• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৬৬ | মার্চ ২০১৭ | গল্প
    Share
  • সম্পর্কিত : সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায়


    “আয় মুন্নি, আমার পাশে বোস। কত রোগা হয়ে গেছিস! খাওয়া দাওয়া করিস না নাকি ঠিক করে?” মামা মুন্নির হাত থেকে চায়ের কাপটা নিয়ে বিছানার ওপরই নামিয়ে রাখে। তারপর হাত ধরে টেনে তাকে পাশে বসায়। বাসি মুখে এক কাপ চা না খেয়ে মামা বিছানা ছাড়তে পারে না। বালিশ আঁকড়ে আড় হয়ে পড়ে ছিল এতক্ষণ। বালিশটা ফেটে তুলো বেরোচ্ছে, সেলাই দিতে হবে। মামার বুকের কাঁচা পাকা চুলে গুঁড়ো গুঁড়ো হলুদ রঙের তুলো লেগে আছে। চোখ দুটো লালচে, ফোলা ফোলা। সবে ঘুম ভেঙ্গেছে। চোখের কোলে পিচুটি জমে আছে। খসে পড়া লুঙ্গির কষিটা টেনে পেটের ওপর তুলে গিঁট বেঁধে মামা সোজা হয়ে বসল। আটটা বাজার আগে মামা কোনদিন বিছানা ছাড়ে না। মুন্নি ওঠে সেই ভোর বেলা, অন্ধকার থাকতে, থাকতে। তার অনেক কাজ। মামীকে চা দিয়ে ঘুম থেকে তোলা। ছোটকুর জলখাবার বানানো। তাকে চান পায়খানা করিয়ে স্কুলের জন্য তৈরি করা। বাসে তুলে দিয়ে আসা। ততক্ষণে মামীর আর একবার চা খাবার সময় হয়ে যায়। এবারের চা-টা মামী নিজেই বানায়। মামার জন্যও এক কাপ বানায়। মুন্নির হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে, “যা, মামাকে দিয়ে আয়।” মামাদের শোবার ঘরটা দোতলায়। লাগোয়া বাথরুম। পাশে আর একটা ঘর। অবরে সবরে লোকজন এলে থাকে। নীচে খাবার দালান, রান্নাঘর, ভাঁড়ার ঘর, কমন কল-পায়খানা। মামীর হাঁটুতে ব্যথা। বেশি ওপর-নীচ করতে পারে না। মুন্নি তরতর করে সিঁড়ি ভেঙ্গে উঠে ভেজানো দরজায় ঠেলা দেয়।

    মামা আদর করে কাছে টেনে মুন্নির পিঠে হাত রাখে। মুন্নির ফ্রকের পিঠের ওপরের দুটো হুক ছেঁড়া। তিন্নি খোলা মুখ দুটো জড়ো করে সেফটিপিন লাগিয়ে দিয়েছিল। পিঠে হাত বোলাতে গিয়ে সেটা মামার হাতে ঠেকল। “কতদিন বলেছি রাত্তিরে শোবার সময় সেফটিপিন লাগিয়ে শুবি না। পিঠে ফুটিয়ে একটা কাণ্ড বাধাবি। তখন আমায় ডাক্তারখানায় ছোটাছুটি করতে হবে।” সেফটিপিন না লাগানোর কথা মামা কবে বলেছিল মুন্নির খেয়াল নেই। কিন্তু সকাল সকাল মামার এই আন্তরিকতা দেখে মুন্নির ভাল লাগে। সে মামার কাছ ঘেঁসে বসে। ফ্রকটা ছোট হয়ে গেছে। মুন্নি আঠারো পেরিয়ে উনিশে পা দিল। খয়া-খপ্পুরে চেহারা বলে এখনও ফ্রক পরে বাড়িতে। তিন্নি পরে না, মামীর পুরোন নাইটি পরে।

    দাঁড়িয়ে থাকলে এক রকম। বসলে ফ্রকটা হাঁটুর ওপরে উঠে আসে। মুন্নি সেটাকে টেনে টেনে যতটা পারে নীচে নামাতে চেষ্টা করে। মামা সেদিকে দেখতে দেখতে বলে, “এবার পয়লা বোশেখে তোকে দুটো নতুন ফ্রক কিনে দেব।”

    মুন্নি আদুরে গলায় বলে, “একখানা সালোয়ার কামিজ দিও খন।”

    “এদিকে আয় দেখি।” মামা কাঁধের কাছে ঝুঁকে আসে। মুন্নি ঘাড়ের ওপর মামার নিঃশ্বাসের ছোঁয়াচ পায়। মুখে লেগে থাকা বাসি ঘুমের গন্ধ পায়। আঙ্গুলের চাপ দিয়ে পিঠের সেফটিপিনটা খুলে মামা মুন্নির হাতে দেয়, “রাখ।”

    মুন্নি সেটা সাবধানে বন্ধ করে খাটের পাশের টেবিলের ওপর রেখে দেয়। চায়ের কাপটাও বিছানা থেকে সরিয়ে টেবিলে রাখে। কখন উলটে পড়ে অনর্থ হবে। নড়াচড়ায় হুক ছেঁড়া ফ্রকটা একদিকের কাঁধ থেকে আলগা হয়ে অন্যদিকের হাতের ওপর সরে যায়। মামা মুন্নির হাড় জিরজিরে খোলা পিঠে, উঁচু পালকায় হাত বুলিয়ে দেয়। আঙ্গুল দিয়ে খসখসে চামড়ার ওপর আলতো দাগ টানে। মুন্নির ভীষণ সুড়সুড়ি লাগে। সে শরীরে মোচড় দেয়। মামার হাত ততক্ষণে মুন্নির পিঠে এক্কা-দোক্কা খেলা করতে শুরু করে দিয়েছে। চু-কিত-কিত করে শিরদাঁড়ার সিঁড়ি দিয়ে নেমে যায়। মুন্নি দম বন্ধ করে বসে থাকে। আবার ওপরে উঠে আসে। মুন্নি শ্বাস ছাড়ে।

    ক’দিন আগে পিঠে একটা প্যাঁচড়া মতন হয়েছিল। সেটা নিজে নিজেই শুকিয়ে মামড়ি পড়ে গেছে। মামা সেটার ওপর কুট কুট করে চুলকে দিচ্ছে। মুন্নির ভারী আরাম লাগছে। সে চুপটি করে বসে আছে। জানলার বাইরে একটা কাক ক্ব-ক্ব করে ডাকাডাকি করছে। ঘাড় ঘুরিয়ে কুতকুতে চোখে দেখছে। মুন্নি কাকটাকে চেনে। ওকে সকালে বাসি পাঁউরুটি দেওয়া হয় নি আজ। জানলার গ্রীলের ফাঁক দিয়ে সকালের রোদ এসে পড়ছে বিছানার চাদরে। চাদরটা ময়লা হয়েছে। মামীকে বলে কাচতে দিতে হবে।

    “মুন্নি-ই-ই, মামী তোকে ডাকছে।” তিন্নি নীচে থেকে চিল চেঁচাচ্ছে।

    “যাই-ই।” মামার হাত এক ঝটকায় পিঠ থেকে সরিয়ে মুন্নি উঠল। তিন্নি দেখলে রাগ করবে। মামার সোহাগ করার রীতি নীতি তিন্নি বিলকুল পছন্দ করে না। প্রায়ই মুন্নিকে বলে, “মামার কাছ ঘেঁষবি না বেশি। লোকটার মতলব ভাল নয়।”

    “লোক আবার কী? মামা বল।”

    “তুই বল গে। মায়ের মাসতুতো বোনের পিসতুত ভাই, সে আবার মামা...।”

    “মামা না দেখলে ভাত কাপড় জুটত? রাস্তায় গিয়ে দাঁড়াতি।”

    “তুই একটা মাথামোটা। বিনি পয়সায় ব্যাগার খাটার জন্যে আমাদের এনে রেখেছে। দেখলি না আমরা আসার পর মামী রাত-দিনের কাজের মাসীকে ছাড়িয়ে দিল।”

    তিন্নি বই খুঁজতে খুঁজতে মুখ ভ্যাটকায়। ওরা দুজনে এক তলার ভাঁড়ার ঘরটায় থাকে। অথবা বলা যায় ওদের ঘরেই রাজ্যের ভাঁড়ার রাখা থাকে। আগে এই ঘরে কাজের মাসী থাকত। মেঝেতে কাঁথা পেতে শুত। ওরা আসার পর মামা একখানা চার বাই ছয়ের ডিভান কিনে দিয়েছে। ওরা দুই বোন সেটাতে ঘেঁষাঘেঁষি করে শোয়। খাটের নীচে মামা পাইকারি বাজার থেকে সস্তায় আলু কিনে এনে রেখে দেয়। সেগুলো ইঁদুরের গতর-ঠেলা খেয়ে সারারাত এদিক ওদিক গড়ায়।

    ঘরে বাকি আসবাব বলতে একখানা নড়বড়ে পায়ার কাঠের টেবিল। সেটা রান্নাঘরে রাখা থাকত। মামীর হাঁটু কোমরে বাত ধরেছে। মেঝেতে বসে কাজ করতে পারে না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেটার ওপর সবজি কাটত। মামা গত মাসে রান্নাঘরে মার্বেল পাথরের ঝকঝকে প্ল্যাটফর্ম বানিয়ে দিয়েছে। টেবিলটা মামী বারান্দায় বার করে দিয়েছিল। মামার পেয়ারের পাড়া-বেড়ানো হুলোটা দিন রাত সেটার ওপর কুণ্ডুলি পাকিয়ে শুয়ে থাকত। বেড়ালটার মহা ওঁচা স্বভাব। ফাঁক পেলেই খাবারে মুখ দেয়। তিন্নি বেড়ালটাকে ভাগিয়ে টেবিলটা ঘরে ঢুকিয়েছে। মুন্নি ভেবেছিল মামা রাগ করবে। নেহাত মামী বেড়ালটাকে দু চক্ষে দেখতে পারে না। মামা মনে হয় তাই মুখ খোলেনি। টেবিলটার ওপর খবরের কাগজ বিছিয়ে তিন্নি এখন তার ইভনিং কলেজের বই খাতা রাখে। এক ধারে হাত-আয়না, সাজগোজের টুকিটাকি জিনিষপত্র। তিন্নি যখন থাকে না মুন্নি ধূলো ঝেড়ে বইগুলো গুছিয়ে রাখে। তিন্নিটা বড় অগোছালো। জিনিষপত্র এদিক ওদিক ফেলে ছড়িয়ে রাখে। পরে খুঁজে পায় না।

    মুন্নি পায়ে পায়ে রান্নাঘরে ঢোকে। মামী টের পায়। “কী করছিলি এতক্ষণ? এক কাপ চা মামার হাতে ধরিয়ে দিয়ে আসতে এত সময় লাগে?”

