• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৬৬ | মার্চ ২০১৭ | গল্প
    Share
  • ‘নিতান্তই পুতুলের গল্প কিংবা অনিন্দিতার কাহিনী’ : দিবাকর ভট্টাচার্য


    ‘অনি ও তার আরেকটি পুতুল’

    ইবার অনির সামনে এসে হাজির হলো আরেকটি পুতুল। চোখে চশমা গায়ে পাঞ্জাবি। মাথাভর্তি ধবধবে সাদা কোঁকড়া চুল। বসে আছে হেলানো চেয়ারে। একদৃষ্টে অনির দিকে তাকিয়ে। মাঝরাতে। রাতবাতির আধো আলোয়।

    ‘অনি ও তার তিন বন্ধু’

    অনি ও গোলাপি দাদু

    অনির বয়স তখন ছয়। একদিন বিকেলবেলায় ঘুম থেকে উঠে অনি দেখলো তার মাথার কাছে একগাল হেসে দাঁড়িয়ে রয়েছে কে যেন। মুখে ধবধবে সাদা দাড়ি। গায়ে তার ঝলমলে গোলাপি রঙের পাঞ্জাবি। অনি অবাক হয়ে তার দিকে তাকালো। এক গাল হেসে সে বললো — ‘বলো তো আমি কে?’ অনি ফিক করে হেসে বলে ফেললো— ‘তুমি গোলাপি দাদু’। মাথা নেড়ে হাসতে হাসতে সে বলে উঠলো— ‘ঠিক! ঠিক! একেবারে ঠিক!’ অনির বয়স তখন ছয়।

    অনি ও রক্ষী

    অনির তখন আটবছর বয়স। সন্ধেবেলায় খেলে এসে ঘুমে চোখ জুড়ে আসছে তার। খাওয়ার টেবিলে একা একা বসে তার মনে হলো সামনে কে যেন এসে দাঁড়ালো। মাথায় খয়েরী রঙের টুপি। সারা গায়ে খয়েরী রঙের পোষাক। টানটান হয়ে সে দাঁড়িয়ে রয়েছে তার মুখের সামনে। অনি জিগ্‌গেস করলো— ‘তুমি কে?’ সে কোনো উত্তর না দিয়ে আগের মতোই দাঁড়িয়ে রইলো। ‘রক্ষী। তুমি রক্ষী’ — আপনমনেই বলে উঠেছিলো অনি। এবারেও কোনো উত্তর এলো না। স্থির চোখে সে তাকিয়ে রইলো অনির দিকে।

    অনির তখন আট বছর বয়স।

    অনি ও বেহালাওলা

    অনি সেদিন দশে পড়লো। জন্মদিনের হৈ হট্টগোলে ক্লান্ত অনি কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলো তার বিছানায় তা সে টেরই পায় নি। কিন্তু মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গিয়েছিলো তার। আর ঘুম ভাঙতেই টের পেয়েছিলো যে ও শুয়ে আছে ওর মায়ের পাশটিতেই। হাল্কা নীল লাইট ল্যাম্পের আলোয় মনে হচ্ছিল কে যেন বসে আছে তার মাথার কাছেই। ভালো করে খেয়াল করার পরে সে বুঝতে পারলো যে তার মাথার পাশেই বসে আছে একটি অল্পবয়েসী ছেলে। ঘাড় গুঁজে মুখ নামিয়ে একটা বেহালা বাজাচ্ছে একমনে। চারদিকে তার যেন কোনো হুঁস নেই। ‘বেহালাওলা? তুমি বুঝি বেহালাওলা?’ — জিগ্‌গেস করছিলো অনি। সে কোনো উত্তর দেয় নি। একমনে চোখ বুজে বেহালা বাজিয়ে যাচ্ছিল সে। ‘ও বেহালাওলা - ও বেহালাওলা’- ভাবতে ভাবতে আধোঘুমে আধোজাগায় বাকি রাতটা কেটেছিলো তার।

    অনি সেদিন দশে পড়েছিলো।

    এইভাবে অনির ছোটবেলায় তিন বন্ধু হয়েছিলো। তিন জন বিশেষ বন্ধু।

    ‘অফুরন্ত খুসীর দেশে’

