মুহূর্ত সময়ে যতীন্দ্রনাথ কন্ডোমের প্যাকেটটা খুঁজে পেলেন না। বাদামী চামড়ার হাত ব্যাগটার চেনের মধ্যে রাখা থাকে। এখন নেই। বিদেশী জিনিষ, ওপরে সোনালী চুলের যুবতীর মদালসা ছবি। এসপ্ল্যানেডের ফুটপাথ থেকে দরদাম করে কিনেছিলেন। কোথায় পড়ল কে জানে? বিছানায় শুয়ে থাকা কালোকুলো নাঙ্গা মেয়েটা খিক খিক করে হেসে মাথার বালিশের নীচে থেকে একটা সস্তার রাংতার প্যাকেট বার করে দিল। সেটা হাতে নিয়ে যতীন্দ্রনাথের মেজাজ খিঁচড়ে গেল। তিনি পারতপক্ষে অসাবধানী নন। নিজের জন্য তো বটেই। তাছাড়া শেফালীর কোনো রোগভোগ হোক তিনি একেবারেই চান না। খারাপ রোগের জন্য এই বয়সে ডাক্তার বদ্যি করতে হলে লজ্জার একশেষ হবে। অবশ্য ইদানীং শেফালীর সঙ্গে দৈহিক সংসর্গ কমে এসেছে। যতীন্দ্রনাথের মনে হয় যে শরীর সন্তান উৎপাদন করতে পারে না সেই শরীরের আকর্ষণ ফুরিয়ে যায়। শেফালীর উৎসাহেও ভাঁটা পড়েছে।
মাসে চার পাঁচ দিন তাঁর বাড়ি ফিরতে দেরি হয়ে যায়। বড়বাজারে মালের বায়না করে ফেরার সময় শেওড়াফুলিতে নেমে পড়েন। বেশ্যাপল্লী স্টেশন থেকে খুব দূরে নয়। রেল লাইনের পাশ দিয়ে পায়ে হাঁটা পথ। তাও কাজ মিটিয়ে বাড়ি ফিরতে রাত হয়ে যায়। শেফালী না খেয়ে বসে থাকে, মুন্নিও। যতীন্দ্রনাথ বহুবার বলেছেন খেয়ে নিতে। শেফালী কথা শোনে না। প্রথম প্রথম তাঁর প্রবল অপরাধ বোধ হত। ইদানীং বলা ছেড়ে দিয়েছেন। হাজার হোক তিনিই খাদ্যের যোগানদার। পরিবারের সবার গ্রাসাচ্ছদনের দায়িত্ব তাঁর। মাসে দু-চার দিন তাঁর রাস্তা চেয়ে বসে থাকলে এমন কিছু মহাভারত আশুদ্ধ হয়ে যায় না। বরং বাড়ি ফিরে শেফালী আর মুন্নির অভুক্ত মুখের দিকে তাকিয়ে যতীন্দ্রনাথের একটা সূক্ষ্ম অহমিকা বোধ আসে। এই সংসারটা সম্পূর্ণ তাঁর উপার্জিত অর্থর মুখাপেক্ষী। তিনি দাতা, অন্যরা গ্রহীতা। দাতার একটা প্রাপ্য সম্মান থাকে। সেটা না পেলেই বরং মনের মধ্যে অশান্তি তৈরি হয়।
আজ বাড়ি ফিরে দেখলেন ছোট মেয়ে জয়তী জোর করে মাকে নিজেদের সঙ্গে খেতে বসিয়েছে। ওরা ছোটকুকে নিয়ে ফিরে যাবে। শেফালী, মুন্নি, জয়তী, বিপ্র, ছোটকু সবাই গোল হয়ে ডাইনিং টেবিল ঘিরে বসেছে। খেতে খেতে জোর গল্প জমেছে। ছোটকু হাত পা নেড়ে রাইম বলছে। তাঁকে দেখে কয়েক মুহূর্তের জন্য সেটা বন্ধ হল। শেফালী জিজ্ঞেস করল, “তুমি কি এখন খেতে বসবে?”
যতীন্দ্রনাথ উত্তর করলেন না। সিঁড়ি ভেঙ্গে দোতলায় উঠে এসে খাটের পাশে চেয়ার টেনে বসলেন। তাঁর বিরক্ত লাগছে। অথচ আজ তাঁর মন ভালো থাকার কথা ছিল। সাধারণত মাসের এই কটা দিন তাঁর মেজাজ বেশ ফুরফুরে থাকে। নিজেকে বেশ ডন-বৈঠক টানা যুবক যুবক লাগে। ঘরের লাগোয়া স্নানঘরে ঢুকে গুন গুন করে সুর ভাঁজতে ভাঁজতে গায়ে জল ঢালেন। সারা দিনের ক্লেদ সাবানের ফেনায় ধুইয়ে নর্দমা দিয়ে ভাসিয়ে দেন। গামছা দিয়ে ঘষে ঘষে গা মুছে জল শুকোন। তারপর পরিষ্কার লুঙ্গি পরে খেতে নাবেন। আজ উঠতে ইচ্ছা করছে না। ছোটকু এসে টা টা বাই বাই করে গেল। তিনি থুম্বু হয়ে বসে রইলেন। মেয়ে জামাই নাতিকে নিয়ে চলে গেল। যতীন্দ্রনাথ নীচে নামলেন না। দুপুরবেলা রাস্তার পাশের স্টল থেকে মিক্সড চাওমিন খেয়েছিলেন। তার ঢেঁকুর উঠলো। গলায় টক জল এল। অম্বল হয়ে গেছে।
মুন্নি ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে আছে, “মামা, খাবে না?”
“নাহ!”
“মাথা ধরেছে? মাথা টিপে দেব?”
