‘অ’ (কবিতা-সংগ্রহ)—অরুণাচল দত্ত চৌধুরী; সৃষ্টিসুখ প্রকাশন এল এল পি, বাগনান হাওড়া ৭১১৩১২; প্রথম প্রকাশ: জানুয়ারি, ২০১৭; ISBN: 978-1-63535-148
নিজে কবিতা লিখতে না জানলে যদি কবিতার গ্রন্থ-সমালোচনা না করা যায় তবে স্যর নেভিল কার্ডাস তো ক্রিকেট নিয়ে লিখে অন্যায় করেছিলেন, বা নীলাক্ষ গুপ্ত সঙ্গীত নিয়ে। সমালোচনা না হোক্ নিদেন নির্ণিমেষ তাকিয়ে তো থাকা যায় হিমালয়ের ঐ উত্তুঙ্গ শৃঙ্গের দিকে, তার তুষারধবল ধ্যানমগ্নতা... (গোড়াতেই বাক্যিহারা হলে চলবে না)
*
কোনো কাব্যগ্রন্থের পাঠ কোত্থেকে শুরু হওয়া উচিত? বিশেষত, তার নাম যদি ‘অ’ হয়? আর, রক্তবর্ণ প্রচ্ছদে যদি থাকে বর্শা-গৃধ্নু-শৃগাল পরিবেষ্টিত অভিমন্যু? সেখান থেকেই। হয়তো। এ’অধম তো শেষ থেকে শুরু করেই ‘অরুণালোকে চন্দ্রাহত’।
ব্লার্ব! জানি না, তাঁর এতো কবিতা থাকতে শ্রেষ্ঠটিকে কে বেছে নিতে পারলেন চতুর্থ প্রচ্ছদের জন্যে, পুরোটাই এখানে তুলে দেবার লোভ সামলাতে পারছি নাঃ
“এই কুরুক্ষেত্র রোজ ভরে যাচ্ছে শেয়ালে দালালে।চাবুকের মত এ’হেন লাইন পড়ে শেষ কবে খাড়া হয়ে গেছে শিরদাঁড়া, ভাবতে বসি। পাতা উল্টিয়ে অন্দরে প্রবেশ। আশিটি কবিতা, ক্বচিৎই কোনোটি এক পৃষ্ঠার চেয়ে দীর্ঘতর। প্রথম কবিতাটিই ‘বেহাল’। তাই? ও, পরে পড়বো। চোখ গেল ‘ইউথেনেসিয়া’-র প্রতি (সেটা কি কবি পেশায় এক বরিষ্ঠ চিকিৎসক বলে?)ঃ
কে দেখবে আমাদের, অভিমন্যু তুমিও পালালে?
মৃতভুক শকুনিরা মেলে দিচ্ছে নিউজপ্রিন্ট ডানা
মৃতের জবানবন্দী খুঁজে নিচ্ছে বিকৃত ঠিকানা।
বিষাক্ত যত অস্ত্র সপ্তরথী করেছে সংগ্রহ।
কোলাহলে খুব ব্যস্ত শিক্ষক…পিতা…পিতামহ।
এই ব্যূহে তুমি একা। ভঙ্গী আছে। সঙ্গী নেই কোনও।
অস্ত্র নেই অভিমন্যু। অস্ত্র তুমি পাওনি কখনও।”
“ও অসুখ ফিরে এসো দিনে, মাঝরাতেচন্দ্রাহত! চন্দ্রাহতহই।
আর কোনওদিন দেখো চাইবো না তোমাকে সারাতে
……………আমাকে করুক গ্রাস চাইছিনা এর বেশি আর
বেঁচেই এইযে মরা এটাও তো ইউথেনেসিয়া”
বা,পরেই ‘চন্দ্রাহত’ :
“ও চাঁদ, আমাদের পুড়িয়ে দিয়েছিলে!
কলঙ্কের দাগ সবই তো মোছা হল
তবু কি রয়ে গেল কিছু?
অবুঝ কোনও কোনও অচেনা অদ্ভুত
স্বপ্ন ছাড়ছে না পিছু।”
আচ্ছা, এটা কি প্রেমের কবিতা?
‘গন্তব্য’হায়রে, কবিদের তো বয়েস বাড়ে না আর! মধ্যষাটেও তাঁদের অষ্টাদশী প্রেমিকা থাকতে পারে, নীরার মতো।“আমার শোকে ভেসো না থই থই
এই শহরে তত সময় কই?