    এক অফুরন্ত খুসীর দেশে বাস করে এক বৃদ্ধ, এক যুবা ও একটি ছোটো ছেলে। এদের মধ্যে মাঝে মাঝেই দেখা হয়। কথা হয়। এরা সবাই অনির বন্ধু। যে যার মেজাজে চমৎকার আছে। এইভাবেই তাদের দিন কাটে। রাত কাটে। এই অফুরন্ত খুসীর দেশে।

    অনি ও তার নতুন সাম্রাজ্য

    অনি আজ খুব খুসী। যেন এক নতুন সাম্রাজ্যের অধীশ্বরী হয়েছে সে। তা সাম্রাজ্যই বটে। অনির যাবতীয় সম্পত্তিই তো ঢুকলো এখানে। অর্থাৎ তার ছোট্‌দাদুর এই আলমারিটায়।

    অনির ছোটদাদু রাধিকামোহন ছিলেন সৌখিন মানুষ। ছবি আঁকতেন। গানবাজনা করতেন। সখের থিয়েটারের দল ছিলো। আবার ছাত্র হিসেবেও তিনি ছিলেন অতি কৃতী। চাকরিও করতেন বিরাট মাপের। এই আলমারিটা তিনি নিজে মিস্ত্রি দিয়ে বানিয়েছিলেন অনেক মেহনত করে। এটি ছিলো সত্যিই একটি দেখবার জিনিস।

    আলমারিটার দুটো অংশ। পুরোটাই মেহগনী কাঠের। নীচের অংশে ছিলো দুটো বড়ো বড়ো ড্রয়ার। দুহাত লম্বা। দেড় হাত চওড়া। আর প্রায় ততখানিই গভীর। সিংহের মুখওয়ালা দুটো বিরাট বিরাট পিতলের হাতল লাগানো তাতে। এদুটো বানানো হয়েছিলো ওনার সেইসব জিনিসপত্র রাখতে যেগুলো আকারে বড়ো আর ভারী। এর একটিতে থাকতো তাঁর ছোটছোটো ক্যানভাসগুলি আর রঙ তুলি ইত্যাদি সব আঁকার সরঞ্জাম। আর অপরটিতে গোছাগোছা গানবাজনার লং প্লেয়িং রেকর্ড। স্বরলিপির বাঁধানো খাতা। এই ড্রয়ার দুটির উপরে ছিলো চারটি সরু লম্বা ড্রয়ার। সেখানে তাঁর পেন পেনসিল, চশমা, ঘড়ি, ব্যাঙ্কের কাগজপত্র ইত্যাদি একেকটিতে গুছিয়ে রাখা। এর উপরেই ছিলো সাদা ধবধবে শ্বেতপাথরের অংশটি। আর তার উপর আলমারিটার উপরের ভাগ। সেখানে কাঁচের পাল্লা দেওয়া দুটিমাত্র সেল্‌ফ। শ্বেতপাথরটির দৈর্ঘ্য বরাবর। লম্বায় প্রায় আড়াই হাত। আর চওড়ায় দেড় বিঘৎ। এখানে থাকতো ওনার সংগ্রহের নানান জিনিস। আর অল্প কয়েকটি বই।

    ছোটদাদু মারা যাবার পর আলমারিটা পড়েই ছিলো বাড়ির কোণে। অনির বাবা (অর্থাৎ ছোটদাদুর ভাইপো) দীপঙ্কর সেই আলমারি সাফসুতরো করে মিস্ত্রি ডেকে পালিশ করিয়ে সেটাকে দুর্দান্ত একটা জিনিস করে তুললেন। দীপঙ্করের স্ত্রী অর্থাৎ অনির মা মল্লিকা সেটা দেখে বললেন— ‘আগেকার দিনের কাজ বলেই আজও এত সুন্দর।’ আর দীপঙ্করের একমাত্র সন্তান অনিন্দিতা অর্থাৎ আমাদের অনি বললো— ‘যেন একটা রাজপ্রাসাদ।’ দীপঙ্কর হেসে বললেন— ‘তোমার জন্য - তোমার জন্মদিনের উপহার।’ অনি সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে উঠে তার বাবার পরিপাটি করে আঁচড়ানো মাথাভর্তি কোঁকড়া চুলগুলো আদর করে এলোমেলো করে দিয়ে চেঁচিয়ে বলে উঠল— ‘এটা আমার! এটা আমার!’ অনির যাবতীয় জিনিস ঠাঁই পেলো এই আলমারিতে। পুরনো যত খেলনা এসে ঢুকলো নীচের বাঁ দিকের ড্রয়ারটিতে। ডানদিকেরটিতে ঢুকলো কিছু বই আর খাতা। উপরের ড্রয়ারগুলোতে বন্ধুদের দেওয়া একগাদা কার্ড, ছবি আর হাজার রকমের পেন পেনসিল। উপরের সেল্‌ফ্‌দুটিতে স্কুলের কিছু বইপত্তর আর খাতা। আর অতি প্রিয় ব্যাডমিন্টন র‍্যাকেটটিকেও সে এনে সাজিয়ে রাখলো সেই শ্বেতপাথরটার উপর। এইভাবে তার চোদ্দ বছরের জন্মদিনটিতে ওই মেহগনীকাঠের আলমারিটির মধ্যে অনায়াসে যেন তার সাম্রাজ্য বিস্তার করে ফেললো। দীপঙ্কর দেখে বললেন— ‘আজ থেকে এটা ওর নিজস্ব আলমারি।’ মল্লিকা বললেন— ‘আদিখ্যেতা।’ আর অনিন্দিতা অর্থাৎ আমাদের অনি কিছুই না বলে ওই আলমারি থেকে দুহাত দূরে দাঁড়িয়ে আলমারিটির কাচের পাল্লায় সমানে দেখছিলো তার নিজের হাসিমুখটা।

    ‘পাতালে কোনো ঋতু নেই’

    পাতালে শুধু অন্ধকার। সে অন্ধকার এতো গভীর যে কেউ কাউকে দেখতে পায় না। এমনকি নিজেকেও না। তাই ওরা কেউ কাউকে দেখতে পাচ্ছে না। নিজেদেরকেও না।

    এ অন্ধকার এতো ভয়ঙ্কর যে এখানে কোনো শব্দ শোনা যায় না। তাই কেউ কারো কথা শুনতে পায় না। এমনকি নিজের কথাও শোনা যায় না নিজের কাছে। তাই ওরা কে কি বলছে কিছুই শোনা যায় না।

    এ অন্ধকার এতো গভীর যে এখানে কোনো সময় বোঝা যায় না। তাই এখানে কোনো ঋতু নেই।

    তাই ওদের অতীত ওরা মনে করতে পারে না। ওদের কোনো ভবিষ্যৎ ওরা দেখতে পায় না। ওদের জীবনে সময় বলে কিছু নেই।

    অথচ একটা সময় ছিলো যখন অন্ধকার এতো গভীর ছিলো না। তখন ওরা পরস্পরের সঙ্গে কথা বলতো। অনেকটা এইভাবে—

    ‘আচ্ছা কেন এমন হোলো বলো তো? কি দোষ করেছি আমরা?’ — বৃদ্ধটি আপনমনে মাথা নাড়তে নাড়তে জিজ্ঞাসা করতো।

    ‘কোনো দোষ নেই। কোনো কারণ নেই। শুধু কপাল’ — উত্তর দিতো সেই যুবাটি।

    ছোটো ছেলেটি কোনো উত্তর দিতো না। স্থির বসে থাকতো তার বেহালাটি হাতে নিয়ে। আধো অন্ধকারে কখনো কখনো সেই বেহালায় করুণ সুর শোনা যেতো।

    ক্রমশ সময় পার হতে লাগলো। আর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অন্ধকার ক্রমশ গাঢ় হতে লাগলো। কতো সময় পার হোলো? কেউ জানে না। কতো অন্ধকার জমা হোলো? কেউ বলতে পারে না। শুধু ক্রমশ নিশ্চুপ হয়ে গেলো ওরা।

