• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৬৬ | মার্চ ২০১৭ | ছোটদের পরবাস | গল্প
    Share
  • মানুষের ধর্ম : চম্পক সৌরভ


    -নে-ক বছর আগেকার কথা। সে সময়ে এম.বি. ডাক্তার সহজলভ্য ছিল না। স্বভাবতই এম.বি. ডাক্তারদের খুবই সম্মান ছিল সেসময়—বিশেষত শান্তিপুরের মতো মফস্বল শহরে। ডা: আলমকে একডাকে চিনত গোটা শান্তিপুর, রীতিমত সমীহ করত, ভালোও বাসত।

    ডা. আলম প্রতিদিন সূর্য ওঠার অনেক আগেই ঘোড়ায় চড়ে প্রাতর্ভ্রমণে বেরোতেন, শীতকালেও এর অন্যথা হত না। সেদিনও গঙ্গার তীর ধরে চলেছিলেন—হঠাৎ তাঁর কানে এলো কারও কাতর আর্তনাদ। কেউ একটানা যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। সেই শব্দ লক্ষ্য করে খানিকটা এগিয়েই আলম বুঝলেন, আর্তনাদটা ভেসে আসছে একেবারে গঙ্গার ধার থেকে। ঘোড়া থেকে নেমে গঙ্গার পাড় ধরে নামতে নামতে পৌঁছে গেলেন একেবারে জলের ধারে। গিয়ে দেখলেন, একজন মানুষ—কোমর পর্যন্ত এই ঠাণ্ডায় জলে ডোবানো। শীতে, ঠাণ্ডায় কাঁপছে মানুষটা।। ভোরের ঠাণ্ডা হাওয়া হু হু করে বইছে। মানুষটার মাথার ওপর একটা ছাউনি থাকলেও, চারদিকে কোনও আড়াল নেই। পাড়ে খানিক ওপরে একটা ঝুপড়ি মতন। ডা: আলম বুঝতে পারলেন, মানুষটাকে অন্তর্জলি যাত্রায় রেখে যাওয়া হয়েছে। একটু ঠাহর করে দেখে বুঝতে পারলেন, মানুষটা একজন বৃদ্ধা। ডা: আলম বৃদ্ধার নাড়ি ধরে দেখলেন, খুব দুর্বল হলেও হাল ছেড়ে দেওয়ার মতো নয়। ডাক্তারের সহজাত প্রবৃত্তিতে আলম বৃদ্ধাকে তুলে নিয়ে এলেন ওই ঝুপড়িতে। দেখলেন, ভিতরে একটা বিছানা পাতা। বৃদ্ধাকে তাতে শুইয়ে তার হাত-পা ঘষে শরীরের উত্তাপ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করতে লাগলেন। যখন মনে হল, জীবনহানির ভয় আর নেই, গিয়ে লোকজন ডেকে এনে বৃদ্ধাকে নিজের বাগানবাড়িতে নিয়ে এলেন। কথা বলার মতো অবস্থায় আসার পর বৃদ্ধা ডা: আলমকে জানালেন তাঁর নাম গিরিজাবালা দেবী। পাশের গ্রামে বাড়ি। তাঁর নিজের তিন ছেলে তাঁকে এই অন্তর্জলি যাত্রায় রেখে গিয়েছে গতকাল। মৃত্যুর বয়স ঘনিয়ে এলে এভাবেই জলে অর্ধেক ডুবিয়ে রেখে যাওয়াটাই প্রথা—যাতে মৃত্যুর পর অক্ষয় স্বর্গলাভ হয়। তিনি এখন সুস্থ হয়ে উঠলেও তাঁকে ওরা আর ফিরিয়ে নেবে না, কারণ অন্তর্জলি যাত্রা হলে আর ঘরে ফেরার নিয়ম নেই। গোটা একটা দিন আর একটা রাত এই শীতে জলে আধডোবা হয়েও উনি বেঁচে ছিলেন, এটাই আশ্চর্যের! হিন্দু ঘরের বিধবা—বিধর্মীর ছোঁয়া কিছু খাবেন না। তাই, ডা: আলম একজন হিন্দু মহিলাকে তাঁর যত্ন করার জন্য বহাল করলেন, যে গিরিজা দেবীকে দুধ, ফল, খই এসব যোগাবে। চিকিৎসার থেকে মহিলার পরিচর্যার বেশি প্রয়োজন ছিল। ডা: আলমের শুশ্রূষায় দু-দিনেই সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠলেন। ডা: আলম বললেন, ‘মা এখন তো আপনি সম্পূর্ণ সুস্থ, চলুন আপনাকে আপনার বাড়িতে দিয়ে আসি। আমার কথা ওরা ফেলতে পারবে না।’

    গিরিজাবালা ফুঁসে উঠলেন, ‘কক্ষনো না। ওদের কাছে আমি আর ফিরব না। ওরা আমাকে অন্তর্জলিতে পাঠিয়েছিল সম্পত্তির লোভে। আমার দোষ, আমার শ্বশুরমশাই মারা যাবার সময় নাতিদের সম্পত্তি না দিয়ে উইল করে আমাকে দিয়ে গিয়েছিলেন। তক্কে তক্কে ছিল ওরা। ক-দিন আগে আমার শরীর খারাপ হয়েছিল। কবরেজ ডাকা তো দূরের কথা, ওরা আমাকে খাবার দেওয়া পর্যন্ত বন্ধ করে দিল! তুই আমাকে মা বলে ডেকেছিস, তুই আমার ডাক্তার ছেলে। আমি তোর কাছেই থাকব।’

    গিরিজাবালা রয়ে গেলেন ডা: আলমের কাছে। ডা: আলম তাঁর বাগানবাড়িটা গিরিজাবালার বসবাসের উপযোগী করে তুললেন। উঠোনে তুলসীমঞ্চ গড়া হল, গোয়াল গড়ে তাতে দুটো দুধেল গাই রাখা হল। সমাজে প্রথমে খুবই হইচই পড়ে গিয়েছিল। গিরিজাবালার ছেলেরা দু-তিনজন ব্রাহ্মণ পণ্ডিতকে নিয়ে ডা: আলমের বাড়িতে চড়াও হয়েছিল। তাদের যুক্তি ছিল, অন্তর্জলি হওয়া মানুষকে বাঁচিয়ে তুলে ঘোর অধর্ম করেছেন—এতে গিরিজাবালার অনন্ত নরকবাস নিশ্চিত। ডা: আলম জানালেন, চিকিৎসকের ধর্ম প্রাণ রক্ষা করা। আমি তাই করেছি। অতএব অধর্ম হয়নি। তাছাড়া মা-ই আর ফিরতে চান না। ওঁর ছেলেরা ওঁর সম্পত্তি ভোগ করতে পারেন। ওতে আমার কোনও লোভ নেই। ওঁরা দেখলেন ডা. আলম গিরিজাবালার সম্পূর্ণ বিধিসম্মত ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। কারও আর কিছু বলার নেই। অন্তর্জলিতে যাওয়া মানুষ হিন্দুসমাজের কাছে মৃত, এই যুক্তি দেখিয়ে ওঁরা ফিরে গিয়েছিলেন।

    আরও দশ বছর বেঁচে ছিলেন গিরিজাবালা। ডা: আলম ওঁর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া করিয়েছিলেন পুরোপুরি হিন্দুমতে। ডা: আলম প্রমাণ করে দিয়েছিলেন, মানুষের একমাত্র ধর্ম মানুষকে ভালোবাসা, প্রাণ রক্ষা করা, ধ্বংস নয়।



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ রাহুল মজুমদার
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments