• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৬৭ | জুন ২০১৭ | গল্প
    Share
  • রঙমেলান্তি : অদ্রিজা চ্যাটার্জী


    "এই ভাই! আজ আঁকার ক্লাসে দেরি হলে কিন্তু স্যার বলেছে বাইরে থেকেই বাড়ি পাঠিয়ে দেবে" - দোদোলের গলার চিন্তান্বিত তাড়াহুড়ো শুনে গোগোল আরও উৎসাহিত হয়ে ধীরে ধীরে ওর আঁকার সরঞ্জাম গোছাতে লাগল। দোদোল যে বড্ড চাপ নেয় সেটা বুঝে ফেলার পর থেকেই গোগোল এখন নানা অছিলা খুঁজে বেড়ায় ওর চাপটাকে শেষমেষ ভ্যাঁ-তে পরিণত করতে। তবে এ সুখ বেশিদিন সইবে না, তা ও ভালরকম জানে। ওদের মা বাবা এখন কিছুদিন তাদের পৈতৃক ভিটে বাড়িতে গেছে ওদের এক জ্ঞাতি ঠাকুর্দার চিকিৎসা করাতে। গোগোল আর দোদোল আপাতত সপ্তাহ দুয়েক তাদের দিদা দাদুর জিম্মায়। সকল হুজ্জুতির সবচেয়ে সুরক্ষিত জায়গা দাদু-দিদা—তাই গত তিনদিনেই দোদোলকে তার দাভাই-এর জন্য কমপক্ষে পাঁচ থেকে সাতবার নাকের জলে চোখের জলে হতে হয়েছে।

    আঁকার স্যারের ঘটনাটা তার মধ্যে সবথেকে উল্লেখযোগ্য সমস্যা সৃষ্টি করেছে। ওদের আঁকার স্যার তপনদা—ওই পাড়ার এক অগ্রগণ্য প্রতিভা। এমনিতে কিসব বড় পড়াশুনা করে—হয়ত এ পাড়াতে বেশিদিন থাকবে না। গোগোল শুনেছে একদিন বাবাকে বলছে যে সে বিদেশে চলে যাবে। চলে গেলে যে অনেক ভাল হবে, সেই আনন্দেই ও আর আজকাল হোমটাস্কেও 'না' করে না। কিন্তু পড়াশুনা ছাড়াও তপনদার আয়ত্তে নেই এমন কাজ খুঁজে পাওয়া ভার। তার মধ্যে আঁকাটাই অন্যতম। কিন্তু ওদের দুই ভাই-বোনেরই বোধগম্য হয় না যে মানুষটা অত সুন্দর আঁকতে পারে, সে ওরকম খরখরে কাঠখোট্টা ভাবে আঁকা শেখায় কেন।

    গোগোল খুব ছোট নয়—ক্লাস সিক্স হয়েছে ওর এই এপ্রিলে। দোদোলটা অবশ্য ওর ধারণায় 'ঢ্যাঁড়শ'—ক্লাস ফোরে পড়ে অথচ এখনও রাত্রে একা বাথরুম যেতে ভয় পায়! দোদোলকে তাই কান্না কান্না পরিস্থিতিতে ফেলতে ওর সাঙ্ঘাতিক মজা লাগে। এই যেমন তিনদিন আগে, স্রেফ দোদোলকে প্যাঁচে ফেলার জন্যে ও বোনের ক্রেয়ন সেট আর আঁকার খাতাটাকে সযত্নে বালিশের খোলের ভিতরে লুকিয়ে দিয়েছিল। ওগুলো খুঁজে উদ্ধার করতেই সোয়া পাঁচটা হয়ে গেছিল। যেখানে তপন স্যারের কাছে ওদের সাড়ে চারটে টাইম দেওয়া। অবশেষে যখন দু-গলির পর স্যারের বাড়ি গিয়ে উপস্থিত হল দুই ভাই বোন, সন্ধে সাড়ে পাঁচটায়, তখন তপন স্যার আরও তিনজন সিনিয়রদের আঁকা শেখানো শুরু করে দিয়েছেন। দোদোলটা সরল মনে যেই বলেছে, "স্যার, আমার আঁকার খাতা পেন্সিল খুঁজে পাচ্ছিলাম না..."—দাদার গুণপনা অবধি যাওয়ার আগেই স্যারের গুরুগম্ভীর বার্তা এসেছে, "পরেরদিন থেকে নিজেকে খুঁজে আনতে দেরি হলে আর আঁকা শিখে কাজ নেই! বাবা-মাকে বলে দেব যে আগে গোছগাছ শিখিয়ে তারপর এখানে পাঠাতে।" ক্লাস সেভেনের তিনজন দাদা দিদির সামনে এরকম কড়া, গম্ভীর শাসন শুনে দোদোলের চোখ যথারীতি ছলছল। গোগোলের ঈষৎ রাগ হয়েছিল বইকি। বোনুটা ওর কথা পরে বলবার জন্যে রাখল বলেই ধাতানিটা একার ঘাড়ে নিতে হল। পরমুহূর্তেই বুঝল যে 'না! ও ঢ্যাঁড়শ বলেই কায়দা করে অন্য কথা বলতে পারেনি। বেশ হয়েছে! আরও আতুপুশু হয়ে থাকো!’