    সেই নিশ্চুপ হয়েও ওদের একটা মন ছিলো। তাই তখন তারা শুধু ভাবতো পুরোনো দিনের কথা। হয়তো এইভাবে—

    বৃদ্ধের মনে পড়তো কিভাবে কাটতো তার দুপুরবেলাগুলো - তার ছোট্ট বন্ধুটির সাথে। সেই ছোট্ট বন্ধুটি কতো কথাই না বলতো সেই সময়ে।— ‘জানো জানো আমাদের ছাদে একটা ছোট্ট নীল পাখী এসেছিলো আজ সকালে তার ঠোঁটটা কিন্তু হলুদ — ওই শিউলিগাছটার উপরে বসেছিলো অনেকক্ষণ - আর কি সুন্দর করে ডাকছিলো - তারপর উড়ে গেল হঠাৎ - ওই কোণায়। কিগো শুনছো?’ চোখ বড়ো বড়ো করে বলতো তার সেই ছোট্ট বন্ধু। তখন সে উত্তর দিতো— ‘নিশ্চয়ই- নিশ্চয়ই- বলো- বলো’

    যুবাটির মনে পড়তো--সেই সন্ধেগুলোর কথা যখন তার ক্ষুদে বন্ধুটি জড়োসড়ো হয়ে বসে থাকতো তার পড়ার টেবিলে আর মাঝে মাঝে তাকাতো তার দিকে। ভয়ে ভয়ে জিগ্‌গেস করতো তাকে - ‘আচ্ছা আমার মা কখন আসবে বলো তো?’ ‘বাবার তো অনেক রাত হবে আসতে তাই না?’ – ‘দিদু পাশের ঘরে জেগে আছে কিনা জানো?’ এখন যদি কেউ আসে – এইঘরে - তুমি আটকাতে পারবে তো তাকে? কি গো পারবে তো তার সঙ্গে যুদ্ধ করতে?’ যুবাটি স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতো তার দিকে। ওই দৃষ্টি দিয়েই সে বলতো— ‘নিশ্চিন্ত থাকো - নির্ভয়ে থাকো’।

    অল্প বয়েসী ছেলেটির মনে পড়তো সেই রাতগুলির কথা যখন তার সেই ছোট্টবন্ধুটি তার কাছে এসে বসতো চুপটি করে, সবার অলক্ষ্যে। আর টপটপ করে চোখের জল ফেলতো তারই গায়ে, মাথা নীচু করে নি:শব্দে — আর বলতো আপনমনেই — ‘আমি পারি না - কিছু পারি না- পড়া মনে রাখতে পারি না - খেলতে পারি না - কারো সাথে ভালোভাবে মিশতে পারি না - কেন বলো তো? কেন আমি কিছু পারি না?’ সে তার ছোট্টবন্ধুটির চোখের জলে ভেজা প্রশ্নগুলির উত্তর দিতো বেহালার সুরে নিবিষ্ট হয়ে।

    কিন্তু একটা সময় এলো যখন অন্ধকার সবচেয়ে গাঢ় হোলো - তখন ওরা আর ভাবতে পারতো না কোনো কথা - কোনো পুরোনো ঘটনা। এইভাবে ওরা ক্রমশ ভুলে গেলো যে ওরা কি ছিলো আর কে কি করেছিলো।

    তাই ওরা পড়ে রইলো পাথরের মতো - সবচেয়ে গভীর অন্ধকারে কতকাল কে জানে--

    কারণ পাতালে তো কোনো ঋতু নেই।

    ‘অনি ও তার সবচেয়ে সুন্দর সকাল’

    অনির কাছে আজ সকালের আলোটা তার দেখা সবচেয়ে সুন্দর আলো। এক স্বপ্নের রাজ্যের রাণী হতে চলেছে সে। মাত্র চব্বিশ ঘন্টা বাদেই। বাড়ির সর্বত্র সেই খুসীর আলো ঝলমল করছে। সমস্ত বাড়িটা রঙ করা হয়েছে। বদল করা হয়েছে সমস্ত দরজা জানালার পুরোনো পর্দা। বাতিল হয়েছে পুরোনো আলোপাখা আসবাবপত্র। অবশ্যই কয়েকটি আছে এর ব্যতিক্রম। যেমন বাইরের বসার ঘরের সেই পুরোনো কার্পেটটা। সেটা ঝেড়েঝুড়ে পাতার পর ঘরের মেঝেটাই যেন রাজকীয় হয়ে গেলো। তেমন আরেকটি হোলো ওই ঘরেরই একটা প্রকাণ্ড আলোর শেড। বহুবছরের কালিঝুলিমাখা। ধুয়েমুছে পরিষ্কার করে আবার লাগানো হোলো। এর মধ্যেকার হলুদ বাল্বটা সত্যিই ব্রিটিশ আমলের। এবং আশ্চর্যভাবে সেটি জ্বললো এতকাল পড়ে থাকার পরেও। এবং সেই মেহগনী কাঠের শ্বেতপাথর লাগানো আলমারিটা। অনির ছোটোবেলার হাজারো জিনিস বেরিয়ে এলো তার ভিতর থেকে। সেগুলো সরিয়ে রেখে আলমারিটাকে একেবারে ফাঁকা করে তার ভিতরটা ন্যাকড়া দিয়ে মুছে পরিষ্কার করে দিতেই আবার দেখা গেলো তার পুরোনো জেল্লা। ‘এগুলোর ক্লাসই আলাদা। এগুলো অবশ্যই থাকবে’ — বললেন দীপঙ্কর। অনি কথাটা খেয়াল করলো না। সে তখন খুব যত্ন করে দেখছিলো আয়নায় তার সুশ্রী মুখটাকে। আর ভাবছিলো একে অপরূপা করতে গেলে আর কি কি প্রয়োজন। কারণ এক স্বপ্নের যাত্রার জন্য তৈরী হতে হবে তাকে আজ সকাল থেকেই। তাই আজকের সকালটাই তার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর সকাল।

    “আলোয় অথচ অলক্ষ্যে”

    এইবার হঠাৎ এক আলোর ঝলকানিতে চোখ ধাঁধিয়ে গেলো ওদের সকলের। বৃদ্ধটি কেঁপে উঠে বললো— ‘কি হোলো কি হোলো আবার?’ যুবাটি বলে উঠলো— ‘এতো আলো! এত আলো! তাকাতে পারছি না।’ বলে চোখ বন্ধ করে নিলো। ছোটো ছেলেটি সেই আলোয় মাথা তুলেই সঙ্গে সঙ্গে মাথা নামিয়ে নিলো। এইভাবে এক হঠাৎ আলোর বন্যায় ভেসে গেলো ওরা সকলে।

    খানিক বাদে দেখা গেলো বৃদ্ধটি সেই আগের মতোই এক গাল হেসে মাথা নাড়িয়ে বলছে — ‘বলেছিলাম না? বলেছিলাম না? ধৈর্য ধরো - ধৈর্য ধরো। একদিন আসবে যখন আবার আমরা আগের মতো...।’ যুবাটিও আগের মতোই দৃপ্তভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে পড়লো সোজা সামনের দিকে তাকিয়ে — চোখেমুখে আগের মতোই নিশ্চিন্ত দৃঢ়তা। ছোটোছেলেটি আবার ঘাড় গুঁজে মাথা নীচু করে ডুবে গেলো তার সুরের সাগরে।

    এইভাবে অনেকক্ষণ কেটে গেলো। চোখ সয়ে গেলো ওদের আলোর বন্যায়। ওরা দেখতে পেলো চারিদিকে কতো লোকজন। কতো হই হট্টগোল। কিন্তু এর মাঝে ওরা ওদের সেই ছোট্ট পুরোনো বস্তুটিকে কোত্থাও খুঁজে পেলো না।