……তোমারও মন একলা ভিজে ভিজে
উঠে পড়ুক গড়িয়াহাট ব্রিজে
জানলাঘেঁষা সিটের মালিকানায়
জল পড়েছে গালে দু-এক ফোঁটা
ঠোঁটের ভাঁজে পুরনো তর্কটা
এমন যাওয়া তোমায় শুধু মানায়... ”
হিংসে হয়।
*
কীভাবে লিখতে হয় কাব্যগ্রন্থের সমালোচনা (বা, নিদেন, ‘পরিচিতি’), সেটা অজানা। কেবল ‘আহা, কী পড়িলাম, জন্মজন্মান্তরেও ভুলিবো না’ লিখিলেই চলিবে? গানের তো তবু ব্যাকরণ হয়, স্বরলিপি; তুলনা তার নিরিখে। কিন্তু, কবিতার?
না, গানের কেবল ব্যাকরণ মানামানি দিয়ে যেমন উৎকর্ষের বিচার হয় না, তার ঊর্ধ্বেও কিছু থাকে, কবিতার ক্ষেত্রেও তো ঠিকই তাই। কে রচবে সেই গ্রামার যা দিয়ে ‘সোনার তরী’-র বিচার হবে, বা ‘বনলতা সেন’-এর?
*
কবি অরুণাচল দত্তচৌধুরীকে আগে পড়িনি কেন? কবি মধ্যষাটে, লিখছেনও বহুদিন। কবিসুলভ অবজ্ঞায় কবিতার মুদ্রণ ও প্রকাশকে পিছিয়ে দিয়েই চলে এসেছেন, পিছিয়ে দিয়েই। ভাগ্যিস ততটা নয়, যাতে আমরা অবোধ পাঠকরা এক্কেবার বঞ্চিত হই।
বধাঈ। বধাঈ।
*
কোন্ সে গুণ যাতে প্রথম পাঠেই ধরাশায়ী করে দিলেন কবি অরুণ? তা কি কাব্যছন্দের প্রতি এ’ কলমচির এক অমোঘ আকর্ষণ আছে বলে? বিষ্ণুর চেয়ে সুধীন দত্ত চিরকাল বেশি আকর্ষণ করে এসেছে বলে (সমর ব্যতিক্রম)? এটা একটা প্রধান কারণ, মানি। কবি ছন্দ নিয়ে অনায়াস খেলা করে গেছেন আশিটি কবিতা ধরে, কোত্থাও চ্যুত হননি এতোটুকু। শব্দচয়ন আরেকটি প্রিয় বিষয় লাগলো এঁর লেখায়। এখানে সুধীন্দ্রসম আভিজাত্যপনা নেই, ভাষা অনেক ‘বিনয়ী’, যেন ‘ফিরে এসো, চাকা’-র মতো স্বতঃগতি, প্রাঞ্জল (যদিও ভাবে অন্যপ্রকার)। বিষয়চয়ন আরেকটি অতি উল্লেখ্য দিক। ‘রঙ দাও পার্বতীকে’ কবিতাটি পড়ি... হ্যাঁ, সেই দলিত কন্যেটি যাকে মৃত্যুপূর্বে ধর্ষণ করা হয়নি। রক্ত টগবগে ছোটে, ঘেন্না হয় ‘নিধিরাম কানুনগুলির’ প্রতি। সমাজের প্রতি কবির অঙ্গীকার আরেকবার প্রতিষ্ঠিত হয়ে ওঠে।
*
প্রথাসিদ্ধ না হলেও কবি অরুণাচল জনপ্রিয় যথেষ্টই। তাঁর কবিতায় সুর দিয়ে গান বেঁধেছে নবীন সঙ্গীতদল (ইউ টিউবে শুনলাম)।
ছোট জেলাশহরে তিনি যথেষ্ট নিবেদিতপ্রাণ ডাক্তারবাবু হিসেবে শ্রদ্ধেয়—এটাও জানা গেল। কেবল, এদ্দিন এ’সব জানিনি কেন, কবিকে পড়িনি কেন ভেবে আক্ষেপ। কবিই তো লিখেছেনঃ
‘চিরকাল এই নিয়মেহ্যাঁ, ‘কোনওক্রমে’।
সঙ্গীত থামবে সমে
মাঝে দুই একটি প্রহর ভালোবাসি কোনওক্রমে’
হ্যাঁ, তাইতো অ আ ক খ থেকে জীবনের পুঁথির পাতায় সব বর্ণ ছুঁয়ে ছুঁয়ে অনুস্বার বিসর্গ এলেও চন্দ্রবিন্দু নেই শীর্ষনামে।
কারণ ‘অ’-এর পুনঃপাঠ শুরু করতে হবে যে! আবার, আবার পড়বো কবি অরুণাচলকেঃ
অরুণ যেথায় অচলোপরি সদাদীপ্তমান!!