    মামী লুচি বেলছে। মামী সব সময় নিজেই লুচি বেলে। মুন্নির হাতে দেয় না। লুচি সুখী বস্তু। তরিবৎ করে না বেললে লুচি ফোলে না। ঠিকমত না ফুললে, লুচির থেকে তেল গড়ালে মামা খেতে পারে না।

    “দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিস কী? কড়াইতে তেল বসা।”

    মুন্নি তাড়াতাড়ি তেল বসায়। তেল গরম হলে লুচি ছাড়ে। টুবু টুবু ফুললে সানচা দিয়ে ছেঁকে তোলে। আজ ছোড়দি আর জামাইবাবুও আসবে। সকালের জলখাবার খেয়ে ছোটকুকে নিয়ে যাবে। ছোড়দি আর জামাইবাবু দুজনেই ডাক্তার। সারাদিন হাসপাতালে কাজকর্মে ব্যস্ত থাকে। ছেলে মানুষ করার সময় নেই। মামা মামী নাতি সামলায়। পুরো সপ্তাহ ছোটকু দাদু দিদার কাছে থেকে স্কুল করে। শুক্কুরবার স্কুল থেকে ফিরে বাবা মার কাছে চলে যায়। এ বাড়িতে ছোটকু ভালই থাকে। বেলাবেলি স্কুল থেকে ফিরে টি-ভিতে কার্টুন চ্যানেল দেখতে দেখতে ভাত খায়। বিকেলে পার্কে খেলতে যায়। সন্ধ্যেবেলা প্রাইভেট টিউটরের কাছে ঢুলতে ঢুলতে হোম ওয়ার্ক করে। রাত্তিরে মামা মামীর মাঝখানে শুয়ে ঘুমোয়।

    মুন্নির সঙ্গে ছোটকুর খুব ভাব। মুন্নি ছোটকুকে পার্কে নিয়ে যায়, দোলনা চাপায়। কোনো কোনো দিন ছোটকু মুন্নির সঙ্গে শোবে বলে বায়না করে। তিন্নি বকা দেয়, “যা, পালা। বড়লোকের ব্যাটা ভাঁড়ার ঘরে শুতে হবে না।” তিন্নি রাত জেগে পড়াশুনো করে। ছোটকু থাকলে অনর্গল বক বক করে। ওর অসুবিধে হয়।

    ভাঁড়ার ঘরটা একতলায় বলে গুমোট গরম। মাথার ওপরে সিলিং ফ্যানটা ঘটাং ঘটাং করে ঘোরে। হাওয়ার থেকে আওয়াজ হয় বেশি। তিন্নি জানলা খুলে রাখতে দেয় না। রাত বিরেতে কেউ যদি বারান্দা পেরিয়ে মুখ বাড়ায়। মুন্নির শরীর ঘামে ভিজে জবজব করে। ঘুম হয় না ভাল। মাঝরাতে উঠে দেখে তিন্নি সাদা কাগজে খস খস করে কী লিখছে।

    “কাকে চিঠি লিখছিস রে তিন্নি?”

    তিন্নি ফস করে কাগজটা একটা মোটা বইয়ের নীচে সরিয়ে রাখে, “তুই ঘুমোস নি?”

    “গরমে ঘুম আসছে না। বললি না তো কাকে লিখছিস।”

    “তোর জানার দরকার নেই। তুই ঘুমো।”

    মুন্নি বিছানায় এপাশ ওপাশ করে। ঘুম আসে না। মাঝরাতে ঘুম চটকে মুন্নির বাথরুম পেয়ে যায়। ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি। পার হয়ে অন্ধকার প্যাসেজ। তার অন্য দিকে বাথরুম। প্যাসেজের ওপরে টাঙ্গানো বড় দেওয়াল ঘড়িটা টক টক করে চলে। একটা ইঁদুর রাস্তা কেটে সিঁড়ির নীচে সিঁধিয়ে যায়। তবু মুন্নির ভয় করে। মনে হয় প্যাসেজটা একটা সুড়ঙ্গ। ঢুকে গেলে আর ফিরে আসতে পারবে না। সুড়ঙ্গটা ওকে গিলে ফেলবে। মুন্নি কাতর স্বরে অনুনয় করে, “তিন্নি যাবি একটু আমার সঙ্গে?”

    “দামড়ি মেয়ে, এখনও ভূতের ভয় পাস?”

    তিন্নির ভয় ডর নেই। ঘরের দরজা খুলে বেরিয়ে গটগট করে হেঁটে গিয়ে প্যাসেজের আলো জ্বালিয়ে দেয়। মুন্নি বাথরুমে ঢুকে দরজা ভেজিয়ে রাখে। ছিটকিনি লাগায় না। ভেতর থেকে ডেকে বলে, “তিন্নি, কোথাও যাবি না। দাঁড়িয়ে থাক।”

    ফিরে এসে মুন্নি বলে “তিন্নি আলোটা নিভিয়ে দিবি? প্লিজ। কাল ভোরে উঠতে হবে।”

    “চোখ বন্ধ করে, উলটো দিকে মুখ করে শো।”

    “তুই শুবি না?”

    “আমার সময় লাগবে। তুই ঘুমো।”

    সকালে ঘুম থেকে ওঠার সময় মুন্নি দেখে তিন্নি তাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছে। গায়ের থেকে তিন্নির হাত আলতো করে সরিয়ে দিয়ে মুন্নি উঠে পড়ে। তিন্নির শোয়া ভালো নয়। নাইটি হাঁটুর ওপর উঠে যায়। রোজ সেটা টেনে পায়ের কাছে নামিয়ে দিয়ে মুন্নি বিছানা ছাড়ে।

    “তেল ঝরিয়ে লুচি তোল, মুন্নি।”

    মুন্নি একহাতে কড়াইয়ের কানায় লুচি আটকে, অন্যহাতে কপালের থেকে উড়ো চুল সরায়। ঠিক তখনই ওর খোলা পিঠে মামীর নজর পড়ে। মামী ধমক লাগায়, “ধিঙ্গি মেয়ে হয়েছিস। হুঁস নেই কোনও? সকাল থেকে পিঠ-ছেঁড়া ফ্রক পরে ঘুরছিস। এক্ষুণি দিদি জামাইবাবু এসে পড়বে। কী ভাববে? যা গিয়ে চান সেরে জামা বদলে নে।”

    সত্যি এই জামাটা পরে থাকলে জামাইবাবু কী মনে করবে? ছোড়দিটা উলোঝুলো হয়ে থাকে। ওড়না আঁচলের ঠিক থাকে না। কিন্তু জামাইবাবু সর্বদাই টিপটপ। যখন এ বাড়িতে রাত্তিরে থাকে, সকালবেলা উঠে নিয়ম করে দাড়ি কামায়। গালে চাপড় মেরে মেরে আফটর সেভ লাগায়। তখন জামাইবাবুর গা থেকে কী সুন্দর গন্ধ বেরোয়। ফর্সা গালটা চকচক করে। মুন্নির ইচ্ছে করে একবার হাত দিতে। হাত দিয়ে দেখতে কোথাও কোনো অসমতল রয়ে গেল কিনা।

    “সব ফ্রকগুলোর হুক ছিঁড়ে গেছে, মামীমা।”

    “সেলাই করে রাখিস নি কেন?”

    “হুকগুলো যে কোথায় পড়ে গেছে খুঁজে পাচ্ছি না।”

    মামী লুচিবেলা শেষ করে সিঙ্কের ওপর হাত ধুচ্ছিল। বলল, “ওপরে গিয়ে দেখ। আলনার পিছন দিকে আমার একটা নীল হলুদ বাটিক ছাপ নাইটি আছে। ওইটা পর এখন। বিকেলে গিয়ে সুবোধের দোকান থেকে এক বাক্স হুক কিনে আনবি। আমারও দুটো ব্লাউসে হুক বসাতে হবে।”

    মুন্নি নাইটি আনতে গিয়ে দেখে মামা ঘোলাটে চোখে খোলা জানলার দিকে তাকিয়ে খাটে বসে আছে। গালে খোঁচা খোঁচা দুদিনের না কামানো কাঁচা পাকা দাড়ি। কেন যে রোজ দাড়ি কামায় না কে জানে? মুন্নির বিরক্ত লাগে। আজ ছোড়দিরা আসবে। আজ হয় তো কামাবে। জামাইয়ের সামনে ফিটফাট হয়ে থাকবে। মামার দুই মেয়ে। ছেলে নেই। বড়দির বিয়ে হয়েছে জামসেদপুরে। তার ভরা-ভর্তি সংসার। সে আসে ক্বচিৎ কদাচিৎ। ছোটকুর কথা বাদ দিলে ছোড়দিরা আপনি আর কোপনি। জামাইবাবুর তিন কুলে কোন আত্মীয় স্বজন নেই। টাউন হাসপাতালের কোয়ার্টারে থাকে ছোড়দিরা। রান্না-বান্না ন’মাসে ছ’মাসে পাকে পড়লে। বেশির ভাগ দিনই হাসপাতালের ক্যান্টিনে খেয়ে নেয় দুজনে। না হলে এ বাড়িতে চলে আসে। জামাইবাবুর মাঝে মধ্যে নাইট ডিউটি পড়ে। ছোড়দি এসে রাত্তিরে থাকে। জামাইবাবু ভোরবেলা হাসপাতালের ডিউটি সেরে ফেরে। কোনোমতে চা জলখাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। দুপুর বেলা উঠে চান করে ভাত খায়। তখন জামাইবাবুর গালে নীল রঙের হাল্কা দাড়ি ওঠে। সন্ধ্যেবেলার আকাশের মত। ছোড়দি তখন জামাইবাবুর পাশ ঘেঁসে না। জামাইবাবু রগড় করে গালে গাল ঘষে দিলে ছোড়দির গাল ছিলে যায়।

    মুন্নি আলনা থেকে আলগোছে নাইটিটা তুলে নেমে আসে। মামা টেরও পায় না। চান করে মামীর হাওদার মত নাইটিটা গায়ে দেয় মুন্নি। মামীর পাছা কোমর ভারি। আগে ছিলনা। এখন হয়েছে। অ্যালবামে মামীর পুরোন ছবি দেখেছে মুন্নি। রোগা ভোগা মুরগীর ছানার মত চেহারা ছিল। এখন বেছে বুছে খোলামেলা নাইটি কেনে মামী। মুন্নির পরে অস্বস্তি হয়। মনে হয় গায়ে কিছু পরে নেই। চুলে গামছা জড়িয়ে বেরিয়ে দেখে মামা খাবার টেবিলে জলখাবার খেতে বসেছে। মুন্নিকে দেখে মামা অবাক হয়ে তাকায়। মামীর নাইটি পরেছে বলেই বোধ হয়। তারপর মুখ নামিয়ে আঙ্গুল দিয়ে একটা ফুলকো লুচির গরম বাতাস বার করে। লুচির ওপরের আস্তরণটা চুরচুর হয়ে যায়। মামা লুচি ছিঁড়ে চচ্চড়ির আলু জড়িয়ে মুখে তোলে। মুখে শব্দ করে চিবোতে চিবোতে মামীকে জিজ্ঞেস করে, “মেয়েজামাই কখন আসবে?”

    মামী বলে “এসে পড়বে এইবার। দেখা করে দোকানে বেরিও।”

    স্টেশন রোডের ওপর কালীতলার মোড়ে মামার দোকান – অন্নপূর্না ভাণ্ডার। দোকানের নাম মামার মায়ের নামে। মামার নাম যতীন্দ্রনাথ বসাক। মামীর নাম শেফালী। দোকানে পাঁউরুটি থেকে আলপিন সব পাওয়া যায়। অনাথদার কাছে চাবি থাকে। সে কোলাপসিবলের তালা খুলে দোকান চালু করবে। মামা একটু দেরিতে গেলেও ক্ষতি নেই।

    না খুব পুরোন কথা মনে করতে পারে না। খেই হারিয়ে যায়। কেবল মনে করতে পারে সে শৈশব থেকেই হাঁটছে। পাহাড়, জঙ্গল পেরিয়ে দলের সবার সঙ্গে সার বেঁধে, পায়ে পা মিলিয়ে। মাঝখানে দলের বাচ্ছারা আর বয়স্করা। সামনে যূথপতির সঙ্গে যুবকেরা। পিছনে সমর্থ মেয়েরা। হাঁটতে হাঁটতে তারা মাথা সমান উঁচু ঘাসের মাঠ, বনাঞ্চল পেরিয়ে যায়। পা ডুবিয়ে পাহাড়ি নদী পারাপার করে। কুমীর কামঠ বাঁচিয়ে ভরা নদী সাঁতার দিয়ে পেরিয়ে যায়। বন্য হাতির দল এড়িয়ে চলে। বাকি হিংস্র পশুরা মানুষের দঙ্গল দেখলে কাছে আসে না।

    দিনের আলো থাকতে থাকতে ছেলেরা পাথর ছুঁড়ে শূয়র, শশক, বনমোরগ শিকার করে। মেয়েরা ফল মূল সংগ্রহ করে। রাত্রে বিশ্রামের জন্য কোন জলাশয়ের ধারে দলটি থামে। শুকনো কাঠ কূটো জড়ো করে আগুন জ্বালায়। গোল হয়ে সকলে আগুন ঘিরে বসে। মেয়েরা সেই আগুনে মাংস ঝলসায়। তারপর সকলে হাত দিয়ে মাংস খুবলে খায়। প্রথম গ্রাসের অধিকার যূথপতির। দলের মেয়েদের ওপরও প্রথম অধিকার যূথপতির।

    যূথপতির বিশাল দেহ। চওড়া কাঁধ, পেশীবদ্ধ রোমশ শরীর। উঁচু কপাল আর ঠেলে ওঠা হনুর হাড়ের কোটরে তীক্ষ্ণ চোখ। যূথপতির নির্দেশ মত দলটি পথ চলে। যূথপতি আদেশ দিলে দলটি কোন যায়গায় কিছুদিনের জন্য অস্থায়ী বসতি পাতে। পাহাড়ের গুহা-কন্দরে, জল জঙ্গলের কাছাকাছি। বিশেষ করে যখন আকাশে মেঘ জমে বা হাড়-কাঁপানো শীতের হাওয়া দেয়। দলের কোন সদস্য গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে বা কোন মেয়ের প্রসব আসন্ন হলেও তারা থেমে পড়ে। কিছুদিন এক যায়গায় থেমে থাকে। তারপর আবার পথ চলা শুরু।

    ইনার আবছা মনে পড়ে তুষারপাতের কথা। যেন গতজন্মের স্মৃতি। যেখানে তারা থাকত শীতের সময় সে অঞ্চলে দিনের আলো ফুটতে না ফুটতে মিলিয়ে যেত। রাত ফুরোতে চাইত না। সাদা বরফের আস্তরণে ঢেকে থাকত পৃথিবী। ইনার চোখের ভিতর ছবি জমা হয়ে আছে – হিমশীতল গুহার মধ্যে আগুন জ্বালিয়ে তারা হাত সেঁকছে। বাইসনের চামড়ার পোষাকে ভাল করে গা ঢেকে নিচ্ছে। বরফ গলে যখন রোদ উঠত, তখন তারা জঙ্গল থেকে কাঠ কুড়িয়ে আনত। সারা বছরের জন্য শুকনো কাঠ জমিয়ে রাখত। প্রখর রৌদ্রে মাংস শুকিয়ে রেখে দিত। তাই দিয়ে শীতের দিন গুজরান হত। সে বড় কষ্টের দিন ছিল।

    যূথপতি তখন যুবক। তুষারপাতের দিনগুলিতে যখন তারা গুহার থেকে বের হতে পারত না, তখন তিনি গুহার গায়ে ছবি আঁকতেন। ভেষজ রঙে সেগুলি রাঙাতেন। পশু শিকারের ছবি। মানুষ মানুষীর ছবি। একবার আঁকলেন সারিবদ্ধ মানুষের ছবি। সামনে এক শালপ্রাংশু পুরুষ তাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তর্জনী তুলে পথনির্দেশ দিচ্ছে। সেবার শীত শেষ হলে তিনি যাত্রার সিদ্ধান্ত নিলেন। তাঁর ওপর ভরসা করে, তাঁর নেতৃত্ব মেনে নিয়ে সঙ্গে এল আরও কিছু যুবক যুবতী। ইনার মা তাদের মধ্যে একজন। শুরু হল তাদের পথ চলা। পথশ্রম অগ্রাহ্য করে, হিংস্র পশুর আক্রমণ প্রতিহত করে তারা এগিয়ে চলেছে। যত এগোচ্ছে তত আবহাওয়া সহনীয় হচ্ছে। দিন রাত্রির অবসর সমান সমান হচ্ছে। যেন দৈব নির্দেশে যূথপতি তাদের নিয়ে কাঙ্খিত বাসভূমির দিকে অগ্রসর হচ্ছেন। চলার পথে ইনা শিশু থেকে কিশোরী হল, ঋতুমতী বালিকা হল। হাঁটা আর ফুরোয় না।

    একটি নদীর তীর বরাবর তারা হাঁটছিল। ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে। ধীরে ধীরে উঁচু গাছপালা কমে এল। ছোট খাটো ঝোপ ঝাড় ভেঙ্গে তারা বনভূমির কিনারে শস্পাস্তীর্ণ খোলা ময়দানে বেরিয়ে এল। নদীটা যেন হঠাৎ শেষ হয়ে গেছে। দৃষ্টি আড়াল করে খাড়াই উঠে গেছে একটি পাহাড়ের শ্রেণি। ভাল করে নজর করলে বোঝা যায় নদীটি পাহাড়ের একটি চূড়াকে দ্বিধা বিভক্ত করে অন্য দিকে এক অতুল জলরাশিতে গিয়ে মিশেছে। যতদূর চোখ যায় সেই জলরাশির পার দেখা যায় না। এত বিশাল জলরাশি দলটির কেউ আগে দেখেনি। এমন কী যূথপতিও না।

    যূথপতিকে বিভ্রান্ত দেখাল। চোখের ওপর হাত রেখে কয়েক মুহূর্ত তিনি চারিপাশ গভীর ভাবে পর্য্যবেক্ষণ করলেন। পাহাড় চূড়াটি নদীর জলে ঝুঁকে পড়ে যেন নিজের মুখ দেখছে। তাঁর নাসারন্ধ্র স্ফীত হল। যেন হাওয়ায় ভেসে আসা বনজ পুষ্পের গন্ধ নিচ্ছেন। তারপর তিনি চূড়াটির দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করলেন। চূড়াটির জানু দেশে বিন্দু-প্রমাণ গিরি কন্দরগুলি তাঁর নজর এড়ায় নি। দলটি যূথপতির নির্দেশ অনুযায়ী এগোল। তিনি কখনও তাদের ভুল পথে চালনা করেন নি।

    সন্ধ্যার আগেই দলটি গিরি-কন্দরগুলির সামনে পৌঁছে গেল। গুহাগুলি খুব উঁচুতে নয়। একটি বড়-সড় গুহা বেছে ছেলেরা এগিয়ে গেল। গুহার সামনে তারা চকমকি পাথর ঠুকে আগুন জ্বালাবে। সোরগোল চিৎকার করবে। শুকনো গাছের ডালে আগুন ধরিয়ে গুহার মধ্যে ছুঁড়ে দেবে। কোন বন্য জন্তু যদি গুহার মধ্যে বাসা বেঁধে থাকে তবে ধোঁয়া-আগুন-হই-হল্লায় পালাবে। ভাগ্য ভাল থাকলে রাতের খাবার যোগাড়ও হয়ে যেতে পারে। মেয়েরা আর ছোটরা দূরে দাঁড়িয়ে দেখছে। প্রয়োজনে তারাও এগিয়ে যাবে। ইনার পাশে দাঁড়িয়ে আছে ওজস। ইনার সঙ্গে খুব ভাব। ইনার থেকে বয়সে সামান্য ছোটই হবে। কিন্তু বর্ষার জল পাওয়া চারা গাছের মত ইনার মাথা ছাড়িয়ে চাড়া দিয়েছে। খরস্রোতা নদী হেঁটে পার হবার সময় ওজস ইনার হাত ধরে রাখে। ওজসের কব্জিতে খুব জোর। কাছিমের কামড়ের মত। ধোঁয়ার তাড়নায় এক ঝাঁক বাদুড় গুহার থেকে উড়ে বাইরে বেরিয়ে এল। তারা রাত্রির প্রাণী। দিনের আলোয় হতচকিত হয়ে তারা পাহাড়ের গায়ে মাথা ঠুকে মরতে লাগল। গুহাটিতে অন্য কোন বন্য জন্তু নেই। অন্ধকার নামার আগেই দলটি নিশ্চিন্তে গুহাতে সাময়িক আস্তানা পেতে ফেলল।

    গুহার বাইরে অমা রাতের নিকষ অন্ধকার। গুহামুখে সারারাত আগুন জ্বলে যাতে বন্য জন্তুরা সাহস করে পা বাড়াতে না পারে। দিনের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে ছেলেরা পাথর শান দিতে বসে যায়। মেয়েরা যায় জলের সন্ধানে। তাদের কোমরেও পাথরের অস্ত্র গোঁজা থাকে। বাসন ভরে নদী থেকে জল নিয়ে আসে। ইনা ফিরে এসে ওজসকে খোঁজে। ওজস সবার সাথে নেই। মাকে জিজ্ঞেস করে ওজসকে দেখেছে কিনা। মা বলে, “দেখ, চঞ্চল ছেলে, কাছেই কোথাও থাকবে।” ইনা হরিণের পায়ে চলে যায়। ইনার মা উদবিগ্ন হয়ে মেয়ের চলে যাওয়া দেখে।

    দল ছেড়ে খুব দূরে যাবার অনুমতি নেই কারো। একলা কেউ বিপদে পড়লে কোমরে বেঁধে রাখা শিঙা খুলে আকাশের দিকে মুখ করে ফুঁ দেবে। মুহূর্তে সবাই জোট বেঁধে হাজির হবে। ইনা খুঁজতে খুঁজতে নদীর ধারে এসে দেখে ওজস পাথরের ওপর চুপ করে বসে আছে। ইনা কাছে এলে তাকে হাত ধরে পাশে বসায়। যেন জানতই ইনা তাকে খুঁজতে আসবে। একটু আগে শামুকের খোলা ভেঙ্গে কয়েকটা মুক্তোর দানা বের করে রেখেছিল। সেগুলি ইনার হাতে দেয়। ওজস জানে কোন শামুকে মুক্তো হয়। ইনা হাততালি দিয়ে হেসে ওঠে। ইনা মুক্তোর দানা জমাচ্ছে। আর দু চারটে হলেই মালা গেঁথে পরবে।

    “ইনা, তোর জন্যই বসে আছি। এই দেখ...”

    ইনা দেখে ওজস একটা অদ্ভুত অস্ত্র তৈরি করেছে। দীর্ঘ সরল একটি গাছের ডালের আগায় এক টুকরো তীক্ষ্ণ পাথর বনজ লতা দিয়ে শক্ত করে বেঁধেছে।

    ইনা জিজ্ঞেস করে “এ দিয়ে কী হবে?”

    ওজস ব্যাখ্যা করে, “দেখ, আমরা শিকার করি দল বেঁধে, পাথর ছুঁড়ে। পশুটা যদি কাছাকাছি এসে পড়ে আমরা মুশকিলে পড়ে যাই। থাবার ঘায়ে, নখের আঁচড়ে আহত হই। এই অস্ত্র দিয়ে আমরা তাকে আমাদের শরীরের থেকে দূরে ঠেলে রাখতে পারব।”

    ধীরে ধীরে ব্যাপারটা ইনার মাথায় ঢোকে। সাংঘাতিক একটা আবিষ্কারে সামিল হবার উত্তেজনায় ইনা ওজসের হাত চেপে ধরে। ওজস সবার থেকে আলাদা চিন্তা করে। ওজস আবার বলে, “পাথরের পিছনে লম্বা শক্ত কিছু বেঁধে দিলে দূর থেকে নিশানা লাগানোও অনেক সহজ হয়। দেখবি?”

    ওজস উঠে দাঁড়িয়ে অস্ত্রটা তুলে নিয়ে সবল হাতে একটা ঝোপের মধ্যে ছুঁড়ে দেয়। একটি শশকের রক্তাক্ত দেহ কয়েক মুহূর্ত ছটফট করে স্তব্ধ হয়ে যায়। ওজস লতায় বেঁধে অস্ত্রের আগায় মৃত শশকের দেহ ঝুলিয়ে উঠে দাঁড়ায়। বলে, “চল ইনা আমরা পাহাড়ের উপরটা দেখে আসি।”

    গুহাগুলিকে পাশ কাটিয়ে ওরা পাহাড়ের চূড়ার দিকে যাবার পথ খোঁজে। দুটি সুঠাম শরীর হাত পায়ে ভর দিয়ে পাথর ডিঙোয়। অনায়াস দক্ষতায় পাহাড়ে চড়ে। পাহাড়ের মাথাটি সমতল। কোমল তৃণে আস্তীর্ণ। দুজনে কিনারায় এসে দাঁড়ায়। ঝুঁকে পড়ে দেখে নীচে তাদের পরিচিত নদীটির জল থৈ থৈ করছে। তারা পাহাড়ের কিনার পরিক্রমা করে। যে দিক থেকে তারা চূড়ায় উঠেছে তার উলটো দিকে বালি, পাথর পার হয়ে আদিগন্ত জল। আকাশ ঝুঁকে পড়েছে জলের ওপর। ঝড়ের মত হাওয়া দিচ্ছে। ভারি হাওয়া, জিভে নুনের স্বাদ লাগে। ইনার চুলে গুঁড়ো গুঁড়ো জলকণা জমে। ওজস স্বপ্নাতুর চোখে জলের দিকে তাকিয়ে বলে, “দেখিস আমি একদিন ওই জল পার হব।”

    ইনা অবাক হয়, “জল পার হবি, কীভাবে?”

    ওজস হাসে, “নদীতে গাছের গুঁড়ি ভেসে যেতে দেখেছিস? অনেকগুলো গুঁড়ি একসাথে লতা দিয়ে বাঁধব। তারপর, তার ওপর চড়ে জল পাড়ি দেব। সঙ্গে নেব শুকনো মাংস। ফল মূল। দেখব পৃথিবীর শেষ কোথায়।”

    “কী দিয়ে বাঁধবি? জলে থেকে থেকে লতা পচে যাবে। বাঁধন খুলে যাবে।”

    “হুম। সেটাই সমস্যা। একটা শক্ত-পোক্ত লতা খুঁজে বার করতে হবে। অথবা...।”

    ইনা জানে ওজস একটা উপায় খুঁজে বার করবে। দুজনে আপাতত জলের দিকে তাকিয়ে হাতে হাত রেখে বসে। ইনা বলে, “যাবি যখন আমাকেও সঙ্গে নিস।”

    ওজস হাসে। ইনা গুন গুন করে গান ধরে। ধীরে ধীরে গলা তোলে। সে গানে কথার থেকে সুর বেশি। মিলের থেকে অমিল। ওজস পায়ে তাল দেয়। দুজনে জল জঙ্গল পাহাড়ের মধ্যে মশগুল হয়ে বসে থাকে।

    সূর্য মাথার ওপর উঠলে ইনা বলে, “চল এবার। এখন না ফিরলে সবাই খুঁজতে আসবে।” ফেরার সময় ওজস বলে, “অস্ত্রটার কথা এখন কাউকে বলিস না। ওটাকে আর একটু ভাল করে বানাতে হবে। ভাবছি গাছের ডালটার মাথায় একটা খাঁজ কাটব। তা’হলে পাথরের টুকরোটা খুলে পড়ে যাবার ভয় থাকবে না। ডালটা ভিতর থেকে কুরে দেব। তাহলে অস্ত্রটা হালকা হবে। ছুঁড়তে সুবিধে হবে।”

    ইনা মাথা নাড়ে।

    গুহার কাছাকাছি এসে ওজস অন্যমনস্ক ভাবে বলে, “ইনা, যূথপতি ডাকলে কাছে যাবি না। দূরে দূরে থাকবি।”

    যূথপতির নেতৃত্ব প্রশ্নাতীত। তাঁর অঙ্কশায়িনী হতে পারলে দলের মেয়েরা সম্মানিত বোধ করে। তাঁর সন্তান গর্ভে ধারণ করে গর্বিত হয়। যূথপতির সঙ্গে মিলিত হবার জন্য ইনা অপেক্ষা করে আছে। রজঃস্বলা হবার পর থেকেই।

    ইনা অবাক হয়, হতচকিত হয়ে প্রশ্ন করে, “কেন?”