    বৃদ্ধ মানুষটি মাথা নেড়ে নিজের মনেই বলে যেতে লাগলো — ‘কোথায় গেলো বলো তো? ও কোথায় গেলো বলো তো? যুবাটি প্রখর দৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকিয়ে রইলো - যদি দেখা যায় তাকে- এই মানুষজনের হট্টমেলায় - কিছুতেই যেন চোখ না এড়ায় - কোনোমতেই। ছোটোছেলেটি কোনো কথা না বলে কোনোদিকে না তাকিয়ে মাথা ঝুঁকিয়ে মিশে গেলো তার বেহালার করুণ সুরে।

    সময় গড়াতে লাগলো। কিন্তু তারা কেউ তাদের সেই ছোট্ট পুরোনো বন্ধুটির দেখা পেলো না। বরং তারা দেখতে পেলো হরেকরকমের লোক যাদের কক্ষনো দেখে নি তারা। নানান ধরনের কথাবার্তা যার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝছে না তারা।

    এইভাবে তারা পড়ে রইলো অজানা আলোর বন্যায়। না-জানা লোকের মাঝে। আলোয় অথচ অলক্ষ্যে।

    ‘অনি ও তার আবিষ্কার’

    অনি এসেছে। অনি এসেছে! অনি এসেছে!!

    বিয়ের পর আবার অনি এসেছে।

    আটদিনের মাথায়।

    তার নিজের বাড়িতে।

    এ আসা অবশ্য নিয়মমাফিক। একদিনের জন্য। এবার সে চলে যাবে বহুদূর। তার বরের চাকরীস্থলে।

    ফলে সামনে তার নতুন দেশ। নতুন জীবন। মনের ভিতর অন্যরকম আনন্দের স্রোত বইছে সারাক্ষণ। কিন্তু একটু মনখারাপও আছে এর মধ্যে। বাবা মাকে ছেড়ে চলে যেতে হবে কতদূরে। তাই সে প্রাণপণ চেষ্টা করছে যাতে তাদের বুঝতে না দেওয়া যায় তার এই কষ্টটা। এই জন্যেই তো ভোরবেলাতেই সে এসেছে। ঠিক আগের মতো হৈ হৈ করে বাবার কাছে যাচ্ছে। মায়ের কোল ঘেঁষে বসছে। নিজে হাতে গুছিয়ে দিচ্ছে এখানে সেখানে পড়ে থাকা সমস্ত টুকিটাকি।

    এইভাবেই সে গুছিয়ে রাখলো তাদের শোয়ার ঘরের আলনাটা। খাওয়ার ঘরের টেবিলটা। এইবার সে গেলো তার পড়ার ঘরটিতে। যেখানে কেটেছে তার ঘণ্টার পর ঘন্টা। বহুবছর ধরে। পড়ার টেবিল, চেয়ার, টেবিলল্যাম্প সব একে একে গুছিয়ে রাখলো সে। যেন এখুনি পড়তে বসবে। তারপর তার চোখ গেল সেই অতিপ্রিয় শ্বেতপাথর লাগানো আলমারিটার দিকে। শ্বেতপাথরটার উপর জড়ো করে রাখা আছে কিছু জিনিস। সেই জিনিসগুলোর দিকে চোখ গেলো তার। এরপর সেই জিনিসগুলোর থেকে কয়েকটা জিনিস বার করে খুব যত্ন করে তার নরম আঙুল দিয়ে সেগুলোকে পুঁছে সাজিয়ে রাখলো একটি একটি করে সেই শ্বেতপাথরটার উপর।

    ‘কি খুট্টুর খুট্টুর করছিস ওখানে? আয় এদিকে আয়’ — বললেন দীপঙ্কর।

    ‘নাহ্‌। কয়েকটা জিনিস আবার আবিষ্কার করলাম’ — একগাল হেসে বললো অনি।

    ‘স্মৃতি এবং শ্বেতপাথর’

    মাত্র কদিন আগেই অনি নিজে হাতে সাজিয়ে দিয়ে গেছে তার ছোটোবেলার কয়েকটি স্মৃতি। ওই শ্বেতপাথরের উপর।

    একটি ঘাড়নড়া মাটির পুতুল — একমুখ দাড়িওলা — গোলাপী জামা গায়ে — তার ছ বছর বয়সের সাথী!

    একটি কাঠের সেপাই — হাতে বল্লম, গায়ে খয়েরী রঙের জামা - তার আট বছর বয়সের বন্ধু!

    একটি ধবধবে সাদা চিনেমাটির তৈরী বেহালা হাতে কোঁকড়া চুলের ছোটো ছেলে — মুখ নীচু করে আপনমনে যেন বাজিয়ে চলেছে — তার দশ বছর বয়সের সঙ্গী!

    এবং শেষটি একটি মরচে ধরা ছোটো স্টিলের ফ্রেমে বহুকালের ধুলোপড়া ছবি — একটি ছোট্ট মেয়ের। মাথার দুপাশে দুটো ঝুঁটি - দাঁড়িয়ে রয়েছে ঝলমলে হাসিমুখে - তার সাতবছরের জন্মদিনের ছবি।

    যারা এতোকাল ছিলো ওই আলমারির নীচের ড্রয়ারে এককাঁড়ি হাবিজাবি জিনিসের সঙ্গে - অনির চোদ্দ বছরের জন্মদিন থেকে কদিন আগে পর্যন্ত — অন্ধকারে গুঁজে রাখা--তাদের এইভাবে সাজিয়ে দিয়ে অনিন্দিতা স্যান্যাল চলে গেলো বহু দূরদেশে।

    তাই এইভাবে পড়ে রইলো তার কয়েকটি স্মৃতি সেই শ্বেতপাথরটির উপর।

    ‘আবার খুসীর দেশে’

    ‘আমি জানতাম। আমি জানতাম। ওকি কখনো আমাদের ছেড়ে থাকতে পারে?’ — ঘাড় নাড়তে নাড়তে হৈ হৈ করে বলে উঠলো সেই বৃদ্ধ।

    মুখে কিছু না বললেও অতি প্রসন্ন মুখে বর্শা ধরে দাঁড়িয়ে রইলো সেই যুবাটি।

    আবার মাথা নীচু করে বেহালায় ছড় টানলো সেই অল্পবয়েসী ছেলেটি। এবার তার আনন্দের সুর।

    এরা তিনজনে এখন আবার এক জায়গায়। আর এদের মাঝে দেখা যাচ্ছে দাঁড়িয়ে আছে এদের সেই ছোট্ট পুরোনো বন্ধুটি — তার দারুণ সুন্দর মিষ্টি হাসিটি মুখে নিয়ে।

    তাই ওরা সবাই আবার খুসীর দেশে।

    ’মাঝরাতে এক প্রৌঢ় মানুষ’

    মাঝরাতে এক প্রৌঢ় মানুষ – চোখে চশমা – মাথাভর্তি ধবধবে সাদা কোঁকড়া চুল – হলুদ পাঞ্জাবি গায়ে – নাইটল্যাম্পের হাল্কা নীল আলোয় এদেরকে এইভাবে দেখে পায়ে পায়ে এগিয়ে এলেন এদের খুব কাছে। তারপর ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখলেন এদের প্রত্যেককে। তাঁর মনে হোলো হঠাৎ যেন একটু আবছা দেখছেন তিনি — বিশেষত ওই ফ্রেমে বাঁধানো একান্ত আপন শিশুটির হাসিমুখটাকে — নাকি সবকিছুই ...

    আর তারপর তাঁর হেলানো চেয়ারটিকে টেনে এনে বসে পড়লেন এদের সামনে। মাঝরাতে। সেই আধো অন্ধকারে।

    ’নিতান্তই পুতুল একটি’

    — অনি!

    — ও অনি!

    — দেখতে পাচ্ছো?

    — তোমার সামনে ওই যে – চোখে চশমা

                                — গায়ে হলুদ পাঞ্জাবি

                                — মাথাভর্তি ধবধবে কোঁকড়া চুল

                                — বসে আছে হেলানো চেয়ারে

                                — একদৃষ্টে তোমার দিকে তাকিয়ে ....

    অর্থাৎ — পুতুল!

    — মধ্যরাতে

    — তোমার জন্য

    — বসে আছে

    — নিতান্তই পুতুল একটি!



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণ : অনন্যা দাশ
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments