গাধা; প্রদীপ দাশশর্মা; প্রথম প্রকাশ: আগস্ট, ২০১৬, কথাসত্য, কলকাতা; পৃষ্ঠাঃ ৭২; ISBN: নেই
যে কোনও বই নিয়ে কথা বলতে গেলে সংযম অভ্যাস করা জরুরি বলে মনে করা হয়। খারাপ বা ভালোর বোধকে তূরীয় স্তরে নিয়ে গেলে বিদগ্ধ পাঠকেরা সেই আলোচনাকে বিশ্বসনীয় বলে মনে করেন না বলে শুনেছি। কিন্তু ‘গাধা’ আমার এমন ভালো লেগেছে যে সেই নিয়ম মানা সম্ভব হবে না। তাতে যদি আমি ‘গাধা’ হই ক্ষতি নেই। কারণ গাধার আসল মজা তো সেটাই, যে কোনও চমৎকার সাহিত্য কর্মের মত, গাধা এক প্রাণির কাহিনি, যার ভেতর আমরা আর আমাদের ভেতর যে নিরন্তর বর্তমান। কবিতার বই কী ভাবে আলোচনা করতে হয় সে বোধ আমার নেই। আমার কাছে গাধা এমন একটা কাজ যার ফর্ম বা চলন-ধরন নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকার নেই। সে কখনও কবিতা, কখনও নাটক আবার যার একটা লাইন পড়ে, বইটা খানিক বন্ধ করে, আমরা একটা জীবনের গোটা উপন্যাস-বিস্তার পরিসরও টের পেতে পারি আমাদের মধ্যে। যদি অতিকথন মনে হয়, সন্দেহ নিরসনের একটাই উপায়। বইটা পড়ে দেখুন।
আমরা একটা বই পড়ি একটা পরিবেশের মধ্যে, নানান আখ্যানের মধ্যে। আমাদের বাড়িতে যখন সব মা বাবা বাচ্চারা ম্যানেজমেন্ট পড়তে চাইছে, ভিরাট কোহলি ছাড়া আর কোনও মুখ আয়নাতেও দেখা দুষ্কর, অমিতাভ বচ্চন বসে হাগো প্রতিযোগিতাতেও নাম লিখিয়েছেন, বিফ কাবাব খাওয়াটাকে সন্ত্রাসবাদি কার্যকলাপ বলে গণ্য করা হচ্ছে তখন আরও অনেক কাহিনি পুরো হারিয়ে যাচ্ছে। আমরা ভুলে যেতে বসেছি যে আরও কিছু নাগরিক ছিল, আছে, থাকবে কি না জানি না। তখন হঠাৎ নবারুণ ভট্টাচার্যের গল্পে, সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়ের হয়তো ততটা পরিচিত নয় ‘বুনো স্ট্রবেরিজ’ বইয়ে আমরা আরো কিছু মানুষের মুখ খুঁজে পাই। যে ঘোড়া হতে চায় না। রেস জিততে চায় না, ট্রাপিজের খেলা দেখাতে পারে না। নিজের মত থাকে, কিছু বোঝা টানে, কিছু ঘাস খায় আর মাঝে মাঝে ডেকে ওঠে ‘ব্যা’। তার এমন নিরাসক্ত ভাব যে ধোপার পেটানিতেও বিশেষ কিছু আসে যায় না। সে জানে অরণ্যের দিকে নীলগাই, চিত্রমৃগ, বাইসনেরা ঢের সুখে আছে, কিন্তু যাওয়ার কোনও তাড়া নেই তার। যদিও সে ইচ্ছে করলেই যেতে পারে কারণ তার কোনোও মুখরজ্জু নেই, কিন্তু বনে বা পাহাড়ে পালিয়ে যায় না এই হতভাগা কারণ তার নিজের একটা খুবসুরতি আছে।
এই যে নানান মানুষের নানান খুবসুরতি, এক সময় তারাশঙ্করের উপন্যাসে, সুবোধ ঘোষের গল্পে, পুরোনো বাংলা সিনেমার কিছু চরিত্রে, এমন কী শীর্ষেন্দুর ‘কাগজের বৌ’ ধরনের কিছু উপন্যাসে আমরা এদের দেখতে পেতাম। এই বই আমাদের জানায় যে এক সময় গাধা বিভূতিভূষণেরও স্নেহ পেয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে কেবল কাপ্তেনদের গল্পেই ভরে যাচ্ছে আমাদের আকাশ বাতাস চোখের আর কানের পর্দা। পৃথিবীর সব কিছু ঘোড়ার ওয়াস্তে তাই গাধার চক্ষুদ্বয় কালো অশ্রুসজল।
কিন্তু এই বই বিপন্ন গাধার জন্যে বিলাপ কমিটির ম্যানিফেস্টো নয়। এ লেখা তার চেয়ে অনেক জটিল, অনেক বেশি রাজনৈতিক (যদিও রাজনীতি কথাটা আজকাল সরল আর তরল বর্জ্য হয়ে উঠেছে) এক আখ্যান। গাধা কিন্তু ভাঙা আস্তাবলের ফাঁক দিয়ে চাঁদ দেখে যায়, বন্দুক-টোটা চিবোতে চিবোতে বলে চলে, ‘যা: তোদের হিংসে ফর্দাফাই’। কিন্তু আবার সে গাধা বলেই বোধ হয় তাকে বারবার স্মরণ করিয়ে দিতে হয়: হিংসা কি খতম হয় রে গাধা?
তাই এই নাগরিক জীবনের কাহিনিটা যোগাড় করুন, পড়ুন, একা একা হাসুন, ভাবুন, হয়তো মাঝে মাঝে চুপ করে বসেও থাকতে হবে।