“নাহ, তুই যা। যাবার সময় আলোটা নিভিয়ে দিয়ে যাস।”
মেয়েটা বড় হয়ে গেছে। মুন্নি চলে যাবার সময় যতীন্দ্রনাথ তার দিকে তাকিয়ে রইলেন। বাপ মা মরা মেয়েটাকে বাড়িতে এনে রেখেছিলেন। তিনি আশ্রয় না দিলে কোথায় গিয়ে উঠত কে জানে? মুন্নির কথা মনে এলে যতীন্দ্রনাথের নিজেকে ঈশ্বর মনে হয়। তিনি ইচ্ছে করলে মুন্নি বাঁচবে, না হলে মরে যাবে। চোখের সামনে রোগাভোগা মেয়েটা ভরভর্তি হয়ে উঠছে। সামাজিক বিধি নিষেধের জল ঠেলে মাঝে মধ্যেই তাঁর মনে একটা অন্যরকম ইচ্ছে ভুস করে ভেসে ওঠে।
কাজ মিটিয়ে ওপরে আসতে শেফালীর সময় লাগল। ঘরে এসে শেফালী সুইচ টিপে আলো জ্বালালো। যতীন্দ্রনাথ চোখ কোঁচকালেন। অন্ধকারই ভালো লাগছিল।
“অন্ধকারে বসে আছো কেন? কী হয়েছে? খাওয়া দাওয়াও করলে না।”
“কিছু না। একটু অম্বল মতন হয়েছে।” বলে, যতীন্দ্রনাথ উঠলেন। বাইরের পোষাক ছেড়ে, চোখে মুখে জল দিয়ে এলেন। টেবিলের জাগের থেকে ঢেলে এক গ্লাস জল খেলেন। শেফালী ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে ক্রীম মাখছে। ক্রীমের গন্ধটা বুনো ফুলের গন্ধর মতন তীব্র। যতীন্দ্রনাথের সহ্য হয় না। দম আটকে আসে। ছোট থেকেই তাঁর বুনো ফুলের রেণুতে অ্যালার্জি হয়। অনেক ওষুধ পত্র খেয়েও সারে নি। শেফালীর চোখের নীচ, চিবুক থেকে উঠে আসা গন্ধটা তাঁর স্নায়ুর ওপর চাপ তৈরি করে। মনে হয় শেওড়াফুলির পুকুর পাড় ধরে হাঁটছেন। জলের ওপর ঝুঁকে পড়া ঝোপ ঝাড়ে অসংখ্য কমলা হলুদ বুনো ফুল ফুটে আছে। তিনি রুমালে নাক ঢেকে হাঁটছেন।
নাক কুঁচকে বিছানায় ওঠার সময় কণ্ডোমের হারিয়ে যাওয়া প্যাকেটটা হাতে করে এগিয়ে দেয় শেফালী, “এটা বোধহয় তোমার ব্যাগ থেকে পড়ে গিয়েছিল। সাবধানে রাখতে পারো না? রঙচঙা প্যাকেট দেখে ছোটকু কুড়িয়ে আমার হাতে দিল।”
যতীন্দ্রনাথ হতভম্ব হয়ে হাত বাড়িয়ে প্যাকেটটা নিলেন। শেফালী তাকিয়ে আছে। যেন জবাবদিহি চায়। ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখতে রাখতে আমতা আমতা করে অজুহাত দিলেন, “তোমার তো এখনও মাঝে মধ্যে... তাই কিনে রেখেছিলাম।”
শেফালী চুপ করে রইলো। বছর ঘুরতে চলল তার ও’সবের পাট চুকে গেছে। মানুষটা খবরও রাখে না। যতীন্দ্রনাথও বোধ হয় মনে মনে হিসেব করছিলেন। কতদিন শেফালীর শরীর ছোঁন নি। বিছানায় আসার পর আচমকা স্ত্রীকে কাছে টানলেন। কতকটা প্যাকেটটা ব্যাগে থাকার যৌক্তিকতা প্রমাণ করার জন্যে। শেফালী আড়ষ্ট হয়ে রইল। অনেক দিনের অনভ্যাস। তাছাড়া দুপুরবেলা ছোটকু প্যাকেটটা হাতে দেবার পর শেফালী একটা অবিবেচকের মত কাজ করে বসেছে। প্যাকেটটা আঁচলের নীচে লুকিয়ে ঘরে নিয়ে এসেছিল আলমারির মধ্যে আড়াল করে রেখে দেবে বলে। কী মনে করে ওপরে লেখা নম্বরের সঙ্গে মিলিয়ে দেখেছে যতগুলো স্ট্রিপ থাকার কথা ততগুলো নেই। অথচ সেগুলো কী কাজে খরচ হয়েছে জিজ্ঞেস করতে পারল না শেফালী। ভয় পেল পাছে যতীন্দ্রনাথ জেনে যান সে গুণে দেখেছে। জেনে যান সে যতীন্দ্রনাথের কথা বিশ্বাস করে না। শুধু বাধা দিয়ে বলল, “কী করছ? দরজা খোলা আছে।”
দরজাটা আজকাল রাত্তিরে বন্ধ করার দরকার পড়ে না বিশেষ। খোলাই থাকে। রান্নাঘরের কাজ সেরে ওপরে আসতে আসতে যতীন্দ্রনাথের অর্ধেক রাত্তির। কখনও কখনও শেফালী ঘরে ঢুকে আলগা করে দরজাটা ভেজিয়ে দেয়। জানলার বাইরে টুপ টাপ করে গেরস্ত ঘরের আলো নিভে যায়। মফস্বল শহরের অন্ধকার গাঢ় হয়। সে দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে শেফালীর হঠাৎ ভয় হয়। পাশে নিঃসাড়ে ঘুমন্ত মানুষটার নাকের নীচে আঙ্গুল নিয়ে দেখে শ্বাস-প্রশ্বাস পড়ছে কিনা।
বিছানা থেকে উঠে দরজা বন্ধ করার সময় যতীন্দ্রনাথ দেখলেন নীচে খাবার ঘরের আলোটা জ্বলছে। হয় তো শেফালী ভুলে গেছে নিবিয়ে আসতে। থাক গে! নিজেকে নির্দোষ প্রতিপন্ন করার ব্যস্ততায় দরজায় ছিটকিনি তুলে যতীন্দ্রনাথ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিছানায় ফিরে এলেন। তারপর দুটি অনিচ্ছুক শরীর পরস্পরকে তৃপ্তি দেবার আপ্রাণ চেষ্টায় রত হল।
*
রাত্রে মুন্নি ঘুমিয়ে পড়লে তিন্নি উঠে খাবার ঘরে এল। সারা বাড়ি নিস্তব্ধ। স্যুইচ টিপে আলো জ্বালার শব্দটাও বড় হয়ে বাজল। সাইকোলজি নোটবুকের পিছনের পাতা থেকে দশটা নম্বর গুণে গুণে ডায়াল করতে না করতেই অন্য দিকে একটা ঘুম জড়ানো গলা হ্যালো বলে উঠলো। বেচারা সকাল ছটা দশের ট্রেন ধরে।
কোথাও কি কোন শব্দ হল? দরজা বন্ধ করার? বা হয় তো বেড়াল লাফালো। তিন্নি চারপাশ একবার দেখে ফিস ফিস করে বলল, “আমি তিন্নি।”
নামটায় ম্যাজিকের মত কাজ হল। গলাটা যেন ঘুম ঝেড়ে সোজা হয়ে বসল।
“কী ব্যাপার, এত রাতে, শরীর ঠিক আছে তো?”
“কাল একবার দেখা করতে পারবে? খুব জরুরী।”
কথা টথা বলে ফোনটা রেখে দেবার পর একটা অদ্ভুত স্বস্তি বোধ করল তিন্নি। ঘরে ফিরে ঘুমন্ত মুন্নির পিঠে হাত রেখে শুয়ে পড়ল। আজ আর রাত জেগে পড়াশুনো করার ইচ্ছে করছে না।
“মুন্নি, তুমি তিন্নিকে সঙ্গে নিয়ে এলে না কেন? আমি তো তোমাদের দুজনকেই আসতে বলেছিলাম। তোমার ছোড়দি তোমায় বলে নি।”
“তিন্নি এল না। ও আমার সঙ্গে কোথাও আসতে চায় না।”
ছোড়দি মুন্নিকে সঙ্গে করে হাসপাতালে এসেছিল। তারপর ডঃ বিদিশা রায়ের চেম্বারের সামনে বসিয়ে রেখে চলে গিয়েছিল। চেয়ারে বসে বসেই মুন্নি দরজায় লাগানো সাইন বোর্ডটা দেখেছে – ডঃ বিদিশা রায়, পি জি ডি ক্লিনিক্যাল সাইকিয়াট্রি। আরো দু চার জন পেশেন্ট তখনও বসে ছিল। তারা এক এক করে ঢুকল বেরোল। মুন্নি বসে আছে তো আছেই। ছোড়দি আর আসে না। শেষ পেশেন্টটা চলে যাবার মিনিট দশেক পরে ছোড়দি এল। তারপর মুন্নিকে সঙ্গে নিয়ে চেম্বারে ঢুকল। চেম্বারের মধ্যে ঢিমে আলো। ডঃ বিদিশা রায় উঠে এসে মুন্নির হাত ধরে বসালেন। যেন অনেকদিনের চেনা।
“মুন্নি তুমি আমায় বিদিশাদি বলতে পারো। বসো এখানে। ভাল করে ভেবে বল তো তিন্নি কবে থেকে তোমার সঙ্গে রয়েছে?”
“ও মা, কবে থেকে আবার? ছোটবেলা থেকেই...।”
ছোড়দি ধমক দিল, “মুন্নি, আবার বাজে কথা বলছিস?”
ডঃ বিদিশা রায় হাত তুলে ছোড়দিকে থামালেন। বললেন, “জয়তী, তুই একটু ঘুরে আয়। মুন্নির সঙ্গে কথা বলতে আমার একটু সময় লাগবে।”
ছোড়দি কিছু বলতে গিয়েও বলল না। চলে গেল। ডঃ বিদিশা রায় উঠে এসে একটা চেয়ার টেনে মুন্নির সামনে বসলেন। দুজনের মাঝখানে এখন আর টেবিলের বাধা নেই। মুন্নি বিদিশাদির কোলের ওপর রাখা সরু সরু ফর্সা আঙ্গুল দেখতে পাচ্ছে। বিদিশাদির হাতে কোন গয়না নেই। বাঁ হাতে সরু ব্যাণ্ডের হাতঘড়ি। দৃষ্টি ওপরে তুলতেই মোটা ফ্রেমের চশমার মধ্যে ঝকঝকে দুটো চোখ। মুন্নির ভিতর পর্যন্ত দেখে নিচ্ছে।
“জানি না বিদিশাদি, সবাই কেন এমন বলে। যবে থেকে জ্ঞান হয়েছে, তবে থেকেই তিন্নি আমায় সামলায়। আমি বোকাসোকা ভিতু টাইপের। তিন্নি কিন্তু খুব স্মার্ট। ছোটবেলায় বাবা মা যখন খুব ঝগড়া করত, আমি খুব কাঁদতাম। আমাদের ঘরটা বাবা মায়ের ঘরের থেকে আলাদা ছিল। রাত্রে যখন শুতে যেতাম বিছানাটা ঠাণ্ডা স্যাঁতসেঁতে হয়ে থাকত। তিন্নি বিছানার ওপর আমার পাশে বসে শক্ত করে আমার হাত ধরে থাকত। আমায় কোন প্রবোধ দিত না। পাথরের মত মুখ করে দেওয়ালের দিকে চেয়ে থাকত।”
“তোমার বাবা মা নেই?”
“না। সেই জন্যেই তো আমরা মামা বাড়িতে থাকি। মা রাগ করে বাড়ি ছেড়ে চলে গেল। তখন আমি আর তিন্নি সাত বছরের। বাবা তারপর থেকে খুব মদ খেত। আমরা বারণ করলেও শুনত না। হঠাত একদিন বাবা মরে গেল। অফিস থেকে ফিরে মদ খেতে খেতে বুকে হাত দিয়ে শুয়ে পড়ল। আর উঠল না।”
“মা, কখনো খোঁজ নেয়নি?”
“না গো। জানিও না, বেঁচে আছে না মরে গেছে। জানো বিদিশাদি, বাবা কিন্তু তিন্নিকে খুব ভালবাসত। আমাকেও বাসত। তবে তিন্নিকে একটু বেশি।”
“মুন্নি, তোমায় আমি একটা মোবাইল ফোন দেব। তাতে একটা ক্যামেরা লাগানো আছে। তুমি তিন্নির ছবি তুলে আমায় পাঠাবে? আমার তিন্নিকে খুব দেখতে ইচ্ছা করছে।”
মুন্নি লজ্জা পেল। বলল, “আমি যে ওটা চালাতে পারি না, বিদিশা দি।”
“তাতে কী আছে? আমি তোমায় শিখিয়ে দেব।”
বলতে বলতে ডঃ বিদিশা রায় টেবিলের ওপর পড়ে থাকা একটা মোবাইল ফোন নিয়ে এলেন। চেয়ারটা মুন্নির চেয়ারের কাছে টেনে এনে বুঝিয়ে দিতে লাগলেন, কেমন করে মোবাইলের ক্যামেরায় ছবি তুলতে হয়। সেটা পাঠাতে হয়। মুন্নি আগ্রহ ভরে দেখল। এমন কিছু শক্ত কাজ নয়, সে পারবে।
“তোমার এত ভয় করে কেন, মুন্নি? কেউ কি তোমায় ভয় দেখায়?”
মুন্নি মুখ নামিয়ে নিল। কী বলবে? দিন মাস বছর তো ভয়েই কেটে যায়। ভয়ের কাছে মুন্নি আত্মসমর্পণ করে দিয়েছে। তিন্নি বলে, মুন্নি ভয় পেতে ভালবাসে। ভয় ছাড়া মুন্নি বাঁচতে পারবে না। ছাগলের মত ম্যা ম্যা করে ডাকবে, কিন্তু খোঁটা উপড়ে পালাবে না।
“না, না বিদিশাদি। সবাই আমায় খুব ভালবাসে। দেখো না ছোড়দি নিজে থেকে নিয়ে এল তোমার কাছে। আমার নাকি অসুখ করেছে। ভুলভাল কথা বলি।”
“মামা, মামী?”
“মামীমাও। নিজের নতুন নতুন জামাকাপড় আমায় পরতে দেয়। মামা আমাদের বাড়িতে এনে না রাখলে আমরা হয় তো না খেতে পেয়ে মরে যেতাম।”
বলতে বলতে মুন্নি হাসপাতালের লোহার চৌখুপী গ্রীল লাগানো জানলা দিয়ে বাইরে তাকায়। দুপুর বেলার চড়া রোদে আকাশটা সাদা হয়ে আছে। দুটো একটা চিল, চাতক আকাশে ঘুরপাক খাচ্ছে।
“আমার দিকে তাকিয়ে কথা বল, মুন্নি।”
মুন্নি মুখ ফেরায়। তার চোখে ভয়।
“সত্যি বলছি, বিদিশাদি। সবাই খুব ভাল।”
“জামাইবাবু?”
জামাইবাবুর কথা মনে হলে মুন্নির মন ভাল হয়ে যায়, হেসে বলে “জামাইবাবুর মত হাসি খুশি সাদা মনের মানুষ কম আছে। ছোড়দির বিয়ের রাতে জামাইবাবু একাই বাসর মাতিয়ে রেখেছিল।”
মুন্নির চোখ থেকে ভয় সরে গিয়ে খুশি খেলা করে। ডঃ বিদিশা রায়ের নজর এড়ায় না। মুন্নি দেখে দরজা ঠেলে ছোড়দি ঘরে ঢুকছে। গলার স্টেথোটা টেবিলে নামিয়ে ছোড়দি একটা চেয়ার টেনে বসে। বিদিশাদিকে জিজ্ঞেস করে,
“কিছু বুঝলি?”
“হুম।”
“হুম কী? ঝেড়ে কাশ।”
“মনে হচ্ছে, তিন্নি একটা ডিফেন্স মেকানিসম। একটা আশ্রয়।”
“সেটার দরকার পড়ল কেন?”
“গুড কোশ্চেন! আমিও উত্তরটা খুঁজছি। ট্রাবল্ড পাস্ট... মে বি... যা বুঝলাম স্প্লিটটা ছোটোর থেকেই শুরু... কিন্তু বড় হবার সাথে সাথে সেটা কমে যাবার কথা। বিশেষ করে তোদের বাড়িতে আসার পর। স্পষ্টতই সেটা হয় নি। স্টিল শী হ্যাজ দ্যাট সেন্স অফ ইন্সিকিওরিটি। ঠিক আছে আজ এই পর্যন্ত।”
বিদিশাদি মুন্নির দিকে তাকিয়ে হাসলেন, “মুন্নি তিন্নির ছবি তুলে পাঠাতে ভুলো না যেন।”
ছোড়দি মুন্নিকে নিয়ে বেরিয়ে একটা রিক্সায় তুলে দিল।
“একা একা যেতে পারবি তো? ভয় করবে না?”
মুন্নি বলল, “না না, এইটুকু তো মোটে রাস্তা।”
মোড় ঘুরে কিছু দূর এগোতেই মুন্নি রিক্সাওলাকে বলল, “বাঁ দিকের রাস্তাটা নাও।”
“দিদি, পাল পাড়া যাবেন বলে উঠলেন যে...।”
“যা বলছি করো।”
রিক্সাওলা বাঁ হাতটা শূন্যে তুলে বাঁ দিকে মোড় ঘুরল। রাস্তাটা জি টি রোড টপকে, পুরোন পোস্ট অফিস পার হয়ে সোজা লঞ্চ ঘাটে পৌঁছেছে।
*
মুন্নিকে রিক্সায় তুলে দিয়ে আসতে আসতে জয়তী ভাবছিল মুন্নির মধ্যে ভয়টা ও নিজেও লক্ষ করেছে। কে জানে মুন্নি কাকে ভয় পায়। কীসে ভয় পায়। জয়তী কোয়ার্টারে ফিরে দেখল বিপ্র মাইক্রো ওয়েভে খাবার গরম করছে। দুজনে লাঞ্চ করতে বসল। বিপ্র জিজ্ঞেস করল, “বিদিশা কী বলল?”
জয়তী চিন্তিত মুখে বলল, “ঠিক বুঝছে না। মুন্নি হ্যাজ আ ডিপ সীটেড ফিয়ার ইন হার মাইন্ড। তিন্নি ওকে বল ভরসা দেয়। সাহস যোগায়। কিন্তু আসল ব্যাপারটা বুঝছি না। মুন্নির ভয়টা কীসের?”
“তুমি ভাল বলতে পারবে। ওকে ছোট থেকে দেখছ।”
“হ্যাঁ, যখন প্রথম এসেছিল, ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে থাকত। ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হল। তারপর তো আমি কলেজে চলে গেলাম। পাশ করতে না করতেই বিয়ে। তোমার আর তর সইল না। বাড়ি ছেড়ে চলে এলাম।”
বিপ্র জয়তীর দিকে তাকিয়ে হাসছিল। বিপ্রর হাসিটা জয়তীকে দুর্বল করে দেয়। লাঞ্চের পর তড়িঘড়ি হাসপাতালে ফিরে যেতে হবে। আপাতত জয়তী হাসি টাসি খুব একটা প্রশ্রয় দিল না। নিজেকেও। কিন্তু বিদিশার সঙ্গে মুন্নিকে নিয়ে কথা বলার পর যে মনের ওপর যে ভার চেপে ছিল সেটা হঠাৎ করে কেটে গেল।
তিন্নি রিক্সার ভাড়া চুকিয়ে কলেজের সামনে নেমে দেখল অমিত আগে থেকেই দাঁড়িয়ে আছে। ওদের এই মফস্বল শহরটা গঙ্গার কিনারে। ওদের কলেজটাও। দুপুর বেলা কলেজে ছেলে মেয়েদের ভিড়। মেন গেটের দুধারে জমায়েত, ইতস্তত সাইকেল ছড়িয়ে ছিটিয়ে। সিঁড়িতে একদল আড্ডাবাজদের পাশ কাটিয়ে অমিত তিন্নিকে নিয়ে ক্যান্টিনের দিকে এগোল। কাউন্টারের ছেলেটাকে দুটো চা দিতে বলে কোণের দিকে একটা টেবিলে গিয়ে বসল। পাশের খোলা জানলা দিয়ে টেবিলের ওপর এক ফালি রোদ এসে পড়েছে। গঙ্গার থেকে ঝোড়ো হাওয়া দিচ্ছে। তিন্নির চুল এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল। মুখোমুখি বসে অমিত তিন্নির দিকে ভুরু তুলল, “বলো।”
তিন্নি নখ খুঁটছিল। কী বলবে নিজেই জানে না। আচমকা এক জোড়া কড়া পড়া শক্ত হাত এসে তার নরম হাত দুটিকে মুঠো করে ধরল। তিন্নির মনে হল তার দ্বিধাগ্রস্ত ভীতু পায়রার মত হাত দুটি এতদিনে একটা নিশ্চিত আশ্রয় পেল।
“আমার ওপর ভরসা করতে পারো।”
তিন্নির ভেতর পর্যন্ত কেঁপে উঠলো। সে চমকে তাকাল। একজন অল্প পরিচিত মানুষ তার সামনে বসে আছে। কিন্তু চোখ দুটোর দিকে তাকালে তাকে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে। মনে হয় মানুষটাকে সব কথা বলা যায়। তিন্নি অমিতকে মুন্নির কথা বলল। মুন্নির ভয়, আশঙ্কা, গোপনতা...। মুন্নি একটা ভীষণ বিপদে পড়তে যাচ্ছে। বলতে বলতে তার গাল বেয়ে জল গড়িয়ে এল। অমিত স্তব্ধ হয়ে শুনছিল। ক্যান্টিনের ছেলেটা কখন দু কাপ চা রেখে গিয়েছিল। কথা বলতে বলতে জুড়িয়ে জল হয়ে গেছে। অমিত এক চুমুক দিয়ে সরিয়ে রাখল।
কথা শেষ হলে দুজনে কলেজ থেকে বেরিয়ে এল। গঙ্গার বাঁধানো ঘাটে গাছ পালা এড়িয়ে বিকেলের হলুদ রঙের আলো এসে পড়েছে। সিঁড়ি নেমে গেছে জল পর্যন্ত। সিঁড়ির দুধারে ধাপ কাটা আছে। তিন্নি বসল। অমিত দাঁড়িয়েই রইল। দু চারটে টুকি টাকি কথা। যা না বললেও চলত। একটা নৌকা পাড়ের কাছ ধরে ভেসে যাচ্ছিল। সেটার থেকে কেউ অমিতকে নাম ধরে ডাকল। অমিত হাত তুলে সাড়া দিল। তিন্নির মনে হল এই মুহূর্তে পৃথিবীর আহ্নিকগতি বন্ধ হয়ে গেলে কার কী ক্ষতি হত? অন্তত তার কোন অনুযোগ থাকত না। নদীর ওপর সন্ধ্যা খুব ধীরে নামে। জলের রঙ ধূসর হয়। আলো পড়ে এলে অমিত একটা রিক্সা ডেকে তিন্নিকে তুলে দিল। বলল, “নম্বরটা লেখা আছে তো? ফোন কোরো যখনই দরকার হবে। মাঝ রাত্তির হলেও।”
অমিতর ফোন নম্বরটা তিন্নি মুখস্ত করে নিয়েছে। লজ্জায় সে কথাটা বলতে পারল না।
*
বিদিশা ব্যাগ তুলে বেরিয়ে পড়ার উপক্রম করছিল। জয়তী কেবিনের দরজা ঠেলে ঢুকলো, “তোর ফেরার তাড়া আছে নাকি?”
বিদিশা ঘড়ি দেখল একবার, সাড়ে ছটা। বাইরে সন্ধ্যে নেমেছে। রাস্তার আলো জ্বলে গেছে। চাদরের ওম নেবার মত একটা গা ছম ছমে ঠাণ্ডা পড়েছে ক’দিন। ফেরার পথে অপ্টিশিয়ানের কাছ থেকে মায়ের চশমাটা নিয়ে যেতে হবে। যাক গে, পরের ট্রেনটা নিলেও এমন কিছু দেরি হয়ে যাবে না। দুটো ষ্টেশনের ব্যাপার। শেয়ার অটোতে স্টেশন থেকে বাড়ি পৌঁছোতে দশ মিনিট। আজকাল টোটোও হয়েছে। ব্যাগটা টেবিলের ওপর নামিয়ে রেখে বন্ধুর দিকে ভুরু তুলে তাকালো।
“দুপুর থেকেই মুন্নির ভয়টা নিয়ে ভাবছিলাম।”
বিদিশা হাসল, “ভয় ব্যাপারটা খুব কমপ্লেক্স, বুঝলি। বলতে পারিস আমাদের জিনের মধ্যে পুঁতে রাখা থাকে। এতই গভীরে যে খুঁড়ে তুলে আনা মুশকিল।”
“সে ভাবে দেখলে আমাদের পুরো জীবনটাই তো জিনের মধ্যে এনকোডেড।”
“ঠিক বলেছিস। অনেক কিছুই আমরা আমাদের জিনের মধ্যে বয়ে বেড়াই, বংশপরম্পরায়। এমন কী মনস্তত্বও। তাই বলছে আজকালকার মনস্তাত্বিকরা। পারস্পরিক নির্ভরতা, সামাজিক সম্পর্ক এবং তাদের ভেরিয়েশনগুলোও।”
“আমার একটাই জিজ্ঞাসা, মুন্নির মাথায় ভয়টা পুঁতলো কে?”
বিদিশা চেয়ারে বসল। চোখ থেকে চশমাটা খুলে টেবিলে রাখল। চোখ বন্ধ করে দুহাতের আঙ্গুল দিয়ে বন্ধ চোখের পাতা ডলল। সারাদিনের পর সামান্য ক্লান্তি আসছে। বলল, “দেখ, ভয়ের বীজ বপনের কাজটা হয়েছে লক্ষ লক্ষ বছর ধরে। যাকে ভাল বাংলায় বলি অভিযোজন, চারদিকের পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে গিয়ে মানুষের শুধু শারীরিক বিবর্তনই হয়নি মানসিক বিবর্তনও হয়েছে। ইংরিজির ইভল্যুশনারি সাইকোলজি শব্দটা বেশি চেনা। নেট ঘেঁটে দেখে নিতে পারিস।”
জয়তী মানতে চাইল না, “ভয় তো আমরা সবাই পাই। ভয় না থাকলে মানুষ বাঁচতে পারত না। দশ তলা বাড়ির ছাদ থেকে আখছার লাফ দিয়ে পড়ে মরে যেত।”
বিদিশা বন্ধুর কথা মেনে নিল, “ঠিক বলেছিস। আমরা অন্ধকারকে ভয় পাই, অচেনা যায়গায় যেতে ভয় পাই। এমন কত আছে। ভয় পাবার কোন যুক্তি থাকে না। আচমকা আমাদের চেপে ধরে। মুন্নির মাথার ভয়টাকে কেউ উস্কে দিচ্ছে, ইন্ডিউস করছে।”
জয়তী অস্থির ভাবে মাথা ঝাঁকায়, “কে?”
“মুন্নি আলমারির চাবিটা রাখ।”
মামী বিয়ে-বাড়ি যাবার জন্যে তৈরি। অনাথ দা রিক্সা ডাকতে গেছে।
“জলখাবারে রুটি বানাতে হবে না। পাঁউরুটি টোস্ট করে দিবি। দুদিনের তরকারি রেঁধে আমি ফ্রিজে রেখে গেছি। গরম করে দিবি। ইস্তিরিওলা এলে জামাকাপড় গুলো গুনে নিবি।”
ছোটকুকে ছোড়দিরা নিয়ে গেছে। ক’দিন ওদের ওখান থেকেই স্কুল করবে। লাস্ট কবে মামী এমনি করে ঘরবাড়ি ফেলে রেখে গেছে মুন্নির মনে পড়ে না।
“দরকার পড়লে ফোন করিস মুন্নি। মামাকে দেখিস।”
মামা দুপুর বেলা ভাত খেয়ে দোকানে বেরিয়ে গেছে। মামী কিট ব্যাগে জামা কাপড় গুছিয়ে রিক্সায় উঠলো। অনাথ দা সাইকেল নিয়ে দোকানে ফিরে গেল। বাড়িটা খাঁ খাঁ করছে। খালি বাড়িতে মুন্নি আর তিন্নি।
“আয় তিন্নি, তোর কতগুলো ছবি তুলি। বিদিশাদি পাঠাতে বলেছে।”
“তুলবি? তোল।”
তিন্নি বেণীটা বুকের ওপর টেনে এনে টেবিলে কনুই রেখে পোজ দিয়ে বসল। মুন্নি মোবাইলের ক্যামেরায় ছবি তুলছে। যে ছবিটা সব থেকে ভাল হবে সেটা বিদিশাদিকে পাঠাবে। একটার বেশি পাঠালেও আপত্তি নেই। বিদিশাদি বলে দিয়েছে।
বিদিশাদিকে তিন্নির ছবি পাঠিয়ে মুন্নি ঘুমোতে শুলো। তিন্নি উঠে গেল। মুন্নি শুনতে পাচ্ছে তিন্নি কাউকে ফোন করছে। হাসছে, তড়বড় করে কথা বলছে। আজকাল প্রায়ই তিন্নি কাউকে ফোন করে। জিজ্ঞেস করলে উত্তর দেয় না। মুন্নির কেমন একটা কষ্ট হল। গলার কাছে ব্যথা করে উঠল। তিন্নি তাকে ছেড়ে যাবে না তো?
মুন্নির ঘুম ভাঙল সন্ধ্যে পেরিয়ে। কলিং বেলের শব্দে। শুনতে পেল সদর দরজার বাইরে থেকে মামা ডাকছে, “মুন্নি, মুন্নি, দরজা খোল।” চোখ খুলে দেখল তিন্নিটা খাটের ধারে গ্যাঁট হয়ে বসে আছে। উঠে গিয়ে দরজা খুলে দেবে না। কোনো দিনই দেয় না। মুন্নি উঠলো। খাবার ঘরের, বারান্দার আলো জ্বালিয়ে দরজা খুলে দিল। মামার ফিরতে দেরি হয়। আজ তাড়াতাড়ি ফিরেছে।
“মামা, শরীর ঠিক আছে তো?”
মামা হাতের খবরে কাগজে মোড়া প্যাকেটটা টেবিলের ওপর নামিয়ে রেখে ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলল। মুন্নি জানে ওই প্যাকেটে কী আছে। ন’মাসে ছ’মাসে মামা মদের বোতল নিয়ে ঘরে ফেরে। ওসব খাওয়া মামীর একদম পছন্দ নয়। দেখলেই নাক সিঁটকোয়। আজ মামী নেই। মামা ছাড় পেয়েছে।
“মুন্নি একটু পেঁয়াজি ভাজ তো।”
মামা চটি খুলে রেখে বোতল বগলদাবা করে দোতলার শোবার ঘরে উঠে যায়। মুন্নি চোখে মুখে জল দিয়ে রান্নাঘরে ঢোকে।
একা হাতে পেঁয়াজ কেটে, বেসনের লেই বানিয়ে মুন্নি পিঁয়াজি ভেজে তোলে। কপাল দিয়ে ঘাম গড়ায়। গ্যাস অফ করে থালায় পেঁয়াজি আর কাঁচা লঙ্কা নিয়ে সিঁড়িতে ওঠার সময় তিন্নি পথ আটকায়।
“কোথায় যাচ্ছিস?”
“মামার জন্য খাবার নিয়ে যাচ্ছি।”
“তুই কোত্থাও যাবি না।”
“কেন?”
“কেন বুঝিস না, ন্যাকা।”
“পথ ছাড় তিন্নি, মামা বসে আছে।”
মামা সিঁড়ির মাথায় এসে দাঁড়িয়েছে। বাইরের জামা প্যান্ট ছেড়ে লুঙ্গি পরে নিয়েছে। গায়ে একটা আলগা বেনিয়ান।
“খালি বাড়িতে কার সঙ্গে কথা বলছিস মুন্নি?”
তিন্নি সরে দাঁড়িয়ে যায়গা করে দেয়। মুন্নি সিঁড়ি ভেঙ্গে তরতর করে উঠে আসে। শোবার ঘরে ঢুকে হাতের প্লেটটা টেবিলে নামিয়ে রেখে বলে।
“তিন্নির সঙ্গে, মামা।”
মামা মুন্নির পিছনে পিছনে ঘরে ঢোকে। মুন্নির কথা শুনে পানের দাগ ধরা দাঁত বার করে হাসে।
“তিন্নি কে রে মুন্নি? তুই আর আমি ছাড়া আজ আর বাড়িতে কেউ নেই।”
টেবিলে বোতলের পাশে একটা আধ খালি কাঁচের গ্লাস। মামা এর মধ্যেই শুরু করে দিয়েছে।
“তোমরা কেউ মানতে চাও না। আমি আজ তিন্নির ছবিও তুলেছি।”
“ছবি তুলেছিস?” মামা ঈষৎ চমকায়, “কীসে ছবি তুলেছিস?”
“বিদিশাদি আমায় মোবাইল দিয়েছিল। তার ক্যামেরায়।”
“তিন্নির ছবি আমায় দেখাবি না, মুন্নি?”
“তুমি দেখবে? দাঁড়াও, নিয়ে আসি।”
মুন্নি নীচে থেকে ক্যামেরা আনতে আসে। ভাঁড়ার ঘরে ঢুকে দেখে তিন্নি মোবাইলে কাউকে ফোন করছে।
“তুই আমার মোবাইল নিয়েছিস কেন?”
তিন্নি ঘুরে দাড়ায়। ওর চোখ জ্বলছে, “বেশ করেছি।”
“আমার ফোন দে। মামা চাইছে।”
“ওরে আমার মামা-সোহাগী! কথা বলা শেষ হলে ফোন পাবি। তার আগে নয়।”
মুন্নি দাঁড়িয়ে থাকে। তিন্নি কথা শেষ করে ফোনটা মুন্নিকে দেয়। মুন্নি সিঁড়ি দিয়ে ওঠার আগে পিছন ফিরে দেখে তিন্নি খাবার ঘর পেরিয়ে সদর দরজার দিকে যাচ্ছে।
“তিন্নি এই সন্ধ্যে বেলা কোথায় যাচ্ছিস?”
“কোথাও না।”
তিন্নি গিয়ে সদর দরজার ছিটকিনি খুলে দেয়। তারপর শান্ত হয়ে খাবার টেবিলে এসে বসে। যেন কেউ আসবে, তার প্রতীক্ষায়।
বাড়িতে কেউ নেই। তবু মামা দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে আসে। মুন্নি মামার পাশে বসে মোবাইলে ছবি দেখায়, “এই দেখ তিন্নি, টেবিলে হাত রেখে বসে... জানলার ধারে দাঁড়িয়ে...।”
মামা গ্লাসে চুমুক দিয়ে হো হো করে হাসে, “মুন্নি সত্যি তুই খুব বোকা। কোথায় তিন্নি?
মুন্নি দেখে “সত্যিই তো, খালি টেবিল, বই গাদা করে রাখা। জানলার বাইরে একটা বসন্ত-বাউরি পাখি। তিন্নি নেই। কেউ নেই।”
“কিন্তু তিন্নি তো ওখানেই ছিল।”
মামার হাসি থামে না। একহাতে মুন্নির কাঁধ বেড় দিয়ে বলে, “মুন্নি, তিন্নি তোর কল্পনা ছাড়া কিছু না। তিন্নি বলে কেউ নেই, কখনো ছিলও না।”
মুন্নি মামার হাত কাঁধ থেকে ফেলার জন্য গা মোচড়ায়, “না মামা, ছাড়। তিন্নি সত্যি আছে। আমি দেখে এসেছি খাবার টেবিলে বসে আছে। আমি ডাকলে এক্ষুণি উঠে আসবে। দেখবে ডাকব?”
“কেউ আসবে না মুন্নি। বাড়িতে শুধু তুই আর আমি।” মুন্নির কাঁধে মামার হাড় বার করা আঙ্গুলের খাঁচা চেপে বসে। মুন্নির কাতর খরগোসের মত খোলা কাঁধ বেরোবার জন্য হাঁচড় পাঁচড় কাটে। খাঁচা কাটতে পারে না।
“ছেড়ে দাও মামা, লাগছে। তোমার পায়ে পড়ি।” মুন্নির চোখে জল আসে। মামার হাত ছাড়িয়ে উঠে যেতে পারে না। ছটফট করে।
“কাছে আয় মুন্নি।” মামা টানে। মুন্নি ফিরে দেখে মামার চোখের মণির রঙ বদলে গেছে। শেয়ালের মত ক্রূর সবুজ হয়ে জ্বলছে। মুন্নি মামার নাগালের বাইরে যাবার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে। পারে না। চীৎকার করে ডাকে, “তিন্নি, তিন্-নি-ই।” কেউ সাড়া দেয় না। তিন্নি কি তাকে ছেড়ে চলে গেল। এই তো দেখে এল নীচে বসে আছে। মুন্নি অসহায় হয়ে দরজার দিকে তাকিয়ে থাকে।
হঠাৎ সিঁড়িতে পায়ের শব্দ ওঠে। কারা যেন দুপ দুপ করে উঠে আসছে। দরজাটা ধড়াস করে খুলে যায়। মুন্নির চোখে সাদা আলো ঝলসায়। শোবার ঘরের দরজায় কয়েকজন দাঁড়িয়ে। একজন চিৎকার করে বলে, “ছবি তোল। বুড়োর ঢ্যামনামি ঘোচাচ্ছি।”
স্যার দেবীপ্রসাদের ছেলেরা দরজা আগলে দাঁড়িয়ে। সামনে অমিত। আবার ফ্ল্যাশের আলো ঝলসায়। মুন্নির কাঁধের ওপর হাত আলগা হয়ে যায়। মামা চমকে মুখ ফিরিয়ে তাকায়। মুন্নি ছুটে গিয়ে অমিতর গা ঘেঁসে দাঁড়ায়। ফুঁপিয়ে কাঁদে।
“এত দেরি করলে কেন?”
“কেঁদো না তিন্নি। চুপ কর। জয়তীদিকে খবর দিতে গিয়ে একটু দেরি হল। জয়তীদিও আসছে। লোকটাকে নিয়ে যাবে।”
স্যার দেবীপ্রসাদের ছেলেরা মামাকে ঘিরে দাঁড়িয়েছে। গালাগালি করছে। একটা ছেলে মামার বেনিয়ানের বুকের কাছটা মুঠো করে ধরে, টেনে দাঁড় করিয়ে দেয়। অমিত বলল, “মারধোর করিস না। লোকটা সিক। ওর চিকিৎসার দরকার।”
মামা কোনও কটূক্তির প্রত্যুত্তর করছে না। তাদের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। অন্ধরা যেভাবে তাকিয়ে থাকে। চোখ খোলা অথচ কিছুই দেখছে না। অমিত তিন্নিকে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। তিন্নির হাঁটু কাঁপছে। চোখের জলে অমিতর বুকের জামা ভিজে যাচ্ছে। তিন্নিকে বুকের কাছে আঁকড়ে ধরে সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে অমিত বলল, “মাকে তোমার কথা বলেছি। মা বলেছে আজকের রাতটা তুমি আমাদের বাড়িতে মা’র কাছে থাকবে। কাল মামী ফিরে এলে দেখা যাবে। দু এক হপ্তার মধ্যে একটা পাকাপাকি বন্দোবস্ত করে তোমার নিয়ে যাব। এখন ব্যাগ গুছিয়ে নাও। বইপত্রগুলো সঙ্গে নিয়ে নিও।”
তিন্নি লক্ষ্মী মেয়ের মত ঘাড় নাড়ে।
অমিত একটু থেমে অল্প হেসে বলল, “ফাঁকা বাড়ি। মুন্নি রাতে ভয় পাবে। ওকেও বল, সাথে করে নিয়ে যাব।”
তিন্নি আর অমিত ভাঁড়ার ঘরের সামনে এসে দাঁড়াল। ঘরের দরজা বন্ধ। তিন্নি দরজায় কান লাগিয়ে শুনল। ভিতরে কি কেউ ফুঁপিয়ে কাঁদছে? তিন্নি দরজা ঠেলল, “মুন্নি, দরজা খোল।” কেউ দরজা খুলল না। তিন্নি নিরুপায় চোখে অমিতর দিকে তাকাল, “মুন্নি ভিতর থেকে দরজায় ছিটকিনি দিয়ে রেখেছে। আমি জানি ও এই বাড়ি ছেড়ে নড়বে না।”
অমিত বলল, “কোথায়, দেখি...।”
দরজার ওপর হাতের মৃদু চাপ দিতেই দু-হাট করে পাল্লা খুলে গেল।
এই গল্পের উপসংহার খুব ছোট। প্রশান্ত মহাসাগরের এক বিজন দ্বীপের সমুদ্র উপকূলে একটি মেয়ে তার শিশু পুত্রের হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে। আজ সকালে ঝকঝকে রোদ উঠেছে। অথচ হাওয়ায় শীতলতা। অশান্ত ঊর্মিমালার বুকে ভাসতে ভাসতে একটি ভেলা এসে ভিড়ল বেলাভূমিতে। হাতের দণ্ডটি ভেলার ওপর রেখে তার থেকে লাফ দিয়ে নামল এক শালপ্রাংশু যুবা পুরুষ। তার গালে বর্ষা শেষের ঘাসের মত নরম দাড়ি। দু-চোখে যুদ্ধ সেরে ঘরে ফেরা সৈনিকের উচ্ছ্বসিত তৃপ্তি। মেয়েটি শিশুটিকে নিয়ে তার বুকের কাছে গিয়ে দাঁড়াল, “জানতাম, তুমি আসবে।” মুখে হাসি, চোখে জল নিয়ে ছেলেকে চিনিয়ে দেয়, “দেখ, তোর বাবা।”