    ওজস জবাব দেয় না।

    দলের কোন মেয়ে সন্তানধারণের উপযুক্ত হলে প্রথম সঙ্গমের অধিকার যূথপতির। দলের প্রতিটি সদস্যর শরীরে যূথপতির বীজ বাহিত হবে। এই নিয়ম যুগ যুগান্ত ধরে চলে আসছে। এই নিয়ম লঙ্ঘনের শাস্তি মৃত্যু। ওজসও সে কথা জানে। ইনার হঠাৎ ওজসের জন্য ভয় হয়।

    ভনিং কলেজ শেষ হতে হতে বেশ রাত হয়ে যায়। তিন্নি একটাও রিক্সা পাচ্ছে না। এ সময় অধিকাংশ রিক্সা-চালক তিন-চাকা গ্যারেজ করে মদের ঠেকে গিয়ে বসে। কলেজ থেকে বাড়ি, হাঁটা পথে বড় জোর কুড়ি পঁচিশ মিনিট। এমন কিছু নয়। আসলে পায়ে চলার পথটা একটা জুট মিলের উঁচু দেওয়ালের গা ঘেঁসে, বেশ কিছুটা। এই সময় মিলের শিফট ভাঙ্গে। পাঁচমেশালি মানুষের ভিড় ঠেলে আধো অন্ধকার যায়গাটা দিয়ে হেঁটে যেতে তিন্নির অস্বস্তি হয়। তাই ফেরার সময় রিক্সা খোঁজে। একটা রিক্সা চলন্ত অবস্থাতেই জিজ্ঞেস করল, “কোথায় যাবেন?” পাল পাড়া শুনে থামালো না। মদের ঠেক বসে স্টেশনে। পাল পাড়া সে রাস্তায় পড়বে না। কলেজটা মোটামুটি ফাঁকা হয়ে গেছে। যে যার মত বাড়ির দিকে রওনা দিয়েছে। রাত নামতে না নামতেই যায়গাটা শুনশান হয়ে যায়। একলা দাঁড়িয়ে থাকতে তিন্নির বিরক্ত লাগছিল। রোজকার সমস্যা।

    দুটো ছেলে সাইকেল নিয়ে কলেজের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আড্ডা দিচ্ছে। ওরাও একটু পরে চলে যাবে। ওদের মধ্যে একজনকে তিন্নি চেনে। ওদের বাড়ির কাছেই থাকে। সঙ্গে যাবার জন্য বললে হয়। তিন্নি আগে কোনোদিন কথা বলেনি। বাধো বাধো লাগে। লাইব্রেরির সন্তোষদা সাইকেল নিয়ে বেরোচ্ছিলেন। তিন্নিকে একা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, “কি রে, রিক্সা পাচ্ছিস না?” তারপর জবাবের অপেক্ষা না করে হাত তুলে ছেলেটিকে ডেকে বললেন, “বাপি, তিন্নিকে ওদের গলির মুখ পর্যন্ত ছেড়ে দিয়ে যাস।”

    “না, না সন্তোষদা আমি ঠিক চলে যাব।” বলে এবার তিন্নি বেণী দুলিয়ে হাঁটা দিল। বাপি বলে ছেলেটা সাইকেলের হ্যাণ্ডেলটা ধরে হাঁটিয়ে নিয়ে তিন্নির পাশে এল।

    “পাল পাড়ায় থাক তো তুমি?”

    সাইকেলের একদিকে তিন্নি, অন্যদিকে ছেলেটা। ছেলেটা রাস্তার দিকে। জুট মিল কাছে বলে এই রাস্তাটায় লরী চলে। কাঁচামাল বয়ে আনে, চট কাপড় নিয়ে ফিরে যায়। পিচ রাস্তার ধার দিয়ে সাইকেলটাকে গড়িয়ে গড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে ছেলেটা। তিন্নি বলল, “আমি একাই চলে যেতে পারতাম।”

    “না, না ঠিক আছে, আমিও তো ওই দিকেই যাব।”

    তিন্নি আড়চোখে দেখল ছেলেটাকে। দোহারা লম্বা চেহারা, মাজা মাজা রঙ, পেটানো স্বাস্থ্য। জিম টিম করে মনে হয়। সামনে দিকে তাকিয়ে হাঁটছে। হ্যাংলা, গায়ে পড়া ছেলেদের তিন্নি দু চক্ষে দেখতে পারে না। এই ছেলেটাকে দেখে তেমন মনে হচ্ছে না। টুক টাক কথা বলছে। ভাল নাম অমিত। সেকেণ্ড ইয়ার। বাবা রেলে চাকরি করতেন। কর্মরত অবস্থায় মৃত্যু হয়েছিল বলে বড় ছেলে হিসেবে অমিত চাকরিটা পেয়েছে। দিনের বেলা অফিস করে, রাতে পড়াশুনো।

    মোড় ঘুরে একটা খালি রিক্সা হাত তুলে দাঁড় করালো অমিত। রিক্সাওলা ছেলেটা মনে হয় অমিতকে চেনে। পাল পাড়া শুনেও রা কাড়লো না। তিন্নি রিক্সায় উঠে পড়ল। নভেম্বরের মাঝামাঝি। হাওয়ায় হালকা কুয়াশা ভাসছে। অল্প হিম পড়ছে। তিন্নি রিক্সার হুডটা মাথার ওপর তুলে দিতে গিয়ে দেখল অমিত সাইকেল নিয়ে রিক্সার পিছন পিছন আসছে। লাইটপোস্টের নিভন্ত আলোয় কুয়াশার মধ্যে দিয়ে তার আবছা অবয়ব দেখা যাচ্ছে।

    তিন্নি রিক্সাওলা ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করল, “দাদাকে চেনো নাকি?”

    “হ্যাঁ, খুব ভাল ভলি খেলে। রেলের হয়ে ন্যাশানালে খেলেছে।”

    মফস্বল শহরের রাস্তা তাড়াতাড়ি খালি হয়ে যায়। দু একটা পান-বিড়ি-সিগারেটের গুমটি ছাড়া দোকান পশারের ঝাঁপ পড়ে গেছে। রিক্সাওলা ছেলেটা জোরে টানছে। সওয়ারির ওজন কম। তার ওপর তার নিজেরও ফেরার তাড়া। রিক্সাটা প্রায় উড়ছে। ইদানীং খোলা মাঠ ময়দান কমে আসছে। পুকুর বুজিয়ে উঁচু ফ্ল্যাট বাড়ি তৈরি হচ্ছে। তাও পথ চলতি মাটির গন্ধ নাকে আসে। তিন্নির চোখে মুখে ঠাণ্ডা হাওয়ার ঝাপটা লাগছে। ভারি আরাম হচ্ছে। জ্বরপোড়া কপালে মা ভিজে হাত রাখলে যেমন গা জুড়োত। অমিত কি এখনও আসছে রিক্সার পিছনে পিছনে?

    কলেজ থেকে ফেরার সমস্যাটা সমাধান হল। অমিত কলেজের শেষে তিন্নির জন্য অপেক্ষা করে। রিক্সা পেলে ভাল। না হলে দুজনে হাঁটা দেয়। মাঝরাস্তায় রিক্সা পেয়ে গেলে তিন্নি উঠে পড়ে। অমিত গলির মুখ পর্যন্ত সঙ্গে আসে। তারপর সাইকেল ঘুরিয়ে নিজের বাড়ির দিকে রওয়ানা দেয়। ছুটির দিনও মাঝে মধ্যে দেখা হয়ে যায়। অমিতরা ওদের ক্লাবের সামনে ক্যারাম খেলে। ক্লাব মানে একটা একানে চালা ঘর। নামটা গালভারি – স্যার দেবীপ্রসাদ কর্মকার ব্যায়াম সমিতি। স্যার দেবীপ্রসাদ কোন মান্ধাতার আমলে পাড়ার ছেলেদের এক্সারসাইজের উপকরণ কেনার জন্য কিছু অর্থমূল্য দান করেছিলেন। তার থেকেই ক্লাবের স্থাপনা এবং নামকরণ। পরে স্যার দেবীপ্রসাদের বংশধরদের ভিটেয় ঘু ঘু চরলেও ক্লাবের নাম বদলানোর কথা কেউ ভাবে নি। তিন্নি সারদা মিষ্টান্ন ভাণ্ডার থেকে মিষ্টি কিনতে গিয়ে দেখতে পায় অমিত পাজামার ওপর হাফ হাতা রঙ্গিন পাঞ্জাবি পরে ক্যারাম পেটাচ্ছে। অমিত হাত তোলে। তিন্নি মৃদু হাসে। অনেক সময় অমিত এগিয়ে এসে একটা দুটো সাধারণ কথা বলে। আজ যেমন এল।

    “কাল ফেরার সময় দেখলাম না। কলেজে আসো নি, নাকি?”

    “প্রোফেসর বক্সী আসেন নি বলে কাল ক্লাস তাড়াতাড়ি ছুটি হয়ে গিয়েছিল।”

    সন্ধের সময় রিক্সা পেতে অসুবিধে হয় না। তিন্নি চলে এসেছিল। অমিত ওকে খুঁজে পায় নি। তিন্নির একটু অপরাধবোধ এল। বেচারা বোধহয় অপেক্ষা করছিল। তিন্নির খেয়াল হল অমিতর কাছে মোবাইল ফোন থাকে। বলল, “এক কাজ কর। তোমার মোবাইল ফোনের নম্বরটা দিয়ে রাখ। এবার থেকে আগে চলে গেলে, বাড়ি ফিরে তোমায় একটা ফোন করে দেব।”

    অমিত স্পষ্টত খুশি হল। ফোন নম্বর দিয়ে বলল, “অন্য সময়ও করতে পার, ইচ্ছে হলে।”

    তিন্নির ইচ্ছে যে হয় না, এমন নয়। কিন্তু ল্যাণ্ডফোনটা একতলার খাবার ঘরে রাখা থাকে। মামীমা সারাদিন নীচেই থাকে। জিজ্ঞেস করবে – কাকে ফোন করছিস? জানে তো আগে পিছে কেউ নেই। মুন্নিটা ভিতুরাম। মুখে সোজাসুজি কিছু বলবে না। ঠারে ঠোরে জিজ্ঞেস করবে।

    মুন্নি তিন্নিকে ভয় পায়। মুন্নির অবশ্য সব কিছুতেই ভয়। ভূতে ভয়, ভগবানে ভয়। মামা কী বলবে, ভয়। মামী বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেবে, ভয়। তাড়িয়ে দিলে কোথায় যাব? কী খাব? ছোটর থেকেই কেমন যেন ভয়ে সিঁটিয়ে থাকে। মাধ্যমিকের পর পড়াশুনোটাও দুম করে ছেড়ে দিল। আর নাকি তার পরীক্ষা দেওয়া পোষাবে না। এখন বাড়িতে বসে সারাদিন মামীর ফাই ফরমাস খাটে। তিন্নি পাশ করে যে কোন একটা চাকরী পেলেই মুন্নিকে নিয়ে মামাবাড়ি ছেড়ে চলে যাবে। আলাদা বাসা নেবে। দুই বোনে এক সঙ্গে থাকবে। কারো মন যুগিয়ে চলতে হবে না।

    ঘরের কাজে তিন্নিও হাত লাগায় না এমন নয়। মামা একতলায় নেমে এলে তিন্নি বিছানাটা গুছিয়ে রেখে আসে। মশারী ভাঁজ করে রাখে। নীচের চাদরটা টান টান করে পেতে শলার ঝাঁটা দিয়ে ঝাড়ে। বালিশগুলো সাজিয়ে রেখে বেডকভার দিয়ে ঢেকে দেয়। বিছানার পাশের টেবিল থেকে মামার আধ খাওয়া চায়ের কাপটা নামিয়ে আনে। পাশে পড়ে থাকা সেফটিপিনটা তুলে হাতের চুড়িতে গেঁথে রাখে। এই একগাছা চুড়ি মায়ের স্মৃতি। একটা তিন্নির হাতে, অন্যটা মুন্নির। দরকারের সময় সেফটিপিন খুঁজে পাওয়া যায় না। মুন্নির সবগুলো জামার হুক ছিঁড়ে গেছে। কাজে দেবে।

    বিছানা ঝেড়ে নীচে নেমে এসে দেখল মুন্নি পিঠ ছেঁড়া জামা পরেই রান্নাঘরে লুচি ভাজছে। তিন্নি কিছু বলল না। ঘরে চলে এল। বই মুখে দিয়ে বসল। মুন্নি এল একটু পরে। গুন গুন করে গান গাইছে। চান করতে যাবে। ঘরের মধ্যে একটা দড়ি টাঙ্গিয়ে রোজকার পরার জামাকাপড় গামছা রাখা থাকে। মুন্নি গামছা নিতে এসেছিল। তিন্নি জিজ্ঞেস করল, “জামার সেফটিপিনটা কোথায় ফেললি?”

    মুন্নি চমকে তাকাল, “কোথায় খুলে পড়ে গেছে, দেখিনি।”

    “তোর জামা থেকে হুক খুলে পড়ে যায়, সেফটিপিন খুলে পড়ে যায়, টের পাস না?”

    “নাহ।”

    বলে মুন্নি গামছা নামিয়ে দরজার দিকে এগোল। তিন্নির দিকে ফিরে তাকাল না। মামার জলখাবার খাওয়া হলে মামী খেতে বসে। মুন্নি তিন্নিও বসে। আজ মামী দেরি করছে। ছোড়দিরা আসলে বসবে। ওরা এলে বাড়িটা বেশ হাসি খুশি হয়ে ওঠে। জামাইবাবু আমুদে লোক। সব সময় কথা বলছে, গল্প করছে, হাসছে। ছোড়দিটা চুপচাপ। মুন্নি চান করে বেরোল। মাথায় গামছা জড়িয়ে।

    “মুন্নি, ঘরে গামছা মেলবি না, যা বারান্দায় মেলে দিয়ে আয়।”

    মুন্নি গামছা মেলতে গিয়ে দেখল ছোড়দিরা বাইরের গেট ঠেলে ঢুকছে। গেটের ধারে মামী মাধবীলতা লাগিয়েছিল। সেটা পাঁচিল ধরে উঠতে শুরু করেছে। কিছুদিনের মধ্যেই দোতলার বারান্দার গ্রীল ধরে ফেলবে।

    “ও মামীমা, ছোড়দিরা এসে গেছে।”

    ছোড়দি ঘরে ঢুকেই চেয়ারের ওপর কাঁধের ভারি ঝোলা ব্যাগটা ধপাস করে নামিয়ে রেখে বলল, “মুন্নি, আমি একটা পেপারব্যাক অর্ধেক পড়ে ফেলে গেছলাম। কোথায় রেখেছিস বার করে দে।”

    মামী মেয়েকে মৃদু ধমক দিলেন, “জয়ী, আগে খাওয়া দাওয়া করে নে। পরে বইয়ে মুখ গুঁজবি।”

    মুন্নি বলল, “আমি রাখিনি, তিন্নি রেখেছে।”

    ছোড়দি কঠিন চোখে মুন্নির দিকে তাকাল। মুন্নি ভয় পেল, “দাঁড়াও, দেখছি।”

    বইটা খুঁজে পেতে ছোড়দির হাতে এনে দিল। ছোড়দি জামাইবাবুর দিকে তাকিয়ে বলল, “বিদিশাকে বলেছি। একবার নিয়ে যাব ওর কাছে। মুন্নি, কাল সকাল সকাল রেডি হয়ে থাকবি।”

    জামাইবাবু গম্ভীর ভাবে ঘাড় নাড়ল। তারপরই হাসি হাসি মুখ করে মামীর কাছে অনুযোগ জানাল, “মা, সকাল থেকে আপনার মেয়ে শুধু জল খাইয়ে রেখেছে। এবার পেটে ভাল মন্দ কিছু না পড়লে আমারই ভাল মন্দ কিছু একটা হয়ে যাবে।”

    এক এক জন মানুষ থাকে যারা মুখ গম্ভীর করে রাখলেও চোখ থেকে হাসি যেতে চায় না। জামাইবাবুকে দেখে তিন্নির সে রকম লাগে।

    “বালাই ষাট।”

    মামী তাড়াতাড়ি খাবার যোগাড় করতে গেল। মুন্নিকে রান্নাঘরে ডেকে নিয়ে গেল। মামা খাওয়া শেষ করে টেবিলেই বসে ছিল। দু একটা কথা বলে উঠে পড়ল। জামাইকে বলল, “বিপ্র, তোমরা খেতে বস। আমি এবার দোকান যাই। বিকেলে একবার কলকাতা যেতে হবে।” মামা দোকানের মালের বায়না করতে কলকাতা যায়। চেনা জায়গা। পয়সা কড়ি দিয়ে আসে। তারা পরে মাল পৌঁছে দেয়।

    মামী লুচির আটা মেখে রেখে দিয়েছিল। এখন নেচি কেটে জামাইবাবুর জন্য গরম গরম লুচি ভেজে দিচ্ছে। মুন্নি থালায় সাজিয়ে লুচি এনে দিচ্ছে। জামাইবাবু আহা উহু করতে করতে জিভ পুড়িয়ে খাচ্ছে। টেবিলের উল্টো দিকে ছোড়দি বসে আছে। এক হাতে পেপারব্যাক, অন্য হাতে লুচি ছিঁড়ে মুখে ঢোকাচ্ছে। মামী বলছে, “শুনেছিস তো অবনীর ছেলের বিয়ে। তোর বাবাকে বলে দিয়েছি সাত দিন গিয়ে থাকব। তোরা তো বৌভাতে যাবি। ক’দিন এসে এখানে থাকতে পারবি?”

    “কেন, মুন্নি তো আছে। সামলাতে পারবে না? কি রে মুন্নি?”

    মুন্নি ঘাড় নাড়ল। কেন পারবে না? এক্ষুণি ছোটকু এসে পড়বে। তারপর তার মায়ের কাছে সারা সপ্তাহের গল্প বলা শুরু হবে।

    “জানো মা, শ্যামলী না এক গালে একটা বড় মথ খেতে পারে।”

    এ বাড়ির দেওয়ালের টিকটিকিগুলোর আলাদা আলাদা নাম আছে। শ্যামলী, রূপালী, তারাপদ... “তাই নাকি? তুমি একগালে কত খানি খেতে পার, সোনা?”

    ছোটকু এই সব অবান্তর কথায় মন দেয় না। সে বকে যায়। এবারের এন্যুয়াল ডে-র ফাংশনে সে হ্যাণ্ড রাইটিঙের জন্য প্রাইজ পাবে। মিলি টিচার দুমাস ধরে আসছিল না। তার বেবি হয়েছে।

    “মা হিন্দীতে বেবি মানে মেয়ে আর বাবা মানে ছেলে, তাই না?”

    তিন্নির এমন সুন্দর একটা পারিবারিক ছবি দেখতে খুব ভাল লাগে। সে চোখ ভরে দেখে। তার মন ভাল হয়ে যায়।

    বিকেলে ঘুম ভেঙ্গে তিন্নির মন খারাপ হয়ে যায় আবার। মুন্নি তাকে মিথ্যে বলছে, কথা লুকোচ্ছে। মুন্নির সরল স্বভাব। নিজের ভাল মন্দ বোঝার ক্ষমতা নেই। সারাজীবন তিন্নিকে আগলে রাখতে হয়। কখন কীভাবে নিজের ক্ষতি করে বসবে নিজেও জানে না। কারো সঙ্গে পরামর্শ করতে পারলে হত। কার সাথে করবে? ছোড়দি? মামী? ক’দিন কলেজ নেই। কালচারাল ফেস্ট চলছে। ছেলে মেয়েরা রাত জেগে হুল্লোড় করে। অমিতর সঙ্গে দেখা হয় না। অমিতর সঙ্গে একবার কথা বলতে পারলে ভাল হত। তিন্নির হঠাৎ অমিতর কথা মনে হল কেন কে জানে? ক’দিনের তো মাত্র আলাপ। তবু মনে হয় ছেলেটার ওপর নির্ভর করা যায়।

    ই গুহাটা ঝোপ ঝাড় লতা পাতা দিয়ে আড়াল করা। সহজে কারো নজরে আসার ভয় নেই। দুদিন হল এই গুহাটার মধ্যেই ইনা আর ওজস লুকিয়ে আছে। ফল মূল খেয়ে ক্ষুধা মেটাচ্ছে। আগুন জ্বালাবার উপায় নেই। ধোঁয়া দেখে দলের লোকেরা ওদের হদিস পেয়ে যাবে। তারা ওদের হন্যে হয়ে খুঁজছে। গুহার মুখের কাছে বসে ওজস নতুন একটা অস্ত্র বানাচ্ছে। পুরোন অস্ত্রটা আমূল বিঁধে গিয়েছিল ঋক্ষর বুকে।

    ইনার শরীরে সন্তান সম্ভাবনার ইঙ্গিত দেখা দিচ্ছিল। সাধারণত দলের কোন মেয়ে গর্ভবতী হলে তা খুশির বার্তা নিয়ে আসে। মেয়েটিকে ভারি কাজের থেকে বিশ্রাম দেওয়া হয়। সে শিকারে অংশ নেয় না। তার ভাগের খাদ্যর পরিমাণ বৃদ্ধি করা হয়। দলে নতুন সদস্য সর্বদাই স্বাগত। বেঁচে থাকা নিরন্তর সংঘর্ষ। যে দল যত বড়, সেই দলের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা তত বেশি। যূথবদ্ধ মানুষকে বন্য পশুরাও এড়িয়ে চলে। কিন্তু ইনা জঘন্য অপরাধ করেছে। গর্ভে যে সন্তানটিকে সে লালন করছে সেটি যূথপতির ঔরসজাত নয়।

    দলের লোকেরা ইনাকে ঘিরে ধরেছিল। দলের প্রতিটি সদস্যকেই যূথপতি মায়ার চোখে দেখেন। ইনা নামের মেয়েটিকেও তিনি স্নেহ করেন। কিন্তু তিনি দলের নিয়ম লঙ্ঘন করতে পারেন না। তাঁর প্রধান দায়িত্ব হল দলটিকে একত্র রাখা। তাদেরকে বাঞ্ছিত বাসস্থলে পৌঁছে দেওয়া। যেখানে তারা নিরঙ্কুশ বসতি পাতবে। আবহাওয়া নাতিশীতোষ্ণ হবে। নদীর জল সুমিষ্ট হবে। শিকার সহজলভ্য হবে। দিনের সিংহভাগ দৈনন্দিন খাদ্যের অন্বেষণে ব্যয়িত হবে না। রোগ ব্যাধির আক্রমণে মানুষ সদা জর্জরিত থাকবে না। তখন তারা গুহা গাত্রে ছবি আঁকবে। জ্যোৎস্নার রাতে আগুনের চারপাশ ঘিরে বসে গান গাইবে। তাঁর ইচ্ছা করছিল ইনাকে তিনি মাপ করে দেন। কিন্তু তিনি যদি তাঁর নিজের তৈরি করা নিয়ম অমান্য করেন তবে দল ভেঙ্গে যাবে। দল তাঁর সার্বভৌমত্বকে অস্বীকার করবে। যূথপতি নিজেকে অতিক্রম করতে পারেন না।

    যূথপতি একটি চ্যাটালো পাথরের ওপর একলা বসে ছিলেন। ইনার অপরাধের শাস্তি মৃত্যু। প্রতিটি গোষ্ঠীর কর্তব্য স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করা। দলের প্রতিটি সদস্য হবে গোষ্ঠীপিতার বীজের বাহক। এই অমোঘ নিয়মের কথা দলের প্রতিটি মানুষ জানে। এই ব্যবস্থার অন্যথা করা মানে যূথপতির প্রতি অনাস্থা জ্ঞাপন করা। দল এই অপমান সহ্য করবে না। যূথপতি গালে হাত রেখে অন্যদিকে তাকিয়ে বসে আছেন। দলের ছেলেরা ইনাকে চতুর্দিকে বৃত্তাকারে ঘিরে ধরেছে। প্রত্যেকের চোখে ক্রোধ, হাতে পাথর। মেয়েরা আতঙ্কিত। বাচ্ছারা চীৎকার করে কাঁধছে। হঠাত ভিড়ের থেকে লাফ দিয়ে বেরিয়ে এসে একটি তরুণ পুরুষ ইনাকে আড়াল করে দাঁড়াল। তার হাতে একটি লাঠি। তার আগায় পাথর বাঁধা।

    “ওজস সরে যা!” ঋক্ষ হাতের ভারি পাথরটা মাথার ওপর তুলে এগিয়ে আসছিল।

    “না।”

    ওজসের কাঁধের পেশী ফুলে উঠছে। সে বাঁ হাত ঋক্ষর দিকে তাগ করে ডান হাতে লাঠিটা কাঁধের পিছনে টেনে সজোরে ছুঁড়ে দিল। অস্ত্রটা সোজা এসে বিঁধে গেল ঋক্ষর বুকে। হাতের পাথর খসে পড়ল। ঋক্ষ বুকে হাত চেপে হাঁটু ভেঙ্গে মাটিতে বসে পড়ল। লাঠির পিছনের অংশটি ঋক্ষর বুকের ওপর জেগে থেকে থির থির করে কাঁপতে লাগল। দলের সবাই এতই অবাক হয়ে গেল যে পাথর ফেলে ঋক্ষর দিকে দৌড়ে গেল। সেই ফাঁকে ওজস ইনার হাত ধরে পালাল। পাথর ডিঙিয়ে পাহাড়ের গা বেয়ে ওজস ইনাকে টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছিল। ইনার পা চলছিল না।

    “আর একটু চল, ইনা। এসে পড়েছি প্রায়।”

    ইনার মনে হল, ঘটনাগুলো ওজস আগে থেকেই ছকে রেখেছিল। এই গুহাটাও ওজসের আবিষ্কার। গুহার মুখ থেকে দশ হাত দূরে দাঁড়িয়েও কেউ বুঝতে পারবে না এখানে একটা এত বড় গহ্বর আছে। লতা পাতার আড়াল সরিয়ে গুহায় ঢুকে ইনা শুয়ে পড়ল। তার শরীর আর দিচ্ছে না। শরীরের মধ্যে আর একটি শরীর বহন করে সে হা-ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। ওজস তাকে জল এনে দিল। পাথরের বাসন ভরে ওজস জল সংগ্রহ করে রেখেছে। ফল মূল এনে রেখে দিয়েছে। ক’দিন গুহার বাইরে না বেরোলেও বেশ চলে যাবে। ওজস সামনে বসে তার জল খাওয়া দেখছিল। ইনা জলের বাটি সরিয়ে রেখে তার বুকের কাছ ঘেঁসে এল। তারপর তাকে দু হাতে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কেঁদে ফেলল।

    অবধারিত মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসা মেয়েটির মাথায় ওজস হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল। তাকে শান্ত করার চেষ্টা করছিল। ইনার কান্না আর থামে না। ইনা মৃত্যুকে মেনে নিয়েছিল। ইনা জানত সে অপরাধ করেছে। কয়েক মাস আগের এক জ্যোৎস্না-স্নাত রাতে। যূথপতির শয়ন-সঙ্গিনী হবার আগেই সে ওজসের সঙ্গে মিলিত হয়েছে। সে বাধা দেয় নি। বাধা দিতে পারে নি। ঘাসের বিছানায় মাথার ওপর চাঁদ আর পায়ের নীচে নদী নিয়ে তারা দুজনে পাশাপাশি শুয়ে ছিল। সেদিনও ইনা কাঁদছিল। অনিশ্চিত ভবিষ্যতের আশঙ্কায়। চোখের জলে দৃষ্টি ঝাপসা থাকায় দেখতে পায় নি তার কান্না শুনে ওজসের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠছে।

    “এই গুহাটার খোঁজ কোথা থেকে পেলি, ওজস?”

    “একটা শূয়র মেরেছিলাম। ব্যাটা জখম হয়ে পালিয়ে এই গুহায় ঢুকে বসে ছিল। রক্তের দাগ ধরে আমিও পৌঁছে গেলাম।”

    “তোর ভয় হল না? জখম জন্তু মারাত্মক হয়।”

    “আমি কাউকে ভয় পাই না। যূথপতিকেও নয়। আমি তোকে নিয়ে এখান থেকে চলে যাব। কেউ আমাদের কিছু করতে পারবে না।”

    ইনা মাথা নীচু করে বসে থাকে। তার ওজসের কথা বিশ্বাস করতে ভয় হয়।

    ওজস ইনার হাত ধরে গুহার ভিতর দিকে টেনে নিয়ে যায়। গুহার গায়ে একটা যায়গা মসৃণ করে তার ওপর ওজস নক্সা বানিয়েছে। তরঙ্গায়িত কিছু লাইন। দেখে মনে হয় জল, অকূল পাথার। তার ওপর ভাসছে একটি চৌকোণা পাটাতন। ওজস বলে, “শক্ত লতার সন্ধান পেয়েছি। যা দিয়ে অনেকগুলো গাছের গুঁড়ি একসাথে বাঁধা যাবে। লতাটাকে রোদে শুকিয়ে নিতে হবে, এই যা।”

    ইনার হাত ধরে দেওয়ালের গায়ে নিজের আঁকা ছবিটার দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে। স্বপ্ন দেখে ইনাকে নিয়ে ভেসে পড়ার। জল যেখানে শেষ হবে সেখানে আছে প্রার্থিত ভূমি। সেখানে দুজনে বাসা বাঁধবে। তারপর কত কী যে করার আছে! সমগ্র বিশ্ব পড়ে আছে আবিষ্কৃত হবার জন্য। জল, স্থল আকাশ - পরিক্রমার শেষ নেই।

    ফল মূল শেষ হয়ে আসে। জল ফুরিয়ে আসে। ওরা জানে দল কীভাবে শিকার করে। শিকারের চারদিকে ধীরে ধীরে কিন্তু নিশ্চিতভাবে বৃত্ত গুটিয়ে আনে। ওজস বলে, “ইনা আমাদের বেরোতে হবে।”

    ইনা ঘাড় নাড়ে।

    “পারবি তো?”

    পারতে হবেই। রাতের অন্ধকারে ওরা রওনা দেয়। আকাশে আপাতত চাঁদ নেই। অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে যতটা দূরে যাওয়া যায় চলে যেতে হবে। পাহাড়ের গা ঘেঁষে ওরা এগোয়। শরীর ভারি হয়ে ইনা শ্লথ হয়ে পড়েছে। দরকারে ওজস ওর হাত ধরে নিয়ে যাচ্ছে। কিছু দূর গিয়ে ওরা দাঁড়ায়। দম নেয়। আবার চলে। দলটি যে গুহায় বাসা বেঁধেছে ওরা তার উল্টো দিকে যাচ্ছে। নদীর দিকে নেমে যাচ্ছে। একবার কোনভাবে নদী পার হতে পারলে আর ভয় নেই। এই নদী যেমন গভীর তেমনি চওড়া। দল নদী পার হবার ঝুঁকি নেবে না। কিন্তু তারাই বা নদী পার হবে কী করে?

    নদীর চরে নেমে আসতে আসতে চাঁদ উঠলো। আলোর বন্যায় আকাশ ভেসে গেল। ওজস ইনাকে একটি বিশেষ লক্ষ্যে নিয়ে যাচ্ছে। এই পালানোটাও মনে হয় ওজস ছকে রেখেছিল। নদীর চর শেষ হয়ে যেখানে পা ডোবানো জল শুরু হয়েছে সেখানে মাথা সমান ঝোপ জঙ্গল। গাছ গুলি যেন জলজ। অথচ জলে ভেসে নেই। তাদের শিকড় বাকড় জল থেকে মুখ বার করে শ্বাস নিচ্ছে। দেখেশুনে পা ফেলতে হয়। ওজস থামল। মোটা একটা গাছের গুঁড়ি একটা গাছের ডালের সঙ্গে শক্ত লতা দিয়ে বাঁধা রয়েছে। নদীতে ভেসে যাওয়া গাছের গুঁড়িটা ওজস সাঁতার দিয়ে ঠেলে পাড়ে তুলে এনে রেখেছিল। ওজস গুঁড়িটা নদীর দিকে ঠেলতে শুরু করল। গুঁড়িটা ভারি। ওজস একা পেরে উঠছে না। কাছেই কোথাও শিঙার শব্দ হল। দলের কেউ কাউকে ডাকছে।

    গুঁড়িটা একটা পাথরে আটকে গেছে। ওজস হাতের অস্ত্রটা গুঁড়ির নীচে রেখে চাড় দিয়ে তুলছে। তার কপাল থেকে ঘাম ঝরছে। ইনা হাত লাগাল। তারি বা কতটুকু সামর্থ্য! দুজনে হ্যাঁচড়াতে হ্যাঁচড়াতে গুঁড়িটা টেনে নিয়ে যাচ্ছে। আর একটু এগোলেই ডুবো জল। গুঁড়িটাকে নদীর জলে ভাসিয়ে দিতে পারলেই সেটা ধরে দুজনে নদী পার হয়ে যাবে।

    ঠিক তখনি দুজনের ওপর ঘন হয়ে ছায়া পড়ল। ওজস মুখ তুলে দেখল চাঁদ আড়াল করে দাঁড়িয়ে আছে যূথপতির বিশাল দেহ। যূথপতি জানতেন পালাবার একটাই রাস্তা। নদী পার হতে পারলে দুই দলভ্রষ্টকে ধরার উপায় থাকবে না। সাঁতার দিয়ে এই বিশাল নদী পারাপার করা অসম্ভব। নদীর ধার ধরে এগোতে এগোতে ওজসের পালাবার শেষ চালটা তিনি আন্দাজ করে ফেললেন। দলের দুজন পালা করে দিন রাতের জন্য মোতায়েন রইল। তাদের আদেশ দিলেন ওজস ইনাকে দেখলেই যেন তারা শিঙ্গা বাজিয়ে অন্যদের ডাকে। তিনি চান না ওজসের অস্ত্রর আঘাতে আর কারো মৃত্যু হোক।

    ওজস দেহের সমস্ত শক্তি সঞ্চয় করে গুঁড়িটাকে একটা শেষ ঠেলা দিল। ইনা হাল ছেড়ে গুঁড়িটার ওপরই নেতিয়ে পড়েছিল। গুঁড়িটা ইনাকে নিয়েই খরস্রোতা নদীর মধ্যে ঝাঁপ দিল। ঠিক সেই মুহূর্তে পাথরের আঘাতে ওজসের হাত থেকে অস্ত্রটা ছিটকে পড়ল। ওজস আর দাঁড়াল না। সে দৌড়ল। জলের মধ্যে থেকে উঁচু হয়ে থাকা শিকড়ের মধ্যে দিয়ে পা বাঁচিয়ে, চরের বালি ভেঙ্গে, জঙ্গলের দিকে। পিছনে দলের লোকেরা বন্য কুকুরের মত তাড়া করছে। কিন্তু একবার জঙ্গলের অন্ধকারে পৌঁছে যেতে পারলে তাকে আর কেউ খুঁজে পাবে না।

    ইনা সাময়িকভাবে সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েছিল। কিন্তু জলে পড়ার সময় গুঁড়িটার গা থেকে বেরিয়ে থাকা যে শাখাটা ধরে ছিল, সেটা ছাড়ে নি। সহস্র শতাব্দীর অভ্যাস হাত মুঠি করে ডাল ধরে রাখা। ঘুমের মধ্যেও তা ছাড়ে না। ইনা গুঁড়িটার সঙ্গে ভেসে রইল। নদীতে ভাঁটার টান। নদীর সীমায়িত স্রোত গিয়ে মিশছে অনন্ত জলরাশিতে। ইনা ভবিতব্যের টানে সেই দিকে চলল। নদী যেখানে কলকল্লোলে অপার জলরাশির সঙ্গে গিয়ে মিশেছে তার অন্যদিকে জল তুলনামূলক ভাবে ভারি। সেখানে পৌঁছে ইনা গুঁড়িটার ওপর চড়ে বসল। এবার তাকে টেনে নিয়ে চলল মহা সমুদ্রের অন্তঃসলিলা স্রোত। রাত কাটে, দিন আসে। মাথার ওপর জ্বলন্ত সূর্য। তৃষ্ণায় বুক শুকিয়ে মরু ভূমি। নীচের জল লবণাক্ত, মুখে দেওয়া যায় না। দিন পেরিয়ে রাত আসে। আকাশ ভরা গ্রহ তারা জলে মুখ দেখে। কত দিন কত রাত পেরিয়ে ইনা অবসন্ন দু চোখ মেলে দেখল চক্রবালে সবুজ রেখা। ভাসতে ভাসতে এসে ঠেকল শক্ত মাটিতে। সেই মাটিতে তার আগে কখনো কোন মানুষের পদচ্ছাপ পড়েনি।

    (পরের পাতা)



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণ: রাহুল মজুমদার
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments