• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৬৭ | জুন ২০১৭ | গল্প
    Share
  • অশ্লোকসম্ভব : রঞ্জন ভট্টাচার্য


    ইভাবে ওরা অগ্রসর হতে লাগলো। একে অন্যের পিছুপিছু। নিঃশব্দে। কিন্তু নিশ্চিতভাবে।

    ***
    সূর্যাস্তের সময়। মহাযুদ্ধের আগে এই শেষ সূর্যাস্ত। দূরের হিরণ্ময় মেঘে সময় যেন নির্ণিমেষে তাকিয়ে আছে সামনের বিপুল রণসম্ভারের দিকে।

    তাকিয়ে আছেন তিনিও। ওই আপাতনিশ্চল সৈন্যসমাবেশের সামনে। নিয়তির মতো নির্বিকার দৃষ্টিতে। তিনি যে মহামতি। মহর্ষি।

    কিছুক্ষণ আগেই এই রণস্থল বিদীর্ণ হয়েছিলো কৃষ্ণার্জুনের শঙ্খধ্বনিতে। সেই মহানাদে ত্রস্ত হয়ে বিকট চিৎকার করে উঠেছিলো দুর্যোধনের শতাধিক যুদ্ধাশ্ব। ধূলিঝড়ে আচ্ছন্ন হয়েছিলো চতুর্দিক। কিন্তু এখন এই আসন্নসন্ধ্যায় চারিদিক মধ্যরাত্রের পাখির মতো নীরব।

    ওই সমূহ আয়োজনের মধ্যেই মহর্ষির দৃষ্টিগোচর হলো এক আশ্চর্য বিষয়। তিনি দেখতে পেলেন একটি পিঙ্গলবর্ণের কীট সম্মুখের যুদ্ধভূমির উপর দিয়ে এগিয়ে আসছে তাঁর দিকে। কীটটিকে নিরীক্ষণ করার জন্য তিনি এগিয়ে গেলেন। তারপর কি মনে হতে পরম মমতায় তাঁর ডান হাতে তুলে নিলেন সেই ক্ষুদ্র প্রাণটিকে। কীটটি ক্ষণিকের জন্য বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকালো তাঁর দিকে। তারপর তার সামনের হস্ত (অথবা পদদুটি) জোড় করে বলে উঠলো — "প্রণাম ঋষিবর! প্রণাম! যাওয়ার শুরুতেই আপনার দেখা পেলাম। তাই আমার যাত্রা নিশ্চয়ই সার্থক হবে।" মহর্ষি বললেন — "কিসের যাত্রা?" কীটটি বললো--সেরকম কিছু নয়। বরং অত্যন্ত সাধারণ।" মহর্ষি বললেন — "বিষয়টি কি?" কীটটি যেন খুব কুন্ঠিত হয়ে উত্তর দিলো — "বাড়ি ফিরবো। অনেকদিন বাদে। কিছু খাদ্যের সংগ্রহে বেরিয়েছিলাম। পেয়েছি কিছু সন্ধান। কিন্ত আগে তো বাড়ি ফিরি। তারপর সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে। বাড়িতে আমার স্ত্রীপুত্রপরিবার অপেক্ষা করে আছে আমার জন্যে কতকাল ধরে।" যেন এক নিশ্বাসে কথাগুলি বললো সে। মহর্ষি জিজ্ঞাসা করলেন — "কোথায় তোমার বাসস্থান?" "ওই তো — ওই দূরে — এই কুরুক্ষেত্রের শেষ প্রান্তে।" মহর্ষি অবাক হয়ে তার দিকে তাকালেন। কীটটি বললো — "একটা কথা জিজ্ঞাসা করবো প্রভু?" মহর্ষি বললেন — "হ্যাঁ বলো।" "চারিদিকে কিসের এত কোলাহল? মাঝেমাঝেই বিকট আওয়াজে সবকিছু যেন থরথর করে কেঁপে উঠছে — কোথাও কোনো দুর্যোগ হলো নাকি প্রভু? বিরাট কোনো ঝড়? বৃষ্টি? ভূমিকম্প? তাহলে তো এই দুর্যোগের আগেই আমায় বাসায় পৌঁছতে হবে — সেখানে যে আমার স্ত্রীপুত্র পড়ে রয়েছে — " মহর্ষি ম্লান হেসে বললেন — "সেসব কিছু নয় — যুদ্ধ হতে চলেছে — এসব তারই প্রস্তুতি।" কীটটি যেন আশ্বস্ত হয়ে উত্তর দিলো — "ওহ যুদ্ধ! তা হোক গে! কিন্তু সে তো শুনেছি রাজারাজড়াদের ব্যাপার — তাহলে আপনি এখানে কি করছেন প্রভু?"

    কীটটির এই প্রশ্নে মহর্ষি মুহূর্তের জন্য হতচকিত হলেন। তারপর বললেন — "দেখছি।"

    "কি দেখছেন প্রভু?”

    "সব দেখছি।"

    "কেন? কেন?"

    "এদের সমস্ত কথা আমায় লিখতে হবে — এদের ধর্মের কথা... অর্থের কথা... কামের কথা...আর মোক্ষের কথা...সব লিখতে হবে...কিচ্ছু বাদ যাবে না..." যেন স্বগতোক্তির মতো বলে উঠলেন সেই মহাযোগী ব্যক্তিটি।

    "কিচ্ছু বাদ যাবে না? তাহলে আমার কথাও লিখবেন প্রভু?"

    কীটটির এই কথায় বোধহয় একটু অপ্রস্তুতে পড়ে গেলেন মহর্ষি। তারপর যেন সস্নেহে তার পৃষ্ঠে অঙ্গুলিস্পর্শ করে বললেন — "অবশ্যই — তোমারও কথা লিখবো।"

    বলেই তাঁর মনে হলো — সত্যিই তো — শুধু রাজন্যবর্গ নয় — বলতে হবে সমস্ত স্তরের মানুষের কথা — জীবজগতের কথা — আসমুদ্রহিমাচলপর্বতের কথা।

    ক্ষণিকের এই নীরবতায় কীটটি সম্ভবত অধৈর্য হয়ে উঠলো — "প্রভু তাহলে এখন আমি আসি — অনেক দূর যেতে হবে তো — বাসায় আমার স্ত্রী-পুত্রেরা অনেককাল ধরে বসে আছে আমার অপেক্ষায় — এভাবে বললাম বলে কিছু অপরাধ নেবেন না যেন..." বলতে বলতেই মহর্ষির হাত থেকে নেমে সে তার ছয়টি অতিক্ষুদ্র পদের দ্রুত সঞ্চালনে সহজেই অদৃশ্য হলো ওই বিপুল রণসম্ভারের মধ্যে।

    মহর্ষির মনটা সহসা ভারাক্রান্ত হয়ে উঠলো। তাঁর মনে হলো — কাল প্রত্যূষেই এই যমভুমির উপর ছুটে বেড়াবে শতসহস্র অশ্বশকট — অযুতনিযুত পদাতিকের ভারে প্রতি মুহূর্তে কম্পিত হবে এই ভূমি — খণ্ডবিখণ্ড শবের স্তূপে আচ্ছন্ন হবে চতুর্দিক — রক্তপ্লাবনে তিলমাত্র স্থান অনার্দ্র থাকবে না — যে স্থানে যেকোনো অস্ত্রহীন বর্মহীন ব্যক্তির মুহূর্তকাল উপস্থিতির অর্থ অবধারিত মৃত্যু -- সেই স্থান অতিক্রম করার কি গভীর প্রত্যয়ে এই সামান্যপ্রাণটি চলেছে তার গৃহের দিকে।

    এক দূরাগত বেদনায় মহর্ষি যেন মর্মবিদ্ধ হলেন তীব্রভাবে। তাঁর আর্ত মুখ ঢেকে গেলো আসন্নসন্ধ্যার অন্ধকারে।


    ***


    যুদ্ধান্তের প্রথম প্রভাত। সময় যেন সূর্যোদয়ের শতকোটি লোহিতকণায় রণভূমির বিপুল রক্তস্রাবের সাথে মিশে নিঃশব্দে ভেসে যাচ্ছে।

    সেই নিথর নীরবতাকে ছিন্ন করে শোনা গেলো এক অদ্ভুত কন্ঠস্বর — আর্ত ও বিজড়িত — "তোরা শুনলি না — কেউ শুনলি না — বলেছিলাম ধর্মপথে থাক — শুধু ধর্মপথে থাক — তাহলে সব পাবি — সব পাবি — কেউ শুনলি না আমার কথা —"

    দেখা গেলো এক বৃদ্ধ — বিহ্বলদৃষ্টি — বাহ্যজ্ঞানরহিত — হেঁটে চলেছেন ওই শবসমূহের মধ্য দিয়ে — আপনমনে বারংবার এই কথাগুলি বলতে বলতে।

    এইভাবে অনির্দিষ্ট পথে চলতে চলতে হঠাৎই যেন থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন তিনি। যেন সহসা লক্ষ্য করলেন কোনো দূরবর্তী বস্তুকে। এবং অতিবিস্মিত হলেন। তাঁর মনে হলো — এ কোনো দৃষ্টিবিভ্রম নয় তো?

    মনে হলো — এ কি করে সম্ভব? বিগত আঠারো দিন ধরে অসংখ্য হাতি ঘোড়া পদাতিক এই ভূখণ্ডকে প্রতি মুহূর্তে নিষ্পেষিত করেছে - বিপুল রক্তপ্লাবনে আকীর্ণ হয়েছে এই রণভূমির সর্বাঙ্গ — সেখানে এই ক্ষুদ্রদেহী সামান্যপ্রাণটি, কি করে এত পথ ও এত সময় স্বচ্ছন্দে অক্ষতদেহে অতিক্রম করতে পারলো? তিনি বিশ্বাস করতে পারলেন না তাঁর দৃষ্টিশক্তিকে। তাই প্রবল সংশয়ে এগিয়ে গেলেন সেই ধাবমান কীটটির দিকে — তাকে স্বহস্তে স্পর্শ করতে — নিশ্চিত হতে তার অস্তিত্ব সম্পর্কে।

    আর ঠিক তখনই তিনি শুনতে পেলেন — "প্রণাম নেবেন! আমার কি সৌভাগ্য! আবার আপনার সঙ্গে দেখা হয়ে গেলো।" বৃদ্ধটি বাক্‌রহিত হলেন। "আপনি এখনো এইভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছেন? কেন? যুদ্ধ কি এখনো শেষ হয় নি?"

    বৃদ্ধটির মনে হলো তাকে উদ্দেশ্য করে বলেন — "তুমি কি কিছুই বোঝোনি? অস্ত্রশস্ত্রের এত ভয়ানক শব্দ? এত আর্তনাদ? এত রক্তস্রোত? কিছুই অনুভব করো নি তুমি?"

    তারপরেই তাঁর মনে হলো এসব কি ভাবছেন! এই অবোধ প্রাণীটির অজ্ঞতাই তো তার জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ।

    বৃদ্ধটির এই ক্ষণিকের নীরবতাতেই কীটটি যেন অধৈর্য হয়ে পড়লো। সে বলে উঠলো — "তাহলে আমি আসি প্রভু — অনেক দেরি হয়ে গেলো — বাড়িতে সবাই অপেক্ষা করছে — আমার দেরি হলে তারা বড়ো দুশ্চিন্তায় পড়বে — কে জানে হয়তো এখনই তারা কত দুর্ভাবনায় রয়েছে।"

    এই কথা বলেই সেই সামান্যপ্রাণীটি কোনো উত্তরের অপেক্ষা না করেই প্রাণপণে দৌড়তে লাগলো সেই রণক্ষেত্রের উপর দিয়ে। বৃদ্ধটি চিৎকার করে বলতে চাইলেন — 'ওরে কোথায় চলেছিস তুই? কোথায় আছে তোর স্ত্রী-পুত্র-পরিবার? তোর এত সাধের বাসা? এই মহানাশের পর? ফিরে আয় — আমার কাছে ফিরে আয়--'

    কিন্তু নাহ্‌। কোনো শব্দই উচ্চারণ করে উঠতে পারলেন না তিনি। বরং বিহ্বল হয়ে দেখলেন আরেক ভয়ঙ্কর দৃশ্য! এক রক্তস্রোত! যেন শতধারায় ধেয়ে আসছে! বৃদ্ধটি চোখ বন্ধ করলেন।

    গতরাত্রের সেই বীভৎস রক্তপাতের ঘটনাগুলি যেন আবার চক্ষুষ্মান হলো তাঁর কাছে। যুদ্ধের অন্তিমকালে অশ্বত্থামার ওই চূড়ান্ত নারকীয়তার দৃশ্যগুলি যেন আবার গ্রাস করলো তাঁকে।

    বৃদ্ধটি চোখ খুললেন। আবার দেখতে পেলেন সেই রক্তস্রোত। ধীরে ধীরে কিন্তু অনিবার্যভাবে প্লাবিত হচ্ছে সেই যমভুমির উপর দিয়ে। চারিদিকের সমাকীর্ণ হিংসাচিহ্নের পাশ দিয়ে। কীটটিকে দেখে তাঁর মনে হলো যেন ধর্ম অর্থ কামের যাবতীয় সঞ্চয় নিয়ে সে এগিয়ে চলেছে তার মোক্ষের দিকে। আর তার পিছু নিয়েছে ওই ভয়ঙ্কর রক্তস্রোত।

    বৃদ্ধটি আবার চক্ষুদুটি মুদিত করলেন। এবার দেখলেন অন্য চিত্র। রক্তস্রোতটি যেন চারিদিক গ্রাস করতে করতে এসে স্পর্শ করলো কীটটিকে... তারপর ওই রক্তকর্দমে সমস্ত গতি স্থির হয়ে গেলো ওই অবোধ প্রাণীটির।

    তখনই যেন এক তীক্ষ্ণ তীর বিদ্ধ হলো তাঁর মর্মস্থলে। চক্ষুদুটি মুদিত করে তিনি যেন ওই রক্তধারাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন — "স্থির হও! — অথবা দিক পরিবর্তন করো! —এখুনি! — আমি আদেশ করছি! — নয়তো এই ধরিত্রীর বুকে..."

    কিন্তু নাহ্‌। তিনি একটি শব্দও উচ্চারণ করতে পারলেন না। পড়ে রইলেন নির্বিকার স্থাণুর মতো।

    এদিকে সেই রক্তস্রোত নিঃশব্দে কিন্তু নিশ্চিতভাবে প্লাবিত হতে থাকলো কীটটির পিছুপিছু। সেই অজ্ঞকীটটিও আপনমনে দৌড়তে থাকলো তার বাসার উদ্দেশ্যে।

    এরপর?

    এরপর ওই কীট ও রক্তধারা এইভাবে ক্রমশ অগ্রসর হতে থাকে... তাদের নিজস্ব ধর্মপথে...এক বিলুপ্ত উপাখ্যানের দিকে... ব্যাসোক্ত যাবতীয় শ্লোককে অতিক্রম করে...



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ লেখক
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments