রকাশনালয়ের কাজ ভালো লেগেছে, যদিও ব্লার্ব এতো দীর্ঘ পড়তে ভালো লাগে না। বিশ বছরে গ্যাপে লেখক-মহাশয় ফের একেনবাবু লিখেছেন এবং এই মান ধরে রেখে---ভেবে হিংসে হচ্ছিল (‘কালের মন্দিরা’-র পরে এ’হেন উদা. পেলুম)। সত্যি, নব্বুইয়ের দশকে প্রথম প্রকাশিত হওয়া সত্ত্বেও এদ্দিন পড়িনি কেন ভেবে আফশোষ।
বাঙলা গোয়েন্দাগল্পের পাঠকদলকে এখন থেকে দুইভাগে ভাগ করা যাবে, (এক.) যাঁরা একেনবাবু পড়েছেন আর (দুই.) যাঁরা এখনও না।
আমি, বাপু্, এখন থেকে প্রথম দলেই পড়বো, হ্যাঁ।
পুনঃ - দ্বিতীয় খণ্ড কবে হাতে পাবো, স্যর?
KANAN DEVI: THE FIRST SUPERSTAR OF INDIAN CINEMA; Mekhala Sengupta; Publisher: HerperCollins Publishers India. First published in 2015; P-ISBN: 978-93-5136-536-5; E-ISBN: 978-93-5136-537-2
সেই পঙ্কজার জন্মশতবর্ষ এই সবে হলো।
হলিউডে গ্রেটাগার্বো মনরো থেকে এ’দেশে উমাশশী মধুবালা কেউই উচ্চ-ধনী ঘর থেকে আসেননি (দেবিকা রানী ব্যতিক্রম), তবে কাননের মত এতোটা দীনহীন শুরুয়াৎ এনাদের কারোরই ছিলো না। তাই মনে হয়, প্রতিভা-পরিশ্রম-ভাগ্যের কোন্ সমাহার ঘটলে একজন কাননবালার, না, কানন দেবীর জন্ম হয়! ভারতীয় ফিল্মের প্রথম মহানায়িকা কে, দেবিকা রানী (১৯০৭-৯৪) না কাননবালা (১৯১৬-৯২)--এ’বিতর্ক হয়েই থাকে। তবে, দেবিকাকে তুলে ধরবার জন্যে তাঁর প্রতিভাধর স্বামী হিমাংশু রায় ছিলেন, আর কাননের প্রথম স্বামী অশোক মৈত্রেয়র নামোল্লেখমাত্র কাননের আত্মজীবনীতে নাই। কানন সেলফ-মেড।
কাননবালা কতবড়ো অভিনেত্রী ছিলেন বা কত উঁচুমানের গায়িকা তার তুল্যমূল্য বিচার করার জন্যে এই গ্রন্থ-সমালোচনা নয় (সে ক্ষমতাও নাই)। বইখানি ‘পরবাস’-এর এই কলমে স্থান করে নেয় এই বিচারে যে তাঁর জন্মের একশত বৎসর পরেও হার্পার কলিন্সের মতো এক বিশ্বশ্রেষ্ঠ প্রকাশনালয় ইংরেজি ভাষায় জীবনী ছেপে বের করছে এমন এক অভিনেত্রীর যিনি বাঙলা (কলকাতা) ছেড়ে বম্বে যাননি কক্ষনো (যদিও সেকালে কলকাতাই হিন্দি-বাঙলা দুই ফিল্মেরই ভরকেন্দ্র ছিলো)। তবু চল্লিশের দশকে রেঙ্গুনের প্রেক্ষাগৃহে ‘তুফান মেল...’ (‘জবাব’, ১৯৪২) যেমন রমরম করে চলেছিলো, লাহৌরের হলে ‘লগান’ তেমনই। সারা ভারতবর্ষ জুড়ে এমনই দুর্বার আকর্ষণ ছিল বঙ্গললনা কাননবালার! আর বর্তমান গ্রন্থটির লেখিকা, যাঁর জন্মই বোধহয় কাননের চিত্রজগত থেকে অবসর নেবার পরে? কোন্ আকর্ষণে সেই ‘লন্ডন বিজনেস স্কুলে’র গ্রাজুয়েট দিদিমণি জার্মান ব্যাঙ্কের চাকুরি ছেড়ে কাননবালার জীবনী লিখতে উদ্বুদ্ধ হন? কাননবালার জোরটা তাহলে কোথায়?
রূপোলী জগতের বাইরে একটু আসি। সেকালে যাঁর সূক্ষ্ম রুচিবোধকে যামিনী রায় থেকে বিষ্ণু দে সম্ঝে চলতেন সেই অশোক মিত্র (আই সি এস) মহাশয় স্মৃতিচারণা করেছেন—১৯৪১ এ তিনি যখন কৃষ্ণনগরে, স্বামীর সঙ্গে কানন এলেন শ্বশুরালয়ে। কেবল তাঁর অপরূপ রূপ বা কোকিলবিনিন্দিত সুর নয়, তাঁর কথা-বলা হাঁটাচলার মধ্যে অপূর্ব রুচিবোধের হদিশ পেয়েছিলেন মিত্রসাহেব। কোত্থেকে পেলেন কানন এই রুচিবোধ? এ’ও পরিশীলন, তাঁর সুর ও অভিনয়ের মতো। আর জনপ্রিয়তার কথা? ‘চলো, তোমাকে আমার কলেজ দেখিয়ে আনি’, বলে বিলেতভ্রমণকালে ননদাই প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশ তাঁকে কেম্ব্রিজে নিয়ে গেছেন। সেদিন বোধহয় কেম্ব্রিজের সব ক্লাসই মুলতুবি হয়ে গেলো ভারতীয় ছাত্রেরা ভিড় করে কাননবালাকে দেখতে এসেছে বলে। সেখান থেকে যুক্তরাষ্ট্রে। মেট্রো-গোল্ডুইন-মেয়ার স্টুডিও দেখে বেরিয়েছেন, লস এঞ্জেলসের কাগজ হেডিং করলো, ‘ভারতের গ্ল্যামার কুইনকে এসকর্ট করে নিয়ে এসেছেন এক স্টাটিস্টিশিয়ন!’
হ্যাঁ, এ’সব ছুট্কাহানী (anecdote)-তে ভরা এই বইখানি।
পরিশ্রম ও গবেষণার ছাপ বইখানির অঙ্গে অঙ্গে। হাওড়া বা হাড়কাটা গলি থেকে উত্থান উত্থান উত্থান---নিউ থিয়েটার্সের স্বপ্নরাজ্য....দেবকী বসু রাইচাঁদ বড়াল বি এন সরকার থেকে রবীন্দ্র-নজরুলের সুরে গাওয়া, তাঁদের আশীর্বাদ....। ব্রাহ্মসমাজ ও শান্তিনিকেতনের গণ্ডী ছাড়িয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীতকে আমবাঙালির ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়ায় কাননের কৃতিত্ব পঙ্কজকুমার মল্লিকের সমতুল্য। অবধারিত এসেছেন তাঁর সহানুভূতিশীল (দ্বিতীয়) স্বামী নেভি-অফিসার হরিদাস ভট্টাচার্যের কথা, সফল ফিল্ম-প্রযোজনা ব্যবসায়, কাননের অগাধ দানের প্রসঙ্গ, তাঁর আধ্যাত্মিক জীবন। একশ’ বছর আগের এক নারী, যাঁর প্রসঙ্গে আমাদের বাপ-মা-ঠাকুর্দা-ঠাকুমারা নালেঝোলে হতেন, মা গাইতেন, ‘আমি বনফুল গো...’ যেন চোখের সামনে মূর্ত হয়ে ওঠেন এই বই পড়তে পড়তে। আজকাল সুবিধে হয়েছে ইউ-টিউব হাতড়ালেই ‘ইয়েহ্ দুনিয়া তুফান মেল...’ বা, ‘জরা নয়নো সে নয়না...’ শুনতে পাওয়া যায় (এতো সাফ্ উর্দু/হিন্দোস্তানী উচ্চারণ কানন শিখলেন কোত্থেকে?)। বেশ কয়েকটি সুমুদ্রিত সাদাকালো ছবি, কিছু ফিল্মের কিছু কাননের ব্যক্তিগত জীবনের, বইটির মান বাড়িয়েছে। লেখিকার কিছু বাক্যবন্ধ (উদা. পৃ xvi), কিছু ভাষার প্রয়োগ (উদা. পৃ ৩), ও কিছু তথ্যের সঙ্গে সহমত হলাম না (উদা. ব্লার্বে, কানন একটি গান গাইতে এক লক্ষ টাকা নিতেন, এক ফিল্মের জন্যে পাঁচ!)
আজকের বাঙালি প্রজন্মের জন্যে এই বই ইংরিজিতে লেখা সুপ্রযুক্ত হয়েছে, তারা জানুক কঙ্গনা রানাওত বা দীপিকা পাড়ুকোনের দিদিমার কালে ভারতের শ্রেষ্ঠ মহানায়িকা ছিলেন এই বাঙলারই, কলকাতার, আদতে এক ঘরহীনা কুলহীনা ধনহীনা নারী, যাঁকে কাননবালা থেকে কাননদেবী-তে উত্তীর্ণ করে দিয়েছিলেন তাঁর অগণ্য ভক্তকুলই, যাঁদের উদ্দেশ্যে সেই মহীয়সীর আত্মজীবনী ‘সবারে আমি নমি’।
তাঁকে আমরা নমি, শতবর্ষের নয়নজলে। ঠাকুর বলতেন, ‘ওরে, যাকে বহু লোকে মানেগোনে ভালোবাসে, তাঁর মধ্যে ঈশ্বর বিরাজ করেন’।
তা আর বলতে?