    তবে আজকেও যখন ঘড়িতে সাড়ে চারটে বাজতে পাঁচ মিনিট বাকি, গোগোলের ধ্যান জ্ঞান তখন কিভাবে দোদোলকে কাঁদাবে! সেদিনকে যেমন কোনক্রমে সন্ধে সাতটার সময় বাড়ি ফিরে দিদুর কোলে গিয়ে দোদোলের সে কি কান্না! ভিন্ডি কোথাকার! আবার ভিন্ডি বললেই মুখ খিঁচিয়ে এক খাবলা নুনছাল তুলে দেবে।

    যাইহোক! আজকে ও নতুন ফন্দি এঁটেছে। আজ ও নিজেই দেরি করবে! হেলতে দুলতে আঁকার সরঞ্জাম নিচ্ছে যখন, দোদোল এসে হাজির, "দাভাই! আজ যদি আমাকে আবার তোর জন্যে বকা খেতে হয় তাহলে..." —ওর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে গোগোল বলে উঠল, "তো? তো কি করবি আমাকে? পড়িস তো ক্লাস ফোরে! অত ফর ফর করিস কেন?” কথাগুলো শুনে দমে গেল দোদোল। কিছু না বলে চলে গেল। 'ভাল হয়েছে' —গোগোল ভাবল! এরপর থেকে অত ক্যাঁচর-ম্যাচর করলেই এই ছোট ক্লাসের টোপটা গেলাবে ওকে। স্কুলে ওর বোনের খুব ডানা ওড়ে। ডানা আবার ওর ভাল নাম—ক্লাস ফোরের প্রথম তিনজনের একজন ও। উঁচু ক্লাসের দাদাভাই র‍্যাঙ্ক করে না বলে স্কুলে যেন চিনতেই পারে না মেয়েটা! মা যেদিন দোদোলকে টিফিনে চাউমিন, এগ্ রোল দেয়, সেদিন গোগোল ওর বোনের ক্লাসে যাওয়ার আগেই মেয়েটা পুরো টিফিনটা গপগপ করে খেয়ে ফেলে—দাদার জন্যে অর্ধেকটা না রেখেই! অবশ্য গোগোলও আগে তাই করত, যখন ও ফোর আর বোন ক্লাস টু। কিন্তু তাতে কি? গোগোল ওর দাদা, বয়সে বড়, এই কথাটা তো বাবাও বলে, দোদোলকে, মাকে—তাতেও ওর লজ্জা নেই। কই! দুষ্টুমি, মারপিট করতে তো বোন ওকে নকল করে না! তো এইসবে কেন?

    ঘড়িতে যখন চারটে পঁয়তাল্লিশ, গোগোল তখন ধীরে সুস্থে সিঁড়ি দিয়ে নেমে বাইরের ঘরের মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে ডাক পাড়ল, “এই বোন, আমি রেডি! তুই কি এখনও তোর খাতা খুঁজছিস?" গোগোল দেখে দিদু বেরিয়ে এসছে তলার খাবার ঘর থেকে। ওদের দিদা বেশ চৌকশ দেখতে। বেরিয়ে আসতেই গোগোলকে বলল, "ডানা তো বেরিয়ে গেছে রে! ও যে বলল তুই ওকে বলেছিস পরে বেরোবি!" গোগোল প্রথমে ভাবল দিদু আর নাতনি মিলে মজা করছে। তারপর দিদুর নির্বাক মুখটা দেখে বুঝল যে না, দিদু সত্যি কথাই বলছে।

    দোদোলকে তপন স্যার আজকে একটা সিনারি কপি করতে দিয়েছে। বেশ শক্ত—কোন এক বিদেশের শহরের এক ছবি। অনেক উঁচু লম্বা সব বাড়িঘর, গাছগাছালিও প্রচুর, মাঝের রাস্তা দিয়ে লোক হেঁটে যাছে। লোকজনের গায়ের রঙ দেখেই ও বুঝেছে যে শহরটা বিদেশের। একবার দাদাভাইকে ক্রিকেট চলাকালীন ও ভুল করে জিগ্যেস করে ফেলেছিল, "এই ওরা সবাই এত ফর্সা কেন রে?"—দাদা তাতে হ্যাহ্যা করে হেসে বলেছিল, "নয় তো কি আমাদের মতন হবে? ওরা তো বিদেশী রে! ফর্সাই হয় রে ভিন্ডি!!"—ভারি দুঃখ হয়েছিল দোদোলের। ও নাহয় তখন সদ্য ক্লাস ওয়ান আর দাদা থ্রিতে পড়ে, তাই বলে ওরমভাবে কিছু না জানলেই ভিন্ডি বলার কি আছে? দোদোল ভিন্ডি খেতে ভালবাসে সেই ছোটবেলা থেকে, ওর দাদার একেবারে উল্টো। তাই বলে কিছু না জানলেই ভিন্ডি?! কেন! মা-বাবা, দাদু-দিদুরাও তো ভিন্ডি খায়—ওদের মুখের ওপর বলে দেখাক তো দাদাভাই যে 'ভিন্ডি কোথাকার'! যওসব!

    সিনারিটা কপি করতে করতেই এসব ভাবছিল ও। নাহ! স্যার আজ বড় শক্ত জিনিস দিয়েছেন! নির্ঘাত ও একা এসেছে বলে! সব দাদাগুলোই এক! খালি প্যাঁচে ফেলার চিন্তা! ঘাড় শক্ত করে এঁকে যাছিল ও। হঠাৎ খেয়াল হল যে চলে তো এসেছে ও কিন্তু দাভাই তো এলো না। সবে দুমাস হল যে ও ঘড়ি দেখতে শিখেছে—খানিকক্ষণ হাঁ করে সামনের বড় ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে থেকে বুঝল যে সাড়ে পাঁচটা বাজে। স্যার কিসব অঙ্ক কষে চলেছে খাতায়। এই অবস্থায় দাদার ব্যাপারে মুখ খোলবার সাহস করল না ও। এখুনি তো অন্য বড় দাদা দিদিরা চলে আসবে। তার আগেই ওকে বেশি কাজটা শেষ করে ফেলতে হবে। নাহলে ফের ওকে দেখলেই আগের দিনের স্যারের বকুনি নিয়ে হাসাহাসি করবে।

    ঘড়িতে যখন সোয়া ছটা, তখন বাকি দাদা দিদিদের সামনেই তপনদা বলে উঠল, "ডানা, তোমার যতটা হয়েছে ততটা অবধি দেখিয়ে আজ উঠে পড়। তোমার দাদা তো বোধহয় আর শিখবে টিখবে না কিছু।”

    বাকি তিনজন—বুবাইদা, টুকিদি আর রুমিদি হাঁ করে দোদোলকে দেখছে—যেন দোদোলের দায়িত্ব দাদাকে আঁকা শেখাতে নিয়ে আসার। দোদোলের রাগ হলেও কিছু বলল না ওদের। মুখে মুখে তর্ক করাটা ওর একদম ভাল লাগেনা। দাদাভাই খুব করে, ওর বন্ধুগুলোর সাথে। মা অনেক বকেছে কিন্তু বাবার কোন হেলদোল নেই বলে সব পার পেয়ে যায়। তপনদাকে শুধু বলল, "স্যার আমি একা এসেছি তো তাই দাদার কথা জানি না।” শুনে বাকিরা একটু নড়ে বসে ফের কাজে মন দিল। তপনদার বাড়ি থেকে যখন ও বেরিয়ে আসছে, দেখে অত বড় মানুষটা বেশ মায়া মায়া মুখ করে ওর দিকেই আসছে।

    দোদোলের সামনে দাঁড়িয়ে তপনস্যার একরকম অপরাধী মুখ করেই জিগ্যেস করল, "সেদিনকে দাদার জন্যে দেরি হয়েছিল...তাই কি?!"—প্রশ্নটা শুনে দোদোলের ভারি অভিমান হয়। ও তো সত্যিটাই বলতে চেয়েছিল। সেদিনকে একঘর বড়দের সামনে তাহলে ওরকমভাবে তো নাই বকতে পারতেন স্যার। কিছু বলল না ও। গলার কাছে একদলা গভীর অভিমানের কান্না উঠে আসছিল। কিন্তু কাঁদবে না ও এখানে। ও দেখেছে, মাকে যখন বাবাই ভুল করে ধমকে দেয়, খারাপ খারাপ কথা বলে, তখন মা শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। পরে ও দেখেছে যে মা লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদে। হয় দিদুকে ফোন করতে গিয়ে নাহলে ওদের ঘরের ভেতরে একলা দাঁড়িয়ে। ও’-ও একা একা কাঁদবে। মায়ের মতন। নাহলে এখন দিদু আছে তাই দিদুর কাছে গিয়ে।

    তপন স্যার যতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল, দোদোলের মাথায় ততক্ষণ এসবই ঘুরে যাছে। ও ভেবেছিল ওর চুপ থাকা দেখে স্যার ওকে গুরুগম্ভীর স্বরে বকাঝকা দেবে। কিন্তু কে জানে কেন, স্যার বকল না একটুও। ওর নিচু করা মুখটা তুলে ওর মাথায় খুব শান্ত স্নিগ্ধভাবে হাত বুলিয়ে দিল। দোদোলের চোখটা বোধহয় অভিমানের চাপা ব্যথায় লাল হয়ে আসছিল তাই স্যার কেবল বললেন, "কেঁদো না। কান্নাকাটি করলে গোগোল তোমাকে আরও কষ্ট দেবে। দোদোল শুনে চুপ করে থেকে ঘাড়টা নাড়িয়ে সম্মতি দিল কেবল। দিয়ে ও ঘুরে গিয়ে গেটটা খুলে বাড়ির দিকে রওনা দিল।

    গোগোল নিশ্চয়ই এতক্ষণে বাড়িতে মহাভারত করছে। দোদোলের এবার ভয়ই করছিল—গোগোলটা না আবার ওদের ঘরটা তছনছ করে ফেলে রাগে। এখন মা বাবাও নেই! অবশ্য থাকলেও কিছু হত না—বাবা কিছু বলবে না গোগোলকে—মায়ের একার বলাতে কিছু যে হবে না সেটা ও জানে। হনহন করে বাড়ির দুটো বাড়ি আগে যখন ওর গতি কমিয়ে আনছে, দেখে বাড়ির সামনে ওদের গাড়িটা দাঁড়িয়ে। লাল রঙের যেটাকে নাকি বার্গান্ডি বলে, মারুতি গাড়িটা—যেটা এখন দূরের ওদের গ্রামের বাড়ির দিকে থাকার কথা, সেটা হঠাৎ এখানে কি করছে দোদোল বুঝল না। কারণ ওর মা-বাবার তো অনেকদিন ওখানে থাকার কথা।

    দোদোল বেরিয়ে আসার পরমুহূর্তেই তপন স্যারের মনে হলও যে খুব ভুল করে ফেলেছিল সেদিন। দোদোল আর গোগোল ওর কাছে একবছর যাবৎ আঁকা শিখছে—লক্ষ্য করে দেখেছে যে দোদোল কেমন যেন দাদার উপস্থিতিতে আড়ষ্ট থাকে। যে কোনও ভাইবোনের মধ্যেই ঝগড়াঝাঁটি এই বয়সে খুব স্বাভাবিক এক ঘটনা। কিন্তু কয়েকটা উদাহরণ ওকে ধাঁধায় ফেলে দেয়। দোদোল তার বয়েস অনুযায়ী যতটা শিশুসুলভ মনের ততখানিই কিন্তু আত্মসন্মানবোধ তার অটুট। আট নয় বছরের খুব বেশি ছাত্রছাত্রীকে ও সিটি লাইফ আঁকতে দেবে না। কোথাও একটা ওর নিশ্চিত বিশ্বাস যে ও পারবে, দোদোলের সেই প্রতিভা আছে। অন্যদিকে গোগোল বড়ই প্রশ্রয়ে গদগদ। ওর পরিষ্কার মনে আছে, যে যেদিন গোগোল আর দোদোলকে ও প্রথমবার একটাই সিনারির ছবি আঁকতে দিয়েছিল, গোগোল এঁকেছিল কিন্তু বড়ই দায়সারা ভাবে। অন্যদিকে দোদোল অনেক যত্নসহকারে নিপুণতার সাথে প্রত্যেকটা বাড়ি, রাস্তা, গাছ আঁকছিল। হয়ত দুজনের কারুরই সেদিন অনভিজ্ঞ হাতে একেবারে আহামরি কোনও ছবি ফলপ্রসূ হয়নি, তবে এটাও ঠিক যে সেদিন বা তার পরে, গোগোলের সেটা নিয়ে কিঞ্চিত মাথাব্যথা না থাকলেও, দোদোলের ছিল। সেটা যেমন পড়াশুনার জন্যেও ও দেখে সত্যি, তেমন অন্যান্য শিল্প বা খেলাতেও। গোগোল যে বড়ই অসাবধানী, একবগ্গা, তা নিয়ে তপনের কোনও সমস্যা নেই—ওর চিন্তা একমাত্র যে গোগোল-ও না একদিন তার এই অসাবধানতার দাস হয়ে সেটাকেই ঠিক বা উচিত মনে করে নেয়।

    কারণ তপন চায় না যে গোগোল তার বোন দোদোলের এই প্রতিভা, আগ্রহ, চেষ্টাকে নিচু করবার চেষ্টা করুক। ও জানে যে যেরকম একদিন গোগোল ইচ্ছে করে, দোদোলের আড়ালে ওর ছবির খাতার ওপর কালির শিশিটা ফেলে দিয়েছিল বা অন্য আরেকদিন দোদোলের আঁকার হোমটাস্কে গঁদের আঠা দিয়ে স্টিকার সেঁটে দিয়েছিল—সেরকমই একদিন ঈর্ষা হবে গোগোল আর দোদোলের ফাটলের কারণ।

    শিশুমন বড়ই অদ্ভুত। তপন জানে সেটা। যেরকম ওর প্রতিভাকে একদিন ওরই পিসতুতো দাদা খর্ব করতে গেছিল—সেই খর্বের যাত্রা ছেলেবেলা থেকেই শুরু হয়। মা বাবারা এসব ক্ষেত্রে থাকে নীরব দর্শক। ছেলেভোলানো রসিকতার আড়ালে চলে কত ভবিষ্যৎ চূর্ণ করা অভিসন্ধি—তা দূরদৃষ্টি বা নিজস্ব অভিজ্ঞতা না থাকলে উপলব্ধি করা অসম্ভব। তপনের মা বাবাও যে ভুল করেছিলেন আঠারো কুড়ি বছর আগে, তপন মানসচক্ষে দেখছে দোদোল–গোগোলের মা বাবাকে সেই একই ভুল করতে। তপনের মা বাবার ভুলের খেসারত তারা আজ দিচ্ছে যখন প্রতিভা থেকেও তাকে চিহ্নিত করা হয় আত্মীয়মহলে দাদার 'চাকরি খেয়ে’ নেওয়ার অপরাধে—ক্রমশ একঘরে হয়ে গিয়ে। তাই তার ভাবনাতে প্রতিনিয়ত ঐ দুটো শিশুমন থাকছে। ভাবছে কি করে বাঁচানো যায় দুজনকে।

    দোদোল বাড়ির সামনের গাড়িটাকে দেখে একপ্রকার চিন্তিতই হয়ে গেল। মা, বাবা ঠিক আছে কিনা এই আশঙ্কাটাই তাকে উদ্বিগ্ন করে তুলল। হনহনিয়ে গিয়ে বাড়ি ঢুকে দেখে—ঘর আলো করে মা বাবা বসে আছে। ওকে দেখেই বাবা বলল, "কিরে! কেমন সারপ্রাইজ দিলাম বল!!” দোদোল ছুটে গিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরল। বাবার গায়ের গন্ধটা ওর ভারী প্রিয়। মা এসে শাড়ির আঁচল দিয়ে ওর মুখটা মুছিয়ে বলল, "কাল তো গোগোলের জন্মদিন, তুই আজ ওকে একা রেখে আঁকার ক্লাসে চলে গেলি সোনা?"—মায়ের গলায় যেন বেশ অনুযোগ। দোদোল কিচ্ছুটি বলবে না। ও জানে কিছু বললেই ওকে বলা হবে, "গোগোল তোমার দাদা সোনা! বয়সে বড় তো ও, ও অমনি করবে, তুই তাই বলে অমুক অমুক করবি!”—তাই ও চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকল। গোগোল ততক্ষণে যা নালিশ করার তা করে ফেলেছে ঝুড়ি ঝুড়ি। কিন্তু দিদু এসে বলল, “না রুনা, তুই ডানাকে কিছু বলবি না। সম্পূর্ণ দায়টাই কিন্তু গোগোলের।” পরমুহূর্তেই দিদু আস্তে করে মায়ের কাছে এসে বলল, "গোগোলের কিছু আচরণে কিন্তু এখনই রাশ না টানলে মুশকিল!” তাতে মা বলল, “আমি জানি মা, কিন্তু তুমি তো জানো পলাশ ওর বিরুদ্ধে একটা কথাও শুনবে না!” দিদু তাতে নিশ্চুপ রইল।

    সবাই আবার যে যার কাজের ছন্দে লেগে গেল। বাবা যথারীতি টিভিতে খবর; মা গেল মুখ হাত ধুতে আর দিদু রান্নাঘরে সকলের জন্য চা বানাতে। দোদোল ঢোকা ইস্তক গোগোলকে দেখেনি। গুটি গুটি পায়ে ও ওপরের সিঁড়িতে গেল। বেশ বুঝতে পারছে ওপরের থমথমে গাম্ভীর্যে যে গোগোল মারাত্মক রেগে আছে। সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে সামনেই একটা ছোট স্টাডি, তার থেকে বাঁদিকে পরপর দুটো ঘর, একটা দোদোল গোগোলের, অন্যটা দিদুরা বা অতিথি আসলে তাদের।

    স্টাডি থেকেই ওদের ঘরটা জরিপ করতে লাগল—গোগোল গোঁজ হয়ে খাটে বসে আছে, দাদু পাশে বসে আছে, দোদোল কে দেখে বলল, "দিদুভাই, দাদা খুব রেগে আছে।” গোগোল শান্তভাবে বলল, "কই! না তো! ও তো গেছিল আঁকার ক্লাসে, আমি যাইনি! ফুরিয়ে গেল।” দাদু বুঝল তার জেদি একরোখা নাতি নাতনিকে পাঠ পড়ানো তার পক্ষে সম্ভব না। সে উঠে যেতে যেতে বলে গেল, "দেখো দাদুভাইরা আমার, ওরকম গোঁসা করতে নেই।” দোদোল চুপ করে দাভাইয়ের সামনে গিয়ে বলল, “দাভাই, আঁকতে না গেলে, যখন স্যার আর থাকবে না এখানে, তখন এত ভাল আঁকা শিখতে পারব না রে। তাই জন্যই তো গেলাম। আমি ভাবলাম তুই আসবি, এলি না তো!” গোগোল ওর সামনে থেকে উঠে উলটো দিকে জানলার সামনে থাকা টেবিলের ওপর হিস্ট্রি বই খুলে বসল। দোদোলের এত খারাপ লাগছিল যে সবাই মিলে যেন ওকে শাস্তি দিচ্ছে কেবল ও দাদার দুষ্টুমি উপেক্ষা করে একা আঁকা শিখতে গেছে বলে। লজ্জায় কষ্টে ও বলেই ফেলল, "দাভাই সরি সরি সরি! এভাবে আমার সাথে আড়ি করিস না। আয় না খেলব।” তাতে গোগোলের নিশ্চুপ উত্তর, “আমার পড়া আছে।”

    রাত্রে খেয়ে ওঠা অবধি বাড়িতে হইচই তেমন কিছু নেই। মা কেবল পরেরদিন গোগোলের জন্মদিন বলে কেক, ফ্রায়েড রাইস বানানোর আয়োজন করল। বাড়ির পরিবেশ স্বাভাবিক, বাবা মেতে আছে কিছু উপহার রঙিন মোড়কে মোড়ানোর জন্যে। দিদু দাদুন যা এনেছিল গোগোলের জন্মদিনের জন্যে সেগুলোকে বাবাই বসে বাঁধাছাঁদা করেছে। রাত্রের খাওয়াদাওয়া শেষ। ভাত মাছের ঝোল দিয়ে খাওয়া সেরে দুই ভাইবোন মিলে ওপরে উঠে এলো।

    ওপরে ওঠার সময় গোগোল হঠাৎ শুধল, "আজ কি শেখালেন স্যার?" দাদা এতক্ষণে স্বাভাবিক ভাবে কথা বলছে দেখে দোদোলের সে কি আনন্দ! অবশেষে দাদার রাগ পড়েছে ভেবে মহানন্দে শুরু করল যে স্যার আজকে কত কঠিন সিনারি আঁকতে দিয়েছে তার বিবরণ। এসব বলতে বলতে দুজনে ঘরে ঢুকতে গোগোল আচমকা জিগ্যেস করল, "তুই আমায় জন্মদিনের উপহার দিবি না বোনু?" দোদোল কল্পনাও করতে পারেনি যে তার পক্ষেও দাদাকে উপহার দেওয়া সম্ভব। সরলমনে বলল, "কি দেব রে দাদাভাই? আমার কাছে তোকে দেওয়ার মত তো কিছু নেই! আগে বললে কিছু বানিয়ে রাখতাম তো! এমা এখন তো আর সময়ও নেই!" গোগোল তা শুনে মুচকি হেসে বলল, "না আছে তো!" দোদোল একেবারে বুঝতে পারছে না যে দাভাই কি বলে চলেছে বা কি বলতে চাইছে! অবাক চোখে তাকিয়ে আবারও বলল, "কি আছে রে? বল না!" গোগোল মুখটা হাসি হাসি করে বলে উঠল, "কেন! তোর পুতুলের বাড়িটা! ওটা আমার খুব পছন্দ! ওটা আমাকে দে আমার জন্মদিনে!”

    কথাটা শুনে দোদোল প্রথমে ভাবল দাদা ইয়ার্কি করছে বোধহয় ওর সাথে! খুব ঠাট্টা করে দাভাই ওকে নিয়ে মাঝে মাঝেই! কিন্তু আবার যখন গোগোল নির্বিকারভাবে বলল, "কেন দিবি না আমাকে?” তখন দোদোল বুঝল যে দাদার এই আবদারটা আর যাই হোক ইয়ার্কি একেবারেই নয়। দোদোলের পুতুলের বাড়িটা দোদোলের প্রাণ! বাবাকে অনেক অনেক বুঝিয়ে, কান্নাকাটি করে ও তার এক একটা ঘরের সরঞ্জাম, সাজ, ভেতরের ব্যবস্থা সব করেছে। ওর পুতুলের বাড়িটা একটা দেওয়াল আলমারির দুটো তলা জুড়ে। কাচ দিয়ে দেখা যায়—ভেতরে কত রকমের জিনিস, বিভিন্ন রকমের রসদ দিয়ে তা সাজানো। লেগোর রাস্তা, কাঠের ছাল দেওয়া মাটির বাড়ি, ভেতরে ছোটো ছোটো বেত, কাঠ, প্লাস্টিক, চীনেমাটির খাবারের টেবিল—তাতে নিজে হাতে কাপড় কেটে করা কভার, নকশা তোলা ছোট সোফা সেট। আসল ফোম দিয়ে করা, বাবা করে নিয়ে এসেছিল। রান্নাঘর, কলতলা, ছোট বাগান—সব, সব আছে। দুবছরের ওপরে ধরে তিল তিল করে সব সাজিয়েছিল দোদোল। ওখানেই ও খেলে। ছোটো ছোটো পুতুল আছে সামঞ্জস্য বজায় রেখে। আর আজ ওর দাভাই ওর সেই নিঝুম দুপুরের খেলার রসদ, বিন্দু বিন্দু করে গড়ে তোলা চিন্ময়ী রূপের সেই নগরীকে ওর কাছ থেকে নিয়ে নেওয়ার আবদার করছে! না এটা দোদোল দিতে পারবে না, "না দাভাই! তুই অন্য যা কিছু চা কিন্তু এটা নিস না—প্লিজ দাদাভাই!"—বলতে বলতে ওর গলা ধরে এলো! আর পারছে না ও স্থির থাকতে! একছুটে নিচে নেমে হাউ হাউ করে কেঁদে বলল, "মা! মা! দাভাই বলছে ওর জন্মদিনে আমার পুতুলের ঘরটা ওর চাই! মা আমি দেব না মা! আমি পারব না দিতে!" শুনে রুনা বলল "না না ও ওটা মোটেও নিতে পারে না! ওটা তো তোর! ও তো ওটা দেখলেই খ্যাপাত! বলত পুতুলখেলা খুকি!”

    এরমধ্যে গোগোল নিচে নেমে এসেছে। সবার সামনে ঘোষণা করল, "ওপরে ঐ পুতুলের ঘরটা না নিজে নিজেই কিরকম কয়েকটা জায়গায় ভেঙে পড়ল। গিয়ে দেখবে এস।”

    এটা শুনে দোদোলের ঠিক কি চলছিল মনে তা ও কাউকে, এমনকি নিজেকেও বুঝিয়ে উঠতে পারবে না। সবাই মিলে ওপরে গেল। মা, বাবা, দিদু, দাদুন। একা দোদোল নিচে। দোদোল সবার পরে গিয়ে ধীরে ধীরে দরজার সামনে গিয়ে ঘরটা দেখল। আলমারির নিচের তলার মাটির সব জিনিসগুলো টুকরো টুকরো হয়ে গেছে—কাঠও ফেটে গেছে কয়েকটার। ও কিছু বলতে পারল না, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুধু নিঃশব্দে চোখের জল পড়ে যাচ্ছিল।

    সব দেখে বাবা শুধু বলল, "গোগোল, তুমি এত নিচে নেমে যাবে আমি ভাবতেও পারিনি কোনদিন।”

    "আমি তো কিছুই করিনি বাবা!"—গোগোল একটু দমে গেল।

    "আমি তোমার বাবা তো তাই সবকথা আগে থেকে বলে দিতে হয় না আমাকে।”

    দিদু এসে দোদোলকে কাছে টেনে বলল, "ডানা, চল তোর দাদু আর আমার সাথে শুবি তুই।” দোদোল নিঃশব্দে দিদুকে অনুসরণ করল। সবাই এক এক করে ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল—রুনা কেবল পলাশকে বলল, "অনেকদিন আগে শাসনটা করলে আজ এই দিন আসতো না।”


    গোগোলের ঘরে তখন অন্ধকার। মা বলে দিয়ে গেছে যে সেই রাত্রি থেকেই গোগোল আর দোদোলের ঘর আলাদা। দোদোল পাশের ঘরে থাকবে। দিদুরা থাকলে তাদের সাথে শোবে আর না থাকলে মা বা বাবা এসে শোবে যতদিন না দোদোল একলা শুতে পারছে। গোগোল যেহেতু একা শুতে বা বাথরুমে যেতে ভয় পায় না তাই ও একা শুতে পারবে বলেই সবার ধারণা।

    এই প্রথম গোগোল একলা শুতে গেল। ও জানে না যে কিসের বশে ও ওরকমভাবে ঘরটাকে ভেঙে দিল। বোনকে কাঁদাতে ভাল লাগে বলে নাকি এমন কিছুর জন্যে যা ওর কাছেও সম্পূর্ণ অজানা। ভয় করছিল গোগোলের। ছিমছাম ঘোরের এই একলা আঁধারে দোতলা বাড়ির এই ঘরটা যেন প্রতিধ্বনি দিচ্ছে অন্য পাড়ার কুকুরের অবিরাম কান্নার চাপা পড়া সুরটা। গোগোল বেডসুইচটা জালিয়ে দিল আবার। সবকিছু খুব অচেনা ঠেকছে ওর। এই ঘরটা, আসবাবপত্র, বিছানার মশারি।

    জলটা কোণের জানলার কাছের পড়ার টেবিল এ রয়েছে—বেডসুইচটা জ্বালা সত্ত্বেও একটা আশঙ্কা হল গোগোলের। কিসের আশঙ্কা জানে না ও। খুব জল তেষ্টা পেয়েছে ওর—কিন্তু জলটা খেতে টেবিল অবধি যেতে অদ্ভুত এক চোরা ভয় করছে ওর। যে ভয়টা দোদোল পেলে ও খ্যাপাত বোনকে। যেই ভয়টা পেলে দোদোলের মুখটা ফ্যাকাসে, দিশেহারা হয়ে যেত। গোগোলের সামনের কোনও আসবাবে যদি আয়না থাকত তাহলে ও দেখতে পেত যে সেই পাংশুটে রঙটা কেমনভাবে যেন দোদোলের মুখ থেকে ওর মুখে এসে লেগে গেছে। পাশের ঘরে দাদু, দিদু, দোদোল থাকলেও গোগোল ডাকতেই পারছে না ওদের। 'কেন?'—কারণটা ওর অহং ধরা পড়ে যাওয়ার ভয় নাকি কেবলই ওর নিজস্ব আতঙ্ক থেকে মুখ লুকিয়ে থাকার প্রচেষ্টা তা জানে না ও।

    মশারিটা খানিকক্ষণ পরে বহু কষ্টে একটু একটু করে খুলে সন্তর্পণে চারপাশটা দেখে নিল গোগোল। কোথাও কিছু নেই। অনেকটা সাহস সঞ্চয় করে, জলের জগ রাখা টেবিল অবধি ওর ভারি হয়ে যাওয়া পা দুটোকে টেনে আনল। ঢক ঢক করে দু তিন গ্লাস জল খেয়ে একছুটে চলে গেল বিছানায়। টেবিলের সামনের জানলাটা যেন খেতে আসছে ওকে। ভয়ে, আশঙ্কায় চোখটা বুজে ফেলল গোগোল। যেন সমস্ত চিন্তা, ভয়ের ওখানেই শেষ, ওর চোখের পাতার ভেতর - সমস্ত আশঙ্কার দুয়ার যেটা ও বন্ধ করতে পেরেছে। ঘুম এলো কিনা জানে না, কিন্তু এইমুহূর্তে ওই চোখ-আবৃত অন্ধকারটাই ওর একমাত্র স্বস্তির আবর্ত।

    কতক্ষণ ওভাবে চলে গেছে গোগোল জানে না—হঠাৎ এক তীব্র ব্যথার অনুভবে ওর চোখ বন্ধ করা অন্ধকারটা ভাঙতে বাধ্য হল। অসম্ভব বাথরুম পেয়েছে ওর। এদিকে বাথরুমে যেতে হলে ঘর থেকে বেরিয়ে স্টাডি, সিঁড়ির মুখ অবধি যেতে হবে। সেখানে যেতে যত না ভয় তার থেকে অনেক বেশি চিন্তা যে এই ঘরটা খালি রেখে যেতেও হবে আর ফিরতেও হবে এই খালি ঘরে, জানলা খোলা অবস্থাতেই। বাথরুম চেপে রাখা যখন অসম্ভব হয়ে উঠেছে, প্রাকৃতিক তাড়না ভয়ের ঊর্ধে গিয়ে ওকে নিয়ে গেল বাথরুমে।

    বাথরুম থেকে ঘরে ফেরার মতন দুঃসাহসিক কাজ গোগোল আগে করেছে বলে ওর বিশেষ মনে হয় না। কিন্তু ঘরে ঢুকে যখন ও বুঝল যে ঘরটায় ও তাড়াহুড়োয় একটাও লাইট না জ্বালিয়ে চলে গেছিল এবং সুইচটা ঠাহর করতে হলে এই অন্ধকারেই করতে হবে, সেই উপলব্ধিতেই ওর গোটা শরীরটা ছেড়ে দিল। ও পারবে না, আর পারবে না—এখানেই, এই ঘরের চৌকাঠেই বসে থাকবে যতক্ষণ না ভোর হচ্ছে ।

    আচমকা ঘরের ভেতর থেকে এক ছোট্ট ছায়ামূর্তি দেখে এগিয়ে আসছে ওরদিকেই। একমুহূর্তের জন্যে গোগোলের মনে হল যে এটাই ওর শেষ মুহূর্ত। কিন্তু হাতটা মাথায় ছুঁতেই ও বুঝল যে ও আর একা নেই ঘরে। "দাভাই! খুব ভয় করছে তোর তাই না?!"—গোগোলের সবচেয়ে আশ্চর্য লাগল যে প্রশ্নটার ভেতরে দোদোলের একরাশ ব্যথা, কষ্ট আছে কিন্তু ঠাট্টার তির্যকতা নেই। দুহাত দিয়ে ও বোনকে আঁকড়ে ধরল। কোন কথা, কোনও অভিব্যক্তির আর ক্ষমতা ছিল না তাদের প্রকাশ করবার। ওর চোখ দিয়ে কেবল অঝোর ধারায় জল পড়ে চলেছিল। আর পারছিল না তাদের আটকাতে, কোথাও একটা ইচ্ছেও করছিল না। অভিমান, কেবল অভিমান ঝরে পড়তে চাইছিল। অভিমান নিজেরই ওপর, অভিমান তাদের ওপর যারা হঠাৎ ওকে একদম একলা করে দিয়ে নিজেদের পুরনো চেনা জায়গায় ফিরে যেতে পারল নিশ্চিন্তে। কিন্তু দোদোল?! আজকে তো গোগোলের এই অন্ধকার ঘরে, অন্ধকার নেমে আসা সকল প্রশ্নের মধ্যে দোদোল কোথাও চলে যায়নি!

    দাভাইয়ের চোখের জল মুছিয়ে দিচ্ছিল দোদোল। "না দাভাই! তোকে কাঁদলে একদম ভাল দেখায় না রে... কাউকেই কাঁদলে ভাল দেখায় না দাদাভাই!” গোগোল আরও জোরে আঁকড়ে ধরল বোনকে—নিঝুম রাতের সাক্ষী হয়ে রইল অব্যক্ত অপরাধবোধের উপলব্ধি।




    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ রাহুল মজুমদার
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments