বিকেল পাঁচটা। ব্যস্ত বাসস্টপ। একের পর এক বাস আসছে, যাত্রীরা নিজেদের গন্তব্য অনুযায়ী লাইন দিয়ে চাপছেন, নামছেন। স্কুল ফেরত ছায়াদি দাঁড়িয়েছিলেন। এপ্রিলের এই পচা গরমে প্রাণ অতিষ্ঠ হয়ে উঠছে। ব্যাগ থেকে রুমাল বের করে গলার ঘাম মুছে বাঁদিকে তাকাতেই দেখলেন মেয়েটিকে। আজো একইভাবে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে শ্যামলা রঙের বারো বছর। ময়লা ফুলছাপ জামা পরা মেয়েটিকে গত চার-পাঁচদিন হল দেখছেন ছায়াদি। মুখটায় একটা অদ্ভুত সারল্য। কিন্তু চোখ দুটোর মধ্যে অজানা ভয়।
''অ্যায়, তোর বাড়ি কোথায় রে?'' - প্রশ্নটা করতে কিছুটা চমকে গিয়ে ঘুরে দাঁড়ালো মেয়েটি। রেলিং-এ ভর দিয়ে দাঁড়িয়েছিল। ছায়াদির আচমকা প্রশ্নে দৃশ্যতই ঘাবড়ে গেছে। বুকের কাছে ধরা মুঠি শক্ত করে একটু সরে দাঁড়াল ও। 'বাড়ি কোথায়'-এর মত নিরীহ একটা প্রশ্ন যে একটা সাধারণ মেয়েকে এতটা চিন্তিত করবে ভাবতে পারেননি ছায়াদিও।
“যাবি কোথায়?” ভিড় একটু পাতলা হতেই আবারও প্রশ্ন করলেন তিনি। মেয়েটি এবার চোখ নামিয়ে পায়ের নখ খুঁটতে লাগল। ছায়াদি দেখলেন ওর পায়ে পায়ে দগদগে ঘা। বহুদিন খালি পায়ে পাথুরে মাটিতে চললে যেরকম ক্ষত হয়, সেরম রুক্ষ, পুঁজ বের হওয়া পায়ের দিকে চেয়ে একটু শিউরে উঠলেন ছায়াদি। তবে দ্বিতীয়বার আর কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই তাঁর কাঙ্ক্ষিত বাস তীক্ষ্ণ শব্দে এসে পড়ল।
রাত্রে খাবার টেবিলে ছেলের ক্লাস্ট টেস্টের মার্কস দেখে একটু হতাশ হলেন ছায়াদি। ইংলিশে নাম্বার বেশ কমে গেছে। বকাবকি করার প্রতি তার প্রশ্রয় নেই, কিন্তু ইংলিশের দিকে আর একটু নজর কিভাবে দেওয়া যায় তা নিয়ে ভাবতে ভাবতেই টুকাই হঠাৎ বলল -- “মাম্মাম, আজ টিচার জিজ্ঞেস করেছিল, 'হোয়াট আর আওয়ার থ্রি প্রাইমারি নীড্স?' আমি জানতাম না। তাই বলতেই পারি নি। তুমি জানো অ্যানসারটা?"
-- “লিখে রাখ, দ্য থ্রি প্রাইমারি নীড্স অফ আস আর ফুড, ক্লোদ্স অ্যান্ড শেল্টার।” জলের বোতল এগিয়ে দিয়ে বললেন ছায়াদি। টুকাই দশটার মধ্যেই বিছানা ঢলে পড়ে। মশারি গুঁজতে গুঁজতে ছায়াদির চোখ গেল টেবিলে সাজানো ফটো ফ্রেমের দিকে। মা-ছেলের সুদৃশ্য ফটো, ফ্রেমের অবয়বে লেখা ‘হোম সুইট হোম’।
হোম = শেল্টার, বাড়ি, আশ্রয়, সুরক্ষিত স্থান, বাসা, নিবাস, থাকার ঠিকানা – টুকাইয়ের ইংলিশ খাতা উল্টাতে ‘বাড়ি’র এতগুলো প্রতিশব্দ লেখা দেখে ছায়াদি হাসলেন। কি সুন্দর মুখস্থের মত এতগুলো শব্দ লেখা আছে ঐ ইংরাজী শব্দটার অর্থ হিসেবে।
যেকোনো শিক্ষিত মানুষই এতে অভ্যস্ত, অবাক হওয়ার তো কিছু নেই। হঠাৎ তাঁর মনে পড়ল ঐ বাসস্ট্যান্ডের মেয়েটাকে। কেমন চমকে উঠেছিল সে 'বাড়ি' শব্দটিতে। এরকম একটা নিরীহ শব্দও বিস্মিত করেছিল ওকে, ভাবিয়েছিল। আচ্ছা ও কি লেখাপড়া করে টুকাই-এর মত? মনে তো হয় নি। আর একটা জিনিসও তার চোখ এড়ায় নি, তা হল বাসে ওঠার আগে ওর সাথে চোখাচুখি হতেই কেমন যেন ঘোলাটে চোখে মৃদু হেসেছিল মেয়েটা।
তারপর যা হয় - ভিড় ঠেলা, ব্যাগ ও দেহ সামলানো, অন্যের ঘাম ও কর্কশ বাক্যবাণ-গালাগালি-কাশি ও খালাসির চিৎকার সব ঝক্কি সামলানোর মধ্যে মেয়েটিকে বেমালুম ভুলে গিয়েছিলেন ছায়াদি। এখন হঠাৎ মনে পড়ল - ওর অবাক চাহনি ও তার সাথে বড় বেমানান মৃদু হাসি।
বাড়ির প্রশ্নে হাসি! এ হাসিকে ঠিক কিভাবে ব্যাখ্যা করা যায়! প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়ার হাসি? উত্তর নেই তাই হাসি? অবজ্ঞার হাসি? শ্লেষের হাসি?
এসব নিয়ে ভাবতে বসে নিজেকে খুব বোকা বোকা ঠেকল তার। একটা স্কুলে দীর্ঘ সতের বছর উনি পড়াচ্ছেন, কতশত ছেলে মেয়ে তাঁর হাতে গড়া। কতজনের কত কাহিনী। কিন্তু এরকম বাঙময় হাসির অর্থ ভাবতে কেউ তাঁকে বাধ্য করে নি।
টুকাই ঘুমিয়ে পড়েছে, বিছানায় গেলেই কি অঘোরে ঘুমায় ছেলেটা। এত মায়াবী লাগে ওর মুখ, যেন পৃথিবীর কোনো অসুন্দরই ওকে ছুঁতে পারবে না। টেবিল ল্যাম্পটা জ্বেলে কাগজটা টেনে বিছানায় হেলান দিলেন ছায়াদি। সকালে তাড়া থাকে, পড়া হয়ে ওঠে না। তাই ঘুমানোর আগে খবরের কাগজ নিয়ে বিছানায় ঘণ্টাখানেক চোখ বুলানোর অভ্যেস তার। রোজকার কিছু খবর এক থাকে, কুৎসিত পৃথিবীর চলমান জলছবি পাতায় পাতায় আঁকা। আনমনে সেসব পাতা উল্টালেও বাসস্টপের শ্যামলা মেয়েটির মুখ কেন কে জানে বারবার ভেসে উঠতে লাগল। মেয়েটির স্থবির মৌনতা বলে দেয় সে আশ্রয়হীন কিন্তু ভিখিরি নয়, কোথাও যেন একটা গল্প আছে ওর। টুকাইয়ের আচমকা অবাক প্রশ্নগুলোর মত হঠাৎই এক প্রশ্ন ছায়াদিকে অস্থির করে তুলল। আচ্ছা, সব মানুষের অন্য দুটি প্রাথমিক চাহিদার মত বাড়ি বা ঠিকানা থাকে?
যেমন মরুদেশের কিছু মানুষ, যারা একত্রে ঘুরে বেড়ায়। বেদুইন যাযাবরের মত তাঁবুই যাদের শীত-গ্রীষ্মের আশ্রয়, তাদের কাছে বাড়ির চেহারা কি তাঁবু মাত্র? অথবা রেল লাইনের সেই ভবঘুরেটা যার রাত কাটে ফুটপাথে, দিন কাটে রাস্তায়, বাসে, ট্রেনে, নগরে বাজারের পথে, তার বাড়ি কোনটা?
অথবা যে মেয়েটি প্রতি রাত্রে হাত বদলে, প্রতি মাসে ঠিকানা বদলে, এখন বড় বড় মানুষের সঙ্গে বড় বড় দেশে ভ্রমণ করে - তার বাড়ি কি ওই রঙিন লাইটের বাহারি হোটেলগুলি?
রাত একটা দশ!
ছায়াদির চিন্তারা জট পাকাচ্ছে। কিছুটা পরিস্কার, কিছুটা আবছা ... কিন্তু কিছুতেই যেটা পরিস্কার হচ্ছে না, তা হল ঐ মেয়েটির রহস্যময় হাসি!
এক রকম জোর করেই ছায়াদি ঘুমাতে গেলেন।
স্কুলে আজ ইউনিট টেস্টের শেষদিন ছিল। পাঁচ বান্ডিল খাতা জমেছে, তবু রোজদিনের চেয়ে আধ ঘণ্টা আগে ছাড়া পেয়েছেন। আজ টুকাইয়ের ইংলিশ-স্যারের বাড়ি যেতে হবে, সামনের বছর ক্লাস সিক্সে উঠবে। ওর এবারের মার্কশীট বলে দিচ্ছে পড়ার ‘মোডাস অপারেন্ডি’ শুধরে নেওয়ার এটাই সময়। ঢিলে দিলে চলবে না, বিশেষত ল্যাঙ্গুয়েজ গ্রুপের।
স্কুলের বাইরে ক্লাবের মাঠে একদল ছেলেপুলের ভিড়। এই ভ্যাপসা গরমে যখন নাগরিক সমাজ ছাতা আর জলের বোতল নিয়ে হাঁসফাঁস করছে, তখন এই চিরনতুনের দল রোদের ঝাঁঝকে হেলায় ঠেলে ফুটবল নিয়ে এলোমেলো দৌড়াচ্ছে।
কদমফুলের গাছটার তলায় ক্ষণিক দাঁড়িয়ে ওদের দেখতে বেশ লাগছিল। টুকাইয়েরও এরকম একটা হৈচৈ-মাখা শৈশব পাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু বড্ড দুর্বল যে ও। স্কুল,টিউশান আর তবলার ক্লাস করেই ছেলে নেতিয়ে পড়ে। ঘুসঘুসে সর্দি-গর্মির সাথে শ্বাসকষ্টের একটা ধাত আছে ওর। বাবার থেকে আর কিছু না পাক বংশগত এই হাঁপের টান ঠিকই পেয়েছে। ছুটোছুটির খেলা তাই ওর জন্য নয়। ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল ছায়াদির। যেমন ছোটবেলা তাঁরা কাটিয়েছেন, সেরকম কিছু এখনকার টুকাইরা যে কেন পায় না ... ভাবতে ভাবতেই বাসস্টপে এসে পড়লেন তিনি। আর এখানে আসতেই মেয়েটির দিকে আজও চোখ চলে গেল।
নাহ, আজ তিনি কথা বলেই ছাড়বেন। দুপুর সাড়ে তিনটের বাসস্টপ বেশ ফাঁকা। মেয়েটি কোনার বেঞ্চে বসে একমনে একটা জবা ফুল চিবোচ্ছে। পাশের গুমটি দোকান থেকে এক প্যাকেট বিস্কুট কিনে ধীরে ধীরে ওর দিকে এগোলেন তিনি।
“খিদে পেয়েছে? নে, এটা ধর।” প্যাকেটের মুখটা ছিঁড়ে ওর মুখের সামনে ধরলেন।
একটু চমকে উঠে মেয়েটা তাকাল। তারপর জামায় হাতের তেলো মুছে প্যাকেটটা নিল সে। প্যাকেটের ভেতরে বিস্কুট দেখে মুখ ভরে গেল হাসিতে। খুব মিষ্টি হাসে মেয়েটা।
ছায়াদি গলা ঝেড়ে বললেন “খেয়ে নে। আচ্ছা, কোথায় থাকিস তুই? এখানে একা একা পড়ে থাকিস কেন?” মেয়েটি জবাব না দিয়ে পা দোলাতে দোলাতে চার-পাঁচটা বিস্কুট খেল আর বাকিটুকু খুব যত্নে মুড়ে তাকালো ছায়াদির দিকে।
"পুরোটাই তোর। রেখে দে। জল খাবি?” জলের বোতল সামনে ধরতে মেয়ে ঢকঢক করে আকণ্ঠ জল পান করল। ফ্রকের খুঁট দিয়ে মুখ মুছে আবারও একটা মন ভোলানো হাসি উপহার দিল ছায়াদিকে।
“কিরে, এবার বল থাকিস কোথায়? যাবি কোথায়? এখানে রোজ বসে থাকিস কেন?”
মেয়েটি এবার তার জামার ভেতর থেকে একটা ভাঁজ করা ময়লা কাগজ বের করে ছায়াদির হাতে দিল।
ছায়াদি দেখলেন সেটা ক্লাস সেভেনের একটা মার্কশীট, নাম লেখা পিংকি বাউরি। একবছর আগের, স্ট্যাম্পে স্কুলের নাম বোঝা যাচ্ছে না। খুব অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “এটা কি তোর? এভাবে রেখেছিস কেন?” নির্বাক দৃষ্টির মেয়েটি হাত তুলে দূরে কি যেন ইঙ্গিত করল।
ছায়াদি বুঝতে না পেরে বললেন, “ওদিকে কি আছে? তোর বাড়ি? আমায় নিয়ে যাবি?”
ছায়াদি উঠলেন, মেয়েটির দিকে হাত বাড়িয়ে বললেন, “চল দেখি।“
তখন বিকেল চারটে দশ। রাস্তায় একটু একটু করে ভিড় বাড়ছে। রাস্তার ফুটপাত পার করে ঘড়ি দেখে ছায়াদি একটু ভাবলেন টুকাইয়ের ইংলিশ-স্যারের বাড়ি কি আর যাওয়া হবে? ভদ্রলোক তো প্রায় বিকেলেই টিউশানে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তার মধ্যে কথা বলা... আঁচলে টান পড়ল ছায়াদির। আনমনে তিনি একটু এগিয়ে গিয়েছিলেন, মেয়েটি তাকে পাশের একটা সরু গলির দিকে যাওয়ার ইঙ্গিত করছে। এখনো অবধি একটাও কথা সে বলে নি। ও কি কথা বলতে পারে না? ছায়াদির ভাবনার সুতোয় টান পড়ল গলির মুখটার বিশ্রী গন্ধে। খোলা ভ্যাট থেকে ভক ভক করে দূর্গন্ধ বেরোচ্ছে। ইস, এই গলির ভেতর দিয়ে কোথায় চলেছে মেয়েটা! তার অবশ্য সেসবে ভ্রুক্ষেপ নেই।
এক হাতে ছায়াদির আঁচলের খুঁট, অন্যহাতে বিস্কুটের আধখাওয়া প্যাকেট আর ভাঁজ করা মার্কশীট ধরে মেয়েটি চলছে। ছায়াদি নিঃশব্দে তাকে অনুসরণ করে চললেন। এঁদো গলির ভেতরে একটা বস্তি আর সেটার একেবারে শেষে একটা বুড়ো শিবতলা। বিশাল বটগাছের নিচে একটা ভাঙা মন্দির। এদিকটায় কোনোদিন ছায়াদি আসেন নি। মন্দিরের সামনে গিয়ে মেয়েটি থামল।
তারপর ইশারায় তাঁকে দাঁড়াতে বলে মন্দিরের ভেতরে ছুটে ঢুকে গেল। একটু পরে তার হাত ধরে বেরিয়ে এল আরো দুটো ছেলে মেয়ে। এ মেয়েটি বড়, বয়স ১৪-১৫ বছর হবে। ছেলেটি খুব ছোট, ছেঁড়া হাফপ্যান্টে দিদির হাত ধরে বুড়ো আঙুল চুষছে। তিনজনের হাতেই সেই প্যাকেটের একটা করে বিস্কুট ধরা। তিনটে মলিন মুখ বলে দেয় কত কাল অভুক্ত তারা। ছায়াদির ভেতরটা মুচড়ে উঠল।
বড় মেয়েটি এগিয়ে আসছে। ওকে দেখে বেশ চেনা লাগছে ছায়াদির। কোথায় যেন দেখেছেন,ঠিক মনে করতে পারছেন না তো! সামনে আসতেই সে মেয়ে একমুখ হাসি নিয়ে ছায়াদির পায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। এটার জন্য একদম প্রস্তুত ছিলেন না তিনি।
“এই এই কি কর, ওঠ ওঠ...” করে তাড়াতাড়ি মেয়েটিকে তুলে ধরলেন।
“দিদি, চিনতে পারলে না লয়, আমি পিংকি। তুমার ইস্কুলে পড়তাম সেভেন কেলাসে।”
নিমেষে ছায়াদির মনে পড়ল মার্কশীটের নামটা। আর সাথে সাথে নীল-সাদা ইউনিফর্মে আরেকটা চেহারাও মনে পড়ল।
পিংকি বাউড়ি। খেলায় দুর্দান্ত ছিল মেয়েটা। কী ভাল দৌড়াত, আর কি বাধ্য। মিড ডে মিলে সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার কথা কেউ মনে না রাখলেও, কিছুজন নিয়মিত পরিষ্কার করে হাত-থালা ধুয়ে খেতে বসত। পিংকি ছিল তাদের মধ্যে একজন। পড়াশুনায় ভাল ছিল না, তবু হাতের লেখা ছিল দেখার মত। পড়াশুনার বাইরেও কয়লা তোলার কাজ করত পিংকি আর তার মা। অভাবি বাড়ির মেয়েদের বিনা বেতনে ভর্তির ব্যবস্থা আছে তাঁদের স্কুলে। পিংকির মত বেশ কিছুজন সেভাবেই ভর্তি হয়। খুব সাধারণ মেয়ে হলেও পিংকি নজরে পড়েছিল ওর পায়ের জোরে। অ্যানুয়াল স্পোর্টসে টানা দু’বছর হাই জাম্পে আর ৫০ মিটার ও ১০০ মিটার দৌড়ে ফার্স্ট হয়েছিল সে-ই। সিক্স থেকে সেভেনে ওঠা এই মেয়ের পায়ের জোর নিয়ে স্টাফরুমেও সেবার বেশ কথা হয়েছিল। তারপর এবছরে হঠাৎই তাকে আর স্কুলে দেখা যায় নি।
“ওহ হ্যাঁ মনে পড়েছে, তা একি হাল হয়েছে তোর! এখানে মন্দিরে থাকিস কেন? বাড়ি কোথায় তোদের? স্কুলে যাস না কেন আর?”
পিংকি চোখ নামিয়ে নিয়েছে, ময়লা ওড়নার প্রান্ত ধরে আঙুলে পেঁচাচ্ছে। মন্দিরের দালানে বসে বাকি দুটো বাচ্চা তখনো বিস্কুটের প্যাকেট খুঁটছে।
ছায়াদি জলের বোতল এগিয়ে দিলেন, “ কি হয়েছে পিংকি? বাড়ি ছেড়ে তুই এখানে কেন,মা? আমায় খুলে বল। ভয় পাস না।”
জল খেয়ে কিছুটা ধাতস্থ হয়ে মুখ খুলল মেয়ে।
“সে অনেক কথা দিদি। বাড়ি ছিলোক মোদের। এখুন লাই। বাপটো ম্যুনিসিপ্যালিটির ডাম্পার চালাইত। নেশার ঘোরে এক রাতে এক্সিডেন্ট করে মাথা ফাটাইল। কি রক্ত! উফ! হাসপাতালে তিন দিন যমে মানুষে টানাটানি করেও বাপটোকে বাঁচানো গেল না, জানো। বুন আর ছটকুর এত কিছু মনে লাই হয়তো। ক’দিন বাদে গেরামের লোক বুরা নজর দিতে লাগলক মোদের দিকে। মা আর আমি তখন কয়লা তুলি আর শেঠদের বেচি। মা বেটি মিলে ম্যুনিসিপ্যাল বাবুদের কত বইল্লুম, বাপটো মরে গেইছে, ট্যাকাপয়সা কিছু পাওয়া যাবেক কি না। অনেক দিন ঘুরাইলেক মোদের, দিয়ে একদিন বড়বাবু হাজার টাকা দিয়ে মুদের ভাগিয়ে দিলেক।”
এরপর পিংকি বলে গেল আর ছায়াদি নিঃশব্দে ধীরে ধীরে আত্মস্থ করতে লাগলেন কিভাবে ওর মা কয়লা-খাদান থেকে বয়ে নিয়ে এল যক্ষারোগ, কিভাবে পিংকির এইটুকু কাঁধে এসে পড়ল মস্ত সাংসারিক বোঝা, কিভাবে এক সময়ের সেরা দৌড়বাজ স্কুলছাত্রীটি স্কুলছুট হল, গ্রামের হাতুড়ে নয়ন ডাক্তার যে কিনা ওর মায়ের জন্য একবার ‘দাওয়াই’ দিয়েছিল, সেই লোকই কি করে ওদের সর্বনাশ ডেকে আনল।
একবার গ্রামের দুই ছোট ছেলে পুকুরে স্নান করতে গিয়ে ডুবে গেলে সবাই পিংকিদের পরিবারের দিকে আঙ্গুল তুলল। নয়ন ডাক্তারের কাছেই গ্রামের ‘মুখিয়া’ জেনেছিল পিংকির মায়ের রক্তবমির কথা। একলা বিধবা নারীর শেষ সম্বলটুকুর লোভে ধুরন্ধর মুরুব্বিরা ঘোলা জলে মাছ ধরতে পিংকির মা-কে ডাইনি বলে দাগিয়ে দিল।
ক্লাস সেভেনের রেজাল্টের দিন পাশ করেছে জেনে পিংকি যখন দৌড়ে ঘরে ফিরল তখন সন্ধে নামতে খানিক দেরি আছে। ঘরে মাকে না পেয়ে সে কয়লা-খাদান, ঝাঁপান মাঠ, পীরতলা সব জায়গায় খুঁজল। কিন্তু মায়ের চিহ্নমাত্র নেই সেখানে। হতাশ পিংকি সন্ধেবেলা ঘরে ফিরে দেখে ভাই বোন খিদের চোটে মাটি খাবলাচ্ছে। মার্কশীটটাকে জামার নিচে মুড়ে রেখে পিংকি রান্নাঘরে গেল। হাঁড়িতে বাসি খুদ সিদ্ধ ছিল, তাই দিয়ে শাপলার ঝোল রেঁধে সবার ক্ষুধানিবৃত্তি করল সে। ক্লান্তি আর হতাশায় ভোরের দিকে যখন তার খানিক তন্দ্রা এসেছে, সেইসময় দরজা ধাক্কাল কেউ বা কারা। খবর পেল পুকুরে ভাসছে তাদের মা।
পুকুরপাড়ে যখন পৌঁছাল তারা তখন ‘ডাইনির লাশ ডাঙ্গা ছুঁয়েছে’ বলে শোরগোল। মা-মরা তিন শিশু কেঁদে হালকা হওয়ার অবকাশটুকু পেল না আশেপাশের “ডাইনির পোলা”, “ভাগিয়ে দাও”, “গ্রামে মড়ক লাগবে” ইত্যাদি চিৎকারে। বিপদ জেনেও পিংকি মুখিয়ার পা ধরে ভিক্ষা চায় “মুর মায়ের লাশটো ফেরত দে কেনে! আগ দিবক।“ কিন্তু ডাইনির লাশের চিতার আগুন ছোঁওয়া পাপ – এই অজুহাতে মুখিয়ার ছেলে এবং বাকি কিছুজন লাথি মারতে লাগল তাদের, সাথে অশ্রাব্য গালিগালাজ। কেউ আবার তাদের ডাইনি মায়ের দেহ ছোঁওয়ার ‘অপরাধে’ জ্যান্ত পুড়াবার নির্দেশ দিল। বেলা যত চড়ছিল বিপদ তত বাড়ছিল। একসময় জল নাকের নিচে পৌঁছেছে বুঝে পিংকি তার ভাইবোনের হাত ধরে দৌড় দিল।
সেই দৌড়ের কোনো লাল ফিতের ফিনিশিং মার্ক ছিল না, তবু সেটাই যে তার জীবনের সবচেয়ে সেরা দৌড় ছিল তা আজ তারা জীবন দিয়ে বুঝেছে।
তারপর থেকে তারা এই পোড়ো শিবতলাতেই আছে। কতদিন যে পার হল, ভয়ে ভয়ে বাঁচতে বাঁচতে তার হিসেব ভুলেছে তারা। শুধু এটুকু জানে, যেখানে ভূতের ভয়ে ‘সভ্য মানুষ’ আসতে ভয় পায় সেখানেই তারা নিরাপদে বাঁচার ভরসা পেয়েছে। পেটের দায়ে ভিক্ষাপাত্র হাতেই ঘোরে এখন তারা। পিংকির বোন একটি মূক শিশু, তাই সেদিন বাসস্টপে হাজার প্রশ্নের জবাবে সে শুধু হেসেছিল। আর আজ আসল উত্তর দিতেই বোধহয় ইশারায় তাঁকে টেনে এনেছে দিদির কাছে। সৌজন্যে সেই বিবর্ণ, ভাঁজেভাঁজে ছিঁড়ে যাওয়া মার্কশীট।
পিংকি যখন কথা থামাল তখন পাখপাখালির ক্যাকোফনি শিবতলার বটগাছটার জমাট কালো কুঠুরিগুলোকে আক্ষরিকই ভূতুড়ে করে তুলেছে। ছায়াদির গলার কাছে একদলা কষ্ট, ঢোক গিলতে পারছেন না এত ব্যথা ওখানে।
এই পচা গ্রীষ্মের ভরসন্ধেবেলা তিনটে শিশুর মাঝে স্থাণুবৎ বসে থাকতে থাকতে ছায়াদি তাঁর মন ও মস্তিষ্কের গোপন সংঘর্ষের মাঝে কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছিলেন। পিংকির অস্ফুট স্বর তাঁকে বাস্তবে ফিরিয়ে আনল, মার্কশীটটা মুঠোয় ধরে সে বলছে “জানো দিদি, আমার ইস্কুলের কথা খুব মনে পড়ে।”
তখন অন্ধকার নামছে ধীরে ধীরে। ছায়াদি মনস্থির করে উঠে দাঁড়িয়ে গলা খাঁকরানি দিয়ে বললেন “চল তোরা আমার সাথে। যাবি?”
"কুথাকে?
"আমার কাছে। তোদের এখানে থাকতে হবে না। আজ আমার বাড়ি চল, দেখি কিছু করতে পারি কিনা। ভয় পাস না, ওখানে কেউ তোদের চিনবে না।
রাত দশটা। ছায়াদির এক কামরার ফ্ল্যাটের ব্যালকনিতে ঢালা বিছানায় ঘুমিয়ে আছে ওরা তিনজন। টুকাই স্কুল থেকে ফিরে অবাক হয়েছে, প্রচুর প্রশ্ন করেছে। ছায়াদি যথাসম্ভব বুঝিয়ে উত্তর দিয়েছেন। টুকাইকে ঘুম পাড়িয়ে তিনি মনকে স্থির করলেন। তারপর ডায়াল করলেন ১০৯৮ – চাইল্ডলাইন নাম্বার।
বেশ কিছুক্ষণ কথা বলার পরে অনেকটা হালকা লাগল তাঁর। আগামী কালের প্রভাত তিন ভাই বোনের জীবনে একটু অন্যভাবে আসবে। আজকের রাত একটু ভাল ভাবে ঘুমাক ওরা। ঘুমাতে যাওয়ার আগে ব্যালকনি গেলেন ছায়াদি, ফুরফুরে হাওয়া দিচ্ছে। ও ঘরে টুকাইয়ের ঘুমন্ত মুখ আর এধারে ওরা তিনজন। চারটে নিষ্পাপ শিশুর মুখে তিনি কোনো তফাৎ করতে পারলেন না। পিংকির মুখের উপর দুটো চুল এসে পড়ছে। আলতো হাতে সেটা সরিয়ে দিলেন তিনি। অঘোরে ঘুমাচ্ছে ওরা সবাই। কত কালের নিশ্চিন্তের ঘুম যে ওদের পাওনা ছিল!
তিনটে অপাপবিদ্ধ চেহারার দিকে চেয়ে তিনি ফিসফিসিয়ে বলে উঠলেন –
“মা রে, একটা মাত্র জীবন বাঁচা আমাদের। তবু তোদের মত এত গভীর ঘুম আমাদের চোখে নেই। আমরা দিনরাত পাশ-ফেলের হিসেব করে জীবন কাটাই, কিন্তু জীবনের মার্কশীটে কতগুলো লাল কালি যে জমা থেকে যায়, সে হিসেব মেলে না। আমাকে, আমাদের এই সমাজকে কোনোদিন ক্ষমা করিস না তোরা।”
ছটকুর পা-টা সোজা করে দিয়ে, টেবিল ফ্যানের স্পীড খানিকটা বাড়িয়ে দিলেন তিনি।